#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৩
জাহানারা পুষ্প আজ কয়েক বছর পর গ্রামীণ রূপের সাজ সেজেছে। বাসায় তিনি একলা ব্যক্তি। ছেলে আর ছেলের বাপ দুটো বাহিরে। বাহিরের অবস্থা সম্পর্কে দেশের সূক্ষ্ম স্তরের মানুষেরও জানা। সেখানে তাকে দেখলে মনে হবে তিনি এসবের কোনো দায় ধরেন না। তিনি নিজের খেয়ালে মগ্ন প্রায়। কপালে টিপ পরে চুলগুলো বেনি করে আয়নার সামনে বসে আছেন। এরূপ কী তার স্বামী মোঃ আবু সিদ্দিক এর পছন্দ? আপনমনে জাহানারা পুষ্প কথাটা ভাবলেন। কপালে উপর সিঁথি কাটা। তার নিচে বাদামী টিপ পরা দেখতে গ্রাম্য মেয়ের আভাস ফুটে উঠেছে তার মাঝে। সেই টিপে হাত রাখতেই তার চোখজোড়া বেয়ে জল গড়াল। পরক্ষণে চোখের জল আলতো হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুছে নেয়। জল লাগোয়া স্থানে মেকাপ লাগিয়ে স্থানটা পূর্ণ করে দিল। তিনি উঠে গিয়ে আলমারির দরজা খুললেন। ভেতরে একটা লকার আছে। সেই লকারে তিনি তার পুরনো জিনিস সংরক্ষণ করে রেখেছেন। লকার বদ্ধ আলমারিটি তার বাবার বাড়ির দেওয়া সম্পত্তি। এ কোনো যৌতুক হিসেবে আসেনি এই বাড়িতে বরং তার অতীব পছন্দময় বলে সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। অবশ্য মোঃ আবু সিদ্দিক দ্বিরুক্তি করেননি সেই ব্যাপারে। মেয়েটা তার পরিবার ছেড়ে এতটা পথ অতিক্রম করে দূরে পর পরিবারের আপনত্ব বহন করতে রাজি হয়েছে এই যেনো ঢের তার কাছে। কিন্তু জাহানারার কাছে স্বামীর ঐরূপ আদিখ্যেতা ছাড়া বৈকি আর কিছু নয়। রূপে-গুণে-দায়িত্বের দিক দিয়ে স্বামী হিসেবে লোকটা খারাপ নয় মোটেও। তবুও জাহানারার পছন্দ নয় সেই মানুষটিকে। যার কারণে তার অতীত চিরজীবনের জন্য নিঃশেষ হয়ে গেল। জাহানারা
পুষ্প চোখের জল আটকে আলমারির লকার এ নাম্বার লিখে খুললেন। সেখানে লাল রাঙ্গা শাড়ির আঁচল এ মোড়ানো এক সেট সোনার গহনা। পুরনো আমলের গহনা হলেও এখনো দেখলে মনে হবে কতটা সতেজ, কতটা ঝাঁজ সেই গহনার উজ্জ্বলতায়। তিনি হাত বুলিয়ে সেগুলো নিয়ে বিছানায় বসলেন। গহনা সেটটি মোড়ানো সেই আঁচলে। আঁচলটি বুকে আঁকড়ে ধরে গহনার সেট থেকে একজোড়া কানের দুল হাতে নিয়ে আয়নার সামনে বসলেন। আঁচলটি তিনি নিজের কোলের উপর রেখে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের নগ্ন শূন্য কানের কাছে সোনার দুল দুটো ধরলেন। এরূপ অবস্থানে বসে থেকে তিনি কল্পনায় ডুব দিলেন।
‘পুষ্পরাণী তোমাগো সোনার দুলে নাচিতে দেখিলে আমাগো পরাণে প্রেমের জলের জোয়ার বইয়া যায়। কও তো কী করুম আমি তাতে? এহন মন চায় তোমার কান দুটো-রে চুমু দিয়া পূর্ণ করে দেয়।’
বেশি গভীর ভাবতে পারলেন না। কারো মৃদু কণ্ঠে ‘ম্যাম’ ডাক শুনে হুঁশ ফেরল জাহানারা পুষ্পের। তিনি নিজ খেয়ালে মগ্ন ছিলেন বলে ডাকে উপর ডাক শুনতে পেলেন না। চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দুল জোড়া ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখেই তিনি দরজা খুললেন। মেইড অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার মালিকের বউয়ের দিকে। তাকে এরূপ সাজে সে প্রথম দেখছে। সে ভেবে নিল হয়ত তার মালিকের জন্য সাজ সেজেছেন। খুশিমনে বলে,
“ম্যাম বাহিরের পরিবেশ এখন ঠান্ডা। সবাই চলে আসবে খাবার তৈরি করতে যাবো কী?”
