কোনো এক গোধুলী বেলায় পর্ব-০২

0
2

#কোনো_এক_গোধুলী_বেলায়
[দ্বিতীয় পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

মৃত মানুষ জীবিত হয় কীভাবে? জয়ন্তীর মুখে তার স্বামীর কথা শুনে অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শিরিন। যে মানুষ মারা গিয়েছে তাকে জয়ন্তী কীভাবে গাড়ির মধ্যে দেখে? শিরিন বুঝতে পারে জয়ন্তী হয়তো এখনও তার স্বামীর চিন্তায় আছে। তাই শিরিন বলল,

— জয়ন্তী হয়তো তোমার চোখের ভুল। যে মানুষ মারা গিয়েছে সে ফিরে আসে কীভাবে? হয়তো তুমি অন্য কাওকে দেখেছ। তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসো সেই জন্য অন্য কাওকে দেখে তোমার এমন মনে হয়েছে।

— আপু আমার চোখের এতো বড় ভুল হতে পারেনা। আমি নিলয়কে খুব ভালো ভাবেই চিনি। ওটা আমার নিলয় ছিলো। আমার সাথে একবার আমার শ্বশুর বাড়িতে চলুন প্লিজ। আমি একবার নিলয়কে দেখে চলে আসবো।

— জয়ন্তী নিজেকে সামলাও বোন। ওটা নিলয় ছিলনা। নিলয় তো মারা গিয়েছে।

— আপু শুধুই একবার যাবো। আমি একবার নিজের চোখে দেখবো। আমার চোখে এতো বড় ভুল হতে পারে না।

— আচ্ছা ঠিক আছে যাবো। পিয়াসকে কি করবে? আর পিয়াস কোথায়?

–পিয়াস ঘুমিয়ে আছে। ওকে নিয়ে যাবো। নাহলে ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি শুরু করবে আমাদের না দেখতে পেয়ে।

— আচ্ছা একবার গিয়ে দেখে আশি। তোমার মনের সন্দেহ যেনো সত্যিই হয়। তাহলে ছেলেটা তার বাবাকে ফিরে পাবে। তুমিও তোমার হারানো সংসার ফিরে পাবে৷ তোমার জন্য এই টুকু তো আমি করতেই পারি।

শিরিন পিয়াসকে কোলে তুলে জয়ন্তীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই জয়ন্তীর শ্বশুর বাড়ির সামনে চলে আসে। কিন্তু বাড়িতে তালা ঝুলছে।

শিরিন তালা ঝুলতে দেখে জয়ন্তীর দিকে তাকাল। জয়ন্তী মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে বাসার দিকে। এই বাড়িতে তার কতো স্মৃতি রয়েছে। দুইটা বছর এই বাড়িতে ছিলো সে। সব কিছুই এখনই আগের মতই আছে। কয়েকটি মাস হলো তাকে বের করে দিয়েছে।

— জয়ন্তী কেউ তো মনে হয় বাসায় নেই। মনে হয় কোথাও গিয়েছে।

জয়ন্তী ইশারায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। জয়ন্তীর ধারণা সবাই হয়তো বাহিরে গিয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। কিন্তু অনেক সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও এখন অব্দি কেউ এলোনা। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

শিরিন জয়ন্তীকে বলল,

— কেউ তো এখনও এলোনা। চলো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এখন আমাদের বাসায় যাওয়া উচিৎ।

জয়ন্তীর মন অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। যখনই তারা নিজেদের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তখনই একটা অচেনা লোক আসে। এসে সে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বাসার সব লাইট অন করে দেয়। জয়ন্তী আর শিরিন লোকটার কাছে চাক আশে। শিরিন লোকটাকে বলল,

— এই বাড়ির লোকজন কোথায় গিয়েছে বলতে পারেন?

লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

— এটা তো আমার বাড়ি। আপনারা কার খোঁজ করছেন?

জয়ন্তী কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলো। শিরিন জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল। জয়ন্তী তো কিছু বলতে পারছেনা। শিরিন আবার বলল,

— এই বাড়িতে তো আগে অন্য কেউ থাকতেন।

— জ্বি। এই বাড়িতে আগে অন্য একটা পরিবার ছিলো। তারা বাড়ি বিক্রি করে চলে গিয়েছে।

— কোথায় গেছে বলতে পারবেন?

