মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব-০১

0
34

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#ইশরাত_জাহান
#সূচনা_পর্ব

মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শাহানা পারভীন বলেন,”জানিস মা!মেয়েদের জীবনে নির্দিষ্ট কোনো পরিচয় নেই।বিয়ের আগে বাপের ইচ্ছায় নাম নিয়ে চলে।বিয়ের পর স্বামীর ইচ্ছায় নামে চলে।এই সমাজে চলতে গেলে পুরুষ মানুষের নাম ধরে রাখতে হয়।তা নাহলে যে মানুষ মূল্য দেয় না।”

মায়ের কথার বিপরীতে মোহনা বলে,”আমার তো বাবা নেই।তাও কেনো তার নাম নিয়ে থাকবো!সে তো আমাদের ছেড়ে আরেক বিয়ে করছে।সুন্দরী মেয়ে পেয়ে আমাদের ছেড়ে দিলো।একবারও আমার কথা ভাবলো না।”

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছলো শাহানা পারভীন।তাদের তালাক হয়েছে।কিন্তু সন্তান তো তার বংশের।এটাই যে নিয়ম নীতি।সন্তান মায়ের কাছে থাকুক আর বাপের কাছে।এটা যায় আসে না।আসল কথা সন্তান কোন বংশের।

~~~~~~~~~~~মোহনা যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে,
একদিন তার বাবা মোহন সরদার বউ নিয়ে বাড়িতে ঢোকে।মোহনার মা শাহানা পারভীন যেনো অবাক নয়নে চেয়ে ছিলেন।উহুম স্বামীর দিকে না,তাকিয়ে ছিলেন তার আদরের কন্যা মোহনার দিকে। মোহনাও তখন স্কুল থেকে এসে বসেছে মাত্র।

শাহানা পারভীন জিজ্ঞাসা করেছিলেন,”কেনো করলেন এই বিয়েটা আপনি?মেয়ের কথা কি একটি বারের জন্যেও ভাবলেন না?”

উত্তরে মোহনার বাবা মোহন সরদার বলে,”একেতো তুমি দেখতে কালো তার উপর জন্ম দিয়েছো এক কন্যা সন্তান।কি লাভ হবে এই কন্যা দিয়ে আমার?”

“কন্যা সন্তান হয়েছে তো কি হয়েছে?ওর এই মায়াভরা মুখটি কি আপনাকে একটুও নরম করতে পারলো না?”

“শোনো মোহনার মা,তোমাকে আমার এমনিতেও ভালো লাগতো না।তুমি এই যুগের শিক্ষিত ব্যাক্তি বলে বাবা তোমার সাথে আমার বিয়ে দেয়।তাছাড়া তোমার বাবা আমাদের একটু সাহায্য করে তার প্রতিদান হিসেবে তুমি এই বাড়ির বউ হয়েছো।কিন্তু আমি তো তোমাকে বিয়ে করতে চাই নি।এমনিতেও গ্রামের মেয়ে তার উপরে কালো আবার জন্ম দিয়েছো এক মেয়ে সন্তান।এই সোনালী(মোহন সরদারের দ্বিতীয় বউ) দেখতেও রূপবতী আবার শহরের মেয়ে।ওকে আগে কবিরাজ দেখাইছি উনি বলেছে আমাদের এবার ছেলে সন্তান হবে।”

শাহানা পারভীন চোখের পানি মুছে তাচ্ছিল্য সুরে বলে ওঠে,”ভাগ্যিস আমি গ্রামের মেয়ে।তা নাহলে হয়তো আপনাদের মত অশিক্ষিত মানুষদের মত আমিও কিছু কিছু ভন্ড কবিরাজ ও পীরের ভক্ত হতাম।”

ঠাস করে শাহানা পারভীনের গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেন মোহন সরদার।রাগ দেখিয়ে গলা উচু করে বলে,”কত বড় সাহস তোর?আমাকে অশিক্ষিত বলিস।তোকে আমি আজই তালাক দিবো।এক তালাক দুই তালাক তিন তালাক।”

বলতে না বলতেই মোহন সরদারের গালেও একটি থাপ্পড় পরে। থাপ্পড়টি দিয়েছে মোহন সরদারের বড় ভাই মাহমুদ সরদার।ভাইয়ের উপর খোপ নিয়ে বলে,”বাহ ভাই বাহ।বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথে নিজের রং পাল্টে ফেলেছিস।এই শাহানার বাবা না থাকলে আজ আমরা পথের ফকির হয়ে থাকতাম।ভুলে যাস না এই শাহানার বাবার টাকায় আমাদের ব্যাবসা আজ সাফল্য হয়েছে। আর তুই কি না গ্রামের মেয়ে কালো বলে খোঁচা দিচ্ছিস শুধু তাই না পবিত্র কন্যা সন্তান বলে তাকে নিয়ে আজ অহংকার করছিস?মেয়ে তো তোর রক্তের।কি করে পারলি আজ প্রভাবশালী হয়ে নিজের সন্তানকে ঠকাতে?একবারও কি পিতৃত্বের মায়া জেগে ওঠেনি?”

