মনশহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৭+১৮

0
40

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৭তম_পর্ব

“বাবু, বরের আদর খাওয়ার জন্য রেডি?”

অভ্রের এমন উৎকট কথাবার্তায় অভ্যস্ত ঐন্দ্রিলা। এইসব কিছুর একটাই উদ্দেশ্য সেটা হলো ঐন্দ্রিলার অস্থিমজ্জায় স্ফুলিঙ্গের সঞ্চালন। ঐন্দ্রিলাকে রাগাতে যেন পৈশাচিক আনন্দ পায় সে। তার মুখের ভঙ্গিমাতে স্পষ্ট সেই আনন্দের ঝলক নজরে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ঐন্দ্রিলা। মনটা ঝিমিয়ে আসছে। শরীরটাও জানান দিচ্ছে সে ক্লান্ত। ভারি শাড়ি, গয়না আর এই মুখের উপর বস্তাভরা মেকাপ, উপরন্তু সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি ঘটা ঘটনা সব মিলিয়ে শরীরটা ঝিমঝিম করছে। এখন এই বিশ্রী, ভারী শাড়িটা খুলে ফেলতে পারলেই শান্তি। ফলে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“”ফাজলামি বাদ দে অভ্র, আমি খুব ক্লান্ত। এখন ঘুমাবো”

অত্যধিক শান্ত, বিকারহীন স্বর ঐন্দ্রিলা। অভ্র কিছু সময় চেয়ে রইলো। ঘরময় নিস্তব্ধতা। ঐন্দ্রিলা তাকে দিকে আর তাকালো না, এতো সময় নেই তার নিজের লাগেজটা খুলতেই যাবে ঠিক সেই সময় খপ করে হাতটা ধরলো অভ্র। হ্যাচকা টানে নিজের সন্নিকটে নিয়ে এলো। তাদের মাঝে দুরত্ব নেই বললেই চলে। ঐন্দ্রিলা চমকালো, থমকালো। বিস্মিত নয়তে চাইতেই অভ্রের নেশাতুর নয়ন পরিলক্ষিত হলো। সাংঘাতিক সেই দৃষ্টি। কিছু পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা। নিজেকে বাধন থেকে ছাড়াতে চাইলো ঐন্দ্রিলা। কিন্তু এই নব্বই কেজির ষাড়ের জোরের সাথে পারলো না। অভ্রের এমন উদ্ভট আচারণে ধরফর করছে বুক। ঐন্দ্রিলা জড়স্বরে বললো,
“ছাড় অভ্র, ভালো লাগছে না”
“ছাড়াছাড়ি হবে না ঐন্দ্রি। ভুলে যাস না তুই আমার স্ত্রী। শুধু শরীর নয়, পুরোদস্তর তোর উপর আমার অধিকার। কোনো ছাগলই হবে যে অধিকার থাকতেও সেটা কাজে লাগায় না। আমি সেই ছাগল নই”

অভ্রের কন্ঠ শীতল। তার মুখে সেই ফিঁচেল হাসিটা মিলিয়ে গেছে। চাহনী বদলে গেছে। এ এক অপরিচিত চাহনী। এতকাল অভ্রকে চিনতো পাশের বাড়ির অভদ্র ছেলে হিসেবে, যে তাকে জ্বালাতন করে, ঐন্দ্রিলার পঁচিশ বছরের জীবনের একমাত্র শত্রু এই ছেলেটি। অথচ আজ সব বদলে গেছে। সে এখন তার স্বামী। শত্রু অভ্রকে পড়ার ক্ষমতা থাকলেও এই স্বামী অভ্রকে পড়তে পারলো না। একটা চিন্তার রেশ ধরে উঁকি দিলও হাজারো প্রশ্ন। ঐন্দ্রিলা যখন চিন্তার ভিড়ে অস্থির ঠিক সেই মুহূর্তে অভ্র তাকে কোলে তুলে নিলো। ঐন্দ্রিলার বিস্ফারিত নয়ন তাকে দেখলো। অভ্র তার বিস্মিত, হতবাক নয়নকে দু পয়সার দাম দিল না। হাটা শুরু করলো ফুলসজ্জিত খাটের দিকে। ঐন্দ্রিলা এবার ভড়কালো,
“মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? কি করছিস?”
“যা বাসর রাতে সব স্বামী স্ত্রী করে। নিশ্চয়ই আমি তোকে এখানে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখার জন্য বিয়ে করি নি”

অভ্রের কন্ঠও যেন অপরিচিত লাগলো ঐন্দ্রিলার। ফলে বিশ্রী অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলো সে। কিন্তু তার ছটফটানিকে উপেক্ষা করলো অভ্র। ঐন্দ্রিলাকে একরকম ছুড়ে মারলো যেন খাটে। তারপর তার উপর ভর দিয়ে ঝুকলো। ভারী শরীরটা মিশিয়ে ফেললো পাতলা তনু। ফুলের কারুকার্য একেবারে এলোমেলো হয়ে গেলো। বিক্ষিপ্ত হলো ঐন্দ্রিলার চিন্তাগুলোও। বিমূঢ় হয়ে গেলো মস্তিষ্ক। হুট করেই মস্তিষ্ক বললো,
“এটাই তো ছিল ভবিতব্য। সে তোমার স্বামী। ঘনিষ্ট তো সে হবেই”

