#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৪(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
মেঘকন্যার আজ ভীষণ দুঃখ। নিজের দুঃখটাকে মনোষ্য জাতির নিকট জানান দিতেই কোনো আগাম বার্তা ছাড়া দুপুরের পর ঝমঝমিয়ে ঝর্ষণ নামিয়েছে ধরণীর বুকে। গুরুম গুরুম মেঘের ডাক ছাপিয়ে হঠাৎ হঠাৎ তীব্র বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ।শহরের বিভিন্ন জায়গায় পানি জমাট বেঁধে রাস্তা-ঘাটের অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। হাঁটু অব্দি পানি ডিঙিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হওয়া মানুষ গুলোকে। মাত্র দেড় ঘন্টার রাস্তা দীর্ঘ তিন ঘন্টায় অতিক্রম করে শিকদার মঞ্জিলের সামনে এসে রক্তিমের গাড়িটা থামে। আকাশ তখনও অঝোরে কেঁদে ধরণী ভাসাচ্ছে। আপন মানুষ গুলোকে নিয়ে অত্যাধিক চিন্তায় ভীষণ অস্থির হয়ে থাকা রক্তিম এক মুহূর্ত সময় ব্যয় না করে তড়িঘড়ি করে নেমে আসে গাড়ি থেকে। মূহুর্ত ব্যবধানে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে দেয় তার সর্বাঙ্গ। দু-দন্ড থেমে রক্তিম বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে হৃদয়ে চলা অস্থিরতাটুকু লাঘবের প্রয়াস চালাই।চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস টানতেই ভেজা মাটির গন্ধের সাথে নাকে লাগে আগর বাতির কড়া ঘ্রাণ।গন্ধটা খুব অদ্ভূত ঠেকে রক্তিমের কাছে। বাগানে থাকা অন্য কোনো ফুলের গন্ধ না এসে কোথা থেকে এতো তীব্রভাবে আগরবাতির গন্ধ আসছে? কপালে চিন্তার বলিরেখা সুস্পষ্ট রেখে বৃষ্টির পানিতে ঝপঝপ শব্দ তুলে ত্রস্ত পায়ে গেটের ভিতর এগিয়ে যায়। যত এগোচ্ছে ততই যেন অবাকের মাত্রা সীমা ছাড়াচ্ছে তার। আশ্চর্য!এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার বাড়িতে এতো মানুষের ভীড় কেন? সে এমপি মানুষ, একটা মিথ্যে মামলায় জেলে গিয়েছিল, আজ ছাড়া পেয়েছে দেখেই কী তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য মানুষজন ভীড় করেছে? কিন্তু তাই বলে কেউ আদালতে না গিয়ে বা তার পার্টি অফিসেও না গিয়ে সরাসরি এভাবে বাড়িতে ভীড় করবে? তাছাড়া ভীড় করলেই হলো না কী? দারোয়ান এতো গুলো মানুষকে এভাবে সরাসরি বাড়িতে কোন জ্ঞানে ঢুকতে দিল? বাড়ির ভিতর তার বউ-বাচ্চা, মা আছে। ওদের প্রাইভেসির একটা ব্যাপার আছে না? মাত্র কয়েক দিনের জন্য রক্তিম বাড়িতে নেই, আর এতেই সবাই নিজের দায়িত্ব নিয়ে হেরফের শুরু করেছে! সব কয়টাকে ছাটাই করতে হবে। এগুলো একটারও বোধহয় জানা নেই, শুধু দায়িত্ব নিলেই হয়না, যথাযথভাবে পালনও করতে হয়।
“গেটের ভিতর এতো মানুষ কেন জাবির? তোদের কি একটারও জ্ঞান-বুদ্ধি নেই?এতো গুলো অপরিচিত মানুষকে কোন আক্কেলে ঢুকতে দিলি তোরা?এদের মধ্যে থেকে কেউ যদি কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভিতর ঢুকে থাকে? মাত্র তিন মাস আমি বাসায় নেই, এতেই এই হাল! আমার ফ্যামিলির কোনো প্রাইভেসিই রাখলিনা তোরা!”
ভীষন রুষ্ট চিত্তে জাবিরকে বকতে বকতে আশেপাশে বিরক্তি নজরে তাকায় রক্তিম। আচমকা বাড়ির পূর্ব পাশে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে নজর যেতেই অত্যাধিক বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে থমকে দাঁড়ায়। আজিজ শিকদারের কবরের পাশেই ছয়-সাতজন মিলে নতুন কবর খুড়ছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত একটা দৃশ্য চোখের সামনে দেখে মস্তিষ্কের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। রক্তিম জমে যায় সেখানেই। ভুলে যায় কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করার কথা। শুধু নিরেট মস্তিষ্কে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে ঐদিকে। শোকাহত শিকদার মঞ্জিলের প্রতিটা কোণায় কোণায় ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে, রক্তিম চলে এসেছে। মেহেদী উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে বাড়ির ভিতর থেকে। জড়বস্তুর ন্যায় থমকে থাকা রক্তিমকে ঝাপটে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলে,
“আমি পারিনি।তোর আমানত রক্ষা করতে পারিনি আমি।পারিনি তোর সন্তানকে দেখে রাখতে। কোনোদিন মাফ করিস না তুই আমায়। সব দোষ আমার। আমি যদি আর একটু সচেতন থাকতাম তাহলে হয়তো আজ এই দিন আসতনা। আমার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে রে রক্তিম! ঐ অমানুষ গুলো কী কষ্টই না দিল বাচ্চাটাকে! কিভাবে ভুলব আমি ওর হাসি মুখ? কিভাবেই বা ভুলব ওর আজকের এই বীভৎস চেহারা? আমৃত্যু আমাকে যন্ত্রণা দিবে এই নিষ্পাপ মুখটা। আমার হায়াতটা ওকে কেন দিলনা আল্লাহ? ও তো ফেরেশ্তা ছিল। তবে কেন এতো কষ্টের মৃত্যু দিল আল্লাহ ফেরেশ্তাতূল্য বাচ্চাটাকে?”
