#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩৯ (তোর আমার প্রিয়অপ্রিয়!)
“সারোয়ার ভাই খন্দকার মিয়া আর মোকতাব মিয়া কে চিনি এই তৃতীয় লোক তো আমাদের স্যার! উনিও তাহলে এসবের সাথে সামিল ছিলেন! আমাদের গ্রামে পাঠানো, থিসিসের নামে ছলনা করেছেন তিনি। প্রতারক একটা। ভালোই হয়ছে মরছে জাহান্নামে যাক শা’লা।”
“সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তাদের দেহের উপর নজর দিয়ে দেখ। তাদের কে খন্ডিত করে লি’ঙ্গ থেঁতলে দিয়ে মা’রা হয়ছে। আমি তো পা দিয়ে পিসছি। কিন্তু এই তো পুরোই ভয়ানক করেছে। তার মানে কী দাঁড়ায়! কেউ তাদের কে নি’র্মম’ভাবে হ’ত্যা করেছে। পুরো শরীরে ক্ষ’তের আঘাত স্পষ্ট ভেসে উঠে বুঝা যাচ্ছে।”
ফারদিন কিছু একটা ভেবে সারোয়ার এর কাঁধ ধরে তাকে আড়ালে এনে বলে,
“ভাই এমন এক ঘটনা আগেও হয়ে ছিল। শেহরীনা আর ইপশিতার তখন নয় কী দশ বছর বয়স। তাদের ঘ’নি’ষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমি প্রায় একটা মুদি দোকানের পাশে তাদের জন্য অপেক্ষা করতাম। তখন তাদের দুজনকে দোকানের লোকটা নানান জিনিস দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছুঁ’য়ে দিতে চাইতো। এই দিকটা তারা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারতো না। প্রথমে ভেবেছিল ভুলবশত কিন্তু বারংবার হওয়ায় তারা সেই দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। ঠিক তার একসপ্তাহ পর দেখা গেছে। ঐ দোকান ভেঙ্গে দেওয়া হয়ছে। আর ঐ দোকানদারের লা’শ পাওয়া গেছিল নদীর মাঝে ভেসে থাকতে। তার লা’শ কেও ঠিক ঐ ভাবে মা’রা হয়ে ছিল। খবর নিয়ে জানতে পেরে ছিলাম তার লোকেরাই নাকি তাকে হ’ত্যা করছে।”
সারোয়ার অবাক হলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)পরক্ষণে বলে,’তবে হয়ত তার লোকেরাই করে ছিল। কিন্তু এমন নি’শ্রী ভাবে খু’ন দেখে লাগছে কোনো আদিবাসী করেছে। আদিবাসীদের মধ্যে এরূপ খু’ন করে কেটে খাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রবল। যাই বলো শেহরীনার সাথে হওয়া ঘটনার সামনে তাদের খু’ন হওয়া সামান্য বিষয়। আমার জন্যে শেহরীনা প্রথমে আসে। তাদের কে আমি মে’রে ফেলতাম যদি শেহরীনা সুস্থ থাকতো। সে অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিয়ে চলে আসি।’
ফারদিন ও সায় জানায়।
পূর্বের ঘটনা….
টিভির মধ্যে শেহরীনার শরীরকে যে দুঘাতক রাক্ষস কলঙ্কিত করতে চেয়েছিল তাদের প্রতিচ্ছবি দেখানো হচ্ছে। তাদের ভয়াবহ মৃত্যু দেখে নাস্তার টেবিলের পাশে শেহরীনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে সারোয়ার তাকে আগলে নেয়। মোঃ আবু সিদ্দিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও ছেলের চোখের চাহনি দেখে চুপ করে গেলেন। জাহানারা পুষ্প ছেলের বউয়ের হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া দেখে আতঙ্কিত হয়ে সারোয়ার কে জেঁকে বসেন।
“বাবা কী হলো বউমার! হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল কেনো!”
“কিছু না মা একটুখানি স্ট্রেচ নিচ্ছিল সে। তুমি তো জানো তার পরীক্ষা সামনে। এজন্য স্ট্রেচের জোড়ে মাথা ঘুরে উঠল তার।”
“চল বাবা মেয়েকে রুমে শুয়ে দেয়। আহাগো মেয়েটা নাস্তাও করতে পারল না। যায় একটা স্যুপ করে আনছি আমি।”
মায়ের আহ্লাদ ভরা কণ্ঠস্বর শুনে সারোয়ার আপনমনে হাসল। তার মা যে শেহরীনাকে মেনে নিয়েছে এই তার জন্য ঢের আনন্দের ।
হঠাৎ ইপশিতা চিল্লিয়ে বলে,’সারোয়ার ভাইয়া শেহরীনার জ্ঞান ফিরেছে। সে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আমি বা অন্য কেউ তাকে থামিয়ে রাখতে পারছি না প্লিজ কাম ফাস্ট।’
সারোয়ার এর ধ্যান ভাঙ্গে। সে সহ ফারদিন দৌড়ে ভেতরে যায়। শেহরীনা উম্মাদের মত রুমের আসবাবপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে চুলের উপর থেকে ঘোমটা সরে গিয়ে তার শাড়ির ভেতরকার দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে গেছে, এলোমেলো অবস্থায় সে ছুঁড়ছে। মেয়েটার বিয়ের পর আজ প্রথম সকাল তাদের জন্য । এই দিনেই তার উম্মাদ রূপ দেখে সকলের মাঝে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। জাহানারা পুষ্প রুমের বাহিরে দরজায় দাঁড়িয়ে কান্নায় বিলাপ বকছেন। তিনি রান্নাঘরে গিয়েও বউমার চিৎকারে ফিরে এসে রুমের দৃশ্য দেখে সেখানেই জর্জরিত হয়ে যান। মিশকিতা নিজের মেয়েকে চেপে যেতে চান। তবে নিলীমা তো নিলীমাই। সে মায়ের চাওয়াকে অবমাননা করে ইপশিতার পেছন থেকে বিক্ষোভ ঠাট্টার সুরে বলে উঠে,
“সারোয়ার ভাইয়া আর কাউকে পেলেন না। একটা পাগলী কে বিয়ে করেছেন। দেখো দেখো কেমনে পাগলী মেয়ের মত সব ভেঙ্গে চুরমার করছে। আহারে সব দামী জিনিস ভেঙ্গে দিলো-রে। এই মেয়ে নাকি আবার ল নিয়ে পড়ছে। যার দেমাগই ঠিক…।”
“চুপ আর কোনো শব্দ মুখ থেকে বের করলে তোমাকে আমি চোখের সামনে জ্যান্ত রাখব না। আমার বউ আমার টাকায় কামানো জিনিস ভাঙ্গছে। এই রুমে আমার চেয়েও বেশি এখন সে ভাগীদার,হকদার মাইন্ড ইট।”