ঐন্দ্রিলা তার ছটফটানি থামিয়ে দিলও। ক্ষান্ত হয়ে গেলো মনশহরের কালবৈশাখী। শ্রান্ত শরীরটা ছেড়ে দিল। অভ্র তার কাছে এলেও সে নির্বিকার রইলো। অভ্র তার কাছে আসতেই সে নিস্তেজ হয়ে গেলো। মুখখানা ফিরিয়ে নিলো। অভ্র থামলো। দেখলো গাঢ় নয়নে। আপাতদৃষ্টিতে সবার মনে হতে পারে ঐন্দ্রিলা তার প্রতিবাদ, বিদ্রোহ সব থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অভ্র বুঝলো মেয়েটা তার হৃদয়প্রকোষ্ঠে তুলেছে অভেদ্য দেওয়াল। অভ্র হাসলো। পরমুহূর্তেই উঠে গেলো সে। ঐন্দ্রিলার উপর থেকে ভারী শরীরটা সরে যাওয়াতে অবাক হলো সে। চোখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখলো অভ্র তার আলমারীর কাছে চলে গেছে, একটা নীল টিশার্ট আর শর্টস বের করে চলে গেলো সে বাথরুমে। অতঃপর শাওয়ারের তীব্র শব্দ কানে এলো। ঐন্দ্রিলা বিমূঢ় শুয়ে রইল। ছেলেটা কি চায়? এমন বেপরোয়া আচারণ কেনো?

মিনিট বিশেক বাদে বের হলো অভ্র। ভেজা চুল থেকে বিন্দু বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ছে শ্যাম মুখে। টাওয়ালটা ছুড়ে মারলো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা হতবাক তাকিয়ে আছে। রাগী স্বরে বললো,
“কি?”
“ছড়িয়ে দে”

বলেই নির্বিকার চিত্তে বিছানার কাছে চলে এলো সে। বিনা ভনীতায় হিংস্র জীবের মতো ছিড়ে ফানাফানা করে ফেললো বিছানার সব সাজসজ্জ। অতঃপর সেই উচ্ছেদ্য ফুলগুলো স্তুপ করে ফেলে দিল ঘরের কোনে। ঐন্দ্রিলা হা করে তাকিয়ে রইলো উন্মাদ ছেলেটির কান্ডকারখানায়। অভ্রের মুখে ছড়িয়ে আছে বিরক্তি। ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি ওই মুভি সিনেমার মত ঢং পারি না। আমার খাট ছাড়া ঘুম হয় না। আমি বামপাশে ঘুমাই। এখন তুই বুঝে নে কি করবি”

বলেই ধরাম করে শুয়ে পড়লো অভ্র। বিকট শব্দ হলো। ঐন্দ্রিলা অবাক হলো খাটের মজবুতি দেখে। এতো বিশালকায় লোকটা এভাবে ধরাম করে শুলেও কিছুই হলো না খাটের। ঐন্দ্রিলার রাগ হচ্ছে এই উন্মাদসুলভ কাজে। ফলে ক্রোধিত স্বরে শুধালো,
“এমন পাগলামি করছিস কেনো? আমার রাগ নির্জীব বস্তুর উপর ঝাড়ছিস?”
“কে বলেছে আমি রেগে আছি?”

মুখখানা ফিরিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে শুধালো অভ্র। ঐন্দ্রিলা থতমত খেলো। অভ্র তার উত্তর অপেক্ষা না করেই বলল,
“আমি আমার ঘরে এভাবেই থাকি। এমন উচ্ছৃঙ্খল, এমনই জানোয়ারসুলভ আমার আচারণ। আমি কারোর জন্য নিজেকে বদলাতে পারবো না। তুই আমার স্ত্রী ঐন্দ্রি। আমাকে এখন একটু চিনতে শেখ। এই জানোয়ারের সাথেই তোকে থাকতে হবে চিরকাল। তোর কি ধারণা, আমি সে*** করতে পারি নি বলে এমন আচারণ করছি? শোন, আমি এতোটা পার্ভার্ট না। আমার কিছু নিজস্ব নৈতিকতা আছে, রুলস আছে। আমার স্পর্শে যদি আমার বউ লজ্জাই না পায় তবে পুরুষ হিসেবে আমি ব্যর্থ। যেদিন আমার স্পর্শে তোর হৃদয় কাঁপবে সেদিন আমি তোর থেকে আমার অধিকার আদায় করে নিবো”

বলেই কোলবালিশটা জড়িয়ে চোখ বুজে ফেললো অভ্র। ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে রইল বিমূঢ়। নাহ! সে ভুল। এই পুরুষকে বোঝার ক্ষমতা তার নেই। কোনো কালেই ছিলো না।

