প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
120

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৪৮ (শাস্তি🔥)

‘কককেউ আছে! পপানি পানি খাবো।’
পদ্মিতার মুখের দিকে পানি ছুঁড়ে মা’রল কেউ। নাকমুখে পানি উঠে যাওয়ার উপক্রম। তবুও তৃষ্ণার্ত হয়ে নাকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সর্দির সঙ্গে মুখের লেগে থাকা ঘামাক্ত পানি হয়ে তার ঠোঁটের উপর এসে পড়ে। পদ্মিতা ঠোঁট জ্বিভ দিয়ে চেটে নিলো। তার সামনের ব্যক্তিটি পৈশাচিক হেসে জিজ্ঞেস করে।
‘কাউকে যখন স্বার্থ হাসিলের জন্য বন্দি করা হয় ঠিক এমনি অত্যাচার করা হয় তাই না আন্টি। ওহ সরি ভুল উপাধি দিলাম। মিস বারোভা*তা**।’
পদ্মিতার চোখজোড়া খুলেছে। চোখের সামনে বসা ব্যক্তি কে চিনতে পারলেন না। ব্যক্তিটি তার চাহনি দেখে বলে,
‘চিনতে পারবেন না আমায়। আমি এমন এক ব্যর্থ প্রেমিক, যার স্বপ্নের নারী কে আপনারা আহত করে নিহত করতে চেয়েছিলেন। আচ্ছা আপনাদের কী শাস্তি দেওয়া যায় আমার প্রিয় নারীর সাথে জ’ঘ’ন্য আচরণের জন্য। দেখুন সবাই কত অবুঝ কেউ বুঝলেও খোঁজ নিলো না আপনাদের। নেবেই বা কেমনে! আমি আগেই সব সল্ট আউট করে রেখেছি। এখন তো সব মিডিয়ায় পুপলার ট্রেন্ডিং খবরে আছেন আপনারা। মিডিয়ায় আমি ভুল তথ্য পাঠিয়েছি। আপনারা আত্মহত্যা করে ফেলেছেন। তাও কেমনে! বিশাল সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে নিজে তলিয়ে দিয়ে। ওমা বোকা মিডিয়ার লোকদের দেখুন কত সহজে বিশ্বাস করে ফেইক ছবির বদৌলতে আপনাদের মৃত বানিয়ে দিলো। এটা ভুল হয়েছে তাই না! আপনারা আমার সামনে জ্যান্ত আছেন। মরেননি দুজনে এখনো।’
পদ্মিতা আতঙ্কিত হয়ে কাঁপা গলায় শোধায়।
‘আআআমাকে মমমাফ কইইইরা দদদাও বাবা।’
তার মাঝে ‘উম উম’ শব্দে হলো। তাদের নজর পড়ে ট্রাউজার পরিহিত ন’গ্ন বুকে শায়িত থাকা ব্যক্তির দিকে। ব্যক্তিটি আর কেউ নয় শোয়াইব মিলদাজ বটে। তার মুখে কস্টেপ লাগানো বিধেয় তার শব্দ ‘উম’ করে বের হচ্ছে। ব্যক্তিটি গিয়ে তার কস্টেপ জোরালো ভাবে টান মা’রে। জোর টানে শোয়াইব মিলদাজ এর মুখ জ্বালা করে উঠল আর সাথে সাথে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠেন। ব্যক্তিটির মধ্যে কোনো মায়াদয়া নজরে এলো না। সে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায়। সেখানে ডেস্ক হাঁতড়ে হাঁতড়ে পুরনো ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত লাল মরিচের গুঁড়ার প্যাকেট দেখতে পায়। ভদ্র হেসে সেই প্যাকেট নিয়ে চুলায় একটা কড়াই বসিয়ে গুঁড়া ঢেলে চুলো জ্বালিয়ে দেয়। বাড়িটা শোয়াইব মিলদাজ এর হলেও তিনি কখনো রান্নাঘরের মধ্যে পা রাখেননি। সর্বদা অস্বাস্থ্যকর খাবার হোটেল থেকে আনিয়ে খেয়েছে সাথে‌ শেহরীনা কেও জোর করে খাইয়ে রাখতো। বেচারী বমি করে করে বিধ্বস্ত হলেও শোয়াইব মিলদাজ তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে শান্ত রাখতো। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেয়েছে সে শোয়াইব মিলদাজ এর রুমের ডেস্কে রাখা ঘুমের ট্যাবলেট এর প্যাকেট দেখে।
চুলোয় ঠুস-ঠুস শব্দ করে তাজা হয়ে উঠল লাল মরিচের গুঁড়া। একটু কালচে ভাব এসেছে অর্থাৎ পুরো গরম হয়েছে।
‘কৃষ্ণকুমারী খুব কষ্টে ছিলে তাই না! দেখবে সামনে খুব সুখে থাকবে। তোমার কষ্ট আমার দেখা যায় না। আমার বড্ড প্রিয় কেউ তুমি।’
কায়েসাম এর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গাল বেয়ে মরিচের গুঁড়ার উপর পড়ে।‌ ছ্যাঁত করে শব্দ হয়ে উঠল। রুমের ভেতর থাকা শোয়াইব মিলদাজ এবং পদ্মিতা আওয়াজ শুনে ঢোক গিলেন। তারা বুঝতে পারছেন না ছেলেটা হঠাৎ রান্নাঘরে কেনো গেল! কায়েসাম চোখ মুছে উম্মাদহীন ভাব নিয়ে কড়াই থেকে গুঁড়া একটা বাটিতে ঢেলে নেয়। বাটি হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে সন্তপর্ণে চেয়ার সমেত বসে পড়ল শোয়াইব মিলদাজ এর সামনে। তার সামনে বাটিটি তুলে দেখিয়ে বলে,
‘এটা কী আমি বলছি এটা হচ্ছে লাল মরিচের গুঁড়া আপনি তো কখনো দেখেননি তাই না! এটা লাগালে কেমন অনুভূতি হবে জানেন কী!’
কায়েসাম প্রশ্ন করেই নিশ্চুপে শান্ত চাহনি দেয়। তার কণ্ঠস্বরে তুই শব্দের চেয়েও আপন শব্দ তুমি, আপনি ব্যবহার হচ্ছে। এই তার অভিনব উপায়ে নিজেকে তৃপ্তি দেওয়ার পদ্ধতি। কাউকে তুই, কাউকে তুমি, কাউকে আপনি বলে বলে সে তার প্রতিশোধ নেয়। শোয়াইব মিলদাজ এর বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। গু’লিটি এখনো তার বুকের মধ্যে লেগে আছে। তবুও তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। চলবেই না কেনো! কায়েসাম তাকে জানে মা’রবে কখনো। যে লোক তার প্রিয় নারী কে কষ্ট দিয়েছে সেই লোক কে আদৌ কায়েসাম সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র!
শোয়াইব মিলদাজ শুকনো ঢোক গিলে ‘আ’ শব্দ উচ্চারণ করতে নিলে কায়েসাম এ ফাঁকে অর্ধ মরিচের গুঁড়া তার গালে ঢুকিয়ে কস্টেপ মে’রে দেয়। শোয়াইব মিলদাজ এর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায়। তার গলার ভেতর যেনো কেউ জ্বলন্ত আগুন ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি উম্মাদের মত ধাপড়াতে লাগলেন। কায়েসাম নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পদ্মিতা ভয়ে গুটিয়ে রইলেন। মুখ থেকে এক টু শব্দ অব্দি বের করতে পারছেন না। শোয়াইব মিলদাজ এর চোখজোড়া এহেন বড় হওয়ায় কায়েসাম অবাক হয়ে আরেকটি ভালো কাজ করল। হাতের মধ্যে লাগোয়া গুঁড়া শোয়াইব মিলদাজ এর চোখজোড়ায় বলতে গেলে চোখের পাতা থেকে আরম্ভ করে পুরো মণি পর্যন্ত মেখে মেখে গুঁড়া লাগিয়ে দিলো। ‘না মন ভরেনি’। বিড়বিড় করে সে বাটিতে অল্পস্বল্প গরম পানি ঢেলে লাল মরিচের গুঁড়া মেখে নেয়। পেস্ট হয়ে আসলে একটা ছু’ড়ি’তে ভালোমত পেস্ট মাখিয়ে সেটি নিয়ে শোয়াইব মিলদাজ এর ন’গ্ন বুকের গু’লিবি’দ্ধ অংশে জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেয়। দম বন্ধ হয়ে আসছে শোয়াইব মিলদাজের। তার গলা ফুলেফেঁপে গেছে। চোখের পাশ বেয়ে র’ক্ত ঝরছে। যেনো সে র’ক্তের কান্না করছে। যে কাঁদায়, একদিন সে নিজেও কাঁদে। কথাটা যেনো শোয়াইব মিলদাজ এর সাথে মিলে গেল। ছু’ড়িটা কে নেড়েচেড়ে লোকটার হৃৎপিণ্ডের শব্দ বন্ধ করার চেষ্টা করে কায়েসাম। তার ব্যবহার এমন সে ‘ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না’। নাড়ছে আর নাড়ছে। মিনিটের কাঁটা ২০ থেকে গড়িয়ে ৪০ হয়ে গেল। কায়েসাম দেখে বিস্মিত হলো। শোয়াইব মিলদাজ এর তবুও প্রাণ রয়েছে। এ যেনো অলৌকিক! মৃদু হাসল কায়েসাম।
হাতের মধ্যে র’ক্তা’ক্ত ছু’ড়িটি বিছানায় ফেলে কায়েসাম একটা ইন’জে’কশন নেয় টেবিলের উপর থেকে। সেখানে গুলিয়ে রাখা হয়েছে নাম না জানা দুয়েক রকমের ক্ষতিকর ড্রা’গ’স। যার এক আহরণে মৃত্যু হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কায়েসাম এটি সংগ্রহ করেছে ফার্মেসির থেকে কড়া দামে নিয়েছে বটে! ইন’জে’কশন পুশ করল শোয়াইব মিলদাজ এর হৃৎপিণ্ডে। ইন’জে’কশনটি ও বিছানায় উপর ফেলে কায়েসাম পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় পদ্মিতার দিকে। তার নিকট হাঁটু গেড়ে বসে বলে,
‘আপনি তো মায়ের সমান আন্টি! কিন্তু আপনাকে মা ডাকলেও নারী জাতিকে কলঙ্ক করা হবে। আপনি যদি ‘মা’ শব্দের ভারী বোঝাটা নেওয়ার সামান্যটুকু চেষ্টা করতেন। তবে আমি আপনাকে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আপনি এক নিষ্পাপ বাচ্চার প্রাণ নিয়েছেন এ আমি কেমনে মেনে নেই বলুন! তাও অন্য কারো নয় আমারই প্রিয় নারীর গর্ভ খালি করলেন আপনি। এটুকুন দয়া অব্দি হয়নি আপনার। মেয়েটা কে পানির নাম করে খাইয়ে নি’কৃষ্ট অপরাধ করতে আপনার বুক কাঁপেনি! থাকগে এখন কেঁপে লাভ নেই। ঐ দেখুন আপনাল সহযোগী পুরুষ কিন্তু আপনার দিকে চেয়ে আছেন।’
পদ্মিতার চোখজোড়া টকটকে লাল হয়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত কান্নার ফলে। কায়েসাম তার দুগাল চেপে শোয়াইব মিলদাজ এর দিকে আঙ্গুল করে দেখায়।
‘দেখুন দেখুন আঙ্কেল কত শান্তিতে তাকিয়ে আছেন। আর উম’উম শব্দ করছেন না। এর মানে জানেন আপনি! কানের মধ্যে বলি লজ্জা সরমের ব্যাপার।’