— না, এসব ব্যাপারে তো আমাকে কিছু বলেনি।

— আচ্ছা ধন্যবাদ আপনাকে।

শিরিন জয়ন্তীর কাছে গিয়ে বলল,

— চলো বোন।

জয়ন্তীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। জয়ন্তী বুঝতে পারেনা তারা বাসা কেন বিক্রি করে চলে গেলো? তার স্বামী কি আদোও বেঁচে আছে নাকি সে আসলেই ভুল দেখেছে? তার স্বামী আসলে তো তাঁকে অবশ্যই খোঁজার চেষ্টা করতো। স্বামী যখন দেশের বাহিরে যায় তখন জয়ন্তী প্রেগন্যান্ট ছিলো। পিয়াসের জন্মের পর থেকে আর যোগাযোগ হয়নি স্বামীর সাথে। হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার দুই মাস পরে খবর আসে জয়ন্তীর স্বামী মারা গিয়েছে রোড এক্সিডেন্টে। তারপর থেকে শ্বশুর শ্বাশুড়ির অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। ভালো ভাবে খেতে দিতো না। মেয়েটার যে মানুষীক শান্তির দরকার সেই টুকোও পায়নি কারোর কাছে। রাতে কান্নার করে ঘুমিয়ে পড়তো। নিজের সন্তানের কথা ভেবে সব কিছুই সহ্য করতেন জয়ন্তী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে বাচ্চাকে সহ।

জয়ন্তী আর শিরিন নিজের বাসায় চলে আসে। জয়ন্তী এখনও কান্না করেই যাচ্ছে। শিরিন জয়ন্তীর কাছে এসে বলল।

— কান্না করে আর কি হবে? কান্না করোনা বোন। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার স্বামী যদি সত্যিই বেঁচে থাকে তাহলে তার সাথে তোমার অবশ্যই দেখা হবে কোনো এক দিন। ছেলেটা কান্না করছে ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি একটু দোকানে যাই। সারাদিন তো তেমন একটা কাজ করতে পারিনি। কিছু জামাকাপড় কাল ডেলিভারি দিতে হবে। আমার ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। তুমি দরজা বন্ধ করে দিবে।

এই কথা বলে শিরিন চলে গেলো। জয়ন্তী বাসায় একাই থাকে। স্বামীর সাথে কাটানো মুহুর্ত গুলো খুব মনে পড়ছে। সে বাক প্রতিবন্ধী হলেও সংসারে কোনো অশান্তি ছিলনা। স্বামী খুব ভালোবাসতো জয়ন্তীকে। জয়ন্তী এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে সে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ দরজার শব্দ শুনে চোখ খুলে জয়ন্তী। জয়ন্তী তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিয়ে দেখে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে শিরিন। শিরিন ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জয়ন্তীকে বলল,

— জয়ন্তী তোমার জন্য একটা খবর আছে। এবার মনে হ তোমার কষ্টের দিন শেষ হতে চলছে।

জয়ন্তী শিরিনের কথা শুনে শিরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শিরিন আবার বলল,

— আমাদের দোকানে মাঝেমধ্যে আসে যে রহিম মেয়া, উনি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তোমার জন্য।

— কীসের প্রস্তাব?

— ওনার নাকি একটা ছেলে আছে। ওনার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তোমা ব্যাপারে সব শুনেছে। উনি তোমাকে তার ছেলের বউ করে নিতে চায়। আর বলেছে পিয়াসকেও তোমার সাথে রাখতে পারবে। উনিও কিন্তু খুব ভালো মনের মানুষ। আমি এখনও কিছু বলিনি তোমার তো নিজের মতামতের দরকার আছে।

জয়ন্তীর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে গিয়ে পিয়াসের পাশে বসে পড়ে। শিরিন জয়ন্তীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল,

— বোন ভেবে দেখো। পিয়াসের কথা অন্তত চিন্তা করো। ওর তো বাবার খুব প্রয়োজন। আর তোমার ও এখনো বয়স বেশি হয়নি। ওনার পরিবার ও খুব ভালো। তুমি ওখানে ভালোই থাকবে। পিয়াস ও খুব ভালো ভাবে বড় হবে। সে বাবার একটা পরিচয় পাবে। আমার মনে হয় তোমার রাজি হয়ে যাওয়া দরকার।

জয়ন্তী কিছু না বলে মন খারাপ করে বসে রইলো। শিরিন আবার বলল,

— আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে। আর বিষয়টা ভেবে আমাকে উত্তর দিবে।

এই কথা বলে শিরিন চলে গেলো। জয়ন্তী ঘুমাতে যায় কিন্তু তার চোখে কোনো ঘুম আসছেনা। তার কেমন যেনো খারাপ লাগা কাজ করছে। সে দোটানায় পড়ে গেল। কি করবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। তার কেনো জানি হাসবেন্ডের কথা মনে পড়ছে। তার যায়গায় অন্য কাওকে সে বসাতে পারছেনা। জয়ন্তী উঠে চলে গেলো জানালার পাশে। সে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর শীতল হয়ে এসেছে। হঠাৎ তার কাঁধের উপর কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই সে চমকে উঠে। পিছনে তাকাতেই সে হতবাক হয়ে যায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার হাসবেন্ড নিলয়। নিলয়কে দেখে জয়ন্তী নিলয়কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে।

চলবে?