কারণ আমি মেয়ে পর্ব-০৬

0
44

#কারণ_আমি_মেয়ে
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৬

বাড়িতে এসে দেখতে পেলাম মা’কে একজন খুব বিচ্ছিরি ভাবে খারাপ ভাষায় কথা বলছে। আমি ভেতরে গিয়ে কিছু বলতে গেলে, দেখতে পেলাম উনি আর কেউ না, আমার মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই। কেন তিনি এতো খারাপ ভাষায় কথা বলছে জানতে চাইলে মা আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে বললেন,

“চুপ করে এখানে বসে থাকবি, একদম বাহিরে বের হবি না।”

এই কথা বলেই মা বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠে গিয়ে ফাতেমাকে ডাকলাম, ফাতেমা আসতেই বললাম

“কি হয়েছেরে? উনি ওমন করে কথা বলছে কেন?”

“উনি তোর জন্য একটা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলো, কিন্তু মা না করায় তিনি বলেন,

মেয়েরতো বাইশ চলছে, আর কত ঘরে রাখবে। এবার কি ঘরের খুঁটি দিবে! এক মেয়ে তো ধর্ষণ হতে গিয়েও বেঁচে গেছে। একে জানি কবে লোকেরা ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়। শুনলাম মেয়ে নাকি রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে তাহলে এরকম কিছু ঘটার কারণ আছে। নাকি মেয়েকে ঘরে রেখে ব্যবসা করাবে? মোটা অংকের টাকাও ইনকাম হবে সাথে মেয়ে ঘরেও থাকবে।

ফাতেমার মুখে কথা গুলো শুনে মাথার রাগটা তরতর করে বেড়ে গেলো। তাই কোন কিছুর চিন্তা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এসেই ঐ লোকটার উদ্দেশ্য বললাম,

এতো যখন বিয়ে দেওয়ার শখ জেগেছে নিজের মেয়েকে গিয়ে বিয়ে দিন না। আমাকে বিয়ে দিতে কেন উঠে পরে লেগেছেন? নিজের মেয়ের তো আমার চাইতেও এক বছর বেশি হলো, তার কথা আগে ভাবুন। আর আমার বাবা-মা আমাকে দিয়ে ব্যবসা করাবে না, করান তো আপনার মেয়েকে দিয়ে। যে কিনা নিজের রূপ দিয়ে বড়লোক ছেলেদের ফাঁসিয়ে তাদের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করে। নিজের ঘরের খবর কি মনে করেন আমরা জানি না। সব জানি, কিন্তু আমরা ভদ্রতা জানি, তাই কিছু বলি না। আরো কিছু বলতে যাবো তার আগেই মা আমার মুখ চেপে ধরে।

ভাইজান এখান থেকে যান, আর শুনুন আমার মেয়েকে বিয়ে দিবো। আর তা এই সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু এতো মিথ্যা অভিযোগ আমার মেয়ে দু’টোর নামে দিবেন না, আল্লাহর দোহাই লাগে। আর আপনি এখন যান, আমি আপনার আনা সমোন্ধে আত্মীয়তা করবো না।

মায়ের কথা শুনে উনি বললেন

“হ হ দেখা যাইবো কতো ভালা জাগায় বিয়া দাও, আমিও দেখমু! আর এই অপমানের প্রতিশোধ তো আমি নিমুই।”

আমি মুখ থেকে মায়ের হাত সরিয়ে বললাম

“যখন নিবেন তখন দেখা যাবে, এখন এখান থেকে যান।”

উনি চলে যেতেই, মা বললেন তৈরি হয়ে’নে কিছু লোক আসবে তোকে দেখতে।

আমি মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম, আসলে বুঝতে চেষ্টা করছি মা কি করতে চাইছে আর কি বোঝাতে চাইছে!

“কি বলছো মা? ঐ লোকটার জন্য এখন তুমি আপু কে বিয়ে দিবে?”