সারোয়ার কথা না বাড়িয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে মাকে সামলানোর জন্য ইঙ্গিত করে। মোঃ আবু সিদ্দিক স্ত্রীর নিকট এসে দাঁড়ান। কাঁধে জড়িয়ে আগলে নেন স্ত্রীকে। সারোয়ার উত্তপ্ত চোখে পুনরায় নিলীমার দিকে তাকিয়ে ধরাস করে দরজা আটকে দেয়। নিলীমা আপনাআপনি ঢোক গিলল। তার মুখ তখনিই বন্ধ হয়ে যায়। ফারদিন আর ইপশিতা ও রেগেমেগে তাকায়। তবে বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় তারা তর্কে জড়ায়নি। তানভির মুখখানা রগরগে হয়ে আছে। মূলত নিলীমার কথায় তিরস্কার পেয়ে সে ভীষণ চটে আছে। মেয়েটা তার স্যারের ওয়াইফকে নিয়ে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছে। এ যেনো তার সহ্য হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করতে সে সবাইকে শান্ত করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়।
সারোয়ার শেহরীনার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। মেয়েটা হাতের নাগাল যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ছে।
‘আসবেন না কাছে আসবেন না। আআআমি অপবিত্র। আমার কাছে ঘেঁষবেন না।’
‘বউ ও বউ শান্ত হও প্লিজ! আমাকে কাছে আসতে দাও। আমার বউ নিষ্পাপ পবিত্র ফুল।’
‘না না নাহ আমি অপবিত্র তারা আমার সাথে আমাকে রে**প করেছে… আমি আমি…।’
শেহরীনা নিজের হুঁশে নেই এমুহুর্তে। তাকে শান্ত করার জন্য অন্য বুদ্ধি কাটায় সারোয়ার। শেহরীনা ঘোরের মাঝে একটা ফল কাঁটার ছুড়ি হাতে নিয়ে নেয়। তাকে দেখে সারোয়ার নিজের রাগ সামলাতে পারল না। মেয়েটার হাত হেঁচকা টানে নিজের বুকের মাঝে চেপে ছুড়িটা দূরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। শেহরীনা মাথা নেড়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য পাগলাটে ভাব করলো। সারোয়ার এর কষ্ট হয় তবুও রগ্ন আচরণ করতে ভয় পেল না। তৎক্ষণাৎ রগচটে দুজোড়া শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া মিলিত করে দেয়। মিলিত হওয়ার পরপর শেহরীনার ভয়ার্ত রুপের চাহনি মিইয়ে গেল। তার শরীর ভার ছেড়ে দিলো। সারোয়ার অপেক্ষায় ছিল এর। সে সহসায় মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে ওয়াশরুমে গিয়ে নামায়। বউয়ের মলিন চেহারা সারোয়ার এর বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে তবুও নিজেকে নির্লিপ্ত রেখে মেয়েটার চোখমুখ ঘাড়, গলা মুছে একঝটকে আঁচল সরিয়ে ফেলে। শেহরীনার মাঝে লজ্জা বা ভয় লক্ষিত হলো না। সে নিরব রইল। সারোয়ার আঁচলটি আলনায় রেখে আলমারি খুলে অন্য একটি পাতলা সুতির আঁচল নিয়ে ওয়াশরুমের ভেতরে যায়। ওয়াল এটার্চড তোয়াল হোল্ডারে আঁচলটি রেখে শেহরীনার মুখপানে তাকিয়ে বলে,
“আমি বাহিরে অপেক্ষায় আছি। ফ্রেশ হয়ে আসো।”
দরজা ভিড়িয়ে দিলো। পুতুল মেয়ের মত আচরণ করছে মেয়েটা। দরজাও ভেতর থেকে আটকায়নি সে। তপ্ত শ্বাস ফেলে সারোয়ার নিজেকে নিজে বলে,
“তুমি আমার বহু অপেক্ষার ফল বউ। তোমার মায়াময় শরীর দেখে আমার মাঝে ঝড় বয়ে গেল। তবে তা কামনার নয় মুগ্ধতার। কারণ ঐ শরীরে মাঝে আমার ছোঁয়া আছে। আজ নিজ হাতে তোমার আঁচল সরিয়েছি নিজ হাতেই তোমায় আপন বানিয়ে নেবো।”
‘হয়েছে’ মৃদু এক শব্দের কণ্ঠস্বর শুনে মাথা চুলকে হাসল সারোয়ার।
___
“স্যাম বাবা তুই কেনো আবার মুখ ফিরিয়ে নিলি, মেয়েটা তোকে কত ভালোবাসে। আর তুই কিনা এক বিবাহিত মেয়ে কে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিস বল না এটা মিথ্যে! ঐ অলক্ষ্মী মেয়েটা আমার ছেলেকে খেয়ে দিচ্ছিল। ভাগ্যিস তনুদির মত মেয়ে তোকে বাঁচিয়ে নিলো। ঐ মেয়েটা কে তো আমি অভি…।”
‘মা প্লিজ চুপ চুপ প্লিজ! তারপর কোনো কথা বলো না।’
রুফিয়া সাইমুম এর হঠাৎ কান্না পেল। ছেলেকে বিষণ্ণতায় ভুগতে দেখেছেন প্রায় কয়েক মাস। সেই তার ছেলে ঐ মেয়ের বিয়ের কথা শুনে পুনরায় বিষণ্ণ হতে চলে ছিল। আজ যদি তিনি কয়েক মিনিট দেরি করতেন তবে কখনো আর নিজ ছেলেকে ছুঁয়ে অব্দি দেখতে পারতেন না। মায়ের কান্না দেখে কায়েসাম এর বুক জ্বালাপোড়া করতে লাগল। সে প্রেমে অন্ধ হয়ে আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। এই কষ্ট সে শুধু নিজের জন্যে বরাদ্দ করলেও এটা ভেবে দেখেনি এর ফলে তার পরিবারের উপর কত ঘাত-প্রতিঘাত আসতে পারতো।
কায়েসাম বাস্তবতা মেনে নেবে বলে আপনমনে পণ করল। তবে তা কতটুকু সত্য হবে সে নিজেও জানে না। মাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে,
“মম হতে পারে শেহরীনার কাছে আমি অপ্রিয় তবে সে আমার প্রিয় এক পুতুল ছিল। জানো মা ভার্সিটির মধ্যে ঐ মেয়েটাই ছিল যে আমায় সম্মানে শ্রদ্ধায় আগলে রাখতো। ভাবতাম সে আমায় ভালোবেসে ঐ কাজ করতো। তবে তা যে শুধু ভাইয়ের নজর পাক্ষিকে তা বুঝতে পারিনি। যখন বুঝলাম তখন নিজের অনুভূতি কে বুঝিয়েও কোনো সুরাহা পায়নি। আজ দেখো মেয়েটা কত সুখী! খোদা তাকে সেই সুখের জোয়ারে ডুবিয়ে রাখুক। আমি নাহয় তার এক তরফা প্রেমকে বুকে আগলে বাস্তবের সাথে মেনে চলবো। তুমি মোটেও তাকে অভিশাপ দেবে না মম। প্লিজ মম প্লিজ…।”
ছেলেটার চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ে মায়ের কোল চেপে নিলাজ বাচ্চার মত কেঁদে ভাসাতে লাগল। তার জীবনের প্রথম প্রেম আহ!যে তুমি কখনো জানতেও পারবে না কেউ তোমাকে মন উজাড় করে ভালোবেসে ছিল।
কায়েসাম কে সামলে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে চলে যান রুফিয়া সাইমুম। তবে কায়েসাম এর চোখজোড়া খুলে যায়। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে মনে করতে লাগল সে সময়ের কথা!
অতীত….