জাহানারা পুষ্প একধ্যানে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাড়িতে তিনটি মেইড কাজ করে নির্দিষ্ট স্থানে। তাদের মধ্যে এই অল্পবয়সী মেয়েটি পেটের দায়ে রান্নার কাজ করে নিজের পড়াশোনা টিকায়। তিনি মুচকি হেসে বলেন,
“ওহ তাহলে আজকের রান্নার জন্য ফ্রিজ থেকে নাও পুঁইশাক করো ডাল দিয়ে, ঢেঁড়স নাও, সিদ্ধ ডিম চারটা তোমার মালিক আর বড় সাহেব এর প্রোটিন দরকার পড়ে তাই। সাথে ডিপ ফ্রিজ থেকে বের করবে দেশি মুরগির পিচ। কেটে আনা হয়েছে। পরিষ্কার করে প্রথমে কষায় নেবে তারপর চুলোয় তেল দিয়ে ভেজে তরকারি করে বাকি কাজ সম্পন্ন করবে। শেষে মরিচ শুঁটকি ভর্তা করিও। যাও যা বলেছি তা করে ভাত বসাবে। ভাতের বস্তায় দেখবে ছোট পট রাখা। পট দিয়ে মেপে মেপে ঠিক ছয় পট দিয়ে রান্না শেষ করে পরিস্থিতি ঠিক থাকতে ফিরে যেও বাসায়।”
মেইডটি খুশি হলো। সে চলে যেতে নিলে তিনি থামিয়ে হাত চুলকানোর ভান করে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তোমার নামটা যেনো কী?’ মেইডটি হেসে বলে,’জ্বী আমি হুসনেইন জাহরা’। কতটা মিষ্টি নাম শুনালো সে। জাহানারা পুষ্পের ভালো লাগল। তিনি হাতের ইশারায় যেতে ইঙ্গিত দিলেন।
____
মোঃ আবু সিদ্দিক বহুক্ষণ পরেই ছাড়া পেলেন ধুপি দোকানের বদ্ধ আবাসন থেকে। কোটগুলো নিয়ে সামনের দিকে নজর দিতেই অবাক হয়ে গেলেন। রাস্তাঘাট র*ক্তে লাল হয়ে আছে। এ দৃশ্য যেনো মর্মান্তিক পূর্ণ। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি নিজের গাড়ির কাছে গেলেন। গাড়ির জানালায় ও র*ক্তের ছিটকে এসে লেগেছে। তিনি আলতো কাঁপা হাতে সেই র*ক্ত ছুঁয়ে দেখতে গিয়েও তার হৃদয় মোচড়ে উঠল। যখন দেখলেন তার গাড়ির ভেতর এক কিশোর ছেলে র*ক্তে ভেজে আছে। তিনি আশ্চর্য হয়ে দরজায় হাত লাগিয়ে খুলতেই দেখতে পেলেন দরজা আপনাআপনি খুলে গিয়েছে। বুঝতে পারলেন গাড়ির দরজায় কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে তাই চাবি হীন খুলে গিয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ছেলেটার পাশে বসে তার নাকের উপর আলতো হাত রাখলেন। শ্বাস খুবই নির্বিঘ্নে চলছে। চটজলদি তিনি বেরিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। ছেলেটাকে হাসপতালে নেওয়া দরকার।
পুলিশের আনাগোনা দেখে তিনি শান্ত মনে হাসপাতালের দিকে গাড়ি নিয়ে গেলেন। মাঝে দুয়েক পুলিশ তার গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। যা তিনি আড়চোখে খেয়াল করেছেন। একপলক পেছন ফেরে ছেলেটার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। দেখতে পেলেন ছেলেটার কপালে ভীষণ বাজে ভাবে আঘাত করা হয়েছে। ইশ তরুণ প্রজন্মই আজ নিজ মাতৃভূমিতে নিরাপদহীন এ ভোগছে। হাসপাতালের সামনে আসতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একেক আহত ব্যক্তির ঢোল পড়েছে এখানে। তিনি অন্য হাসপাতালে যাওয়ার মত কোনো সুযোগ খুঁজে পেলেন না ছেলেটার বেগতিক দশা দেখে। অসহায় হয়ে তিনি ছেলেটাকে কাঁধে চরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। আশপাশ জুড়ে হাহাকার কান্নার স্বরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। একে একে সন্তান হারানোর বেদনায় জর্জরিত দশা দেখে তিনি নিজেও তার সন্তান সারোয়ারের চিন্তায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছেন। কাঁধের ছেলেকে কোনো ভাবে একটা স্ট্রেচারে রেখে ইমার্জেন্সি ডক্টরের খোঁজ চালালেন। প্রায় সব ইমার্জেন্সি ডক্টর আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় লেগে পড়ে আছে। তিনি সময়সীমার মাঝে একজন অর্ধবয়স্ক ডক্টর কে পেলেন। তিনি তাকে ছেলেটার চিকিৎসা করার জন্য অনুরোধ করলে ডক্টর ও রাজি হয়ে যান। মোঃ আবু সিদ্দিক ছেলেটাকে কেবিনে পাঠিয়ে সিটে গাঁ হেলিয়ে দিলেন। জোরালো শ্বাস ফেলে তৎক্ষণাৎ নিজ ছেলের নাম্বারে ফোন লাগান।
অন্যত্রে সারোয়ার তন্নতন্ন করে খোঁজ করছে নাজমুরের। তবে কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন রাস্তাঘাটে শিথিল অবস্থা। আত্মীয় পরাআত্মীয় প্রিয়জন সকলে নিজ নিজ আহত সন্তানদের নিয়ে দৌড়ের উপর আছে। নিহতদের জন্য তো আহাজারি চলছেই। সারোয়ার এর মন হৃদয় এ প্রথম ছোট ভাইয়ের মত মানুষটি কে হারানোর ভয় জেগেছে। তার মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কপালের ঘাম মুছে সে আহতদের মাঝে নাজমুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। শেহরীনার বাড়ির আশপাশে থাকা প্রতি হাসপাতালে নাজমুর কে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে সারোয়ার। না পেয়ে পায়ের গতি কমে সে নিজ গাড়ির কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়ল। চোখজোড়ায় ঘুম হানা দিয়েছে তার। তবুও সে নাজমুর হীন এ পথ থেকে বাড়ি ফিরবে না। হঠাৎ পকেটে ভাইব্রেশন এর শব্দে চমকে গেল সে। তৎক্ষণাৎ পকেট হাতড়ে দেখল তার বাবার ১০টা মিসড কল। সে তটস্থ হয়ে বাবার ফোনে কল দেয়। মোঃ আবু সিদ্দিক ছেলেকে ফোনে না পেয়ে ফোন রেখে সিটে গাঁ হেলিয়ে থাকা অবস্থায় চোখ নিভু করে ফেলে ছিলেন। কিন্তু ফোনের তীব্র শব্দে জেগে গেলেন। ফোন এর মধ্যে ছেলের নাম্বার দেখে খোশমনে চিন্তিত গলায় কল ধরেই বলেন,
“বাবা তুই কোথায়? ঠিক আছিস? কোথায় আছিস তুই বাবা কোথাও যাসনে তুই। আমি হারাতে চাই না তোদের কে।”
সারোয়ার এর ঠোঁট কামড়ে এলো। সে পরিবারের বিরুদ্ধ গেলে তার পরিবার ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আপনি চিন্তা করবেন না আমি ঠিক আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন বাবা? আপনার ওষুধ খেয়েছেন? এখন তো দুপুর দুটা বাজছে।”
মোঃ আবু সিদ্দিক তপ্ত গলায় বলেন,’বাবা আসলে আমি বাহিরে আছি। আর হাসপাতালে এখন।’
সারোয়ার এর মাথায় বাজ পড়ল। সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘বাবা আপনি ঠিক আছেন? কিছু হয়নি তো আপনার! কিছু হলে বলেন আমি ব্যবস্থা নেবো।’
“না না বাবা তা মোটেও করিস না। পরিস্থিতি আমাদের হাতের প্রতিকূলে। তুই কিছু করলে তার বিপরীত দশা হাতের নাগালে পাবি। তাই শান্ত হয়ে থাক।”
ফোন আঁকড়ে সারোয়ার জোরালো হতাশার শ্বাস নিল। দম আটকে আসছে তার। তবুও সে তীব্র মন খারাপী নিয়ে বলে,
“আপনি হাসপতালে কেনো? কী হয়েছে আপনার?”