মেহেদীর মুখে ‘তোর সন্তান’ কথাটা শুনে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতোই চমকে তৎক্ষণাৎ দূরে সরে যায় রক্তিম। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকে মেহেদীর দিকে। কন্ঠে অগাধ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কী আবোলতাবোল বলছিস তুই এসব? আমার সন্তান মানে কী? কার কী হয়েছে? রোদ্রিক কোথায়? দৃষ্টি! আর, আর ওর মাঝে বেড়ে ওঠা আমাদের দ্বিতীয় বাচ্চা!এসব হচ্ছে কী কেউ একটু ক্লিয়ারলি বল আমাকে। ঐখানে কবর খুড়ছে কার? হচ্ছে কী কেউ বলবি একটু আমাকে?এসব হেয়ালি আমি আর নিতে পারছিনা।”
পাগলের মতো আশেপাশে তাকায় রক্তিম। নয়ন জোড়া আকুল হয়ে খোঁজে প্রিয় কিছু মুখ। কিন্তু পায়না কারো সাক্ষাৎ। বুকের ভিতরটা হঠাৎ করেই ভীষণ বাজেভাবে মুচড়ে ওঠে। মস্তিষ্ক কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ফের ঘুরে তাকায় কান্নারত মেহেদীর দিকে। থমকানো নজরে শুধু তাকিয়েই থাকে। ইতিমধ্যে জায়গাটাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ভীড় জমিয়েছে এলাকার মানুষজন। কেউ কেউ আফসোস ঝেরে ফিসফিসিয়ে বলাবলি করছে, “আহারে! জেল থেকে ফিরে এসেই লোকটা সন্তান হারা শোক সহ্য করতে পারবে তো?” আবার কেউ কেউ বলছে, “ছেলেটার ভাগ্যই খারাপ। সেই যে কত বছর আগে থেকে একের পর এক কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে, এখনো ভাগ্য পরিবর্তন হলনা। এই দুঃখ মানবের বোধহয় দুঃখের সাথেই সন্ধী।” পিছন থেকে কাঁধে কারা হাতের স্পর্শ পেয়ে রক্তিম সম্ভিত ফিরে পেয়ে ঘাড় কাত করে। দেখতে পায় জাবির ছলছল চোখে তাকিয়ে তার দিকেই। কিছু একটা বলছে। কিন্তু রক্তিমের কান অবধি সেই কথাটা পৌঁছাচ্ছেনা। মস্তিষ্ক তার অসাঢ়। ফ্যালফ্যাল নজরে শুধু বোকার মতো তাকিয়ে আছে। একটু পর হাতে টান অনুভব করে জাবির আর মেহেদীর পিছু পিছু জড়বস্তুর ন্যায় এগিয়ে যায় বাড়ির পিছন দিকের খোলা জায়গাটাই। তেরপলের ছাউনি দিয়ে কিছুটা জায়গা ঘেরাও করা। বেড়ার একটা পাশ উঁচিয়ে রক্তিমের হাত ধরেই ছাউনির ভিতরে নিয়ে যায় জাবির। সাথে সাথে ভিতরের চিত্র দেখে রক্তিমের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। কোমর পযর্ন্ত চাদরে ঢেকে রাখা একটা অর্ধ গলিত লা’শ। দেহ ফুলে উঠেছে। মুখের ডান পাশ দিয়ে জ্বীভ বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে আসা জ্বীভের মাঝ বরাবর গোল একটা গর্ত। বাম চোখের মণি বীভৎসভাবে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাতে-পায়ের নক সব গুলো থেতলে দেওয়া। গলার কাছটাই লম্বা কাটা দাগের পাশাপাশি দুটো শিক ঢুকানোর চিহ্ন। নর পিশাচ গুলো ছোট্ট রোদ্রিকের ফুলের মতো কোমল দেহটাই অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রেখে দিয়েছে। প্রাণহীন দেহটাই একবার চোখ বুলালেই শক্ত, কঠোর হৃদয়ের একজন পুরুষও আৎকে উঠছে আঘাতের চিহ্ন দেখে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছে বাচ্চা ছেলেটার মৃত্যুর আগ মুহূর্তের যন্ত্রণাকাতর সময়টার কথা স্মরণ করে। না জানি কিভাবে তড়পেছিল বাচ্চাটা যন্ত্রণায়! না জানি একটু পানির জন্য কতটা আকুতি জানিয়েছিল অমানুষ গুলোর নিটক! মায়া হয়নি,একটুও মায়া হয়নি এই নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়েও নরপিশাচ গুলোর।
দাঁড়ানো অবস্থায় রক্তিম আচমকা শরীর ছেড়ে পরে যেতে নিলেই পিছন থেকে জাবির, মেহেদী, রাকিব সহ উপস্থিত আরও অনেকেই ঝাপটে ধরে। মুহূর্ত ব্যবধানে হুলস্থুল কান্ড ঘটে যায়। সন্তানের এমন করুণ পরিণতি সহ্য করতে না পেরে সর্বদা পাষাণ চিত্তে থাকা রক্তিম শিকদারের পাথুরে হৃদয়টাও আজ হার মেনে নেতিয়ে পরেছে। রক্তিমের অসাঢ় দেহটা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এসে দীর্ঘ সময় যাবৎ মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরাতে সক্ষম হয়।কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরও কেমন যেন অস্বাভাবিক শীতল আচরণ করে রক্তিম। কাঁদেনা এক ফোঁটা। অথচ চোখ দুটো তার রক্তাভ হয়ে আছে। বুকের ভিতরটাই চেপে আছে বাবা হয়ে সন্তানের নিথর বীভৎস দেহ দুচোখে দেখার যন্ত্রণা। ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও বাঃহিক দিক থেকে নিজেকে ভীষণ কঠোর প্রমাণ করে জ্ঞান ফেরার পর প্রথম মুখ খুলে রক্তিম অত্যন্ত ঠান্ডা সুরে মেহেদীকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“ওদের নিষেধ কর আমার ছেলেটাকে আর যেন কষ্ট না দেয়। ঐ ব্যথায় জর্জরিত শরীরটা যেন আর না ছুঁয় কেউ। যত দ্রুত সম্ভব জানাজার ব্যবস্থা কর।”