সারোয়ার-রা যখন শেহরীনাকে হন্ন হয়ে খুঁজছিল তখন কায়েসাম শেহরীনাকে বাঁচাতে প্রায় কাছেই চলে গিয়ে ছিলো। তবে শেহরীনা কে বাঁচাতে খন্দকার মিয়ার মাথায় যে পাথর সারোয়ার মে’রে ছিল সেই পাথর তার গাঁয়ে নয় বরং মোকতাব মিয়ার কপালে লেগে ছিল। মোকতাব মিয়া ব্যথার মাঝেও দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে নজরে পড়েনি খন্দকার মিয়ার। মোকতাব মিয়া কপালে আঘাত পেয়ে পড়ে গেলে খন্দকার মিয়ার মাথা বরাবর জোরাল পাথর ছুঁড়ে ছিল সে নিজে। সবাই যখন শেহরীনাকে নিয়ে চলে যায়। সে গিয়ে অপরাধী দুটোর কাহিল অবস্থা করে।
হ্যাঁ কায়েসাম তাদের কে জ্যা’ন্ত মে’রেছে। তাদের থেঁ’তলে যাওয়া লি’ঙ্গ কে সে নিজ পায়ের তলায় পিসিয়েছে। হাতে করে আনা দা দিয়ে তাদের শরীরকে খন্ডিত করেছে। যুক্ত করে ছিল সেই স্যার কেও। তাকেও লোক দিয়ে ধরে এনে একই জায়গায় খন্ডন করে ফেলে রেখে যায়। তার হিংস্রতা শুধু শেহরীনার জন্য ছিল। তার পাশে কাউকে দেখে সে সহ্য করতে পারত না। আজ সে মেয়েটার পাশে থাকা গোটা পুরুষ কেই সে আজ সহ্য করার চেষ্টা করছে।
উফ! সারোয়ার ছেলেটা সুনিয়ত ভাগ্য আছে বলাবাহুল্য। কৃষ্ণকুমারি কে পাওয়া হলো তার। অথচ সে নিশিরাত্রীর সেই জোনাকি পোকার মত উড়ে বেড়িয়েছে একটুখানি আলো দেওয়ার আশায়। কায়েসাম তার ভাবনার অতলে ডুবিয়ে কবে ঘুমিয়েছে বুঝতে পারেনি। তার সরল মনপেক্ষতা দরজার বাহির থেকে আড়ালে চিবুক তুলে চুপিচুপি দেখছিল এক মেয়ে। তার ঘামাক্ত পিঠখান দেওয়ালে লেগে এসেছে। তার চোখজোড়া শীতল হয়ে গেছে। চোখের অশ্রু কবে শুকিয়ে গেল সে নিজেই বুঝতে পারল না।
রুফিয়া সাইমুম দূর থেকে দেখে কাছে যেতে গিয়েও গেলেন না। কী বলে মেয়েটাকে শান্ত্বনা দেবেন তিনি নিজেও জানেন না! তার চেয়ে দুজন দুজনার মনকে স্থবির করে তুলুক সেই প্রার্থনা করেন তিনি।
তনুদি মনো কাতর হেসে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,
“তুই যদি এই ভালোবাসাটুকু আমায় দিতি তবে আমি তোকে পাহাড়ের চেয়েও উচ্চতায় আকাশচুম্বী প্রেমের বর্ষণ বিলিয়ে দিতাম। কিন্তু তোর এই ভালোবাসা আমার জন্য নয় অন্য কারো এটা মানতেই আমার জন্য কষ্ট হয়ে যায়। পরিণয়ে এটুকু বুক চিঁড়ে নিংড়ানো কণ্ঠে বলতে পারব তুই আমার প্রিয় হলেও আমি তোর অপ্রিয় বঁধুয়া হয়ে ভালোবাসব-রে সাম। #তোর_আমার_প্রিয়অপ্রিয় সংসারের ভীড়ে তুই আমার মায়ায় জড়িয়ে গেলেও আমি তৃপ্তি পাবো। তোর প্রেম নাহয় অন্য কেউই থাকুক।”
চলবে….
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৪০ (উষ্ণ হাওয়া🙈)
(১৮+এলার্ট)
“বাবা শোন না তনুদির বাড়িতে প্রস্তাব পাঠায়! মেয়েটা কে কষ্ট পেতে দেখে নিজেরো খারাপ লাগছে। দেখবি মেয়েটা তোর জীবন সুন্দর করে গুছিয়ে দেবে। আগে তো নিজ মর্জি মত কাজ করতি। আজ মায়ের কথাটা রাখ বাবা। এই কথা রাখলে তোর মায়ের জীবন রক্ষা পাবে।”
মায়ের আত্মমনৌ কথা শুনে কায়েসাম এর বুক ধড়ফড় করে উঠল। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“প্লিজ মা আমি বিয়ে করতে চাই না। তনুদি আমাকে ডিজার্ভ করে না। আমার মত অযোগ্য, ব্যর্থ, দেবদাস টাইপ ছেলে কী আদৌ তার যোগ্য!”
“কেনো আমি কী তোকে কখনো বলেছি তুই দেবদাস হয়েছিস বলে আমার তোকে পছন্দ হবে না! হ্যাঁ বল কথা বল এখনি।”
রুমের মধ্যে হড়হড় করে ঢুকে কথাগুলো রেগেমেগে বলে তনুদি। তাকে দেখে কায়েসাম চোখ শান্ত করে মাকে সরিয়ে তনুদির কাছে গিয়ে তার দু কাঁধে হাত রেখে বলে,
“দোস্ত তুই আমার ছোট বেলার বান্ধবী। হতে পারে তোর মনে আমার জন্য ফিলিংসটা নতুন। কিন্তু আমি কখনো তোকে নিয়ে কিছু ফিল করিনি। সেদিন তুই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে রিং পড়িয়েছিস। তবে আমি বিয়ে করব না।”
“আন্টি আপনি একটু বাহিরে যান। আপনার ছেলের মাথায় গোবর ভরে গিয়েছে। তার গোবরভর্তি ড্রাম খালি করা শুরু করতে হবে। আপনি যান আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।”
রুফিয়া সাইমুম ফ্যালফ্যাল করে তাকান। তিনি তনুদির উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন। বিধেয় টু শব্দ না করে বেরিয়ে গেলেন। তবে দরজা ভিড়িয়ে দেন। মায়ের যাওয়া দেখে ভ্রু কুঁচকে কায়েসাম তনুদির দিকে তাকায়। তার মনে হচ্ছে মেয়েটা ভারী অন্যায় কিছু করতে চাইছে। তনুদি ঢোক গিলে সাহসী মনোভাব পুষে এক,দু কদম পা বাড়ায়। কায়েসাম থ হয়ে গেল। মেয়েটার আগানো দেখে ছেলেটা ঘাবড়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। তার শরীর মন কেঁপে যাচ্ছে। মেয়েটা অস্বাভাবিক ভাবে আগাচ্ছে কেনো!
‘দেদদদখ দোস্ত থেমে যাহ্।’
তনুদি ঘোর নয়নে চেয়ে কায়েসাম এর সন্নিকট হলো। বেচারার পিঠ ঠেকে যায় দেওয়ালের সঙ্গে। এতে তনুদি দেরি না করে চট করে একটা ওষ্ঠজোড়া কায়েসাম এর উত্তপ্ত তৈলাক্ত গালে ছুঁয়ে দিয়ে রুমের দরজা খুলে এক ছুটে চলে যায়। তাও সে এদিক ওদিক তাকায়নি। সোজা বাড়ির বাহিরে এসে থেমে জোরালো শ্বাস ফেলল। উপরের জানালার দিকে তাকায়। কায়েসাম এর রুমের জানালা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা কে না! সে ম্লান হাসল। সাহসীক প্রেমিকার ন্যায় একটুখানি ছোঁয়া দিয়েছে সে। এতেই সে স্বস্তি পায়। সে জানে তার মন পুরুষের মনে ঝড় তুফান বয়ে যাচ্ছে। সে হয়ত এই বেগ সামলাতে হিমশিম খাবে। কারণ তার স্থান হওয়ার কথা তো ছিল অন্য কারো! সেই স্থানে জোরপূর্বক নিজের নাম বসিয়েছে তনুদি। তনুদির ভাবনার মাঝে গাড়ির হর্ন শব্দ করে উঠে। তনুদি তার ড্রাইভার নিয়ে এসেছিল। ম্যামকে দেখে সেও হর্ন বাজিয়ে আসার ইঙ্গিত করেন। মলিন শ্বাস টেনে গাড়িতে বসে যায় সে। তার অপেক্ষা হলো ব্যর্থ চাওয়া। তার ছোঁয়া কোনো প্রভাব ফেলেনি কায়েসাম এর উপর। যদি প্রভাব ফেলতো তবে সে আজ ছুটে এসে তার গালে এক চটকানা লাগাতো। তনুদি চোখজোড়া বুঁজে নেয়। করিডোরের থেকে রুফিয়া সাইমুম মেয়েটাকে চলে যেতে দেখে অবাক হোন। তিনি সে সময় রুমের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তনুদি কে বেরিয়ে যেতে দেখে শত পিছু ডেকেও সাড়া পেলেন না। ছেলেটা পুনরায় মেয়েটাকে কষ্ট দিলো কী! তিনি আজ এর একটা বিহিত করে ছাড়বেন। গম্ভীর আক্রোশ মনে চেপে তিনি রুমের দরজা খুলে ভেতরে চোখ ফেলতেই দেখতে পান।
কায়েসাম আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব কে ঘোর নয়নে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে মোহিত হয়েছে। রুফিয়া সাইমুম চোখজোড়া সরু করে তাকান। আচমকা ছেলের ডান গালে গোলাপী আভায় ঠোঁটের চিহ্ন দেখে তিনি আপনমনে মুচকি হেসে নিরবে বেরিয়ে যান। ছেলেকে তার নতুন অনুভূতির সাথে স্বপ্রাণ হওয়ার জন্য সময় দেন। পুরানো স্মৃতি ভুলে এবার নতুন স্মৃতিই তাকে তার অন্তরে জায়গা করে নিতে হবে।
কায়েসাম এর মোহিত চেহারা কিঞ্চিৎ মুহূর্ত পরই নিভে গেল।আয়নার মধ্যে শেহরীনার কৃষ্ণ কাজল কালো রেখার অক্ষিদ্বয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সে মেয়েটার চোখ কে আলতো হাতে ছুঁতে গেলে শেহরীনা খানিক পিছিয়ে যায়।
কায়েসাম কেঁপে উঠে। একটুখানি প্রিয় ছোঁয়া ও কী তবে শেহরীনাকে দেওয়ার অধিকার তার নেই!
