প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
33

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৬

“দোস্ত তুই না কয়েকদিন আগেও বিয়ে করবি না বলে লাফাচ্ছিলি। তাহলে হঠাৎ তোর মাথায় বিয়ের ভূত ঢুকল কেনো? সারোয়ার ভাই কোনো জাদুটোনা করল না তো?”

শেহরীনা রেগে গেল। সে ইপশিতার কাঁধে চাপড় মে*রে বলে,
‘ধুর হা*রা*মী আমি সম্মতি দেয়নি এখনো। আমার মন এখনো সায় দিচ্ছে না। হ্যাঁ বলতে পারিস আমি সাময়িক সময়ের জন্য গলে গিয়ে ছিলাম। পরে ভাবলাম আমার লক্ষ্য কী? আমি পুনরায় কাউকে বিশ্বাসের ঘোরে ফেলতে চাইছি না। তুই তো জানিসই বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক টিকে না। কয়েকদিন পর যদি সারোয়ার এর পক্ষ হতে কোনো দ্বিতীয় বউ বিয়ের সময় এসে বলে আমি তার দ্বিতীয় বউ আমাকে লোভে পড়ে বিয়ে করেছিল নাহয় যে কোনো এক কারণে বিয়ে করে বাচ্চা দিয়ে ভেগে গেল। এমন পুরুষকে বিশ্বাস করা টাফ। সবচেয়ে বড় কথা কী জানিস? তার প্রথম বউয়ের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কেনো যেনো মানতে পারি না আমি। মনে হয় তার বলা কথায় মিথ্যে বর্ণনা জুড়ে আছে।’

চিন্তিত বান্ধবীর ধ্যান ফেরাতে ইপশিতা কোমড়ে আঁচলের ন্যায় উড়না গেঁথে বলে,

“ধুর ওতো ভাবিস কেনো হুম? আমরা আছি কী করতে বল?”

শেহরীনা বোকা বোকা নজরে চেয়ে বলে,
‘আমরা? হাহ্ আমরা আছি পড়ায় ডিম পেতে।’

জাফরান আর ফারদিন ফিক করে হেসে দিল। তারাও সিরিয়াস হয়ে শেহরীনার সঙ্গে আলাপে ছিল। তার সূক্ষ্ম কথায় তারা তাদের হাসি আটকে রাখতে পারল না। ফলে হেসেই ফেলে। ইপশিতা ‘আ’ শব্দ দিয়ে কোনো ধ্বনি প্রকাশ করার পূর্বেই হতদন্ত হয়ে আচমকা শেহরীনাকে কেউ জড়িয়ে ধরল। ব্যাপারটা মুহূর্তেই ঘটে যাওয়ায় চমকে গেল তারা। শেহরীনার শরীর রি রি করে উঠল ঘৃণায়। পরপুরুষের ছোঁয়া তাও কি-না তার আপন কেউ নয় বটে। শেহরীনা জোর লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। ফারদিন আর জাফরান রেগে গেল। তাদের বন্ধুকে জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে। ইপশিতা অবাক স্বরে ‘কায়েসাম’ নাম ধরল। শুনেই মেজাজ চওড়া হলো শেহরীনার। কায়েসাম শক্তহাতে জড়িয়ে আছে। ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। ফারদিন রেগে এক পিলে ঘু*ষি লাগাল কায়েসামের নাকে। তাতেও বিশেষ লাভ হয়নি। লোকটা বদমাইশি ধরণে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে। ভার্সিটির মধ্যে ব্যাপারটা সবাই অদ্ভুত নজরে দেখছে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শেহরীনা চেঁচিয়ে ‘ছাড় হা*রা*মজাদা ছাড় বলছি’ বলেই কায়েসাম এর পিঠে বেধমে আঘাত করছে। চোটের কারণে তার মুখ দিয়ে ‘আহ’ শব্দ অব্দি বের হচ্ছে। তবুও সে ছাড়ছে না। কায়েসাম উম্মাদ গলায় আওড়ে যাচ্ছে।

“আমায় প্লিজ ভালোবাসো না। আমি তোমার ভালোবাসা চাই‌। প্লিজ প্লিজ!”

তার মুখ থেকে প্রতিটা শব্দ যেনো বিষাক্ত লাগছে শেহরীনার কাছে। ইপশিতাও রেগে ফারদিনের সহায়তায় কায়েসামকে টেনে নিজের বান্ধবী কে দূরে সরিয়ে জোরালো এক চ*ড় বসাল কায়েসামের গালে। চ’ড় এর শব্দটা গুঞ্জনের ন্যায় ছড়ায়। স্তদ্ধ নিরবতা ছেয়ে গেল চারপাশ জুড়ে। ভীষণ জেদি কায়েসাম। তার যা চাই তা চাই মানে চাইই। সে ইপশিতার চ’ড় এ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। উল্টো বাঁকা হেসে বলে,

“কতদিন তোমার বান্ধবীকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে? এক দিন না এক দিন সে আমার বুকে….।”

পরের বাক্য উচ্চারণ করার পূর্বেই তার গালে পুনরায় চ’ড় পড়ল। এবারের চ’ড় কায়েসামকে উম্মাদ করে দিল। হিংস্র নজরে সামনে তাকাল। শেহরীনা জ্বলন্ত চোখে চেয়ে আছে। তার কপালের ভ্রু অব্দি টানটান হয়ে পড়েছে রাগের প্রতি সীমায়। সেও উত্তপ্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছে কায়েসামের ব্যবহারে। তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে,

“হাউ ডেয়ার ইউ টার্চ মি? বলে ছিলাম না সভ্য হতে শিখুন। অসভ্যের মত মাঠে নেমে অসভ্যতা দেখিয়ে কী লাভ হলো? নিজের সম্মান তো খুইয়ে ফেললেন। কী দাম থাকলো আর আপনার সিনিয়র ব্যাচ হওয়ার? এই আপনাকে না আপনার বাবার অবর্তমানে ভার্সিটির ট্রাস্টি হতে বলার অনুরোধে নোটিশ দেওয়া হয়েছে? এই আপনার ট্রাস্টি হওয়ার নমুনা। কোনো যোগ্যতা আছে কী আপনার মাঝে?”

ভার্সিটির ছেলে-মেয়ে গুলো কানে কানে ফসুরফাসুর করছে দৃশ্যপট দেখে। কায়েসাম এর সাঙ্গুপাঙ্গু ইতিমধ্যে খবর পেয়ে চলে এসেছে। তারা জানতো না তাদের লিডার বলতে গেলে ভার্সিটির মধ্যে তাদের দলের মান্যতা ছিল প্রচুর। সেই ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে আছে কায়েসাম। তার ছোট থেকে ছোট বিষয়ে খবরাখবর রাখে তারা। যেনো নিরাপত্তা আর রক্ষার ক্ষেত্রে সচেতন থাকে। ভার্সিটির আগাম ট্রাস্টি চ’ড় খেয়েছে শুনে তারা দলবেঁধে এসেছে। শেহরীনা দেখে ঘাবড়ে গেল না বরং তার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সে তাদের দেখে তাচ্ছিল্যের হেসে টোন মার্কা কথা শুনিয়ে দিল এই বলে,

“ওহ এখন দেখি আমাদের সাথে লড়াই করার জন্য সাঙ্গুপাঙ্গুদের নিয়ে এসেছো। ভালোই তো। এই ট্রাস্টির এমন রূপ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ভার্সিটির উন্নয়ন উন্নতি কতদূর অব্দি যাবে।”

