দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০৮

0
146

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৮ ( আগের পর্বগুলো পড়ে তারপর এই পর্ব পড়বেন। নয়ত বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। )

আজ সারাদিন নবনীর খুব খারাপ কেটেছে। সকাল সকাল বিহানের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গিয়ছিল। কিন্তু মাকে এসব বিষয় কিছুই বলতে পারছে না সে। নানার আসল রূপটা সবার সামনে কীভাবে আনবে তা তার অজানা।

সময়টা এখন ঠিক সন্ধ্যা। নবনী একটা কালো টপসের সাথে জিন্স পড়েছে। আর একটা কালো ওড়না মাথায় পেচিয়ে নাফিজাকে উদ্দেশ্য করে নবনী বলে,

“চল।”

নবনীর মামি নবনীর কথা শুনে প্রশ্ন করে, “এখন রাতে কোথায় যাবি?”

“স্কুলের কাছে নাকি একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে যাচ্ছি। ভাবলাম ওকেও নিয়ে যাই।”

“এত রাতে?”

“রাত কোথায়? গ্রামে সবাই আগেই ঘরে চলে আসে। আর এইটুকু থেকে এইটুকু। সমস্যা হবে না।”

নবনীর মামি বারবার বারণ করা সত্ত্বেও সে নাফিজাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। গ্রামে এসে রাতের আবহাওয়াতে একটু না ঘুরলে হয় নাকি?

গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছে নবনী। রাতের আকাশে চাদঁমামা নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মিটমিট আলো দেয়ার। তবে কুয়াশাচ্ছন্ন এলাকায় সে ব্যর্থ। নাফিজা ভয়ে নবনীর জামার একটা কোণা টেনে রেখেছে। নবনী ওর ভীতু মনোভাব দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,

“ঐ দেখ, তালগাছটার উপরে যেন কী।”

“আহহহ।”

“আরে থাম থাম। এভাবে চিল্লালে সবাই এসে পড়বে। মজা করছিলাম আমি।”

“ভয় দেখাইয়ো না আপু।”

অবশেষে হাটিহাটি পা করে ওরা লাইব্রেরিটার সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। বাহির থেকে দেখলে বুঝার উপায়ই নেই ভিতরে কোনো লাইব্রেরি আছে। তবে উপরে মোটা মোটা অক্ষরে বাতি দিয়ে সাজিয়ে লেখা,
“কফিহাউজের লাইব্রেরি।”

নবনী বেশ অবাক হয় আর হাসে। লাইব্রেরির নাম আবার কেউ কফিহাউজ দেয় নাকি। নাফিজা পাশ থেকে বলে,

“আপু ভিতরে না একটা বাক্সর মতো কি জানি আছে। পয়সা দিলে নিচ থেকে ডাকনার মতো ছোট একটা ছিদ্রটা খুইলা যায়। আর একটা ইসপিরিট ক্যান এর মতো বের হয়। ভিতরে তিতা একটা চা।”

নবনী হেসে বলে, “বোকা ঐটা হট কফি হয়ত। ভালোই হলো, বই পড়তে পড়তে শীতের মাঝে ধোয়া উঠা কফিও পান করা যাবে।”

“কপি?”

“কপি না কফি। তুই তোর গেয়ো গেয়ো কথা বাদ দে বোন। চল ভিতরে যাই।”

“আইচ্ছা। চলো।”

নবনী ভিতরে গিয়ে বেশ অবাক হয়। বাহির থেকে খুব সাধারণ মনে হলেও ভিতরে খুব সুন্দর করে বুকসেলফ দিয়ে সাজানো। নাফিজা একপাশে গিয়ে চেহারে বসে হেলান দিয়ে থাকে। নবনী ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে পুরো লাইব্রেরি দেখতে থাকে। ছোটছোট রুমের মতো ভাগ করা। একজন লাইব্রিরিয়ান তার টেবিলে বসে নবনীকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তার বয়স ৫০ ছুই ছুই। নবনীকে দেখেই বুঝে ফেলে মেয়েটা শহুরে।
………

“মুগ্ধ।”