কায়েসাম পদ্মিতার কানের কাছে ঠোঁট এলিয়ে বলে,
‘লোকটার কাছে আপনার গোসলের ভিডিও আছে। ইশ দেখুন কত পবিত্র ভালোবাসা তার। এত পবিত্র ভালোবাসা রেখে আপনি এই অপবিত্র পৃথিবীর মাটিতে কী করছেন! আপনার উচিৎ তার কাছে ফিরে যাওয়া। এখন না আসবেন সিদ্দিক আঙ্কেল না আসবেন নাছির আঙ্কেল। খুব বুড়ি বয়সে ভীমরতি করতে চেয়ে ছিলেন না। এর জন্য তো আপনার কাছে আপনার প্রিয় মানুষটির কাছে যেতে হবে। দেখুন কত শান্ত দৃষ্টি শোয়াইব আঙ্কেলের!’
কায়েসাম পদ্মিতার কাছ থেকে সরে শোয়াইব মিলদাজ এর ঠোঁটের উপর থেকে কস্টেপ টান দেয়। মুখের অর্ধ চামড়া ছিঁড়ে কস্টেপের সাথে উঠে আসল। দেখে কায়েসাম অবাক না হলে চোখ দুটো ভয়ে বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল পদ্মিতা। শোয়াইব মিলদাজ এর দন্ত অংশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিঞ্চিৎ পরই নীলাচে বর্ণ ধারণ করবে। কায়েসাম গিয়ে পদ্মিতার কাছে দাঁড়াল। গালে হাত রেখে ভাবান্তর কণ্ঠে বলে,
‘আপনাকে কী শাস্তি দেবো আন্টি! এক নারীর গর্ভ খালির অপরাধে, এক মেয়ের উপর জু’লু’ম করার অপরাধে, এক মেয়ের খাবারে ড্রাগ মেশানোর অপরাধে না এক মেয়েকে পরপুরুষের কাছে বিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করার অপরাধে! এত অপরাধ করেও কেমনে ভাবেন আপনি এ থেকে পার পেয়ে যাবেন। আমি জানি মানুষ কে শাস্তি দেওয়ার আগে সুযোগ দেওয়া যায়, ক্ষমা করতে হয়। আপনাকে আমি সুযোগ দিতে চাই আন্টি। তবে তাও কোনো মৃত্যুর থেকে কম নয়। আপনি বাঁচবেন এই অপবিত্র পৃথিবীতে কিন্তু বেঁচে থেকেও আপনি ম’রণের স্বাদ গ্রহণ করবেন। আমি নিরুপায়। আমি পাগলা প্রেমিক, বদ্ধ প্রেমিক হতে পারি। কিন্তু যার জন্য হতে চেয়েছি সেই তো আমার নয়। সেই নারীই অন্য কারো ব্যক্তিগত দলিল। আমি তো নামেমাত্র কাগজের টুকরো। যেই কাগজ চোখের জলে ভিজবে, মনের জ্বরের যন্ত্রণায় কাতরাবে, অকৃত্রিম হেসে হেসে বুকের যন্ত্রণা মোচড়ে দেবে এবং কোনো এক বার্ধক্যে মৃত্যুর প্রহরে যেয়ে ছিঁড়ে যাবে। আপনি ভাবছেন নিশ্চয়ই আপনাদের কুকর্মের কথা যেখানে পুলিশ ফোর্স জানতে পারল না সেখানে আমি কেমনে জানলাম! সহজ জবাব তারা আসার আগেই যেমনে আপনাদের লুকিয়েছি তেমনি আসবাবপত্র থেকে লুকানোর মত জিনিস নিজ হাতে লুকিয়ে যতনে রাখলাম।’
কায়েসাম এর গলা শুকিয়ে আসছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সে টেবিলের থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক ঢকে পানি পান করে নেয়। গলা ভিজে ভিজে গেলে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। পদ্মিতা বিষন্নতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখ বাঁধা নয় তবুও তার কথা বলার মত ভাষা নেই। কায়েসাম কে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে।
‘কী করবে তুমি! খু’ন করবে করে দাও। এই পৃথিবীর অংশ হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। মে’রে দাও বাবা এসব পা’প থেকে মুক্তি দাও আমাকে।’
কায়েসাম ‘হু হু’ করে হেসে উঠল। পদ্মিতার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছেলেটার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি জানেন ছেলেটা তাকে মা’রবে না তবুও তার ইচ্ছেই নেই বাঁচার। কায়েসাম তার নিজের দুগালে মৃদু চাপড়ে বলে,
‘আপনার মনে হয় আমি মা’রব! উহুম আমি নারীদের সম্মান করি, খু’ন করি না। নারীদের কে সম্মান করতে শিখিয়েছেন আমার জন্মদাত্রী মা। তার শিক্ষা আমায় নির্মম হতে শিখায়নি।’
পদ্মিতার কাছে এত অত্যাচারের মাঝে ছেলেটার আলাবোলা কথা সহ্য হচ্ছে না। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
‘তাহলে কী করতে চাইছো তুমি! মা’রতে বলছি মা’রছো নাহ, ছেড়ে দিতে বলছি ছাড়ছো না। তাহলে কী বন্দি রাখতে চাও ঠিকাছে বন্দি করে রেখে দাও পঁচে গলে ম’রব। তবুও আমায় রেহাই দাও।’
কায়েসাম এর হাসি বন্ধ হয়ে গেল। পদ্মিতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে টেবিলের ডেস্ক খুলে ঝাঁঝালো দুর্গন্ধময় একটা কাঁচের বোতল বের করে সে। পদ্মিতা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়। কিশোরী বয়স থেকেই তার রুপ ছিল দুধের মত ফর্সা। যার কারণে উঠতে,বসতে গেলে ছেলেদের ভীষণ নজর কাড়তো। তার রুপের আগুন ধরিয়ে দেওয়া ঝলক। সেই ঝলকের কারণেই কতই না লোকের সঙ্গে হাঁটা চলা হয়েছিল তার। তার ফাঁদে পড়ে মোঃ আবু সিদ্দিক ও পড়েছিল তবে সময় থাকতে তিনি নিজের সহিপথ আঁকড়ে ধরে ছিল। তার সেই রুপের অহংকারই কী তবে তার সর্বনাশা হয়ে গেল! ঢোক গিলে কায়েসাম এর উদ্দেশ্যে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘বববাবা এএই কী করছো! এএএটা কিসের বোতল! ওষুধের গন্ধ কেনো।’
‘এটাকে বলে এসিড। কোন এসিড নিশ্চয়ই বুঝছেন! আমি বলেছি না আন্টি আমি আপনাকে নারীর জাত হিসেবে কষ্ট দিতে পারব না। তবে আপনি অন্যায়কারী, পাপী এক নারী। আপনার সামান্য খু’নে শাস্তি পূর্ণ হবে না। এক নারীর গর্ভ খালি করে দেওয়ার মত অন্যায় আর দুটো নেই। আপনার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতেই টিকে থাকবে তবে সেটা হবে খুবই নগণ্য। মানুষের জীবনে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় কী জানেন! জ্বলসানো মুখ আর শরীর। আপনাকে জনে জনে দেখবে। কিন্তু ভয়ে আপনার ধার অব্দি ঘেঁষবে না। তারপর বুঝতে পারবেন জীবনের কাঠিন্যতা।’
পদ্মিতার চক্ষু চড়কগাছ। মাথা নেড়ে নেতিবাচক ইঙ্গিত বুঝিয়ে কাঁপা গলায় শোনায়।
‘ববাবা সোজাসুজি মে’রে দাও। তবুও এই কষ্টটা দিও না আমি সহ্য করতে পারব না, বেঁচে থেকেও মরে যাবো বাবা।’
‘আন্টি জানেন তো সবার নিজস্ব একটা দূর্বলতা থাকে। সেই দূর্বলতার কারণেই মানুষটা মা’রাও যায়, নিঃস্বও হয়ে যায়। আপনার দূর্বলতা হলো আপনার এই রুপ। যেই রুপের কারণে আপনি এক মেয়ে কে কষ্ট দিতেও দুটো বার ভাবেননি।’
কায়েসাম দ্বিতীয় বার কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করল না। পদ্মিতা নিজেকে চিৎকার দিয়ে চেয়ার থেকে ছোটানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু লাভ নেই। কায়েসাম দরজার নিকট দাঁড়িয়ে দূর থেকেই পদ্মিতার উপর এসিডের ভেতরকার তিক্ত গরম জল ছড়িয়ে দেয়।
পুরো রুম বিবশ চিৎকারে ভরে যায়। কায়েসাম দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। বাড়ির দরজার দিকে আসার পূর্বে পা থেমে যায় কায়েসাম এর। পেছন ফেরে শেহরীনা কে বন্দি করা সেই রুমের দিকে তাকায়। যেখান থেকে কারো কান্নার গুঞ্জন, চিৎকারের শব্দ উত্তাল পাতাল হয়ে বাড়ি কাঁপাচ্ছে।
‘কৃষ্ণকুমারী দেখো তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি দিয়েছি। আমি পারিনি তাকে জানে মা’রতে। তুমিও নারী সেও নারী। কেমনে পারতাম মা’রতে বলো! নারী জাত অমূল্যরতন এই পৃথিবীতে। সে অন্যায়কারী হোক আর না হোক। তবে তাকে ম’রণ যন্ত্রণা দিয়েছি। যেই যন্ত্রণার থেকে সে কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। সে যদি কখনো তোমার সামনে চলেও আসে তুমি ভুলো মনে তাকে অন্ন দেবে তখন এই মহিলাটা বুঝবে কে ছিল সে, কী হলো তার পরিণতি, কেনোই বা তার উদ্দেশ্য সৎ ছিল না। কৃষ্ণ কুমারী তুমি বড্ড ভুলো মনের নারী। তোমার সাথে আমার অভিমান রয়ে যাবে চিরজীবন।’
কায়েসাম এর ভাবনার মাঝে তার ফোন বিকট শব্দে আওয়াজ করে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল। তনুদি তার স্ত্রীর ফোন কল। নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে সালাম জানায়। তনুদি ও সালামের জবাব দিয়ে কান্না করে দেয়। কায়েসাম জেনেও ঢোক গিলে অজানার ভান করে রইল। তবে চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘কী হয়েছে কাঁদছো কেন, ব্যথা পেয়েছো কোথাও, কিছু হয়নি তো তোমার আর শুনলাম শেহরীনা কে পাওয়া গেছে! কেমন আছে সে!’
তনুদি কাঁপা গলায় বলে,
‘আআআমি হাসপাতালেই আছি। ডডক্টরে বলেছে মমমমিসক্যারেজ হয়েছে বাচ্চার।’
কথা বলতেই ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কায়েসাম এর চোখ থেকেও পানি পড়ছে। সে অস্বাভাবিক থেকেও স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করছে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে,
‘আমি আসছি।’