কায়েসাম এর হিংস্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলে,’কুমারিনী আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না। তোমাকে মন দিয়ে প্রেম নিবেদন করছি। চুপচাপ মেনে আমার হয়ে যাও। রাজরাণীর কম মান্যতা পাবে না। দরকার পড়লে তার চেয়েও বেশি কিছু চাইলেও দেবো। কোনো ধরনের তামাশা চাইছি না।’

“ওহ রিয়েলি আপনি আমাকে বেশি কিছু চাইলে দেবেন পারবেন দিতে এক মেয়ের ছোট বেলায় মায়ের পরশ মায়ের আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসা ছোট বেলাকে ফিরিয়ে দিতে? পারবেন দিতে বলুন? পারবেন অসহায় ক্ষুধার্ত মেয়ের অসময়ের দিনগুলো ফিরিয়ে সেই দিনে আমায় পরিপূর্ণ করতে? পারবেন আমার অতীতের দাগ মুছে দিতে? সব মুখে বললেই হয় না। এমন কিছু কালো দাগ কপালে থাকে যেগুলো সরানো দায় হয়ে দাঁড়ায়।”

কায়েসাম নির্লিপ্ত তাকিয়ে ছিল শেহরীনার বলা কথাগুলো শুনে। তবে তার বলা শেষের কথায় তপ্ত শ্বাস ফেলে তার বাহুডোরে হাত দিয়ে ছুঁতে চাইলেই দুপা পিছিয়ে গেল শেহরীনা। কায়েসাম মুখে হাত চেপে জোরালো দম ফেলে হাতজোড়া পকেটে গুঁজল। অনিহার সত্তেও নিবিড় কণ্ঠে আওড়াল।

“একবার সুযোগ দিয়ে দেখো। তোমার অতীত শুদ্ধ ভুলিয়ে সুন্দর জীবনের নতুন রূপ দেখিয়ে আগলে রাখব। সেই ক্ষমতা আমার আছে।”

“কিন্তু আমার কাছে সেই ক্ষমতায় কোনো কিছু যায় আসে না। আজ প্রমাণ হয়ে গেল ছেলেরা বেশিই লাফায়। কারণে অকারণে তারা তাদের মর্জি চাপিয়ে দিতেই শ্রেষ্ঠ। বাট সরি টু সে আমি ঐসব চুপচাপ সহে নেওয়া মেয়েদের মধ্যে পড়ি না। তাই পুনরায় বলছি স্টে আওয়ে ফম মি।”

শেহরীনা তার বাক্যধারা বয়ান করেই ক্লাসের জন্য আগাল। তার পেছন পেছন ফারদিনরাও যায়। তারা কথা বলতে চেয়েছিল মাঝে তবে শেহরীনা চায়নি তারা নিযুক্ত হোক এই বিষয়ে। তার বিষয় সে একাই হ্যান্ডেল করতে পারবে। দীর্ঘশ্বাস বেরুল শেহরীনার অন্তরভেদ করে। শেহরীনার মুখশ্রী রক্তিম হয়ে আছে। তার ফোনে অনবরত মেসেজ করছে সারোয়ার। কিন্তু কায়েসাম এর স্পর্শে তার মন বিছিয়ে আছে। বিধেয় সে বিকৃত মনে ফোনটা সুইচ অফ করে দিলো। অন্যত্রে সারোয়ার হঠাৎ করে মেসেজ যাচ্ছে না দেখে ভ্রু কুঁচকে তার নাম্বারে কল লাগায়। শুনতে পেল মেয়েলী কণ্ঠস্বরে সার্ভিসিং।
‘আপনি যে নাম্বারে কল দিয়েছেন তা এ মুহূর্তে বন্ধ আছে।’
সারোয়ার এর মন খারাপ হয়ে গেল। মূলত সে মেসেজ করে শেহরীনার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। আজ চাইছিল একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে শেহরীনাকে। তার এখন অব্দি সে দিনের কথা মনে পড়ে যখন ভার্সিটির থেকে শেহরীনাকে সঙ্গে করে কফিশপে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছে পোষণ করে ছিল সে। নিমিষেই মেয়েটা গাড়িতে থাকা অবস্থায় নাকচ করে দেয়। সেদিনও কষ্টে বিজড়িত মনকে বুঝ দিয়ে ফেলেছিল। তার হঠাৎ নাকচে সেও দ্বিরুক্তি করেনি। তবে সুন্দর এক মুহুর্ত তার মন কেড়েছিল। মেয়েটার হরিণী চোখের ডাগর ডাগর কাজলরেখা দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল ভীষণ। ফারদিন তার বন্ধুর মনখারাপি দেখে বিষয়টা আমলে নিয়ে শেহরীনার বাহুডোরে নাড়া দেয়। সেও ধ্যানচ্যুত হয়ে তার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ‘কী’ বোঝায়। ফারদিন ও ইঙ্গিত করে ‘কী হয়েছে’ বলে। শেহরীনা মৃদু হেসে ‘কিছু না’ বলে উঠে। শুনে ফারদিন ও আর ঘাঁটল না। ইপশিতা অপলক তাকিয়ে আছে ফারদিনের দিকে। মানুষটার ভেতর কী টান বোধ আছে আদৌ? একটা মেয়ে কতক্ষণ যাবত তার দিকে হ্যাংলার মত তাকিয়ে আছে। তাও মানুষটা নিরামিষ বেশে বসে আছে। ব্যাপারটায় ভীষণ বিরক্ত সে। বিড়বিড়ে ‘গাধা’ বলে আখ্যায়িত করল ফারদিন কে। ফারদিন ইপশিতাকে আপন মনে বিড়বিড় করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
‘কী হলো তুই আবার কী মুখ চালাস?’
ইপশিতা চোখ ঘুরিয়ে ভেংচি কেটে বলে,’নাথিং’। ফারদিন স্যারের ক্লাসেও ফিসফিসিয়ে ইপশিতাকে ব্যঙ্গ করে বলে,
‘পেত্মীদের তো আবার মুখ এমনিতেই চলে। তাদের বললেও লাভ নেই,না বললেও লাভ নেই। তাই চুপ করেই বসে থাক।’

ইপশিতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে। মুখ ফুলিয়ে চোখের ইশারায় ভস্ম করার ইঙ্গিত দেয়। দেখে ফারদিন জ্বিভ দেখিয়ে পুনরায় ব্যঙ্গ করে। দুজনের ঝগড়া বাড়ার পূর্বেই শেহরীনা দুজনের পায়ের উপর পারা দিলো। ব্যাপারটা আকস্মিক হওয়ায় জোরেসরে ‘আহ’ করে চেঁচিয়ে উঠল তারা। শেহরীনা ঘাবড়ে মুখ নামিয়ে টেবিলে হেড ডাউন করে ফেলে। মনে মনে ‘চ’ উচ্চারণ করে গা*লি ছুঁড়তে গেলেই স্যারের কণ্ঠস্বর শুনে থমথমে মুখ করে হেড আপ করে দেখে। স্যার ভ্রু কুঁচকে দুজনের দিকে গম্ভীর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
‘এটা কী চিৎকার চেঁচামেচি করার ক্লাস পিরিয়ড পেয়েছো? তোমাদের দেখি ম্যানার্স নেই। চুপচাপ ক্লাস করো। না বুঝলে পরীক্ষায় ডিম পাবে।’
শুরু হলো হিসবুল স্যারের মহামূল্যবান বাণী সমগ্র। মাঝ মধ্যে মনে হয় লোকটা বকা নয় বাণী শুনাতেই উস্তাদ যতসব। হিসবুল স্যার হাঁপিয়ে উঠেছেন। দুজনকে বসতে বলে তিনি এক ঢক পানি খেয়ে নিল। এতে ছাত্র-ছাত্রী নিরামিষ ভাবে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা মোটেও স্যারের ক্লাস করতে ইন্টারেস্টেড নয়।

