হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
153

#হৃদস্পর্শে_প্রেমসায়রে
#রক্তিমা(লেখনীতে)
#অন্তিম_পর্ব

দূঃখে নিমজ্জিত হৃদয় আর অসন্তোষ মন নিয়ে তন্দ্রা পাত্রপক্ষের সামনে উপস্থিত হয়েছে।পরনে হালকা গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ।ফর্সা গায়ে রঙটা মানিয়েছে বেশ।
যন্ত্রমানবীর ন্যায় পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে সে।

মেঝেতে তার দৃষ্টি আসার পর থেকে!একটিবার সামনে তাকিয়ে অবধি দেখছে না।অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়ী।তার পরনে সেই কলাপাতা রঙের শাড়ি।কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই মুখশ্রীতে তবুও কি এক নূর তার চেহারায় চমকাচ্ছে।ত্রয়ীর দুরন্ত চক্ষু খুঁজে চলেছে তার অতিপ্রিয় মুখকে।অন্যত্র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তন্দ্রার পানে তাকায় ত্রয়ী।ভ্রু কুঁচকে রাখা অসন্তোষ,শুকনো মুখখানা দেখে মায়া লাগে তার।তন্দ্রাকে পাত্রের মা তার সাথে বসিয়েছেন।কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো পাত্রের এখনো আগমন ঘটেনি।
তখনই সুপ্ত আসে বাইরে থেকে হাতে মিষ্টির প্যাকেট।তন্দ্রা আলগোছে একবার সেদিকে তাকায়।তখনই সকলের মুখে হইহই করে ফুটে উঠে,

-এইতো পাত্র হাজির!

তন্দ্রা তার কপাল পু্ড়ানো লোকটাকে একবার দেখার জন্য আঁখিপল্লব তুলে তাকাতেই অচেনা কোন ছেলের জায়গায় রিক্তকে দেখে।তন্দ্রার ব্যথিত মন ভেবেই বসে সে দূঃখে-কষ্টে ভুলভাল দেখছে।নয়তো পাত্রের জায়গায় রিক্তকে কেন দেখবে সে?পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি সে?
তার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে তার পাশে বসা মহিলার কন্ঠস্বরে অর্থাৎ পাত্রের মার কথায়।

-এত দেরি লাগে আসতে রিক্ত?সকলে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য!

সহসা তড়িৎ বেগে তন্দ্রার দৃষ্টি ঘুরে রিক্তের উপর পরে।গাঢ় সবুজ রঙের শার্ট গায়ে জড়ানো যুবকটি আসলেই রিক্ত?সে ভুল দেখেনি?

পরপর পলক ঝাপটায় তন্দ্রা।দূরে দাড়িয়ে তাকেই লক্ষ করছে ত্রয়ী।তার ওষ্ঠজুড়ে মিটিমিটি হাসি।এই সারপ্রাইজটা দিবে বলেই কেউ তন্দ্রাকে জানাইনি যে পাত্র স্বয়ং রিক্ত।
তন্দ্রার অবাক,অবিশ্বাস্য নজর দেখে তার দিকে একপলক তাকায় রিক্ত।পরক্ষণেই ভ্রু নাচিয়ে সুধায় কি হয়েছে?

এইদিকে তন্দ্রা যেন প্রতিক্রিয়া দেওয়ায় ভুলে গেছে।তার হৃদয় ভেতরে ভেতরে পুলকিত হয়ে গেছে।সে তৎক্ষনাৎ নিজের খুচি প্রকাশ করার জন্য ত্রয়ীর দিকে তাকায়।ভ্রু নাচিয়ে দেখায় ত্রয়ী।তন্দ্রা ওষ্ঠপটে আপনা আপনি ফুটে উঠে অকৃত্রিম হাসি!

রিক্তের মা-বাবা কে কখনো দেখেনি তন্দ্রা।তাই পাশের মহিলা যে রিক্তের মা তা ঠাউর করতেই পারেনি।এবার ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকায় সে।রিক্তের সাথে ওনার চেহারার বেশ মিল আছে।ভালোভাবে দেখলে তন্দ্রা ঠিকই বুঝতে পারতো যে এই মহিলা রিক্তের মা।কিন্তু অসন্তোষ কিশোরী যে নিম্নে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছিল!এই মিল খুঁজে পাবে কি করে?

