#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৫১ (ছোঁয়াছুঁয়ি♥️)
“আপনি আমার সাথে রাগ করবেন না। আমি সত্যিই অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি ভুলে বলে ফেলেছি প্লিজ আমার কথাটা মানুন!”
ফুঁপিয়ে সারোয়ার এর কোল জড়িয়ে কেঁদে উঠল শেহরীনা। উদরের নিচে অল্পস্বল্প ব্যথার যন্ত্রণা থাকায় সে ঠিকঠাক উঠে বসতে পারে না। তার উপর দিয়ে হাতের মধ্যে লাগোয়া প্লাস্টার। মূলত এই রোগীর মত বেশভূষায় ভিষণ বিরক্ত শেহরীনা। বউয়ের ক্রন্দনরত চেহারা দেখে সারোয়ার তার মুখের আদলে হাত ডুবিয়ে দুগাল চেপে ঠোঁটজোড়া প্রশমিত করে দিলো। কত দিন, কত ঘণ্টা, কত মিনিট-সেকেন্ড প্রহর পেড়িয়ে তাদের ছোঁয়াছুঁয়ি হলো। অমৃত লাগছে শেহরীনার কাছে। সারোয়ার শুকনো অধরের মধ্যে থেকে মধুর মিষ্টি স্বাদ পাচ্ছে কিন্তু কেমনে! অধর প্রসারিত রেখেই মৃদু কণ্ঠে বলে,
‘মধু খেয়ে কী আমায় বাগে আনতে চেয়েছিলে!’
জামাইয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে বলাবাহুল্য। চট করে বউয়ের বুদ্ধি কে ধরে ফেলেছে। শেহরীনার গালে হালকা করে আদুরীয় চাপ দেয় সারোয়ার। বউয়ের কণ্ঠস্বরে লাজুকতা বিদ্যমান।
‘হুম যদি জামাইয়ের রাগ কমে তবে!’
সারোয়ার তিক্ততা কমিয়ে মুহূর্তটা নষ্ট হতে দিলো না। বরঞ্চ অধরের মধ্যে লাগোয়া স্বাদ আমলে নিতে লাগল। শেহরীনা আবেশে চোখ বুঁজে সারোয়ার এর কাছ থেকে আদরের স্পর্শ অনুভব করছে। এত ব্যথা যন্ত্রণায় তার বদ্ধ চোখের সামনে তাদের প্রথম তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ চিহ্ন পুনরায় ভেসে উঠল। চোখ ভিজে আসল শেহরীনার। এ সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করতে যথেষ্ট ছিল তার চোখের কোণা বেয়ে টপটপ করে পানি গাল বেয়ে সারোয়ার এর গাল স্পর্শ করায়। মিষ্টি মুহূর্তে মেয়েটার অশ্রুসিক্ত অনুভব করেও সারোয়ার ছাড়ল না। শেহরীনার নাক শব্দ করে উঠল। কেননা সারোয়ার তাকে চেপে ধরে অধর বন্দি করে রেখেছে। বেচারির নাক, চোখের পানি একাকার হয়ে শব্দ করছে। লজ্জায় শেহরীনা মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম। সারোয়ার তাকে ছেড়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকায়। শেহরীনার মুখপান ঘেমে গেল। আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিতে চাইলে সারোয়ার তাকে থামিয়ে দিলো। আচমকা কোলে উঠিয়ে নেয়। মানুষটার হুটহাট আচরণের সাথে এখনো মেয়েটা অভ্যস্ত হয়ে উঠল না। কোনো পুরুষ এত বার নিজের বউ কে কোলে উঠাতে পারে! না তার পুরুষই বোধোদয় অন্যরকম পুরুষ। যার ভেতরকার অনুভূতি প্রখর আর প্রখর। মেয়েটার মলিন নাজুক চেহারা দেখে সারোয়ার নানান কিছু কল্পনা করে রেখেছে।
ওয়াশরুমে এনে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে আদেশের সহিতে বলে,
“এখনি গড়গড়া করে কুলি করো এবং নাকের পানি পুরোপুরি ঝেরে নাও। আমার রোমান্সের সময় তেরোটা বাজাতে ওস্তাদ এরা।”
শেহরীনা তড়িঘড়ি হাতের কনুই বাঁকায়। সারোয়ার সঙ্গেই হাত ধরে চোখের দৃষ্টি কড়া করে নেয়। শেহরীনা ভুলবশত বাচ্চামি করায় মুখটা বাচ্চার মত করে বলে,
‘সরি খেয়াল করিনি।’
“আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না কৃষ্ণ বউ। কতটা তোড়পাড় চলছে এই বুকের মাঝারে তা বোধোদয় তুমি দেখছো না হয়ত বুঝতে পারছো না। তোমার হাতের এই ব্যথা তোমার কাছে মারাত্মক নাই লাগতে পারে। কিন্তু এই ব্যথার অনুভব আমি স্বচক্ষে করেছি। যখন তোমাকে সেই স্থানে আহত ও র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম। আমার চাপা স্বভাবের কারণেই সবাই ভাবে আমি গম্ভীর বেশি, অনুভূতি কম। কিন্তু মনে রাখবে তোমার স্বামীর অনুভূতি খুব তিক্ষ্ম এবং স্পর্শকাতর। বলতে পারো আমার নিজের দলিলের উপর খুব সেন্সিটিভ ভাবনা কাজ করে। এই ভাবনা থাকায় মন চাই। যে তোমায় চাই তাকেই তোমার থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে রাখি। কিন্তু আমি তা করছি না। যে তোমাকে চাই, নিশ্চয় তার মনে তুমি শুদ্ধ নারী ছিলে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এই গোটা তুমিই হলে পূর্ণ নারী। এই নারীর উপর হকদার আমিই। অন্যের চাওয়া কে পূর্বে হতে পারে কটু চোখে দেখেছিলাম। কিন্তু এ মুহূর্তে স্বীকার করে বলছি তার চাওয়া কে আমি সম্মান করি।”
শেহরীনা তার কঠোর মানবের দিকে কোমল চোখে তাকায়। সারোয়ার নিজ হাতে বউয়ের হাত ধরে তাকে ধুয়ে মুছে দিলো। কোলে নিতে চাইলে শেহরীনা আমতা আমতা করে হাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিলো। সারোয়ার বুঝল না। স্বাভাবিক নয়নেই চেয়ে রইল। শেহরীনা সংকোচ নিয়ে বলতে সাহস পাচ্ছে না। হাত কচলাচ্ছে। সারোয়ার দেখে মৃদু হেসে বলে,
“স্বামী হলো একান্ত আপন মানুষ। তার কাছে সংকোচ নয় আবদার মানাই বুঝলে। আমি দরজা ভিড়িয়ে রাখছি। হয়ে গেলে জানাইও।”
শেহরীনা মাথা নাড়ল। সারোয়ার দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। কপালে হাত ঠেকিয়ে অপেক্ষায় রইল শেহরীনার ডাক শোনার জন্য। হঠাৎ টুং করে শব্দ হলো। সারোয়ার চোখ ফিরিয়ে ফোন হাতে নেই। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তানভির রেকর্ড পাঠিয়েছে মেসেঞ্জারে। অপশনে গিয়ে রেকর্ডিং চালু করে।
“স্যার শোয়াইব মিলদাজ আর পদ্মিতার কোনো খোঁজ আর পায়নি। কোথাও তাদের খুঁজে পাচ্ছি না। এবং কী তারা দেশের বাহিরেও যায়নি। গেলে আমরা সেই হিসেবে মামলা নিতে পারতাম। এখন কী স্যার কেইসটা থামিয়ে দেবো!”
