নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-০১

0
45

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_২
পর্বঃ০১
#জান্নাতুল_বিথী

বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে অর্ধ*নগ্ন অবস্থায় বসে কান্না করছে তুহা। গায়ের শাড়িটা কোনো মতে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। সারা শরীর যন্ত্রনায় ছটফট করছে সে। পিঠে, ঘাড়ে কামড়ের লাল দাগ গুলো স্পষ্ট। কেউ নিজের সবটুকু রাগ তার উপরে তুলেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তুহার অপরপাশে শুয়ে আছে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী শৈবাল। ফর্সা পিঠে নখের দাগ। তুহা একবার নিজের হাতের দিকে তাকায়। হাতের নখ গুলো বেশ বড় হয়েছে। সে ফের ফুপিয়ে কেঁদে উঠলে ধমকে উঠে তার স্বামী শৈবাল। চোখ গরম করে বলে,

“মরা কান্না জুড়ে দিয়েছো কেন? বিয়ে করার খুব শখ তাই না? এখন প্রতিদিন এই অত্যাচারের জন্য রেডি থাকো। নাটক না করে চুপচাপ শুয়ে পড়ো।”

তুহা শৈবালের কথা অগ্রাহ্য করে উঠতে নিলে তার ডান হাতের কব্জি চেপে ধরে শৈবাল। ঘুম ঘুম চোখে টেনে তুহাকে তার পাশে শুইয়ে দেয়। তুহা ছটফট করলে তাকে শ*ক্ত করে চেপে ধরে তার উ*ন্মুক্ত বক্ষে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে। তুহার কাছে সব কিছু অসহ্যকর লাগছে। মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। তার সুন্দর গোছানো জীবন টা কি থেকে কি হয়ে গেলো। তুহা চোখ বন্ধ করে তার বাবার কথা ভাবে। উনি সুস্থ আছে? এখন কি করছে? চোখ বন্ধ করতেই তার জীবনের বি*ভৎস অতীতের ঘটনা মনে পড়ে।

তুহার বয়স যখন চৌদ্দ বছর তখন তার মা মা*রা যায়। তার বাবা নুরুল পাটোয়ারী মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বার আর বিয়ে করেনি। তুহার চাচা, চাচী, চাচাতো ভাই আর তার পিতা মিলে তাদের সংসার। তার চাচাতো ভাই রাফি সারাদিন পথে ঘাটে বখাটেপনা করে রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা নিত্য দিনের কাজ। সেই ছেলের জন্য যখন তুহার চাচী নুরুল পাটোয়ারীর নিকট তুহাকে চায় তখনি তিনি সাথে সাথে নাচক করে দেয়। কিন্তু তার চাচী না শব্দটা মানতে নারাজ। তিনি তুহাকে রাফির সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ফল স্বরূপ তার পিতা একদিনের মাথায় তুহার মামাতো ভাই শৈবালের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয় কোনো আয়োজন ছাড়াই। তার মা কুশুম বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে তুহার মামাদের সাথে তার পিতা খুব একটা যোগাযোগ করেনা৷ তার মামাও ভুলে বসে ছিলো বোনের একমাত্র মেয়ে এবং তার স্বামীর কথা। শৈবালের মা তার জন্য পাত্রীর খোঁজ করলে তুহার কথা জানায় তাদের বাড়ির পাশের একজন৷ দেখতে গিয়ে জানতে পাশে তার একমাত্র ননদীনির মেয়ে তুহা। তৎক্ষণাৎ তারা বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে নুরুল পাটোয়ারী ও আর নাচক করেনা। তুহাও বাবার অনুরোধের কাছে হয় পরাজয়। কিন্তু বেঁকে বসে শৈবাল, সে কিছুতেই এখন বিয়ে করতে রাজি নয়। তার মা আফসানা বেগম কান্নাকাটি করে সু*ইসাইডের ভ*য় দেখিয়ে ছেলেকে রাজি করায়। বিয়েতে রাজি হলেও মনে মনে সাঙ্ঘাতিক রে*গে যায় সে। যার ফলে সমস্ত রাগ গিয়ে রাতে পড়ে তুহার উপরে।
সব কিছু ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। তার সাথে কোনো অন্যায় সে কখনো মেনে নিবে না। এক পলক শৈবালের দিকে তাকিয়ে ঘৃ*নায় মুখ ফেরিয়ে নেয়। এক সময় তার বাহুডোরেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।
.
রোদের তেজে চোখ বন্ধ করে রাখা দু*ষ্কর ঠেকছে তুহার নিকট৷ চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে অন্যপাশে ফিরতে গেলে শরীরের ব্যাথায় ককিয়ে উঠে তুহা৷ চোখ মেলে তাকাতেই নজরে পড়ে শৈবালের ফর্সা মুখখানা৷ মনে করার চেষ্টা করে এই ছেলেটা কে। সে এখানে কি করছে৷ সব কিছু মনে পড়তেই তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুহা। শৈবালের বাঁধন থেকে নিজেকে আলগা করে শরীরে বিয়ের শাড়িটা জড়িয়ে উঠে পড়ে সে। জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ডুকে। শরীরে পানির স্প*র্শ লাগতেই সারা শরীর জ্ব*লে উঠে তার। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গোসল করে রুম থেকে বের হয় তুহা।