আংটি পরানো শেষে সামান্যতম সুযোগ হতেই তন্দ্রা রিক্তের নিকটে এসে দাড়ায়।এখনো তার চোখে মুখে বিস্ময় লেপ্টে।রিক্ত সেই বিস্ময়মাখা মুখশ্রীতে দৃষ্টি বোলায়।তার ওষ্ঠদ্বয়ে ফুটে উঠে মিটিমিটি হাসি যা সে একমুহূর্তেই লুকিয়ে নেয়।রিক্তের দিকে তাকিয়ে তন্দ্রা দ্বিধাযুক্ত হৃদয়ের প্রশ্ন করে,

-আমি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি রিক্ত ভাই?পাত্রবেশে তুমি!আর এখন আমি তোমার বাগদত্তা!সব কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে।

-তুই সবকিছুকে এতটাই অসম্ভব ব্যাপার-স্যাপার ধরে নিয়েছিলি যে এখন বাস্তবকে তোর অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
রিক্তের কথায় তন্দ্রা ভ্রু উঁচায়।তারপরেই তার ওষ্ঠদ্বয়ে ছড়িয়ে পরে অকৃত্রিম হাসি।সে আবার রিক্তকে জিজ্ঞেস করে,

-কিন্তু তুমি তো বেকার।বাবা মা কিভাবে মেনে নিলো?

রিক্ত একপা এগিয়ে তন্দ্রার নিকটে এসে দাড়ায়।তাতেই খানিক চমকে দেহ কেঁপে উঠে তন্দ্রার।রিক্ত থেকে তন্দ্রা অনেকটায় নিচু।রিক্তের বুক বরাবর মেয়েটার অবস্থান।তাই মাথা উঁচিয়ে তাকায় তন্দ্রা।চোখে মুখের বিস্ময় আকাশ ছাড়িয়েছে।রিক্ত পকেটে হাত পুরে তন্দ্রার দিকে ঝুঁকে বলে উঠে,

-আমি এখন বউ পালার জন্য সমর্থ তাই তোর বাবা মা তোকে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে।

কথাখান বলেই রিক্ত তন্দ্রাকে ক্রস করে সামনে চলে যায়।মুখে ফুটে উঠে অন্যরকম সুন্দর এক হাসি।রিক্ত ঘাড় ঘুরিয়ে একবার গোপনে হৃদয়ে পোষা প্রেয়সীর ভ্রু কুঁচকে থাকা বোকা বোকা মুখশ্রী দেখে।আজ যেন মনে অন্য এক অধিকারবোধ তার মনে।এতদিন ভয়ে ভয়ে যাকে অসংখ্যবার ভেবেছে আজ তাকে সামনাসামনি মন ভরে দেখার সুযোগ।
.
সকলে প্রস্থান করার পর পরই রুমে প্রবেশ করে ত্রয়ী।সুপ্ত এখনো ড্রয়িংরুমে।ত্রয়ী হাতে থাকা মোবাইল বিছানায় আলগোছে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়।শাড়িতে মোড়ানো রমনী নিজেকে দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিভ দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তে আস্তে পেটের কাছের শাড়ির আবরণ ছড়ায় ত্রয়ী।দর্পনে তাকিয়ে উদর মধ্যে থাকা প্রাণটাকে দেখার বৃথা চেষ্টা চালায় ত্রয়ীর আঁখিদ্বয়।তার ভেতর পবিত্র আরেক প্রাণ,সুপ্ত ও তার অংশ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ভাবতেই শিহরিত হয় ত্রয়ীর হৃদয়।নেত্রকোণে আনন্দের অশ্রু জমা হয়।তখনই দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজে ধ্যান ভাঙে ত্রয়ী।সে শাড়ি ঠিকঠাক করে দ্রুত বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়।মিনিটের মাথায় রুমে প্রবেশ করে সুপ্ত।রুমে এসেই চোখ বুলায় সহধর্মিণীর সন্ধানে।কিন্তু অন্ধকার বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকা রমনীকে সে দেখতে পায় না।ওমনি ভ্রু কুঁচকে আসে সুপ্তের।ত্রয়ীকে রুমে আসতে দেখেছে সে।তাহলে কি বেলকনিতে আছে?

