কোনো এক গোধুলী বেলায় পর্ব-০১

0
2

#কোনো_এক_গোধুলী_বেলায়
[সূচনা পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

চার মাসের শিশুকে বুকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে চলছে জয়ন্তী। পড়ে তাঁর সাদা শাড়ী। সদ্য বিধবা জয়ন্তী, স্বামী গত হয়েছে মাত্র কিছুদিন হলো। এর মধ্যেই শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাঁকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। চার মাসের শিশুকে নিয়ে কোথায় যাবে জয়ন্তী? মেয়েদের তো একটা বাপের বাড়ি থাকে কিন্তু জয়ন্তীর তো তিন কুলে কেউ নেই। তার উপর সে বাক প্রতিবন্ধী।

বড় হয়েছে এক চাচার বাসায়। সেই চাচাও গত হয়েছে দুই বছর হলো। এখন এই মেয়েটা তার নবজাতক শিশুকে নিয়ে কোথায় যাবে? কাওকে তো সাহায্যের জন্য মুখ খুলে কিছু বলতে পারবেনা। রাস্তাঘাটের অবস্থাও বেশি একটা ভালো না। কে দাঁড়াবে জয়ন্তীর পাশে? আনমনে উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে চলছে সে। হঠাৎ করে কোলের বাচ্চাটা কেঁধে উঠে। জয়ন্তী বুঝতে পারে বাচ্চার খিদে পেয়েছে। কিন্তু রাস্তার মধ্যে সে কীভাবে বাচ্ছাকে খাওয়াবে? জয়ন্তী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে মানুষ তার দিকে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। তাকানোর কারণ ও আছে, সাদা শাড়ী পড়ে কেউ এভাবে রাস্তায় বের হয়? তাও এই ভরদুপুরে! কোলের বাচ্চাটা কান্না করেই চলছে। মায়ের মন বাচ্চার কান্না দেখে নিজের চোখ ভিজে উঠেছে।

তখনই জয়ন্তীর কাছে আসে একটা মধ্যবয়সী মহিলা।

— একি বোন বাচ্চা কান্না করছে কেন? আর তুমি এই ভরদুপুরে বাচ্চা নিয়ে রোদের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছ কোথায়?

জয়ন্তীর চোখে পানি দেখেই বুঝতে পারে মেয়েটা হয়তো অসুবিধার মধ্যে আছে!

— বোন তুমি আমার বাসায় আসো। কাছেই আমার বাসা। বাচ্চাটা তো খুব কান্না করছে হয়তো খিদে পেয়েছে। তুমি আমার সাথে আসতে পারো। পরে না হয় আবার চলে যাবে।

জয়ন্তী কোনো কথা বলল না। সে মহিলার সাথে হেঁটে চলে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা জয়ন্তীকে কিছু প্রশ্ন করে। কিন্তু জয়ন্তীর মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রমহিলার বাসায় পৌছে যায়। এবার জয়ন্তী তার বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় ভিতরে প্রবেশ করে। জয়ন্তী তাড়াহুড়ো করে বাচ্চাকে আগে খাওয়ানো শুরু করে। বাচ্চা খাবার খেয়ে কান্না থামায়। ভদ্রমহিলা জয়ন্তীর জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে জয়ন্তীর হাতে দিতেই সে এক বারে সব পানি খেয়ে ফেলে। জয়ন্তী এতক্ষণ ধরে এই মহিলার সাথে আছে তার মুখ থেকে একটা শব্দও বের হলোনা।

— বোন নাম কি তোমার? আর বাসা কোথায় তোমার?

জয়ন্তী বয়স্ক মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কোনো উত্তর সে দিতে পারছেনা।

— কি হলো বোন কথা বলছ না যে?

জয়ন্তী কোলের বাচ্চাটাকে খাটের উপরে শুইয়ে দিয়ে মহিলাকে ইশারায় বলল তাকে কাগজ আর একটা কলম দেওয়ার জন্য। এতক্ষণে মহিলাটা বুঝতে পারে জয়ন্তী কথা বলতে পারেনা। তাই সে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে জয়ন্তীর হাতে ধরিয়ে দেয়।

জয়ন্তী কাগজে কিছু লিখে মহিলার দিকে এগিয়ে দেয়। যেখানে লেখা ছিলো,

— আমি জয়ন্তী। আমি কথা বলতে পারিনা। তাই এতক্ষণ আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

— তোমার বাসা কোথায় বোন?

