একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-০৬

0
19

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ৬
#আদওয়া_ইবশার

“জনদরদি আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় যে! ভুল করে রাস্তা হারিয়ে চলে এলেন না কী?”

রুমে ঢুকতে ঢুকতে ঠাট্টার সুরে রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে দৃষ্টি।রোদ্রিককে নিয়ে হোমওয়ার্ক করাতে বসেছিল রক্তিম। আড়চোখে একবার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কোনো প্রত্যুত্তর না করে ছেলের লেখার দিকে মনযোগ দেয়। দৃষ্টি কোনো সাড়া না পেয়ে মুখ ভেংচায়। ধুপধাপ পা ফেলে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বিরবিরায়,

“বুড়ো বয়সেও এখনো এটিটিউট কমেনা। একটু হাসি মুখে দুটো কথা বললে যেন মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে।”

কথা গুলো বিরবির করে বললেও ঠিক রক্তিমের কর্ণপাত হয়। তবে সেসবে তোয়াক্কা না করে ভার সুরে প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন করে,

“তোমার হিটলার ভাইয়ের খোঁজ জানো?”

তৎক্ষণাৎ থেমে যায় দৃষ্টির পা জোড়া। কপালে ফুটে ওঠে চিন্তার বলিরেখা। সত্যিই তো, সেই যে সকালে বের হলো, এরপর আর কোনো খোঁজ খবর নেই। দৃষ্টি বারবার বলেছিল পৌঁছে ফোন করতে। কিন্তু করেনি। এক ছেলের চক্করে পরে বাবা-মা, ভাই সবার চিন্তা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। রক্তিমের প্রশ্নে এতোক্ষনে টনক নড়েছে দৃষ্টির। বাবা-মা না হয় ময়মনসিংহ নিজের বাড়িতে গিয়েছে, পুরোনো, বিশ্বস্ত ড্রাইভার আজম কাকা সাথে আছে। ওনাদের নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে। কিন্তু ভাইটা তো গিয়েছে রিস্কি কাজে। অথচ সে এভাবে নিশ্চিন্তে খোঁজখবর না জেনে বসে আছে! রাগ হচ্ছে এখন নিজের প্রতি। এতো বেখেয়ালি সে কবে থেকে হলো? চিন্তিত মেজাজটা হুট করেই বি’গড়ে ওঠে দৃষ্টির। আচমকা পিছু ঘুরে চ্যাঁচিয়ে ওঠে,

“সব দো’ষ আপনার ছেলের। সারাটা দিন আমাকে জ্বা’লি’য়ে-পু’ড়ি’য়ে শেষ করে ফেলে। এটাকে সামলাবো না কী অন্য দিকে ধ্যান রাখব? দিন দিন বড়ো হচ্ছে আর আমার ক’লি’জা চি’বি’য়ে খাওয়ার পায়তারা করছে।”

হুট করে মায়ের এমন চ্যাঁচিয়ে ওঠাতে রোদ্রিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। লেখা বাদ দিয়ে থম মেরে তাকিয়ে থাকে মায়ের রো’ষা’গ্নি মুখবিবরে। তার এহেন কান্ডে রক্তিম কতক্ষণ শান্ত নজরে দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে ছেলের বই-খাতা গুছিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে বলে ওঠে,

“আজ আর পড়তে হবেনা বাবা। যাও, দিদুনের সাথে গল্প করো।”

রোদ্রিককে আর পায় কে! পড়াশোনার মতো বিরক্তিকর একটা কাজ থেকে ছুটি পেয়ে গেছে, এর থেকে বড়ো আনন্দ কিছুই না। মুখ ভরে হেসে বাবার গলা জড়িয়ে নিজেও রক্তিমকে অনুকরণ করে তার কপালে শব্দ করে চুমু এঁকে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

“তুমি আমার ভালো পাপ্পা, মাম্মা বেশি বেশি পঁচা।”

বলা শেষে ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জিহ্বা বের করে ব্য’ঙ্গ করে এক ছুটে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে। তার এহেন কান্ডে রক্তিম নিঃশব্দে হাসলেও দৃষ্টি মুখটাকে বিকৃত করে ফেলে। সরু ভ্রু দুটো ভীষণভাবে কুঁচকে মুখে রাগি ভাব ফুটিয়ে বলতে চায়,”খা’টা’শ বাপের ছেলে কী আর সাধু হবে!” কথাটুকু মুখে উচ্চারণ করার আগেই রক্তিমকে অতি সন্নিকটে দেখে টুপ করে গিলে নেয়। এই অতি দা’ম্ভি’ক, পা’ষা’ণ লোকটা তার অর্ধাঙ্গ, বিগত সাতটা বছর যাবৎ এক ছাদের নিচে বসবাস করছে দুজন। এরপরও দৃষ্টি পারেনা এখনো তার মুখের উপর চ্যা’টাং চ্যা’টাং কথা বলে মাত্রাতিরিক্ত সাহসটুকু দেখাতে। ঐ যে একটু আগে যেটুকু বলেছে, এর জন্যই ভিতরে ভিতরে রক্তিমকে এতো কাছাকাছি শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুনামী বয়ে যাচ্ছে। এমন ভদ্র রুপে দাঁড়িয়ে থেকে না জানি তাকে কোন পদ্ধতিতে গি’লে খাবার নীল নকশা এঁকে নিচ্ছে মনে মনে। দৃষ্টি আড়চোখে একবার রক্তিমের শীতল নয়নজোড়া পরখ করে আলগোছে কেটে পরতে চায়। একহাতে পিছনের ওয়াশরুমের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে যেই ছুট লাগাতে যাবে, ওমনি হ্যাচকা টানে তার নরম দেহটা নিজের শক্ত, পুরুষালী বক্ষের সাথে মিশিয়ে নেয়। চোখ দুটোর শান্ত ভাব কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পরে রোদ্রময়ী তেজ। সেদিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলে দৃষ্টি। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চায়। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে রক্তিম তার চিরচারিত গম্ভীর সুরে কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে ধমকে ওঠে,

“শিক্ষিত হয়েও তোমার এমন মূ’র্খের মতো আচরণ আর কতদিন সহ্য করতে হবে আমাকে? বারবার বলি ছেলের সামনে কোনো বা’জে আচরণ করবেনা, কানে যায়না কথা? এখন ওর শেখার বয়স, তোমার ঐসব আলতো-ফালতো কথা যদি কোনোদিন আমার ছেলেকে অনুকরণ করতে দেখি, আই সয়্যার মুখ সেলাই করে ফেলব তোমার।”

আকস্মিক রক্তিমের এমন রু’ক্ষ মে’জা’জের ব’লি হয়ে বিহ্বল হয়ে যায় দৃষ্টি। যদিও জানতো, জাঁ’দ’রেলটা নিশ্চিত কোনো একটা ইস্যু ধরে তার তিরিক্ষি মেজাজ দেখাবেই, তবুও সেটা যে ছেলের সামনে বলা তার কোনো কথাকে কেন্দ্র করে হবে এমনটা ভাবনায় ছিলনা দৃষ্টির। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও নিজেকে সামলে নেয় দৃষ্টি। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“কী বা’জে আচরণ করেছি ছেলের সামনে?”

দৃষ্টির অবুঝপনায় রক্তিমের মেজাজের পারদ তরতর করে বাড়তে থাকে। নিজের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় থাকা ওর কোমল হাতে তীব্র চাপ প্রয়োগ করে রাগের মাত্রাটুকু বুঝিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,

“একদম নাদান বাচ্চা তুমি? কিচ্ছু জানোনা? ওর সামনে চ্যাঁচাচ্ছিলে কেন? একবারও লক্ষ্য করেছো, তখন ছেলেটা কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল! লিসেন, আবারও ওয়ার্ন করছি, আমার কিংবা অন্যদের সাথে করা তোমার সমস্ত অবুঝপনা, পাগলামি মেনে নিলেও এসব আমার ছেলের বেলায় একটুও গ্রহণযোগ্য হবেনা। মা তুমি, আমার থেকেও বেশি তুমি ওর কাছাকাছি থাকো। সেই হিসেবে ওর মানসিক বিকাশে আমার থেকে অবদান তোমার বেশি থাকবে। কথাটা মাথায় রেখে সন্তানের ভালোর জন্য হলেও একটু হেয়ালিপনা বাদ দাও।দ্বিতীয়বার যেন ওর সামনে তোমাকে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে না দেখি।”

কথা গুলো দৃষ্টির অন্তঃকোণে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে। বিস্মিত চোখ দুটো সচ্ছ জলে টলটলে হয়ে ওঠে। নিদারুণ এক অস্থিরতায় বক্ষস্থল তীব্র গতিতে উঠানামা করে। রক্তিম কী বলতে চাইছে? ঐ কথা গুলো দ্বারা কী সরাসরি তার উপর আঙুল তুলেছে! অভিযোগ করছে, সে তার ছেলের মানসিক বিকাশে বিগ্ন ঘটাচ্ছে? অথচ এই ছেলেটার সুন্দর, সুস্থ একটা জীবন কামনা করেই দৃষ্টি রাত-দিন, নাওয়া-খাওয়া, চাওয়া-পাওয়া সমস্ত কিছু হারাম করেছে। নিজের শরীরের প্রতিও কতটা অযত্নশীল হয়েছে, তা আয়নায় প্রতিবিম্বের দিকে তাকালেই স্পষ্ট চোখে ভাসে। এসব কী রক্তিমের চোখে পরেনা? না কী শুধু তার মাঝেসাজে করা ক্ষিপ্ত আচরণটুকুই চোখে বাজে! মাঝে মাঝে দৃষ্টির বড্ড ইচ্ছে করে একটা হিসাব মিলাতে, রক্তিমকে ভালোবেসে বিগত বছর গুলোকে কী পেয়েছে সে? কিন্তু ক্যালকুলেশনটা হয়ে ওঠেনা। জীবনের হিসাব মিলাতে বড্ড আনকোরা সে। প্রতিবার নিজেকে দমিয়ে নেয় এই ভেবে, ভালোবাসার মানুষটাকে বৈধভাবে পেয়েছে, সাথে থাকতে পেরেছে তার, এক আকাশ সম ভালোবাসার বিনিময়ে মানুষটা বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ না ঘটালেও শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে দিয়েছে তার ঔরসজাত সন্তান। তার নারী জীবন পূর্ণ করেছে। ব্যাস, এটুকুই যথেষ্ট। এক জীবনে এর থেকেও বেশি কিছু কোনো মেয়ের ভাগ্যে থাকে না কী? দাম্পত্য জীবনে দুই পক্ষ থেকেই ভালোবাসা উতলাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এক পক্ষ থেকে যদি সম্পর্কটাকে সম্মান দিয়ে প্রতিনিয়ত উপচে পরে নিগূঢ় ভালোবাসা, তবে সেটুকুই যথেষ্ট সংসার ধর্মে আমৃত্যু একে অন্যের পাশে থাকার জন্য। কিন্তু আজ তার এই ভাবনাটা মন মানতে চাচ্ছেনা। মস্তিষ্কের নার্ভ গুলো ব্যস্ত হয়ে উঠেছে হিসাব মিলাতে, এই মানুষটাকে ভালোবেসে তার পূর্ণতার ঝুলিটা ভারী হয়েছে না কী দুঃখে ঘেরা অপূর্ণতার ঝুলি? কিন্তু এবারও ব্যর্থ হয় দৃষ্টি। হুট করেই মনের ব্যথাটা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পরে। তীব্র যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাবার উপক্রম হয়। বুক ভরে ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার অতি শখের পাথর হৃদয়ের পুরুষটার দিকে। যে এখনো তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে দৃষ্টিকে পরখ করে যাচ্ছে। দৃষ্টির একবার ইচ্ছে হয় নিজেকে এক্সপ্লেইন করতে। কিন্তু পর মুহূর্তে দমে যায় কিছু একটা ভেবে। মনে জমে থাকা বি’ষ টুকু মনের মাঝেই চেপে রেখে বহুকষ্টে মুখে উচ্চারণ করে,

“আ’ম স্যরি। অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে আমার।আর এমন হবেনা।”

রক্তিমের অতৃপ্ত হৃদয়টাকে তৃপ্ত করতে নিজেকেই ভুল প্রমাণ করে দৃষ্টি চুপচাপ কেটে পরে সেখান থেকে। বুকে সদ্য জন্মানো বি’ষ ফোড়া নিয়েও কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব ধরে পুরো দমে কাজে মনযোগ দেয়। তার এমন শান্ত-স্বাভাবিক আচরণ রক্তিমকে কী একটুও ভাবায়না? একটুও বুঝেনা সে, তার কথায় মেয়েটা ঠিক কত বড়ো আঘাত পেয়েছে? কথার আঘাত যে মানুষকে মৃ’ত্যু’সম য’ন্ত্র’ণা দেয় এটা বোধহয় সত্যিই জানা নেই, এই পাথর হৃদয়ের অধিকারী পাষণ্ড মানবটার। জানলে নিশ্চয়ই এভাবে মেয়েটাকে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে সামনে থেকে চলে যেতে দিতনা।

চলবে….