“তোমার ঘরে ছেলে আছে বলে তো বুঝতে পারছো না ছেলে না হলে কত জ্বালা।তুমি তো নিজের সম্পত্তির পরিমাণ ঠিকই বেশি বেশি নিয়ে ভোগ করবে।আমার দিকটাও আমাকে বুঝতে দেও।নিজের ষোলো আনা পূরণ হয়েছে বলে স্বার্থপরের মত কথা বলতে এসো না।”

অবাক হলো মাহমুদ সরদার।মাহমুদ সরদারের পরিবার আগে প্রভাবশালী ছিলো।সরদার পরিবারের পারিবারিক ব্যাবসা আছে।যেটাতে মাহমুদ সরদার ইন্টারেস্টেড ছিলেন না।তিনি রাজনীতি করতেন।মাহমুদ সরদারের বাবা ও মোহন সরদার ব্যাবসা দেখতেন।মাঝখানে ব্যাবসা বাণিজ্যে বিভিন্ন লস হতে থাকে।মাহমুদ সরদারের বউ মিসেস মালিনী তার পরিবার থেকে অনেক সাহায্য করে।কিন্তু তারপরও সমস্যার সমাধান হয় না।অবশেষে শাহানা পারভীনের বাবা তার ব্যাবসার অর্ধেক টাকা ও ঢাকায় কিছু জমির অংশ মোহন সরদারের নামে করে দেন।বিনিময়ে ভালো বংশ দেখে শাহানা পারভীনকে বিয়ে দেন।শাহানা পারভীন অনেক বুদ্ধিমতি নিজের বুদ্ধি দিয়ে স্বামীর ব্যাবসায় উন্নতি করিয়ে দেন।মাহমুদ সরদারের ছেলে এখন দেশের বাইরে মিসেস মালিনীর ভাইয়ের কাছে গেছে।ওখানে পড়াশোনা করছে।মাহমুদ সরদার কখনও ভাইয়ে ভাইয়ে ভেদাভেদ দেখেন না।উল্টো বাবা মারা যাওয়াতে ব্যাবসা তার নামেই করে দিয়েছে।আজ সেই ভাই তাকে এতবড় কথা শুনালো।মাহমুদ সরদার সাথে সাথে বলে ওঠে,”আমি স্বার্থপর! আর তুই যে মেয়ে বউয়ের কথা না ভেবে আরেক বিয়ে করলি তাও কি না নিজের স্বার্থের কথা ভেবে তার কি হবে?”

“নিজের সুখ পেতে আমি এই বিয়ে করেছি।সুন্দরী বউ কে না চায়!ওরকম কালো গ্রাম্য মেয়ে দিয়ে আমি কি করবো?”

“কালো আর গ্রাম্য দেখলি,কিন্তু শিক্ষিত আর উচ্চ বংশ এটা দেখলি না।আজ তুই এই নারীকে তিন তালাক দিয়ে বাঁধন ছাড়া করেছিস।একদিন বুঝবি জীবনের কি কি হারিয়ে ফেলেছিস তুই।”

“এসব নাটক সিনেমার কথা শুনতে আগ্রহী নই।”বলেই নতুন বউ নিয়ে চলে গেলো ঘরে।

মাহমুদ সরদার শাহানা পারভীনের মাথায় হাত দিয়ে বলে,”বোন আমার,তোমার এই ভাইকে ক্ষমা করে দিও।এই অপদার্থ ভাই তোমার কোনো উপকার করতে পারেনি।”বলেই কান্না করতে লাগলেন।

শাহানা পারভীন বিয়ে করে এসে স্বামী ও শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করে থেকেছেন।কিন্তু এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছে।মাহমুদ সরদার ও তার বউ মালিনী শাহানা পারভীনকে বোনের মত করে স্নেহ করতেন।

ওইদিন শাহানা পারভীন মোহনাকে নিয়ে চলে আসে নিজের গ্রামে।থাকবেন না আর এই বাড়িতে।গ্রামে আসার কয়েকদিন পরই তালাকের কাগজ পাঠান মোহন সরদার।তালাক দেন একে অপরকে।মোহনা সেদিন থেকে মাকে কান্না করতে দেখেছে।বাবার প্রতি জন্ম নিয়েছে তার ঘৃণা।

ওইদিনের পর মোহনাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করানো হয়।মোহনার যাবতীয় খরচ খরচা শাহানা পারভীন ও তার বাবা চালান। মোহনার নানুর একটি গার্মেন্টস আছে।ওখানে এখন কাজ করে শাহানা পারভীন।নানুর গড়া গার্মেন্টস এখন মোহনার মা দেখাশোনা করে।এভাবেই দুই বছর চলে যায় মোহনার।