“তুই চুপথাক। কোন কথা বলবি না। তোর বাপ তো বেঁচে থেকেও মরার মতো পরে আছে। যত জ্বালা আমার কাঁধে দিয়ে তিনি শুয়ে আছেন বিছানায় আরামে। আজ মিজান বলেছে কাল আশেপাশের সবাই বলবে। পরশু সমাজ বলবে। কিন্তু আমি এতো কথা শুনতে পারবো না। আর রাবেয়া তুই যদি আমার কথা না শুনিস আমি গিয়ে গলায় দড়ি দেবো। তখন কিন্তু আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।”

কথা গুলো বলেই মা হনহন করে বাহিরে চলে গেলেন। আমি ওখানেই হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম, এতো কষ্ট করে এতোটা সাফল্য অর্জন করে এখন আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে। বাবা-মার জন্য কিছু করার আগেই আমাকে সব ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। এটা ভাবতেই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। এতো পরীক্ষা কোন স্কুল কলেজেও দিতে হয়নি, যতো পরীক্ষা জীবন আমার নিচ্ছে।

আমি ঘরের এককোণে বসে রইলাম। মা সত্যি সত্যি আমার বিয়ে ঠিক করলেন, কিছুক্ষন পর ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে। এখন যে ছেলের পরিবার আমায় দেখতে আসছে সেটা আমাদের বাড়ির পাশের এক কাকা মাকে কিছু দিন আগে এই সম্বন্ধের কথা জানান। কিন্তু মা তখন না করে দেয়। আজ আবার জানাতেই কাকা ছেলেদের ফোন দিয়ে জানতে চায় তারা মেয়ে দেখতে আসতে পারবে কিনা। তারা জানান পারবে। তারা বিকালেই আসবে।

আমাকে এমন নিশ্চুপ ভাবে বসে থাকতে দেখে ফাতেমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আপু আমরা যা ভাবি তা আমাদের জীবন নয়, আমাদের সাথে যা ঘটে তাই আমাদের জীবন। মায়ের মনে যে বিষ ঢেলে দিয়েছে এই সমাজ তা তোকে বিয়ে না দেওয়া অবধি মায়ের শরীর থেকে যাবে না।”

আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই মা আমার হাতে একটা শাড়ি দিয়ে বলে এটা পরে আসতে। আমিও চুপচাপ শাড়িটা পরে নিলাম। মা জোর করে আমাকে মুখ ধুয়ে দিয়ে একটু ক্রিম লাগিয়ে দিলো। একটু সাজাতে চাইলে আমি কিঞ্চিৎ রাগ দেখালে তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমার ডাক এলো।

মা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে একটি চেয়ারে বসালেন। আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। একটু আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম পাত্রপক্ষের সামনে বিশাল খাবারের আয়োজন। আর ছেলেপক্ষ কেমন রাক্ষসের মতো গিলছে। মেয়ে পছন্দ হলে তো হলো আর না হলে এই পেটুকগুলো গিলে চলে যাবে। কিন্তু কখনো এটা চিন্তা করে না যাদের মেয়েকে আমরা ছেলের বউ করবোই না তাদের কষ্টের জমিয়ে রাখা টাকা-পয়সার খাবার কি করে খাই? এমনটা নিয়ম করলে কেমন হতো, মেয়ে পছন্দ হলে তারপর ওই বাড়ির খাবার মুখে তুলবে। কিন্তু এমনটা তো নিয়ম নয়। আমার এই আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই মা আমার মুখটা উপরে তুললেন। আমি সামান্য ব্যথা পেলাম কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললাম না। কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই ছেলেদের মাঝে একজন মহিলা বলে উঠলেন।

“আপা মেয়ের চুলটা একটু খুলে দেখান তো”

মা আমার চুল খুলে দেখালো

চুল খুলে দেখা’র পরই বলে উঠলেন, “মা, একটু হেঁটে দেখাও”

আমার রাগে শরীর জ্বলছে, তবুও চুপ করে হেঁটে দেখালাম, তারপর কেউ একজন বললো।

আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে আপনার চাইলে আজই আমরা পাকা কথাটা সেরে ফেলতে পারি।

মা “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলেন।

আর আমার চোখের কানিস বেয়ে গড়িয়ে পরলো একফোঁটা জল।

এরমাঝে একজন বলে উঠলেন।

দেখেন ভাবি ছেলে আমাদের পঁচিশ হাজার টাকা বেতন পায়। যশোরে নিজেদের বাড়ি আছে। আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে তাই কোন দাবিদার নেই। আপনারা খুশি হয়ে আপনার মেয়ে জামাইকে যা দিবেন সেটাই আমরা নিবো। তো বলেন কি দিবেন?