নেতিবাচক উক্তি শুনে সারোয়ার এর কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। পরক্ষণে মনের সন্দেহ কে সাময়িক বিরতি হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে ম্লান গলায় একটা রেকর্ড নিজ থেকেই পাঠিয়ে দেয়।
“হ্যাঁ যারা নিজ থেকেই হারিয়ে গেছে তাদের খুঁজে লাভ নেই। আর কোনো নিউজ থাকলে জানাবে।”
রেকর্ড পাঠানো হয়েছে। তানভির দেখে শুনে পরক্ষণে সে আবারো বিশ সেকেন্ডের একটা রেকর্ডিং পাঠাল। ভ্রু কুঁচকে সারোয়ার সেই রেকর্ডিং চালু করে।
“স্যার তাজ্জব ব্যাপার আপনি কী নিউজ দেখেছেন! আপনার কথায় মাত্রই আমি ফেসবুক লগইন করেছি। চোখের সামনে স্ক্রিনে যমুনা টিভির নিউজ এসেছে। সেখানে দুজন ব্যক্তির নিহত দেহের খণ্ডিত লা’শ পাওয়া গেছে। দুজনের পকেটে আইডি কার্ড ছিল। এক শোয়াইব মিলদাজ আরেক পদ্মিতা। তাদের অবৈধ ব্যবসার কার্ড।”
শুনে যেনো প্রশান্তি অনুভব করল সারোয়ার। তার বউয়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের শাস্তি তারা নিজেরা পেয়ে গেল। ফলে তার থেকে মামলায় জড়িয়ে তদন্তের মোকাদ্দমা অব্দি যাওয়ার ইচ্ছেটা আর রইল না। কারণ তার এ মুহূর্তে একটাই বাসনা। তা হলো তার বউকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া এবং তার শরীরের সুস্থতার দিকে বিশেষ নজরবন্দি রাখা। অতঃপর চিন্তিতহীন কণ্ঠে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আরেকটি রেকর্ডিং পাঠায় তানভির কে।
“আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তারা তাদের শাস্তি পেয়েছে এটাই যথেষ্ট আমার জন্য। নাহলে আমি আকাশপাতাল এক করে হলেও তাদের কে ফাঁসি অব্দি নিয়ে যেতাম। যেহেতু ফাঁসি খুব সোজা এবং সহজ শাস্তি সেহেতু জালিয়াতি মানুষদের জন্য খণ্ডিত হয়ে লা’শ হওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি আমি। এই নিয়ে আমি আর গভীরে যেতে চাই না। তারা কেমনে মরল, কী হলো কিছুই জানার নেই। পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। আর আগাম শুক্রবার এ মাহফিলের ব্যবস্থা রাখব। আমার ছোট বাচ্চার নিশ্চিহ্ন প্রাণ হারানোর জন্য এই মনে অনেক জ্বালা তানভির। আমি চাই আমার বউয়ের সঙ্গে নিরিবিলি থাকতে। পারলে বাকি কাজ সামলে নিও। জরুরি হলে জানিয়ে দিও। আজকে তোমার একাউন্ট চেক করতে ভুলবে না। অবশেষে একটা কথা মাথায় রেখো তানভির, আমরা মানুষ মাত্রই ভুল। তাই বলে সেই ভুলের ক্ষমা নেই তাও নয়। ভুল করলে শাস্তি দিয়ে ভুল শোধরানোর সুযোগ দাও। একবার দিয়ে দেখবে পরের বার করলে ছেড়ে দেবে। তবুও একবার হৃদয়ের মানুষ হারালে তখন হাজার চেয়েও তাকে ফিরে পাবে না। আশা করি তোমাকে আমার বুঝিয়ে বলতে হবে না রাখছি।”
পুরো এক মিনিটের রেকর্ডিং পাঠিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট মোড রেখে চার্জার বোর্ডে রেখে দিলো। হঠাৎ কুহ কুহ কাশির শব্দ শুনে তড়িঘড়ি ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সারোয়ার। তবে ভুলবশত দরজার হ্যান্ডেল তার হাতের সঙ্গে লেগে যাওয়ায় দরজা অর্ধ উম্মুক্ত হয়ে পড়ে। শেহরীনা ঘাবড়ে গেল। সারোয়ার স্তদ্ধ তার শরীর জুড়ে এক অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটেছে যেনো! এ কেমন বিস্ফোরণ উত্তেজিত মনে শরীর কে কাবু করতে সারোয়ার পেছন মোড়ে যায়। শেহরীনার পরণে আঁচল আর পেটিকোট জড়ানো। ব্লা’উজটি গরমে ভেজা ভেজা হওয়ায় সে খুলে রেখেছিল। আঁচলটা বুকের উপর পেঁচিয়ে নিলেও অস্পষ্ট বাঁক দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তা অবশ্য শেহরীনা খেয়াল করেনি। সে নিজ মনে ব্লা’উ’জটা এক হাতে পানিতে স্বল্প খানিক ভেজানোর সময় পানি ছিটকে এসে তার নাকের ভেতর চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে কেশে উঠে। সারোয়ার ও ভেবেছে মেয়েটা মনে হয় বিপদে পড়ল। সারোয়ার এর হাত-পা কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘আআমি কী থাকব না বাহিরে যাবো!’
শেহরীনার নাজুক অবস্থা। সে কী হ্যাঁ বলবে না-কি না বলবে বুঝতে পারছে না। মানুষটা তো তার স্বামী হয়। তবে বাহিরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এতটা আত্মসম্মানবোধ আর লজ্জাশীল পুরুষ ও বুঝি পৃথিবীতে আছে। নিজের স্ত্রীর দিকে এ পুরুষ মুগ্ধ হয়ে তাকায় বিধেয় তার হৃদয় এতটা সুপ্ত। মুচকি হেসে বলে,
“বউ তো আপনার তবে দূরে কেন চলে যাবেন হুম!”
সারোয়ার মাথা নুইয়ে বলে,’আমি তোমার কষ্ট বাড়িয়ে দিতে চাই না। তুমি তো আমারই। আমার হৃদয়ের রাণী। রাণী কী তার রাজা আর রাজ্য ছেড়ে চলে যায়! সে তো সর্বদা তার রাজার কাছে কাছে থাকে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠো তারপর দেখবে বমি কতবার আসে!’