রক্তিম-দৃষ্টির ভালোবাসার প্রথম ফসল, আদরের সন্তান। যে সন্তানের মাধ্যমেই তাদের ভালোবাসার সেতুবন্ধন দৃঢ় হয়েছিল। যার মুখ থেকে দুজন প্রথম শুনেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্রুতিমধুর ডাক বাবা-মা। যে সন্তানের উজ্জল ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে ভেবে হাজারো নির্ঘুম রাত পার করেছে দৃষ্টি-রক্তিম। যে সন্তানের সামান্য একটু জ্বর হলেও কেঁদে-কেটে অস্থির হয়েছে দৃষ্টি। ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছেলের শিয়রে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো রাত পার করেছে রক্তিম। আজ রক্তিম-দৃষ্টির সেই আদরের সন্তান, সেই কলিজার টুকরা সাত রাজার ধন রোদ্রিকের শেষ গোসলটাও ভালোভাবে কপালে জুটেনি। শত আঘাতে জর্জরিত ছোট্ট শরীরটা পঁচে এমনভাবে ফুলে উঠেছে যে শরীরে পানি ঢালতেও দ্বিধা হচ্ছে মুরুব্বিদের। অর্ধ গলিত দেহটায় কোনোমতে শুধু বড়ই পাতা দিয়ে করা উষ্ণ গরম পানি ঢেলে জীবনের শেষ গোসল করিয়ে কাফন চড়িয়েছে। ফুলে উঠা শরীরে নির্দিষ্ট কাফনের কাপড়টুকু পযর্ন্ত ভালোভাবে হয়নি। কোনোমতে আঁটসাঁট করেই প্যাচিয়ে খাটিয়ায় তুলেছে। খাটিয়ার একপাশে রক্তিম, দিহান অপর পাশে মেহেদী, সাদেক সাহেব। ছোট্ট দেহের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে জানাজা শেষে নিয়ে যায় শেষ ঠিকানায়। যে ঠিকানায় চিরনিদ্রায় শায়িত হবে রক্তিম-দৃষ্টির আদরের সন্তান, শিকদার মঞ্জিলের প্রাণ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই পাজো কোলে করে শেষবারের মতো সন্তানকে কোলে নিয়ে কবরে নামে রক্তিম। ভীষণ যত্নে কিবলা মুখী করে শুইয়ে দিয়ে একে একে কাঁচা বাশ বিছিয়ে একটু একটু করে মাটি দিয়ে আজীবনের জন্য ঢেকে দেয় রোদ্রিকের দেহটা। সেই সাথে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলে রোদ্রিক নামের অস্তিত্ব। কবর দেওয়া সম্পন্ন হতেই একে একে সবাই চলে গেলেও মাটিতে হাঁটু লুটিয়ে বসে পরে রক্তিম। বুকের ভিতর চলা যন্ত্রণাটা আর ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে এই যন্ত্রণায় এই বুঝি এখনই তার মৃত্যু হবে। তার সন্তান, তার আদরের রোদ্রিক এই এখানে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে শুয়ে আছে। আর কখনো ইচ্ছে হলেও তাকে ঝাপটে কোলে নিয়ে চুমুতে চুমুতে নিষ্পাপ, হাসি হাসি মুখটা ভরিয়ে দেওয়া যাবেনা। আর তাকে পাপ্পা বলে ঐ মায়াবী মুখটা ডাকবেনা। কখনো বায়না ধরবেনা নতুন খেলনা এনে দিতে। কখনো জেদ করবেনা ‘পাপ্পার সাথে যাব” বলে। আর কাউকে প্রতি বেলা কাঁদিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হবেনা রক্তিমকে। ফিরতে একটু দেরি হলেই আর কেউ ফোন করে ভীষণ অভিমানে নিভু নিভু স্বরে বলবেনা, “পাপ্পা তুমি এখনো আসছোনা কেন? তোমার সাথে কাট্টি।” রোদ্রিক কেন্দ্রিক পুরোনা মধুর স্মৃতি গুলো যত স্মরণ হচ্ছে ততই নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে রক্তিমের। শেষ পযর্ন্ত মনের দহন সহ্য করতে না পেরে দুহাতে কবর আকরে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। এক সন্তানহারা শোকাহত বাবার করুণ আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। মুহূর্ত ব্যবধানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছন্দ পরিবর্তন হয়ে আকাশ কাঁদে ভীষণ আকুল হয়ে। রক্তিমের থেকে কিছু হাত দূরে দাঁড়িয়ে দিহান, মেহেদী, রাকিব, জাবির অসহায় নজরে তাকিয়ে দেখে এক সন্তানহারা বাবার পাগল পাগল দশা। তাদের কারো জানা নেই সন্তান হারানোর বেদনা ঠিক কতটা তীব্র। জানা নেই এক সন্তানহারা বাবাকে ঠিক কি বলে শান্তনা দেওয়া যায়। শুধু অসহায় চিত্তে রক্তিমের করুণ নিনাদ দেখে যাওয়া ছাড়া কারো কিচ্ছুটি করার নেই।
চলবে….