“বাবা আসলে আমার গাড়িতে একটা ছেলে লুকিয়ে ছিল। সে কে আল্লাহ ভালো জানেন। আহত অবস্থায় পড়ে ছিল। আমার মনে হচ্ছে সে আহত অবস্থায় আমার গাড়িতে এসে লুকিয়ে পড়েছিল। তাই তাকে কেউ দেখেনি। তার আহত অবস্থা দেখে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এখন এখানেই অপেক্ষায় বসে আছি আমি।”
সারোয়ার একপলক চারপাশ দেখে নিল। নাজমুরের খবর নিখোঁজ। তাকে এখন পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। ফলে সে ব্যর্থ হয়ে তার বাবার অবস্থানরত হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভেবে নিল। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“বাবা কোথাও যাবেন না। আমাকে হাসপাতালের নাম বলুন আমি আসছি।”
“ঠিকাছে হাসপাতালের নাম হলো ****। বাবা সাবধানে আয়।”
সারোয়ার মৃদু শব্দে ‘ইন শা আল্লাহ’ বলে ফোন কেটে গাড়ি চালু করে রাস্তায় নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটল।
চলবে…..
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৪
“আপা আপনার বাড়িতে আইছি আপনার মাইয়াটারে দেখার জন্য। আপনার বড় ঐ কালা মাইয়াটারে আমার ছোট ভাইয়ের পছন্দ হইছে। সে বিয়ে গড়লে তারেই গড়বে বলতেছে। তাই আমি আইছি আপনার মাইয়াটারে দেখতে। হুনছি মাইয়াটার বাপ নাকি সৎ বাপ কথা কী সত্যনি?”
রূপালি বেগম চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে বসে থাকা মহিলার দিকে। তার সাহস কত বেশি হলে এক মায়ের সামনে তার মেয়েকে তার বর্ণ নিয়ে মশকরা করতে পারেন। তিনি একপলক বড় মেয়ের রুমের দিকে তাকালেন। এখন সময় দুটা চলছে। এ সময়ে মেয়েটা নির্বিঘ্নে ঘুমোবে তিনি জানেন। ফলে হাত কচলে শাড়ির আঁচল মাথা টেনে নিয়ে মহিলাটির হাত ধরে সাদরে ঘরের চৌকাঠে নিয়ে গেলেন। মহিলাটি প্রথমে লোভের দায়ে ভেবে ছিল তাকে কোনো কিছু উপহার দেবে। তবে তার সেই আশায় গুঁড়েবালি। রূপালি বেগম সাদরে মহিলাটিকে ছুঁড়ে ধিরস্থির ভাবে ঘরের চৌকাঠের বাহিরে রেখে নিজে ভেতরে আসলেন। মহিলাটি ব্যাপার খানা বুঝলেন না। প্রশ্নাতীত নজরে রূপালি বেগম এর দিকে তাকান। তিনি নিম্ন দৃষ্টিতে চেয়ে শান্ত গলায় জবাব দিলেন।
“সে আমার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সন্তান নয়। মেয়ে আমার। নাড়িছেঁড়া ধন সে। তার বর্ণ নিয়ে কারো সাহস নেই তিরস্কার করার। নাহলে এই আমার ভয়ংকর রাগ দেখবে। আপনার ভাইয়ের বোধ হয় পতিতার ঘ্রাণের আভাস পেয়েছে। দয়া করে তাকে সেখানে লেলিয়ে দেন। আমার মেয়ের চারপাশেও যেনো নজরে না আসে।”
মহিলাটি মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে তার পাড়ায় চলে গেলেন। অন্যথায় রূপালি বেগম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মহিলার কোন না কোন ভাইয়ের নজর পড়েছে তার মেয়ের উপর। ঢোক গিললেন দিন দুনিয়ার খবর আজকাল বেখবরের মত। তার মেয়ের সাথে যদি উঁচুনিচু কিছু হয়ে যায়। তবে তিনি মায়ের দায়িত্ব নেভানোয় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে পড়বেন। মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে দরকার পড়লে তিনি নিজেই মেয়ের সাথে চলাফেরা করবেন। মোটেও মেয়েকে আজ থেকে একলা ছাড়বেন না । অবিবাহিত কুমারী মেয়ের উপর নজর পড়া মানেই অশুভ সংকেত বলে মনে করেন তিনি। কেনো না তিনিও সেই সময় পার করে এসেছেন! মেয়ের সাথেও সেই সময়ের পুনরাবৃত্তি হোক তা মোটেও চান না তিনি। তৎক্ষণাৎ ঘরে ফিরে এলেন। দেখতে পেলেন শেহরীনা জাগ্রত। তাকে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেলেন কোনো ভাবে সে জানতে পারল না তো ব্যাপারটা? শেহরীনা মাকে দেখে খোশমনে মাকে জড়িয়ে ধরল। এই প্রথম রূপালি বেগম আদর মনে তার স্নেহের হাত মেয়ের পিঠে রেখেছেন। শেহরীনা চোখ বুজে আনন্দের সহিতে জড়িয়ে ধরেছিল। পরক্ষণে তার মায়ের সাথে তার সম্পর্কে চলমান দৃশ্যপট তার চোখে ভাসমান হতেই সে ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু মায়ের স্নেহের স্পর্শ পেয়ে মেয়েটা থমকে গেল। চমকিত, পুলকিত হলো তার হৃদয়ের আবেগখানা। বুক কাঁপছে তার। মা কী তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবে? এ বাক্যখানা তার মনের ভেতর প্রশ্ন সহযোগে ভাসল। রূপালি বেগম গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
“আর কতক্ষণ জড়িয়ে রাখবে? নাজমুর কে কী পাওয়া গিয়েছে?”
