তুমিময় মোহ পর্ব-০৩

0
45

তুমিময়_মোহ [৩]

গ্রিন ডোর ক্লাবের ভেতরে একত্রিত হয়ে মিরান সহ সব বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিল। তাঁদের জানাশোনা টপিক সামাইরার উধাও হওয়া নিয়ে। কেউ একজন বলছে পালিয়ে গেছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে। আবার কেউ বলছে কিডন্যাপ করেছে। আসল তথ্য কারো জানা নেই। তাঁদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে জোহান ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসলো। তাকে দেখে সব বন্ধুরা অবাক এবং খুশি দুটোই হয়। বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা। সচারাচর জোহান কাজে ব্যস্ত থাকে। মিরান জিজ্ঞেস করে,
‘কালকে এভাবে না জানিয়ে হঠাৎ কোথায় খায়েব হয়ে গেলি?’
মিরানের কথনে জোহান চোখের সানগ্লাসটা খুলে ভাবে পরশু দিনের কথা। সামাইরার বিয়ে ঠিক হবার কথা জানতে পেরেই তাড়াহুড়োয় রাতের ফ্লাইট ক্যান্সেল করে বিকেলের দিকে রওয়ানা হয়। পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। এসেই বাড়িতে না গিয়ে সোজা বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়। বরযাত্রী হয়ে সামাইরাদের বাড়িতে আসে। কৌশলে সামাইরাকে কিডন্যাপ করে বন্দী করে নিজের কুঠরীতে।
‘জোহান।’ আহিলের ডাকে ধ্যান ভাঙে। জোহান একটু আয়েশ করে বসে বলল,
‘ফ্যামিলির কেউ জানে না আমি কখন আসবো। জানলে তোদের সঙ্গে বরযাত্রীতে যেতে পারতাম না। এজন্য সকালে পৌঁছে সারপ্রাইজ দিয়েছি।’
‘রাতে কোথায় গিয়েছিলি?’ মিরানের ফের প্রশ্ন।
‘এত তেল মাখানো খাবার পছন্দ না। এজন্য তোদের না বলেই যেতে হয়েছে। এমনিতেও তোরা জানিস আমার কোলাহল অপছন্দ।’
‘এট লিস্ট বলে যেতে পারতি।’ আরেক বন্ধু আরমানের কথন।
‘এই প্রশ্নগুলো করে আমায় ইরিটেট করছিস।’ বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল জোহান।
‘বাদ দে। আমরা খুব টেনশনে আছি জোহান।’ মিরান কিছুটা হতাশ হয়ে বলল।
‘তুই কোনো আইডিয়া দে আমাদের। কিভাবে ইমরান ভাইয়ার বউকে খুঁজে বের করা যায়।’ লামিম বলল বাক্যাটি।
‘প্রথমত তার বউ হিসেবে সম্বোধন করা স্টপ রাখ। দ্বিতীয় এই বিষয়ে আমার কোনো আইডিয়া নেই। ভেবে জানাবো।’
‘দ্রুত! জোহান ভাইয়ার অবস্থা ভালো না। ভাবিকে খুব ভালোবাসে সে। আমাদের পরিবারের সম্মান জড়িত এখানে। কি করব বুঝতেছি না।’
জোহান ভেতরের রাগ ভেতরে চাপিয়ে রাখলো। ইমরান তাকে ভালোবাসে কি-না তার চেয়ে কেউ সেটি ভালো ভাবে জানে না। ঈষৎ ভারী গলায় জোহান বলে,
‘রিয়েলিটি এটাই। বউ পালিয়েছে তার হবু স্বামীর সাথে।’
‘হবু স্বামী?’
‘যার সাথে পালিয়েছে, সে হবু স্বামী না হয়ে কি হবে?’
‘কীভাবে? না কোনো ক্লু। না কেউ দেখেছে। কীভাবে সম্ভব এটা?’ আহিল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
‘অসম্ভবের কিছু দেখছি না আমি।’ জোহান কাধ উঁচু করে বলল।
‘ছাড়। ভাইয়া মেবি থানায় গেছে আব্বুর সাথে। আমি সেখানে যাব।’
‘আমিও যাব।’ আহিল বলে উঠলো।
মিরান ও আহিল বের হলো একত্রে। তিন বন্ধ মিলে হালকা ড্রিঙ্ক করল।
..
‘শান্তি নেই। এই মেয়েটা পালিয়েছে সঙ্গে আমায়ও মেরেছে। কোন দুক্ষে যে পালাতে বললাম।’ রাধিকা একাধারে বিড়বিড় করে রাস্তা পাড় হচ্ছে। এরিমাঝে এপাশ থেকে ওপাশের জনশূন্য গলিতে আসতেই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো। ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠলো। উঠে বসে হাতের কনুইতে ক্ষত দেখতে পেল। হঠাৎ জোহান এগিয়ে এলো রাধিকাকে তুলতে। চোখ তুলে জোহানের পানে তাকাতেই স্থির হয়ে গেল সে। এত সুন্দর সুদর্শন পুরুষ তাকে সাহায্যের জন্য এসেছে দেখে খুশিতে মরে যাবার উপক্রম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কোথায় ব্যাথ, কীভাবে পড়েছে কিছুই মনে নেই তার। জোহান তার হুঁশ ফিরালো। সৌজন্যবোধ দেখিয়ে বলল,
‘কোথায় ব্যাথা পেয়েছেন?’
রাধিকা কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ নিয়ে বাঁ হাত উঁচু করে তুলে বলল,
‘এখানে।’
জোহান দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করল। মৃদু হেসে বলল,
‘মুছে নিন। তবে এর আগে নাকের উপরের অংশ মুছুল। কিছুটা ময়লা লেগেছে।’
রাধিকা লজ্জা মিশ্রিত নয়নে তাকিয়ে রুমালটি নিলো। নাকের উপর রুমাল রাখতেই কয়েক সেকেন্ড বাদে জ্ঞান হারালো। জোহান উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর কণ্ঠে লোকদের নির্দেশ দিলো,
‘মেয়েটিকে গাড়িতে উঠিয়ে ঐ ফ্লাটে নিয়ে যাও। তার চোখ যেন বাঁধা থাকে।’
সেই লোক দু’জন জেহানের নির্দেশ অনুযায়ী বিলম্ব না করে গাড়িতে উঠালো। এরপর চোখ বেঁধে দ্রুত গাড়ি ছুটালো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
জোহান কয়েক কদম এগিয়ে কালো রঙের প্রাইভেট কারে উঠে বসল। ধুলোবালি উড়িয়ে সেটিও ছুটলো।

একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল ভুবন জুড়ে। এত বাঁধভাঙা বৃষ্টি যেন ঘর থেকে বের হওয়া দায়। আষাঢ় মাস বলে কথা। খুব জরুরি মিটিংয়ে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছে এত জুম বৃষ্টির মাঝে জোহান ও জাহাঙ্গীর আহসান। পাশাপাশি দুই বাপ-বেটা বসে টুকটাক আলাপ করছিল প্রজেক্টের বিষয়ে। মাঝে কথপোকথন থামে। বাহিরে বৃষ্টির রেশ দেখার জন্য জানালা দিয়ে বাহিরে নজর ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ একগুচ্ছ গোলাপ ফুল হাতে একটি মেয়েকে বন্ধ দোকানের ছাওনিতে দাঁড়ানো দেখতে পায়। পাশে ছিল আরেকটি মেয়ে। সে খুব কথা বলছিল। বারেবারে পাশের মেয়েটি কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে। মেয়েটির ভেজা চোখ, ভেজা ঠোঁট, ভেজা চুলগুলো আদলের স্নিগ্ধতা আরো কয়েকগুল বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার কথা শুনে বারে বারে আকাশের পানে তাকাচ্ছে। হয়তো বৃষ্টি থামছে না বলে কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করছে। এমনভাবে কোনো মেয়ের সৌন্দর্য দূর থেকে কখনো দেখা হয়নি। আজ জোহান দেখছে। হৃদয়ে প্রশান্ত এক প্রণয়ের হাওয়া বইছে। তার শুঁকনো ঠোঁটে মিষ্টি হাসির দেখা মিলল।
‘জোহান মিটিং ক্যান্সেল করে দেও। আমি বাড়ি যাব।’ বাবার কথনে হালকা বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকালো।
‘ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাও।’ তিনি ফের বললেন। বলতে দেরি গাড়ি ঘুরাতে দেরি হলো না।
জোহান বাবাকে কিছু বলতে যাবে এর মাঝে তার ফোন বেজে উঠে। সেটি পকেট থেকে বের করে দেখে ভাইয়ার কল। জোহান পেছনে ফিরে মেয়েটিকে শেষ বারের ন্যায় একবার দেখে বিরক্ত জড়িত কণ্ঠে ফোন রিসিভ করল। কথা সারলো কয়েক মিনিট। সেদিন বাবার উপর বের বিরক্ত হয়েছিল জোহান। সেবারের পর আর মেয়েটিকে খুঁজে পায়নি।
নাম, ঠিকানা বিহীন খুঁজেছিল বহুদিন। মিলেনি তার দেখা। এক বছর শুধু অনুভব করে কাটিয়েছে সে। সেদিন মিরান যখন সামাইরার একটি চিত্র হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছিল। এক টুকরো প্রশান্তির হাসি ফুটেছিল ঠোঁটে। কিন্তু বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হলো না। যখন জানতে পারে সামাইরা মিরানের ভাবি হবে। সে ছোট বেলা থেকেই ইমরানের বিষয় সব জানে। তার চরিত্র কতটুকু জঘন্য অজানা মিরানের কাছে থাকলেও, তার কাছে নয়। এজন্য সে মিটিং শেষ করে ন্যানো সেকেন্ড দেরি করেনি। হলুদের অনুষ্ঠানের পরদিনই চলে এসেছে। আর আজ তাকে বন্দি অবস্থায় নিজের কাছে হেফাজতে রেখেছে। আচমকা হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের টোন শুনে চৈতন্য ফিরলো তার। গাড়িতে বসে ভেবে যাচ্ছিল গত কয়েক দিয়েন ঘটনা। মেসেজটি তার একজন লোক পাঠিয়েছে। সেটি ছিল একটি ভিডিও ক্লিপ। সেটাও ইমরানের। একটি বারে বসে মদ্যপান করে মাতলামো করছে। তার বাক্যগুলো ছিল এমন।
‘সামাইরার উপর নজর পড়েছিল সেই ছোট্টবেলা থেকে। সেই ছোট্ট সামাইরাকে সেবার ছাদে একা পেয়ে হাতছাড়া করেছি। তখন থেকেই ওঁকে পাবার খায়েশ ছিল বহুত। যত মেয়েকে স্পর্শ করেছি তাঁদের মধ্যে সামাইরাকে অনুভব করেছি। দ্বিতীয় ওর বাবা বড়োলোক। চারদিক সুন্দরী সামাইরা। এজন্যই বিয়ে করতে চাইছি। ভালোটালো বাসি না।’ বলতে বলতে বিশ্রীভাবে হাসতে আরম্ভ করল।
জোহান এতটুকু দেখে ভিডিও ক্লিপ বন্ধ করে রাখলো। বাকিটুকু আর শুনলো না। রাগে দাঁতে দাঁত পিষে রাখে। নাকের পাঠা ফুলে গেছে। তার অনুমান সঠিক ছিল। ফোন মুঠোবন্দি করে শক্তভাবে চেপে ধরেছে। সে চাইলে এই ভিডিও সবাইকে দেখাতে পারে। তবে এর চেয়ে আরো শক্তপোক্ত এভিডেন্স তার প্রয়োজন ইমরানের বিরুদ্ধে। ততদিনে সামাইরাকে সে নিজের কাছে রাখবে। তাকে বোঝাবে, ভালোবাসবে।