#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৪ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
যে ছেলেটাকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে মরনসম যন্ত্রণা সহ্য করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে, সেই আদরের পুত্রধন আর পৃথিবীর বুকে বেঁচে নেই, কথাটা শোনার পর সেই যে জ্ঞান হারিয়েছিল দৃষ্টি আর দুচোখ খুলে দুনিয়া দেখেনি। এর জন্য দায়ী অবশ্য মেডিসিনের তীব্র ডোজ। পেটের বাচ্চাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ডাক্তার দৃষ্টির শারীরিক অবস্থার সাথে মানানসই ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ক্ষণিকের জন্য মানসিক চাপ থেকে দূরে রেখেছে। যতক্ষণ ঘুমে থাকে ঠিক ততক্ষণ ভীষণ শান্ত। ঘুম ভাঙলেই শুরু হয় পাগলামি।নিজের গায়ে নিজেই বারবার আঘাত করে, পাগলের মতো চিৎকার করে এলোমেলো বিলাপ জুড়ে। মেডিসিনের প্রভাব কাটতেই ভারী চোখের পল্লব মেলে সিলিং এর দিকে কিছু পল ঠাই তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি। হুট করেই ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জাগ্রত হয়ে বুঝে উঠতে পারেনা বর্তমান পরিস্থিতি। একটু একটু করে নার্ভ সচল হতেই হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসে। শরীরে জড়ানো শাড়ির আঁচল ঠিক নেই। এভাবেই উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বাইরের দিকে অগ্রসর হতেই ঝাপটে ধরে দিলশান আরা। কিন্তু বিধিবাম! এই দৃষ্টি যেন ভিন্ন এক দৃষ্টি। যার মাঝে ভর করেছে কোনো এক অশোরে শক্তি। পারেনা দিলশান আরা মেয়েকে আটকাতে। ব্যর্থ হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“কে কোথায় আছো ওকে আটকাও!”
সন্তান হারা শোকে পাগল প্রায় দশা রক্তিমকে কোনোমতে সামলিয়ে দিহান, মেহেদী, জাবির তাকে নিয়ে সবেই বাড়িতে ফিরেছিল। ড্রয়িং রুমে শত আত্মীয়ের ভীড় মাড়িয়ে রক্তিম পা বাড়িয়েছিল উপরের দিকেই দৃষ্টির খোঁজে। ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে আসছিল মেয়েটার কথা স্মরণ হতেই। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য বারবার নিজেকেই অপরাধি মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, যদি দৃষ্টি নামক ঐ ভীষণ সরলা মেয়েটাকে তার অভিশপ্ত জীবনে না জড়াতো তবে বোধহয় এই অল্প বয়সে আজ তার ভাগ্যদোষে মেয়েটাকে সন্তান হারা বেদনা সহ্য করতে হতনা। হঠাৎ শাশুড়ির চেঁচামেচি শুনে সচকিত হয় রক্তিম। তড়িৎ নিজেকে সামলে দ্রুত কদমে এগিয়ে গিয়ে সিড়ির প্রথম ধাপেই উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছুটতে থাকা দৃষ্টিকে নিজের শক্ত বাহুডোরে আগলে নেয়। ধরা গলায় বলে ওঠে,
“দৃষ্টি! আমার কথাটা শুনো। পাগলামি করোনা। নিচে অনেক মানুষ। তুমি এমন করলে মানুষ কী ভাববে?”
রক্তিমের কথা গুলো দৃষ্টির কর্ণপাত হয়না। ভীষণ অস্থির হয়ে ছুটতে চায় সে রক্তিমের বাহুডোর থেকে। ধস্তাধস্তির মাঝেই চিৎকার করে প্রকাশ করে মনের আর্তনাদ,
“আমার রোদ্রিক, আমার কলিজার টুকরা! আমার রোদ্রিক কোথায়? ওরা কোথায় নিয়েছে আমার রোদ্রিককে? ও তো ছোট বাচ্চা। আমাকে ছাড়া একটুও থাকতে পারেনা। আমার রোদ্রিককে এনে দাও তোমরা। ও আল্লাহ! আল্লাহ গো, আমি কী এমন পাপ করেছি? কিসের জন্য তুমি আমার কোল খালি করলে? কোন নরপশু আমার ফুলের মতো নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে এভাবে আঘাত করল? আমার ছেলে আমাকে মাম্মা বলে আর ডাকেনা কেন? কেন আমাকে আর বিরক্ত করেনা? আল্লাহ গো আমি কী নিয়ে বাঁচব? তুমি কেন আমাকে মরন দিলেনা? আমার জীবনের বিনিময়ে কেন আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখলেনা? আমার রোদ্রিক! আমার সোনার ছেলে, আমার চাঁদের টুকরো কই? তোমরা এনে দাও আমার সন্তানকে। আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছি আমি। কেউ একটু রহম করো আমাকে।”
দৃষ্টি নিজের মাঝে নেই। এই দৃষ্টি কোনো এক পরিবারের সুখী বধূ না। না এই দৃষ্টি রক্তিম নামক এক পাষাণ পুরুষের প্রেমে দিওয়ানি। এই দৃষ্টি এক সন্তান হারা মা। যে মা হারিয়ে ফেলা সেই যকের ধনকে কখনো বুক থেকে আলগা করেনি সন্তান কষ্ট পাবে বলে। ছোট্ট দেহটা কখনো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেনি ব্যথা পাবে বলে। এক মুহূর্তের জন্য কখনো চোখের আড়াল করেনি মা’কে না পেয়ে কাঁদবে বলে। শত কাজ থাকলেও সর্বদা চোখে চোখে রেখেছে সোনার মানিককে। এই সন্তানের মুখেই তো প্রথম মা ডাক শুনে দৃষ্টির নারী জীবন ধন্য হয়েছে। কিভাবে ভুলবে সে এই সন্তানের কথা? কিভাবেই বা স্বাভাবিক একটা জীবন পার করবে প্রথম সন্তান হারিয়ে?সেই নারী ছেড়া ধনকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারেনি দৃষ্টি। তার পাগলামি বাড়বে বলেই তাকে গভীর ঘুমে রেখেই তার সাত রাজার ধনকে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে চিরতরে সমাধিত করে এসেছে।