শেহরীনার হুঁশ এলো। সে ততক্ষণে মায়ের আঁচল ছেড়ে সরে এসেছে। বরঞ্চ তার ছাড়ার ইচ্ছে মোটেও ছিল না। কতবছর পর মায়ের স্পর্শ শুঁকেছে মেয়েটা। চোখের জল আটকে মাথা নেড়ে সম্মতি বোঝায়। রূপালি বেগম দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন। শেহরীনা আর দুদণ্ড মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে রইল না। ‘আমি আসছি’ বলে তার রুমে ফিরে গেল মেয়েটা। রূপালি বেগম এক চিলতে হাসলেন। কতবছর পর আবেগের সাথে মেয়েটাকে আগলে ধরলেন গণনা করে দেখলে সীমান্ত খুঁজে পাবেন না। হয়ত মেয়েটা নিজেকে সামলাতে না পেরেই কান্না নিবারণ করতে তার রুমে চলে গেল। ভাবল তার মা তার চোখের জল দেখে তিরস্কার করবে। বোকা মেয়ে একটা যে মা তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন সেই মা কেমনে মেয়ের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হবেন না?
হঠাৎ ঘরের দরজায় বেল বাজার শব্দে তিনি এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলতেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়ে হিতাহিত অবাক হয়ে যান তিনি। সারোয়ার ও দ্বিতীয়বার দেখা পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে তার হবু শ্বাশুড়ির সঙ্গে। সালাম বিনিময় করায় রূপালি বেগম বুঝলেন তিনি কোনো স্বপ্ন দেখছেন না। বিধেয় তিনি হবু পাত্রকে ভেতরে আসার জন্য অনুরোধ করতেই থমকানো দৃষ্টিতে সারোয়ার এর পেছনে বহু বছরের পরিচিত ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। ‘আম্মু’ ডাক শুনে তার ধ্যান ভাঙ্গল। ছেলেকে আহত দশায় দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাকে ধরে কোনোমতে সোফায় বসিয়ে দুজন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদ্বয়ের কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন। ছেলেকে সুস্থ শরীরে জীবিত পেয়ে তিনি স্বস্তি অনুভব করছেন।
“আন্টি কিছু মনে না করলে আমরা আজ আসি।”
শেহরীনা চমকে গেল। তার কান্না মুহূর্তে থেমে যায় পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে। তৎক্ষণাৎ চোখমুখ মুছে রুম এর দরজা খুলল। সারোয়ার দরজা খোলার শব্দে বাঁ পাশে তাকাল। তার সঙ্গে অন্যদের দৃষ্টিজোড়া ও সেদিক পড়ে। শেহরীনা উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে এসে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সে একজন। ব্যাপারটা অদ্ভুত দেখায়! সারোয়ার একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। রূপালি বেগম আড় চোখে বারংবার সারোয়ার এর সঙ্গে আগত লোকটার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটা নিশ্চুপ। সারোয়ার তার বাবাকে নিরব দেখে সে নিজেই রূপালি বেগম এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে উদ্যত হয়।
“আন্টি ইনি হলেন আমার বাবা মোঃ আবু সিদ্দিক। আর বাবা উনি হলেন সেই পাত্রী তথা শেহরীনার মা রূপালি বেগম।”
মোঃ আবু সিদ্দিক ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে রূপালি বেগম এর দিকে। এই দৃষ্টিকোণ কী প্রকাশ করছে? অনুভূতি, অনুবেদনা , ক্ষুণ্ন হওয়ার স্নেহ নাকি এককালীন আকাঙ্ক্ষা? রূপালি বেগম কঠোর হলেন হৃদয়জুড়ে। মেহমান সমীতে তারা এসেছে। ফলে তিনিও আপয়্যনে ত্রুটি রাখতে চান না। সারোয়ার এর এক হাত ধরে বলেন,
“বাবা আমার ছেলেকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিয়েছো তার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব।”
“আরে আন্টি কী বলছেন? এই কৃতজ্ঞতা আমাকে নয় বরং বাবাকে দিন। তার কারণেই নাজমুর সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেয়েছে।”
রূপালি বেগম নির্জীব ভঙ্গিতে মোঃ আবু সিদ্দিক এর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আপনাকে অনেক শোকরিয়া ভাইজান। আপনার কারণে আমার সন্তানকে আমি ফিরে পেয়েছি। নাহলে এক ভালোবাসা হারানোর চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হতো সন্তানের লাশ দেখা।”
“দেখুন এভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লজ্জিত করবেন না। আমি যা করেছি বোন ভেবেই করেছি।”