“কৃষ্ণকুমারী তুমি কী আমায় ছাড়া সুখে আছো! সে কী আমার চেয়েও বেশি প্রিয় তোমার! আমিই তো তোমার জন্য প্রতিবার লড়ে বেড়িয়েছি। তবুও কেনো তুমি আমার দিকে ফিরে চাওনি।”
“হাহাহা আমি কখনো তোমার প্রিয় ছিলাম না কায়েসাম ভাইয়া। তোমার প্রিয় সর্বদা তনুদি ছিল। তাকে মেনে নিলেই তুমি আমায় ভুলতে পারবে।”
“আমি তোমাকে ভুলতে চাই না কৃষ্ণকুমারী। তুমি আমার হৃদয়ের বীজ। যার থেকে প্রেমময় ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে।”
“তবে সেখানে বন্যার পানি ছড়িয়ে দাও। যাতে আমার বীজ মুছে যাক আর তনুদির মত মেয়ের সূক্ষ্ম বীজ রোপণ হোক।”
কায়েসাম হাসল, তাচ্ছিল্যের হাসি তার চেহারায়। সে কখনো মেয়েটার নিরপেক্ষ যৌক্তিক কথার তর্কে পারবে না। শেহরীনার চিত্র ছায়া ‘হু হু’ করে হেসে অদৃশ্য হয়ে গেল। কায়েসাম আয়নায় হাত ছুঁয়ে খানিকক্ষণ হাতড়াতে লাগে। কিন্তু পেলো না কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে। বিতৃষ্ণ মনে হেসে দেয়। চোখের কোণা দিয়ে জল গড়ায় তার।
“প্রিয় তুমি আমার প্রিয় হয়ে থাকলেও আমি কখনো তোমার প্রিয় হতে পারলাম না এই আক্ষেপ আমার আজীবনের।”
রুফিয়া সাইমুম দরজায় টোকা দেন। কায়েসাম তার ম্লান মুখখানা লুকাতে গলা উঁচিয়ে বলে,
“মা আমি খানিকক্ষণ পর আসছি। তুমি যাও।”
রুফিয়া সাইমুম উঁকি দিয়ে একপলক দেখে নেন। ছেলেকে লজ্জা পেতে দেখে তিনি মুখ টিপে হেসে চলে যান। কিন্তু কায়েসাম অভিনয়ের ন্যায় মৃদু হেসে ওয়াশরুমে যায়। সে জানত তার মা রুমের মধ্যে তাকাবেন। তাইত সে সেরা অভিনেতা মত লাজুক হেসেছে। কষ্ট বুকে লুকিয়ে রেখেও হাসা যায়।
____
“এই কৃষ্ণরাণী তুমি কী আমার শার্ট পরে ঘুমাতে পারো না!”
সারোয়ার এর কথায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল শেহরীনা। আচমকা চেঁচিয়ে বলে,’হোয়াট!!!’
‘আরে আস্তে পাড়াপড়শিকে দেখি তুমি জানিয়েই ছাড়বে আমি তোমাকে অনেক আদর যত্ন করি। কিন্তু আমার জন্য ভালোই হবে। আমাকে দেখে তাদের স্বামীরা জ্বলবে,পুড়বে। এতে আমিও বুক ফুলিয়ে থাকব।’
“থাক আপনার থেকে সোহাগগিরি প্রমাণ করতে হবে না।”
সারোয়ার চমৎকার হেসে শেহরীনার গালের নিকট মুখ এলিয়ে নিতেই সেখানে সাফওয়ান ‘বড় আম্মু বড় আম্মু’ করে ডেকে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। অধৈর্য সারোয়ার আতঙ্কিত কণ্ঠে শেহরীনাকে দরজার পেছনে দেওয়ালের সাথে চাপিয়ে বলে,
“ওহো কৃষ্ণরাণী তাড়াতাড়ি চুমু খেয়ে ফেলো। নাহলে আজ সারাদিন তোমার সোহাগের থেকে সোহাগীর অভাবে ভোগতে হবে। প্লিজ কৃষ্ণরাণী দাও না!”
শেহরীনা থতমত খেয়ে গেল। একে তো সাফওয়ান ডাকছে, তার উপর স্বামীর আবদার। বোকামি হলেও সে বুদ্ধি কাটিয়ে স্বামীর বগল দাবা হতে বেরিয়ে সাফওয়ান এর সামনে পড়ল। সারোয়ার থ। সে পেঁচার মত করে অভিমানি কণ্ঠে বিড়বিড় করল।
‘জল্লাদ কৃষ্ণরাণী। একটা মাত্র বউ তারে দিয়ে চুমু খাবো বললাম সেটাও মানল না। ধ্যাত বিয়ে না করে বনবাসে গেলেই মনে হয় ভালো হতো।’
শেহরীনা সাফওয়ান কে চেয়ারে বসিয়ে একগ্লাস চকলেট দুধ বানিয়ে দিলো। এর মাঝে খেয়াল করে সারোয়ার ছোট সাফওয়ান কে আদর দিয়ে চলে গিয়েছে। তাকে রা শব্দ করে জানাতেও চাইল না। সাহেবের অভিমান হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। শেহরীনা মিটিমিটি হাসল। সাফওয়ান কে দুধের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো তার ননদীনির কাছে। ননদীনি সাজিয়ার সঙ্গে আজকাল তার ভাব হয়েছে বেশ। মেয়েটা পূর্বের চেয়ে এখন মিশতে শিখেছে। সাজিয়ার ছেলেটাও হয়েছে মিশুক প্রকৃতির। সে সর্বদা তাকে বড় আম্মু আর তার স্বামী সারোয়ার কে বড় আব্বু বলে ডাকে।
‘যাই গিয়ে জনাবের অভিমান ভাঙ্গিয়ে আসি।’
সারোয়ার কৃত্রিম জেদ ধরে ফোঁস ফোঁস করছে। রুমে এসেই ওয়াশরুম থেকে মুখ হাত ধুয়ে পরণের ফতুয়া খুলে আলনায় রেখে দেয়। উদাম বুক নিয়ে আলমারির দরজা খুলে আগে গেঞ্জি হাতে নিয়ে পরে। তার উপর সাদা শার্ট পরে বড় হাতা ফোল্ড করে আলমারির দরজায় টাঙানো কটি গাঁয়ে জড়িয়ে নেয়। পূর্ণ ব্যারিস্টার বেশে পারফিউম মেখে চুল ব্রাশ করছে। রুমের বাহিরে এসে শেহরীনা আড়ি পেতে উঁকি দেয়। শুদ্ধ পুরুষ হয়ে ইতিমধ্যে বেরুনোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে তার সোহাগপ্রিয়। শেহরীনা সুযোগটা কাজে লাগায়। আয়নার মধ্যে থেকে নিজের প্রতিচ্ছবি কে লুকিয়ে তৎক্ষণাৎ সারোয়ার এর গালে গভীর চুম্বন দিয়ে ছুটে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সারোয়ার থমকে যায়। কিঞ্চিৎ মুহূর্ত পর মুখ বাঁকিয়ে পাত্তাহীন চুল ব্রাশ শেষ করল। শেহরীনার লাজুক মুখ ফাঁকা বাঁশের মত হয়ে গেল। সারোয়ার আয়নায় নিজেকে একপলক দেখে নিজের গালে টোকা দিয়ে শেহরীনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
“দুই পয়সার চুমু দিয়ে কেউ যে দয়া দেখাল। ইটস এনাফ টু হার্ট মাই ইগো উহ্ হু। এটাকে কী চুমু বলে! বিয়ের আজ দু’সপ্তাহ পার হলো। কেউ এখনো স্বাদমত চুমু দিতে শিখেনি। যখন শিখবে তখন যেয়ে আমার মন পাল্টি খাবে। নাহয় দয়া দেখিয়ে চুমু আমিও দিতে জানি। আমি আবার অধোবদন আদর দিতে চায় না বড় হৃদয়ের মন বলে কথা। এই মন জাস্ট ফর মাই স্পেশাল পার্সন।”
সারোয়ার দরজার কাছে গিয়ে শেহরীনার কোমর চেপে একটানে বুকে চেপে ফেলল। হুমড়ি খেয়ে স্বামীর বুকে হাত পড়ে যায় শেহরীনার। নিঃশ্বাস আটকে আটকে এলো তার। ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল সোহাগ পুরুষ এর দিকে। সারোয়ার মোহময় কণ্ঠে বলে,