শ্বশুড় বাড়ির প্রথম দিন তুহা বেশ ভয়ে ভয়েই আছে। এই বাড়ির মানুষ গুলো চেনা হয়েও বড্ড অচেনা। মানুষ গুলো কেমন হবে, কিভাবে তাকে নিবে সেই চিন্তায় সে অস্থির। তুহা আস্তে আস্তে ড্রয়িংরুমে আসে। সেখানে আগে থেকেই বসে ছিলো তার মামি মানে শ্বাশুড়ি মা। তার সাথে আরো দুই তিনজন মহিলা বসে আছে। তুহা সেখানে যেতেই সবার নজর এসে পড়ে তার দিকে৷ সবাই এমন ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই গিলে খাবে। মধ্য বয়স্ক মহিলা একজন বলে বসলো,

“আপনার ছেলের বউ তাই না? সামনে এতোজন মানুষকে দেখেও সালাম দিচ্ছে না, কি মেয়েরে বাবা। আদব কায়দা শেখায়নি কেউ?”

তার কথার ধরনে তুহা হালকা ঢোক গিলে মিনমিনে স্বরে সালাম দেয়। তার সালাম শুনে কেউ কেউ মুখ বাঁকিয়ে নেও, আবার কেউ সালামের জবাব দেয়। তাদের মধ্যে থেকে আরেকজন মহিলা বলে উঠে,

“আপনার বউমার গায়ের রঙ তো ফর্সা আছে। তা বাপের বাড়ি থেইকা কি কি দিলো শুনি?”

কথাটা শুনে খারাপ লাগে তুহার, এই জিনিস গুলো নিয়ে চিন্তা করার মতো মানুষ এখনো আছে? তার মামি কি এই কথার জবাব দিবে? তুহা অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকালে তিনি বলেন,

“তুহা আমার ননদের মেয়ে, মানে আমার মেয়ের মতো। আর আমি যদি আমার মেয়ে প্রিয়’র দিয়ে দেই তাহলে কখনোই যৌতুক দিবো না। যেখানে আমার মেয়ের জন্য যৌতুক দিবোনা সেখানে আরেক মেয়েকে কিভাবে যৌতুক নিয়ে ঘরে আনবো? আপনারা আমার শৈবালের বউকে দেখতে এসেছেন দেখা হয়ে গেলে দয়া করে চলে যান। আমি বা আমার তুহা কেউই এসব শোনার জন্য প্রস্তুত না।”

মায়েদের কথাগুলো হয়তো এরকমই হয়। তুহা প্রশান্তিতে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ওই মহিলারা চোখ মুখ কালো করে উঠে চলে যায়৷ তুহা তখনো দাড়িয়ে থাকে। আফসানা বেগম উঠে এগিয়ে আসে তার দিকে। হাত টেনে টেবিলে বসাতে বসাতে বলে,

“খাবি আয়, এসব কথায় একদম কান নিবি না। এরা থাকেই এসব বলার জন্য।”

তুহা কিছু বলেনা, নিরবে সম্মতি জানায়। আফসানা বেগম তুহাকে বিভিন্ন ধরণের কথা বলছে আর তুহা সেসব মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করছে। তার খাওয়ার মাঝে নিচে নেমে আসে শৈবাল। তাকে নামতে দেখে আফসানা বেগম বলে,

“তুই এখন বের হবি শৈবাল? কিছু খেয়ে যা বাপ, না খেয়ে সকালে বের হয়না।”

শৈবাল মায়ের কথাতে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলে,

“যাকে নিয়ে এসেছো তাকে খাওয়াও। আমার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই তার পাশে বসে খাওয়ার!”