দৃষ্টির পাগলামির সামনে রক্তিম নিজেও একটা সময় ব্যর্থ হয় নিজের ভিতরে চলা কষ্টটাকে সামলাতে। পুরুষালী ভীষণ রুক্ষ, কঠিন চোখ দুটোই জল গড়িয়ে পরে। পাগলপ্রায় দৃষ্টিকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলে ওঠে,
“রোদ্রিক আর কোথাও নেই দৃষ্টি। আর কখনো আসবেনা আমাদের সন্তান। বাবা হয়ে আমি নিজের কাঁধে চড়িয়ে ওকে শেষ ঠিকানায় রেখে এসেছি। নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি আমার কলিজার টুকরাটাকে। আগে শুধু শুনেছি, পৃথিবীর সবথেকে কষ্টের কাজ বাবা হয়ে সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া। আমি যদি সেই কাজটা করেও নিজেকে সামলাতে পারি, তুমি কেন পারবেনা পেটের বাচ্চাটার কথা ভেবে নিজেকে সামলাতে? একটু বুঝো আমার কথাটা! রোদ্রিক আল্লাহর মেহমান হয়ে গেছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গিয়ে সে জান্নাতে চলে গেছে। আমাদের তো এখন পাগলামি মানায়না। আমাদের এখন ওর জন্য দুহাত তুলে দোয়া করতে হবে। তুমি চাওনা আমাদের সন্তান ওপারে ভালো থাকুক? আল্লাহর কাছে ওর ভালো চাইবেনা? আর যে এখনো আছে আমাদের মাঝে! যার অস্তিত্ব তুমি টের পাচ্ছো নিজের মাঝে। তাকে সুস্থ রাখতে হবেনা? তাকে সুন্দর একটা পৃথিবী, সুন্দর একটা পরিবার, সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে হবেনা আমাদের? প্লিজ! একটু বুঝো লক্ষ্মীটি।”
“চাইনা। কিচ্ছু চাইনা আমি। কাউকে চাইনা। আর কোনো বাচ্চা চাইনা। আমি শুধু আমার রোদ্রিককে চাই। কোথায় রেখে এসেছেন আমার রোদ্রিককে? আপনি নিষ্ঠুর, পাষাণ আপনি। আপনার এই নিষ্ঠুরতা, পাষন্ডতা কেন শুধু আমার বেলায় থাকলনা? নিজের সন্তানের সাথেও কিভাবে এতো পাষাণ হলেন? কিভাবে ওকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসলেন? একবারও বুক কাঁপলনা আপনার? আমার সন্তানকে আমার থেকে কেন আলাদা করলেন? কখনো ক্ষমা করবনা আমি আপনাকে। কখনও না।”
রক্তিমের কান্নারত গলায় কথা গুলো শুনে হুট করেই দৃষ্টির আচরণ ভীষণ খ্যাপাটে হয়ে যায়। দুহাতে রক্তিমের নাক-মুখ, বুকে যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই এলোমেলো আঘাত করে কামড়ে ছুটে আসে রক্তিমের বাহু বন্ধন থেকে। হুট করে কামড়ের আঘাতে রক্তিম চমকে হাতের বাঁধন নরম করতেই সেই সুযোগে এক ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় দৃষ্টি। ড্রয়িং রুমে থাকা আত্মীয়রাও আচমকা তার এমন ছুটে যাওয়া দেখে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠে তাকে আটকাতে উদ্যত হওয়ার আগেই চোখের পলকে সদর দরজা ডিঙ্গিয়ে বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে সোজা পারিবারিক কবরস্থানে চলে যায়। সময়টা তখন সাজের বেলা হলেও বৃষ্টিমোখর আবহাওয়ার কারণে চারপাশে তখন স্বল্প আলোয় মিশে আছে এক ফালি অন্ধকার। রোদ্রিকের কবরের পাশে কিছুদিনের জন্য একটা বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করেছে, যাতে আঁধারের সুযোগ নিয়ে শিয়াল-কুকুর কবরের মাটি খুড়তে না পারে। দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আশপাশ তাকিয়ে নতুন কবরটা দেখতে পেয়েই আবারও এক ছুটে গিয়ে বসে পরে কবরের পাশে। এলোমেলো হাতে কবরের মাটি হাতরে করুণ আর্তনাদে লুটিয়ে পরে। একটা সময় চিৎকার থামিয়ে নিরবে কাঁদতে কাঁদতে ত্রস্ত দুহাতে খামচে কবরের মাটি খুড়তে শুরু করে। বিরবির করে বলতে থাকে,
“রোদ্রিক! বাবা এই তো মাম্মা চলে এসেছি। আর একটুও ভয় পাবিনা বাবা। মাম্মা তোকে এখনি অন্ধকার থেকে বের করে আনছি। কাঁদেনা বাবা। আর একটু সময় শুধু।”
দূর থেকে কবরস্থানে ছুটে আসতে আসতে দৃষ্টির এহেন পাগলামি দেখে চরম আশ্চর্যে হতবিহ্বল হয়ে যায় বাড়ির প্রত্যেকে। রক্তিম, দিহান কাল বিলম্ব না করে দৌড়ে এসে দুপাশ থেকে দুজন দৃষ্টিকে ঝাপটে ধরে কবরের উপর থেকে টেনে নিয়ে আসে। পুরুষালী দুটো দেহের সাথে নাজুক দৃষ্টি ব্যর্থ ধস্তাধস্তি করতে করতে গগনবিদারী চিৎকারের সাথে বলতে থাকে,
“তোমরা আমাকে নিওনা। আমার ছেলে কষ্ট পাচ্ছে। ও অন্ধকারে ভয় পেয়ে কাঁদছে। ও তো বাচ্চা ছেলে। কিভাবে থাকবে এই অন্ধকারে? আমাকে খোঁজছে ও। তোমরা এতো নিষ্ঠুর হওনা। আমাকে যেতে দাও ওর কাছে।”