“ঠিক এতটা কাছে এসে অনুভূতি জাগিয়ে চুম্বন করতে হয়। নাউ আই উইল সো ইউ হাউ টু ডু দিজ! ইউ জাস্ট রেসপন্স উইড মি।”
উষ্ণতার হাওয়ার বেগে তারা ঘোরে পড়ে যায়। সারোয়ার কাল পরিবেশ না ভেবে তৎক্ষণাৎ তার কৃষ্ণরাণীর শুকনো ওষ্ঠজোড়া ভিজিয়ে দেয়। দু টুকরো ছোট সিরিশের গোলাপী রঙের আভাস কে লাল রঙে পরিণত করে দেয় সারোয়ার। শেহরীনার দম আটকে এলো। সে সারোয়ার এর বুক ঠেলে পেছন করতে চাই। তবে সারোয়ার নরম টসটসা চামড়া কে দাঁত দিয়ে মৃদু কামড়ে ছেড়ে দিলো। শেহরীনার হৃদপিন্ড জোরে সরে স্পন্দিত হচ্ছে।একটুখানি চুম্বনেই মেয়েটার মুখে বিন্দু বিন্দু শিশির দেখা মিলল। তবে পুরো তাকেই জব্দ করতে গেলে মেয়েটা কী শিশির কন্যায় পরিণত হবে! ভেবেই ফিকফিকে হেসে ফেলে সারোয়ার। শেহরীনার বিস্মিত চেহারা দেখে তার সজাগ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। শেহরীনার মুখে লালাভ আভা ভেসে উঠে। সে হাসল ইশ সেও বিয়ের পর লাজুক হতে হতে গোমরে মরছে!
সারোয়ার গাড়িতে বসে ভাবছে কয়েকদিন পূর্বের কথা। মেয়েটা টিভির পর্দায় থাকা সেই প্রতিচ্ছবি ভুলতে পারেনি। যার কারণে রাতদিন সে নিজ থেকে মেয়েটাকে স্বাভাবিক করার তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তার স্বাভাবিক রুপ, লাজুকতা ফিরেও আসে স্বামীর #সোহাগপ্রিয়ায়। আজ দুদিন হলো মেয়েটার পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে। আজও পরীক্ষা থাকায় সে জানে তার সোহাগীনি এ মুহুর্তে পরীক্ষার জন্য চলে যাবে।সারোয়ার স্বস্তি ভরা শ্বাস টেনে চোখের মধ্যে সাদা ফ্রেমের চশমা এঁটে নেয়। দুঘণ্টার মধ্যে অফিস এসে তার কেবিনে ঢোকার মুহুর্তে ধাক্কা খেল কারো সাথে। কিন্তু অপর ব্যক্তি পড়ে যেতে নিয়ে ছিল তাকে ধরে ফেলে সোজা দাঁড় করিয়ে মুখোমুখি করে সারোয়ার। নজর পড়ে দেখল এই তো নিলীমা। তার অফিসে কেনো এলো! নিলীমা আপনমনে ঘাবড়ে গেল। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করল ছেলেটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হতে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে থাকার।
“আপনি আমার কেবিনে কী করছিলেন!”
“আআআমি দেখা করতে আসছিলাম।”
“কার সঙ্গে!”
“ওই আমি ভাবছি আমার উকিল ও এখানে থাকবে।”
“ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন। বাহিরের দরজায় স্পষ্ট আমার নাম চাপানো আছে। তানভির এই তানভির কৈ তুই!”
তানভির হতচকিত হয়ে ঘুম থেকে জেগে গেল। সে সকালে উঠে তার স্যারের কেবিন পরিষ্কার করেছে। কাজ শেষে স্যারের কেবিনেই কবে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে যায় তারও খবর নেই তার। কিন্তু স্যারের গম্ভীর ডাক শুনে শা’লার স্বাদের ঘুম উবে গেল। একদন্ড মুহূর্ত নষ্ট না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। সারোয়ার তার তানভির আপাতমস্তক দেখে বুঝল। না সন্দেহের কিছু নেই। তানভির জানেই না মেয়েটা এখানে এসেছিল! তানভির চোখে পড়ে নিলীমা মেয়েটার উপর। নিলীমার গলা ঘেমে গিয়েছে শুকনো ঢোক গিলল সে। তানভির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
“ম্যাম আপনি এখানে কেমনে! কখন আসলেন!”
সারোয়ার নিশ্চিত হলো মেয়েটা কোনো গন্ডগোল করতে এসেছে। সে মেয়েটার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়।
“যাও”। তানভির বেক্কল বনে গেল। স্যার মেয়েটাকে যেতে দিচ্ছে। তা কেমনে সম্ভব! স্যার যেখানে কোনো আসামী কে না খুঁটিয়ে ছাড়ে না সেখানে মেয়েটাকে ছাড়ল অসম্ভব ব্যাপার! হতে পারে মেয়েটা স্যারের কাজিন বলে নতুবা ভদ্র পুরুষ হওয়ায় মেয়েকে শ্লীলতাহানির স্বীকারোক্তি করতে দেননি। নিলীমা বাঘের মুখ থেকে ছাড়া পেতেই অতি দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সারোয়ার মনে মনে বিদ্রুপ হেসে বলে,
‘সাধুর মন পুলিশ পুলিশ’।
পরক্ষণে স্বাভাবিক চেহারায় তানভির দিকে তাকিয়ে বলে,
“চল কাজ আছে। আজকে দুজন মিলে ফসলিমা নামে এক মহিলার একটা কেইস নিয়ে স্টাডি করব। মহিলাটি কয়েকদিন যাবত তার স্বামী দ্বারা অ’প’প্রেশন, ট’র্চা’রের শিকার হচ্ছে। সেই তার স্বামীর আরো কয়েকজন বউ আছে। ফসলিমা হলো তার ছয়তম বউ।”
‘ছয়’ গলা উঁচিয়ে বলে ফেলে তানভির। তার আশ্চর্যান্বিত চেহারা দেখে সারোয়ার তার ফাঁকা মুখ বন্ধ করে দেয়।
“হুম ছেলে যেই জাতই হোক না কেনো তাদের বদভ্যাসগত তারা দু, চার কী আট, দশটাও বিয়ে করে থাকে। তার কেইসটা যেনো আমি নিজ হাতে হ্যান্ডেল করি সেটার জন্য অনুরোধ করেছে মহিলাটি। তার কেইস নিয়ে ঘাঁটতে হবে চল কেবিনে।”
সারোয়ার আর তানভির মিলে সেই কেইসের জন্য একেকটা ফাইল ঘাঁটছে।
অন্যত্রে, শেহরীনা বোরড ফিল করছে। সময়ের আগেই তার পরীক্ষার লিখা শেষ হয়ে গিয়েছে। ইশিতা,ফারদিন,জাফরান এখন অব্দি পরীক্ষার হলে লিখছে। গাছের নিচে নিরব বসে থাকল শেহরীনা। তখনি কেউ পেছন থেকে ‘হাই’ বলে উঠে। শেহরীনা চমকে তাকায়। সুশ্রী চেহারার হিজাব পরিহিতা এক রমণী কে দেখে শেহরীনার আইব্রু খানিকক্ষণ এর জন্য নড়ে উঠে। রমণী শান্ত দৃষ্টিতে শেহরীনার দিকে তাকিয়ে আছে। শেহরীনাও ভদ্রতা স্বরুপ ‘হাই’ বলল। তবে রমণী নিশ্চুপ। শেহরীনা ভ্রু কুঁচকে তাকে ‘হাই’ বলল পুনরায়।
“ওহ সরি তোমার দিকে তাকিয়ে ঘোরে পড়ে ছিলাম।”
“কেনো কেনো কে আপনি!”