মুগ্ধ ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল। হঠাৎ নিজের নাম কোনো নেকামো কন্ঠে শুনে বুঝে যায় এটা মাহি। তবে তাকিয়ে যা দেখে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। মাহি একটা টাওয়াল পড়ে দাড়িয়ে আছে।

“মুগ্ধ, অন্তত আজকে রাতটা আমাকে নিজের করে যেন। কথা দিচ্ছি, কেউ কিচ্ছু জানবে না।”

কথাটা বলে হেলতে হেলতে মাহি আগাতে থাকে। মুগ্ধ আর একবার ওর দিকে তাকায়। বুঝে যায় এই মেয়ে ড্রাংক। এখন না সামলালে পরে কেলেঙ্কারি হবে। মুগ্ধ উঠে গিয়ে হঠাৎ মাহির খুব কাছে চলে আসে। মাহি লজ্জায় চোখ বন্ধ করতেই, হঠাৎ গালে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে।

চোখ মেলে বুজতে পারে, মুগ্ধ থাপ্পড় দিয়েছে ওকে। ব্যাথায় কাদতে কাদতে বলে,

“তোর কি কোন অক্ষমতা আছে মুগ্ধ। ছেলে হয়ে কেন…”

আর কিছু বলার আগেই মুগ্ধ দরজা খুলে মাহিকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আর দাতে দাত ঘষে বলে,

“আর একটা ওয়ার্ড উচ্চারণ করলে তোকে মে /রে তক্তা বানিয়ে দিব।”
….

নবনী ঘুরতে ঘুরতে এক কোণায় গিয়ে থামে। বুকসেলফ এর একটা বইয়ে তার চোখ আটকায়। খুব সুন্দর একটা কবার লাগানো ইংরেজী বইটার নাম দেয়া, “দা মোমেন্ট আই ফল ইন লাভ।”

কিছুটা ইনটারেস্ট জমে নবনীর। তবে বইটার কাছে যেতে নিতেই, “আহ!”

পায়ে কিছু লেগে নিচে পড়ে যায়। মেজাজটা গরম হয়ে গেল। নিচে তাকিয় থেকে কতগুলো কাগজ, গাম, হাবিজাবি। কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা,

“বদনা মার্কায় ভোট দিন।”

আরেকটায় লেখা,

“এক বড় না দুই বড়, মতিসুর মেম্বারের মন বড়।”

এসব দেখে নবনীর রক্ত গরম হয়ে যায়। কতটা ফালতু হলে একদল মানুষ লাইব্রেরীতে দলীয় ব্যানার এর কাজ করে? এমন সময় লাইব্রেরিতে কাউকে ঢুকতে শুনে নবনী কোনোমতে উঠে দাড়ায়। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ।

নবনীকে এখানে দেখে মুগ্ধও বেশ অবাক হয়। সে এসেছিল ব্যানারগুলো আর জিনিসপাতি নিয়ে যেতে। সাথে রাগটা ঠান্ডা করতে। তবে এখন হয়ত হিতের বিপরীত হবে। সব দোষ শাওনের। এত করে বলেছিল এখানে বই পড়ার জায়গা, এসব ছড়িয়ে না রাখতে। ছেলেটা তাও শুনলো না। ঐদিকে মাহির ধরাধরির ভয়ে বাড়ির বাহিরেই বেশিক্ষণ থাকতে হয় তার।

“আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি আর জীবণে একটাও দেখি নি।”

নবনীর কথায় তার দিকে তাকায় মুগ্ধ। মেয়েটা থাপ্পড় মেরেও কি শান্তি পায়নি। ঐ একটা কথার জন্য এতকিছু। নাকি কেউ তার কান ভরেছে। এমনিতে মাহির কাজে মুড অফ, আর এ যেন আরো রাগিয়ে দিচ্ছে।

মুগ্ধ ভাবল, এবার আমিও উত্তর দিবো। দেখি মেয়েটার তেজ কত?

“জ্বী আমি খুব খারাপ। তবে কিছু মেয়েদের থেকে ভালোই আছি। এখন এখান থেকে বেরিয়ে না গেলে আরো খারাপ হবো।”

নবনীর কি হলো কে জানে। সে হয়ত ভুলেই গিয়েছে, এই লাইব্রেরির মালিকই তার সামনে দাড়িয়ে আছে। একটু আগে নিচে পড়ে যাওয়ার রাগটাও মুগ্ধর উপর ঝেড়ে দেয়।

তার কাধে ঝুলানো ছোট্ট সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে। মুগ্ধর কিছু বুজে উঠার আগেই বোতলের পানি ছু করে তার মুখে মেরে দেয়।

“what’s this?”

মুগ্ধ চিল্লিয়ে বলে। নবনী একটা ডেবিল হাসি দিয়ে বলে,

“আপনাকে আমি ভয় পাই না মিস্টার মুগ্ধ।”

এইবার যেন মুগ্ধরও বেশ ইগো হার্ট হয়। একটা মেয়ে লিমিট অতিক্রম করে তার সাথে এমন বিহেব করছে কি করে? হঠাৎ নবনীর কাছে যেতে থাকে সে। নবনীও একটু পিছাতে পিছাতে ভাবে, এখন রাতে একা রাগানোটা ঠিক হয়নি। এইখান থেকে চিৎকার দিলেও লাইব্রেয়ান শুনবে না। দূরর।

মুগ্ধ আরো কাছে এসে এক হাত দিয়ে নবনীর চোয়াল চেপে ধরে একদম দেয়ালের সাথে মাথাটা ঠেকিয়ে দিলো। আর আরেক হাতে থাকা বন্দু/কটা ঠিক ওর মাথার কপাল বরাবর সোজাসুজি ধরে চিল্লিয়ে বলল,

“Now say that, you don’t?”

নবনীর মুখে একটু ব্যাথা পায়। মেয়ে মানুষের ত্বক এমনিতেও নরম হয়। আর সামনে দাড়িয়ে থাকা পুরুষ মানুষটি মোটেও দুর্বল কেউ নয়। তার বলিষ্ঠ দেহের শক্ত হাতের ছোয়ায় ব্যাথায় কুকড়ে উঠছে নবনী। তবে সেও দমে যাওয়ার মেয়ে নয়। মুগ্ধর বুকে সজোড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে কিছুটা দূরে সরায়ে দেয়। আর হুংকার দিয়ে বলে উঠে,

“বললাম তো ভয় পাইনা। কি করবেন আপনি? পুরুষ মানুষকে আল্লাহ শারীরিক দিক দিয়ে বেশি শক্তি দিয়েই পাঠিয়েছে। নিজের গায়ের জোর খাটাবেন?”

মুগ্ধ অবাক নয়নে নবনীর দিকে তাকায়। এত তেজ এই মেয়ের? এখনো গলা উচু করে কথা বলছে। এই মেয়ের তেজ আর সাহসের সামনে নিজের আকাশচুম্বী রাগকে ফিকে হয়ে যেতে দেখে মুগ্ধ। নবনীর কাছে এসে দুপাশে দেয়ালে হাত রাখে। অনেকটা ঝুকে তার ঠোটদুটো ঠিক নবনীর ঠোটের কাছে নিয়ে আসে। তার রাগে জিদে ফেটে পড়া ঘন ঘন নিঃশ্বাস নবনী ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে।

লাইব্রেরির জানালা দিয়ে একটা দমকা হাওয়া রুমে প্রবেশ করল। বাতাসে নবনীর চুলগুলো উড়ে কিছুটা সামনে এসে পড়ল। যা বারবার মুগ্ধর মুখের উপর এসে পড়ছে। তবে এতে যেন মুগ্ধর কোনো খেয়ালই নেই। সে অবাক চোখে শুধু সামনের মেয়েটাকে দেখছে। ঠান্ডা শীতল বাতাসে নবনী বারবার কেপে উঠছে। এই বিষয়টাও মুগ্ধর চোখ এড়ায় নেই।

“শীত করছে?”

মুগ্ধর কথা শুনে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে নবনী। এখন কি এই প্রশ্নটা করার কোনো মানে হয়? নাকি বড় কোনো ঝড়ের পূর্ব ইঙ্গিত দিচ্ছে ও। মুগ্ধ আবার বলে উঠে,

“ধরো আমি তোমাকে এখন একা পেয়ে খুব খারাপ কিছু করে ফেললাম। নাহ। জানে মারব না। ধরো তোমার শরীরের প্রতিটা ভাজে ভাজে শুধু আমার স্পর্শ পড়ল। তুমি শইতে পারবে তো?”

নবনী এবারো চুপ করে আছে অন্যদিকে তাকিয়ে। যেন কথা বললেই তার ভীত কন্ঠ শুনে মুগ্ধর শক্তি বেড়ে যাবে। ভিতরে ভিতরে যেন কালবৈশাখীর ঝড় চলছে নবনীর। ভয়ে হাত পা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তবে আল্লাহ ছাড়া বিনা দোষে কারো সামনে মাথা নত করবে না সে। নিজেকে সামলে সেও উত্তর দেয়,

“চাইলে সেটাও করে দেখতে পারবেন। যার মুখ দিয়ে মদের বাজে গন্ধ বের হয়, যার দলের লোক বিনা কারণে মেয়েদের জীবণ নরকে পরিণত করে। যার বাবার কুকীর্তি সবার জানা। সেই কাপুরুষের কাছ থেকে আর কি আসা করা যায়?”

“আমি কাপুরুষ?”

তৎক্ষণাৎ বলে ফেলে মুগ্ধ। তাকে কেউ কখনো এত বাজে শব্দ দিয়ে আঘাত করেনি। নবনী বলে উঠে,

“কাপুরুষ নয়ত কি? যেই ছেলে জোর করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবার কাছ থেকে সম্মান আদায় করে, নিজের থেকে প্রায় সাত আট বছরের ছোট মেয়ের কাছ থেকে সরি না শুনতে পেয়ে শরীরের জোর খাটানোর ভয় দেখায়। সে কাপুরুষ নয়ত কি? আপনার বোনকে কাল এভাবে কেউ ভয় দেখালে আপনার কেমন লাগবে?”

“এই মাহিয়ান মুগ্ধ বেচে থাকতে কারো সাহস নেই তার কোনো বোনের দিকে তাকানোর।”

“আমিও তো কারো বোন, কারো মেয়ে। আমার পরিবারের উপর দিয়ে কি যেতে পারে সেটা ভাবুন তো। আপনাদের মতো পুরুষদের জন্য প্রতিদিন কত মেয়ের পরিবার শেষ হয়ে যায় জানেন?”

মুগ্ধ চুপ হয়ে যায়। সাথে মুখে অনেকটা হতাশার চিহ্ন। সে মোটেও ব্যাপারটা ঐদিকে নিতে চায়নি। শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিল। তার এক ইশারায় বিছানা অব্দি চলে যাওয়ার মেয়ের অভাব নেই। মেয়ে মানুষকে অপছন্দ করলেও তাদের ইজ্জতকে সম্মান দিতে সে জানে। নবনীর থেকে হঠাৎ দূরে সরে যায় সে।

একটু সরিই তো শুনতে চেয়েছিল সে। সাথে দেখতে চেয়েছিল কত জিদ আছে এই মেয়ের মনে। তা দেখা হয়ে গিয়েছে। নয়ত সামান্য বিষয় নিয়ে মুগ্ধর এত বাড়াবাড়ি করার কোনো মানেই হয় না। দুটো বিষয়ে সে নিশ্চয়তা পায়। এক, এই মেয়ে তার বাড়ির পরিবেশে ঠিকই টিকে যেতে পারবে। আর দুই, কেউ একজন এর মনে মুগ্ধকে নিয়ে খুব বাজে ধারণা ডুকিয়ে দিয়েছে।

এক দৃষ্টিতে শান্তভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুগ্ধ বলে উঠে,

“বিয়ে করবে আমাকে?”

নবনী শুধু চোখ বেকিয়ে তাকিয়ে থাকে। এই লোকটা জগন্য সে জানে। সাথে পাগলও নাকি? এভাবে বিয়ের প্রস্তাব কে দেয়?

#চলবে….