*********

নিগুঢ় রাত। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। হুট করেই অনুভব হলো একটা পাথরের বস্তা গলার কাছে ধপ এসে পড়লো। তার পেটের উপরও একটা পাথরের বস্তা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ লাগছে। এই বুঝি পড়ে যাবে সে। কিন্তু সে তো ঘুমিয়েছিলো অভ্রের ঘরে। অভ্র কি তাকে মেরে ফেলার জন্য তাকে পাথর চাপা দিয়েছে। চিন্তাটা মস্তিষ্কের কোষে জাগ্রত হতেই তড়িৎ গতিতে চোখ মেললো ঐন্দ্রিলা। ঘর অন্ধকার। আশপাশটা দেখতেই অনুভূত হলো সে অভ্রের ঘরেই কাছে। মস্তিষ্ক একটু জাগ্রত হতেই অনুভব করলো সে হাত পা নাড়াতে পারছে না। অস্থির হলো চিত্ত। পর মুহূর্তেই নিজেকে শান্ত করলো যখন বোধ হলো তার উপর কোনো পাথরের বস্তা না, এগুলো অভ্রের হাত, পা। একটা মানুষ এতো বাজেভাবে কি করে ঘুমাতে পারে? অভ্রের হাত তার গলার উপর। পা পেটের উপর। ঐন্দ্রিলার দম আটকে আসার যোগাঢ় হলো। হালকা শরীরের সকল শক্তি পুঞ্জিভূত করে ধাক্কা দিলো সে অভ্রকে। কিন্তু সে সরার বদলে নড়ে আরোও সন্নিকটে চলে এলো। মুখ গুজলো ঐন্দ্রিলার ঘাড়ে। শরীরের সমস্ত ভর ঐন্দ্রিলার উপর। ঐন্দ্রিলা ধাক্কাধাক্কি করলো কাজ দিল না। অভ্রের কোলবালিশ অবহেলায় পড়ে আছে মেঝেতে। আর সে ঘুমিয়ে আছে ঐন্দ্রিলার উপর। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়লো সে। শরীর ছেড়ে দিলো। তলিয়ে পড়লো গভীর ঘুমে।

****

ঐন্দ্রিলার সারা শরীরে ব্যাথা। ঘুম ভাঙলো খুব দেরিতে। পাথরটা এখনো ঘুমে। সারাটা রাত ঐন্দ্রিলার উপর এভাবে বেঘোরে ঘুমিয়েছে এই মানব। আর সহ্য হচ্ছে না। ফলে নিজের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো সে অভ্রকে। ধাক্কাটা এবার কাজে দিল। গড়িয়ে পড়ে গেলো অভ্র। ফলে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করলো পৃথিবীকে। ঐন্দ্রিলা কোপিত স্বরে বলল,
“আরেকবার এমন করলে দেখিস কি করি”

বলেই উঠে গেলো সে। অভ্র হতবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো। বুঝতে পারলো না হলো টা কি

*****

নতুন বউ এতো দেরি করে উঠেছে ব্যাপারটি বেশ আলোড়ণ তৈরি করলো। উপর থেকে ঐন্দ্রিলার পা ফেলতেও যেনো কষ্ট হচ্ছিলো। নব্বই কেজি ওজনের একটা পাথর যদি নিজের সব ভার ছেড়ে তার উপর ঘুমায় এই ছোট দেহ কি সইতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা অন্যভাবেই নিলো অভ্রের তিন খালা। একজন তো খাওয়ার টেবিলেই বলে উঠলো,
“কাইলরাত কি খুব ধকল গেছে বউ”

খেতে খেতে বিষম খেলো ঐন্দ্রিলা। নাকে মুখে উঠলো খাবার। তাড়াতাড়ি পানি খেলো সে। ততসময়ে নিচে এলো অভ্র। চেয়ার টেনে বসলো। ঐন্দ্রিলা তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। এর মাঝে আরেক খালা বলে উঠলেন,
“তা বউ, বাচ্চার মুখ দেখাবা কবে?”

ভদ্রমহিলার কথা শুনে জমে গেলো ঐন্দ্রিলা। কি উত্তর নেওয়া উচিত তার জানা নেই। নতুন বউদের মতো লজ্জা পেয়ে মাথা নত করার কথা অভ্যাস না নেই। তাই সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো খালার দিকে৷ ঠিক তখন পাশ থেকে অভ্র মুখে খাবার পুরে বললো,
“এটা কি ফুডপান্ডা খালা? অর্ডার দিলাম আর আধা ঘন্টায় ডেলিভারি! সময় লাগে এসবে। চিন্তা করো না, অর্ডার দিয়েছি, এগারো মাসে কোনো না কোন নিউজ পেয়ে যাবা।

অকপটে খাবার ঘর ভর্তি লোকের সামনে উত্তর দিল অভ্র। ঐন্দ্রিলা মনে মনে বলল,
“আল্লাহ, মাটিটা ফাঁক হয়ে যাক। আমি ঢুকে পড়ি। আর সহ্য হচ্ছে না”

********

খাওয়া দাওয়া শেষে ঐন্দ্রিলা গেলো রান্নাঘরের দিকে। কানন তখন খুন্তি নাড়তে ব্যাস্ত। ছবিরণ পটল কাটছে। সকাল থেকেই মেঘলা করে আছে আকাশ। তাপ নেই সূর্যের। তাই দুপুরের রান্না খিঁচুড়ি, বেগুন ভাঁজা, পটল ভাঁজা আর গরু মাংস ভুনা। ঐন্দ্রিলা শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কানন খুন্তি নাড়তে নাড়তে বললো,
“কিছু লাগবে তোমার?”
“আপনি আমার উপর রেগে নেই মা?”