“আব আমি তোমার সাথে পরিচিত হতে এসে ছিলাম। আমি হলাম কায়েসাম এর ফিয়ন্সি তনুদি দিয়াভ।”
‘কায়েসাম’ নামটুকু শুনে শেহরীনা অবাক হয়ে গেল। তবে সে প্রচন্ড খুশি হলো। সে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“প্লিজ ছেলেটাকে আগলে রাখবেন আপু। আপনাকে দেখে বড় লাগছে তাই আপনি করেই বলছি। ছেলেটা ভালোবাসার কাতর। আমার মত অযোগ্য মেয়ের প্রেমে পড়ে সে নিজেকে বেহায়া ও বানিয়েছে। তবুও আমি তার প্রেমে সাড়া দিতে পারিনি। কারণ নিয়তি পূর্বেই আমার সাথে আমার স্বামীর নাম জড়িয়ে দিয়ে ছিলেন।”
তনুদি হাসল। তার চেহারায় ম্লান কী তুষ্ট হাসি বোঝা গেল না! তবে এই হাসি কে মিষ্টি হাসি বলা চলে। কারণ হাসির তনুদির গালে টুপ করে একটা ডিম্পল ফুটে। খুব সূক্ষ্ম সেই ডিম্পল।তার চেহারার আদলে অন্যরকম মায়া।
“তুমি অযোগ্য নয় শেহরীনা। অযোগ্য হলে কেউ তোমাকে এতটা ভালোবেসে উম্মাদ হতে পারত না। তুমি নিজেকে কখনো অযোগ্য বলবে না। কেউ কখনো অযোগ্য হতে পারে না। জানো এরিস্টটলের একটা প্রবাদ আছে,
‘যোগ্যতা রাতারাতি কখনোই হয় না এটা হলো একটা অভ্যাস যা তৈরি করে নিতে হয়’। তোমার যোগ্যতা তুমি অনেক আগেই বানিয়ে ফেলেছো। অযোগ্য সেই যে কৈশোর থেকেও একজনের অভ্যাসে পরিণত হতে পারে না।”
শেহরীনা তনুদির শেষ কথাটুকু বুঝল না। তবে তনুদি কে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাও মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরে। তখনি সেখানে ফারদিনরা হাজির হয়। তাদের সাথে তনুদির পরিচয় করিয়ে দেয়। তারাও বেশ খুশি হলো বটে। কায়েসাম শেহরীনার পিছু ছেড়েছে এই যেনো তাদের কাছে ঢের মহত্ত্বের বিষয়!
চলবে….
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৪১ (বিপদ সংকেত)
“রুপ তুই আমার বউ। কোন আক্কেলে অপরিচিত কালনাগিনীর পা ধরস তুই! চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন এর বউ হয়ে একটা বেই**শ্যা মাইয়ার পা জড়িয়ে আছস কেন! ঐ হা**রা**জাদী। তুই আমার বউ-রে কী করছিস বল!”
চুলের মুঠি চেপে ধরে পদ্মিতা কে দূরে ধাক্কা দিলেন নাছির উদ্দিন। তিন চার কদম পিছিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় পদ্মিতা। একটুর জন্য তার শরীর থেমে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়। তার চোখে জ্বলন্ত অগ্নি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পদ্মিতা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“ওহো প্রতারক তো তুই এনা! বিয়ে করবি বলছিলি আমারে! আর বিয়ে করছিস এই মা**গীরে। হের জ্বালায় হের রুপের পইড়া দেখি বাচ্চাও নিলি। তৈ আমার লগে কেন প্রেমে জড়াইছিলি!”
পদ্মিতার কথায় চোখমুখে খিঁচে বন্ধ করে ফেলল রূপালি বেগম। নাছির উদ্দিন উত্তপ্ত লাভার ন্যায় তাকিয়ে রইল। পদ্মিতা ধীরপায়ে হেঁটে নাছির উদ্দিন এর কাছে এসে বলেন,
“এহনো সময় আসে আমাদের হাতে। আহো দুজন এক হওয়া যায়।”
মাথা ধরে গেল নাছির উদ্দিন এর। তার স্ত্রীর সামনে মেয়েটার অশ্লী’ল ইঙ্গিতে তার শরীরে দৈব শক্তি এসে ভর করে। জোরসরে এক চ’ড় লাগিয়ে দেন তিনি। পদ্মিতা মুখ থুবড়ে পড়ল। ইতিমধ্যে সরগোল এর শব্দে নাসমুর আর নাসমা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ছোট নাসমা চোখ পিটপিট করে তাকালো। মহিলাটি কে পড়ে থাকতে দেখে তার নিকট যেতে নিল। কিন্তু নাছির উদ্দিন আতঙ্কিত হয়ে মেয়েকে ধরে বুকে আগলে নেন। গলা উঁচিয়ে বলেন,
“কালনাগিনী বেরিয়ে যাহ্ আমার বাড়ি থেকে। তোকে যদি আবার দেখি তাহলে আমি তোর খু’ন করে ফেলব শয়তান কোথাকার।”
পদ্মিতা রেগে গজগজ করে নাছির উদ্দিন এর বাড়ি ত্যাগ করেন। রাস্তায় এসে ফোঁস ফোঁস করে সাপের মত পায়চারী করতে থাকেন। এখনো মধ্যরাত হয়নি তবুও তার নিজের আত্মরক্ষার পরোয়া নেই। তখনি কেউ তাকে পিছু ডাকে। তিনি পেছন ফিরে তাকান। এক ভদ্রলোক চশমা এঁটে দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।
“কে আপনে!”
“আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।”
___
নাছির উদ্দিন রেগে মাদরের উপর হাত চাপড়াচ্ছে। রূপালি বেগম নিশ্চুপ কান্না করছেন। তিনি শেহরীনার ভবিষ্যৎ ভেবে ওমন পাপ করতে গিয়ে ছিলেন। কারো সামনে মাথা নত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। মা তো মায়ের মন বড়ই অদ্ভুত! নাছির উদ্দিন শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
“রূপ এহনো সময় আছে কও কেন তুমি ওমন এক কাজ করলা! জানো কত অপমান লাগতাছিল। আমার বউ কারো পায়ের পদতলে ছুঁয়ে কাঁদছে এর চেয়ে জঘন্য দৃশ্য দেহার আগে আমার মরণ….।”
রূপালি বেগম তৎক্ষণাৎ স্বামীর মুখে হাত চেপে অশুভ কথা বলা থেকে থামায় দেন। নাছির উদ্দিন এর চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। তার বউ এক বে**শ্যার পা ছুঁয়ে কাঁদছিল তা যেনো তিনি ভুলতেই পারছেন না। নাছির উদ্দিন বউ কে সরালেন না। নিরব তাইলে চোখের অশ্রু ঝরান।
“আমারে ক্ষমা কইরা দেন। আমি আমাদের শেহরীনা মাইয়ার জন্য ওমন করছি। ওই মহিলা এত হারাপ হইব জানিলে আআআমি কখনো ওমন করতাম না। আমারে ক্ষমা কইরা দেন আপনে! তবুও মরণের কতা কৈবেন না। আপনার কিছু হইলে আমাগো কী হবে! আপনে ছাইড়া আমাগোর বাচ্চারা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হইয়া যাবো।”
নাছির উদ্দিন তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে বউকেও পাশে বসিয়ে শান্ত করান। তিনি উম্মুক্ত চোখে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের সামনে সেই দুপুরের দৃশ্যপট বারংবার ভেসে উঠছে।
দুপুরবেলার ঘটনা…
সকাল ১০টায় নাছির উদ্দিন আজ খোশমেজাজে বাজার করছেন। হাতে বড়সরো পলিথিন ব্যাগ। দুটো রুই মাছ, একটা কুড়াল মাছ নাসমুর জন্য আর শেহরীনার জন্য দুটা বড় বড় ইলিশ মাছ। নাসমার জন্য দেশি মুরগি একটা আর তার আহ্লাদী বুড়ি বউ এর জন্য খাসীর মাংস কিনেন। জম্পেশ বাজার করে পলিথিন ভর্তি করে নিলেন দুঘণ্টায়। তার কারণও আছে বটে। আজ দুই মাস পেরিয়ে গেছে প্রায়। শেহরীনা আজ তার বাবার বাড়িতে আসবে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও আসার কথা। তার বড় শালক আসবে কিছু আয়োজন না করলেই নয়। শেহরীনাকে রেখে তারা ফিরে যাবেন। তা ইতিমধ্যে কল দিয়ে জানিয়েছেন মোঃ আবু সিদ্দিক। সেই ভাবনা এঁটে রেখেই তিনি বাজার করছেন। কাঁচা বাজার শেষে সবজির বাজার করে বাজারঘাটা থেকে বেরিয়ে পড়েন। গাছের ছায়াতলে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। পরণের শার্ট ঘামে ভিজে ভোতকা গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। তবুও তাড়াহুড়ো করলে তার প্রেশার বেড়ে যেতে পারে সেই আশংকায় তিনি জিরিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
সেই সময় তার পাশ দিয়ে একটা ঠান্ডা আইসক্রিম এর স্টল নিয়ে হেঁটে যায় এক ছেলে। তাকে দেখে নাছির উদ্দিন এর ইচ্ছে হলো একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আইসক্রিম খাওয়ার। বর্তমানে বয়স বাড়লেও ছোটবেলায় প্রচুর আইসক্রিম খেতেন তিনি। আইসক্রিম দেখে লোভ লাগায় তিনি একটা কিনে নেওয়ার মুহুর্তেই তার নজরে পড়ল চিপা রাস্তার গলিতে। তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আইসক্রিম খাওয়ার স্বাদ টুকু মিটে গেল। স্তদ্ধ চোখে রাস্তার মোড়ের খালি গলির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি ভাবতেও পারছেন না তার স্ত্রী রূপালি বেগম কি-না পদ্মিতার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এই দৃশ্য দেখে রাগে চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠে নাছির উদ্দিন এর। বে***শ্যা মেয়েটা দু’দুটো জীবন ধ্বংস করেও শান্তি পায়নি! এখন আবারো ফিরে এলো তাদের জীবনে।
তিনি কটমটে বাজার নিয়ে সেখানে যান।
রূপালি বেগম স্বামীকে দেখেই আঁতকে দাঁড়িয়ে যান। পদ্মিতা ভাবেননি নাছির উদ্দিন হঠাৎ প্রকট হবেন। ঘাবড়ে দুকদম পিছিয়ে গেলেও পুরনো সময়ের মায়ার টানে দাঁড়িয়ে রইলেন। নাছির উদ্দিন এসেই রূপালি বেগম কে আঁকড়ে ধরে নিজের পেছন করে নেন। পদ্মিতা অভুক্ত মুখে তাকিয়ে রইলেন।
“বেই**শ্যা মাইয়া কোনখান! তোর কী অশান্তি নো গড়িলে শান্তি মিলে না! আবার কেন ফিরে আইছস। তোরে না আমি ত্যাগ করছি।”
“নাছির আমার কতা হুনো…।”
“চুপ চুপ মা***। মুখ খারাপ নো গড়িস। আমাগোর পিছে আইবি তো খু’ন গড়ে ফেলুম। আর তুই রূপ তুই আমার বউ হওয়া এত বড় অপমানের কাজ করলি। আজ তোর শাস্তি হইব।”
টেনেহিঁচড়ে বাজার চেপে রূপালি বেগম কে নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে পড়েন নাছির উদ্দিন। রূপালি বেগম স্বামীকে থামানোর চেষ্টা করায় অগ্নি দৃষ্টিজোড়া নিয়ে বউয়ের দিকে তাকান। এতে চুপসে গিয়ে তিনি সিএনজিতে স্বামীর শার্টের টুকরো হাতের তালুর মধ্যে চেপে নিশ্চুপ বসে রইলেন। নাছির উদ্দিন ফোঁস ফোঁস করে রাগের মাত্রা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
বাড়িতে এসে তিনি থমকে যান। শেহরীনার শ্বশুরবাড়ির লোক ইতিমধ্যে বাড়িতে অবস্থান করছেন। ঢোক গিলে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের দিকে তাকান। মোঃ আবু সিদ্দিক অধীর আগ্রহে বাহিরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বোন কে আসতে দেখে আহ্লাদী হয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন। রূপালি বেগম ভাই আর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনে কোনো মতে নিজেকে সামলে নেন। তাদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই কেক নিয়ে হাজির হই শেহরীনা। কেক দেখে নাছির উদ্দিন আর রূপালি বেগম চোখ পিটপিট করে তাকান। মোঃ আবু সিদ্দিক ম্লান হেসে বলেন,
“বোন রুপ এই প্যাকেটটা খুলে দুজন জামা পড়ে আয়। আজকের এই স্পেশাল দিন তোকে নিয়ে কাটাতে চায়।”
ভাইয়ের কথায় বুকের ভেতর কেমন যেনো করে উঠল রূপালি বেগম এর। জাহানারা পুষ্প নির্লিপ্ত চোখে স্বামীকে দেখছেন। তবে কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করেননি। শেহরীনা বাড়িতে এসেছে অনেক আগেই। এসে ঘরধর সাফসুতরো করে সারোয়ার কে চলে আসতে বলে। সারোয়ার ও কেক নিয়ে তার পরিবারের সাথে চলে আসে।
রূপালি বেগম আর নাছির উদ্দিন কে দেখে অবাক তারা। গ্রাম্য ধরনের পোশাক পরায় তাদের কে শহুরে লোক লাগতো না। বেশভুষায় আলাদাই একটা মধ্যবিত্তের ভাব আসতো। আজ তাদের পরণের জামার সাথে তাদের কে জমিদার বাড়ির পুরুষ মহিলা মনে হচ্ছে। রূপালি বেগম এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মোঃ আবু সিদ্দিক। তার চোখের মায়া যেনো উপচে পড়ছে। তার ছোট বোন রূপ এত জলদি বড় হয়ে গেল! ভাবতেই পারছেন না তিনি।
‘ভাই’ শব্দটা শুনে ধ্যান ফিরে মোঃ আবু সিদ্দিক এর। তিনি খেয়াল করেন ছোট সেই সময়ের রূপ এসে ডাকছে। তিনিও মাথা নেড়ে সাড়া দিলেন। রূপালি বেগম কে নিয়ে তিনি কেকের সামনে দাঁড়ান।
“জানিস রূপ তোকে একবার একটা মেয়ে পাথর মেরে কপাল ফাটিয়ে ছিল। আমার ফুলের মত বোনটা তখন কেঁদেকেটে একাকার। তোর সেই কান্না আমার বুকে কেমন একটা ব্যথা দিয়ে ছিল। তারপর তুই ঐ মেয়ে দেখেছিলি আর!”
