কারণ আমি মেয়ে পর্ব-০২

0
37

#কারণ_আমি_মেয়ে
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২

“আমার ওতোটুকু বোনটাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে কিছু নরপিশাচ। কিন্তু ভাগ্যক্রমে এক চাচা বাঁচিয়ে আনে। কিন্তু বোন আমার আর আগের মতো চঞ্চল নেই। আগের মতো স্বাভাবিক ও নেই। আমি কোনো প্রতিবাদ করতে চাইলে ঐ চাচা বলে, নরপিশাচ গুলো টাকা দিয়ে কোন ভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু বদনাম হয়ে যাবে আমার বোনটার। সেদিন আমার মনে হয়েছিলো নরপিশাচ গুলোকে খু ন করি। কিন্তু এটা ভেবে পারিনি, আমি যে নিজেই ওদের খাদ্য। কারণ আমি মেয়ে। আস্তে আস্তে মনে হলো জীবনে বেঁচে থাকাটাই বেশি কষ্টের মৃত্যুর চাইতে। বোনকে অনেক চেষ্টা করেও আমি আর মা মিলে স্বাভাবিক করতে পারিনি। ও এখন আর ঘর থেকে বের হয় না। সারাদিন ঘর বন্দী হয়ে থাকে। আমার ছোট্ট বোনটার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটে দেয় ওই নরপিশাচ গুলো। ওরা আমার সামনে থেকেই ঘুরতো কিন্তু আমি চাইলেও কিছু করতে পারতাম না। তখন মনে হতো নিজেই নিজেকে ধারালো ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করি। কিন্তু সবতো আর আমাদের কথায় হবে না। কারণ আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার পরিবারের কি হবে? এগুলো চিন্তা করেই নিজেকে শান্ত করলাম। অনেক কিছু সামলে পরীক্ষা দিলাম, কিন্তু রেজাল্ট খুব খারাপ এলো। অবশ্য এটা আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। তবুও যেন মন’কে শান্তনা দিতে পারছিলাম না।

বাবা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরতো। ফাতেমা রাতে ঘুমের মাঝেই চিৎকার দিয়ে উঠতো। মায়ের বয়স বাড়তে শুরু করলো। আগের মতো মা অন্যের বাড়ি কাজ করতে পারতো না। এটা নিয়েও মা’কে পরের বাড়ি থেকে কথা শুনতে হতো। আস্তে আস্তে সব কিছুই চোখের সামনে ধোঁয়াশা দেখতে থাকলাম। আর যেন এই নরক জীবনটাকে টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। শুধু এটাই ভাবতাম কবে এই জীবনের শেষ।

কিছু খারাপের মাঝেই ভালো কিছু হয়ে গেলো আমাদের জীবনে। আমার কলেজের দু’টি বন্ধু রিফাত আর নিঝুম। আমি ওদের যতো এড়িয়ে যেতাম ওরা ততোই আমার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতো। আমি না চাইতেও আমার সাথে ওরা জোর করে মিশতো।

একদিন কলেজে গেলে ওরা জোর করেই আমার বাড়িতে আসলো। আমি না করেও ওদের আটকাতে পারিনি। ওরা আমাদের বাড়িতে এসে বাবার সাথে খুব সহজেই মিশে গেলো। আমার বোনকে নিজেদের কাছে টেনে নিলো। এগুলো দেখে মনের মাঝে খারাপ লাগা নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। সেদিন ওরা আমার পরিস্থিতি আমার পরিবার এবং ঘরের অবস্থা সব বুঝে নিলো নিজেরা।

তারপর ওরাই আমাকে সব দিক থেকে হেল্প করতে শুরু করলো। প্রায় ওরা আমাদের বাড়িতে এটা ওটা নিয়ে আসতো। আর সব কিছু করতো আমার অগোচরে। আমার পড়াশোনার বিষয়েও অনেক হেল্প করতে থাকলো। ওদের সাথে মিলে কয়েক মুহূর্তে ভুলেই গেলাম আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু বিষাদময় বছরের কথা। ওরা কখনো আমার কাছে কিছু শুনে করতো না। যা করার সব নিজেরাই করতো। ওরা হয়তো বুঝতে পারতো, আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু কারো কাছে হাত পাততে রাজি নই। তাই ওরা ওদের মন মতোই সব কিছু করতো।

কখনো নিজেদের হাত খরচের টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে বলতো তা দিয়ে যেন বাবার ঔষধ কিনে। কখনো ফাতেমার জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসতো। কখনো কখনো ওরা নিজেরাই বাজার করে নিয়ে এসে মা’কে বলতো,
আন্টি আজ জমিয়ে রান্না করুন দুপুরে আমরা এখানেই খাবো।