সেই বৃষ্টিমোখর সন্ধ্যায় সন্তান বিয়োগে গভীর শোকে শোকাহত এক মায়ের করুণ আর্তনাদে ভারী হয় আকাশ-বাতাস। শহুরে ইট-পাধরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয় শোকের মূর্ছনা। উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মন কাঁদে, চোখ কাঁদে সন্তান হারা মায়ের করুণ নিনাদে। অবচেতন মন সৃষ্টিকর্তার নিকট খুব করে আর্জি জানায়, আর কোনো মা-বাবার আগে যেন সন্তানের মৃত্যু না হয়। আর কোনো মা’কে যেন সন্তান হারা শোকে এমন পাগল হতে না হয়। আর কোনো বাবার কাঁধে যেন সন্তানের ভারী লাশের বোঝা বহন করতে না হয়।
_____
কথায় আছে মানুষ মরলে না কী সৃষ্টিকর্তা তিন দিনের মাথায় আপনজনদের মনে পাথর চাপা দিয়ে দেয়। যার কারণে সজন হারানোর বেদনা ভুলে গিয়ে মানব জাতি সহজেই জীবনমুখি হয়ে পরে। ভুলে যায় অতি আপন, প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বামী, সন্তান, বাবা-মা, কিংবা ভাই-বোন হারানোর বেদনা। যদি না’ই ভোলা সম্ভব হতো তবে বোধহয় আপনজন হারিয়ে মানুষ এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে বাঁচতে পারতনা। আজ তিনদিন হয়েছে রোদ্রিক নেই। রোদ্রিক নামক ছোট্ট আদুরে বাচ্চাটার কোনো অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীর বুকে। যে শিকদার মঞ্জিল সর্বদা বাচ্চা ছেলেটার খিলখিল হাসির শব্দে মুখোরিত হয়ে থাকতো সেই শিকদার মঞ্জিলের প্রতিটা দেয়াল আজও তাকে হারিয়ে গভীর শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন। গোটা তিনটা দিন পার হয়ে গেলেও এক বিন্দু ভোলা সম্ভব হয়নি রোদ্রিক নামক ছোট্ট জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের কথা। উল্টো তাকে ঘিরে জড়ো হওয়া স্মৃতি গুলো বড্ড তাড়া করে বেড়ায় বাড়ির মানুষ গুলোকে। শয্যাশায়ী রেহানা বেগম নাতিকে ঘিরে মিষ্টি-মধুর স্মৃতি গুলো স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থতা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ।না আছে ঠিকঠাক খাবার খাওয়া না হচ্ছে ঠিকঠাক মেডিসিন খাওয়া। বাড়িতে প্রবেশ করতেই রক্তিমের চোখে ভাসে ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বসে রোদ্রিক তার খেলনা রিমোর্ট কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলছে। এই বুঝি খেলার ফাঁকে পাপ্পাকে দেখেই মিষ্টি হেসে দৌড়ে এসে কোলে ঝাপ দিবে। কিন্তু হয়না এমন কিছুই। ভ্রম কেটে গিয়ে মুহূর্তেই নিষ্ঠুর বাস্তবতা এসে টনক নাড়িয়ে জানান দিয়ে যায় রোদ্রিক নামের ছোট্ট আদুরে বাচ্চাটার কোনো অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীর বুকে। আর কখনো আসবেনা সে পাপ্পার কোলে। কখনো মিষ্টি সুরে পাপ্পা বলে ডাকবেনা। কথা গুলো স্মরণ হতেই রক্তিমের বুকটা এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ভারী হয়ে আসে। ইচ্ছে করে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ম-নিতী ভেঙ্গে মেয়েদের মতো চিৎকার করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে। কিন্তু পুরুষ মানুষের যে শত কষ্টেও কাঁদতে নেই!হয়তো তাদের জন্মই হয়েছে বুকের ভিতর কষ্টের পাহাড় চাপিয়ে রেখে আপন মানুষদের কথা ভেবে হাসি মুখে গোটা একটা জীবন পার করে দিতে।
ছোট্ট রোদ্রিকের আত্মার আগফেরাত কামনা করে আজ বড়ো করে মিলাদের আয়োজন করেছিল রক্তিম। দুটো এতিমখানার বাচ্চাদের খাওয়ানো সহ আশেপাশের মসজিদ গুলোতে যোহরের পর মিষ্টি মুখ করিয়ে দোয়ার আয়োজন করেছিল। কাছের-দূরের সমস্ত আত্মীয়স্বজন অপেক্ষায় ছিল এই দিনটার জন্যই। মিলাদ শেষ হতেই যে যার ঠিকানায় ফিরে যেতে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ফেলেছে। এটাই বোধহয় মানবজাতির নিয়ম। তাছাড়া আর কি’ই বা করবে? জীবন তো আর কখনো কারো জন্য থেমে থাকেনা। সে চলে তার আপন গতিতে। সেই জীবনের চলার তাগিদেই মনোষ্যকূলকেও ব্যস্ত হতে হয় কর্মমোখর জীবনে। একমাত্র দিলশান আরা,সাদেক সাহেব, দিহান,ইতি, মেহেদী ছাড়া বাকী সকল আত্মীয় একে একে চলে যেতেই বাড়িটা কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। বিগত তিনটা দিন তবুও আত্মীয়স্বজনের বিভিন্ন গল্পকথায় বাড়িটাতে প্রাণের স্পন্দন ছিল বলে মনে হয়েছিল। এখন যেন পুরো বাড়িটাই প্রাণহীন, নিস্তেজ হয়ে আছে। কারো মুখে কোন রা-শব্দ নেই। প্রথম দুদিন ভীষণ পাগলামি করে দৃষ্টিও গতকাল থেকে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। প্রাণহীন এক মৃত দেহের মতো চুপচাপ পরে থাকে ঘরের এক কোণে। সর্বক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে দেয়ালে টানানো রোদ্রিকের হাস্যজ্জ্বল ছবির দিকে। ছবিটা রোদ্রিকের পঞ্চম জন্মদিনের প্রোগ্রামে তোলা। বাবা-ছেলে গায়ে এক ডিজাইনের শুভ্র রঙা পাঞ্জাবী জড়ানো। মুখে অমায়িক হাসি লেপ্টানো দুজনেরই।পাশেই দৃষ্টি এক ধ্যানে তাকিয়ে বাবা-ছেলের দিকে। একদম পার্ফেক্ট একটা ফ্যামিলি ফটো। ছবিতে রোদ্রিকের গায়ে জড়ানো পাঞ্জাবীটা এখনো যত্ন করে তোলে রাখা ওয়ার্ড্রোবে। সব কিছুই আছে আগের মতোই। মাঝখান থেকে শুধু চলে গেল নিষ্পাপ প্রাণটা সবাইকে ফাঁকি দিয়ে না ফেরার দেশে। ছবিটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টি আচমকা দুহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। রক্তিম সবে মাত্র আসরের নামাজ শেষ করে ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে বাড়ি ফিরেছিল। হলরুমে দাঁড়িয়েই আচমকা দৃষ্টির করুণ কান্নার শব্দ শুনে নাভিশ্বাসে দৌড়ে আসে। পিছন পিছন ছুটে আসে বাকিরাও। নিজেদের রুমে ঢুকেই রক্তিম দেখতে পায়, দৃষ্টি প্রাণপণে চেষ্টা করছে দেয়াল থেকে ছবিটা নামিয়ে আনার জন্য। কিন্তু মেঝেতে দাঁড়িয়ে ছবিটার নাগাল পাচ্ছেনা। ব্যর্থ হয়ে বারবার নিজের চুল টেনে চিৎকার করে ক্লেশ মিটাচ্ছে। দৃষ্টির কান্ড পরখ করে রক্তিম ত্রস্ত ছুটে গিয়ে তাকে আগলে নিতে চায় নিজের সাথে। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ছিটকে সরে যায় রক্তিমের কাছ থেকে প্রায় অনেকটা দূরে। রোষানলে ফেটে পরে চ্যাঁচিয়ে ওঠে সর্বশক্তিতে,
“ছুঁবেননা আমায়। একদম ছুঁবেননা। আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার রোদ্রিক আমার কাছে নেই। শান্তি হয়েছে তো এবার আপনার? খুশি হয়েছেন আপনি? জমবে তো এবার আপনার রাজনীতি? মনে পরে কতবার অনুরোধ করেছিলাম এসব নোংরা রাজনীতি থেকে সড়ে আসতে? কেঁদে বুক ভাসিয়ে পায়ে পযর্ন্ত পরেছি, হাত জোর করে বলেছি এসব থেকে ফিরে আসুন। কিন্তু শুনলেন না আমার কথা। শেষ পযর্ন্ত আমার ছেলেটাকে আপনার এই সো কল্ড রাজনীতির নোংরা খেলায় বলির পাঠা বানালেন। আপনার ক্ষমতার লোভে বলি হলো আমার নিষ্পাপ ছেলেটা। আপনার কাছে আপনার রাজনীতিই সব। আমি বা আমার ছেলের কোনো দামেই কখনো ছিলনা। আজও আপনার কিচ্ছু আসে যায়না আমার ছেলে মরলো বলে। কারণ আপনি তো ঠিক আছেন। ফিরে এসেছেন সুস্থভাবে জেল থেকে। আবার দাপটের সাথে রাজনীতি করে বেড়াবেন। একটুও মনে পরেনা আমার ছেলেটা কত রাত কেঁদে ফোন করে তার পাপ্পাকে বাড়ি আসতে বলতো? কতদিন আবদার করতো পাপ্পার সাথে খেলবে বলে! কিন্তু তার পাপ্পার কাছে তো রাজনীতিই সব। নিজের সন্তানের থেকেও প্রিয় এই রাজনীতি। আমি ভাবতাম আপনি যেমন স্বামীই হোন না কেন, খুব ভালো বাবা হবেন। আমার সাথে যত অন্যায় অবিচার করেছেন, কখনো এর জন্য কোনো অভিযোগ করিনি আমি। মুখ ফুটে কখনো নিজের শখ,আহ্লাদের কথা বলিনি। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল মুখে স্বীকার না করলেও আপনার জীবনে আমার মূল্য আমার সন্তানের মূল্য অপরিসীম। পৃথিবীর কোনো লোভের মুখে পরে আমাদের আপনি হারাবেননা। কিন্তু দিন শেষে আজ আমি মিথ্যে, আমার সমস্ত ভাবনা মিথ্যে। আমার আগেই ভাবা উচিৎ ছিল, যে লোক নিজের স্ত্রীর মন রাখতে জানেনা সেই লোক আর কি’ই বা সন্তানের কদর বুঝবে? গোবরে যেমন পদ্ম ফুটেনা তেমন নিষ্ঠুর হৃদয়ে কখনো মায়ার জন্ম হয়না। আমার সন্তানের প্রকৃত খুনী আপনি, আপনার রাজধানী নামক নোংরা খেলার জন্যই আজ আমার সন্তান এই পৃথিবীতে নেই। কখনো ক্ষমা করবনা আমি আপনাকে।আমার বা আমার সন্তানের সাথে জড়িত আপনার কোনো স্মৃতি চিহ্ন আমি রাখবনা। থাকবোনা আমি এই সংসারে। যে সংসারে আমার সন্তান নেই, যার জীবনে আমার কথা, ইচ্ছে- অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই তার জীবনে তার সংসারে আমি আর এক মুহূর্তও থাকবনা। আমার ছেলের খুনির সাথে বছরের পর বছর এক ছাদের নিচে আমি থাকতে পারবনা। আপনি আমাকে ডিভোর্স দিবেন। আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল আপনাকে ভালোবাসা। আপনার জীবনে জোর করে প্রবেশ করেছি দেখেই আপনি আজ আমার এতো বড়ো ক্ষতি করে প্রতিশোধ নিলেন।আমি আর কষ্ট চাইনা। সহ্য হয়না আর আমার। বিশ্বাস করুন, সহ্য করতে করতে হাপিয়ে গেছি আমি। নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয় আজ আমার। অন্তরটা জ্বলে যায়, যখন মনে পরে যার জন্য বছরের পর বছর নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়ে সংসার নামক জেলখানায় বন্দি হয়েছি সেই মানুষটার জীবনে আমার এক বিন্দু মূল্য নেই। আমার সন্তানের জন্য কোনো মায়া নেই ঐ পাষন্ডের বুকে। আমি একটা বর্বর, নিষ্ঠুর, বেঈমান, হৃদয়হীন পাষন্ডকে ভালোবেসে এসেছি এতোদিন ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতিই। আমাকে মুক্তি দিন এই ঘৃণার জীবন থেকে। মুক্তি দিন দয়া করে। না হয় মরে যাব আমি। দম বন্ধ হয়ে সত্যি সত্যি মরে যাব।”