আমি এগুলো শুনেই হাতটা শক্ত করে কিছু বলতে নিলে মা বললো,

ভাই আমার অবস্থা তো আপনারা রাজ ভাইয়ের থেকে জেনেই এসেছেন। তবুও মেয়েকে কানের দুল আর ছেলেকে আমি আংটি দিবো। আর ঘরের জন্য মনে করেন টুকটাক জিনিসপত্র এই যা। এর থেকে বেশি কিছু দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

মায়ের কথা গুলো আমি অনেক কষ্টে হজম করলাম। তাদের কথাবার্তা শেষ হতেই, ছেলেপক্ষের কেউ একজন আমার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে মা’কে বললো,

“ভাবি মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেন।”

মা আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসতেই, আমি মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আগের নিজের হাতের মুঠো খুললাম! তখন দেখলাম হাতের মুঠোয় ১ হাজার টাকার একটি নোট এবং খুচরো ১ টাকা। এটা দেখে আমি মায়ের দিকে ফিরে বললাম।

“মা তোমার কি মনে হয় আমি চিড়িয়াখানার কোন জন্তু যাকে দেখলে টাকা দিতে হয়?”

“এটাই নিয়ম।”

“কেমন নিয়ম মা মেয়ে দেখে টাকা দিতে হয়! আর তোমাদের এই ফালতু নিয়ম গুলোই মেয়েদের দিনে দিনে সস্তা বানিয়ে দিচ্ছে। কেন আমাকে হেঁটে দেখাতে হবে? যখন পায়ে হেঁটে তাদের সামনে গিয়েছিলাম তখন কি তারা চোখ বন্ধ করে ছিলো? আর চুল খুলে দেখাতে হবে কেন? তারা কি বিয়ের পর বউয়ের চুল বিক্রি করে টাকা রোজকার করবে যার জন্য দেখেশুনে নিচ্ছে?”

“রাবেয়া, আর একটা আজেবাজে কথা বললে তোকে ঠাটিয়ে একটা চড় মারবো।”

“মা”

“একদম চুপ“

মা চলে গেলেন। আর আমাকে রেখে গেলেন গোলকধাঁধার মাঝে! ছেলেরা কি সুন্দর করে নিজেদের দাবি গুলো প্রকাশ করলেন, কিছু চাইলেন না আর কিছু চাইতে বাদও রাখলেন না। কিন্তু মা এতো কিছু কোথাথেকে দিবে? আর সব থেকে বড় কথা কেন এতো তাড়াহুড়ো করছে মা? আমি তো জীবনের সাফল্যের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। আরেকটু এগিয়ে গেলেই সাফল্য আমার সামনে! তাহলে কেন আমাকে সাফল্যের এতো কাছ থেকে মা টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোন উত্তর নেই। আধা ঘণ্টা পর মা এসে বললেন এই শুক্রবার আমার বিয়ে। আর আমি যদি এই বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলি তাহলে মায়ের মরা মুখ দেখবো। আমাকে মা বেঁধে দিলো মাতৃত্ব দিয়ে। আমার আর কিছু বলার রইলো না। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই। কিন্তু ঘুম ছুটে গেলো কারো ফিসফিস আওয়াজে। বিছানা ছেড়ে উঠে সেই আওয়াজকে অনুসরণ করলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কথা গুলো স্পষ্ট না, তাই একটু কাছে গিয়ে যা শুনলাম! সেটা শোনার পর আমার মস্তিষ্ক চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো।

চলবে…