চলবে…..

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৪৯ (ভ্রুণ 😓)

“মা আপনার ছেলের কপাল পোড়া। এতদিন শুনতাম ঘর-সংসারে ছোট থেকে ছোট কোনো দোষ হলেই মেয়েদের খোঁটা দিয়ে বলতো মেয়ের কপাল পোড়া, অলক্ষ্মী, অপুয়া আরো কত কী! এদিক দিয়ে আমার নিজেকে কপাল পোড়া পুরুষ মনে হচ্ছে। আচ্ছা মা বিধাতা কী শুধু আমার সাথেই এমনটা করতে পারেন! আমি তো নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি। আমি তো কাউকে কখনো কষ্ট দিতে চাইনি। আমার পেশাটাই হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের জন্য। এতে আমি নিজের সর্বোচ্চ দিলেও আমার প্রতিটা আবেগ-অনুভূতি জুড়েও একটা মন আছে তো মা। সেই আপনার ছেলের মন নিয়ে খেলা করা হয় কেনো!”

ছেলের কথায় আহাজারি করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন জাহানারা পুষ্প। সারোয়ার কে শান্তনা দেওয়ার মত ভাষা তাদের কারোর মুখে নেই। কোনো ভাবেও ছেলেকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। জাহানারা পুষ্প ছেলেকে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছেন। মোঃ আবু সিদ্দিক মনমরা হয়ে বসে আছেন একই বেঞ্চে। সারোয়ার পুরুষ একজন পুরুষ কাঁদে কখন! আবেগের যন্ত্রণায় নাহয় হারানোর ভয়ে! পুরুষ অতি কষ্টে ও নিজেকে সামলাতে পারে শুনেছি। তবে সারোয়ার কেন নিজেকে সামলাতে পারছে না। হাসপাতালের মধ্যে অপারেশন রুমের সামনে কয়েকজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখের মালিক ছাতক পাখির ন্যায় অপারেশন রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। সারোয়ার চোখজোড়ার পলক কয়েক বার ঝাপ্টে তাকিয়ে থাকছে। তার মুখে ‘রা’ নেই। শেহরীনা কে অপারেশন রুমে নেওয়ার পর থেকে নিশ্চুপ বসে ছিল। তবে ছেলে কে দমে থাকতে দেখে জাহানারা পুষ্প মন হালকা করতেই বলে ছিলেন।
‘বাবা কষ্ট পাস না দেখিস বউমা সুস্থ হয়ে যাবে।’
তখনো সময়টা স্বস্তির ছিল। তবে অপারেশন রুম হতে এক নার্স কে সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির ট্রের মধ্যে ছোট এক ভ্রুণ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে দেখে সারোয়ার এর বুকের মধ্যে তোড়পাড় আরম্ভ হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ট্রে ছিনিয়ে নিয়ে বাতির নিকট ধরে। ছোট এক র’ক্তা’ক্ত ভ্রুণ! কত দিন হবে অথবা কয় দিন! এত ছোট ভ্রণ কখন আসে! সারোয়ার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার কাছে সামান্য ধ্যান ধারণা আছে বাচ্চা, ভ্রণ বিষয়ে! তবে কী সে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে থেকেই শেহরীনা গর্ভ ধারণ করেছিল। স্তদ্ধ হয়ে ট্রে হাতে নিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। ট্রের মধ্যে তাদের আবেগ, অনুভূতি, পবিত্র বন্ধনের সংমিশ্রণে গড়া গোটা এক ছোট এক নিশ্চিহ্ন প্রাণ! সারোয়ার ট্রে ধরে রেখেছে। তা নিয়ে সে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যায়। নার্স কে জিজ্ঞেস করে।
‘আআআআমার বউ কোথায় তার কী অবস্থা এখন! প্লিজ চুপ থাকবেন না বলুন না আপু।’
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের চোখে প্রিয় নারী কে দেখার তীব্র আহাজারি, তাদের ভালোবাসার চিহ্ন কে হারিয়ে ফেলার বেদনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নার্সটি চোখ নামিয়ে বলে,