কথাটা শুনে মনে হলো শেহরীনার মাথা ঘুরে উঠবে। মানুষটার বেহায়াপনাও কম নয়। বিড়বিড় করে বলে,’একটু আশকারা মা’রলেও সমস্যা। হুট করে বেশরম হয়ে যায় ধ্যাঁত।’
সারোয়ার এর খাঁড়া কান শুনে ফেলল কথাটা। ফিক করে হেসে দিলো সেই। পূর্ণ নজর নিয়ে শেহরীনার দিকে ঘুরে দরজার উপর একহাত ঠেসে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। শেহরীনার চিত্ত জুড়ে শীতল ঢেউ বয়ে গেল সেই দৃষ্টি খানা দেখে। সারোয়ার এগিয়ে গেল। শেহরীনার আঁচলটা বুকের সাথে শক্ত ভাবে চেপে ধরে পাঁজাকোলা করে রুমে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শেহরীনা চোখ পিটপিট করে দেখে গেল। সারোয়ার তাকে ইশারায় অপেক্ষা করতে ইঙ্গিত করে। আলমারি খুলে একটা পাতলা সুতির হাতকাটা টিশার্ট বের করল। শেহরীনা দেখল টিশার্টটি একদম নতুন। হয়ত কখনো পড়েনি সারোয়ার। ভাঁজের থেকে বের করেছে। কিন্তু সারোয়ার কে কখনো টিশার্ট পরে থাকতে দেখেনি সে। আজ হঠাৎ টিশার্ট কেনো দেখছে সে! মনের ভাবনায় খেয়াল করল সারোয়ার তার দিকে একটা বই এর ছবি দিয়ে কারুকাজ করা টিশার্ট এগিয়ে দিলো। শেহরীনা চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকায়।
“ওমন চোখ বড় করে কী দেখছো! বিয়ের আগে কামিজ,শেলোয়ার অনেক পড়েছো। এখন তোমার হাতের মধ্যে চোট পেয়েছো। তাই টিশার্ট আর প্লাজা প্যান্ট পরবে। সেই সাথে আমি কিছু বড় সাইজের ওড়না অর্ডার করে নেবো। আজ থেকে সুস্থ হওয়া অব্দি এই কাপড়ই পরবে তুমি।”
শেহরীনা শুনে মৃদু চিৎকার করে ‘না’ বলল। সারোয়ার হা হয়ে যায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘কেনো কী হয়েছে!’
‘ছিঃ আম্মু আব্বু কী মনে করবেন! আআআমি এসব কখনো পরিনি আর পরবও না।’
‘তুমি কী আমাকে অস্বীকার করছো!’
সারোয়ার এর কথায় শেহরীনা কাঁদো কাঁদো মুখ করে নেয়। যা দেখে মনে মনে ভিষণ হাসি পেল সারোয়ার এর। তবে এর থেকে ভালো উপায় আর তার নজরে আসছে না। কেননা এই হাতের প্লাস্টার নিয়ে মেয়েটা যদি শাড়ি পরতে যায়। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এমনকি সিঁড়ি দিয়ে উপর-নিচ করার সময় শাড়ির আঁচল এ পা বেজে পড়তেও পারে! নানান দূর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে বটে। এমনিতে উড়নচণ্ডী বউ তার। রাতদিন থৈ থৈ করে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এরে নিয়ে তার আরেক জ্বালা। শেহরীনা মলিন মুখে বলে,
‘কিন্তু আমার শাড়ি পরতে ভালো লাগে।’
সারোয়ার এর মেজাজ ধরে গেল। মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করতে গিয়েও তা গিলে ফেলল। নিজেকে শান্ত করে শেহরীনার দিকে চোখ পাকিয়ে বলে,
‘বর্তমানে তাপমাত্রা দেখেছো! এখানে এসি আছে বলে অনুভব হচ্ছে না। ওয়েট এসিটা অফ করে দেয়।’
সারোয়ার জেদ দেখিয়ে এসি অফ করে দিলো। শেহরীনা নির্লিপ্ত। মিনিট খানেক গিয়েও দুজন নিরবতা পালন করছে। দুজনের মনে অদৃশ্য জেদ। শেহরীনা খেয়াল করল তার নগ্ন বুকের উপর এই ভারি আঁচলটা নরকের বস্ত্র বলে মনে হচ্ছে! ইশ এত গরম কেন লাগছে! মনে মনে কথাটা আওড়ে শেহরীনা নড়েচড়ে বসল। ইতিমধ্যে সারোয়ার এর চুল, কপাল, মুখ, গলা ঘেমে গিয়েছে। পুরুষ মানুষের শরীরে তাপমাত্রা অতিশয় প্রভাব ফেলে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেল শেহরীনা। কিন্তু এ কী মানুষটা তার শার্ট খুলছে কেন!
সারোয়ার অজানার ভান ধরে শার্টের একেক বোতাম খুলতে লাগল। টগবগে যুবকের ন’গ্ন বুক ধীরস্থির হয়ে উম্মুক্ত হচ্ছে। ঢোক গিলল শেহরীনা। তার ভেতর অন্যরকম শিহরণ জাগছে। সারোয়ার এর বুকে গরমের প্রভাবে বিন্দু বিন্দু জল এসেছে। যা লোমশ বুকের মধ্যে ফুটে উঠেছে। শার্টটি আলনায় হেলিয়ে দিয়ে সোফায় দুহাত রেখে নিজেকে মেলে ধরেছে। এরূপ ভাব দেখিয়ে বসল সারোয়ার। শেহরীনা মনের অজান্তে বালিশ খামচি দিলো। মানুষটা জেদের বশবর্তী হয়ে নিজেকে ঘামিয়ে ফেলছে একবারে। এই রুপ দেখে যেকোনো মেয়েই অনিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য। তার উপর দিয়ে সে তো এ মানুষটার বউ। সারোয়ার এর দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ শেহরীনার উপর। মনে মনে মেয়েটার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে হাসল সে। ভালোই সিডিউস হচ্ছে তার বউটা। আগে কখনো সে খুঁটিয়ে দেখেনি ব্যাপারটা। আজ যেনো আমূল সুযোগ রত্নের মত হাতে পেয়েছে সে। শেহরীনার ও এখন গরম গরম অনুভুতি হচ্ছে। আচমকা বুকের আঁচল খামচি ধরল। মনে মনে জামাই নামক বেলাজ কে বকে দিলো। তার এমুহুর্তে মন বলছে, এসি না দিলে বস্ত্রহীন হয়ে হাওয়া খাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠবে তার শরীর। ঢোক গিলে বলে,
‘আচ্ছা আচ্ছা পরব এসি দিন জলদি গরম লাগছে অনেক।’
সারোয়ার শুনল কি-না বোঝা গেল না। সে উঠে দাঁড়াল। কেঁপে উঠল শেহরীনা। তার মনজুড়ে উত্তেজনার মনোরঞ্জন আরম্ভ হলো। সারোয়ার হেলেদুলে হেঁটে বিছানার নিকট এলো। শেহরীনা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে আছে। সারোয়ার মেয়েটার অধরের নিকট ঝুকল। তবে নির্বিকার অপেক্ষারত ঝুকে রইল। শেহরীনা একধাপ এগিয়ে অধরের মাঝে অধর প্রসারিত করতে গেলেই সারোয়ার চট করে এসির রিমোট নিয়ে এসি অন করে পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শেহরীনা। কী হলো এটা! মানুষটা তাকে বোকা বানিয়েছে! এত বড় ধোঁকা। তার চেয়েও বেশি শরমের ব্যাপার হলো। সে নিজ থেকে তার এই বেহায়া ঠোঁটখানা এগিয়ে দিয়েছে। সারোয়ার বউয়ের পাশে বসে তার লাজুক শরীরের সাথে কাঁধ ঘেঁষে কানের কাছে ঠোঁট এলিয়ে নেশাময় গলায় বলে,