অপমানে চোখ টলমল করে উঠে তুহার। গলায় পরোটা আটকে যায়। বহু কষ্টে সেটা গিলে নেয় সে। সামনে তাকিয়ে দেখে শৈবালের প্রস্থান। ছেলের কথা শুনে মুখ কালো হয়ে যায় আফসানা বেগমের। আড়চোখে একবার তুহার দিকে তাকায়। মা হারা মেয়েটার জন্য বড্ড মায়া হয় তার। তুহা প্লেটে কোনোরকম হাত ধুয়ে উঠে যেতে নিলে আফসানা বেগম শুধায়,

“না খেয়ে উঠেনা তুহা।”

তারপর একটু থেমে বলে,

“আমার ছেলেটা একটু বদ মেজাজি, জানি তোমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু বিশ্বাস করো ওর কোনো মেয়ের সাথেই সম্পর্ক কেউ। নাক উচু একটু অহংকারী টাইপের। তোমাকে সেই অহংকারের ভীত নাড়িয়ে দিতে হবে। পারবে না তুমি মা?”

কান্না চাপিয়ে রেখে তুহা বলে,

“জীবনটা কোনো সিনেমা বা উপন্যাসের কাহিনি না মামনি, এটা বাস্তব জীবন। আর এখানে সব কিছু মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া সহজ না।”

তার কথা শুনে আফসানা বেগম হাসে। এগিয়ে যায় তার দিকে। মাথায় হাত রেখে বলে,

“জীবনটা নাটকের চাইতেও নাটকীয়। চেষ্টা করলেই সব সম্ভব। আর আমি জানি তুমি পারবে।”

তুহা পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নেড়ে বলে,

“আমি পারবো না, আমি সত্যিই পারবোনা তোমার ছেলের সাথে মানিয়ে নিতে। আমি পড়ালেখা করতে চাই মামনি। আমি তোমার ছেলের থেকে দূরে থাকতে চাই। অনেক দূরে!”

মা মারা গেলেও বাবার কলিজার টুকরো ছিলো তুহা। সব সময় সব বিপদ কটূ কথা থেকে তাকে আগলে রাখতো। বাবার আদরের কন্যার কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। নুরুল পাটোয়ারী মেয়ে চাওয়ার আগেই সব কিছু হাজির করেছে। তাই তার মেয়ে হয়ে তুহা হঠাৎ করে শৈবালের এই ব্যবহার নিতে পারছে না। ব্যাপারটা বুঝে হতাশ হয়না আফসানা বেগম। বুঝানোর ভঙ্গিতে তাকে বলে,

“তুমি পড়াশোনা করবে, সব কিছু করবে। তোমার এখনো সংসার সামলানোর মতো বয়স হয়নি। তাই আমি তোমাকে সংসার সামলাতে বলবোনা। তুমি পড়াশোনা করো। কিন্তু দূরে যাওয়ার কথা বলবেনা প্লিজ।”

শৈবালের হাসপাতাল থেকে ফোন আসায় তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে সে বের হয়। পেশেন্ট দেখতে হবে তাকে। হুট করে বিয়ে হওয়া ছুটি নেওয়া হয়নি বা বলা চলে সে ইচ্ছে করেই ছুটি নেয়নি। তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যাওয়ার কারণে মোবাইল নিতে ভুলে যায় সে। যার কারণে আবারো ফিরে আসতে হয় তাকে। দরজাতে পা রাখতেই মায়ের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকায় সে। গম্ভীর স্বরে বলে,

“বিশ লক্ষ এক টাকা কাবিন রেখে বিয়ে করেছি বিয়ের পরেরদিন বউ দূরে চলে যাওয়ার জন্য না। আগে টাকা উসুল করা হবে তারপর যেখানে ইচ্ছে যাওয়া হবে। জোর করে বিয়ে করিয়ে এখন তোমার আদরের বউটা চলে যেতে চাইছে কেন মা? বিয়ে করার স্বাদ পেতে হবেনা?”

চলবে,,,,,,

নীড়ের খোঁজে সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন