মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৫+১৬

0
36

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৫তম_পর্ব

অভ্রের দৃষ্টি তার ঐন্দ্রির দিকেই। মেয়েটার চোখ ম্লান। অনেকক্ষণ পর ডান হাতে ঐন্দ্রিলার মাথাটা টেনে বুকের সাথে মিশালো। হঠাৎ প্রশস্ত বুকের উষ্ণতায় হৃদয়ের বিষাদপাথরগুলো গলতে লাগলো যেন। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো বিষাদসিন্ধুর জলধারা। নিশ্চুপ ঐন্দ্রিলা। চোখ থেকে অনবরত ঝরছে অশ্রুধারা। ভিজে যাচ্ছে অভ্রের শেরওয়ানি। ঐন্দ্রিলা বোঝার পূর্বেই তার অভিমানী অশ্রু জোড়া ভিজিয়ে দিল গাল। যেন বছর গড়িয়েছে কিন্তু কাঁদা হয় নি। এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে, এতোটা কষ্ট সে কি করে পুষে রেখেছিলো। তার উপরে সে যার উষ্ণতায় গলে যাচ্ছে সে মানুষটি মোটেই তার প্রিয়র তালিকাবদ্ধ নয়। ঘৃণ্য মানুষের বুকে এতটা উষ্ণতা থাকে। যে ছিলো চক্ষুশূল, যার প্রতি ঘৃণায় অন্ধ ছিলো হৃদয়; তার শরীরের গন্ধে কি সেই উষ্ণনুভূতি আছে? খানিকক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশে বিষাদবিলাশ হলো আড়ালে। ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করা হাতটা তখন মাথায় আলতো করে বুলিয়ে খুব কোমল স্বরে অভ্র বললো,
“তুই শুধু ভেড়াদের আমদানী কি করে করিস?”

কথাটায় তাচ্ছিল্য ছিলো না, ছিলো না উপহাসের রেশ। তবুও ঐন্দ্রিলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। সময় নিলো না। মিশে গেলো তার প্রশস্থ বক্ষস্থলে। শব্দ করে ফুপালো। দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো কোমড়। অভ্র কপাল কুঁচকে বললো,
“আমার শেরওয়ানিতে সর্দি লাগিয়ে দিলি তো”

কিন্তু মাথায় আলতো করে হাত বুলানোতে বিরতি হল না। ফলে মেয়েটি থামলো না। বরং শক্ত হলো বাঁধন। কত যন্ত্রণা পুষে রেখেছে সেটা কি জানে অভ্র? তার জীবনে সব ই তো ফাজলামি। সে কি করে বুঝবে হৃদয় ভাঙ্গনের দুঃখ। অভ্র বিদ্রুপ টেনে বললো,
“ইশ! এই নাকের জল আর চোখের জলে তো চিপচিপে হয়ে গেলাম রে। তুই এতো বাজে ভাবে কেন কাঁদিস ঐন্দ্রিলা। কাঁদতে হবে সৌন্দর্য নিয়ে। নাহ, তোর কান্না একেবারেই সুন্দর না। তুই কান্নায় ফেল মেরেছিস”

ফলে আরোও শব্দ করে কাঁদলো ঐন্দ্রিলা। এই পাজি ছেলের বুকে হুমড়ি খেয়েই কেনো কাঁদতে হবে তার? কয়েকটা কিল মারলো বুকে। তবে নড়লো না একচুল। নিবিড়ভাবে লেপ্টে রইলো অভ্রের বুকে।

*****

ঐন্দ্রিলা দুহাত নিয়ে চোখ মুছছে। চোখজোড়া ফুলে গেছে। ফুপাচ্ছে এখনো। নাক টানছে ক্ষণে ক্ষণে। অশ্রুর সাথে ভালোবাসা, বিশ্বাস সব জ্বলাঞ্জলি দিয়েছে। শ্বাসে টান লেগেছে। অভ্র তার শেরওয়ানি নিয়ে খুব চিন্তিত। বুক বাঁকিয়ে বলল,
“ইশ! আমার শেরওয়ানির মানইজ্জত সব তোর নাকের সর্দিতে ধুয়ে গেলো। ছে”

ঐন্দ্রিলা হাসলো মৃদু। কিল দিল বাহুতে। কিন্তু এই সামান্য কিলে কিচ্ছু হলো না তার। হাত পা টানা দিয়ে বললো,
“চল”
“কোথায়?”