“দেখুন স্যার আবেগ দিয়ে বুঝলে আপনি পেশেন্ট কে সামলাতে পারবেন না। ডক্টর চিকিৎসার সময়ে দুর্ভাগ্য বশত পেশেন্ট জেগে যায়। তখনি আমার হাতে ট্রের মধ্যে এই র’ক্তা’ক্ত ভ্রুণ দেখে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে যায়। পেশেন্ট কে তাই বিশেষ ভাবে চিকিৎসা পরীক্ষণ নিরীক্ষণ করা হচ্ছে। পেশেন্টের হাতের কনুইয়ের ভেতর কাঠ ভাঙ্গা কাঁচ ঢুকেছে চিকিৎসা করতে সময় লাগবে। প্লিজ আপনারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন এবং দয়া করুন।”

নার্স নিজের মত কথা বলে চলে যায়। তবে ট্রেটি নিতে ভুলেননি। কী হবে এখন এই ছোট ভ্রুণটির সঙ্গে! সারোয়ার এর চোখজোড়া শীতল হয়ে গেছে। চোখের পানি শুকিয়ে আঠালো হয়েছে বোধোদয়। রূপালি বেগম আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। এ কী হলো তার সোনার মোড়ানো সংসারে! তার মেয়েটা পূর্বেও সুখ নামক জিঞ্জিরা দেখেনি। যাও একটু দেখতে নিয়ে ছিল সেটাও তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। জীবনে সুখ নামক জিঞ্জিরা কী শেহরীনা দেখতে পাবে না! নাসমুর নাসমা কে নিয়ে এককোণে বসে আছে। তারা ভয় পেয়েছে না কষ্ট পেয়েছে বোঝা মুশকিল। তারা সবার চোখের পানি দেখে নিজেদের শান্ত্বনা দিচ্ছে। নাসমা তো বার কয়েক শেহরীনা কে নেওয়া অপারেশন রুমের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছে। নাসমুর কোনোভাবে মেয়েটিকে থামিয়ে রেখেছে। সারোয়ার বেঞ্চে বসায় দেওয়ালে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। সাজিয়া অপলক দৃষ্টিতে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ও কষ্ট হচ্ছে ভাবীর এ অসুস্থতায়, এ দূর্ঘটনায়!
ইশ কী দুর্ভাগ্য তার ভাইয়ের! প্রথম বাসর রাতে স্ত্রীর মুখ দেখার মাঝেই হঠাৎ স্ত্রীর মৃত্যু হওয়া। তারপর না জানি কত কটুক্তি শুনতে হয়েছিল তাদের। সাজিয়া ও নানা অপদস্থ হয়েছিল। তার বিয়ের আগে তার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে ছিল। তখন হঠাৎ প্রথম ভাবীর মৃত্যুর কারণে কেউ কেউ বলেছে তার ভাই অনুর্বর অর্থাৎ বন্ধ্যা, কেউ বলেছে কপাল খারাপ, কেউ বলেছে ভাগ্য নেই, কেউ বলেছে নিয়তির দোষ যত রকমের মন্দ শব্দ ছিল তার কোনোটাই নতুন নয় তাদের কাছে। সেই থেকে তার ভাই গুরুগম্ভীর, শান্ত প্রকৃতির হয়ে চলাচল করে। বিয়ের কথা উঠলেও চুপ থাকতো। তবে তার এই ভাবী শেহরীনা কে দেখার পর থেকে তার ভাইয়ের জীবন বদলে গেল। গম্ভীর ছেলেটা আজ হাসে সেই সুফলতার বর্ষণকারীনি কে কেনো বিধাতা কেড়ে নিতে চাইছেন! হঠাৎ কারো স্পর্শে ধ্যান থেকে ফিরে আসল সাজিয়া। চোখ গেল তার পাশে বসে থাকা ব্যক্তির দিকে।‌ ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয় তার স্বামী দেওয়ান। তাকে পরম মায়ায় জড়িয়ে ধরেছে। স্ত্রী কে এক ধ্যানে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই সে জড়িয়ে ধরেছে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)আহারে জীবনটা বড্ডো নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছে! সাজিয়ার মুখ বন্ধ ভাইয়ের কষ্টের ভাগীদার হওয়া ছাড়া তার মুখে ভাষা নেই।

“আপনারা আসুন কিছু খেয়ে নিন। এভাবে থাকলে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনাদের উপরই এখন ভরসা হয়ে থাকবে শেহরীনা।”

কোমল গলায় পুরুষেলী কণ্ঠস্বর শুনে সবার নজর পড়ে পেছনের দিকে। কায়েসাম এসেছে। তনুদি তাকে গিয়ে জড়ায় ধরে কেঁদে উঠল। কায়েসাম নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তনুদির দিকে তাকিয়ে তার চোখের পানি নিজ হাতে মুছে দিয়ে বলে,
‘উহুম কেঁদো না। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখানে এসেছিলে কেনো! এসেছিলে যেনো তাদের মনোবল শক্ত হোক। আর সেই তুমি তাদের কে কাঁদিয়ে রেখেছো। এমন চললে কিন্তু তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি রেখে আসব।’
কথাটা শুনে এক নিমিত্তে নিশ্চুপ, স্বাভাবিক হয়ে গেল তনুদি। বোরকার হিজাব দিয়ে চোখমুখ মুছে বলে,
‘আআআমি ককককাঁদছি না।’
সবার মুখের মধ্যে মৃদু হাসি ফুটলেও সারোয়ার এর কর্ণপাত হয়নি কোনো শব্দমালা। বরঞ্চ তার চোখের দৃষ্টিকোণ সর্বদা অপারেশন রুমের দরজার উপর থাকা বাতির উপর। যেটায় লাল হয়ে জ্বলছে এক নাগাড়ে। এতটা সময় পার কেনো হচ্ছে! তার বউ কী তার বুকে ফিরে আসবে না! তার বউ কে কী সে জড়িয়ে ধরে বলতে পারবে না সে যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
কায়েসাম এর নজর এড়ালো না। মৃদু হাসল সে। বুকের কোথাও এখনো সেই জ্বলন তার রয়ে গেছে। কিন্তু এই জ্বলনে নেই কোনো হিংস্রতা, নেই কোনো বিদ্বেষ-আক্রোশতা। আছে সম্মান-শ্রদ্ধা-ভুক্তি। থাকবেও না কেনো! মানুষটা তো তার প্রিয় নারীর লিখিত সংবিধান। তার প্রিয় নারীর প্রিয় পুরুষ। আর সে এক তরফা অপ্রিয় পুরুষ। ‘সে অপ্রিয় পুরুষ!’ কথাটা সবসময় কায়েসাম এর বুকে বিঁধে।
‘ইশ আমি কেনো তোমার প্রিয় পুরুষ হতে পারলাম না কৃষ্ণ কুমারী। এই আক্ষেপের কী কভু কোনো সমাপ্তি আছে আদৌ!’
নাহ জানা নেই তার। আসলে সে বিধাতার লিখনে মন বসিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। হয়ত কখনো মানবে নয়ত বুকে রেখেই পার করে দেবে। কায়েসাম নজর ফিরিয়ে শেহরীনার বাবা নাছির উদ্দিন কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আঙ্কেল প্লিজ আন্টি কে বলুন, সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনারা সেই কখন থেকে এখানে আছেন। ৫ ঘন্টার ধরে পেটে দানাপানি দেননি। এখন চলুন আমি, তনুদি, ফারদিন, ইপশিতা, রোকসানা আর জাফরান আছি। সারোয়ার কে ফারদিন খাইয়ে দেবে। আপনারা বয়স্ক আপনাদের সময়ের মূল্য দিয়ে চলতে হবে। এখন যদি আপনারাও অসুস্থ হোন। তাহলে শেহরীনার মনে যে ধাক্কাটা লেগেছে সেটা সে সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না।”

কায়েসাম এর কথায় সকলের টনক নড়ে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তারা আসলেই বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি। দুশ্চিন্তায় এক জায়গায় বসে থেকে খাবারের কথাও ভুলে গিয়েছে তারা। কী করবে ঘরের মেয়ের মারাত্মক দশায় কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারে না! কায়েসাম তনুদির‌ দিকে তাকায়। মেয়েটা কেঁদে কেটে চেহারার নাজেহাল অবস্থা বানিয়ে ফেলেছে। মেয়েটার হিজাবও ঘেমে চুলগুচ্ছ দৃশ্যমান। কায়েসাম এগিয়ে তনুদির হাত ধরে করিডোরের মধ্যে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে আবেগের গলায় বলে উঠে,

“তুমি আমার না চাওয়া এক উপসংহার। যেখানে তুমি প্রথম না হলেও শেষটায় তুমি আছো। প্রথমটা জুড়ে যার বসবাস সে আমার অমূল্য রত্ন। তার জায়গাটা খুব স্পেশাল। তুমি তার মান রাখতে কখনো দ্বিধাবোধ করোনি। এর জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ তনু। তবে তাই বলে তোমার কদর আমার জীবনে কম তাও না। তুমি হলে আমার সম আকাশের এক উজ্জ্বল তারা। যার প্রতি আমার ভালোবাসার চেয়েও বেশি কিছু হৃদয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। সেটা কী জানো! মায়া বউয়ের প্রতি আমার মায়ার বন্ধন। যেখানে ভালোবাসার অন্যরকম জোঁক দেখা যায়। তাই বলছি উপসংহারে নিজেকে টিকিয়ে রাখো। সহায়তার হাত সর্বদা আমি বাড়িয়ে রাখব।”

তনুদির যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না কায়েসাম এ কথাগুলো বলছে! বিয়ের দুয়েক মাস পেরুলেও ছেলেটা তার সাথে বন্ধুত্বসুলভ কথা বলেছে। যেনো তারা স্বামী-স্ত্রী হলেও বন্ধু ছাড়া কোনো কিছুই নয়। কত রাত ছটফট করেছে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর আক্ষেপে পাছে যদি ছেলেটার মাথায় আছে সে জোরপূর্বক স্ত্রীর অধিকার চাইছে! সেই ভীতির কারণে একই ছাদের নিচে, একই রুমে, একই বিছানায় থেকেও তাদের মাঝে দূরত্ব ছিল যোজন যোজন। এ দূরত্বের থেকে রেহাই পেতে কতই না আল্লাহর কাছে হাত পেতে কেঁদেছে সে তার সঠিক আন্দাজ জানা নেই তনুদির। আজকের দিন কী তবে তার জন্য শুভ হলো! না মনে হয় ছেলেটা কষ্ট লুকাতে তাকে আপন করছে। নিজের ভাবনায় বিরক্ত হলো তনুদি। অন্যত্রে সে অসম্ভব খুশি অনুভব করছে। হতে পারে শেহরীনার দুর্বিষহ অবস্থা তার হাসিমাখা মুখ হিংস্রতা প্রকাশ করবে। কিন্তু তা মোটেও নয়। তনুদি কায়েসাম এর ভালোবাসা কে সম্মান করে। ফলে আজ শেহরীনার দুর্বিষহ সময়ে পাশে থেকে শান্ত্বনার বাণী ছড়িয়ে দিচ্ছে। তনুদির বিস্মিত নজরে কায়েসাম এর দিকে তাকিয়ে রইল। কায়েসায় একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। বোধোদয় স্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক জবাবের আশা করছে। তনুদি ইতস্তত বোধ করতে লাগল। স্বামীর হাতের মুঠোয় হাত রাখা আছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে না ফিল্মের নায়িকার মত হাত ছাড়িয়ে নিতে। কায়েসাম এর দৃষ্টিকোণ দেখে তনুদির চোখের পলক ঝাপ্টে মুচকি হাসল। কায়েসাম তনুদির এ হাসির অর্থ চেনে, জানে এবং বোঝেও। তার অস্বীকৃতি নেই। চোখের ইশারায় সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়ার আহ্বান করল কায়েসাম। তনুদি দ্বিরুক্ত করেনি। মাথা ঝাঁকিয়ে সবাই কে ধীরস্থির হয়ে পাঠানোর জন্য গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। ফারদিন ঘেমে গিয়েছে পুরো। ইপশিতা তার কাছে গিয়ে কপাল মুছে দিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দেয়। ফারদিন এতক্ষণ যাবত মদিনা হোটেলের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ হলো হোটেলটা হাসপাতালের নিচেই আছে। এলাকায় হাসপাতালটা আছে দেখে নানান মানুষের আনাগোনা চলে। হোটেলের খাবার মজা বলে অনেকে এখানে ভীড় জমিয়ে থাকে। ফারদিন সবার কথা ভেবেই অনেক গুলো সাদা ভাত, কয়েক পিচ মুরগির মাংস, বড় কয়েক পিচ চিংড়ি মাছ, ডাল আর পুঁই শাক নিয়েছে‌। হাতে বড়সরো প্যাকেট। পরিবারের জন্য তনুদির হাতে প্যাকেট ধরিয়ে ভেতরে এসেছে। ইপশিতা একটা রুমে সব সাজিয়ে ফারদিনের নিকট যায়। সে মাত্রই ফ্রেশ হয়ে বসেছে। তার নজর ইপশিতার উপর পড়ে। সে তার নিকট ঝুকে বলে,
‘সারোয়ার ভাই কে ধরে খেতে আনো। সব বেড়ে দিয়েছি।’
ইপশিতার কথায় জোরালো এক দম ছেড়ে সারোয়ার এর দিকে তাকায় ফারদিন। ছেলেটার বিধ্বস্ত রূপ কারোই সহ‌্য হচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে ইপশিতার সঙ্গে জাফরানদের যেতে ইশারা করল। ফারদিন উঠে এগিয়ে যায় সারোয়ার এর কাছে। সারোয়ার একদৃষ্টিতে অপারেশন রুমের সাদা থাই গ্লাস থেকে আহত শেহরীনার বন্ধরত চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সারোয়ার এর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ছেলেটা এক দিনেই কাতরে, ম’রার মত অবস্থা।
‘চল ভাই খাবার খাবি।’
সারোয়ার এর দৃষ্টিকোণ ফিরল না থাই গ্লাসের হতে। ফারদিন তার কাঁধে হাত রাখলে সারোয়ার সন্তপর্ণে সেই হাত ছড়িয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলে,
‘তুই যা খেয়ে নেহ। আমি আসছি কিছুক্ষণ পর।’
ফারদিন কপালে আঙ্গুল চালিয়ে বলে,

“আমাকে কী তোর বোকা মনে হয় ভাই! তুই যে আসবি না এজন্য সহজ‌ স্বীকারোক্তি দিয়েছিস। আমি কিছু শুনব না চল মানে চল।”

সারোয়ার কে ঠেলে আনতে চাইলে সে রেগে গেল। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ফারদিন কে। সারোয়ার কে হিংস্র বিধংসী লাগছে।

“কথা কী তোর কানে যায় না! আমি আমার বউ কে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোদের খাবার গিলতে ইচ্ছে করলে গিল গিয়ে। আআআআমি কোথাও যাব না। আআআমি গেলেই মেয়েটা অভিমান করে দূরে চলে যাবে। না না আমি আর দূরে যেতে দেবো না ওকে। আমি একবার দূরে গেছি বলেই এতটা কষ্ট দিচ্ছে। আমি কাছে থাকলে নিশ্চয়ই সে আমার বুকে ফিরে আসবে। প্লিজ ভাই তুই যাহ্!”

ফারদিন ‘ভাই থাম ভাই কথা শোন’ বলতে বলতে সারোয়ার কে জড়ায় নিতে গেলে জোরালো এক ধাক্কা দিয়ে দেয় সে। সারোয়ার নিজের শক্তি প্রয়োগ করেছে তাও কার উপর! তার পূর্ব পরিচিত কাজিনের উপর, তার আপন কাজিন ভাইয়ের উপর। ফারদিন সারোয়ার কে দেখে হতভম্ব। তার আচরণে অপরিপক্কতা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। কায়েসাম সহ জাফরান-রা খাওয়ার রুমে অপেক্ষায় ছিল সারোয়ার এর আগমনের জন্য। কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে কায়েসাম উঠে দাঁড়ায়। তাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তোমরা খাও আমি আসছি। তারা কৈ দেখে সাথে করে নিয়ে আসছি।’
ইপশিতা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। কায়েসাম এসে দেখে হতবাক। ফারদিন কে দেওয়াল ঘেঁষে চেপে ধরে রেখেছে সারোয়ার। তৎক্ষণাৎ কায়েসাম গিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। সারোয়ার চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেয়। তার এক কথা ‘সে তার সোহাগপ্রিয়া কে দেখতে চাই।’ কায়েসাম এর মুখ থেকে শেহরীনার জন্যে নতুন এক শব্দ বের হওয়ায় তার কাছে শুনতে একদিকে তিক্ততার মত লাগলেও অপর দিকে মন্দ লাগছে না। সারোয়ার নিজেকে ছাড়িয়ে তাদের কে বলে,
‘প্লিজ তোরা চলে যাহ্। আমি কোথাও যাবো না প্লিজ প্লিজ!’
কায়েসাম অতি যত্নে সারোয়ার এর কাঁধে হাত রেখে বলে,

“ভাই বিচলিত সবাই হয়ে আছে। আপনি যদি নিজের প্রতি সর্তক না হোন তবে শেহরীনা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। এক নারীর কাছে তার প্রিয় হৃদয় জোড়া লাগানোর এক হাতিয়ার হলো তার স্বামী তার একান্ত পুরুষ। আপনি খুব ভাগ্যবান পুরুষ মাশাআল্লাহ। যে শেহরীনার স্বামী হয়েছেন নাহলে কেউ কেউ গোমড়ে যে মা’রা যাচ্ছে তার খবরও মেয়েটার কাছে নেই।”

দুঃখ মিশ্রিত কথায় আকস্মিক চমকানো দৃষ্টিতে সারোয়ার কায়েসাম এর দিকে তাকায়। কথাটির অর্থ কী! কায়েসাম বুঝল সে আবেগের বশে ঈর্ষান্বিত কথা বলে ফেলেছে। ঢোক গিলে কথা ঘুরিয়ে বলে,

“দেখেছেন ঠিক এভাবে আপনার থেকে শেহরীনা কে সামলে রাখতে হবে। নাহয় মেয়েটা তার অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে পারবে না। আর রইল আমার তরফা থেকে। আমায় ক্ষমা করে দেবেন।”

সারোয়ার নির্বিকার হয়ে গেল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে খাওয়ার রুমে যায়। ইপশিতা চটজলদি সারোয়ার এর পাতে ভাত বেড়ে সাজিয়ে দিয়ে এগিয়ে দিলো। সারোয়ার এক-দুয়েক লোকমা খাচ্ছে পরক্ষণে বাহিরের দিকে তাকাচ্ছে কারণ খাওয়ার রুমের থেকে বের হওয়ার পরপর ডানে মোড়লে অপারেশন রুম পড়ে। ভাতের মাড় যেনো তার গলায় কাঁটার মত বিঁধছে। খুব কষ্টে ভাত, তরকারি খাচ্ছে। যার ভেতরে দুশ্চিন্তা থাকে তার কাছে কী খাবারটা আদৌ খাবার বলে গণ্য হবে! সারোয়ার খাওয়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। হাঁসফাঁস করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তখনি তার সামনে থাকা কায়েসাম এর উপর চোখের দৃষ্টিকোণ আটকায়। কায়েসাম তনুদি কে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছে। সারোয়ার এর বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে। ইশ! আজ শেহরীনা তার সঙ্গে থাকলে সেও ঠিক পরম আবেশে ভাত খাইয়ে দিতো! স্বপ্ন হয়ে রইল তা। সেই সাথে অপেক্ষার প্রহর যেনো ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

চলবে…..

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৫০ (একমুঠো অশ্রু বর্ষণ💔)

“মা তুমি এ কয়েকদিন অদ্ভুত ব্যবহার কেনো করছো‌ বলো তো! গতকাল কে হাসপাতাল থেকে অসুস্থ হয়েছো বলে তনুদি কে সাথে নিয়ে ফিরে আসতে বললে। কিন্তু এসে দেখলাম তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ। জিজ্ঞেস করায় বললে আমাদের কথা‌ মনে পড়ছিল। তাও মেনে নিয়েছি। কিন্তু আজ তো এশারের পর দুজনে হাসপাতালে গিয়েছি। তাহলে হঠাৎ জরুরি ভিত্তিতে কল দিয়ে ডাকলে, বাড়িতে এসে দেখি তুমি অপেক্ষা করছিলে তাও আবার আমায় রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য। যেখানে আমি আগেই বলে রেখেছিলাম আমি আর তনুদি বাহিরে খেয়ে নেবো। কী হয়েছে মা! কিছু কী বলতে চাও! যদি বলতে চাও বলো। তোমার জন্য আমি সবসময় ফ্রি।”

কায়েসাম কোমল গলায় মাকে বুঝিয়ে ফিচেল হাসল। কথায় কথায় ওয়াশরুমে গিয়ে ঘামাক্ত শার্ট পাল্টে বের হলো। বিছানায় ঘাপটি মে’রে বসে আছেন কায়েসাম এর মা রুফিয়া সাইমুম। ছেলের কথা আদৌ তিনি আয়ত্তে নিলেন কি-না সন্দেহ! তার স্বামী ইদবির সাবেক নিজের বেডরুমে শুয়ে আছেন। মূলত স্বামীর সাথে শলা পরামর্শ করেই তিনি আজ ঘাঁট বেঁধে ছেলের প্রতি মেকি রাগ নিয়ে রুমে এসে বসে আছেন। কায়েসাম মায়ের নিশ্চুপতা দেখে অবাক হলো। তার মা হলো তোতাপাখির মতো। তোতাপাখির যেমন কথা না বলে থাকতে পারে না ঠিক তার মাও কথা না বলে থাকতে পারে না। চব্বিশ ঘণ্টায় যদি বারো ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটান তবে বাকি বারো ঘণ্টা গল্পগুজবে কাটিয়ে দেন। হয় তনুদির সঙ্গে নাহয় শ্বশুর বাড়ি অথবা বাপের বাড়ির সঙ্গে। অবশ্য এতে কায়েসাম খুশি। কারণ তার মা হলো আপন মানুষ। বান্ধবীর মত আচরণ করেন বলেই কায়েসাম তার হৃদয়ের সব কথা মায়ের সাথে ভাগাভাগি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুধু অসহায় এক তরফা প্রেমের কথাটাই ভাগ করতে পারেনি। তবে মায়ের মন বলে কথা। তিনি ছেলের গতিবিধি লক্ষ্য করে অনুসন্ধান করে বেরও করে নিয়ে ছিলেন। ‘শেহরীনার কাছ থেকে দুঃখজনক ভাবে রিজেকশন পাওয়া’ ব্যাপারটা বোধোদয় ভার্সিটির কারো থেকে তার অগোচরে জানতে পেরেছিলেন তার মা। তপ্ত শ্বাস ফেলল কায়েসাম। পরিপাটি হয়ে মায়ের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল মাটিতে। রুফিয়া সাইমুম ঠোঁট ফুলালেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
কায়েসাম মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে।
‘আমার প্রিয় মায়ের মুখ কালো হয়ে আছে কেনো হুম!’
‘কেনো আর ছেলে যখন নিজেই সব বুঝতে শিখে যায় তখন তার থেকে কী আর মায়ের দরকার পড়ে!’
‘মানে কী মা তুমি জানো আমি তোমার সব কথা শুনি। তাও বলছো আমি সব তোমাকে না বলেই করি।’
‘তা নয়তো কী হুম! ছেলে বেশি বড় হয়ে গেছিস। মায়ের কাছ থেকে অনুমতিহীন নিজেই নিজের মত চলাফেরা করিস। ঘরের মধ্যে তোর বউ থাকে তা ভুলে কেনো যাস বাবা!’
হঠাৎ রেগে গেলেও শেষে নম্র গলায় জিজ্ঞেস করেন রুফিয়া সাইমুম। কায়েসাম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
‘সে কী তোমার বউমা তো হাসপাতালে! আমাকে তো তুমিই ডেকে এনেছো।’
‘ধুর বোকা বাবা। তোদের বিয়ের তিনমাস পূর্ণ হবে কালকে। কালকের তারিখ ও ভুলে গেছিস দেখছি।’
কথাটা শুনে কায়েসাম এর অনীহা লাগলেও প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘তুমি কী চাইছো মা সরাসরি বলেই দাও। ভনিতা করে আমায় দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
কায়েসাম মায়ের দিক থেকে উঠে ওভারড্রপে থাকা তার ভার্সিটির ফাইল হাতে নিয়ে ঘাঁটতে বসে গেল সোফায়। রুফিয়া সাইমুম ছেলের কথায় আশকারা পেয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ ছেলের পাশে গিয়ে বসে আমতা আমতা করে বলেন,

“আআসলে বাবা আমাদের তো বয়স বাড়ছে। বুঝিসই তো তুই আমাদের এক মাত্র সন্তান। তনুদিও অনেক আদরের মেয়ে আর‌ বউমা আমাদের। বলছিলাম কী তোর বাবা চাইছে তুই তনুদি কে নিয়ে কোথাও ঘুরে আয়! দুজনের সম্পর্কের উন্নতিও হবে সাথে আমরা দাদা-দাদী হওয়ার আশা রাখতে পারব। এখানে থাকলে তোরা আলাদা থাকবি। যে যার মত ভার্সিটি, চাকরি করেই তোদের সময় নষ্ট করতে থাকবি। তো আমি আর তোর বাবা চাই কাল বা পরশুর মধ্যে টিকেট বুকিং দিতে। তো বাবা তোর পছন্দের জায়গা কোথায়-রে! টিকেট কোন দেশের বুকিং দিলে খুশি হবে!”

মায়ের আমতার কারণ, তোতলে কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে কায়েসাম। হাতের ফাইলটি বন্ধ করে টি-টেবিলের উপর রেখে সন্তপর্ণে মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মা সত্যি করে বলবে এই আইডিয়াটা কে দিয়েছে তোমাকে!’
থমকে যান রুফিয়া সাইমুম। ঢোক গিলে নজর সরিয়ে ফেলেন তৎক্ষণাৎ। কায়েসাম মায়ের দৃষ্টি লুকানো বুঝতে পেরেছে তবুও প্রশ্নটা পুনরায় করে। রুফিয়া সাইমুম চোখ পিটপিট করে স্বাভাবিক থাকার প্রয়াসে বলেন,
‘আআরে কী বলিস বাবা! আমি কোনো আইডিয়া পাচ্ছিলাম না তারা না বললে…।’
‘তারা’ শব্দটা মুখ ফসকে চলে এসেছে রুফিয়া সাইমুম এর। তিনি ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে যান। কায়েসাম মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মা আমার অগোচরে কেউ এসেছিল বাড়িতে!’
রুফিয়া সাইমুম মাথা নেড়ে ঋণাত্মক ইঙ্গিত দেন। কায়েসাম শান্ত গলায় আবারো জিজ্ঞেস করে।
‘কে আর কারা এসেছিল, কিসের জন্য আসছিল তারা!’
রুফিয়া সাইমুম দীর্ঘ এক শ্বাস ছেড়ে ধপ করে ছেলের পাশে বসে যান। হাসিমাখা মুখটায় গম্ভীরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এবার যেনো তার কণ্ঠস্বর খুব তিক্ষ্ম। সেই তিক্ষ্ম গলায় জিজ্ঞেস করেন।
‘তোর আর তনুদির কী কাজ হাসপাতালে!’
কথাটা শুনে কায়েসাম স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো।

“কী আবার শুনোনি শেহরীনা কে পাওয়া গেছে! তার চিকিৎসা চলছে। আমি আর তনুদি হাসপাতালে তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছি। হাতের মধ্যে নাকি সেলাই দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। তবে এখনো অজ্ঞান। চিন্তায় বিভোর ছিলাম দুজনে। তখনিই তুমি আমায় ফোন করে জরুরি কথা বলার জন্য ডেকে আনলে।”

রুফিয়া সাইমুম যেনো ‘শেহরীনা’ নামক আপদের নাম শুনতে মোটেও রাজি নন। তিনি রেগেমেগে বলেন,

“তুই নিজেকে বড় লায়েক ভাবিস হুম! তোকে আমি ইশারা ইঙ্গিত করে কী বোঝাতে চাইছি বুঝিস না। বাবা-রে ঐ শ’য়’তান মেয়েটার কারণেই তোর জীবনটা ধ্বংস হতে যাচ্ছিল। সেই আবার তুই তার জন্য উতাল পাতাল হয়ে ছুটে যাচ্ছিস। ভুলে যাস না তোর বউ নামক এক নারী আছে তোর জীবনে। আর ঐ মেয়ের ও স্বামী নামক এক পুরুষ তার জীবনে আছে। তাহলে তুই কোন অধিকারের জোড়ে মেয়েটার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করিস। দেখ বাবা এখন তোর সব ফোকাস থাকতে হবে তনুদির উপর।”

কায়েসাম হতভম্ব তার মা এসব কী বলছে সে বুঝতে পারছে না! সে শেহরীনার জন্য ছুটছে তার মানে তো এই নয় সে তনুদি কে অবহেলা করছে। শেহরীনা কে আপন করে না পেলেও তার ভালোবাসার উপর সন্দেহের বীজ নেই। বরং তার ভালোবাসার এক তরফা হিসেবে নিখুঁত।
রুফিয়া সাইমুম ছেলের আশ্চর্য চেহারা দেখে পাত্তা দিলেন না। বরং সেই গম্ভীর চেহারা নিয়ে বলেন,

“আমি চাইছি তুই আর তনুদি কালকেই আমেরিকায় চলে যাহ্। দুজন একে অপরের সাথে সময় কাটিয়ে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারবি। তখন যেয়ে আমি আর তোর বাবা নাতনী-নাতনির মুখ দেখতে পারব। তোর এহেন কান্ডে কখনো তনুদি তোর পাশে ঘেঁষবে না। আরে শোকর কর মেয়েটার যে তোকে সন্ন্যাসী হওয়া থেকে রক্ষা করেছে সে। আর তুই আছিস আদৌ ঐ শেহরীনা মেয়েটা কে নিয়ে। আল্লাহ জানেন কার না কার পাপের ফসল! তাও আবার আমার ছেলেকেই পিছে ঘুরাতে থাকে। এমন মেয়ের তো মরে যাওয়া উচিৎ!”

‘মাআআআআ!!’
কায়েসাম এই প্রথম নিজের মায়ের উপর চেঁচিয়ে উঠল! রুফিয়া সাইমুম চমকে গেলেন। ছেলের চোখজোড়া রাগে লাল বর্ণ হয়ে গেছে। কায়েসাম কপালে হাত চেপে পায়চারী করতে লাগল। হৃদয়ের মধ্যে শেহরীনার আহত হওয়ার দৃশ্যপট ভেসে উঠেছে, তার কৃষ্ণকুমারীর অসুস্থতা তাকে পুনরায় পীড়াদায়ক করে তুলছে। পীড়ার‌ পিঞ্জিরায় বদ্ধ হয়ে গেল সে। ছেলেকে অস্বাভাবিক পায়চারী করতে দেখে রুফিয়া সাইমুম ছেলের কাঁধে হাত রাখতে গেলেন। কিন্তু কায়েসাম বুঝতে পেরেই তৎক্ষণাৎ দূরে সরে গেল। চোখ বুঁজে হাত উঁচিয়ে মা কে থামিয়ে দিলো সে। রুফিয়া সাইমুম কষ্ট পেলেন ছেলের কাজে। তিনিও রাগের বশবর্তী হয়ে ছেলের প্রথম ভালোবাসা কে গা’লি দিয়েছেন। আফসোস আর অনুতপ্ততার স্বরে কিছু বলতে নিলেও কায়েসাম অশোনা করে তৎক্ষণাৎ রুম ত্যাগ করল। ছেলের পিছু পিছু তিনিও বের হোন। পিছু ডেকে ডেকে দরজার সামনে এসে জোর গলায় ‘বাবাই’ বলে ডাকেন তিনি। কায়েসাম এর পা থেমে যায়। তার চোখজোড়া থেকে পানি পড়ছে। কী অদ্ভুত প্রকৃতির নিয়ম! তার অন্তর ভেদ করে চোখের পানির সঙ্গে পাল্লা করে ঝুমঝুম করে আরম্ভ হলো বৃষ্টিপাত। চোখের পানি, শরীরের কাপড় ভিজে লেপ্টে যেতে লাগল। মায়ের ডাকে পেছন ফেরে তাকায় সে। রুফিয়া সাইমুম দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে অনুশোচনায় বলেন,

“বাবাই রাগ করিস না মা ভুলে বলে ফেলছে। ভেতরে চলে আয় বাবাই। তোর বৃষ্টির পানিতে এলার্জি আছে। বেশিক্ষণ ভিজলে তুই অসুস্থ হয়ে যাবি।”

কায়েসাম হাসল। এই হাসিতে কী ছিল তা বুঝতে পারেননি রুফিয়া সাইমুম। তিনি আশ্চর্য, বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। ছেলের হাসিটা এত কোমল মায়াবী কেনো লাগছে!
কায়েসাম ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি টেনে বলেন,
‘মা আমার প্রেম ভুল নয়, সে পা’পী না। সে হলো পবিত্র তার অন্তরের মধ্যে মুক্তো দানায় ভরপুর। তুমি তাকে দেখোনি, পরখ করোনি তাই বুঝোনি সে কেমন! কোনো একদিন তাকে সামনে পেলে দেখবে।আমি আমার মুখের জবানবন্দি করে বলছি, তুমি নিজে তাকে পাশে বসিয়ে গল্পের উপর গল্প করবে। মেয়েটা নির্ভুল এক পবিত্র সত্তা। তাকে অপ’মা’ন করা মানে আমার নিজেকে অপ’মানিত বোধ করানো। আমায় আজ ভিজতে দাও মা। তুমি ভেতরে চলে যাও আমি আসছি।”

রুফিয়া সাইমুম উঁচু গলায় ছেলের বাবা কে ডাক দেন। বিছানায় শোয়া থাকায় ইদবির সাবেক এর চোখ ঘুমে ঢলে পড়েছিল। হঠাৎ স্ত্রীর আর্তনাদময় ডাকে ধড়ফড়ে উঠেন। তৎক্ষণাৎ খালি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। ছেলের মা কে দরজার পাশে অসহায় হয়ে কাঁদতে দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে ছুটে এসে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

“কী হয়েছে কাঁদছো কেনো! আর এভাবে বৃষ্টির সামনে বসে আছো কেনো! তোমার থেকে বৃষ্টিতে এলার্জি জানো না। আর তোমার গুণধর পুত্র কোথায়! সেও তার মায়ের সাথে ফাজলামি করছে তাই না।”