মোঃ আবু সিদ্দিক এর চোখজোড়া ‘বোন’ শব্দটা বলতেই কেঁপে উঠেছে। তিনি অনুভূতি লুকিয়ে ফেললেন। তিনি তো ভেবেই অবাক হচ্ছেন ছেলের বিয়ে কার সাথে হওয়ার কথা ছিল সেই পাত্রীকে দেখে। শেহরীনার নিকট এগিয়ে গেলেন তিনি। রূপালি বেগম দেখে ঠোঁট কামড়ে নাজমুর পাশে বসে ক্ষিপ্ত মনের ঝাঁঝ লুকিয়ে শান্ত গলায় বলেন,
“সে আমার প্রথম মেয়ে শেহরীনা। ভালোবাসার পর প্রথম সন্তান সেই। তারপর নাজমুর আর নাসমা। তাকেও দেখে দোয়া দেবেন ভাইজান।”
মোঃ আবু সিদ্দিক তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন,’জ্বী অবশ্যই বোন। তারা আমার নিজের সন্তানের মতই। তাদের জন্য এটুকু করতেই পারি। আশা করি আপনিও আপনার সংসারে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন।’
কথাটায় রূপালি বেগম এর আহত মনে ঘি ঢালার মতো হলো। তিনি অনুভূতি লুকাতে শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন শক্ত করে। সারোয়ার একপলকে দুজনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তার মনে শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এমুহুর্তে সে বয়ান করে আহত ছোট হবু শালককে কষ্ট দিতে চাইছে না। ফলে সে গলা খাঁকারি করে বলে,
“আন্টি আমরা আসি। নাজমুর অসুস্থ। তার ওষুধপত্র গুলো এই যে টেবিলে রেখেছি। শেহরীনাকে বলে দিচ্ছি কখন কোন সময় খাওয়াতে হবে। আমাদের খিদেও পেয়েছে আজ দৌড়ঝাঁপের কারণে পেটে দুদণ্ড খাওয়া যায়নি।”
রূপালি বেগম অস্বস্তি অনুভব করলেন। তিনি তাদের খাওয়ার দেওয়ার কথাই ভুলে গেলেন আপনমনে নিজেকে ‘ছিঃ’ বলেন। পরক্ষণে তিনি অসহায় কণ্ঠে বলেন,
“বাবা এভাবে নারাজ হয়ে যাও না। একটু সময় দাও। আমার এখানে রান্না করা আছে। তোমরা খেয়ে গেলে আমি তৃপ্তি পাবো। হতে পারে আমরা গরীব তবুও আমাদের খাওয়ানোর সামর্থ্য একটু হলেও আছে।”
“আন্টি প্লিজ! এভাবে বলে আমায় ছোট করবেন না। আপনারা যেমন সামান্য খেয়ে বাঁচেন আমরাও কোথাও না কোথাও সামান্য খেয়ে বেঁচে থাকতে শিখেছি। আপনি যাই দেবেন আমরা খেতে পারব।”
রূপালি বেগম হাত কচলে মেয়ের দিকে তাকান। শেহরীনাও মায়ের চোখের দৃষ্টি বুঝল। সে আশ্বাস দিল সেও মায়ের সঙ্গ দেবে। সে রান্নাঘরে গেল। রূপালি বেগম এক বাহানায় তাদের কে নাজমুর এর কাছে রেখে মেয়ের কাছে গেলেন। শেহরীনা কে চুলোয় ডিম বাজতে দেখে তিনি বুঝলেন পাতিলে তরকারি নেই। তিনি নিজেও জানতেন স্বামীর কাছে বাজার এর লিস্ট দেওয়া এখন অব্দি স্বামী সহ বাজার আসেনি ঘরে। তাই খানা পানি এর মধ্যে টান পড়বে। শেহরীনা ডিম হতে দিয়ে আরেক চুলোয় ভাত বসালো। রূপালি বেগম পুরনো পাতিল হাতড়ে সেখান থেকে জোগাড় করা বালাওচাও এর বোয়াম বের করলেন। বোয়াম পাশে রেখে বড় বোল ধুয়ে পানি ভরে তাতে তিনটি পেঁয়াজ আর হলুদ পাতা ধুয়ে কাটতে বসে গেলেন। শেহরীনা মায়ের কাজ দেখে মুচকি হাসল। সে জানে তার মা মৌসুমী উপায়ে খাবার দেবেন। যা খেলে পেট ভরপুর হবে। ডিম হয়ে আসলে সে তৎক্ষণাৎ মিনি ফ্রিজ খুলে দেখল পলিথিন মোড়ানো ঢেঁড়স রাখা। তা হাতে নিয়ে চুলোর নিচে রাখা আলু পেল। ঢেঁড়স আর আলু দিয়ে ভাজি করার দারুণ বুদ্ধি পেল খাবারে স্বাদ পাবার মত। ভাজি করতে উদ্যত হলো সে। অন্যত্রে রূপালি বেগম বালাচাও দিয়ে পেঁয়াজ কুচি আর হলুদ পাতা মিশিয়ে দারুণ সুস্বাদু শুঁটকির ভর্তা বানিয়ে নিলো। তরকারির পরিবর্তে খাবার থালায় এটুকু সাজিয়ে তারা পরিবেশন করল। সারোয়ার আর তার বাবা মৃদু হেসে হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলেন। শেহরীনা চোরা চোখে সারোয়ার কে পরখ করছে। লোকটার শার্ট ঘামের কারণে ভেজে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে কুচকুচে হয়ে গেছে। দেখে খুব মায়া লাগছে তার। মোঃ আবু সিদ্দিক বিষয়টা খেয়াল করে মুচকি হাসলেন। তিনি গলার স্বর আদুরীয় করে সারোয়ার কে বলেন,
“চিন্তে করছি তোর জন্য দেখা পাত্রী মন্দ নয়। পাত্রী মা অর্থাৎ শেহরীনা মা চাইলে কথা আগানো যাবে সামনের মাসে।”
লজ্জা পেল শেহরীনা। সে হাত কচলে মুখ লুকাল মায়ের পেছন গিয়ে। সারোয়ার একপলক মুগ্ধ চোখে তাকায়। রূপালি বেগম মেয়ের খুশিতেই খুশি। নাসমা ও খুব মিশে গিয়েছে সারোয়ার এর বাবার সঙ্গে। লোকটার হাতে ভাত খাচ্ছে আরামে। সারোয়ার দৃশ্যখানা দেখে হঠাৎ বলে উঠল।
“বাবা তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে নিজ মেয়ের মত আপন কাউকে খাইয়ে দিচ্ছো।”
“হুম তাই নয়তো কী ভাগ্নি কার দেখতে হবে না?”