কন্ঠে কৌতুহল ছলকালো ভীষণভাবে। অভ্র স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“বিয়ে করবো”
“তুই পাগল?”
“শোন ঐন্দ্রিলা, এতোটা সময় তোর সব ন্যাকামি সহ্য করেছি। এখন যদি বলিস বিয়ে করবি না, ঠাটিয়ে চড় লাগাবো”

অভ্রের কথায় রাগ প্রকাশ পেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। হতাশ স্বরে বলল,
“এতো রাতে তোকে বিয়ে করানোর জন্য কাজী বসে আছে তো। শ্বশুর লাগে তো তোর?”

ঐন্দ্রিলার কথা পাত্তা দিল না সে। বিল্লালকে ফোন দিল সময় নষ্ট না করে। বিল্লাল ফোন ধরতেই বললো,
“কাজী কি আছে, নাকি চলে গেছে?”
“ব্যাটাকে বেঁধে আসছিলাম। যে রোগা পটকা। বেহুশ হয়ে গেছে মনে হয়। তরুন গার্ড দিচ্ছে”
“ব্যাটার বাধন খোল। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাওয়া। একটা ডিম খাওয়া। এনার্জির প্রয়োজন। বিয়ে পড়াতে হবে তো। দেখা গেলো অর্ধেক বিয়েতে বেহুশ হয়ে গেলো। তখন কাজী পাবো কই?”

অভ্রের আদেশ শুনে হতবাক বিল্লাল ব্রেক লাগালো তার মোটরসাইকেলে। উৎকুন্ঠিত স্বরে বলল,
“বিয়ে? তোরা এখন বিয়ে করবি?”
“তো কি কাজীর থোবড়া দেখার জন্য বেঁধে রাখতে বলেছি?”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিল। তারপর বলল,
“যা মুখ ধুয়ে আয়। আটা ময়দা ধুয়ে আয়। আমার বউ হবে ন্যাচারাল বিউটি। কিন্তু তুই সেই বিউটির ধারে কাছেও পড়িস না। এই আটা ময়দায় আরোও সারারাগুলের মতো লাগছে। যা ধুয়ে আয়”

অভ্রের আদেশের সুর শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলা। আজ অভ্রকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেনো ঘৃণা করত সেই কারণটাও ঠুংকো হয়ে গেছে। হাসলো আনমনে। আজ সত্যি সত্যি তার আর অভ্রের বিয়ে।

******

পিউ কাঁদছে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে। সাবেরা তাকে অনেক বকাবকি করেছেন। কেনো যেন এক বন্ধু আকাম করলে সেই আকামের পুরো দোষটা পড়ে সাথে দাঁড়ানো বন্ধুর ঘাড়ে। সে হয়তো সেই আকামে জড়িত থাকে না। কিন্তু পিউ ঐন্দ্রিলার এই গোল্লাছুটের মুখ্যম সাক্ষী এবং মদকদাতা। ফলে গালি খাওয়া তার জন্য ফরজ। কিন্তু প্রথমে অভ্রের বকাঝকা এরপর সাবেরার বকাঝকায় একেবারে চুপসে গেছে সে। নীলাদ্রি তার পাশে বসে আছে। তার হাতে ঠান্ডা পানি। তার মুখখানা বেজার। সে বাবার আয়োজনের নিন্দা করতে পারছে না। কারণ তার বোন পালিয়েছে। তার বোনের জন্য চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা এতো বেকুবের বেকুব। উন্নত পর্যায়ের গর্দভ না হয়ে কেউ বিয়ে ছেড়ে পালায়? পিউ হিচকি তুলে কাঁদছে। নীলাদ্রি গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমার বোন না হয় বেকুবের বেকুব। কিন্তু তুমি এই বেকুবের সাথে তাল দিলে?”
“বুদ্ধিটা আমার ছিলো নীলাদ্রি ভাই। অভ্রকে জব্দ করতে চেয়েছিলাম। ও অনেক কাঁদিয়েছে ঐন্দ্রিলাকে”
“তুমি আমাকে হতাশ করলে পিউ। আমি ভাবতাম তুমি খুব চালাক মেয়ে। নাহ, ঐন্দ্রিলার সাথে থাকতে থাকতে তুমিও বেকুব হয়ে গেছো”