____
সারোয়ার বিধ্বস্ত মনপ্রাণ নিয়ে তার কেবিনে বসে আছে। হাতে থাকা কেসের ফাইল ঘেঁটে দেখার মত মনমানসিকতা পাচ্ছে না। তবুও আজ তার জরুরি তলব করতে হবে। নতুন কেসের ইনভেস্টিগেশন চলছে। কোর্টে যতক্ষণ না অপরাধীকে শাস্তি পাওয়ে দিচ্ছে ততক্ষণ সে শান্তিতে বসতে পারবে না। তার ভাবনার মাঝেই তার বিপক্ষী দলের লোক তার কেবিনে প্রবেশ করে। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। লোকটা রাজনীতিবিদ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আলতু ফালতু দলের কর্মী তার কেবিনে ব্যাপারটায় মনেমন চটে গেছে সে। তবে সরল মুখশ্রী নিয়ে তাকিয়ে থাকল। লোকটা সারোয়ার এর সামনে পাঁচশ টাকার নোট ভর্তি একটা ব্যান্ডিল টেবিলের উপর ফেলল। তাকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে বলে,

“আমি চাই আপনি নিরাপদে নিশ্চিন্তে থাকুন। কাল পরশু কোর্টে আইনের সুবিচার হোক। আমার লোক যাতে নিরাপদে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে আসুক। সেই ব্যবস্থা করার জন্য এই উপহার দিচ্ছি।”

সারোয়ার তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে টাকার নোটের বান্ডিলটি ধরে ডেস্কের ভেতর ঢুকিয়ে নিল। বাঁকা ঠোঁটের হাসি দিয়ে বলে,

“ভেবে নেন ইন শা আল্লাহ সুবিচার কার্য হয়েই গেল।”

লোকগুলো কুকুরের ন্যায় হেসে খেলে দাঁত দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সারোয়ার এর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে চেয়ে ছিল। যা কৌশলে এড়িয়ে যায় সে। চেয়ারে গাঁ হেলিয়ে চোখ বুঁজে নিল। তার কেবিনে মুখ মলিন করে প্রবেশ করে সারোয়ার এর পিএ তানভি। ছেলেটা তার স্যারের কেসের বিপক্ষী দলের লোকদের দেখে থমকে গিয়ে ছিল। কোনো হাঙ্গামা হবে ভেবেছিল তবে এই তো নিরব দৃশ্য ঘটেছে। তারা টাকা দিল আর তার স্যার সেই টাকা হাতিয়ে নিল ব্যাপার খানায় ভীষণ বাজে প্রভাব ফেলে তানভিরের মনে। তার স্যার ঘুষখোর ভাবাটা যেনো তার জন্য কষ্টকর লাগছে। তবুও সে তার স্যারের ব্যক্তিগত কর্মী। না চেয়েও সবটা মুখ বুঁজে সহ্য করতে হবে। দেশের পরিস্থিতিতে সে ভেবেছিল তার স্যার সঙ্গ দেবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কে অপরাধীদের হাত থেকে লড়াই করে ছাঁটাই করবে। যার ফলে তারা লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে কিন্তু এতো যেনো উল্টো দৃশ্য। তানভি আর কিছুটি না ভেবে ব্ল্যাক কফি তার স্যারের টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল। সারোয়ার চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় মৃদু হাসল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

চলবে…….

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৭

“আপনাকে কোথায় কোথায় না খুঁজে বেড়াইলাম। আপনে কই চলে গেছিলেন? জানেন না আপনার মাইয়াডা আপনারে ছাড়া খানাপানি খায় না। তাও কেন না বলে চইলা গেলেন? পুরো একদিন কোথার থেকে আসছেন ঘরে? সত্য কথা বলবেন কিন্তু। যে বেডা তার স্ত্রীর উপর হাত উঠাতে পারে তার কাছে পতিতালয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না।”

কথাটা বলতে দেরি কিন্তু রূপালি বেগম এর গালে চ’ড় মা*রতে এক মুহুর্ত ব্যয় করলেন না নাছির উদ্দিন। নাসমা তার মায়ের গালে চ’ড় পড়তে দেখে ভয়ে গুটিয়ে গেল। দরজার কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। তার বাবা যে তার মায়ের উপর হাত তুলেছে এ যেনো তার প্রথম দেখা দৃশ্য। সে সবসময় জেনে এসেছে তার বাবা মায়ের মধ্যকার সম্পর্ক খুব মধুর। তবে আজ কী এমন হলো যার কারণে তার বাবা হাত উঠিয়েছে। নাসমা ঢোক গিলে আমতার কণ্ঠে ‘বা বাবা বাবা’ বলে ডেকে উঠে। নাছির উদ্দিন থমথমে মুখখানা নিয়ে পেছন ফেরেন। নাসমাকে দেখে উত্তপ্ত রাগকে নিয়ন্ত্রন করে নিলেন। তবে নিজ স্ত্রীর দিকে ফিরে অব্দি চাইলেন না। রূপালি বেগম তাচ্ছিল্যের হাসলেন। এই আর এমন কী? নাসমাকে দেখে তিনি মৃদু গলায় আওড়ায়।

“মা তোমার না দশটায় এক্সাম? যাও পড়তে বসে যাও। তোমার হাতে শুধু একঘণ্টা আছে। তোমার মাম্মা দুধ নিয়ে আসতেছে কেমন? যাও এখন।”

মায়ের কথা শুনে মাথা নুইয়ে রুমের বাহির থেকে সরে গিয়ে নিজের বড় ভাইয়ের রুমে চলে গেল নাসমা। তার ভাবনা তার বড় ভাইকেও সে চ’ড় এর বিষয়টা জানাবে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বিধেয় বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শুনতে চাইবে।
অন্যত্রে, নাছির উদ্দিন কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন সোফায়। রূপালি বেগম এর চোখের থেকে পরপর জল গড়াচ্ছে। তবুও মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। নিজ মনে রুম সাফসুতরো করে বেরিয়ে গেলেন। নাছির উদ্দিন দেখে ‘ও আল্লাহ্’ বলে মৃদু আর্তনাদ করে চোখ বুঁজলেন। তার চোখ থেকেও জল গড়ায়। কিন্তু কেনো? তা হয়ত শুধু এক বাবা, এক পুরুষই জানেন ভালো। তার চেয়েও বড় আল্লাহর কাছে তার সমাধান আছে। নাজমুর গম্ভীর মুখে বোনের পুরো কথা শুনল। সেও নিরুক্ত। উঁচু গলায় বাবার সঙ্গে তর্ক করার মত বয়স তার এখনো হয়নি। সে নিজেই বাবার সঙ্গে কলেজ যাওয়া আসা করে। তার বাবার সহায়তায় তার পড়াশোনা চলছে। ফলে সে কীভাবে বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে?লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তখনি ঘরের দরজায় জোরালো আঘাত হয়। কেউ এসেছে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে বোধহয়। নাসমা তার ভাইয়ের কাছ থেকে উঠে ছুটে দরজা খুলতে গেল। ভাবল তার বোন এসেছে। দরজা খুলতেই অপরিচিত লোক কে দেখে মুখটা মিইয়ে গেল নাসমার। নাসমা কে দেখে লোকটা তার পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন।

“মামুনি তোমার বাবা কোথায় গো? তারে দেখতাছি না যে?”

“বাবা তো রুমে আপনি কে?”

