দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০৪

0
3

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৪ (❌কপি করা নিষেধ❌)

বিকেলবেলা সামনের উঠান পার হয়ে কিছুটা গভীর বাগানের ভিতরে চলে যায় নবনী। বড় বড় আকাশ ছোয়া গাছগুলো যেন ছাউনির মতো উপরটা ঢেকে রেখেছে। শীত যে এসে গিয়েছে তা ঠান্ডা শীতল আবহাওয়াই জানান দিচ্ছে। কাল থেকে হয়ত শীতের সোয়েটার ছাড়া বের হওয়া যাবে না।

নবনী গায়ের চাদরটা আরেকটু পেচিয়ে নেয় ভালো করে। সে সাথে করে একটা পাটি নিয়ে এসে সেখানে বিছিয়ে বসে। সাথে করে বাটিতে করে গরম গরম পিঠা এনেছে। পিঠা খেতে খেতে ফোনটা হাতে নেয়, তবে সমস্যা হলো কোনো নেটওয়ার্ক নেই। নেট পেতে গেলে মেইন রাস্তা অব্দি হেটে যেতে হবে। এতো সময় নেই তার।

ফাইলে ডুকে একটা গান ছেড়ে দিয়ে, প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকে। আশেপাশের গাছগাছালিতে কতো পাখি বসে আছে। সবাই কি সুন্দর উড়াউড়ি করছে। পাশের একটা গাছের ডালের উপর পাখির বাসাও আছে। এমন সময় শরীরে নরম কিছুর ছোয়া পেয়ে নবনী লাফ দিয়ে উঠে। ভেবেছিল হয়ত কোনো কেচো বা কিছু।

তবে তাকিয়ে দেখে তার বিড়াল পিকু। পিকু বসে বসে লেজ নাচাচ্ছে আর নবনীর হাতের বাটির দিকে তাকিয়ে আছে। নবনী বুজল সেও পিঠার ভাগ বসাতে চায়। একটু ভেঙে সামনে দিতে পিকু খেয়ে নেয়।

“তুই দিন দিন খুব ছোছা হয়ে যাচ্ছিস পিকু। তোর জন্য একা কিছুই খেতে পারি না।”

পিকু কি বুঝল কে জানে। চিল্লিয়ে বলে উঠল,

“মেও মিউ।”

বলেই আস্তে আস্তে নবনীর কাছে এসে পায়ের সামনে দাড়াল। নবনী কিছু বুঝে উঠার আগেই সে একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই পায়ে বসিয়ে দিলো একটা বড় কামড়।

“আহ……..!”
……

সন্ধ্যার আকাশটা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আশেপাশে ঠিকঠাকভাবে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মেইন রোড দিয়ে ঠিকই বাসায় ফেরা যেত। তবে মুগ্ধর ইচ্ছে হয়েছে শর্টকাট নেয়ার। জমির ভিতর ছোট করে পথের চিহ্ন দেয়া আছে। মুগ্ধ সেখান দিয়েই বাড়ি ফিরতে থাকে। অন্ধকারে কোনো ভয় নেই তার। গ্রামের ছেলেদের এমনিও ভয় কম থাকে।

মাথার উপরের চাদঁটাও আজ যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে চাইছে। ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। আচমকা অনেকটা একাকিত্ব ভর করে মুগ্ধর উপর। আসলেই এই বয়সে এমন কাউকে দরকার যার সাথে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা সব কথাগুলো শেয়ার করা যায়।

হুটহাট ইচ্ছে হলেই যার মাঝে হাড়িয়ে যাওয়া যায়। তবে মুগ্ধর এসবে বারণ। তার পরিবারে যেই মেয়ে আসুক, সে কখনোই সুখী হতে পারবে না। আর শহরের মেয়ে হলেতো কথাই নেই। নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে মুগ্ধ বাড়ির দরজায় এসে পৌছায়। আজ বাড়িটা একদম শান্ত। বাবা হয়ত ইলেকশনের কাজে ব্যস্ত। আজও ফিরবে না। শরীফ চাচা নে শার দুনিয়ায় ডুবে আছে।