আজ মোহনার স্কুলে ফরম ফিলাপ করতে হবে।পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার জন্য।এই দুই বছর শাহানা পারভীন ফরম ফিলাপ করতেন।কিন্তু আজ মোহনা শাহানা পারভীনকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো যে সে বড় হয়েছে নিজের যোগ্যতায় ফরম ফিলাপ করেছে।কিন্তু ফরম ফিলাপ করতে যেয়ে উল্টো স্কুল থেকে নালিশ আসে শাহানা পারভীনের কাছে।স্কুলে যেয়ে জানতে পারেন নাম লেখা নিয়ে তর্ক হয়েছিলো বন্ধু বান্ধবীদের সাথে।

শাহানা পারভীনের আইডি কার্ড অনুসারে মোহনা তার নাম শাহানা পারভীন লিখেছে।বাবার নামের জায়গায় মোহন সরদার দিতে হয়েছে। আর নিজের নাম দিয়েছিলো মোহনা শেখ।মোহনার নানাবাড়ির সবাই শেখ বংশের তাই ফরমে মোহনা শেখ দিয়েছিলো।

এটা বান্ধবীরা মিলে দেখে বলে ওঠে,”সন্তানদের বাবার নামের সাথে নাম দিতে হয়।তোমার নাম মোহনা শেখ না মোহনা সরদার হবে।”

“আমার নাম মোহনা সরদার দিবো না।আমার বাবা নেই।আমি মায়ের নামেই দিবো।”

“বাবা নেই তাহলে বাবার নাম ফরমে দিয়েছো কেনো?”

চুপ করে থাকে মোহনা।খুব কষ্ট লাগে তার।বাবা বেচে আছে তাও কি না বাবা নেই।যে বাবা তাকে ছেড়ে দিয়েছে তার নাম কি না সার্টিফিকেটে দিতে হচ্ছে।

মোহনার আরেক বন্ধু টিটকিরি মেরে বলে,”বাবার নামে নিজের নাম রাখবে না আবার বাবার নামের জায়গায় তো ঠিকই তার নাম দিতে হয়।”
বলেই সবাই হাসাহাসি করে।

সহ্য হয় না মোহনার।সাথে সাথে চিল্লিয়ে ওঠে সে।ক্লাসে ম্যাম ছিলেন।সবার ফরম দেখা নিয়ে ব্যাস্ত তিনি।মায়ার চিল্লানো শুনে মায়ার বেঞ্চে এসে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”

মোহনার বন্ধু বান্ধবীরা বলে,”ম্যাম মোহনা নাম ঠিক ভাবে লিখছে না।আবার আমাদের সাথে চিল্লাচিল্লি করতে থাকে।”

ম্যাম মোহনার ফরম দেখে।ফরম দেখে বলে,”মোহনা তুমি এখানে ভুল নাম দিয়েছো।তোমার মা এতদিন এখানে মোহনা সরদার লিখতো।তোমার জন্মনিবন্ধনের সাথে মিল রেখে চলতে হবে তো।সার্টিফিকেট আলাদা হলে তোমার সমস্যা হবে।”

মোহনা কান্না করে দেয় সেখানে।সে কিছুতেই এই নাম নিয়ে চলবে না।বাবা নেই তাও বাবার নাম ব্যাবহার করতে হয় আবার এখন সেই বাবার টাইটেল।কিছুতেই নিবে না এই টাইটেল বলেই কান্না করে।

শাহানা পারভীন এই কথাগুলো শুনে কষ্ট পায় কিন্তু কিছু না বলে নিজের মতো করে ফরম পূরণ করে মোহনাকে নিয়ে বাসায় আসে।তারপর মোহনাকে কোলে নিয়ে ওগুলো বুঝাতে লাগেন।

মোহনা তারপর থেকে জেদ শুরু করে সে তার নাম তার ইচ্ছাতে রাখবে।অনেক কান্নাকাটির পর শাহানা পারভীন রাজি হলেন মোহনার নাম পাল্টাতে।মোহনার ইচ্ছাতে দেওয়া হলো মোহনার নতুন নাম ‘মেহেরুন জাহান মায়া’।

পৌরসভায় অনেক দৌড়াদৌড়ি করে মায়ার জন্মনিবন্ধনের নাম পাল্টাতে হয় ।সাথে স্কুলের পেপারগুলো তো আছেই।এতে অবশ্য শাহানা পারভীন নিজেও খুশি হয়েছেন।যে লোক তাদের ছেড়ে চলে গেছে তাকে নিয়ে পরিচয় না রাখাই ভালো।
এরপর থেকে মায়ার সব জায়গায় নাম থাকে ‘মেহেরুন জাহান মায়া’।

মায়ার এখন একটাই সপ্ন/ইচ্ছা নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার বাবার সামনে দাড়াবে।কালো মাকে নিয়ে অহংকার করবে ওই বাবা নামক বিশ্বাস ঘাতকের কাছে।১২ বছর বয়সী মায়া মনে মনে জেদ রেখে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে।নিজেকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যাতে মোহন সরদার বুঝতে পারে যে মেয়েরাও কম না।ছেলের জন্য সে বউ ও মেয়েকে ত্যাজ্য করেছে একদিন এই মেয়েকেই সে চাইবে।ভিক্ষা করতে আসবে এই কালো বউয়ের সামনে।এটাই মায়ার ইচ্ছা।

চলবে…?