‘ভাগ্নি’ শব্দটা অদ্ভুত শুনাল শেহরীনা,সারোয়ার আর নাজমুর কাছে। তারা অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। রূপালি বেগম স্থির থাকতে পারলেন না। অস্থির গলায় প্রশ্ন করে বসেন।
“ভাগ্নি বলতে কী বুঝিয়েছেন আপনি ভাইজান?”
‘ভাইজান’ শব্দ শুনে মোঃ আবু সিদ্দিক কথা পাল্টে হেসে বলেন,
‘আরে আপা যেখানে ভাই সাহেব , ভাইজান ডাকছেন সেটা ধরলে তো আমার ভাগ্নিই হবে শেহরীনা আর নাসমা। নাজমুর তো ভাগ্না হয়ে যাবে তাই না?’
এবার যেনো বুঝল তারা। তারা মোঃ আবু সিদ্দিক এর যুক্তিকে প্রাধান্য দিলেও সারোয়ার এর ব্যারিস্টারি মন সেই যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে পারল না।
চলবে…..
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৫
নাছির উদ্দিন এর হাতে শক্তপোক্ত গাছের ডাল দেখে ভয় পেলেন রূপালি বেগম। তিনি বুঝতে পারলেন না তার স্বামী হঠাৎ ডাল কেনো এনেছেন? ঢোক গিলে দরজার সামনে থেকে কোণা হেঁটে সরে দাঁড়ান। সোফায় বসে ছিল শেহরীনা। সৎ বাবাকে দেখে উঠে চলে গেল রুমের ভেতর। ভার্সিটির মধ্যে করা কাণ্ডের পর থেকে সে একপলক কেনো এক মুহুর্ত ও লোকটার চেহারা দেখতে আর্জি পোষণ করে না। নাছির উদ্দিন এর চেহারায় গভীরতা চেয়ে আছে। তিনি বাজার সদাই রূপালি বেগম এর হাতে ধরিয়ে বলেন,
“সব গুছিয়ে রুমে এসো।”
কলিজা মোচড়ে উঠল রূপালি বেগম এর। সংসার জীবনে ঘা/ত আঘা/তে জর্জরিত হয়ে জীব/ন্ত লা/শে পরিণত হয়েছে তার শরীরটা। আজ কী আবারো তার সেই দিনগুলোর ন্যায় সহ্য করতে হবে? মাথা নেড়ে দুশ্চিন্তা দূরীভূত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন তিনি। নাছির উদ্দিন বিধ্বস্ত মনে রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েন। নাসমার ছোট মন বাবার হাতে ডাল দেখে সরাসরি মাকে প্রশ্ন করে উঠে।
‘মা ডাল দিয়ে বাবা কী করবে?’
মেয়ের কথায় রূপালি বেগম চোখের মধ্যে ভেসে আসতে চাওয়া জল আটকে বলেন,
“মা মা ঐ ডাল তিনি ডাল এনেছেন তোমাদের কে সাথে নিয়ে মাটিতে বসিয়ে গণনা শেখানোর জন্য।”
নাসমা উৎফুল্ল হয়ে বলে,’বাবা কী আজ আমাদের কে উঠানে বসিয়ে মাটি খেলা শেখাবেন? সত্যি মা শেখাবেন বাবা?’
মলিন মুখে মাথা নাড়লেন রূপালি বেগম। তিনি মেয়ের কথায় বলে তো দিলেন। তবে কথাটা আংশিক সত্য হবে তাও তিনি জানেন। কারণ কোনো বাবাই তার সন্তানের সামনে প্রহার দেখিয়ে তাদের বিগড়ে দেওয়ার মন মানসিকতা পোষণ করেন না। তপ্ত শ্বাস ফেলে তিনি বাজার সদাই দেখে একে একে ফ্রিজে গুছিয়ে রাখছেন। শেহরীনা বিছানায় শুয়ে পড়েছে। বালিশে মাথা ঠেকানো অবস্থায় তার ফোনে কল আসল। দিনকালের ফলে ইন্টারনেট সংযোগ খুব বাজে। কল পেয়ে সে দেখল সারোয়ার এর নামটা ভেসে আছে ফোনের স্ক্রিনে। ঠোঁট কামড়ে ফোনটা ধরল কানে।
“আসসালামুয়ালাইকুম কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস আসসালাম। ভালো আপনি? আর আপনারা বাড়ি পৌঁছেছেন?”