লোকটা পুনরায় ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলেন,
‘মামুনি আমি তোমার বাবার দোকানের পুরাতন মালিক। তারে একটু ডাকো চাই। কথা বলতাম।’
রূপালি বেগম উঠানে চলে গিয়ে ছিলেন। তার পালিত গরু কে খাওয়াবেন ভেবে। গরুকে খাবার দিয়ে ঘরের ভেতর আসতেই অপরিচিত লোককে দেখে মাথায় ঘোমটা টানলেন। ইতিমধ্যে লোকটার চোখ জ্বলমলে উঠল রূপালি বেগম কে দেখে। ঢং মে*রে রূপালি বেগম কে দেখে লাজুক হেসে বলেন,

“আপা কেমনডা আছেন? দিনকাল কেমন যায় আপনার? অনেক দিন হইলো আপনার হাতের পানি খায় না। একটু পানি দিয়ে আমার গলার তৃষ্ণা মেটায় দেন না।”

কথাগুলো শুনে অস্বস্তি বোধ করছেন রূপালি বেগম। তবুও মুখে প্রকাশ করেননি। অনিচ্ছাকৃত হলেও গ্লাসে পানি ঢেলে এগোলেন। তখনি স্ত্রীর হাত থেকে ছুঁ মে*রে পানির গ্লাসটি নিয়ে ঢক ঢকে খেয়ে নেন নাছির উদ্দিন। আকস্মিক কাজে চোখ পিটপিট করে তাকান তারা। নাসমা কী বুঝল কে জানে? সে মিটমিটে হাসল লোকটার হা হওয়া মুখ দেখে। নাছির উদ্দিন গলা কলকলিয়ে পানি খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন মত বলেন,

“আহ্ অনেকক্ষণ পর যেয়ে গলার তৃষ্ণা মিটলগো বউ। কতক্ষণ ধইরা তোমারে ডাক শোধালাম। আইলা না কেন?”

স্বামীর মুখ থেকে আদুরীয় গলা শুনে থম মে*রে তাকিয়ে রইলেন রূপালি বেগম। লোকটা মুখ গম্ভীর করে গলা ঝেড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। নাছির উদ্দিন শব্দ শুনে পাশ ফেরে তাকান। মোকতাব মিয়াকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন।

“আরে মোকতাব মিয়া আপনি? কী খবর আসেন ভেতরে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে এসে বসেন না।”

মোকতাব মিয়া হাসল না তবে হেহে করে বলে,
‘নারে সাব বসব না। পানি চাইছিলাম তা..।’
‘ওহ হ্যা আপনি পানি খাবেন দাঁড়ান মিয়া আমি দেয়। আমি থাকতে মেহমান তৃষ্ণার্ত থাকবে নাকি?’
কথা বলার ছলে গ্লাসে পানি ঢেলে মোকতাব মিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে গ্লাসটা তার দিকে দেন। মোকতাব মিয়া একপলক রূপালি বেগম কে দেখে মৃদু হেসে পানির গ্লাসটি নিয়ে পানি পান করলেন। নাসমা ধীমি পায়ে হেঁটে তার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মোকতাব মিয়া পানি খেয়ে গ্লাসটা নাছির উদ্দিন এর কাছে দিলেন। তিনিও সন্তপর্ণে গ্লাসটা ধুয়ে রেখে দেন। পুনরায় মোকতাব মিয়ার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন।

“তাহলে আপনি বলুন এবার। কেন এসেছেন হঠাৎ?”

“ভাই সাব দোকানের নতুন মালিক তো আপনি। তবে দেখতে হবে না ঐডা কার নামে? দোকান চালাইতেছো আজ কয়েক বছর ধইরা। আপনার বাপে তো লোন নিয়াছিল যে ঐডা তো হাতে পেলাম না। তাই আইসা মনে কইরা দিলাম। আপনার বাপ নাই দেইখা এখন ঐ লোনের হিসেব আপনারে দিতে হবো।”

‘লোন’ শব্দটা শুনে স্তদ্ধ হয়ে গেলেন রূপালি বেগম। অবাক দৃষ্টিতে নিজের স্বামীর দিকে তাকান তিনি। নাছির উদ্দিন নিরুত্তর চেহারায় একপলক স্ত্রীর দিকে তাকান। নিরস গলায় মোকতাব মিয়াকে আদেশ করেন।
‘আপনে বাহিরের চেহারায় বসে থাকুন। আমি আইতাছি এখনি। রুমে যাইতেছি একটু।’

“ওহ ঘরের ভেতর বইতে পারুম…।”
মোকতাব মিয়ার কথা পরিপূর্ণ হওয়ার আগেই নাছির উদ্দিন উত্তপ্ত নজরখানা তার উপর ফেলেন। দেখে মোকতাব মিয়া হেহে হেসে বাহিরের বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসে যান। নাছির উদ্দিন দরজা আটকে রুমে যান। নাসমা কে রূপালি বেগম তার বোনের রুমে পাঠিয়ে দেন। তিনিও ছুটে স্বামীর কাছে গেলেন। নাছির উদ্দিন আলমারির দরজা খুলে একটা পুঁটলি বের করেন। সেখানে তিনি মাসখানেক টাকা জমিয়ে রাখেন। বাচ্চাদের টাকার ফি আলাদা রাখেন। যাতে কোনো কমতি তাদের পড়াশুনার উপর না আসে। তবে স্ত্রীর জন্য জমানো টাকায় দেখলেন ৫০ হাজার টাকা জমা হয়েছে। স্ত্রীর জন্য জমানো টাকা তিনি দিয়ে দেবেন ভেবেই নিজের কাছে তিনি মলিন অসহায়ত্ব বোধ করেন। তার হাতের কাছে যা জমানো টাকা আছে তা দিয়ে তিনি ঘরের যাবতীয় খরচের জন্য রাখেন। তপ্ত শ্বাস ফেলে বাচ্চা স্ত্রীর কথা চিন্তা করে তিনি স্ত্রীর টাকা ধরেননি। খরচের জমানো টাকা ২০হাজার টাকা পকেটে গুঁজে পুঁটলিটা যত্ন করে রেখে দেন। দরজার পাশ ঘেঁষে এককোণে নির্লিপ্ত হয়ে স্বামীর কাণ্ড দেখছিলেন রূপালি বেগম। স্বামীকে টাকা নিয়ে যেতে দেখে তিনিও পিছু পিছু যান। মোকতাব মিয়ার কাছে টাকা টুকু এগিয়ে দিয়ে বলেন,

“আপাতত ২০হাজার টাকা রাখুন। বাকি ৮ হাজার টাকা আমি সামনের বছর দেওয়ার চেষ্টা করব।”

মোকতাব মিয়া টাকা দেখে খুশি হলেও নাছির উদ্দিন এর মুখে পরের বছর বাকি টাকা দেওয়ার কথা শুনে আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
‘মজা পাইছেননি আপনে? ব্যাংকের থেকে লোন নিয়ার ব্যাপার বুঝেন না নাকি? আপনে তো দোকানি মানুষ এ ব্যাপারে ভালা বুঝা উচিৎ আপনার। আমি কিছু জানি না আমার বাকি টাকা তিনমাস পরই লাগবো।’

নাছির উদ্দিন উত্তেজিত হয়ে গেলেন। অবাক হয়ে মোকতাব মিয়া কে বলেন,
‘কী বলছেন মাত্র তিনমাস? এই তিনমাসের ভেতর ৮হাজার টাকা কেমনে আনবো আমি? আপনি জানেন না এখন পরিস্থিতি খারাপ। ব্যবসায় ঘাটতি লাগছে। আপনিও একবার দোকানি মানুষ ছিলেন আপনিও তো জানেন।’

