নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১৮

0
30

#নীড়ের_খোঁজে [০২]
পর্বঃ১৮
#জান্নাতুল_বিথী

জাপানের কিয়োটো (kyoto) শহরের উপকন্ঠে জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট আরাশিয়ামা। আরাশিয়ামা বসন্তে চেরি ফুলের বিস্তৃতি আর শরৎকালে রঙের ছোঁয়ায় অপরূপ রূপ নেয়। এখন যেহেতু শরৎ কাল তাই এই অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্যটি উপভোগ করতে শৈবাল তুহাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছে। তাছাড়া জাপানিদের কিয়োটো এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে জাপানের বিখ্যাত সাগানো বাঁশ বাগান, যা সাগানো ব্যাম্বো ফরেস্ট নামে পরিচিত। একে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে বাঁশ ঝাড়ের মাঝখান দিয়ে তৈরি করেছে পায়ে চলা পথ। শৈবাল তুহার হাত মুঠোয় পুরে সেই পথ দিয়ে এগিয়ে যায়। এদিকে তুহা তাঁর জাপানে আসার অভিজ্ঞতা সহ এখানে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই শৈবালকে জানায়। শৈবাল এক্ষেত্রে খুব ভালো একজন শ্রোতার পরিচয় দেয়। রমণী শৈবালের হাত আরো শক্ত করে ধরে শুধালো,

“এই পথ টা কতো দূর? কি সুন্দর করে তৈরি করেছে ওরা। একারণেই হয়তো বলে জাপানিজরা আমাদের থেকে ৫০ বছর এগিয়ে।”

“বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই পথের দূরত্ব ৫০০ মিটার। তেনরিউজি টেম্পল থেকে নোনোমিয়া শ্রাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে আছে লেক আর ডজনে ডজনে রেস্টুরেন্ট। যেগুলো তে পাওয়া যায় চমৎকার সব জাপানি খাবার। পর্যটকদের আকর্ষণের মূলে থাকে এখানকার বাঁশের ঝোপ ঘেরা পায়ে চলা পথ। এই এলাকায় যে প্রজাতির বাঁশ জন্মায় তা পথটিকে ঘিরে তৈরি করেছে টানেল।”

দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে শ্বাস নেয় শৈবাল। তুহা ফিটফিট করে শৈবালের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। বেশ উৎসাহ নিয়ে জানায়,

“বাহ আপনি তো দেখি অনেক কিছুই জানেন৷ এখানে আগে আসা হোতো আপনার?”

এ যাত্রায় শৈবালের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। নিভু নিভু চোখে বলল,

“যখন সমুদ্র সুস্থ ছিলো তখন আমরা সব জায়গা চষে বেড়াতাম। এরপর এতো বড় ঝড় এসেছে। সামলাতে এখনো হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে!”

“কেনো, কি হয়েছিলো?”

শৈবাল কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অসহায় নেত্রে আওড়ালো,

“এই সময়টা তোমার আমার মিসেস। আমার একান্তে নাহয় এইটুকু সময় কাটাই?”

থমকে দাঁড়ায় তুহা। মন খারাপের রাজ্যে শৈবালকে দেখে খারাপ লাগে বেশ। তাঁর কপালে উড়ে আসা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“আপনার আমার সময় গুলোতে মন খারাপেরা জায়গা পাবেনা। আগে আপনি মনের কোণে লুকিয়ে রাখা কথা গুলো বলে মনটাকে হালকা করেন। তারপর নাহয় সময়গুলো আমাদের নামে কিনে নিবো।”

মুচকি হাসে শৈবাল। মেয়েটা কি নিদারুন কথা বলতে শিখেছে। নিষ্ঠুর রাণী থেকে কোমল রাণীতে পদার্পন করেছে। মনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। শৈবাল জাপানে আছে আজ তেরোদিন হলো। দুইদিন পরেই তাঁর ফ্লাইট। এখন সে একাই যাবে৷ তুহা নাহয় আরেকটু সময় এখানে থেকে নিজের পড়ালেখা শেষ করুক। এই তেরোদিনে তারা জাপানের বিভিন্ন বিখ্যাত জায়গায় ঘুরেছে। শৈবালের সময়গুলো উজার করে দিয়েছে তার মিসেসের নামে। আজকে আবার ঘুরতে বের হয়েছে তারা।

শৈবাল তুহাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসে। মেয়েটা এতোদূর হেঁটে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে। তবুও একটিবারের জন্যে বলছেনা তার খারাপ লাগছে বা কিছু। শৈবাল তুহার দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমার একটা কাজিন ছিলো আবিদ নামের। ওর ফুটফুটে দুইটা জমজ কন্যা ছিলো। জানো তো মিসেস, যখন ওরা দুজন হাসতো তখন মনে হোতো পুরো পৃথিবী যেনো হাসে। এত্তো আদুরে ছিলো ওরা দুজন। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসে শুনি আবিদের বউ তাঁর দুই কন্যাকে গলা টিপে মে*রে ফেলেছে। এরপর অন্য কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে। এই জিনিসটা আমার ছোট্ট মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমি সহজে মেনে নিতে পারিনি বিষয়টাকে। তারপর কয়েক বছর পরে আবার একই ঘটনা ঘটে আমার সামনে। মা তাঁর একমাত্র ছেলেকে রেখে প*রকীয়ার পুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। এরকম বেশ কয়েকটা ঘটনা এক্সিডেন্টলি আমার সামনে ঘটেছে। ব্যাপার গুলোকে তুমি কতোটুকু স্বাভাবিক হিসেবে নিবা আমার জানা নেই। কিন্তু এগুলোতে আমি প্রচুর ধাক্কা খাই।”