খুন্তি থেমে গেলো কাননের। পাশ ফিরে দেখলো ঐন্দ্রিলা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। কানন মৃদু হাসলো। স্মিত স্বরে বললো,
“সত্যি শুনতে চাও তুমি?”

কাননের কথায় বুকখানা ধক করে উঠলো ঐন্দ্রিলার। মুখখানা মিয়ে গেলো। ভয় ঘিরে ধরলো তাকে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, এখন এই বাড়িটাই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। আর এই বাড়ির মানুষগুলো তার আপনজন। কানন ধীর গলায় বললো,
“যখন প্রথম জানলাম তুমি পালিয়ে গেছো, আমার খুব রাগ হয়েছিলো। তোমার উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম। কষ্ট পেয়েছিলাম। ছেলের মা আমি, নিশ্চয়ই আমি চাইবো না কেউ আমার ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করুক। কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন জানলাম তুমি ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসতে। অভ্রের জন্য তুমি কেঁদেছো, আমার মনে হলো তুমি ভুল করো নি। আমিও এমন ছেলের সাথে সংসার করতে চাইবো না যে আমাকে কাঁদায়। আবার রাতে যখন তুমি অভ্রের সাথে ফিরে এলে আমি আমার অভ্রের দিকে চাইলাম। জানো ঐন্দ্রিলা ওকে এতোটা খুশি আমি কখনো দেখি নি। আমার ছেলে জেদি, আমার ছেলে একগুয়ে কিন্তু বড্ড বেপরোয়া। ও কোনো কিছুতেই খুব এট্যাচড হয় না। যখন হয় সেটাকে ছাড়ে না। আমার বদ্ধধারণা আমার ছেলেটা এবার একটু শুধরাবে। তোমার জন্য হলেও সে তার উদাসীনতা ছাড়বে। তাই তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই”

মহিলা কতটা সহজে কথাগুলো বললো। ঐন্দ্রিলা অবাক হলো। এমন স্বচ্ছভাবেও মনের কথা বলা যায়?

বিকেল হতেই তিনখালা নতুন তাল তুললো। ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে তারা ঘুরতে যাবে। বৌভাতের পর ঐন্দ্রিলা নাইওরে চলে যাবে আর খালারা তলপি তলপা গুটিয়ে চলে যাবে। তাই আজকে তারা ঘুরতে যাবে। একটা কাতান ধরিয়ে দিলও তারা ঐন্দ্রিলার হাতে। বললো,
“যাও বউ, বউ সাইজ্জা আও। আমরা আজকে ঘুরুম”

কিন্তু বিপাক হলো অন্যখানে। ঐন্দ্রিলা শাড়ি পড়তে পারে না। এতদিন পিউ ছিলো তার ভরসা। তাই তো সকাল থেকেও সে সালওয়ার কামিজে ঘুরছিলো। এখন শাড়ি পড়ার কথা শুনতেই জ্বর এলো ঐন্দ্রিলার। তালবাহানা করলো। কিন্তু জেদি মধ্যবয়স্কদের সামনে কাজ হলো না। ফলে জোরপূর্বক শাড়ি পড়তে যেতেই হলো। এখন দুনিয়ায় পারি না বলে কথা নেই। ইউটিউবে সার্চ দিলেই সবাই সব পারে। ঐন্দ্রিলাও তাই করলো। ইউটিউব সার্চ করে টিউটোরিয়াল বের করলো। শাড়ি পড়ার বেশ ভালো ভিডিও বের করলো। কাঁধে ভারী আচলটা রেখে কুচিগুলো সুন্দর করে সাজাচ্ছিলোই অমনি ধরাম করে দরজা খুলে ফেললো কেউ। আৎকে উঠতে কুঁচিগুলো সব হাত থেকে ছুটে গেলো। কুঁচি সামলাতে যেয়ে আঁচলটাও বেসামাল হলো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র…………

চলবে

#মনশহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
#১৮তম_পর্ব

কাঁধে ভারী আচলটা রেখে কুচিগুলো সুন্দর করে সাজাচ্ছিলোই অমনি ধরাম করে দরজা খুলে ফেললো কেউ। আৎকে উঠতে কুঁচিগুলো সব হাত থেকে ছুটে গেলো। কুঁচি সামলাতে যেয়ে আঁচলটাও বেসামাল হলো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। তার শান্ত দৃষ্টি ঐন্দ্রিলার হতভম্ব মুখখানার দিকে। ঐন্দ্রিলা তন্মধ্যে তড়িঘড়ি করে আঁচলটা আকড়ে ধরলো। আকস্মিক ঘটনায় মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে গেলো। হাতপা কেমন ঠান্ডা হতে লাগলো। সোজা হয়ে ড্রেসিং টেবিল গেসে দাঁড়ালো সে। হাত থেকে কুঁচি ছুটে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অপ্রস্তুত স্বরে বললো,
“তুই এখানে কি করছিস? আমি তো লক করেছিলাম”