পিউ এতোকাল নিজেকে বেশ বুদ্ধিমতী ভাবতো। কিন্তু নীলাদ্রির কথা শুনে মনটা বসে গেলো। বোকারাম যদি বলে তুমি বেকুব, তাহলে বুঝতে হবে তুমি আসলেই বেকুব। পিউ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আপনি কি আমার উপর রাগ করলেন নীলাদ্রি ভাই?’

নীলাদ্রি খুব সুন্দর করে হাসলো। নির্মল, নিষ্কলঙ্ক হাসি। পিউ এর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
“নাহ, আমার তোমার উপর রাগ হয় না পিউ”

সালাম সাহেব মাত্র ফিরে এসেছেন। কাজীর বাধন বিল্লাল খুলে দিয়েছে। তাকে দুটো সেদ্ধ ডিম, দুটো আম এবং একগ্লাস ঠান্ডা শরবত দেওয়া হয়েছে। মানুষটির অবস্থা ভালো নয়। রুগ্ন শরীরটা ভয়ে যেকোন সময় টপকে যেতে পারে। বিল্লাল তার কাছে ক্ষমা চাইলো। সোফায় বসে থাকা গম্ভীর পৌঢ় চেহারায় ভাঁজ। তীব্র ভাঁজ। রাত বারোটা বাজে। এখন তার বড় নাতীর বিয়ে হবে। তার পরিবারের কারোর বিয়ে এমন অদ্ভুত ভাবে হয়েছে কিনা মনে আসছে না। কি বিদিককিচ্ছির বিয়ে, প্রথমে বউ পালালো, বর জেলে গেলো। এখন তারা আসছে, বিয়ে করবে। এই বিয়ে কি টিকবে আদৌ? এদিকে তার ছেলে আর ছেলের বউ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের মুখ হাসি হাসি, একজনের মুখ গোমড়া। কারণ একটাই ছেলের বিয়ে হবে। একটু আগে অবশ্য ভিন্ন পরিস্থিতি ছিলো। একটু আগে এক হাসছিলো, আনন্দ নিয়ে টফিতে ক্রিকেট দেখছিলো, আফগানিস্তান ভার্সাস বাংলাদেশ খেলায় হাইলাইট। আরেকজন কাঁদছিলো। কারণ ছেলের বউ পালিয়ে গেছে। এদের উপর ভরসা করা মানেই বৃথা। আউওয়াল সাহেব মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন, পাথরের মত কঠিন সিদ্ধান্ত। নাতী বিয়ে করছে করুক। কিন্তু তিনিও তার দাদা। এতো সহজে হাল উনি ছাড়বেন না। তার সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। সিদ্ধান্ত নেবার পর তিনি বেশ সগর্বে হাসলেন।

অভ্র, ঐন্দ্রিলা আসতে সবার প্রশ্নের বানে জর্জরিত হতে হলো ঐন্দ্রিলাকে। অভ্র তখন হুংকার ছেড়ে বললো,
“আগে বিয়ে হবে, তারপর সব প্রশ্নোত্তর”

সাবেরা মেয়ের দিকে তাকালো। কিন্তু ঐন্দ্রিলা মায়ের দিকে একবারও তাকালো না। হয়তো আজ এতটা হেনস্তা হতে হত না। মা যদি একটু তার কথাটা শুনতো। এতটা জোর জবরদস্তি না করত তাহলে এতো বিশ্রী সিদ্ধান্ত নিত না ঐন্দ্রিলা। সে একবারো ঐন্দ্রিলাকে বুঝতেও চায় নি। এখনো মহিলার ভাবমূর্তি অবিচল। কই একবার তো জড়িয়ে ধরতে পারতো সে। বলতে কি পারতো না,
“তুই কি কেঁদেছিস মা?”