সুপ্ত আন্দাজ করে বেলকনির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।কাছাকাছি আসতেই রুম থেকে আসা আবছা আলোয় কলাপাতা রঙের শাড়ি পরিহিতা রমনীর দৃশ্যমান হয়।ত্রয়ী চুপচাপ দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।পা নড়াচড়ায় নুপুরের সুক্ষ্ম আওয়াজ হয়।সুপ্ত তার পাশাপাশি দাড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠে,

-ঠান্ডা লাগবে রুমে চলো।

সুপ্তের কথা কর্ণগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকায় ত্রয়ী।বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় অর্ধাঙ্গের পানে।বলে উঠে,

-এর আগেও রাতে আমি বেলকনিতে এসে দাড়িয়েছি বহুবার।কই তখন তো বললেন না আমার ঠান্ডা লাগবে ভেতরে আসো।তবে এই এক্সটা কেয়ার তার আগমনে উদয় হলো?আমার নিজের কোন ভ্যালুই নেই?

ত্রয়ীর কথা শুনে বোকা বোকা নজরে তাকায় সুপ্ত।স্মিত হেসে বলে,

-কি বললে তুমি?

-এখন আমার কথাও ভালোমতো শুনছেন না আপনি?

ত্রয়ীর কন্ঠে এবার দুষ্টমি লেপ্টে।সুপ্ত ত্রয়ীর কাছাকাছি পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।আলগোছে প্রাণেশ্বরীরকে আগলে নেয়।ভ্রুয়ের কাছাকাছি গালে ওষ্ঠের নরম সোহাগ দিয়ে বলে,

-যদি সব যত্ন তার আগমনেই উদয় হয় তবে কি তুমি ঈর্ষান্তিত হবে বধু সাহেবা?

-আমাকে দেখে কি হিংসুটে মনে হয় আপনার?

-একটু!

ত্রয়ী সুপ্তের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে সুপ্তের বাঁধন থেকে ছোটার চেষ্টা করে।ওমনি সুপ্ত আরো দৃঢ় করে নিজের সাথে ত্রয়ীকে চেপে ধরে।ত্রয়ীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসয়ে বলে উঠে,

-থ্যাংক ইউ মিসেস সুপ্ত।আমাকে বাবা হওয়ার মত শ্রেষ্ঠ খুশি উপহার দেওয়ার জন্য।

ত্রয়ী স্মিত হাসে।পরপরই মাথা নুড়ায় হালকা লাজে।সুপ্তের বুকে মাথা ঠেস দিয়ে সেও বলে উঠে,

-থ্যাংক ইউ টু মিস্টার সুপ্ত।

তারপর দুজনের মুখের নিঃশব্দ হাসির সাথে নিরবতা বিরাজ করে স্থান জুড়ে।মুহুর্ত হয়ে উঠে আরো গাঢ়,আরো সুন্দর।দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দে ভালোবাসার গভীরতা মেপে নেয় দুজন।ত্রয়ী নড়েচড়ে ঘুরে দাড়ায়।মাথা রাখে বুকের মাঝে।সুপ্তের হৃদপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণের শব্দ গুঞ্জন সৃষ্টি করে তার কর্ণগোচরে।সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব কেটে গিয়ে রাত্রি হওয়ার সূচনা হয়।বাইরে থেকে আসা ঠান্ডা বাতাস ত্রয়ীকে ছুঁয়ে যেতেই ত্রয়ী সুপ্তের উষ্ণ আলিঙ্গনে আরো মিশে যায়।ত্রয়ীর আচরণে কেবল মৃদু হাসে সুপ্ত।তারপর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় তার বধুকে।দুজন মানব-মানবী হৃদস্পর্শের দরুন আটকা পড়া প্রেমসায়রে ডুবে রয়।এই প্রেম এত গভীর,এত দৃঢ় যে শত বাঁধা,শত চাতুরতা ভেদ করার ক্ষমতা রাখে না হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রে ডুবে রাখা দুই নর-নারীর হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত প্রেমকে নিভিয়ে দেওয়ার।

বাইরের শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায় সুপ্ত-ত্রয়ীকে।দু’জনের আলিঙ্গনের উষ্ণতায় সমাপ্তি ঘটে হৃদস্পর্শে প্রেমসায়রের এই অধ্যায়!চারিদিকে ছড়িয়ে যায় প্রেমের সুবাস।

সমাপ্ত…