“শুনেন এখন কথা বলার সময় নেই। জলদি গাড়ি নিয়ে যান। ছেলে আমার রাগে বেরিয়ে গেছে। তাকে নিয়ে আসুন। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ছেলে খালি পায়ে ছাতা বিহীন বাহিরে চলে গেছে।”

ইদবির সাবেক এর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তিনি তড়িঘড়ি স্ত্রী কে সোফায় বসিয়ে দিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে ছুটে যান। রুফিয়া সাইমুম কপালে হাত চেপে কাঁদতে লাগলেন।

____
দীর্ঘ এক রাত, এক দিন পার হওয়ার পর চোখ খুলেছে শেহরীনা। চোখের নিচে কালি জমেছে, মুখের মধ্যে মলিনতার ছাপ ফুটে উঠেছে। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে শেহরীনার দিকে। নিভু নিভু চোখে হাত নাড়তে চাইলেই যন্ত্রণায় থেমে গেল সে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল। বড়সরো সাদা প্লাস্টার করা হয়েছে। ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের মধ্যে জোড় পেল। আচমকা তার মনে আবছায়া দৃশ্য ভেসে উঠল। চিকিৎসার সময় এক ট্রের মধ্যে থাকা র’ক্তা’ক্ত ছোট অংশ! কার ছিল সেটা তার! শেহরীনা অস্থির হয়ে উঠল। অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

“আআমি কল্পনা করছি হ্যাঁ হ্যাঁ আমি দেখেছি ছোট একটা বাচ্চা কাঁদছিল। আমাকে মা মা করে ডাকছিল। শুনেন না আমার কী হয়েছিল! আমার পেটে ব্যথা কেনো করছে! বলুন না কী হয়েছে আমার সাথে। আমি কী মা হবো বলুন না চুপ থাকবেন না প্লিজ প্লিজ!”

শেহরীনার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। রুমটা তার কান্নার আহাজারিতে ভারি হয়ে গেল। সারোয়ার তাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। তবুও শান্ত হচ্ছে না সে। মেয়ের করুন আর্তনাদ শুনে রূপালি বেগম আঁচলে মুখ চেপে ফুপাচ্ছেন। তার মেয়ের প্রথম অংশ, প্রথম সন্তান ছিল সেই ছোট ভ্রুণ! ইশ তার স্বার্থপর, জালিম, নিকৃষ্ট পিতা নামক শয়তানের পরজীবন নরক হোক। আল্লাহ যেনো তার কখনো ভালো না করেন। শোয়াইব মিলদাজ এর প্রতি তীব্র নিন্দা জানান মনে মনে তিনি। নাছির উদ্দিন মেয়ের পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“মা-রে আর কাঁদিস না। তোর গর্ভ থেকে বের হওয়া সেই ছোট শিশুর মাগফেরাতের জন্য ব্যবস্থা করব আমরা। তুই কাঁদলে তোর সন্তান ও উপরওয়ালার কাছে অভিযোগ করবে। কেনো তার মা এত কাঁদছে বলে! তুই আর কাঁদিস না মা!”

শেহরীনার চিৎকার থেমে যায়। তবে চোখ দুটোর থেকে বেহায়ার মত পানি পড়তে থাকে। সারোয়ার এর গালে মাথা ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে যায়। তবে সারোয়ার নিজেও যে ঠিক আছে তেমনটা নয়। মেয়েটার মুখখানা গালে জড়িয়ে রেখেই শান্ত করার চেষ্টা করল। সে নিজেও ভেঙ্গে পড়ছে তবুও প্রকাশ করছে না। এমুহুর্তে মেয়েটা অতিরিক্ত কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবে। বিধেয় সে শেহরীনা কে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। মুখ-হাত মুছে দিয়ে বিছানার উপর শুয়ে দিলো। মেয়েটার চেহারার মাধুর্য যেনো এক নিমিত্তে হারিয়ে গেল। শেহরীনার কপালে চুম্বন দিয়ে বলে,
‘তুমি বসো আমি খাবার নিয়ে আসি।’
সবার সামনে থেকে চলে যেতে নিলে শেহরীনা শক্ত হাতে চেপে ধরল সারোয়ার এর। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে সে। জাহানারা পুষ্প নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রন্দনরত মুখখানা লুকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলেন,
‘বাবা তুই বউমার সাথে বস। আমি নিয়ে আসছি খাবার।’
মায়ের কথায় দ্বিরুক্তি করল না সারোয়ার। সে নিজেকে ধাতস্থ করে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করল। দূর্বল হবে না কোনোমতেও। তার দূর্বলতাই হলো শেহরীনার কান্নার কারণ! তাই মনে মনে পণ করে নিলো সর্ব পর্যায়ে শক্ত প্রকৃতির বেশভূষায় কথা বলবে সে। যাতে করে শেহরীনা অতীত সারিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। হঠাৎ কাঁধের উপর কারো ভারি স্পর্শ পেয়ে সারোয়ার মুখ ফিরিয়ে দেখল। শেহরীনা বালিশে নয় তার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঁজে আছে। সারোয়ার চোখের ইশারায় সবাই কে যেতে ইঙ্গিত করে। তার অনুকরণে সবাই রুম ত্যাগ করল। সারোয়ার আলতো হাতে আদুরীয় ভাবে উষ্ণতা নিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। শেহরীনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“জানেন আমি না এই তিনদিন খুব খুব মিস করেছি আপনাকে। আপনি যখন ছিলেন না। তখন আমার কাছে নিজেকে ফিকে এক শূন্য মানবী মনে হতো। আপনি ফেলে রেখে গেলেন কেনো! আমার চেয়েও কী আপনার কাজের মূল্য বেশি হুম!”

সারোয়ার চমকে গেল। তৎক্ষণাৎ শেহরীনার চুলের ভাঁজে হাত গুজিয়ে তাকে শক্ত হাতে টান দিয়ে কোলের উপর শুয়ে দিলো। মানুষটার আক্রমণে বিচলিত অথবা ঘাবড়ে যায়নি শেহরীনা। বরং সে জানত মানুষটা তার উপর অধিকার খাটাবে।

“হুস একটা কথাও বলবে না। আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না কৃষ্ণ বউ। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি এসে থেকে তোমাকে শহরের অলিগলি খুঁজে বেড়িয়েছি। তোমার শূন্যতা আমায় ছন্নছাড়া করে দিয়েছে দেখো আমার চোখমুখের কী এক নাজেহাল অবস্থা!”

স্বামীর আবেগীয় কথায় শেহরীনা চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। সত্য মানুষটার চেহারা বিবর্ণ হয়ে আছে, দাঁড়িও বেড়েছে অল্পস্বল্প, চোখজোড়া ফোলা! কিন্তু কেনো মানুষটা কী তার জন্যে কেঁদেছে! শেহরীনা ঘোরের মধ্যে ডুবে থেকেই স্বেচ্ছায় স্বামীর গাল স্পর্শ করল। সারোয়ার আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে একফুটো চক্ষু পানি শেহরীনার কপালের উপর পড়ল। তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। মানুষটা এত কেন ভালোবাসে তাকে! কী আছে তার এই কালো চেহারায়! মৃদু গলায় বলে,

“কেনো এত চান আমাকে! এই কালো শরীর, কালো চেহারা নিয়েই তো দুনিয়ার মানুষের কত তিরস্কার আর আপনি কি-না…।”

জোরেসরে গাল স্পর্শ করল সারোয়ার। চোখে জ্বলন্ত রাগ, কপালের মধ্যে রাগের বহিঃপ্রকাশে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ও পড়েছে। মানুষটার রাগ কে শেহরীনা ভয় পায়। তবুও শাসন হিসেবে ভালোও বাসে। কিন্তু এ মুহূর্তে বিড়াল ছানার মত মুখ করে মিইয়ে গেল মেয়েটা। দাঁত কিড়মিড়িয়ে সারোয়ার কঠোরতার সহিতে নম্র কণ্ঠে বলে,

“দুনিয়ার মানুষ তোমাকে ঘিরে অতীতে কী বলতো তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। বর্তমান আর ভবিষ্যতে কেউ যদি তোমার বর্ণ নিয়ে কথাও তুলে আমি তাকেই আস্তো রাখব না। তোমার বর্ণ স্বয়ং আল্লাহ প্রদত্ত। এটা নিয়ে তোমার তিরস্কার করা মানাই না কৃষ্ণ বউ। এ নিয়ে চতুর্থবার তুমি তোমার কথা রাখোনি। তাই শাস্তির জন্য প্রস্তুত হও।”

সারোয়ার হাতের জোড় কমিয়ে শেহরীনার গাল ছেড়ে তাকে স্নিগ্ধ স্পর্শে শুয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শেহরীনা ঢোক গিলে ‘আ’..না মানুষটা শুনল না তার কথা। তার কথায় মানুষটা মন খারাপ করে বেরিয়ে গেল। কপাল চাপড়ে নিজেকে নিজেই বলে উঠল,’ধ্যাঁত গাধী একটা’।

চলবে…..