হঠাৎ ছপছপ শব্দ হয়। তাদের কথার মাঝে কারো পায়ের শব্দ শুনে তাদের নজর সেদিকে পড়ে। নাছির উদ্দিন বড় মেয়ে শেহরীনাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে মোকতাব মিয়ার দিকে তাকান। লোকটার লোভী চোখ জ্বলমলে উঠতে দেখে তিনি কঠোর গলায় ‘শেহরীনা’ বলে ডেকে উঠেন। মোকতাব মিয়াও নামটা মনে মনে স্মরণ করে নেন। শেহরীনা ভার্সিটির থেকে সবে মাত্র ঘরে ফিরেছে। সৎ বাবাকে অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সে চুপচাপ ভেতরে যাচ্ছিল। তখনি তার সৎ বাবার ডাক শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাছির উদ্দিন গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

“সোজা গিয়ে পরিষ্কার হইয়া খাইয়া ঘুম যাও গা।”

শেহরীনা চোখ ঘুরিয়ে পাত্তাহীন ভেতরে ঢুকে পড়ল। নাছির উদ্দিন এর মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে প্রকাশ করলেন না তিনি কবেই বা বড় মেয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করেছেন যে একদিনের ভালো ব্যবহারে মেয়েটা তার সাথে আহ্লাদ করবে! মোকতাব মিয়া জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে নাছির উদ্দিন কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“আইসা হুনেন আপনারে একবছরের মত সময় দিলাম। তবে এই উপকারের জন্য আমার কিছু লাগব।”

নাছির উদ্দিন খুশি হলেন তবে চাওয়ার কথা বলায় তিনি প্রশ্নাতীত নজরে তাকান। মোকতাব মিয়া হেহে করে হেসে বলেন,

“আরে জ্যান্ত কিছুই চাইতে পারব তাই না? এই মজা বুঝেন না আপনি?”

“ওহ ঐডা বলেন আমি তো রেগে যেতাম অন্য কিছু চাইলে।”

নাছির উদ্দিন এর সাথে কুশল আলাপ শেষে বিদায় নেন মোকতাব মিয়া। তবে জানালার দিকে উঁকি দিয়ে শেহরীনাকে দেখতে ভুলেন না। শেহরীনা ঘরের ভেতরে সোফায় বসে ছিল। রাস্তার মোড়ের দিকে যাওয়ার সময় সোফায় বসা ব্যক্তিদের দৃশ্য দেখা যায়। সেই হিসেব মোকতাব মিয়া শেহরীনার চুলের দিকটাই দেখতে পেলেন।
রূপালি বেগম খাবার দিয়েছেন টেবিলে। মনে মনে হাঁসফাঁস করছেন তিনি স্বামীর কাছ থেকে ব্যাপার খানা জিজ্ঞেস করার। তবে সন্তানদের ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে আগে। তাই স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। শেহরীনাও বসে আছে। ঘরের নিয়ম সবাই একসাথে খাবে। নাছির উদ্দিন লুঙ্গি গেঞ্জি পরণে দিয়ে খেতে আসেন। শেহরীনা কে দেখে রাগজড়িত গলায় বলেন,

“যহন যেটা কমু সেটা মানবে বুঝলাম না আলগা ভাবখানা দেখাস কেন হুম? ভাব দেখাস বাপরে। জানিস না তোর ফি আমি দেয়নি। ভুলে যাস নাকি এইডা? শেষবার কইতেছি আমি কিছু কইলে সেটা হুনবি নাহলে ঘরের বাইরে চলে যাস আজীবনের জন্য। এহন তুমি আমার মুখ দেখে বসে আসো কেন? খাবার বাড়তে জানো না?”

রূপালি বেগম মৃদু গলায় ‘দিচ্ছি’ বলে স্বামীর বাটিতে খাবার বেড়ে দেন। একে একে সবার বাটিতে খাবার বেড়ে স্বামীর অগোচরে শেহরীনার কাঁধে হাত রাখেন। শেহরীনার কী হলো কে জানে এ প্রথম মায়ের ভরসার হাত পেয়ে সে নিশিথা মনে মায়ের দিকে তাকায়। তবে মায়ের গালের একপাশ ঢেকে রাখা দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে শেহরীনার। রূপালি বেগম চুপচাপ হাত সরিয়ে খেতে ইঙ্গিত দেন। শেহরীনা মাথা নুইয়ে থেকে স্বাভাবিক খাবারে মন দেয়। রূপালি বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে স্বামীর বদভ্যাস কে পরিবর্তন না করতে পেরে হতাশ। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস তেমন ছিল না দেখে চলে এসেছে সে। মিনিট খানেক পর তাদের খাওয়া শেষ হলে; রূপালি বেগম নাসমাকে পরীক্ষার হলে যাওয়ার জন্য সাজিয়ে দিয়ে বইপত্র গুছিয়ে স্বামীর সঙ্গে পাঠিয়ে দেন।

_____
রাতে রূপালি বেগম নাসমাকে পড়িয়ে খাবার গরম করতে আসেন। নাজমুর সুস্থ এখন। দেশ স্বাধীন হওয়ায় সে খুব উত্তেজিত সেবা শ্রুতিমধুর দিয়ে ছাত্রজনতার সঙ্গ দেওয়ার জন্য। তাই সে প্রতিদিন দুপুরে চলে যায় আসে রাত দশটায়। ছেলেকে আসতে দেখে তিনি শরবত এগিয়ে দেন। তার মাঝে মাগরিবের পর পর পুনরায় দোকানে বসেছেন নাছির উদ্দিন। ঘরের ভেতরে এখন তারাই বিদ্যমান। শেহরীনা এই সুযোগ ভেবে মায়ের রুমে গেল। রূপালি বেগম মাথা বালিশে রাখা অবস্থায় চোখ বুঁজে আসেন। মাকে ঘুমন্ত ভেবে শেহরীনা ডেকে তোলার সাহস পেল না। মানুষটা এমনিতে ঘুমানোর বেশি সুযোগ পান না। এখন নাহয় ঘুমিয়ে নিক ঠিকভাবে। শেহরীনা ফিরে রুমে চলে এলো। ফোনটা হাতে নিতেই অবাক আজ সে সারাদিন‌ ফোন অফ করে রেখেছিল। ফোনটা চালু করতেই সারোয়ার এর কল দেখে তার মনটা পুনরায় খারাপ হয়ে যায়। তবে কল ব্যাক করে না সে। ফোনটা সেভাবে ফেলে রেখে শুয়ে পড়ে। খাবার পরে খাবে সবাই মিলে বসলে। আপাতত তার মনমেজাজ ঠিক হোক।
অন্যত্রে, সারোয়ার বিষয়টা খেয়াল করে উদাসীন হয়ে যায়। মেসেজ গিয়েছে দেখে ভেবেছিল শেহরীনা নিজ থেকে কল দেবে কিন্তু বিপরীত দিক ঘটায়। সেও কিছুটি বলল না। হয়ত এই তার কপালের লিখন। একটু একটু প্রণয়ের দিকে এগোছিল তাও এক নিমিত্তে সমাপ্ত এই বুঝি লিখা ছিল কপালে? সারোয়ার মৃদু হাসল। এই হাসি না সুখের, না খুশির। এই হাসি তাচ্ছিল্যের। সেও ফোনটা ফেলে রেখে জানালার সাথে যুক্ত বেলকনিতে গিয়ে চেয়ারে গাঁ হেলিয়ে দেয়। সুন্দর জোৎস্না ভরা চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মন মাজারে নিজের প্রতি অভিযোগ তার। পণ করে নিল সঙ্গিনী করলে শেহরীনাকেই করবে কখনো আর বিয়ে শব্দের সাথে মন বাঁধবে না।
ভেবেই চোখ বুঁজে নেয়। মৃদু ঠান্ডা বৃষ্টিময় বাতাসের তালে সে ঘুমের মধ্যে পাড়ি জমাবে। আকাশ মেঘলা তবে বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। বিধেয় আজ সারা রাত সে বাহিরে কাটাবে।

চলবে……..

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৮ (অর্ধ সত্য প্রকাশ)

মায়ের গালে চ’ড় এর চিহ্ন দেখে শেহরীনার বিশ্বাস হয়ে গেল এই কাজ তার সৎ বাবা ছাড়া আর কারো নয়। সে তৎক্ষণাৎ মাকে সরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে গলা চেঁচিয়ে বলে,

“আপনার মত বাপ যেনো কোনো সন্তানের না হোক একই ভাবে আপনার মত স্বামী যেনো কোনো স্ত্রীর না হোক। আপনার না‌ আছে বাবা হওয়ার যোগ্যতা আর না আছে একজন স্ত্রীর স্বামী হওয়ার যোগ্যতা। আপনি একজন কাপুরুষ বুঝলেন? কাপুরুষ।”

নাছির উদ্দিন এর কথাগুলো সহ্য হলো না। মধ্যরাতে মেয়ের গলা চেঁচানোয় যেমন বিরক্ত বোধ করছেন তেমনি তিক্ত কথার ফাঁদে পড়ে ‘ঠাসস’। তিনি এ প্রথম যুবতি মেয়ের উপর হাত উঠালেন। মধ্যরাত্রীতে চ’ড় এর শব্দটা যেনো পুরো ঘরময় গুঞ্জন ঘটিয়েছে। রূপালি বেগম সোজা গিয়ে শেহরীনাকে ঝাপটে ধরেন। নাছির উদ্দিন ঢোক গিলে শেহরীনার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রূপালি বেগম কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“মেয়েটার সাহস দেখছো নেহ্! তোমাকে না কইতাম মেয়েরে ছোট থাকতে হোস্টেলে ভর্তি কইরা দাও। ঘরের ভেতর থাইকা কোনো আদব কায়দা শিখছেনি? কেমনে বাপের লগে মুখের উপর কথা কই। এইনি তোমার শিক্ষা দিক্ষার নমুনা। তোমার থেকে পুকুরে গিয়ে ডুবে মরা উচিৎ। তুমি মরো না দেখেই আমার জীবনে যতসব অশান্তি। সব ফ্যাসাদের মূল তো তুমি। অশান্তির আরেক নাম রূপালি বেগম।”

নাছির উদ্দিন এর গলা শুকিয়ে এলো। তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। ধপ করে বিছানার উপর শুয়ে পড়েন। এ দৃশ্য যেনো হজম হলো না তাদের। রূপালি বেগম স্বামীকে বুকে হাত চেপে নেতিয়ে পড়তে দেখেই চিৎকার করে ‘নাছির’ বলে ডাক দেন। শেহরীনা নিজেও হতবাক। রূপালি বেগম স্বামীর কাছে গিয়ে তাকে জাগানোর চেষ্টা করেন। তবে নাছির উদ্দিন কোনো সাড়া প্রতিক্রিয়া দেন না। এ দেখে তিনি রাগান্বিত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলেন,

“এই তুই দাঁড়িয়ে আমাদের মুখ কী দেখছিস? তোর বাবাকে দেখ না। কথা বলছে না চোখ ও খুলছে না। জলদি পাশের বাড়ির তোর রুমা আন্টির জামাই ইসমাইল মিয়াকে ডাক গিয়ে। জলদি যাহ্ না মুখ কী দেখছিস?”

শেহরীনা মাথা দুলিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘরের থেকে বেরুলো। রূপালি বেগম স্বামীর হাত-পা গরম আভার জন্য লাগাতার মালিশ করছেন। শেহরীনা রুমা আন্টির ঘরের সামনে এসে জোরে সরে দরজায় বা*রি দিতে থাকে। ইসমাইল মিয়া ঘরের বাহিরের দরজা খুলতেই শেহরীনা চিন্তিত গলায় তার সৎ বাবার কথাটা বলে। তিনি শুনেই তৎক্ষণাৎ বউ সমেত তাদের ঘরের ভেতর আসেন। ইসমাইল মিয়া নাছির উদ্দিন এর অবস্থা বেগতিক দেখে সোজা হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি নিজের গাড়িতে উঠানোর জন্য নাছির উদ্দিন কে চেপে ধরেন। রূপালি বেগম সহায়তা করছেন। মাঝে নাসমা আর নাজমুর মায়ের সঙ্গে যেতে চাইলে তিনি রুমা আন্টির কাছে তাদের থাকতে বলে দরজা বন্ধ করে গাড়িতে উঠলেন।
ঘণ্টাখানেক হাসপাতালের মধ্যে অসহায় হয়ে বসে ছিল তারা। শেহরীনা অনুশোচনায় ভোগে বারংবার কেবিনের দরজায় লাগোয়া আয়নার মাধ্যমে ভেতরে ডক্টর আর নার্সদের কাজ দেখছিল। ইসমাইল মিয়া নাছির উদ্দিন এর হঠাৎ খারাপ অবস্থা দেখে রূপালি বেগম কে আশ্চর্যের সহিতে জিজ্ঞেস করেন।

“নাছির মিয়া তো দিনের বেলায়ও কত না সুস্থ ছিলেন। রাতে কী এমন হয়েছে ভাইয়ের যে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে?”

শেহরীনা মাথা নুইয়ে রাখল। রূপালি বেগম একপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বলেন,

“উঠোনে ঝাড়ু দিচ্ছেন সেসময় পানি খেতে ভেতরে এসেই এমন অবস্থা হয়েছে।”

তাদের কথার মাঝে ডক্টর মাস্ক খুলতে খুলতে বের হলেন। শেহরীনা বসার থেকে দাঁড়িয়ে যায়। অধীর আগ্রহে ডক্টরের মুখপানে তাকিয়ে রইল। রূপালি বেগম তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেন। ডক্টর চিন্তিত কণ্ঠে আওড়ান।

“উনার কন্ডিশন খুব নাজুক। মিনি স্ট্রোক এসেছিল। একটা ছোট অপারেশন করতে হবে। নাহলে উনার এই স্ট্রোক পুনরায় ভয়ানক রূপে আসার সম্ভাবনা আছে। অপারেশন এখন করা যাবে না। অন্ততপক্ষে দুদিন অপেক্ষা করতে হবে। শরীর একটু মানিয়ে এলে অপারেশন এর প্রিপারেশন নেওয়া হবে। ততদিন উনাকে হাসপাতালে এডমিট করাতে হবে। আর দুঃখিত পেশেন্ট এর অপারেশন যেহেতু করতে হবে সেহেতু কিছু ফর্মালিটিজ পূরণ করতে হবে আপনাদের। খরচ যাবে প্রায় বিশ হাজারের মত। কারণ হাসপাতালে উনাকে এডমিট করালে উনার খাওয়ারের ব্যবস্থা যাবতীয় খরচ মিলিয়ে এতটা লাগবে। বাকিটা আপনাদের ইচ্ছে।”

শুনে সবার মুখ থমথমে হয়ে গেল। ইসমাইল মিয়া তাদের মুখপানে তাকিয়ে বলেন,

“আপা আমার তো ঘরে কিছুটা টাকা আছে সব মিলিয়ে আশি শতক হবে আপনি চাইলে নিতে পারেন।”