অভ্রের ঘরের লকটা নষ্ট। নষ্ট করেছে অভ্র নিজেই। এটা নতুন নয়। রগচটা মানুষটির রাগের স্বীকার প্রায় দরজা, জানালা, দেওয়ালকে ভোগ করতে হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক এই বাড়িতে। ইদ্রিশ সাহেব পাত্তা দেন না। অভ্রের ঘরের দিকে তিনি ভুল ক্রমেও নজর দিবেন না, এবং ঘোষণা করেছেন অভ্রের এমন কাজের জন্য তিনি একটা পয়সা খরচ করবেন না। থাকুক লক ছাড়া। কোনোদিন যদি অভ্রের জন্য এই ঘরের দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে বা ছাঁদ খসে যায় তবুও ইদ্রিস সাহেবের ভ্রুক্ষেপ হবে না। বরং তিনি গদগদ স্বরে বলবেন,
“এই চোটে আমার ঘর ছাড়ো”

কিন্তু ঐন্দ্রিলা এই কাহিনী জানে না। তাই সে লক তো দিয়েছে কিন্তু লক হয় নি দরজা। অভ্র তার বিব্রত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে একেবারেই উপেক্ষা করে দরজার ছিটকিনি আটকে দিল। তারপর নির্বিকার চিত্তে নিজের গায়ের টিশার্টটি খুলে উদাম গায়ে খাটের উপর টানটান হয়ে শুলো। পরণে শুধু ঘিয়া রঙ্গের একটা প্যান্ট তার। তার এহেন কার্যে তাজ্জব হল ঐন্দ্রিলা। চোয়াল ঝুলে গেলো। একটা পুরুষ এতোটা অসহ্য কেন হবে? তার টিশার্টটা অবহেলায় পড়ে আছে চেয়ারের উপর। তার অনাবৃত ঘর্মাক্ত, ক্ষীণ লোমশ বুকখানা দেখতে পাচ্ছে ঐন্দ্রিলা। সেই সাথে উন্মুক্ত হয়ে আছে পেটের ধারের কিছু পুরাতন, ক্ষীণ মিলিয়ে যাওইয়া দাগ। ঐন্দ্রিলার মনে হলো তার শরীরের সব রক্ত আলোর বেগে মাথায় উঠে গেছে। নাক, মুখ লাল হয়ে গেলো অসহনীয় রাগে। ফলে কুপিত স্বরে বললো,
“নির্লজ্জের মতো শুয়ে আছিস কেনো? বের হ ঘর থেকে। দেখছিস না আমি শাড়ি পড়ছি।”

চোখের উপর বাম হাতটা রেখে নির্বিকার চিত্তে শুয়ে আছে অভ্র। হেলদোল নেই। ঐন্দ্রিলার অগ্নিবানী তার কানে আসছে না। ঐন্দ্রিলা আবার শুধালো,
“কথা কানে যাচ্ছে না? আমি বললাম তো আমি শাড়ি পড়ছি, বের হ ঘর থেকে”

এবার হাত সরিয়ে চোখ মেললো অভ্র। মোটা কন্ঠে শান্ত স্বরে বলল,
“প্রথমত তুই শাড়ি পড়ছিস না, এক থান কাপড়ের সাথে কোদাকোদি করছিস। দ্বিতীয়ত ঘরটা আমার, এই ঘরের সবকিছু আমার। তাই আমি মোটেই বাহিরে যাবো না। এখন আমি ঘুমাবো। তোর ইচ্ছে হলে তুই যা”

অভ্রের কথা ছ্যাত করে উঠলো ঐন্দ্রিলা। প্রেসার কি বেড়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রিলার। কে জানে? তবে তার মাথা এতোটা গরম যে নিঃসন্দেহে ডিম সেদ্ধ হয়ে যাবে। রাগে গজরাতে গজরাতে বললো,
“এই ঘর আমারও, এখানের সব কিছু আমারও”
“তাহলে আমিও কি তোর?”

মাথাটা কাত করে গাঢ় স্বরে শুধালো অভ্র। ঐন্দ্রিলা থমকে গেলো। শব্দ হারিয়ে ফেললো কি বলবে। অনেকক্ষণ হাতরালো ঝগড়া করার অস্ত্র, আফসোস পেলো না। ফলে চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে ঘুরে গেলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“এদিকে তাকাবি না”

অভ্র শব্দ করে হেসে উঠলো। সেই হাসির শব্দ দেওয়ালে আন্দোলিত হলো। সহাস্য কন্ঠে বললো,
“আমার তোকে দেখার জন্য তোর দিকে তাকাতে হয় না”

ঐন্দ্রিলা আয়না থেকে তাকে দেখলো। নির্লজ্জের মতো হাসছে। ফলে রাগে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা ক্রিমের ডিব্বা ছুড়ে মারলো অভ্রকে উদ্দেশ্য করে। কিন্তু অভ্র সরে যাওয়ায় সেই ডিব্বা লাগলো খাটের পাশের ফুলদানিটার গায়ে। ফলে মুহূর্তেই চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেলো। অভ্র ঘাড় কাত করে সেই ভাঙ্গা অংশগুলো দেখলো। হাসি থামার বদলে যেনো আরোও বেড়ে গেলো। টিটকারীর স্বরে বললো,
“বাহ, প্রথম দিনেই রুপ দেখিয়ে দিলি”

ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে হলো তার বর নামক বর্বর পুরুষটার মাথা ভেঙ্গে চার ভাগ করে ফেলতে। তারপর এই ঘর লন্ডফন্ড করে দিতে। কিন্তু নববধু হয়ে বিয়ের প্রথম দিন এমন তান্ডব করলে নিশ্চিত আউওয়াল সাহেব তাকে বের করে দিবে। তখন যেয়ে উঠতে হবে মায়ের বাড়িতে। কিন্তু আগের রাতেই বড়গলায় বলেছিলো, সে ওখানে ফিরবে না। রাগ কমাতে হবে ফলে ধপ করে বসে পড়লো সে। মাথাখানা চেপে রাখলো। ঠিক তখনই দেখলো বিশালকায় দুটো পা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলতেই বললো,
“উঠ, কোদাকোদি করতে করতে ঘেমে গেছিস”

বলেই বাহু টেনে দাঁড় করালো ঐন্দ্রিলাকে। ঐন্দ্রিলা রাগী স্বরে শুধালো,
“কি করছিস?”

অভ্র উত্তর দিল না। শাড়িটা হাতে নিলো। তারপর ইউটিউবের সেই টিউটোরিয়াল দেখে আস্তে আস্তে শাড়িটা পড়াতে শুধু করলো। ঐন্দ্রিলা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। একরোখা, একগুঁয়ে ছেলেটার এমন যত্নশীলও হতে পারে এ যেন আকাশ কুসুম ঘটনা। কি দৃঢ় প্রযত্ন। যখন তার রুক্ষ্ণ হাতের ছোঁয়া ঐন্দ্রিলার অনাবৃত উদরে লাগছিলো, কেঁপে উঠছিলো সমস্ত দেহ। ঐন্দ্রিলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্র আঁচলটা ছেড়ে দিল। তার ভেজা চুলগুলো টেনে সামনের একপাশে রাখলো। লম্বা চুল থেকে পানি পড়ছে। ঘামে ভেজা, রাগে লালচে হওয়া একটা মুখ, লম্বা অবিন্যস্ত ভেজা চুল আর মিষ্টি রঙ্গা শাড়ি। অভ্র নিলীন চোখে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে। গাঢ় সেই দৃষ্টিতে কি যেন ছিলো যা মুহূর্তেই অস্বতি ঘিরে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। সে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,
“সর, এখনই তোর পাগলা খালার দল আমাকে ডাকবে”

বলেই ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুলগুলো আঁচড়াতে লাগলো। ঐন্দ্রিলা চুলগুলো বাঁধতে নিলেই অভ্র গাঢ় স্বরে বলল,
“বাঁধিস না, তোকে খোলা চুলে বেশী ভালো লাগে”

মুগ্ধ সম্বোহনী কন্ঠ অভ্রের। ঐন্দ্রিলা আয়নার মধ্যে তাকালো অভ্রের চোখে। কতটা সময় তাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো নিজেরাও জানে। এর মাঝেই খালার কন্ঠ শোনা গেলো,
“বউ, তুই কি শাড়ি পড়তেছিস নাকি বানাচ্ছিস? এত সময় লাগে?”

সম্বিৎ ফিরলো দুজনের। অভ্র দাঁড়িয়ে থাকলো না। টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সে হনহন করে চলে গেলো বারান্দায়। ঐন্দ্রিলা এখনো দাঁড়িয়ে রইলো। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে আছে। শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই। এমন কেনো হচ্ছে?

*********

ঐন্দ্রিলা নেমে আসতেই খালাদের উৎসাহের কমতি নেই। তারা যাবে আজ একটি পার্কে। একটু আগেও বিনা শব্দে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। এই কাঁদা পানিতে কি করে কারোর পার্কে যেতে ইচ্ছে হয়। এক খালা বললো,
“পার্ক যাব, ঘুরবো, ফিরবো, আইস্ক্রিম খাবো”

এর মধ্যেই অভ্র নেমে এলো। পরণে একটা নীল পাঞ্জাবি। হাতা কনুই অবধি গুটিয়ে রাখা। ঘড়িটা পড়তে পড়তে বললো,
“চলো”
“তুই যাচ্ছিস?”
“হ্যা, তোমাদের চার রমনীকে ছেড়ে দেওয়া মানে পরদিন নিউজপেপারের হেডলাইন হওয়া। সেই চান্স নিচ্ছি না। আর আমার এতো সুন্দর বউ। তোমাদের আইসক্রিম পেলে তো হুশ থাকে না। দেখা যাবে আমার বউকে হারিয়ে এসেছো, তখন বউয়ের শোকে আমি দেবদাস হয়ে যাব। নো নো, চান্স নিবো না। চলো”

ঐন্দ্রিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভ্রের দিকে। অভ্রও সবার সামনেই ঐন্দ্রিলার হাতটা ধরলো। সে ছাড়াতে চাইলেও পারলো না। কারণ অভ্রের বাঁধন শুধু শক্ত নয় খুব শক্ত।

*******

রাস্তার ধার দিয়ে হেটে যাচ্ছে পিউ। এই বৃষ্টি, বাদল, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, কাঁদা একদম ভালো লাগে না পিউ এর। বৃষ্টি কেবল নিজের ঘরের জানালা দিয়েই সুন্দর। বাহিরে বের হলেই কাঁদা পানি, গর্ত আর পিছলা খাওয়া। দুবার পিচ্ছিল কাঁদায় পা পিছলেছেও পিউয়ের। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঠিক তখনই কারোর স্বর কানে এলো,
“এই পিউ? এই পিউ”