বাড়ির মহিলারা আর কিই বা করবে। তাদের বাড়িটাকে কখনোই বাড়ি মনে হয় না মুগ্ধর। এর থেকে শহরে মাঝে মাঝে ভার্সিটির পরীক্ষার জন্য যায়। তাই ভালো। ছাত্র আন্দোলনের সময়ও কম কষ্ট করতে হয়নি ওকে। অনেকদিন ভার্সিটির হোস্টেলে ছিল। ওদের হলে ওই ছিল প্রধান সমন্বয়ক। সে যেন জীবনের আরেক ইতিহাস।

“মুগ্ধ ভাই এসেছো?”

শ্যামলীর কথায় টেবিলে চোখ যায় মুগ্ধর। সম্পর্কে ভাবী হলেও বয়সে মেয়েটা খুব ছোট। এখন ওর কলেজে পড়াশোনা করে সুইসুতো দিয়ে স্বপ্ন বুনার কথা ছিল। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এমন কারো বৌ হয়ে পড়ে আছে, যে হয়ত তার দিকে ফিরেও তাকায় না। মুগ্ধর বিচক্ষণতা অনেক বেশি। এসব তার কাছ থেকে লুকানো সম্ভব না।

“ভাবী তুমি এখনো এখানে বসে আছো।”

“পায়েস রান্না করেছিলাম একটু। তোমার জন্য বাটিতে সাজিয়ে বসে আছি। মা বলেছিল তোমাকে আসলে দিতে।”

“ওহ।”

মুগ্ধ টেবিলে বসে খেতে থাকে। শ্যামলীও চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। শাড়ির আচল মাথায় আরেকটু টেনে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। মুগ্ধ শ্যামলীর খুতখুতানি দেখে প্রশ্ন করে,

“ভাবী কিছু বলবা?”

“ইয়ে মানে, আসলে।”

“ভাইয়া কেমন আছে, কবে আসবে শুনতে চাও?”

শ্যামলী লজ্জায় কিছু বলতে পারে না। এই একটা মানুষ যে সব জানে। তাই তার কাছেই ছুটে আসে শ্যামলী, স্নিগ্ধর খোজ নিতে।

“ভাইয়া কেমন আছে সেটা সে আসলেই জিগ্যেস করো। পরশু সে আর মারুফ চাচা তার পরিবার নিয়ে গ্রামে আসবে।”

শ্যামলীর মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। তবে মারুফের নাম শুনে ভালো লাগল না। সে আসলে সাথে তার মেয়ে মাহি আর শালা ইমনও আসবে নিশ্চয়ই। মেয়েটা অপমানে কোনো ছাড় দেয় না কাউকে। আর ঐ ইমনতো! মুগ্ধ খেতে খেতে বলে,

“ভাবী, আমিও চাই না মারুফ কাকা আসুক।”

ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটে মুগ্ধর কথায়। শ্যামলী বলে,

“কেন? এটাতো তাদেরও বাড়ি।”

“মাহি মেয়েটা খুব গায়ে পড়া স্বভাবের। আমি কখনো ওকে বোন ছাড়া অন্য চোখে দেখেনি। তবে মেয়েটা কেমন তা তো জানোই। শহরে ফ্রি মিক্সিন এ অভ্যস্ত হয়ে, আর ছেলেদের নিয়ে নাইট ক্লাবে গিয়ে পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার পিছে আঠার মতো লেগেই থাকবে আসলে।”

“এজন্যই তুমি বিয়ে করে নেও।”

মুগ্ধ খাওয়া থামিয়ে পাশে তাকায়।

“কি আবোলতাবোল বলছো ভাবী? ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করব?”