না সে করে নি। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রুগ্ন কাজী অবশেষে বিয়ে পড়ালো। তিন কবুলের মাধ্যমে ঐন্দ্রিলা সারাজীবনের জন্য মিশে গেলো সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্রের সাথে। হয়ে গেলো বাকুয়ি বাড়ির বউ। অভ্র পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
“বউ, প্রস্তুত তো??”

ঐন্দ্রিলা হেসে বললো,
“প্রস্তুতি তুই নে। তোর জীবন যদি জিঙ্গালালা না করেছি আমার নাম ঐন্দ্রিলা মজুমদার নয়”
“বাবু তোমার নাম এমনেও এখন ঐন্দ্রিলা মজুমদার নয়। এখন তুমি মিসেস সৈয়দ মাহাবুল হক অভ্র”
“মরে যা”

মুখ খিঁচিয়ে বললো ঐন্দ্রিলা। অভ্র হেসে বললো,
“মরে গেলে পা ছড়িয়ে কাঁদবি”
“স্বপ্নে”

অভ্র হাসলো। অবশেষে সে বিবাহিত। শুধু তাই নয়, তার পুতুল এখন শুধু তার। এর মাঝেই আউওয়াল সাহেবের গম্ভীর স্বর কানে এলো,
“অভ্র এদিকে শোনো, কথা আছে”

******

অভ্র আউওয়াল সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আউওয়াল সাহেবের চোখজোড়া শান্ত। অভ্র তখন দাদাজানের সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছিলো। ঐন্দ্রিলা চলে যাওয়ায় মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাই বিনয়ী স্বরে বললো,
“দাদাজান, তখনের কাজের জন্য আমি দুঃখিত। ক্ষমা করবেন”

অভ্রের অনুতাপকে মোটেই মূল্য দিলেন না আউওয়াল সাহেব। বরং মেঘমন্দ্র স্বরে বললেন,
“আমাদের চুক্তির কথা স্মরণ আছে তো অভ্র?”

হুট করে দাদার কথায় চমকে গেলো অভ্র। বিমূঢ় চেয়ে রইলো কিছুটা সময়। দাদা তার চাহনী অগ্রাহ্য করে বললো,
“আমি চুক্তিটা ভাঙতে চাচ্ছি”

দাদার এহেন কথায় অস্থির হলো অভ্র। উৎকুন্ঠিত স্বরে বলল,
“মানে টা কি? আমি তো চুক্তির শর্ত পূরণ করেছি। আমি বিয়ে করেছি”
“তাতে কি? তোমার কি মনে হয় তোমার এই ছেলেমানুষী আমি মেনে নিবো? এই বিয়ের ভবিষ্যত কি?”

অভ্র কিছু বলতে গেলে দাদা খুব ঠান্ডা স্বরে বলল,
“যদি এক বছরের মাথায় আমাকে তুমি প্রমাণ করতে পারো তোমাদের বিয়ের ভিত্তি আছে, তাহলেই আমি আমাদের চুত্তি অনুযায়ী তোমাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিব”………………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৬তম_পর্ব

“যদি এক বছরের মাথায় আমাকে তুমি প্রমাণ করতে পারো তোমাদের বিয়ের ভিত্তি আছে, তাহলেই আমি আমাদের চুত্তি অনুযায়ী তোমাকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দিব”

দাদার শর্ত অচিরেই ভালোবাসার নাটক ফুরে শীতল যুদ্ধের আবহ তৈরি করলো দাদা-পৌত্রের মাঝে। অভ্রের চোয়াল শক্ত হল। ক্রোধ গিলে বললো,
“আপনি আপনার কথা পাল্টাতে পারেন না দাদাজান। টাকাটা আমার জন্য কতটা জরুরি আপনি জানেন। সব জেনে শুনে আপনি আমাকে ঠকাবেন?”