“হুম আলহামদুলিল্লাহ আমি রুমে বাবা তার রুমে।”
কথাটুকু শেষে নিরবতা চেয়ে গেল দু নরনারীর মাঝে। যবে থেকে বিয়ে পাক্কা বলেছেন মোঃ আবু সিদ্দিক। তখন থেকে শেহরীনার মনপ্রান্তে লজ্জা আর লজ্জা বিরাজ করছে। কয়েক দিন আগেও যে মেয়েটা অস্বীকৃতি দিয়ে ছিল আজ সেই বিয়ের কথা শুনে অমত পোষণ করেনি। সারোয়ার ম্লান হেসে বলে,
“আজ থেকে আপনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে অভ্যাস করে নিতে হবে। কল পেয়ে যে নারী তার নিঃশ্বাস এর শব্দ দ্বারা কোনো পুরুষ কে আগা করতে পারে সেই নারী অমূল্য। বুঝে নিতে হবে তার মনজুড়ে কারো ভাবনা বিরাজ করছে। জানতে পারি কী সেই ‘কারো’ বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? বলতে পারেন আমাকে বন্ধু ভেবে।”
“আভ না আসলে আমি ভাবছিলাম আপনারা আমাদের আপ্যয়নে নিশ্চিন্ত অসন্তুষ্ট। বেশি কোনো আয়োজন করতে পারিনী।”
“ছিঃ এসব কী বলছেন আপনি শেহরীনা? আপনি আমাদের এতটা নিচু ভাবেন যে, আপনারা যা খাওয়ালেন তাতে আমাদের তৃপ্তি মিলেনি। তাহলে আমি বলছি আমার জীবনটা খুব স্ট্রাগলের মধ্যে কেটেছে। এই যে ব্যারিস্টার পদবী। সহজে পায়নি আমি। ছোট থেকে পরিশ্রমী হওয়ায় পড়াশোনার দায়ে মেসে থাকতে হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। মায়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে হলেও সেই ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে পারিনী। বাবা কতবার চাইতেন আমায় মেস থেকে ছাড়িয়ে নিতে। তবে আমার সুষ্ঠু মানসিকতা আমায় বাঁধা দিতো। সেই বাঁধার জোড়ে বাবাও হার মানতেন। মেসে থেকে দিনাপাতি করে টাকা জমিয়ে ডাল ভাত খেয়েও দিন কাটিয়েছে। কখনো কখনো টাকা না থাকলে এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতাম। টিউশনি করানোর সময় একটু আধটু মজার খাবার কপালে জুটতো। তারপর? তারপর তো যা পেতাম খেতাম। অবশ্য আপনি বলতে পারেন আমি তো উঁচু বিত্ত মানুষ তাহলে আরাম আয়েশে কেনো কাটায়নি। আপনার এই প্রশ্নের একটা জবাব আছে আমার কাছে। সেটা হলো আমি নিজ পরিচয়ে বাঁচতে চাইতাম। মাকে দেখেছি ছোট থেকে আমায় আর সাজিয়াকে উপর থেকে আদর স্নেহ দেখালেও অভ্যন্তরীণ তিনি অবহেলা করতে চাইতেন। সংসারে দেখতাম মায়ের হেঁয়ালি পনা। বাবা মায়ের দোষ চুপালেও আমরা অবুঝ ছিলাম না। বাবার ও কাজ ছিল তখন। মায়ের হেঁয়ালির কারণে সাজিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ত। তখন বাবার সময় হতো না আমার পেছনে সময় ব্যয় করার। আমি রাহ্ দেখতাম কবে বাবা মা দুজনেই দুজনকে বুঝেশুঝে আমায় সময় দেবেন। কিন্তু সেই রাহ্ আদৌও রাহ্ থেকে গেল। ব্যারিস্টার সারোয়ার আজ আমার কাছে কোনো কিছুর কমতি নেই , কমতি আছে শুধু মায়ের পরশের। যার আশায় আমি অপেক্ষিত। আশা করি আমার কথা আপনি বুঝতে পেরেছেন। যদি ভুলভাল বকে থাকি তাহলে আইম সরি।”
কথার ছলে কবে শেহরীনার চোখে জল চলে এলো। বুঝতেই পারল না সে। আজ পর্যন্ত ভাবত সেই একমাত্র অভাগী। যে কিনা মাকে পেয়েও অবহেলিত হয়ে এসেছে। তার চেয়েও বড় অভাগা তো ঐ ব্যক্তি যে মায়ের আঁচল পেয়েও সুপ্ত স্নেহের পরশখানা পায়নি। ঢোক গিলে কান্নাটুকু গিলে শেহরীনা অনুতপ্ত কণ্ঠে ক্ষমা চাইল তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে। যদিও সে কথাটুকু বলেছিল আক্ষেপের কারণে। আকস্মিক মেহমান বেশে র*ক্তমাখা জামায় ঘরের ভেতর আসা ব্যক্তিদ্বয় কে সে আর তার মা তাদের সাধ্যের ভেতর আপয়্যন করেছিল। তবে এখন সেই আক্ষেপ আর নেই শেহরীনার ভেতরে। মুচকি হেসে বলে,
“ভবিষ্যতের কথা জানি না। তবে মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে থাকলে আমার আক্ষেপ করা আর হবে না।”
কথাটুকু বলেই ফোন কেটে দিল সে। সারোয়ার স্তদ্ধ হয়ে শুনল। প্রথমে আশংকা হচ্ছিল মেয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য শুনাবে অবশেষে তার অতৃপ্ত কান সেই বাক্য শুনে ঠোঁট কামড়ে হাসল। ফোন রেখে দিয়েছে বুঝতে পেরে সারোয়ার ফোনটা বুকের মাঝে চেপে ধরে ধপ করে শুয়ে পড়ল।
তৃপ্তি অতৃপ্তির মাঝে তবে কী প্রণয়বার্তা আরম্ভ হতে চলেছে?