— আমাকে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কিছুদিন আগে প্রবাসে আমার স্বামী মারা গেছে রোড এক্সিডেন্টে। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র পনেরো দিন হয়েছে।

— কি বলছ। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কীভাবে? একটা সদ্য বিধবা মেয়েকে কে বাসা থেকে বের করে দেয়? আর সব থেকে বড় কথা তোমার কোলে একটা ছোট শিশু আছে। তার কথাতো একবার ভাবা উচিৎ ছিলো।

জয়ন্তীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ভদ্রমহিলা জয়ন্তীর চোখে পানি মুছে দিয়ে বলল,

— কান্না করোনা বোন। আমি আছি তোমার পাশে। তোমার মতো আমিও খুব একা। তিন কুলে আমার কেউ নেই। আর হ্যাঁ আমার নাম শিরিন। আমার বাবা আমাকে একটা লোকের কাছে বিয়ে দিয়েছে। লোকটা খুব খারাপ ছিলো। প্রতিরাতে নেশায় ডুবে থাকে। কিছু থেকে কিছু হলেই আমার গায়ে হাত তুলতেন। তাই ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়িতে গিয়েছিলাম কিন্তু বাড়িতে আমার বাবা আমাকে উঠতে দেয়নি। তারপর আর কি! নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিয়েছি। এই বাসায় আমি একাই থাকি। বাজারে আমার একটা ছোট দোকান আছে, টেইলরের দোকান। আমি জামাকাপড় সেলাই করে যা টাকা পাই তা দিয়ে মোটামুটি আমার ভালোই চলছে।

জয়ন্তী মন দিয়ে শিরিনের সব কথা গুলো শুনছে। শিরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জয়ন্তীকে বলল।

— আমি জানি বোন তোমার মনে অনেক কষ্ট। তুমি তো তোমার মনের কথা গুলো প্রকাশও করতে পারছো না।

জয়ন্তী কাগজে কিছু একটা আবার লিখে শিরিনের দিকে এগিয়ে দিল।

— আপু আমি তাহলে উঠি। আর আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

— আরে তুমি কোথায় যাবে? যাওয়ার কোনো যায়গা আছে তোমার?

জয়ন্তী দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না বলল।

— আমাকে আপু বলেছো যখন আজ থেকে তুমি আমার বোন।

— আমি আপনাকে ঝামেলায় ফেলতে চাইনা। আমার কপালে যা আছে তাই হবে।

— কিন্তু বাচ্চাটার কি হবে? দেখো বোন আমি বাসায় একাই থাকি। তুমি থাকলে তো অন্তত কথা বলার একটা মানুষ হবে আমার। আমার কোনো ঝামেলা হবে না। আমি যদি খেতে পারি তোমাকেও খাওয়াতে পারবো।

শিরিনের জোরাজোরিতে জয়ন্তী থাকার জন্য রাজি হয়। সে এটা ভেবে অন্তত খুশি হয়েছে যে সে তো মাথায় উপরে একটা ছাদ পেলো। এই বাচ্চাটাকে নিয়ে তার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে না।

জয়ন্তী কিছু একটা লিখে শিরিনের দিকে আবার এগিয়ে দেয়।

— আফা আমিও সেলাইয়ের কাজ জানি। চাচার বাসায় থেকে শিখেছি। আমাকে তাহলে আপনার সাথে নিয়ে যাইয়েন। তাহলে আপনাকে কিছুটা হলে-ও সহযোগিতা করতে পারবো।

শিরিন একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

— তাহলে ভালোই হলো, দুই বোন এক সাথে কাজ করবো, গল্পও করা যাবে। আচ্ছা তুমি তাহলে রেস্ট করো আমি একটু বাজারে যাবো। বাজার কিছু কেনাকাটা করতে হবে আর দোকান টাও বন্ধ করা হয়নি। আমি চলে আসবো কিছুক্ষণের মধ্যেই।

এই কথা বলে চলে গেলো শিরিন। জয়ন্তী বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়। জয়ন্তী ভাবছে আপন মানুষ গুলো খুব অদ্ভুত! আর শিরিনের সাথে তার কোনো রক্তের সম্পর্ক ও নেই। মানুষটা তাকে কীভাবে আপন করে নিয়েছে! বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে, জয়ন্তী রোদে মধ্যে হেঁটে আশায় সে অনেকটাই ক্লান্ত তাই বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিতেই হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।

অন্যদিকে শিরিন দোকান বন্ধ করে কিছু কেনাকাটা করে বাসায় ফিরে এসে দেখে জয়ন্তী ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়ন্তীর চোখের কোণে এখনো পানি লেগে আছে। জয়ন্তীর মায়াবী মুখের দিকে তাকাতেই শিরিনের মনটা খব নরম হয়ে গেলো। তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে! মানুষ কীভাবে এতো নিষ্ঠুর হতে পারে? একটা প্রতিবন্ধী মেয়েকে বাচ্চা সহ বাসা থেকে বের করে দিতে তাদের বুক কি একটা বারও কেঁপে উঠলো না? এরা কি মানুষ নাকি অ*মা*নু*ষ? আজ যদি মেয়েটার হাসবেন্ড বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো মেয়েটার সাথে এতো খারাপ কিছু হতোনা। আল্লাহ মানুষের কতো ভাবে পরিক্ষা নেয়।

এসব ভাবতে ভাবতে সে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করতে শুরু করে। রান্নাবান্না শেষ করে শিরিন জয়ন্তীকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে একটা নতুন সাদা শাড়ী দিয়ে জয়ন্তীকে বলল,

— বোন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, রান্না হয়ে গিয়েছে। খাবার খেতে হবে তো! সকাল থেকে তো না খেয়েই আছো। বাসায় ও কিছু ছিলনা যে তোমাকে কিছু খেতে দেবো।

জয়ন্তী একটা মুচকি হাসি দিয়ে শাড়ীটা নিয়ে ওয়াশরুমের ভিতরে চলে গেলো। জয়ন্তী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে বাচ্চাটা শিরিনের কোলে কান্না করছে। শিরিন জয়ন্তীকে দেখে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে জয়ন্তীকে বলল,

— বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। আগে বাচ্চাকে ঠান্ডা করো, আমি পারছিনা।

জয়ন্তী বাচ্চাকে কোলে তুলে খাওয়ানো শুরু করে।

এরপর থেকে জয়ন্তী শিরিনের সাথে থাকতে শুরু করে। এর মধ্যে কেটে গেলো কয়েক মাস। জয়ন্তী আর শিরিন প্রতিদিন দোকানে বসে। জয়ন্তী তার বাচ্চাকে নিয়ে যায় সাথে করে। জয়ন্তী আর শিরিন দোকান বন্ধ করে বাজারে যায় কিছু কেনাকাটা করার জন্য। তখনই জয়ন্তীর চোখ আঁটকে যায় একটা গাড়ির ভিতরে। জয়ন্তী সাথে সাথে দৌড়ে গাড়িটার কাছে যাওয়ার আগেই গাড়িটা চলে যায়। জয়ন্তী সেখানে দাঁড়িয়ে কান্না করতে শুরু করে। জয়ন্তীকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে শিরিন দৌড়ে চলে আসে।

— জয়ন্তী কি হয়েছে তোমার? এভাবে ছুটে আসলে কেন?

জয়ন্তী হাত দিয়ে ইশারা করে আর মুখ দিয়ে কিছু বলতে চায়। সে হয়তো ভুলে গিয়েছে তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়না। তার বলা কথা গুলো সে ছাড়া অন্য কেউ বোঝেনা। জয়ন্তীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আজ খুব আপসোস হচ্ছে তার। সে যদি বাক প্রতিবন্ধী না হয়ে সবার মতো কথা বলতে পারতো! জয়ন্তীর চোখের পানি মুছে দিয়ে শিরিন জয়ন্তীকে বাসায় নিয়ে আসে। জয়ন্তী তাড়াতাড়ি করে একটা কাগজ আর একটা কলম নিয়ে কিছু লিখে শিরিনের হাতে দেয়।

— আপু আমি আমার হাসবেন্ডে কে দেখেছি গাড়ির ভিতরে।

চলবে?