রূপালি বেগম মুখে হাত ঢেকে কাঁদছেন। তাদের জীবন থেকে দূর দশা যাচ্ছেই না। শেহরীনা মায়ের অবস্থা দেখে আরো ভেঙ্গে পড়ছে। তবে সে তার মাকে সাহস জোগাবে ভেবে মায়ের কাঁধে হাত রাখেন। সে মুহুর্তেই তিনি রেগে তাকে ধাক্কা দেন। শেহরীনা একটুর জন্য পড়তে গিয়ে বেঁচে গেল। করুণ চোখে মায়ের মুখ পানে তাকায়। তিনি জ্বলন্ত চোখে শান্ত গলায় আওড়ান।

“এতটা বছর স্বামী স্ত্রীর মাঝে যা হয়েছে চার দেওয়ালের মাঝে হয়েছে। তুই এতটা বড় হয়ে গেলি যে মায়ের উপর কী হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে বিচার করতে নিজের সৎ বাপের সাথে অন্যায় করলি। আর তুই কী জানিস উনি মুখেই তোর সাথে অন্যায় স্বরূপ কথা বলেন। কখনো তোর গায়ে হাত তুলেছে? হ্যাঁ তুই নিজের দিক দিয়ে সঠিক। তোকে মানসিক কষ্ট দিছেন তুই কাঁদছেন। তোর খারাপ লেগেছে কিন্তু কখনো ভেবে দেখছিস উনি তোকে সবার কাছ থেকে আলাদা রেখেই বড় কিছু বানানোর প্রচেষ্টা করছিলেন। আমিও আগে ভাবতাম উনি তোকে সহ্য করতে পারেন না তাই তোকে দূরে দূরে রাখেন। তবে গতরাতে সব কথা জানার পর থেকে আমি নিজেই অনুশোচনায় ভোগছিলাম। জানিস তো মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ থাকে। সেই হিসেবে তুই উনার এপিঠ দেখেছিস। কখনো উনি তোকে উনার ওপিঠ দেখাননি। তুই যেদিন সত্য জানবি সেদিন তুই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি কখনো? ইয়া মাবুদ কে জানে উনার চিকিৎসা ও করাতে পারি কি না। আমাদের হাতে দানাপানির খরচ জোগাতেই গায়ের ঘাম ছুটে যায় সেখানে বিশ হাজার টাকা জোগাড় করা সোজা কথা না।”

“তোমাগো কিছু জোগাতে হবো না রূপ আসো ঘরে যামু আমি। আমার এহানে থাকতে মন চাইতেছে না। শেহু মামুনিকে আর বকো না।”

তারা হতভম্ব। নাছির উদ্দিন এর পরণে ঘরের শার্ট-প্যান্ট তিনি হাসপাতালের পোশাক খুলে ফেলেছেন। ঘরে যাওয়ার জন্য অর্ধ চিকিৎসা করেই বেরিয়ে পড়ছেন। রূপালি বেগম তাকে গিয়ে ধরলেন। কেনো না তিনি দাঁড়ানোর মত শক্তি অব্দি পাচ্ছেন না। রূপালি বেগম উনার মুখ মুছে দিয়ে মৃদু হেসে বলেন,

“না‌ না‌গো আপনার কথাও যাওয়া হবো না। আপনি এহানে থাহেন। আপনার চিকিৎসা হওন লাগবো তো।”

“রূপ আমি বেশি কথা বলতে পারছি না ঘরে চলো। আর শেহু মামুনি ঘরে চল।”

তারা বেরিয়ে আসে। শেহরীনা সৎ বাপের ডাকে শুধু মাথা নেড়ে সাড়া দিয়েছে টু শব্দ করেনি। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ইসমাইল মিয়া ও একটুর জন্য হাসপাতালের বাহিরে গিয়ে ছিলেন। তিনি রূপালি বেগম ও শেহরীনার মধ্যকার কথা সম্পর্কে জানেন না। কেননা এক মা কখনো নিজের সন্তান কে পর লোকের সামনে কটুক্তি করবেন না।
ইসমাইল মিয়াও নাছির উদ্দিন কে অনেকক্ষণ বুঝান যেনো তিনি চিকিৎসা পূরণ করেন। তবে তিনি নাকচ করায় হার মেনে নেন।

___
সারোয়ার ঘুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তার জন্য ডাইনিং রুমে গেল। তবে তার কদমখানা আর এগোয়নি। টেবিলে আসন দখল করা কিছু অপরিচিত চেহারাকে দেখা যাচ্ছে। তার মাও কেমন যেনো তাদের আপয়্যনে তৎপর হয়ে আছেন। সারোয়ার লজ্জা পেল সামনে আগাতে। সে পেছন পা ফেরাতেই তার মা জাহানারা পুষ্পের চোখ যায়। তিনি উৎফুল্ল কণ্ঠে ‘বাবা’ বলে ডাক শোধায়। সারোয়ার চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মায়ের দিকে তাকায়। তিনি তাদের মাঝ থেকে এসে ছেলের বাহুডোরে হাত ডুবিয়ে টেনে তাদের কাছে নিয়ে আসেন। সারোয়ার বিরক্ত। জাহানারা পুষ্প তাদের কে উৎসাহী গলায় জানান।

“এই হলো আমার ব্যারিস্টারি করা পুত্র সারোয়ার মোঃ আবু সিদ্দিক। আমার মেয়ের কথা তো আগেই বলেছি। আজ সেও আসবে। সাজিয়া আসলে তাকেও পরিচয় করায় দেবো। আপনাদের কোনো ক্ষেত্রেও সাহায্য লাগলে বলবেন আমার পুত্র সমাধান দেবে সেটা। আর সারোয়ার বাবা দেখ উনি হলেন আমার মামাতো ভাই রশিদ খানম আর তার স্ত্রী মিশকিতা। এই দুজন মেয়েকে দেখছিস না ? এরা হলো আমার ভাগ্নে তোকে ভাই বলে ডাকবে। দু’জনের মধ্যে একজন হচ্ছে মিলুনি আরেকজন হচ্ছে নিলীমা। মিলুনি ইন্টার ফাস্ট ইয়ার আর নিলীমা অনার্সের শেষ ইয়ারে আছে।”

সারোয়ার এক বাক্যে শুধু সালাম জানায়। এতে হতাশা হোন তারা। নিলীমা ক্রাশ খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার কাছে অত্যন্ত সুদর্শন পরিপাটিময় যুবকের সংজ্ঞা স্বরূপ সামনের এই যুবককেই লাগছে। ঠোঁট কামড়ে চোখের ফোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে দেখে তার মা মিশকিতা হাতের বাহু দিয়ে টোকা দেন। নিলীমা ধ্যান ফিরে পেতেই চোখ নামিয়ে মনে মনে হাসল নিজের বোকামি কাজের জন্য। তবে এ দৃষ্টিকোণ মোটেও পছন্দ হয়নি সারোয়ারের। সে তার মাকে অনুরোধময় গলায় বলে,

“মা শুনেন আজ আমার কেসের জন্য কোর্টে যেতে হবে। হাতে অনেক কাজ। আমার নাস্তা টা আমাকে দিলেই হবে। আমি চলে যেতে পারব। আর যদি আপনার ব্যস্ততা থাকে তবে আমি বাহির থেকে খেয়ে নেবো।”

সারোয়ার কোর্টের জামা পড়ার জন্য রুমে চলে গেল। তার বলা বাক্য ধারায় জাহানারা পুষ্প ইতস্তত বোধ করেন। তবে রশিদ খানম কিছু মনে করেননি। তিনি হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন,

“মাশাআল্লাহ সিদ্দিক সাহেব আপনার পুত্র তো ভালোই কর্মঠ। এমন পুত্র কেই চাই আমি আমার মেয়ের জামাই বানাতে। তুমি কী বলো মামুনি?”