মা অনেক বিব্রতবোধ করলে ওরা মায়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলতো আন্টি রাবেয়া, ফাতেমার মতো আমরাও আপনার সন্তান। আমরা কি আমাদের মা-বাবা আর বোনদের জন্য এতোটুকু করতে পারি না?
মা তখন ওদের বুকে জড়িয়ে খুশির কান্না কাঁদতো। তখন আমার মনে হতো খারাপ শেষেই বুঝি ভালোর দেখা মিলে। ঐ যে কথায় আছে কষ্টের মাঝে নিশ্চয়ই স্বস্তি লুকিয়ে আছে। ওরা আমার জন্য সব করতো। ওদের কাছে আমাদের মতো একটা ছোট্ট সংসার চালানো কোন ব্যাপারই না। ওরা আমাদের সাথে এমন ভাবে মিশে গেলো যে কেউ দেখলে মনে করতো, ওরা আমাদের আপনের থেকেও আপন। আর ওরা সব কিছু প্ল্যান করেই করতো। আমি যেন ওদের বাঁধা দিতে না পারি। আর ওরা ওদের কথায় আমায় এমন ভাবে ফাঁসিয়ে দিতো আমি আর ওদের বিপক্ষে কোন কথা খুঁজে পেতাম না।

এভাবেই কেটে গেলো দুই বছর আমি ইন্টার পাশ করে অর্নাসে ভর্তি হলাম। ওরাই সব ঠিক করে দিলো। ওরা আমার জীবনে আসার পর বুঝতে পারলাম সত্যিকারের বন্ধু কাকে বলে। আমি ওদের কাছে সব সময় জানতে চাইতাম ওরা কেন আমাকে এতোটা ভালোবাসে। আমার পরিবারের জন্য কেন এতটা করে।

তখন বলতো সময় কথা বলে জানিস তো। সেই সময়ই কথা বলবে। আর কিছু বিষয় আছে যা দেখা যায়। যা দেখতে পাবো তা শুনে কি করবো। তোকে কেন এতো ভালোবাসি আর তোদের জন্য এতো কেন করি সেটা সময় দেখিয়ে দিবে। আমাদের বলতে হবে না। বরাবরের মতো এবারও আমি ওদের কথার জালে ফেঁসে গেলাম। যার ফলস্বরূপ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ওদের সাথে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড় মজা আর দিন শেষে ওদের আমার পরিবারকে সময় দেওয়া এটা আমাদের নিয়ম হয়ে গেলো।

হঠাৎ একদিন নিঝুম অসুস্থ হয়ে পরলো। ওর গায়ে জ্বর এলো। কিন্তু কিছুতেই ওর জ্বর কমছিলো না। তাই আমি আর রিফাত ওকে নিয়ে গিয়ে কিছু টেস্ট করালাম। আর জানতে পারলাম ওর টাইফয়েড হয়েছে। তখন আমি আর রিফাত খুব টেনশনে পরে গেলাম কি হবে এখন। তার মধ্যে ওর বাবা মা দু’জনে কিছু সমস্যার জন্য দেশের বাড়ি গেলেন। ও বাড়িতে একা হয়ে গেলো। তাই সব কিছু ভেবে ওকে আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। তারপর ডাক্তারের কথা মতো ঔষধ এবং সেবা সব কিছু আমি আর মা করতে থাকলাম। প্রায় এক মাস ও অসুস্থ ছিলো। ও সুস্থ না হবার আগে ওকে আর ওদের বাড়িতে যেতে দেইনি। সুস্থ হবার পর তারপর বাড়িতে ফিরলো। আর যাওয়ার আগে বললো।

“কেন তোদের এতো ভালোবাসি এটা প্রামণ হয়ে গেলো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম।

“মানে?”

তখন ও বললো, “আজ তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে কখনো আমার এতো খেয়াল রাখতো না, বা কেউ এতোটা নিষ্ঠা দিয়ে আমাকে সুস্থ করতে চাইতো না।”

আমি বিনিময়ে শুধু হেসে ছিলাম।

এতো কিছু ভালোর মাঝেই খারাপ কিছু ঘটতে সময় নিলো না। হঠাৎ করেই ওরা দু’জন হারিয়ে গেলো। অবশ্য হারিয়ে গেলে ভুল হবে, বলা যায় দূরে চলে গেলো। বাংলায় একটা কথা আছে। কাছে থাকলে মায়া, দূরে গেলে শুধু থাকে তার ছায়া। ঠিক তেমনটাই হলো।

চলবে…