পিউ তাকালো আকাশের দিকে। আকাশ ডাকছে? নীলাদ্রি ভাইয়ের স্বরে? বুদ্ধিমতী পিউয়ের এমন বোকা চিন্তা করা অন্যায়। তাই সে আশপাশ দেখলো। তখন নীলাদ্রি বললো,
“আশেপাশে তাকাচ্ছো কেনো? আমি তো গাছে”

পিউ বাম দিকে তাকাতেই দেখলো গাছের ঘরের জানালা থেকে মুখ বের করে নীলাদ্রি তাকে ডাকছে। বটবৃক্ষটা ঐন্দ্রিলাদের বাড়ির একেবারে পেছনে, বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে। তাই এই বৃক্ষগৃহ থেকে রাস্তাটা খুব ভালো করে দেখা যায়। পিউ যাচ্ছিলো তার খালা বাসায়। তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। মেঘের গর্জন একটু পর পরই শোনা যাচ্ছে। একটু পর ই ঝুম করে নামবে জলদের কান্না। ছাতা নেই পিউয়ের কাছে। তার মুখখানা ভিজে গেছে। নীলাদ্রি বলল,
“কোথায় যাচ্ছো?”
“খালাবাড়ি”
“বৃষ্টি হচ্ছে তো। আরো জোরে হবে। এখন যেও না। তুমি বরং বাসায় এসো। ছাতা নিয়ে যাও”

নীলাদ্রির কথা শুনে পিউ ঠোঁট উলটে বললো,
“অসম্ভব নীলাদ্রি ভাই, আন্টি যে পরিমান রেগে আছে আমার উপর। আপনার মনে নেই আমি আপনার বোনকে পালাতে সাহায্য করেছি। ছাতা চাইলে আন্টি আমার পিঠে ছাতা ভাঙ্গবে”

সাবেরা সেদিন পিউকে বেশ বকেছিলো। ছোটবেলার বান্ধবী হয়ে এমন অকাজে বান্ধবীকে সাহায্য করার অপরাধে তাকে যে জেলে দেওয়া হয় নি এটাই অনেক। তাই এখন তার সামনে যেতে চায় না পিউ। নীলাদ্রি তখন বললো,
“তাহলে উঠে এসো, আমার ঘরে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না”
“আপনার ঘর?”
“হ্যা, আমার বৃক্ষপ্রাসাদ। তুমি চাইলে এখানে সারাদিন থাকতেও পারবে”

বলেই নির্মল হাসলো নীলাদ্রি। মানুষটি এতটা সুন্দর করে কি করে হাসতে পারে জানা নেই পিউয়ের। পিউ বললো,
“আসবো কি করে? আপনার প্রাসাদে আসতে হলে তো আন্টির সীমানা পার হতে হবে”
“তুমি চিন্তা করো না, মা কন্যা শোকে একটু মুর্ছিত। কে আসলো গেলো তার খোঁজ নেই”

পিউ হাসলো। গেটে দারোয়ান নেই। তাই ফুরুত করে ঢুকে পড়লো সে। বৃক্ষগৃহে উঠতে হলে সিড়ির সহায়তা নিতে হয়। কাঠের সিড়ি পিচ্ছিল হয়ে আছে বৃষ্টিতে ভিজে। পিউ বলল,
“উঠবো কি করে? আমি তো পড়ে যাব। আমি তো শুকনোতেই পিছলা খাই। এটা তো পিছলাই আছে”
“তুমি তো বুদ্ধিমতী পিউ। এই সামান্য সিড়িতে উঠতে পারবে না?”
“আপনি হাত দিন। আমি হাত ধরে উঠবো”

নীলাদ্রি একটু ভাবলো। কিছুক্ষণ বাদে দরজা থেকে দু সিড়ি নেমে হাত বাড়ালো। পিউ জুতো খুলে উঠলো সিড়ি বেয়ে। তারপর খপ করে ধরলো নীলাদ্রির হাত। ইশ! হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরা গেলে মন্দ হতো না।

নীলাদ্রির চোখে মুখে লজ্জা। প্রথম কোনো পরনারীর হাত ধরেছে সে। পিউ তার হাত ধরেই প্রবেশ করলো তার বৃক্ষপ্রাসাদে। ছোট একটা ঘর। যেখানে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। একটা তোশক, একটা কম্বল, আর নীলাদ্রির স্তুপকৃত জামাকাপড় আর বই। একটা টিপট আছে। সেখানে গরম পানির ব্যাবস্থা করা হয়। ছোট্ট একটা চুল্লি দিয়ে। পিউ নিপুন চোখে দেখলো নীলাদ্রির ঘর। অবাক চোখে বললো,
“আপনার কষ্ট হয় না নীলাদ্রি ভাই? বৃষ্টির দিন এখানে থাকেন কি করে?”
“ডাবল মাস্টার্স কি খালি খালি করা?”