আউওয়াল সাহেবের পৌড় ঠোঁটে কৌতুকমিশ্রিত হাসি উন্মোচিত হলো। খুব শীতল স্বরে বললেন,
“ঠকিয়েছো তো তুমি আমাকে। কি বলেছিলে, এই মেয়েটা তোমার পছন্দের। একে অপরকে খুব ভালোবাসো তোমরা। আমিও সেটা ভেবেছি। তোমাদের একে অপরের প্রতি আচারণ দেখে আমি ভেবেছি যাক আমার নাতী শুধু শর্তের জন্য বিয়ে করছে না। নাতীর খুশিতে খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি আমার চোখে ধুলো দিয়েছো। মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসেই না। যার ফলাফল ছিলো আজকের ঘটনা। সে তো তোমাকে পছন্দ অবধি করে না। আর তুমি তাকে যে টাকার জন্য বিয়ে করো নি সেটার গ্যারেন্টি কি?। তুমি আমার টাকা পাওয়ার জন্য এমন নাটক করতেই পারো। তোমাদের বিয়ের কোনো ভবিষ্যত অন্তত আমি দেখছি না। দেখা যাবে আমি টাকা দিবো তুমি দু মাসের মধ্যে এই বিয়ে ভেঙ্গে দিবে। তোমার কি ভরসা? শোনো অভ্র, আমার টাকা আমার পরিশ্রম, ঘামের ফসল। তোমার নাটকের জন্য সেটা আমি তোমাকে দিব না।“

আউওয়াল সাহেব একটু থামলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এতো নাটকের প্রয়োজনও ছিলো না অভ্র। তোমার নিজস্ব পছন্দ ছিলো না যখন, আমাকে বলতে। আমি তোমার জন্য ভালো মেয়ে খুজতাম। অত্যন্ত নাটকের বিয়ে তোমাকে করতে হতো না”
“দাদাজান আপনি ভুল ভাবছেন। ঐন্দ্রিলাকে আমি টাকার জন্য বিয়ে করি নি। হ্যা এটা ঠিক আমি এখন বিয়ে করার পক্ষপাতী ছিলাম না। আমার ব্যাবসাটা স্টার্টিং পয়েন্টে। আমি সময় নিতে চেয়েছিলাম। তবে আমি যখন ই বিয়ে করতাম ঐন্দ্রিলাকেই করতাম। কারণ আমার জীবনে আমি অন্য কাউকে ভাবতেই পারি না। হ্যা, মানছি আমার টাকা দরকার ছিলো। তাই তো আমি আপনার থেকে চেয়েছি। আপনি আমাকে বিয়ের শর্ত দিয়েছিলেন। আপনি বলেছিলেন, আমি যদি বিয়ে করি তাহলে আপনি আমার ব্যাবসায় ইনভেস্ট করতে টাকা দিবেন। বিয়ে হয়েছে এখন আপনি শর্ত বদলাতে পারেন না। আর প্রমাণ করার প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে, যেখানে আমি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছি। এখানে দ্বিতীয় কথা আসবে কেন?”

অধৈর্য্য হয়ে বললো অভ্র। আউওয়াল সাহেবের স্বর আরোও গম্ভীর হলো,
“আমি কি বাচ্চা মানুষ? তোমার মত মানুষ চড়াই আমি। আমার চুল এভাবে পাকে নি। তুমি চিৎকার করে বললে তো সত্য বদলাবে না অভ্র। আসল কথা, ঐন্দ্রিলা তোমাকে পছন্দ করে না। তোমাদের বিয়ে একটা তাশের ঘর। যা ভেঙ্গে যেতে একটা দমকা হাওয়াই যথেষ্ট। আর যদি আমার নজর, অভিজ্ঞতা ভুল হয় তাহলে আমাকে ভুল প্রমাণ করো। এক বছরের মাঝে দেখিয়ে দাও তোমরা সুখী দম্পতি। তোমাদের একটা সংসার হওয়া সম্ভব। যেখানে ভালোবাসা থাকবে, ভবিষ্যত থাকবে। বড় পৃথিবীতে তোমাদের নিজস্ব পৃথিবী। যেখানে তোমরা একে অপরকে বুঝবে, একে অপরের হাল ধরবে, ভুল করবে, শিখবে। তারপর হাতে হাত রেখে জীবন পার করবে। আফসোস, এমন কিছুই হবে না। আরে যে মেয়ে তোমাকে ভালোই বাসে না তাকে নিয়ে তুমি ভবিষ্যৎ কি করে কাটাবে। তাই আমার শর্ত আমি পাল্টাবো। তুমি রাজী না হলে আমার জন্য ভালো, আমি টাকাগুলো বেঁচে যাবে”