অনেক পুরোনো কথা হওয়ায় রূপালি বেগম এর মনে পড়তে সময় লাগে। যার কারণে তিনি কিঞ্চিৎ মুহূর্ত অব্দি নিরব ছিলেন। আচমকা মনে পড়তেই বলেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ তারপর ভয়ে আমি গলিতে খেলতে যেতাম না। বান্ধবীরা যখন জোর করে নিয়ে যায় তখন জানতে পারছিলাম মাইয়াটারে নাকি কেউ পাথর মাইরা কপাল ফাটাইয়া দিছে।”
“হুম ঐটা আমি ছিলাম। আজকের এ দিনটাই ছিল তোর সেই কপাল ফেটে যাওয়ার দিন। তোর কান্নার দিন। এই দিন আসলেই আমার বুক কাঁপে-রে বোন। তুই কখনো তোর এই ভাইরে ভুল বুঝবি না কসম খা আল্লাহর!”
“ভাই অদ্ভুত কথা বলিও না। আমার ভাই দুনিয়াতে একটাই আছে যে তার বোনকে খুব খুব ভালোবাসে।”
রূপালি বেগম আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলেন। মোঃ আবু সিদ্দিক হাসলেন। তবে এই হাসি কিসের আদৌ জানেন না কেউ। সারোয়ার তার বাবার পরিবর্তন দেখে ঢোক গিলল। কেনো সে নিজেও জানে না। তার মনে হচ্ছে অশুভ কিছু হবে! সে পিতৃহারা হলে কী বাঁচবে! মোঃ আবু সিদ্দিক খুনসুটি ভরা মুহূর্ত নিয়ে রূপালি বেগম এর সঙ্গে সময় কাটান। জাহানারা পুষ্প এর সাথে একটু আধটু জরুরি ভিত্তিতে কথা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় কথা তাদের বলতে দেখা যায়নি। রূপালি বেগম খেয়াল করে কথা বলতে চাইলে নাছির উদ্দিন থামিয়ে দেন।
‘স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার ব্যাপার স্যাপার। তুমি খালি কও তোমার মত।’
রূপালি বেগম স্বামীর কথামত মন হালকা করে তার ভাবীর সঙ্গপাতিত্ব করেন। আনন্দে সময় কাটিয়ে বিকালের দিকে ভাতের ব্যবস্থা করেন জাহানারা পুষ্প, রূপালি বেগম আর শেহরীনা। রান্না শেষ করে বক্স করে রাখেন রূপালি বেগম। কারণ তার ভাইয়ে জানিয়েছে তারা চলে যাবে রাত অব্দি থাকতে পারবেন না। সাজিয়ার শ্বাশুড়ি অসুস্থ কি-না।
শেহরীনার পরীক্ষাও শেষ হয়েছে। এখন ছুটি চলছে তার।রেজাল্ট এর পর নতুন সেমিস্টার শুরু।
আজ দুমাস পর বাবা-মাকে কাছে পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরল না সে। সারোয়ার ও বউ ছাড়া যাবে না। বিধেয় সবাই ফিরে গেলেও তারা রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেয়।
মাগরিবের নামাজের পর হঠাৎ শয়তান প্রকট হলো উঠানে। এ যেনো সবার জন্য বিস্ময়কর দৃশ্য। পদ্মিতাকে এসেই নাছির উদ্দিন এর পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করে। এতে রূপালি বেগম রেগে যান প্রচুর। তিনি এসেই মহিলাটির চুলের গুচ্ছ ধরে জোরে সরে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাহিরে ফেলেন। পদ্মিতা রেগে গালিগালাজ করতে লাগেন। নাছির উদ্দিন মেয়েটার বদভ্যাস দেখে গরুর প্রস্রাব নিয়ে পদ্মিতার মুখে ছুঁড়ে মেরে কথা শুনান।
‘বাবা বাবা কী হলো কোথায় হারালেন!’
নাছির উদ্দিন এর ভাবনার সুতো কেটে গেল। তিনি আড়চোখে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে গাঁ মোচড়ে উঠে বসেন। শেহরীনা কে দেখে চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা খুঁজে পড়তে চাইলে শেহরীনা নিজ হাতে পড়িয়ে দেয়।
“কোথায় ঘুমাচ্ছিলেন হুম! এটা কী ঘুমানোর জায়গা! ইশ দেখেন কত মশা কামড়েছে। জায়গাটা লাল করে দিয়েছে।এই যে শুনেন সারোয়ার!”
সারোয়ার কে ডেকে শেহরীনা লাল হওয়া জায়গা দেখিয়ে বলে,
“একটু মলম লাগিয়ে দিন আমি আম্মুর সাথে রান্নাঘরে আছি। কিছু লাগলে জানাবেন।”
সারোয়ার শ্বশুর কে তুলে মাদরে বসায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)রুমের ভেতর গিয়ে মলম নিয়ে এসে শ্বশুরের পাশে বসে লালচে স্থানে মলম দিয়ে টিউবের ঢাকনা বাঁধতে বাঁধতে বলেন,
“ঐ ফসলিমা মহিলাটি কেনো এসেছিলেন!”
অপরিচিত নাম শুনে আশ্চর্য হলেন নাছির উদ্দিন। মেয়ের জামাইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
“কী হলো শ্বশুরমশাই বলুন ঝগড়া করে গরুর প্রস্রাব যার মুখে ছুঁড়ে মারলেন তার নাম ফসলিমা খাতুন ওরফে সোহেল রানার ছয়তম বউ তিনি। তাকে হঠাৎ এ বাড়িতে দেখে অবাক হয়েছিলাম তখন। তবে আপনাদের ঝগড়া দেখে আগ বাড়িয়ে কিছু বলিনি।”
নাছির উদ্দিন আশ্চর্য হয়ে বলেন,
“বলো কী সোহেল রানা ঐ বুড়োটা না খামারের কারখানা করে। ওর এত বউ থেকেও বিয়ে করেছে!”
“হুম এখন নাকি ঐ মহিলাকে মারধর করেন। যার জন্য তিনি আমার কাছে কেইস ফাইল করেছেন কোর্টের জন্য।”
শুনেই তিরস্কারমূলক হাসেন নাছির উদ্দিন। ম্লান গলায় সারোয়ার এর কাঁধ চেপে বলেন,
“দুনিয়ায় আমাদের কে বহু কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। না চাইতেও আমরা এমন সত্যের সামনে এসে পড়ি যা আমরা চাইতাম না। যার ব্যাপারে কথা কইতেছ। তারে আমি, তোমার শ্বাশুড়ি আর তোমার বাবা ভালোই চিনি। তার চরিত্রের সার্টিফিকেট আমাদের কাছে আছে। ভালোই হবে তুমি তার কেইস না লড়ে তার মুখের উপর শাস্তি পেতে কেইসটা ছেড়ে দাও।”
“কোন সত্য শ্বশুরমশাই!”
নাছির উদ্দিন ঢোক গিলে তাকান মেয়ের জামাইয়ের দিকে। বলবেন কী বলবেন না সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে উঠেন। তিনি জানেন মেয়ের জামাই কখনো তার আসল মা’কে দেখেনি। এ কথা গোপনে জানিয়ে ছিল তার বড় শালক মোঃ আবু সিদ্দিক। উত্তেজিত হলো সারোয়ার। শ্বশুরের কাছ থেকে মিথ্যে ভাইব পাওয়া যাচ্ছে। সে বুঝে গেছে ঐ ফসলিমা কে হতে পারে! সব নষ্টের গোঁড়া! সব ফাঁসের ঝাড়! তব্দা হয়ে শ্বশুরের পাশে বসে রইল সে।
চলবে…..