সুতো কাঁটা ঘুড়ি পর্ব-০১

0
12

#সুতো_কাঁটা_ঘুড়ি 🪁
#সূচনা_পর্ব
#শেখ_সাদিয়া_স্বীকৃতি

প্রথম স্ত্রী স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে বরণ করে ঘরে তুলছে আর সেই ঘটনার সাক্ষী হতে এসেছে গ্রামের জোয়ান-বুড়ো সকলে। মেয়ের এই দুর্দশা দেখে মিজান আকবর খান চেয়ারে বসে কপাল চাপড়ে কাঁদছেন। ইতোমধ্যে লোকমুখে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে আর বাড়ির সকলে তা বিনাবাক্যে শ্রবণ করে চলছে। এছাড়া আর কারোরই কিছু করার নেই, বলারও নেই। কোন মুখেই বা বলবে! যা হচ্ছে তার জন্যে তো তারা-ই দায়ী।

নিজের স্বামী ও তার সদ্য বিয়ে করা দ্বিতীয় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে হিয়া স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– ভেতরে আসুন।

তিক্ততায় চোখ বুঁজে এলো মেঘের। যেই প্রথাকে সে সবসময় ঘৃণা করে এসেছে আজ সেই প্রথা তারই মাধ্যমে আরো একধাপ সামনে এগিয়ে এলো। পানের বোটা থেকে চুন মুখে নিয়ে বৃদ্ধা শামসুন্নাহার তার ছেলের বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– বউয়ের কপালে চুমু খাও ছোট বউ।

জবাবে বেগম রাশেদা মুখ বিকৃত করে অত্যন্ত রুক্ষ স্বরে বললেন,

– কক্ষনো না আম্মা! যেই মেয়ে আমার ফুলের মতো বউয়ের কপাল পুড়লো তার কপালে চুমু খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে নাহ্!

শামসুন্নাহার প্রতিবাদী হয়ে বললেন,

– ভুইলা যাইয়ো না তুমি নিজেও রমজানের দ্বিতীয় পক্ষ।

– আহা আম্মা, শুধু শুধু পুরনো কথা তুলে অশান্তি বাড়ানোর মানে হয় না!

– তুমি চুপ থাকো বড় বউমা! যখন কথা বলার ছিলো তখন তো কিছু বলবার পারো নাই। তাই এখনও চুপ মাইরা থাকো।

ঝর্ণা বেগম আর কথা বলার সাহস পেলেন না। অতঃপর বেগম রাশেদাকে উদ্দেশ্য করে কাঠকাঠ গলায় আদেশ করলেন,

– শুইনা রাখো ছোট বউ, ঐ মাইয়ার কপাল ডা মেঘ পোড়ায় নাই পোড়াইছো তুমি। আমি চাই না বাইরের লোকের সামনে বাড়ির ভেতরের কেচ্ছা রটাক। তাই যাও ছোট নাতবউয়ের কপালে চুমু খাইয়া তারে ঘরে নিয়া আসো। এইডা এই বাড়ির রীতি। তাছাড়া বেলা ফুরাইছে তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরতে হইবো। তোমার বেটার কারবার রমজান এখনও জানে নাহ্।

অগত্যা বাধ্য হয়ে বেগম রাশেদা নতুন বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসলেন। হিয়া তখনো চৌকাঠের সামনে নির্জীব হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে।

– আহারে এতো লক্ষী মন্ত বউডাও শেষে সতীনের সংসার করবো!

– মেঘের মতো শিক্ষিত মাইয়া কি এইডা ঠিক করলো!

– আরে থও ফালাইয়া। মেঘের কি দোষ? গেরামের বেক্কলে জানে যে মন্ত্রীর বেটা আর মেঘের ছোটকাল থেইকা প্রেম পিরিতের সম্পর্ক। দুইজনের বাপ-মা’র লাইগ্যাই শেষে তিন তিনডা জীবন চুলায় পুড়লো ছ্যাহ্!

আশেপাশের লোকদের কথা যেন হিয়ার কাটা ঘায়ে নুনেরছিটে দিচ্ছে। সে আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সোজা চলে যায় তার স্বামীর সন্ধানে। একে একে সবাই যে যার মতো চলে গেলো। বাদ রইলো শুধু মেঘ আর তার কান্নারত বাবা। কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বললো,

– আমি সব রবের ভরসায় ছেড়ে দিয়েছি বাবা। তুমিও মেনে নাও।

মিজান খান মেয়ের হাত ধরে মাথানিচু করে বললেন,

– মা রে! কেন রাজী হলি? আমার জীবন তো শেষ মা। তুই কেন আমার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করলি?? এই বোঝার ভার আমি কিভাবে সইবো!

মেঘ মলিন হেসে তার বাবার কোলে মাথা রেখে বললো,

– ভাগ্য কি বদলানো যায় বাবা? এতকিছু করে যার থেকে আলাদা করতে চাইলো, ভেঙেচুরে দেখো আমি তার সাথেই জুড়ে গেলাম। তবে পূর্ণতায় নয় তিক্ততায়!

|

বাগানের আরামকেদারায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে রুদ্র। বরণ পর্ব শেষ হওয়ার সাথে-সাথেই সে এখানে চলে এসেছে। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। সারাদিনের ধকলে শরীর টাও ক্লান্তিতে ছেয়ে গেছে। বাড়ির এপাশটা সবসময় শান্ত নিরিবিলি থাকায় তার খুব পছন্দের। তাই গাছগাছালির নির্মল হাওয়ায় মনকে সতেজ করার জন্য এখানে চলে এসেছে।

– আপনি আমার সাথে এমনটা কেন করলেন রুদ্র?

চোখ মেলে ক্লান্ত চাহনি মেলে সামনে তাকায় রুদ্র। আধখোঁপা চুল, এলোমেলো শাড়ি আর কান্নারত চেহারায় হিয়াকে একপ্রকার বিধ্বস্ত রমনী লাগছে। তপ্তশ্বাস ফেলে রুদ্র বললো,

– ব্যাগ গোছাও। কিছুক্ষণ পরেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হবো।

– কথা ঘোরাচ্ছেন?

– এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি এখন প্রস্তুত নই।

– আমি জানতাম বিয়ের আগে আপনার সাথে মেঘের সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিলো আপনি আমায় ভালোবাসবেন। যখন ভালোই বাসবেন না তখন আমায় বিয়ে কেন করলেন? (গলা উঁচিয়ে)

– যখন সবটাই জানতে তাহলে কেন রাজী হলে?? কিসের স্বার্থে কোন আশায় বলো? (চিৎকার করে)

কেঁপে উঠলো হিয়া। চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই ছুটে চলে আসে এদিকে। রুদ্র সবার দিকে আঙুল তাক করে বললো,

– প্রশ্ন তোমার মুখে মানায় না হিয়া। বিয়ের আগে সব জেনে যাওয়ার পরেও যদি তোমার মনে প্রশ্ন জাগে, সেই প্রশ্ন এদেরকে করবে।

……………………..
দোতলার জানালা থেকে সবটাই দেখছে মেঘ। কান্নারত হিয়ার সাথে চোখাচোখি হলে হিয়ার চোখে নিজের জন্য তীব্র ঘৃণা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। হতাশার হাসি হাসে মেঘ। একটা সময় ছিলো যখন সে খুব করে চাইতো রুদ্রের বউ হতে। পাগলের মতো ভালোবাসতো দু’জন দু’জনকে। হঠাৎ একটা ঝড়ে তাদের সাজানো গোছানো ভালোবাসার বানানটা দুমড়ে-মুচড়ে মাটিতে মিশে যায়। আর তারপর সেখান থেকে জন্ম নেয় ঘৃণার সতেজ চারাগাছ। ধীরেধীরে সেই গাছের শিকড় এতটাই গভীরে চলে যায় যে আজ নিজেকে রুদ্রের বউ ভাবতেই তার গা গুলিয়ে আসছে।

শত্রুর প্রতি জমে থাকা ঘৃণা দূর করা যায়। কিন্তু প্রিয়জন যখন চরম শত্রু হয়ে ওঠে তখন তার যে প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয় তা রয় আমৃত্যু। এই ঘৃণার ভার হয় আকাশ সমান, অতলস্পর্শী।
……………………..

বেগম রাশেদা ছেলের কাজে এমনিতেই রেগে ছিলেন৷ এখন আবার হিয়ার সাথে এমন ব্যবহার করায় আরও ক্ষেপে গেলেন তবে রুদ্রের উপর নয় মেঘের প্রতি। বিনাবাক্য ব্যয়ে সে হিয়াকে সাথে নিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। রুদ্র পুনরায় চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে নিল। রুদ্রের এমন ‘কিছুই হয়নি’ মনোভাব দেখে মেঘের ঘৃণার জোয়ারে সহ্যসীমার বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। কয়েকঘন্টা আগের সেই কুৎসিত ঘটনাটি মানসপটে নাড়া দিতে থাকে বারবার।

কয়েকঘন্টা আগে~

*
*
গ্রামের সবার সামনে রুদ্রের পা জড়িয়ে ধরে মেঘ অসহায় কন্ঠে বললো,

– আমার বাবাকে বাঁচা রুদ্র ভাই! প্রয়োজনে আমি সারাজীবন তোদের বাড়ির কাজের লোক হয়ে এই ঋণ শোধ করবো।

গম্ভীর রুদ্র চেয়ার ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। পড়নের সাদা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

– চাকর-বাকর হতে হবে না। কাজী আসছে, তুই একদিক দিয়ে কবুল বলবি অন্যদিক দিয়ে তোর বাবার প্রাণ রক্ষা পাবে।

মেঘ হতবিহ্বল হয়ে বললো,

– কার সাথে বিয়ে দিতে চাইছিস তুই আমায়!?

– আমার বর্তমানে কার সাহস আছে তোকে বিয়ে করার?

চমকে উঠলো চৌচালা ঘরের বারান্দায় অবস্থানরত হিয়া। যে কি-না মন্ত্রী রমজান মোস্তাফা খানের একমাত্র ছেলে রুদ্রের বিবাহিতা স্ত্রী। বিস্ময়ে কয়েক পলক হিয়ার দিকে চেয়ে থেকে মেঘ কিছুটা ঝাঁঝালো গলায় বললো,

– তুই কি ভুলে যাচ্ছিস তুই বিবাহিত?

– ভরনপোষণের দায়িত্ব নিতে পারলে চারটে বিয়ে করা জায়েজ আছে।

রুদ্রের খামখেয়ালী কথাবার্তা হিয়ার কোনোমতেই সহ্য হচ্ছে না। কাউকে তোয়াক্কা না করে সে এগিয়ে আসলে রুদ্র তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়। টানাচোখের শীতল চাহনি দেখে হিয়ার চলন গতি যেন আপনা-আপনিই থেমে যায়। পেছনে হাত বেধে মেঘের সামনে দুই কদম এগিয়ে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো,

– তা মিস মেঘ, বাবার প্রাণ না নিজের আত্মসম্মান? কোনটা বাঁচাবি ঠিক করলি!

স্থির হয়ে দাড়িয়ে রয় মেঘ। জন্ম দিতে গিয়ে জন্মদাত্রী মা ছেড়ে গিয়েছে তাকে। বড় ভাইও জেলের ঘাটি টানছে। দুকূলে বাবা ছাড়া এখন আর তার কেউই নেই। সেই বাবাও আজ কারো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গরাদের পেছনে যেতে চলেছে। হঠাৎ গতকাল ব্যাংক থেকে নোটিশ এসেছে ২৪ ঘন্টার মধ্যে যদি তারা এক কোটি টাকা পরিশোধ করতে না পারে তাহলে তাদের বসতবাড়ীসহ সমস্ত জমিজমা ব্যাংকের দখলে চলে যাবে। সেই সাথে এরেস্ট করা হবে মিজান খানকে। অথচ তার বাবার এতবড় কোনো ব্যাংক লোন নেই। আবার ব্যাংকের লোকদের দেখানো কাগজপত্রগুলোও জাল নয়। তাই সাতপাঁচ না ভেবে সম্মান রক্ষার্থে টাকা শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে তারা। সবগুলো জায়গাজমির দলিল ব্যাংকের লোকদের কাছে থাকায় টাকা যোগাড়ের কোনো ব্যবস্থা হয়ে ওঠে না। ওদিকে সময়ও থেমে নেই।

শত চেষ্টা করেও বাবা মেয়ে এক কানাকড়ি জোগাড় করতে পারেনি। দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মিজান সাহেব। দিকবিদিকশুন্য মেঘ তখন শেষ ভরসা হিসেবে বড় চাচার কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু রমজান খান পার্টির কাজে শহরের বাইরে থাকায় সেই খবর যায় রুদ্রের কানে। পরিবারসমেত সে চলে আসে গ্রামের বাড়িতে। বাকি ঘটনা সবার জানা।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একপলক হিয়া আর বাড়ির সবাইকে পরখ করে ফের রুদ্রের মুখপানে চেয়ে তার শর্তে সায় জানায় মেঘ। রুদ্রের ঠোঁটের কোণে দেখা মেলে এক চিলতে হিংস্র হাসির রেখা।

*
*
বর্তমান~

মেঘ এখনও বুঝতে পারছে না সবগুলো জমির কাগজ ব্যাংকে কবে, কিভাবে গেলো! জানালার গ্রিলকে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে এতটাই মশগুল ছিলো যে কখন রুদ্র ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সে টেরই পায়নি।

– ভাবিস না রাজাকে বিয়ে করেছিস বলে রাণী হয়ে থাকবি। ঐ অধিকার শুধুমাত্র হিয়ার জন্য বরাদ্দ। আমার স্ত্রীর মর্যাদা ও অধিকার তুই কোনোদিনও পাবি না। না-ই পাবি স্বীকৃতি।

মেঘ নিঃশব্দে রুদ্রের সামনে এসে দাঁড়ায়। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কোনো কথা না বলেই রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজার বাইরে আসতেই মুখোমুখি হয় হিয়ার সঙ্গে। মেঘ নরম স্বরে ওর হাত ধরে বললো,

– হিয়া, আমার তোমার সাথে কথা আছে।

হিয়া এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো। ওর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে সাথে সারা শরীরও।

– যদি জানতাম তুমি আমার সুখে ভাগ বসাবে, তোমায় প্রাণে মে রে ফেলতাম!

হিয়ার কথা শুনে মেঘের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো না। উল্টো সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললো,

– এই খেয়াল ভুলেও এনো না! যেই প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য মনে গোপন ইচ্ছে পোষণ করছো তার মাথা থেকে পা অবধি পুরোটাই কলিজা, আমার নয় তোমার প্রাণপ্রিয় স্বামীর।

হিয়া রাগে ফুঁসে ওঠে আরও কিছু শোনাতে যাবে তার আগেই মেঘ সেখান থেকে হনহন করে চলে যায়। আড়াল থেকে দুই অর্ধাঙ্গিনীর স্পষ্ট কথোপকথন শুনে রুদ্র বাঁকা হেঁসে তাদের দিকে চেয়ে মৃদু আওয়াজে সুর টেনে বললো,

– বেবি ইউ চুজ দ্য পেইন..ডোন্ট ইউ নৌ হোয়াট আই আ’ম!

*
*
*

চলবে…?