“না নাহ। ওর কথা বলছি না। বাবা যেই শহরের মেয়েকে আনতে চাইছে তার কথা বলছি।”

“নিজের মতো আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট হোক চাও।”

শ্যামলী কিছু বলে না। মুগ্ধ খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে যায়। আর ভাবতে থাকে, ভালো মেয়েরা চরিত্রের দোষ মানতে পারে না। ঐ মেয়ে সত্যি ভালো হলে, মুগ্ধর কথায় নিজেই বিয়ে ভেঙে দিবে।
………

রাতে উঠোনে গোল হয়ে সব কাজিনরা বসে আছে। নাফিজা, নবনী সাথে নবনীর আরেক মামাতো ভাই সৌরভ ও মামাতো বোন মেঘা। সৌরভ আর মেঘা মাদ্রাসায় থেকে পড়াশোনা করে। তাই এতদিন বাড়ি ফিরেনি। এখন নবনী আসার উপলক্ষে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তবে সামনে বড় কোনো অনুষ্ঠানও আছে হয়ত। সেটা কি নবনী জানে না।

একটা ফ্লাক্সে করে চা আর কয়েকটা কাপ নিয়ে আসে নবনীর মামি। সাথে একটা বাটিতে করে বিস্কুট। সবাই বসে বসে রাত অব্দি গল্প করবে আর খাবে।

“আপু ভার্সিটিতে খুব মজা হয় তাই না?”

মেঘের প্রশ্নে নবনী হেসে উত্তর দেয়,

“হয়, হয়ত। তবে আমি এখনো ঠিক জানি না।”

“কেন?”

“আমিতো মাত্র ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। উঠেই গ্রামে চলে আসলাম বেড়াতে। এখন গিয়ে হোস্টেলে উঠলে বুঝব কেমন মজা হয়।”

নানান গল্পে আড্ডা চলতে থাকে। নবনীর মা উকি দিয়ে ওকে একটু দেখে। সবার মাঝে ওকে কত ছোট মনে হচ্ছে তার। তবে কথায় আছে, “মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি।” নিজের সন্তান তার কাছে ছোট লাগলেও সবার কাছেতো ছোট না।

কাল সকালে নবনীকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। মেয়েটা যেতে রাজি হবে নাকি কে জানে। তবে একবার দেখা করতে যাওয়া উচিত। তার বাবাতো না জানিয়েই সব ঠিক করে ফেলছে।

“নাফিজা এদিকে আয়তো।”

নবনীর কথায় একটু ওর দিকে আসে নাফিজা। নবনী ইশারাতে বুঝিয়ে দেয় গোপন কথা।

“আচ্ছা, তুই যে ওদিন বললি নানা আমার বিয়ে ঠিক করছে। সেটা কেন বলেছিলি?”

“আমি দাদুকে বলতে শুনছিলাম, তোমার বাবাকে বলতে। এবার নাকি তোমার শহরে ফিরা হবে না। বর্তমান মেম্বারের ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। আর কাউকে বলিনি আমি এসব। শুধু তোমাকে বললাম।”

নাফিজা কথা শেষ করে বিস্কুটে কামড় বসায়। তবে নবনী বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। দুয়ে দুয়ে চার না হয়ে পাচ কেন হচ্ছে? নবনীর নানাতো বিপক্ষ দলের লোক ছিল। প্রাক্তন মেম্বারের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। তার ছেলেই বিহান। সবসময় এ বাড়িতে তারা আশা যাওয়া করত বিদায়, বিহানের সাথে সবার ভালো সম্পর্ক।

তবে গত ভোটে হঠাৎ মতিসুর মেম্বার জিতে যায়। তখন থেকে বিহানরা ঠিকঠাক এ বাড়িতে আসে না। শুধু নবনীরা শহর থেকে আসলে বিহান ভাই একটু দেখা করতে আসে। নবনী তাকে ভাইয়ের চোখেই দেখে। তবে কথা সেটা না। নবনী যতদূর জানে, তার নানা মোটেও এমন লোক না যে, যখন যে ক্ষমতায় থাকবে তার চামচামি করবে।

তবে কি এমন হলো যে বর্তমান মেম্বারের ছেলের সাথে নবনীর বিয়ে দেয়ার কথা চলছে। আদৌ কি এটা শুধু বিয়ে? নাকি এসবের আড়ালে লুকিয়ে আছে বড় কোনো রহস্য? কী হতে যাচ্ছে সামনে। ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না নবনী। দেখা যাক, সামনে কি হয়।

#চলবে …..