রশিদ খানমের কথায় লাজুক হাসে নিলীমা। তবে মোঃ আবু সিদ্দিক ‘আ’ ধ্বনি বয়ান করতে গিয়েও স্ত্রীর চোখ রাঙানি দেখে চুপসে যান। তিনি মাথা নেড়ে কৃত্রিম সম্মতি দেন। যার অর্থ তিনি মোটেও এই সম্বন্ধে রাজি নন। তবে স্ত্রীর পাগলাটে আচরণের কারণে কথার বুলি আওড়াতে গিয়েও পিছিয়ে গেলেন। তবে কথোপকথন সারোয়ার এর কর্ণকুহরে ঠিকই পৌঁছাল। সে তার ফোন টেবিলে রেখে গিয়ে ছিল। সেটা নেওয়ার জন্য আসার মুহুর্তেই শুনে ফেলে। তবে তার কোনো ইচ্ছে জাগে না। বিধেয় পাত্তা হীন ভাবখানা বজায় রেখে তার ফোন নিয়ে চলে গেল। অপমানিত বোধ করেন রশিদ খানম আর তার স্ত্রী। তিনি জাহানারা পুষ্প কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“এ কী বোন তোর ছেলে তো আমার কথায় কোনো রিয়েক্ট করল না। তার কী আসলেই সম্মতি আছে এই সম্বন্ধে?”

“আরে ভাইজান আপনি বেহুদা চিন্তা করছেন। আমার নিলীমা মা তো রুপে-গুণে একেবারে একশোতে একশো। আমার ছেলে লাজুক প্রকৃতির। একটু গম্ভীর রগচটা। আমার জানা আছে নিলীমা অবশ্যই মানিয়ে নেবে তাই না নিলীমা মামুনি?”

নিলীমা মাথা নাড়ল। এর মাঝে তিনি চোখের ইশারায় মিশকিতাকে রুমে আসার ইঙ্গিত দেন নিজের স্বামীর অগোচরে। মিশকিতা জানত তার সাথে জাহানারা কথা বলতে চাইবে। তাই তিনিও স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে জাহানারার সঙ্গে রুমের ভেতর চলে এলেন। জাহানারা পুষ্প দরজা বন্ধ করে মিশকিতার হাত ধরে করুণ গলায় জিজ্ঞেস করে।

“দোস্ত আল্লাহর দোয়ায় তোর সাথে কন্টাক্ট করতে পারলাম। শোন না‌ বোন আমাকে বল না আমার বিয়ের পর আনোয়ার ভাইয়া ঐক্য কে কী করেছিল-রে? সে এখন কোথায়? আমার তার সাথে শেষ দেখাও হলো না। আমার ভাইয়ার কারণে জীবনটা আমার ছন্নছাড়া হয়ে গেল।”

মিশকিতা বিরক্তির গলায় বলেন,
‘ছিঃ ছিঃ পুষ্প এসব কথা বলিস না। তুই তোর জীবনে শ্রেষ্ঠ কাউকেই পেয়েছিস। আজ পর্যন্ত ভাইয়া তোর গায়ে হাত উঠিয়ে ছিল কখনো? বিয়ের আগে তোর প্রেম ছিল জেনেও তিনি তোকে ভালোবেসে প্রায় এতটা বছর আগলে রাখছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা তুই বিবাহিত আর দুই সন্তানের জননী। তুই কেমনে পরপুরুষের নাম মুখে নিস হে?”

জাহানারা পুষ্প রেগে গেলেন তিনি মিশকিতার হাত ছেড়ে অন্যপাশ ফিরে সহ্যহীন কণ্ঠে বলেন,

“আমি বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো সিদ্দিকের দিকে প্রেমের নজরে তাকায়নি। সে আমার প্রেম হয় জীবনের একমাত্র ভুল তিনি। আমার প্রথম আর শেষ প্রেম ঐক্য ছিল। সিদ্দিককে আমি সম্মান করি শ্রদ্ধা করি কারণ তিনি আমার সন্তানদের পিতা।”

মিশকিতাও রেগে গেল সে জাহানারা পুষ্পের হাত চেপে নিজের দিক ঘুরিয়ে বলেন,’তুই কিন্তু ভুলে যাসছিস সারোয়ার আর সাজিয়া তোর সন্তান। তাদেরও বিয়ে হবে। সাজিয়া তো এমনিও শ্বশুরবাড়িতে। আর তুই এ বয়সে এসেও ঐ বেঈমানের কথা জিজ্ঞেস করছিস।’

‘মিশু’ চেঁচিয়ে জাহানারা পুষ্প তাকে চুপ করিয়ে দিলেন। তার হাত ধরে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলেন,

“আমার প্রেমের মধ্যে কোনো খুঁত নেই। তিনি বেঈমানি করতেই পারেন না।”

মিশকিতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন,’ওহ ঐক্যের উপর এতটা বিশ্বাস। তবে কী তুই জানিস আসলে কাহিনী কী হয়েছিল সেদিন? কী ঘটেছিল তোর সাথে? আরে তোর সাথে বেঈমানি করে সে তোর স্বামীর বড় বোনকেই বিয়ে করেছে।’

মিশকিতার কথায় জাহানারা পুষ্পের মাথায় বাজ পড়ল। তিনি কথাটা আমলে উঠতে পারছেন না। এই কী শুনলেন তিনি? স্বামীর বড় বোন কথাটা তার গলায় কাঁটার মত বিঁধছে। ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়লেন অসুস্থ রূপে। মিশকিতা তার চাচাতো বোন কে আহত মনে দেখে তার পাশে গিয়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরেন। আসলে রশিন খানম যেমন জাহানারা পুষ্প এর মামাতো ভাই তেমনি মিশকিতা তার চাচাতো বোন।
জাহানারা পুষ্প শান্ত গলায় বলেন,

“বেঈমান তাহলে শুধু ঐক্য নয় সিদ্দিক ও। আজ পর্যন্ত তিনি আমাকে তার বোনের সাথে পরিচয় করাননি। যতবার তার বোনের ব্যাপারে জানতে চেয়েছি কৌশলে তিনি এড়িয়ে গেলেন। ওয়াও আজ বুঝলাম তিনি আমায় এতটা কেনো আগলে রাখেন।”

মিশকিতা বিপাকে পড়ে গেলেন।‌ তিনি চেয়েছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক সুস্থ আর মার্জিত করতে এইতো যেনো প্রতিকূলে চলে গেল। তিনি জাহানারা পুষ্প এর গালে হাত রেখে নিজের দিক ফিরিয়ে বলেন,

“চুপ চুপ এই কথা মুখেও আনিস না। ভাইয়ার এত বছরের গড়া আন্তরিক সংসারের দায়বদ্ধতার সাথে তোর প্রতি তার মনের প্রণয় ও শেষ হয়ে যাবে। যদি তিনি জানেন তুই সব জেনে গিয়েছিস এ কথাটা। বোন নিজের হাতে এত সুন্দর সংসার নষ্ট করিস না। আমার এও মনে হয় ঐক্য ভাই ও তার সংসারে ভালো আছেন। তুইও থাক আল্লাহর ওয়াস্তে। আচ্ছা অনেক কথা হলো চল এখন বাহিরে নাহলে তারা আবার চিন্তায় পড়বে।”

জাহানারা পুষ্প মাথা নেড়ে উঠল। তবে তার ভেতরকার রাগের কথা মিশকিতাকে বুঝতে দিল না।

চলবে…….