লম্বা শ্বাস টেনে আবার বলতে শুরু করে শৈবাল,

“আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিলাম। তাদের মাঝে অন্যতম ছিলো জিহাদ আর সমুদ্র। আমার জানের জিগার ছিলো সমুদ্র। এক সময় ছেলেটা প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। বেশ ভালোই কাঁটে তাঁদের সময়। দিনগুলো মন্দ ছিলো না। আমরা বন্ধুরা মিলে হুটহাট ট্রিপে যেতাম। তখন সবে আমরা ইন্টার্নি শেষ করেছি। একদিন শুনি সমুদ্রের ব্রেক আপ হয়েছে। মেয়েটা তাঁকে ঠকিয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে। পাপিয়া মেয়েটার এমন কোনো ইচ্ছে ছিলো না যেটা সমুদ্র পূরণ করেনি। বাপের টাকা ছিলো আর গার্লফ্রেন্ডের পেছনে উড়াতো। আবার প্রচণ্ড ভালোও বাসতো। ওর কাছ থেকে এভাবে ধোঁকা মেনে নিতে পারেনি সমুদ্র। এক ঘেয়ে টাইপের হয়ে যায়। আমরা সবাই ছেলেটাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করি। তাঁর মন রাখতে ট্রিপে যাই বান্দরবন।”

এতোটুকু বলতেই গলা ধরে আসে শৈবালের। কথা গুলো কন্ঠনালিতে আঁটকে যায়। কোনো রকম নিজেকে শান্ত করে পুনরায় বলা শুরু করল,

“বান্দরবন গিয়েছিলাম সমুদ্রের মন ভালো করতে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো ব্যাপারটা। আমি, রাব্বি মিলে বের হয়েছি চারদিকটা ঘুরে দেখতে। সমুদ্র কে অনেক বলার পরেও ছেলেটা যেতে রাজি হয়নি। শেষে দিহান, আর জিহাদকে ওর কাছে রেখে আমরা বের হয়েছিলাম। ঘন্টাখানেক পরেই রিসোর্ট থেকে ফোন আসে সমুদ্র সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প নিয়েছে। আমরা রিসোর্ট থেকে বেশ দূরেই ছিলাম। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এদিকে জিহাদ ফোন করে কান্নাকাটি করতেছে সে একা পারতেছে না ওকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। দিহানসহ বাকি যারা ছিলো একজনও জিহাদকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। রিসোর্টের একজনকে নিয়ে কোনো মতে হসপিটালে এডমিট করায় সমুদ্রকে। সেদিন আমি সাথে সাথা বন্ধু গুলোর আসল রূপ দেখেছিলাম। তড়িঘড়ি করে ছুটে গিয়েছিলাম হসপিটালে।”

তুহার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। শৈবালও থেমে নেই। নিঃশব্দে কাঁদে ছেলেটা। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে তুহাকে আগলে নেয় বুকের মাঝে। তুহা তখনো ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। শৈবাল তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, মাথায় চুমু খায়। মিনিট সাতেক সময় নিয়ে তুহা স্থির হয়। হয়েই সবার আগে বলল,

“সমুদ্র ভাইয়া এখন কেমন আছে? সুস্থ আছে তো?”

“সেদিন সমুদ্রকে হসপিটালাইজড করার পর অল্পের জন্য বেঁচে যায় ছেলেটা। ডাক্তার জানায় তাকে যেনো সব সময় হাসিখুশি রাখি। এক ধরণের ট্রমার ভেতর দিয়ে যায় সমুদ্র। কিন্তু আমি জিহাদ মিলে হাজার চেষ্টা করেও এক মিনিটের জন্য ছেলেটাকে হাসাতে পারিনি। সমুদ্রের বাবা মা সহ পুরো পরিবার তখন আমেরিকাতে ছিলো। তাদের সাহায্য নিবো যে সেই উপায়ও ছিলো না। আমি দিগবিদিক হারিয়ে ফেলি। কোথা থেকে কি করবো বুঝে উঠতে পারি নাই। ওই এক্সিডেন্ডের দুই মাস পরেই সমুদ্র মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। যেদিন ডাক্তার আমাকে একথাটা নিশ্চিত, করেছিলো বিশ্বাস করো মিসেস সেদিন আমার নিজের কাছে নিজেকে এত্তো পরিমানে অসহায় লেগেছিলো। বন্ধ রুমের মাঝে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম আমি আর জিহাদ।”

তুহা অবাক হয়ে শৈবালের কথা শোনে। শৈবালের ছোট বেলা থেকে এখন অবদি সময় গুলো নিজের মাঝে রিয়ালাইজ করে। ছেলেটা এতোটা মানসিক চাপ সহ্য করে কিভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছিলো? তুহা শৈবালের গলা জড়িয়ে ধরে মৃদু স্বরে আওড়ালো,

“এখন উনি কেমন আছে? আপনি কি তাঁর সাথে দেখা করেন?”

“কথায় আছে না প্রেম মানুষকে অন্ধ করে, আবার প্রেম মানুষকে পাগলও করে! সমুদ্রের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। গত নয় মাস যাবত তাঁর চিকিৎসা চলছে। এখনো কোনো উন্নতির লক্ষণ পাইনি। আমি ওর সামনে যেতে পারিনা। গেলেই সামনে যা পায় তাই দিয়ে আঘাত করে। নিজের মতো প্রলাপ বকে। ফিটফিট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর না চিনে আঘাত করে বসে। এই দেখো আমার কপালে এখনো ওর দেয়া আঘাতের চিহ্ন লেপ্টে আছে!”

চলবে,,,,,,,,,