বলেই একটা সুতো টান দিল। সাথে সাথেই প্লাস্টিকের পর্দা ঘিরে দিলও কাঠের বাড়ি। পিউ বলল,
“আপনার তো অনেক বুদ্ধি নীলাদ্রি ভাই”
“তা আর কি, শুধু বাবাই কদর করে না। আচ্ছা কফি খাবে?”
“খাবো”

নীলাদ্রির মিনিট দশেকের মধ্যেই কফি বানিয়ে আনলো। পিউ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
“আপনি এভাবে আর কতদিন থাকবেন? এখন তো আংকেলের সাথে সন্ধি করতে পারেন”
“নাহ, আমি সন্ধি করবো না। আর আমি তো বেশি দিন নেই। ঐন্দ্রিলার বৌভাতের পর দিন ই আমি চলে যাব। অহেতুক কেনো কম্প্রোমাইজ করবো?”

নীলাদ্রি চলে যাবে শুনতেই মনটা বসে গেলো পিউয়ের। তীব্র বিষাদ ঘিরে ধরলো কোমল মন। বিষন্ন স্বরে শুধালো,
“আপনি চলে যাবেন নীলাদ্রি ভাই?”
“হ্যা, পিউ আমার এখানে ভালো লাগে না। আমার প্রকৃতি ভালো লাগে, পাহাড়ে টেন্ট লাগিয়ে ঘুমানো বা সমুদ্রের অতল ঢেউ এ নৌকার পাল তোলা সেগুলোই যে আমার প্রিয়। এভাবে ইট পাথরের জীবন আমাকে খুব কুঁড়ে খায়”

পিউ খেতে পারলো না কফিটা। গলায় আটকে আছে। নীলাদ্রি তাকে দেখলো। অবাক স্বরে শুধালো,
“কফিটা ভালো খেতে না?”
“নাহ, কফি ভালো। আসলে আমার মনটা ভালো নেই নীলাদ্রি ভাই। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আকাশে যেমন মেঘ জমেছে। আমার মনেও মেঘ করেছে। আমি একজন পঁচিশ বছরের নারী। এমনটা নিশ্চয়ই আমাকে শোভা পায় না তাই না নীলাদ্রি ভাই?”

নীলাদ্রি কিছুসময় নীরব চেয়ে রইলো পিউয়ের দিকে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এককোনায় স্তুপ করে রাখা কদম ফুলগুলোর থেকে পাঁচটি নিয়ে এগিয়ে দিলও পিউ এর দিকে। গাঢ় স্বরে বললো,
“মেয়েদের প্রকৃতির এই ফুল নামক জড়বস্তুর প্রতি খুব মমতা। তারা ফুল পেলেই দুঃখ ভুলে যায়। আমার কাছে এখন দামী ফুল নেই। আছে এই বৃষ্টিস্নাত কদম ফুল। হুমায়ুন আহমেদের মতে এটা খুব ফালতু ফুল। তোমার মন কি এতে ভালো হবে পিউ?”

পিউয়ের চোখ ঝাপসা হলো। ঝাঝা করে উঠলো হৃদয় অসহনীয় বেদনায়। মানুষটা কি সত্যি বুঝে না? নাকি বুঝেও ভান ধরে?

******

পার্কটা শহরের সর্বপূর্বে। বিশাল দুই একর জমিনের উপর একটা ইকোপার্ক। বৃক্ষরাজীতে ঘেরা এই পার্কে আছে অনেক ব্যাবস্তা। বসে নদী দেখা যায়, বিভিন্ন রাইড আছে। খাওয়ার ব্যাবস্থা। কিন্তু অভ্রের খালাদের মাথায় চাপলো তারা বোট চালাবে। একেই বৃষ্টিতে পানির স্তর বেড়ে গেছে। অভ্র বারণ করলো। কিন্ত তারা শুনলো না। ধরলো ঐন্দ্রিলাকেও। ঐন্দ্রিলা সাতার পারে না। উপরন্তু বৃষ্টির জন্য পানি থৈথৈ করছে। এই পানিতে পরলে আর বাঁচা লাগবে না। পানি খেয়েই ভেসে উঠবে। তারা যখন ঐন্দ্রিলাকে টেনে নিয়ে যেতে উদ্ধত হলো। ঠিক তখনই অভ্র ঐন্দ্রিলার হাত টেনে বলল,
“ও যাবে না”
“কেন রে, ও যাইবো না কেন? আমরা মজা করবো আর বউ কি চাইয়ে দেখবে”
“খালা, আমি তো বলেছি ও যাবে না। ঐন্দ্রি সাতার পারে না। আর তোমরা মজা করো না, কেউ তো বারণ করে নি। ও আমার সাথে মজা করবে”

অভ্রের এমন কথায় খালাদের একজন বাকি দুজনকে টেনে কিছু বললো। তারপর তারা নিজেরা হাসাহাসি করলো। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইল অভ্রের দিকে। বাবা-মা ছাড়া কেউ জানে না ঐন্দ্রিলা সাতার জানে না। অভ্র কি করে জানলো সেটা। খালারা মজা করে বলল,
“ঠিক আছে ঠিক আছে। তোরা মজা কর। আমরা ডিসটার্ব করুম না”

তারা চলে যেতেই ঐন্দ্রিলা শুধালো,
“তুই কি করে জানিস আমি সাতার পারি না”

অভ্র হাসলো স্মিত। মৃদু স্বরে বলল,
“এটা তো শুধু সাঁতার বাবু, তোর সম্পর্কে এমন অনেককিছুই আমি জানি যা হয়তো তুই নিজেও জানিস না”…………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি