একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-২৬

0
16

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৬
#আদওয়া_ইবশার

এই সময় বোধহয় শিকদার মঞ্জিলে অতসী মিলিকে প্রত্যাশা করেনি মোটেও।যেটা তার চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছে।এরপরও নিজেকে সামলে মুখে জোরপূর্বক মুচকি হাসি টেনে জবাব দেয়,

“ভালো আছি আপু। আপনি কেমন আছেন?”

“আমি অলয়েজ ভালো থাকি। আসো ভিতরে আসো!”

“বাকিরা কোথায়?”

বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করেই দেখতে পায় সকলেই খাবার টেবিলে উপস্থিত। যা দেখে অতসী উদগ্রীব হয়ে বলে ওঠে,

“আরে রান্না কে করলো? আমি তো খাবার নিয়ে এসেছি সবার জন্য!”

অতসীর গলার আওয়াজ পেয়ে সকলের উৎসুক নজর এসে স্থির হয় তার দিকে। সাদেক সাহেব মুচকি হেসে বলেন,

“তুমি আবার কেন কষ্ট করতে গেলে মা? আমরা চলে যাব শুনে মিলি সেই ভোরে এসে নিজের হাতে সব রান্না করেছে।মেয়েটার রান্নার হাত দারুণ।”

ঝুপ করেই এক ফালি মন খারাপ এসে চারপাশ থেকে ঝাপটে ধরে অতসীকে। এতো উৎসাহ নিয়ে যাদের জন্য সে রান্না করে আনলো তারাই কী না তার খাবার গুলো গ্রহণ করার আগেই অন্য একজনের প্রশংসায় ব্যস্ত! নারী মন এতে কী ঈর্শান্বিত হবেনা? এক মুহূর্তের জন্য মিলি মেয়েটাকে অতসীর কাছে ভীষণ অসহ্যকর ঠেকে।ঐ হাসি হাসি সুশ্রী মুখটার দিকে তাকিয়ে হিংসায় জ্বলেপুড়ে আঙ্গার হতে চায় অতসীর অবচেতন মন। বারবার মনে হয় মিলি মেয়েটা তার স্থান কেড়ে নিতে উঠেপরে লেগেছে। অথচ সেই প্রথম থেকেই মিলি অতসীর সাথে অমায়িক আচরণ করছে। দেখা হলেই কী সুন্দর হেসে কাছে টেনে নিচ্ছে! তবুও কেন অতসীর এমন মনে হচ্ছে? আর তার স্থানই বা কী এই মানুষ গুলোর মাঝে? সে তো এই বাড়ির এমন কেউ না যে তার জায়গা অন্য কেউ কেড়ে নিলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তার।তবুও কেন বেহায়া, অপদার্থ মন এতো হিংসায় জ্বলছে? এমন হিংসুটে মন তো অতসীর কখনো ছিলনা। অতসীর হাসি হাসি মুখটা হুট করেই নিভে যেতে দেখে দিলশান আরা বুঝতে পারে মেয়েটার হয়তো মন খারাপ হয়েছে। স্বামীর জ্ঞানহীন কান্ড দেখেও বিরক্ত হয় স্বামীর প্রতি। এটা কেমন আচরণ সাদেক সাহেবের? মেয়েটা এতো কষ্ট করে রান্না করে বাড়ি বয়ে তাদের জন্য নিয়ে আসল। আর তার সামনেই কী তার তার খাবারের কদর না করে অন্য এক মেয়ের রান্নার প্রশংসা করছে! দিন দিন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়ে কিন্তু দিলশান আরার মনে হচ্ছে এই লোকের বুদ্ধি দিন দিন তরতর করে হাঁটুর নিচে নামছে। স্বামীর দিকে কড়া নজরে এক পলক তাকিয়ে দিলশান আরা অতসীর আঁধারে ঘেরা মুখটাই দৃষ্টিপাত করেন। চমৎকার হেসে বলে ওঠেন,

“আসো তো দেখি কী রান্না করে নিয়ে এসেছো!তোমার মায়ের হাতের রান্নাও কিন্তু দারুণ। ময়মনসিংহ গিয়ে মিস করব খুব এতো মুখরোচক রান্না।”

ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে অতসী আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়।একে একে খাবারের বক্স গুলো খুলে টেবিলে রাখতেই দিলশান আরা ফের হেসে বলে ওঠেন,

“আরেহ্ হাঁসের মাংস! এটা তো দিহানের সবথেকে পছন্দের খাবার। হাঁসের মাংস ভুনা হলে এই ছেলের আর কিচ্ছু লাগেনা।একদম হাত চেটেপুটে খাবে।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই অতসীর কী যেন হলো। হুট করেই মৌনতা ভেঙ্গে স্পষ্ট সুরে বলে ওঠে,

“আমি জানতাম দৃষ্টি আপুর হাঁসের মাংস পছন্দ। আপুর জন্যই তাই এটা রান্না করে নিয়ে এসেছি। আর কারো পছন্দের বিষয়ে আমি জানিনা।”

খাওয়া থামিয়ে দিহান ত্যারা নজরে এক পলক অতসীর দিকে তাকায়।ফের নজর হটিয়ে উঠে যেতে যেতে মিলির দিকে তাকিয়ে মুখ ভরে হেসে বলে,

“মিলি! এমন খাবার মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়ালে মন্দ হয়না। হুটহাট লাঞ্চে অফিসে নিয়ে গিয়ে তৃপ্তি ভরে খাওয়ার সুযোগ করে দিলে এই বান্দা আজীবন কৃতার্থ থাকবে আপনার প্রতি ম্যাম।”

“হুটহাট কেন? তুমি বললে প্রতিদিনই রান্না করে নিয়ে যাব।পরে আবার ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে আমার খাবার নষ্ট করতে পারবেনা কিন্তু!”

অতসীর এই মুহূর্তে দুটোকেই ভীষণ ন্যাকা মনে হচ্ছে।গা জ্বলছে তার এদের কথার ধরণে। মনের বিতৃষ্ণা ফোটে উঠেছে চোখে-মুখেও। যেভাবে আহ্লাদে আটখানা হয়ে একজন আরেকজনকে কথা গুলো বলছে মনে হচ্ছে যেন জনম জনমের আপন মানুষ।

“ওঠে পরলি কেন?হাঁসের মাংসটা টেস্ট করে দেখ।”

“পেট ভরে গেছে মা। তাছাড়া আমি যারতার হাতের রান্না খাইনা এটা তুমি জনো। তোমরা খেয়ে নাও।”

দিহানের এহেন শ্লেষাত্মক জবাবে আচমকা অত্যাধিক রাগে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে অতসী। নাক ফুলিয়ে কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে ওঠে,

“আমিও কাউকে খাওয়ার জন্য জোর করিনি। স্পেশালি যাদের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি তারা খেলেই আমি সন্তুষ্ট আন্টি। অন্য কেউ খেলো কী না খেলোনা এতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা। আপনাদেরও যদি অসুবিধা হয় তবে খেতে হবেনা। খাবার যেভাবে নিয়ে এসেছি সেভাবেই নিয়ে যাব।”

বহুক্ষণ পর এবার নিরব হয়ে থাকা রক্তিম ভীষণ বিরক্ত নিয়ে মুখ খুলে,

“বাচ্চা তোমরা দুজন? আচরণে তো মনে হচ্ছে দুজন রোদ্রিকের থেকেও ছোট। সমস্যা কী তোমরা দুজনের?”

রোদ্রিক!আপন মানুষ,নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আদুরে প্রাণটা চিরতরে হারিয়ে গেলেও তার নামটা ঠিক এভাবেই এখনো শিকদার মঞ্জিলের মানুষ গুলোর মুখে উচ্চারিত হয়। মাঝে মাঝেই ভুলে যায় মানুষ গুলো বাচ্চা ছেলেটা আর তাদের মাঝে নেই। রক্তিম অবচেতনে ছেলের কথা স্মরণ করলেও হঠাৎ বতর্মান পরিস্থিতি মনে করে চকিতে ফিরে তাকায় মুখে কূলুপ এঁটে নিচু হয়ে শুধু খাবার নাড়াচাড়া করা দৃষ্টির দিকে। সাথে সাথে দেখতে পায় মেয়েটা কেমন ছটফটিয়ে ওঠছে। অস্বাভাবিকভাবে ঠোঁট ফাক চেষ্টা বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিচ্ছে।দুচোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পরছে অশ্রুজল। মুহূর্ত ব্যবধানে ডাইনিং রুমের কোলাহলপূর্ণ পরিস্থিতিটা বদলে গিয়ে গুমোট একটা রূপ নেয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে সকলের মাঝে। এই বুঝি মেয়েটা আবার পাগলামি শুরু করে। কিন্তু ভীষণ আশ্চর্যের সাথে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দৃষ্টি হুট করে সামলে নেয় নিজেকে।তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে প্লেটে থাকা খাবার গুলো মুখে পুরতে থাকে। মুখ ভরে খাবার নিয়ে চিবুতে গিয়ে আচমকা কেশে ওঠে। তড়িৎ রক্তিম নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠে গিয়ে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেয় দৃষ্টির মুখের কাছে। রক্তিমের বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাসটা না নিয়ে দৃষ্টি নিজে হাত বাড়িয়ে অন্য একটা গ্লাস নিয়ে ধীরস্থির ভাবে পানিটুকু খেয়ে ওঠে দাঁড়ায়।ক্ষীণ স্বরে দিলশান আরা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি। তোমরা একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।এমনিতেই দেরী হয়ে যাচ্ছে আমাদের।”

অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে ধীরগতিতে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। বাকী সবার অবাক নজর তার দিকেই। একটু একটু করে দৃষ্টি চোখের আড়াল হতেই ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিম নিজেও ওঠে যায়। নিরব পদচারনায় রুমে ঢুকে দেখতে পায় তাড়াহুড়ো করে তৈরী হতে ব্যস্ত দৃষ্টি। হুট করেই মেয়েটার মাঝে কেমন চঞ্চলতা চলে এসেছে!দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন বন্দি থাকার পর হঠাৎ শেকল ছেঁড়ার আভাস পেয়ে মুক্তির আশায় এতো ছটফটানি।

চলবে….