বুকে চলা তীব্র যন্ত্রণায়, ক্লেশে পাগলের মতো বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরে দৃষ্টি। দৃষ্টির একের পর এক অভিযোগের মুখে পরে রক্তিম বাকরুদ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য নজরে শুধু তাকিয়ে দেখে তার লুটিয়ে পরা। অসাঢ় মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাই শুধু বারবার দৃষ্টির বলা কথা গুলোই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ভুলে গিয়েছে এই পরিস্থিতিতে তার ঠিক কী করনীয়। দৃষ্টিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে পরে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে না কী তার কথার আঘাতে হৃদয়ে সৃষ্টি হওয়া সদ্য ঘায়ের টনটনে ব্যথায় ছটফট করবে? নির্বোধের ন্যায় শূণ্য মস্তিষ্কে ঠাই দাঁড়িয়ে রক্তিম শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে দেখে দৃষ্টির আচমকা পরে যাওয়া। ভাগ্য সহায় ছিল বলেই বোধহয় খাটের পাশেই ছিল দৃষ্টি। জ্ঞান হারিয়ে পরেছেও খাটের মাঝে। তবুও অল্প আঘাত পেয়েছে কপালের এক পাশে খাটের কোণায় লেগে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টির অভিযোগ গুলো বাড়ির বাকিরা শুনে আগ বাড়িয়ে আর ভিতরে আসেনি কেউ। ভেবেছিল স্বামী-স্ত্রী দুজনের মান-অভিমানের পালা দুজেনেই সামলে নিবে। রক্তিম ঠিক নিজের ভালোবাসার জালে আটকে অশান্ত দৃষ্টিকে শান্ত করে ফেলবে। কিন্তু হুট করে পরে যাওয়ার শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে সকলেই ছুটে এসে দৃষ্টিকে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে আৎকে উঠে। মেয়ের নিস্তেজ মুখের দিকে তাকিয়ে দিলশান আরা কেঁদে ওঠে। দিহান বোনকে সোজা করে শুইয়ে দিতেই ইতি সেন্টার টেবিলে থাকা গ্লাস থেকে পানি নিয়ে অল্প অল্প করে ছিটিয়ে দেয় দৃষ্টির চোখ-মুখে।প্রায় দশ-পনেরো মিনিট নানাভাবে চেষ্টার পর চোখ মেলে তাকায় দৃষ্টি। কয়েক মিনিট স্থির থেকে ফের অধৈর্য হয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসে দেয়ালে টানানো ফ্যামিলি ছবিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিহানকে বলে,
“ভাই! ভাই আমাকে ছবিটা নামিয়ে দে না প্লিজ! অন্তত আমার এই কথাটা শোন। একটু নামিয়ে দে।”
বোনকে শান্ত করতে দিহান বাধ্য ছেলের ন্যায় ছবিটা নামিয়ে দিতেই দৃষ্টি কিছু পল এক দৃষ্টিতে হাস্যজ্জ্বল ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা চোয়াল শক্তি করে দেয়ালে সজোরে আচড়ে ফেলে। মুহুর্তেই ফ্রেমে বন্দি ছবিটার কাচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তড়িৎ দৃষ্টি কাচ সরিয়ে ছবিটা হাতে নিয়ে একটানে রক্তিমের চেহারার পাশটা ছিঁড়ে ফেলে। পরপর অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে বিরবির করে বলে ওঠে,
“যার জীবনে আমাদের কোনো মূল্য নেই, তাকে এভাবেই মুছে ফেলব আমাদের জীবন থেকে। কোথাও বেঈমান, হৃদয়হীন পুরুষের কোনো অস্তিত্ব রাখবনা।”
আহত বদনে রক্তিম শুধু তাকিয়ে দেখে দৃষ্টির পাগলামি। মন বলে এই দৃষ্টি তার পরিচিত সেই দৃষ্টি না, যে দৃষ্টির চোখে সর্বদা তার জন্য থাকতো এক আকাশ সম ভালোবাসা। কোথায় হারিয়ে গেল রক্তিম নামক এক পাষাণ পুরুষের প্রণয়ে উন্মাদ সেই ভীষণ স্নিগ্ধ, সরল, মায়াবী দৃষ্টি? কী করলে ফিরে পাবে রক্তিম আবার সেই পুরোনো তার প্রাণেশ্বরীকে? এই সম্পূর্ণ অচেনা দৃষ্টির এতো কঠোর রূপ যে রক্তিমের সহ্য হচ্ছেনা। ভিতরটা ভীষন বাজে ভাবে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে এই অচেনা দৃষ্টির এক একটা ধারালো কথার আঘাতে। মনে হচ্ছে রক্তিম সর্বত্র হারিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে কোনো এক আঁধারে। যে অন্ধকার থেকে একটা সময় ছন্নছাড়া রক্তিমকে দৃষ্টি নিজের ভালোবাসার মায়াজালে বন্দি করে ফিরিয়ে এনেছিল আলোর পথে, সেই একই অন্ধকারে কী আবার তাকে দৃষ্টি নিজেই ভীষণ অবহেলায় তলিয়ে যেতে দিবে? আর কিচ্ছু ভাবতে পারেনা রক্তিম। মাথাটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। শরীরটাও কাঁপছে কেমন থরথর করে। আর বুকের ভিতরে বয়ে চলা তীব্র ঝড়! এ ঝড় যে হৃদয়পুরে কতটা বিধ্বংসী তান্ডব চালিয়েছে তা একমাত্র রক্তিম জানে আর জানে তার অন্তর্জামি।
চলবে…..