“চাইলেই অনেক কিছু করা যায় বউ। কিন্তু তোমার এই বর খুব সাধু স্বভাবের মানুষ। তাই তুমি ছাড় পাচ্ছো অন্য সময় হলে এই রুপে তোমায় আস্তো রাখতাম না।”
শেহরীনা তৎক্ষণাৎ সারোয়ার এর দেওয়া টিশার্টটি পরে জোরালো এক দম ছাড়ল। সারোয়ার মেয়েটার চোখের আড়ালে মুখ টিপে হেসে উঠে দাঁড়াল।
“এখন ভ্যাপসা গরম পড়ছে। হুটহাট প্রাকৃতিক অবস্থা দেখে তোমার উচিৎ পোশাক পরিধানের খেয়াল রাখা। এখন এই হিট ওয়েভে উচিৎ পাতলা কাপড় পরে থাকা। দেখবে শরীরে স্বস্তি থাকবে। যখন শীতকাল আসবে তখনের চিন্তা করো না। সেসময় কোনো কাপড়ই তোমাকে পরতে হবে না। আমি আছি না। উষ্ণতায় ভরিয়ে রাখব। দেখবে শীত আর একটুও তোমাকে স্পর্শ করবে না। প্রতিদিন হ’ট হয়ে থাকবে তখন বউউউ।”
শেহরীনা রাগে কটমটে বালিশ একটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মা’রল সারোয়ার এর দিকে। সারোয়ার সঙ্গেই ক্যাচ করে বলে,
“এই বালিশ না ছুঁড়ে পুরো তুমিটাই কোলে এসে বসে থাকতে পারো। এই সব দু পয়সার বালিশের মধ্যে কোনো আরাম নেই।”
শেহরীনা বুঝতে পারল মানুষটা ইচ্ছেকৃত তার সাথে ন্যাকামি করছে। শরমের ঠেলায় উঠে দাঁড়ায় আলমারির কাছে গিয়ে একটা প্লাজা প্যান্ট বের করে পেটিকোট এর ভেতর পরে নিলো। হাতে থাকা সেই পেটিকোটটি সারোয়ার এর দিকে ছুঁড়ে রুম থেকে ধুপধাপে পা বা’রি দিয়ে দরজা ধরাম করে লাগিয়ে দিলো। মেয়েটার যাওয়ার ধরণ দেখে সারোয়ার নিজের হাসি কে আটকে রাখতে পারল না। ‘হু হু’ করে হেসে বিড়বিড় করে বলে,
‘তোমার এই হাসিটাই আমার প্রিয় কৃষ্ণ বউ।’
সারোয়ার মাথা চুলকে শেহরীনার পরণের সদ্য আধোয়া হওয়া জামাগুলোর সাথে তার পরণের জামা ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে গোসল করতে গেল।
শেহরীনা উঁকি দিয়ে একপলক দেখল। মানুষটার এ রুপ তার ভিষণ পছন্দের। বিয়ের পর এক নারীর মুখে উজ্জ্বলতা আসে কেনো! তখনি আসে যখন সে পূর্ণ সুখ পায়। তার সুখ সর্বদা এই মানুষটির উপর আবদ্ধ।
চলবে…..
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৫২_৫৩ (বড্ড অবেলায় এসেছিলে তুমি😓)
“পুষ্প বোন আমার মেয়েটা তোদের সাথে যা করেছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। তবুও সারোয়ার কে আমার মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে বল না। মেয়েটা আজ তিনদিন হয়ে গেল বাড়িতে ফিরে আসল না। আমাদের সবার আহ্লাদী কন্যা সে। নিলীমা কে ছাড়া বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগছে-রে বোন।”
মিশকিতা জাহানারা পুষ্প এর হাতে কপাল ঠেকিয়ে ডুঁকড়ে কেঁদে দিলেন। জাহানারা পুষ্প কী বলে শান্ত্বনা দেবেন নিজেই বুঝতে পারছেন না। তিনি নিজেও এ কয়েকদিন শেহরীনার সুস্থতার জন্য তার পাশে পাশে ছিলেন। আজ হঠাৎ মিশকিতা কে দুলাভাই সমেত বাড়ির চৌকাঠে দেখে ভীষণ খুশিও হয়ে ছিলেন। কিন্তু বোনটার মুখখানা মলিন দেখে জিজ্ঞেস করে বসেন। তখনি তিক্ত সত্য বেরিয়ে আসে। জাহানারা পুষ্প মিশকিতার হাতে ভরসার হাত রেখে বলেন,
“বোনু তুই কাঁদিস না আর। দেখ আমরা মিলে মিশে খোঁজ লাগিয়ে নেবো। মেয়ে বোধোদয় রেগে কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে।”
সারোয়ার কালো কোট হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার পিছনে শেহরীনা গলায় বড় সাইজের স্কার্ফ জড়িয়ে বের হয়েছে। সারোয়ার কে জরুরি ভিত্তিতে কোর্টে ডাকা হওয়া হয়েছে। মূলত শোয়াইব মিলদাজ এবং পদ্মিতার ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশন এর জন্য। সে বলে ছিল এসবে জড়াবে না। বিধেয় অফিসার শেষ মোকদ্দমা হিসেবে সারোয়ার এর কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নেবে। শেহরীনাও সম্মতি দিয়েছে। সারোয়ার এর সঙ্গে ড্রয়িংরুমে এসে কারো ক্রন্দনরত আওয়াজ শুনে তাদের কদম থেমে যায়। আওয়াজ অনুসরণ করে তারা ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল। শেহরীনা তার শ্বাশুড়ির পাশে বসা মহিলা কে পূর্বেও দেখেছিল। ঘোর দৃষ্টিতে দেখার পর বুঝল এই মহিলা নিলীমার মা এবং শ্বাশুড়ির সম্পর্কে চাচাতো বোন হয়। মায়ের সমতুল্য মহিলা কে দেখে শেহরীনা তার গলার স্কার্ফ খুলে মাথায় ঘোমটা হিসেবে এঁটে নিলো। সারোয়ার একপলক দেখে কদম পেড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। মিশকিতা সারোয়ার কে দেখে তার কাছে গিয়ে পরম মমতায় জড়িয়ে নিলো।
“বাবা আমার মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না-রে। একটু খোঁজ নেয় না বাপ। বড্ড চিন্তা হচ্ছে।”
সারোয়ার মা সমতুল্য নিলীমার মা কে ধরে শান্ত করে বসিয়ে দেয়। শেহরীনার দিকে তাকিয়ে বলে,’একগ্লাস পানি এনে দাও।’
‘জ্বি আনছি।’
শেহরীনা তড়িঘড়ি এক গ্লাস পানি এনে সারোয়ার এর নিকট এগিয়ে দিলো। সে নিয়ে নিলীমার মাকে পানি খাইয়ে বলে,’এখন বলুন কী হয়েছিল নিলীমার সঙ্গে!’
জাহানারা পুষ্প ও অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। মিশকিতা পুরো ঘটনা খুলে বলল। সেদিনকার নিলীমার কারণবশত শেহরীনার নিখোঁজ হয়েছে শুনে সারোয়ার এর রাগ হয়নি। কারণ সে পূর্বেই অবগত ছিল। শেহরীনা হতবাক। এক মেয়ে যে অন্য মেয়ের সর্বনাশ এর কারণ হয়ে থাকে। তার পরিদষ্টা স্বয়ং নিলীমা। শেহরীনা তাকে মাথা উঠিয়ে রাখতো সেই মেয়েটাই তাকে পেছন পেছন হিংস্রতা পুষে রাখতো ভেবে ভীষণ কষ্ট পেল শেহরীনা। তবুও নিরবে সারোয়ার এর পাশে দাঁড়িয়ে রইল। মিশকিতা শেহরীনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“মা তুমি তো সবাই কে আপন করে নাও। আমার মেয়েকে অভিশাপ দিও না। সে অবুঝের মত ঈর্ষান্বিত হয়ে তোমার সাথে ভুল কাজটা করেছে। দেখবে আমার মেয়ে ফিরে আসলে তোমার সাথে মিলেমিশে যাবে। কোনো ভেদাভেদ করবে না সে। তবুও দোয়া করো যেনো তাকে ফিরে পায়।”
সারোয়ার নির্বিকার হয়ে বসে রইল। পরক্ষণে তার মাথায় তানভির এর চেহারা ভেসে উঠল। সে পকেট হাতড়ে ফোন বের করে তানভির নাম্বারে কল দেয়। তানভির খোশমেজাজে মায়ের হাতে সুস্বাদু খিচুড়ি খাচ্ছিল। দুপুরের রান্না যে তার মা এতটা সুস্বাদু করে রাঁধবে ভাবেওনি সে। ছেলের উজ্জ্বল হাস্যকর মুখশ্রী দেখে তানভির মা মনে মনে খুশি হোন। তৃপ্তি সহকারে ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছেন। তারা বসে ছিল ড্রয়িংরুমে। তানভির এর ফোন ছিল ডাইনিং টেবিলের উপর। তানভির ছোট ভাই সেখানে বসে ভাইয়ের ফোনে গেইম খেলছিল। হঠাৎ খেলার মাঝে সারোয়ার স্যার লিখা নামে কল আসায় তানভির এর ভাই মলিন মুখ করে তার ভাইকে গলা উঁচিয়ে বলে,
‘ভাইয়া ফোন এসেছে!’
তানভির শুনে ভ্রুক্ষেপ নিয়ে আওয়াজ দিতে চাইলে তানভির এর মা তাকে থামিয়ে বলে,
‘বাবা আজকের দিনটা আমাদের দেয়। প্রতিদিন কী কাজ হুম!’
তানভির তার মায়ের কোলজুড়ে দীর্ঘ এক দীর্ঘ ঘ্রাণ শুঁকে বলে,
‘মা তোমার জন্য একটা ফোন কল না ধরলে কিছু হবে না হুহ।’
ডাইনিং টেবিলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’কল কেটে গেইম খেল।’
তার ছোট ভাই খুশি হয়ে কল কে ইগনোর করে দিয়ে গেইম খেলতে লাগল। সারোয়ার প্রায় তিনবার কল করে না পেয়ে হতাশার শ্বাস ছাড়ল। নিলীমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনি চিন্তা করবেন না আমি বাহিরে যাচ্ছি। কোর্টের কাজ সেরে খোঁজ লাগাচ্ছি।’
শেহরীনা সারোয়ার কে খাবার এগিয়ে দিলো। সে খেয়ে শেহরীনার কপালে চুম্বন এঁকে বলে,’বেশি দৌড়ঝাঁপ করো না। ব্যথা লাগবে তখন আমি তোমাকে ব্যথা দেবো।’
শেহরীনা ভেংচি দিলো। সারোয়ার হেসে বেরিয়ে যায়।
মোঃ আবু সিদ্দিক বাড়ির খোশমহল দেখে তৃপ্তি পান। তবে কোথাও এক খুঁত রয়ে যায়। এই খুঁতময় কিন্তুটা কী খুঁজে দেখা উচিৎ! তবে মনের কোণ দিয়ে একটা জবাবই প্রতিবার আসে তাহলো ‘না’। তপ্ত শ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলের বেরিয়ে যাওয়া দেখে তিনিও খেতে বসেন। শেহরীনা শ্বাশুড়ি কে সময় দিল তিনি যেনো মিশকিতা মামুনিকে সামলে নেন সেজন্য। জাহানারা পুষ্প নিজের সঙ্গে মিশকিতা কে গেস্ট রুমে নিয়ে যান। নিলীমার বাবার চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ প্রায়। মোঃ আবু সিদ্দিক তার পিঠ চাপড়ে বলেন,
‘চিন্তা করবেন না আমার ছেলেকে বলা হয়েছে খোঁজ লাগাবে সে।’
শেহরীনা সাদরে শ্বশুরদের খাবার এগিয়ে দিল।
____
“মা আপনারা এ কয়েকদিন অদ্ভুত আচরণ কেনো করছেন! কায়েসামও বা কোথায়! তাকে ফোনে পাচ্ছি না এ তিনদিন ধরে। সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে তাকে পায়নি। তখন আপনি বলছেন কায়েসাম মিটিং করতে গেছে। তারপর দিন বললেন কাজের জন্য শহরের বাহিরে গেছেন। আর আজকে বলছেন কথা হয়নি। মা আপনি কী আমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছেন!”
তনুদি এক ঝটকে রুফিয়া সাইমুম এর হাতজোড়া আঁকড়ে ধরল। তিনি বিচলিত হয়ে উঠেন। মেয়েটাকে কী বলে শান্ত্বনা দেবেন বুঝে পাচ্ছেন না। তিনি যে প্রকৃতপক্ষে মা হিসেবে দোষী! ছেলের ভালোবাসার অন্তপ্রাণ কে তিনি অপমানিত করেছেন। চোখের পানি আটকে রাখেন বহু কষ্টে। অভ্যন্তরে গলা কাঁপছে তবুও তিনি সাহস করে বলেন,
“মামুনি তুমি খামোখা ভাবছো। স্যাম বাবা চলে আসবে। তুমি তোমার মত পড়ায় মন দাও।”
“মা আমার খারাপ লাগছে তাকে ছাড়া। সে তো জানোই দেবদাস হয়ে থাকতে চাই। আমিই তো পাগলটাকে শোধরে নিতে চাইছি। দেখবেন মা একদিন আমি তার সবটুকু জুড়ে রাজ্যত্ব করব। তখন সে আমায় মাথায় উঠিয়ে রাখবে। একবার আপনার ছেলে কে কাজ থেকে ফ্রি হয়ে ফিরতে দিন।”
রুফিয়া সাইমুম তনুদির মাথায় আশীর্বাদময় হাত বুলিয়ে তৎক্ষণাৎ রুম ত্যাগ করেন। তনুদির সেদিক খেয়াল নেই। সে তার আপনমনে স্বপ্ন পুরুষ কে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে লাগল। রুমের দরজা ভিড়িয়ে দেওয়ার কথাটাও বেচারী বেমালুম ভুলে গেল। গলার ওড়না খুলে দুহাতে মেলে রুমের এক কেন্দ্রে ঘুরতে লাগল। ঠোঁটের মধ্যে মুচকি হাসি আর গলা ভেদ করে একটাই বাক্য তার মুখ থেকে বের হচ্ছে ‘আমার স্বপ্ন পুরুষ কায়েসাম তোমাকে অনেক ভালোবাসি’। রুফিয়া সাইমুম এ দৃশ্য দেখে মনের দুঃখে ম’রতে লাগলেন। রুমের দরজা মৃদু শব্দে লাগিয়ে তিনি দৌড়ে রুমে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন। মাথায় হাত চেপে পুরনো কথা স্মৃতির মত স্মরণ করতে লাগলেন।
ওয়াশরুম সেরে বের হলেন ইদরিব সাবেক। স্ত্রী কে ক্রন্দনরত মুখশ্রী নিয়ে বিছানায় বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে অশান্ত হয়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে বসেন। রুফিয়া সাইমুম এর গাল আঁকড়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলেন,
“কী হয়েছে ছেলের কথা মনে পড়ছে! চিন্তা করো না তাকে খুঁজে পাবো আমরা।”
“কখন পাবো বলেন! মেয়েটা কে মিথ্যে আশ্বাস দিতে দিতে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। মেয়েটার স্বপ্ন আমার কারণে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আমি কী চেয়ে ছিলাম বলুন একটু ছেলের খুশিই তো চেয়ে ছিলাম। হ্যাঁ রাগের বশে কটু কথা চলে এসেছিল মুখ থেকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মন থেকে ঐসব কথা বলেনি। আপনি প্লিজ! এ জেলার বাহিরেও খোঁজ নেন। দরকার পড়লে এয়ার পোর্টে সিল করে দেন। তবুও আমার ছেলেকে আমার কোলে ফিরিয়ে দিন।”
ইদরিব সাবেক নিজেও এক পিতা। তিনি নিজের কষ্ট বুকে গেঁথে রাখেন বিধেয় তিনি কষ্ট দেখাতে পাচ্ছেন না। স্ত্রী কে ব্যর্থ শান্ত্বনা ছাড়া অন্যকিছু দেওয়ার সাধ্য তার নেই।
বিকেল ৪টায় রুফিয়া সাইমুম এর মন চাইল তনুদি কে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার। আজকাল প্রেশার ফল করছে তার। তনুদি তখন রুমে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কায়েসাম রুমে এসে দরজা খোলা দেখতে পেয়ে তিনি দরজা মৃদু খোলে ভেতরে চোখ দেন। মেয়েটাকে ঘুমুতে দেখে আর ডেকে তার স্বাদের ঘুমটা নষ্ট করলেন না। তিনি নিজেই মুচকি হেসে মেয়েটার নিকট গিয়ে দোয়া ইউনুস পড়ে কপাল ছুঁয়ে ফুঁ দিলেন। দরজা ভিড়িয়ে তিনি সঙ্গহীন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হলেন। ইদরিব সাবেক সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। ভার্সিটির মধ্যে পরীক্ষার ঢোল নেমেছে। পরীক্ষার নিয়ম কানুন মানানোর জন্য দুয়েক মিটিং এ বসতে হয়। সেই ক্ষেত্রে তিনি ভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান অধ্যক্ষ হওয়ায় সাইন করার জন্য উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। স্বামীর অনুপস্থিতিতে রুফিয়া সাইমুম বাড়ির দায়িত্বে কাজের ছেলে ফরিদ কে গলা উঁচিয়ে ডাকলেন। ফরিদ তড়িঘড়ি গাড়ি মোছা বাদ দিয়ে ভেতরে চলে আসল। রুফিয়া সাইমুম এর নজরে ফরিদ হলো আর্দশ বালক। বয়স কত আর এই সতেরো কী আঠারো বছর বয়স হবে তার! ওটুকু বয়সে ছাত্র হয়ে ইন্টারের পড়াশোনা করা উচিৎ ছিল তার সেই দুর্ভাগ্যজনক সে গরীব ঘরের ছেলে হওয়ায় পড়াশোনার পর্ব চুকাতে পারল না। ইদরিব সাবেক কাজের লোক খুঁজলে তখন নিজ থেকেই ফরিদ এসে কাজ করবে বলে সাড়া দেয়। ফলস্বরূপ দীর্ঘ চারটে বছর ধরে ফরিদ এ বাড়িতে কাজ করে যাচ্ছে। বিনিময়ে রুফিয়া সাইমুম ও হাত ভরে দেন। ফরিদ এসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
‘জি আম্মা কওন কী করমু আপনার জন্যে!’
‘তোরে বড় দায়িত্ব দিচ্ছি। ঘরের মধ্যে আমার বউমা ঘুম বুঝছিস। পুরো ঘরে নজর রাখিস। কোনো এঠিক বেঠিক হলে খবর আছে বলে দিলাম।’
ফরিদ মাথা নেড়ে বলে,’জ্বি আম্মা আমি নজর রাখমু নেহ্।’
রুফিয়া সাইমুম তৃপ্তির শ্বাস ফেলে যাওয়ার মুহূর্তেই বলেন,’আমার আসতে মনে হয় তিন ঘণ্টা লাগবে। এর মাঝে বউমা উঠে গেলে খাবার গরম করে খেতে দিস। সব খাবার বুয়া রান্না করে রেখেছে। টেবিলেই আছে তুইও খেয়ে নিস।’
ফরিদ স্যালুট করে বলে,’জ্বি আম্মা।’
ছেলেটার হাস্যোজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে রুফিয়া সাইমুম দুশ্চিন্তাহীন হয়ে বাড়ির বাহিরে পা রাখলেন।
গাড়ির কাছে গিয়ে দেখলেন ড্রাইভার গাড়ি মুছে ফেলেছে। সে বাড়ির মালিকের বউ কে দেখেই সোজা দাড়িয়ে বলে,
‘জ্বি আপা কওন কৈ যাবেন!’
‘ভাইজান আমাকে মেট্রো হাসপাতালে নিয়ে চলো।’
‘আচ্ছা আপা বোউন ওনে।’
রুফিয়া সাইমুম বসে যান। তখনি তার ফোনে টোন শব্দ করে একটা ম্যাসেজ আসল। তিনি ম্যাসেজটা খোলে দেখেন। তিনি দুপুরের দিকে তাদের ফ্যামিলিয়ান ডক্টরের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ছিলেন। সেটা এপ্রুভ দেখাচ্ছে। রুফিয়া সাইমুম এর মন শান্ত হলো। চিকিৎসার পরপর বাড়িতে ফিরে আসতে পারবেন। এমনিতে বাড়িতে একলা জোয়ান মেয়েকে রেখে আসতে মন চাইছিল না তার। তবুও শরীরের নাজুক অবস্থা দেখে নিয়ন্ত্রণ ও করতে পারলেন না।
‘ইয়া খোদা মেয়েটাকে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করিও।’
___
এক সপ্তাহ পর জুম্মার দিন শুক্রবার…
আজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে জমিদার সিদ্দিক বাড়ির পুরনো ভিটেমাটিতে। মাহফিল আয়োজন এর জন্য বুধবার রাতের দিকে সিদ্দিক বাড়ির পুরনো ভিটেমাটিতে চলে এসেছিল সারোয়ার-রা। তানভির মলিন মুখে যাবতীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। সারোয়ার মেহমানদের লিস্ট দেখে আমন্ত্রণ কৃত সকলকে আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করছে। নাছির উদ্দিন আর মোঃ আবু সিদ্দিক একসঙ্গে তাদের বাড়ির মৃত শিশুর জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। শেহরীনা ও হাতে হাত রেখে রান্নাঘরের মধ্যে ভাত, তরকারির পাতিলে বড় চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে রান্নার স্বাদ পরীক্ষণ করছে। তার খেয়াল রান্নার দিকে হলেও পরপর এক সূক্ষ্ম দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে। এই আয়োজনে সে তার গর্ভের শিশু কে মনে মনে চাইছে। সকলের অগোচরে তার চোখের পানি টুপ করে পড়ে গেল ভাতের উপর। সে নিজেকে সামলে কাজে মনোনিবেশ করে। দূর থেকে রূপালি বেগম মেয়েকে দেখতে পাচ্ছেন।
ইশ! তার মেয়ের সুখ কপালের একটা চিহ্ন মাটির নিচে এবং খোদার কাছে চলে গেল। রূপালি বেগম এর পরণে সোনালি রঙের জামদানি মসলিন শাড়ি, গলায় সোনার হার, কানে, নাকে সোনার দুল এবং নাকফুল। গ্রাম্য পরিবেশে এসেছেন তারা। ফলস্বরূপ সোনার বালায় নিজেকে ভরিয়ে রাখলেই কি-না স্বামীর আয়ু বাড়ে, মঙ্গল হয়। রূপালি বেগম নিজের মাথায় ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে জমিদার বাড়ি থেকে বের হলেন। ঢোক গিলে পা মেলে দু’রাস্তার মাথায় গিয়ে থামেন। আশপাশ জুড়ে নির্জন হওয়ায় কেউ তাকে দেখতে পায়নি। তিনি ছলছল চোখে সেই পুরনো ভাঙ্গা পুড়ো বাড়ির দিকে তাকালেন। যেই বাড়ি ছিল শোয়াইব মিলদাজ এর। তিনি নিজেকে ধাতস্থ করে একপা দুপা করে এগিয়ে গেলেন। দরজার সামনে আসতেই বিদঘুটে এক গন্ধ তার নাকে ভেসে আসল। তৎক্ষণাৎ নাক চেপে পিছিয়ে যান তিনি।
‘এ কী জমিদার বাড়ি পুরনো হলেও এখনো সুঘ্রাণ বয়ে বেড়াছে। কিন্তু এটা পুরনো ভাঙ্গা বাড়ি এখান থেকে কেমন দুর্গন্ধ ভেসে আসছে।’
রূপালি বেগম আঁচল শুদ্ধ ভাবে এঁটে নাক চেপে দরজায় হাত লাগাতে গেলেই কারো গুমোট শব্দ বাষ্পের সাথে দরজায় এসে বা’রি লাগল।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)চমকে গাঁয়ের পশম যেনো খাঁড়া হয়ে গেল রূপালি বেগম এর। ঢোক গিলে কাঁপান্বিত হাত ছুঁয়ে দেন দরজায় মুকুটে। দরজার ধার এতটা ভেঙ্গে এসেছে যে মৃদু ছোঁয়ায় দরজা আপনাআপনি উম্মুক্ত দৃশ্যমান হয়ে গেল। রূপালি বেগম চোখ পিটপিট করে পা এগোলেন। গন্ধের তীব্রতা ক্রমাগত বাড়তে লাগল। গন্ধের উৎস খুঁজতে তিনি কষ্ট করে ঘ্রাণ শুঁকে ‘ওয়াক’ করে উঠেন। বিবশ বিদঘুটে গন্ধ এটা। যেনো কোনো পঁচে যাওয়া লা’শ এ বাড়িতে বিদ্যমান। রূপালি বেগম রান্নাঘরের দিকে উঁকি দেন। মেঝেতে আঠালো লাল দাগ দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকান। ঝুকে স্পর্শ করতে গেলে কারো ‘উম উম’ শব্দস্বরে ভীতিকর মনে সোজা হয়ে দাঁড়ান। আকস্মিক শব্দস্বর তীব্র হলো তিনি কেঁপে উঠেন। শিহরিত হয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ বাড়িটি ত্যাগ করলেন। তিনি বুঝতেও পারেননি। অনাহারে, অবহেলিত, এসিডের পুড়া মুখ নিয়ে এখনো বেঁচে থেকেও মৃত্যুর প্রহর গুনছেন পদ্মিতা।
রূপালি বেগম বেরিয়ে যাওয়ার পরে অন্য কেউ এসে হাজির হলো সেই পুরনো বাড়ির সামনে। রূপালি বেগম এর যাওয়ার দিকে তার নজর এঁটেছে। মৃদু হেসে বলে,
‘ভালোই হলো আন্টি আমার মাথার উপর থেকে এক পা’পের বোঝা নাহয় আপনিই কমিয়ে দিলেন।’
কথাটা বলেই সে ভেতরে গিয়ে বদ্ধ রুমটির দরজা খুলল। জীর্ণ শীর্ণ হয়ে কাতড়াচ্ছে পদ্মিতা। কায়েসাম এর চেহারায় মায়া দয়া দেখা গেল না। তবে সে তার সঙ্গে করে একটা ক্লোরোফম মিশ্রিত রুমাল এনেছে! দরজা খোলার কারণে ক্ষীণ আলো এসে পড়ল পদ্মিতার চোখমুখে। তিনি যেনো আশার আলো দেখতে পেলেন। ম্লান হেসে ক্ষুধার্ত পেটে কান্না আটকে রাখা গলা পাঁকানো কণ্ঠে বলেন,
‘আইছিস তুই বাপ! ছাড় আমাকে। আমার সব তো ধ্বংস হয়েই গেল। ছাইড়া দেয় এখন।’
‘জ্বি আন্টি ছাড়তেই এসেছি আমি।’
কায়েসাম শান্ত কণ্ঠে বলে জট পাকিয়ে পদ্মিতার নাকে রুমাল চেপে ধরল। মুহূর্তেই জ্ঞান হারালেন তিনি। পাশে পঁচে গলিত শোয়াইব মিলদাজ এর লা’শ একনজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার সঙ্গে আসা কাজের লোক কে ইশারায় কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করল। লোকটি এলে কায়েসাম তার হাতে চকচকে এক হাজার টাকার দুটো নোট ধরিয়ে বলে,
‘এ মহিলাকে শহরের রাস্তার মোড়ে একটা ময়লা কাপড়ের উপর শুইয়ে দিয়ে আসবেন।’
লোকটি জবাবে শুধু মাথা নাড়ল। কায়েসাম সরে যায়। লোকটি আলগোছে পদ্মিতাকে কাঁধের উপর উঠিয়ে নেয়। লোকটা তাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কায়েসাম নিজের গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ল। তার গাড়ির মিরর গ্লাসে অবহেলিত ছেঁড়া এক ফ্রেমে আবদ্ধ রয়েছে শেহরীনার যৌবন কালীন ছবি। এ ছবি কায়েসাম তুলেছিল শেহরীনার অগোচরে। তখন বোধোদয় মেয়েটার ভার্সিটির প্রথম দিন ছিল। ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত ছিল কায়েসাম। তখনি তার নজর কাড়ে গেইটের সামনে হঠাৎ এসে হাজির হওয়া এক মেয়ের দিকে। আকাশী রঙের গোলাপ ফুলের নকশা প্রিন্টেড কাতান শাড়ি পরিহিত, হালকা সাজ কাজল কালো ভ্রু এবং চোখের নিচেও কাজল দেওয়া, চোখজোড়া দেখতে কতই না মায়াবী লাগছিল, ঠোঁটের মধ্যে জেল মাখানো তাই ফুটে আছে। এই স্বল্প সাজেই উত্তীর্ণ যৌবনে ভরা শেহরীনা কে অপরূপা লাগছিল। সেই দিনের এক দেখায় কায়েসাম নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
চোখের সামনে পুরনো দিন ভেসে উঠায় তার চোখের কোণায় জল চলে আসে। চোখ মুছে সেই ছবির থেকে চোখ ফেরাতে গেলে তার নজর কাড়ে অন্য আরেকটি ছবি। ছবিটি তার চোখের সামনে স্টেয়ারিং এর উপর গ্লাসে লাগানো। লাভ ফ্রেমে আবদ্ধ এক ছবি। যেই ছবিতে তনুদি নববধু বেশে লাল শাড়ি পরিহিত, বধুর সাজে মায়ের দেওয়া সোনায় মুড়িয়ে তার জীবনে পদার্পণ করে ছিল। মেয়েটা কে দেখতে সদ্য আসমান থেকে নেমে আসা লাল পরী লাগছিল। কায়েসাম তনুদির সেই ছবিটি ছুঁয়ে দিলো।
“কেনো আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছো তনু! যতবার তোমাকে দেখি ততবারই মনে হয় আমি তোমার সাথে অন্যায় করছি। চেয়েও পারি না আপন করতে! এ দেখো তনু আদৌ তোমার আবছায়া ছুঁয়ে দিলে মনের মধ্যে অনুভূতির জোয়ার সৃষ্টি হয় না। যেই আমি তোমার মাঝে ডুবে থাকতে চাই সেই আমি তিলে তিলে গুমোটে হারিয়ে ফেলি নিজেকে। আচ্ছা আমার হৃদয় এত ব্যাকুল কেনো হয়ে উঠে কৃষ্ণকুমারী কে দেখলে! তনু তুমি তো আমার বউ। সেই হিসেবে আমার অনুভূতি তোমার জন্য স্পন্দন হওয়া উচিৎ। আমায় ক্ষমা করো তনু। আমি পারছি না। এ তিলে তিলে গড়া ভালোবাসার কী কখনো মৃত্যু হয় না কৃষ্ণকুমারী! কেনো তুমি আমার সামনে এসেছিলে! কেনো আমি অজান্তে তোমায় নিয়ে তিলে গড়া ভালোবাসায় ডুবে ছিলাম। এই ভালোবাসার ফলাফল তো শূন্য। কেনো নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না আমি কেনো কেনো….।”
কায়েসাম এর চোখের পানি যেনো কমছেই না। স্টেয়ারিং এ মাথা রেখে নিজেকে নিয়ে বিলাপ করতে লাগল। ঝুলন্ত শেহরীনার ছবিটি আকস্মিক জোরালো বাতাসে দড়ির থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে পড়ে গেল। কায়েসাম খেয়াল করেনি সে আপনমনে কাঁদছে।
অবেলায় কেনো এসেছিলে তুমি,
তোমার আগমনী ছিল স্নিগ্ধ এক বেলায়,
হারানোর বেদনায় লিখিয়েছো নাম,
দিয়ে গেলে এক চিলতে অশ্রু,
তিলে গড়া মোর ভালোবাসা,
দেখতে পেলে না তুমি,
অবেলায় এসে ঘুচিয়ে দিলে নাম,
অবেলায় এসে হারিয়ে যেতে ভুলোনি।
তবে কী তুমি আমার অবেলায় আসা কোনো এক কৃষ্ণকুমারী ছিলে?
হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে তার ধ্যান ফেরে। দেখল জাফরান কল দিয়েছে। ছেলেটার সাথে তার সম্পর্ক আত্মীয়তার। জাফরান এর কল কে উপেক্ষা করল না। শুরু থেকে সম্পর্কে বিভেদ দেখা গেলেও তারা নিজেদের মধ্যে সব ঠিক করে নেয়। কারণ বিবাহিত জীবন যার যার।
‘হহহ্যা বল ভাই কেমন আছিস!’
‘ভাই তুই কী কাঁদছিলি!’
‘না এমনি বল কী অবস্থা!’
জাফরান কয়েকক্ষণ নিরব রইল। কায়েসাম কে সে বুঝে উঠতে পারে না। তবুও মাহফিলের আয়োজন চলছে। শেহরীনা তার দ্বারা তনুদির পরিবার কেও আসার জন্য অনুরোধ করতে বলেছে। অতঃপর শেহরীনার আমন্ত্রণ বৃথা যেতে দেয়নি জাফরান। স্বেচ্ছায় বলে উঠে।
‘শেহরীনা বলেছে মাহফিলে আসতে।’
কায়েসাম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘আচ্ছা আসব তুই তনুদি কে ঠিকানা পাঠিয়ে দেয়। তারা পুরনো বাড়ি চিনে না।’
জাফরান বিনিময়ে ‘ওকে পাঠাচ্ছি’ বলে কল রেখে দেয়।
কায়েসাম গাঁ হেলিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনের কললিস্ট ঘেঁটে তনুদির নাম্বারে কল লাগায়। তনুদি রান্নাঘরের কাজ সেরে সবে মাত্র রুমে এসেছে। ফোনের শব্দ পেয়ে হাতে নিতেই তার চোখজোড়া উৎফুল্ল হয়ে গেল। হাস্যোজ্জ্বল গলায় কল ধরে সালাম দিলো। কায়েসাম মৃদু গলায় সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘কেমন আছো!’
কায়েসাম এর কণ্ঠে এক বাক্য শুনেই তনুদির তৃপ্তি লাগছে। সে মনমাতানো গলায় বলে,
‘তোমাকে মিস করছি।’
“আসব কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। আমি একটু শহরের বাহিরে কাজে আছি। তুমি বাবা-মা কে নিয়ে ক… সারোয়ার ভাইয়ার বাড়িতে চলে যাও। তাদের পুরনো বাড়িতে দাওয়াত। সেই বাড়ির ঠিকানা জাফরান তোমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে পাঠিয়ে দেবে। মাহফিলের দাওয়াত দিয়েছেন সারোয়ার ভাইয়া।”
তনুদি ঘোরে থেকে কায়েসাম এর কথা শুনছিল। এক বিবাহিত স্ত্রী কখনো তার স্বামীর মুখে পরনারীর নাম শুনতে চায় না। যতই সে তার প্রাক্তন হোক! স্বামী মানে সে একান্ত নিজস্ব অঙ্গ। পরিশিষ্টে স্বামীর মুখে শেহরীনার নাম শুনতে না পেয়ে তৃপ্তিভরা শ্বাস নেয় তনুদি। যা ফোনের অপরপাশে থাকা কায়েসাম ও শুনতে পেল। তার বুক কেঁপে উঠল ক্রমান্বয়ে। আজ যদি সে শেহরীনার নাম ভুলবশত মুখে এনে প্রকাশ করতো। তবে মেয়েটা আপন ভাবনায় ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট পেতো! কায়েসাম তনুর জীবন কৃত্রিম বেদনা দিতে চাইছে না। যথাসম্ভব নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেই কৃত্রিম হেসে বলে,
“যাও আমিও কাজ শেষে মাহফিলে উপস্থিত হবো। রাখছি এখন।”
কায়েসাম কল কেটে ফোন পাশের সিটে রেখে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রাস্তায় নেমে পড়ে। অন্যত্রে, শেহরীনার সেই যৌবন কালীন ছবিটি বালুকাময় মাটিতে পড়ে রইল। বাতাসের কারণে স্বল্প মাটি এসে সেই ছবির উপর আবরণে আবৃত হয়ে যায়।
চলবে…….