____
শেহরীনা অলস সময় পার করছিল। মাগরিব নামাজ শেষ করে সে টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসল। টেবিলের ডেস্ক খুলে সুঁ*ই আর সুতো বের তার একটা পুরনো কামিজ হাতে নিলো। বড় কাঁ*চি নিয়ে কামিজের হাতা কেটে নিল। সেই কামিজের চার দিক কেটে হিজাব বানানোর উদ্যোগ নিল। তখনি তার ভাই নাজমুর চিল্লিয়ে উঠে। নাজমুর চিৎকার শুনে হতদন্ত হয়ে কাজ ফেলে সোজা তার রুমে দৌড় দিল শেহরীনা। ভাইয়ের রুমে এসে দেখল সে বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে স্বাধীন স্বাধীন শব্দ আধুবুলিতে ঘুমের ঘোরে বলছে। শেহরীনা তার পাশে গিয়ে বসল। ইতিমধ্যে দরজার ধারে রূপালি বেগম আর নাছির উদ্দিন ও চলে এসেছেন। ছেলের অবস্থা সম্পর্কে অবগত নাছির উদ্দিন। তিনি ছেলের বিছানার বিপরীত পাশে গিয়ে দাঁড়ান। শেহরীনা চলে যেতে নিলে নাজমুর তার হাত চেপে ধরে। ঘুমে থেকেও ছেলেটা তার আহাট বুঝেছে ভাবা যায় বোনের প্রতি ভাইয়ের পরশ কতটা অমূলক। শেহরীনা পুনরায় বসে পড়ে। নাছির উদ্দিন ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে তার মুখের কাছে ঝুঁকলেন। চোখ বুঁজে নিরবে ঠোঁট নাড়লেন। শেহরীনা বুঝল তিনি ছেলেকে দোয়া পড়ে দিচ্ছেন। সন্তানের উপর বাবার সন্তুষ্টতা প্রদান করছেন তিনি। নাছির উদ্দিন চোখজোড়া খুলে কপালের ব্যান্ডেজ মোড়ানো স্থানে দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে পুরো মুখশ্রী জুড়ে ফুঁ দিলেন। তপ্ত শ্বাস ফেলে ছেলেকে কয়েকক্ষণ চেয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে দরজার ধারে রূপালি বেগম কে দেখে কিছুটি বললেন না। শেহরীনার উদ্দেশ্যে শুধু আওড়ালেন।
“রাতের খাবারটা তুই টেবিলে লাগাইস। তোর মায়ের সাথে আমার কথা আছে।”
সৎ বাবার কথায় শেহরীনা নির্লিপ্ত হয়ে মায়ের দিকে সন্দেহভাজন দৃষ্টি দেয়। রূপালি বেগম মেয়ের দৃষ্টিজোড়া পরখ করে ঘাবড়ে গেলেন। ইতিমধ্যে নাছির উদ্দিন স্থান ত্যাগ করেছেন। স্বামীর কথার বিপরীতে মেয়েকে বুঝ দিতে বললেন।
“আসলে আমার পেটে ব্যথা করছে। হঠাৎ ব্যথা করায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না মনে হচ্ছে। সেটাই উনি দেখছেন এজন্য….।”
মায়ের কথায় শেহরীনা তার ভাইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিরস কণ্ঠে আওড়ায়।
‘তোমাদের ব্যাপার স্যাপার তোমরাই জানো বুঝো।’
মাকে পাল্টা জবাব দেওয়ায় শেহরীনার আন্তরিক ভাবে মন্দ লাগছে। তবে সেও বা কী করবে! রূপালি বেগম মেয়ের কাছ থেকে তাচ্ছিল্যতা পেয়ে নিরীহ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে নিজ দম্পতি রুমে ফিরে গেলেন। রান্না তার শেষ হয়ে গিয়ে ছিল রুমে যাওয়ার মুহূর্তেই ছেলের চিৎকার শুনে ভয়ে চলে এসেছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক বিধেয় তিনি রুমে ফিরে দরজা আটকে দিলেন। নাছির উদ্দিন কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে বিছানায় শুয়ে আছেন। রূপালি বেগম ধিমি পায়ে বিছানার কাছে গিয়ে স্বামীর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন। নাছির উদ্দিন পায়ের আহাট পেয়ে বুঝে ছিলেন। তবে তিনি সাড়া দেননি। রূপালি বেগম ভাবলেন তার স্বামী বোধহয় বুঝতে পারেননি যে, তিনি রুমে এসেছেন। ফলে গলার স্বর নিম্ন করে ‘হুম এসেছি’। নাছির উদ্দিন যেমন ভাবে শুয়ে ছিলেন তেমনি আছেন। রূপালি বেগম পুনরায় ধ্যান আর্কষণ করার চেষ্টা করলেন।
‘আজ কী তবে দেখা করেই ফেলেছো নিজের ভাইয়ের সঙ্গে?’
আকস্মিক স্বামীর কথায় থমকে চমকে তাকান রূপালি বেগম। তার হাত পা কাঁপতে লাগল আনমনেই। স্বামীর প্রশ্নে কী জবাব দিবেন বুঝছেন না। নাছির উদ্দিন পুনরায় প্রশ্নটি করে। এবার সে সম্পূর্ণ পাশ ফিরে নিজ স্ত্রীর দিকে তাকান। রূপালি বেগম এতক্ষণ যাবত বন্ধ চোখা স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার ফেরে তাকানোয় নিজের দৃষ্টি লুকিয়ে নেন তিনি। গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে স্ত্রীর ভয়ার্ত চেহারা অবলোকন করছেন তিনি। অতৃপ্ত মনে হৃদয়ের মধ্যকার আবেগ লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘সাথে কে কে ছিল?’
রূপালি বেগম আশ্চর্য হলেন স্বামীর প্রশ্নে। চোখ পিটপিটিয়ে তার দিকে তাকান। নাছির উদ্দিন সেই অতৃপ্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। স্ত্রীর চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টিকোণ সরে গিয়ে আশ্চর্যময়ী প্রকাশ পাচ্ছে।
‘হুম বলো কে কে আসছিল?’
রূপালি বেগম আমতা আমতা করে বলেন,
“আসলে সিদ্দিক ভাইয়ের ছেলেই আমাদের মেয়ের জন্য দেখা সেই পাত্রের বাবা। পাত্রকে তো চেনেনই ব্যারিস্টার সারোয়ার সিদ্দিক।”
থমকে গেলেন নাছির উদ্দিন। ধপ করে উঠে বসলেন। কোনো কথা না বলেই পরণের জামা পাল্টে শার্ট প্যান্ট পরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা আকস্মিক হওয়ায় রূপালি বেগম প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পাননি। তিনিও ছুটে ঘরের দরজার দিকে চলে এলেন। স্বামীর চিহ্ন শুদ্ধ দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে টেবিলের কাছে বসলেন। শেহরীনা সবেই রুম থেকে বেরিয়ে ছিল। সৎ বাবাকে হতদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়েছে বটে। তবে মাকে চিন্তিত দেখে তার আশ্চর্যতা সন্দেহে রুপ নিলো।
চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)