‘রাধিকা। এই রাধিকা। আরে এই ছেমড়ি।’ সামাইরার তীব্র ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো রাধিকা। চোখ পিটপিটিয়ে সামাইরার পানে তাকিয়ে দ্রুতই ঝাপটে ধরে বলল,
‘বান্ধবী কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি? আমি কত চাপে ছিলাম জানিস?’
‘জানি।’ শান্তভাবে জবাব দিলো সে।
রাধিকা ভ্রু কুঁচকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘জানিস তাহলে পালালি কেন শ’য়তান মাইয়া।’
‘ইচ্ছে করে পালাইনি। আমাকে কিডন্যাপ করেছে ঠিক তোর মতো।’
রাধিকার কপালে আরো ভাজ পড়ে। চারদিক নজর বুলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘কে করেছে আমায় কিডন্যাপ? কখন কিডন্যাপ হলাম আমি। তোকেই বা কে করল?’
‘টেরও পাসনি কখন কিডন্যাপ হয়েছিস?’
‘একদমই না।’ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
‘মনে কর।’৷
নজর এদিক ওদিক ফেলে মনে করে রাধিকা জানালো,
‘আমি উষ্ঠা গেলাম। একটা সুদর্শন ছেলে এলো আমায় সাহায্য করতে। এরপর একটা রুমাল দিয়ে বলল নাকে ময়লা পরিষ্কার করতে। আমি লজ্জা পেয়ে রুমাল নিয়ে দ্রুত পরিষ্কার করতে লাগলাম৷ তারপর এখানে পেলাম নিজেকে।’
‘বুঝেছি।’
‘আমাকেও বুঝা।’
‘জোহান আহসান তোকে কিডন্যাপ করেছে।’
‘কে সে? আমার কাছে কি চায়? টাকা-গহনা ছিল না তো আমার কাছে।’
‘টাকার জন্য না গর্দভ।’
‘তাহলে?’
‘তোরটা জানি না৷ আমারটা শোন।’
‘শুরু কর।’
.
.
চলবে?

®সুমাইয়া মনি