অভ্রের মুখখানা রাগে রক্তিম হয়ে যাচ্ছে। দাদার এমন আচারণ তার অসহ্য লাগছে। প্রবীন মানুষটির গিটে গিটে বদ বুদ্ধি। ইচ্ছেকৃত ভাবে তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর ফন্দি। সে আসলে মেনেই নিতে পারছে না অভ্র তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে। তার পছন্দের মেয়েদের ছেড়ে অভ্র নিজের মর্জি চালিয়েছে। আউওয়াল সাহেব স্বভাবগত কারণে অতিরিক্ত দম্ভে পরিপূর্ণ, আত্মজেদি এবং কন্ট্রোল ফ্রিক। তিনি অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চান সবার জীবন। বড় ছেলে এবং ছেলের বউ তার ইশারায় চলে। ইদ্রিস সাহেব এতটাই তার আদেশ মেনে চলে যে, অভ্রের মনে হয় মানুষটা বাথরুমে গেলেও বাবার অনুমতি নিবে। কিন্তু অভ্র ব্যতিক্রম। আউওয়াল সাহেবের সকল স্বভাব তার মাঝে আছে, অতিরিক্ত জেদি, দাম্ভিক এবং কন্ট্রোল ফ্রিক। নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সে সতেচন। ফলে নিজের জীবনে অন্য কারোর ছড়ি ঘুরানো অতীব অপছন্দ অভ্রের। তাই তো সে চলে নিজের মর্জিতে। বেপরোয়া সে জীবনের প্রতি। এইকারণে পাশ করার পরও সে চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিজের ব্যাবসা শুরু করে। এখন সেই ব্যবসাকে বাড়াতে চায় সে। তাই তো দাদার নিকট টাকা চাওয়া। আর এই চতুর খেঁকশেয়ালের মতো মানুষটি তাকে টোপের পর টোপ দিয়ে যাচ্ছে। রাগে গা রিরি করছে অভ্রের, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। শানিত স্বরে বললো,
“আপনি আসলে মানতেই পারছেন না আমি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছি। আজও আমি আপনার অবাধ্য হয়েছি। এতটা সহজে আপনার শর্তও পূরণ করে ফেলেছি। আপনার আত্নসম্মানের দেওয়ালে আঘাত লেগেছে। দম্ভ সত্ত্বার এমন আঘাত আপনি সইতে পারছেন না”

আউওয়াল সাহেব হাসলেন। মৃদু কাঁপলো প্রবীন দেহ। লাঠিটা শক্ত করে ধরে বললেন,
“আমার আত্মসম্মান এতো নগন্য নয়। হ্যা, এখন ঐন্দ্রিলাকে আমার পছন্দ নয়। কিন্তু আমি তাকে মেনে নিয়েছি। যেহেতু সে আমার নাতবউ। কিন্তু কতদিন সে আমার পরিবারে থাকে সেটাও তো আমার দেখার বিষয়। আমার বয়স হয়েছে, আমি চাই আমার পরিবারটি যেন শক্তপোক্ত থাকে। ছেলে, বউ, নাতী, নাতবউ, পোপৌত্র—এগুলো এই বয়সের সবার কাম্য। আমিও ব্যতিক্রম নই। এজন্যই তোমার বিয়ের জেদ করেছি। কিন্তু সেই বিয়ের যদি মূল্য না থাকে তাহলে আমার জেদের কি মূল্য? তাই বলছি তুমি সংসার কর, এক বছরের মাথায় একটা পোপৌত্রের মুখ দেখাও। আমি টাকা দিয়ে দিবো তোমাকে। টাকা নিয়ে তো কবরে যাব না”
“বেশ, চেক রেডি রাখেন। এক বছর পর কথা হবে। আমার বউ শুধু আমাকে ভালোইবাসবে না। আমাদের বাচ্চাও হবে”

দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বললো সে। এক মুহূর্ত দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ফলে গটগট করে বেরিয়ে গেলো সে। আউওয়াল সাহেবের ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ হলো। তার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সফল।

*******

নিজের ঘরের খাটের উপর বসে আছে ঐন্দ্রিলা। সামনে একটা খোলা ট্রলি ব্যাগ। জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আজ থেকে অন্য বাড়ি, অন্য ঘরে তাকে থাকতে হবে। নিজের ঘরে চোখ বুলালো ঐন্দ্রিলা। কত শত স্মৃতি, কত শত মুহূর্ত। কান্না, হাসির, রাগের। আজ থেকে সেই স্মৃতিগুলো থাকবে তবে ঐন্দ্রিলা থাকবে না। মানুষ বলে বিয়ের পর নাকি নিজের ঘর, বাড়ি আর নিজের থাকে না। মেয়েদের জীবনের নিয়তি এমন। বিয়ের পর তাদের সব কিছু শ্বশুরবাড়ি। ঐন্দ্রিলা জানালা দিয়ে তাকালো অভ্রের ঘরের দিকে। আচ্ছা, ঐ ঘরটা কি কখনো নিজের হবে? ঐবাড়িতেও সে নিজের মর্জি দেখাতে পারবে? তার মন খারাপ হলে বাবা আইসক্রিম নিয়ে আসতো, ঘরে ভাংচুর করলে মা কিছু বলতো না। প্রতি মাসে সে ভাংগন তহবিলে টাকা রাখতো। চামচটাও তার ধুয়ে খেতে হয় নি কখনো। ছোটবেলা থেকে নীলাদ্রি এবং ঐন্দ্রিলার মাঝে ভালোবাসার দাড়িপাল্লাটা ঐন্দ্রিলার ভারী ছিলো। মাঝে মাঝে তো সে নীলাদ্রিকে বলতো,
“ভাইয়া আমার মনে হয় তোকে ময়লার ডাস্টবিন থেকে তুলে আনা হয়েছে। সিনেমায় দেখায় না স্বামী-স্ত্রীর বাচ্চা হয় না বলে বাচ্চা রাস্তা থেকে নিয়ে আসে। তারপর তাদের কোল আলো করে রাজপুত্র আসে। আমার মনে হয় রাস্তার ছেলেটা তুই”

আর নীলাদ্রি কেঁদে ভাসাতো। ছবি এনে মুখের সামনে এনে বলতো,
“আমি মোটেই রাস্তার ছেলে নই, এইযে প্রমাণ আমি হসপিটালে হয়েছি”

ঐন্দ্রিলা তখন নির্লিপ্ত ভাবে বলতো,
“তাহলে মনে হয় তোকে হাসপাতাল থেকে তুলে এনেছে”

তারপর নীলাদ্রির কান্না আরোও বাড়তো। কথাগুলো ভাবতেই হেসে উঠলো ঐন্দ্রিলা। এর মাঝেই কড়া পড়লো দরজায়,
“কে?”

সাবেরা থমথমে স্বরে বললো,
“আমি”

মায়ের স্বর শুনতেই জড়োসড়ো হয়ে বসলো ঐন্দ্রিলা। বাসায় ফিরে আসার পর থেকে মায়ের সাথে কোনো কথা হয় নি সে। এখন বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে। একটুপর অভ্রের সাথে ও বাড়ি চলে যেতে হবে তাদের। সাবেরা ভেতরে প্রবেশ করলেন। বসলেন মেয়ের পাশে। নিস্তব্ধতা ভর করলো ঘরে। ঐন্দ্রিলা তার মত গোছগাছ করছে। সাবেরা বসে রইলো। কোনো কথা বললো না। ঐন্দ্রিলা সব জামাকাপড় গুছিয়ে ফেললো। লাগেজ আটকে বলল,
“আমার গুছানো শেষ”
“হুম”

মায়ের এমন শান্ত আচারণে অভিমানের পরদ গাঢ় হলো। একটিবার জিজ্ঞেস করা যেত না “তুমি কেনো কাজটা করেছো?” একবার শুধানো যেত না “বিয়ের পর তোমার কেমন লাগছে? মন কি ভালো আছে?”—না তার মা কোনো কিছু শুধালো না। ঐন্দ্রিলা ভেবেছিলো মা হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারবে। মেয়েকেও বকবে তার ভুলের জন্য। তারপর জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না। ঐন্দ্রিলা যখন লাগেজটা টেনে বেরিয়ে যেতে নিলো তখন সাবেরা ধীর স্বরে বললো,
“এই বাড়িটা তোমার ছিলো, তোমার আছে। বিয়ে হয়ে গেছে বলে মেয়েদের বাড়িতে অধিকার থাকে এসব বুলশিট মনে রাখার দরকার নেই। কখনো কোনো সমস্যা হলে এই বাড়িতে চলে আসবে”
“এসে কি হবে? শুধু থাকার স্থান?”

খুব শান্ত স্বরে কথাটি বললো ঐন্দ্রিলা। সাবেরা কপাল কুচকাল। গম্ভীর স্বরে বলল,
“এটা তোমার বাড়ি, এসে কি হবে মানে?”
“বিয়ের আগেও তো আমার বাড়ি ছিলো। কতবার নিজের মনের কথা বলতে চেয়েছি। নিজের পছন্দ, অপছন্দ জাহির করতে চেয়েছি। কই তখন তো কেউ শুনে নি। এখন তো বিয়েই হয়ে গেছে। এখন কি তার শোনা হবে? চিন্তা কর না, আমার সমস্যা হবে না। আমি খুব গুছিয়ে সংসার করবো দেখো”

বলেই ম্লান হাসলো সে। সাবেরা অপরাধীচোখে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কখনোই তার মাকে বুঝবে না।

********

রাত দুটোটা নাগাদ বধুর গৃহপ্রবেশ হলো। বধুবরণ করলেন কানন। অভ্রের পরিবার একান্নবর্তী পরিবার নয়। কিন্তু এখন তা একান্তবর্তী পরিবার থেকে কম নয়। বিয়ে উপলক্ষে অভ্রের তিন খালা, চাচারা সবাই এসেছে। শুধু অভ্রের আপন ছোট ভাই আসতে পারে নি। লাস্ট সময় তার ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়েছে। ঐন্দ্রিলার বরণ পর্ব শেষ হতেই খালারা ঘিরে ধরলো। তারা অত্যন্ত আন্তরিক। না একটু বেশি আন্তরিক। যে বউ পালিয়ে গিয়েছিলো সেই বউকে নিয়ে এতোটা হুল্লোড় কে করে জানা নেই ঐন্দ্রিলার। এক খালা তো শুধিয়েই বসলো,
“আচ্ছা বউ, তুই ভারি শাড়ি নিয়ে কি করে পালালি। জানালা থেকে নামতে কষ্ট হয় নি? উষ্টা খাইলে দাঁত ভাইঙ্গে যাইতো তো”
“আমি জানালা দিয়ে পালাই নি”

ঐন্দ্রিলার বিব্রত উত্তরের সাপেক্ষে তাদের কৌতুহল বাড়লো। আরেকজন অবাক নয়নে শুধালো,
“তাইলে পালাইলি কেমনে? মানে হগগলের সামনে দিয়া মেইন গেট দিয়া বাইর হইছোস”

ঐন্দ্রিলা কি উত্তর দিবে জানা নেই। এর মাঝে কানন সব খালাদের ধমক দিল। নিজ হাতে বউকে নিয়ে গেলেন অভ্রের ঘরে। মিষ্টি করে বললেন,
“তোমার লাগেজ রাখা ভেতরে। তুমি রেস্ট কর কেমন। কত ধকল গেছে আজকে”

ঐন্দ্রিলা জোর করে হাসলো। মহিলা চলে যেতেই সে একবার ঘরের দিকে তাকালো। কি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। খাটে লাল গোলাপ দিয়ে লাভ বানানো হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। জীবনটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা তার দিকে তাকাতেই ফিচেল হেসে বলল,
“বাবু, বরের আদর খাওয়ার জন্য রেডি?”………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি