মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব-০৫

0
17

#মায়াবতীর_ইচ্ছা
#ইশরাত_জাহান
#পর্ব_৫
🦋
ড্রয়িং রুমে কান চেপে দাড়িয়ে আছে দুইজন মেইড।ভয়তে কাপতে থাকে তারা।ভিতর থেকে শব্দ আসছে ভাঙচুরের।ঘন্টাখানিক এমন হওয়ার পর সবকিছু সাভাবিক হয়ে আসে।ভাঙচুরের শব্দ কমে যায়।সাথে সাথে দুইজন মেইড যায় উপরে।ঘরে যেয়ে দেখতে পায় ঘরের সবকিছু এলোমেলো। কাচের জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুরে একাকার।মেঝের কিছু কিছু জায়গায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।অতঃপর তারা তাকালো ঘরের মালিকের দিকে।দুই হাঁটু ভাঁজ করে মুখ গুঁজে কান্না করতে থাকে মায়া।হাত থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে তার। কাচের জিনিসপত্র ভাঙতে যেয়ে ডান হাতের অনেকটাই কেটে গেছে।মহিলা মেইড এসে মায়ার মাথায় আলতো করে হাত রাখলো।মায়া চোখ মেলে তাকালো মহিলা মেইড এর দিকে।ওনাকে মায়া হাসি বলে ডাকে।হাসিকে দেখে মায়া তার কোলে মাথা রাখলো।হাসি বুঝতে পারলো মায়া এখন ভালোবাসা খুঁজছে।মেয়েটার দুনিয়াতে ভালোবাসার কেউ নেই।একা একটি মেয়ে ভালোবাসা ছাড়া বসবাস করছে।ভালোবাসার কাঙাল হয়ে আছে মায়া।হাসি মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”কি হয়েছে তোমার?”

হাসির কোলে মাথা রাখা অবস্থায় মায়ার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। মুছেনা এই পানি।শূন্যে তাকিয়ে বলে,”সবার জীবন যুদ্ধে এই মায়া জিতে গেলেও নিজের জীবন যুদ্ধে এই মায়া হেরে গেছে।কেনো হারলাম আমি বলতে পারো?”

“হয়তো তোমার প্রতিপক্ষ অনেক বেশি শক্তিশালী।ভিতরে ভিতরে এমন কোনো শক্তি আছে যা তুমি জানো না।চোখের অগোচরে হয়তো তোমার ক্ষতি করে দিচ্ছে।”

“আমার এখন কি করা উচিৎ হাসি?”

“ধৈর্য্য ধরো।তোমার মায়ের জীবনে তো কম ঝড় যায়নি।তাও তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন।তোমাকেও ধৈর্য ধরতে হবে।”

“মা ধৈর্য ধরে মুখ বুজে ছিলো বলেই তো সে আজ পুরো দমে হেরে গেছে।কই মা তো এখন তার মায়ার কাছে নেই।মায়া যে এখন মা ছাড়াও একা বাঁচতে শিখেছে।এত বিলাসিতা এত বড় বড় অট্টালিকা আমার।মা তো একবারের জন্যও দেখতে পারছে না।মায়ের মত ধৈর্য ধরতে গেলে যে আমাকেও মায়ের মত শূন্যতা ভোগ করতে হবে।”

“তাহলে অন্য উপায় দেখো।”

“যেমন?”

“আসল অস্ত্র খুঁজতে থাকো।যেই শত্রুকে দমন করতে উঠেপড়ে লেগেছ তার আশেপাশের সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হও।শত্রুর দুর্বলতা সম্পর্কে আরো ভালো করে জানো।নিজেকে সাকসেস বিজনেসম্যান বানালেই শত্রুর দমন হয় না।পাশাপাশি নিজের শত্রুর দুর্বলতা ও শক্তিশালী চাবিকাঠি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে।”

হাসির কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলো মায়া।হাসি মায়ার গ্রামের বাড়িতে থাকা সার্ভেন্ট।মায়া তাকে এখানে এনেছে নিজের জন্য।হাসি মায়ার মায়ের বয়সী।তাই মায়া হাসিকে অনেক ভালোবাসে।হাসির কথা শুনে মায়া হাসির দিকে তাকায়।মায়া বলে,”আমার চোখের পানি মুছে দেও হাসি মা।তারপর আমাকে কিছু খাইয়ে দেও।”

হাসি বুঝতে পারলো মায়া এখন শাহানা পারভীনকে খুব মিস করছে।যখনই মায়ের কথা মনে পরে তখন মায়া হাসিকে হাসি মা বলে।হাসি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে চলে যায় খাবার আনতে।অন্য সার্ভেন্টসকে পাঠিয়ে দেয় ঘর পরিষ্কার করতে।ঘর পরিষ্কার হলে হাসি খাবার এনে মায়াকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।তারপর হাতের ব্যান্ডেজ করে চলে যায় ঘর থেকে।

রাতে~~~
রাজ বাসায় আসার পর হিয়া ও সিয়ার সাথে আড্ডা দিতে থাকে।তারপর মাহমুদ সরদারের সাথে আলোচনায় বসে।মাহমুদ সরদার বলেন,”তোমার এসিস্ট্যান্ট কল করেছিলো।বললো কাল মিটিং আছে তোমার ।এটা নাকি ফ্যাশন হাউজের সাথে করা হবে।ফ্যাশন হাউজের কোম্পানির উদ্বোধনে তোমাকে ওয়েলকাম করার জন্য ডাকা হয়েছে।এই জন্য ওই ফ্যাক্টরির মালিক নিজে তোমার সাথে কথা বলতে চায়।কিভাবে কি করলে তোমার সুবিধা হবে তাই।”

“ওকে বাবা,আমি যাবো কাল মিটিংয়ে।তোমার ভাইয়ের কি খবর এখন?লোকেদের সাথে তো কথা বলে কেস উল্টিয়ে দিলাম। আশা করি সব সমাধান হয়েছে?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহমুদ সরদার বলেন,”হ্যা,হয়েছে সমাধান।সে এখন রিলাক্স আছে।তার ছেলে মেয়েরাও রিলাক্স আছে।”

রাজ হালকা হেসে বিদায় নিলো।ঘুমাবে এখন সে।কালকে মিটিং দশটায় করা হয়েছে।বেশি রাত জাগতে চায় না।

হিয়া কিচেনে এসেছে চা বানাতে।হিয়ার গল্প পড়ার এক আলাদা নেশা আছে।সরদার বাড়ির ড্রয়িং রুমের সাথে সেট করে একটি বুকশেলফের ঘর করা।যেটাতে বেশিরভাগ সময় হিয়া থাকে।চা বানিয়ে হিয়া চায়ে প্রথমে এক চুমুক দেওয়ার পর আবার যখন চুমুক দিবে তখনই হিয়ার কাছ থেকে চায়ের কাপ ছিনিয়ে নেওয়া হয়।চায়ের কাপটা নিয়ে সে নিজেও চায়ের কাপে দিলো এক চুমুক।হিয়া জানে এই লোকটি আর কেউ না রৌদ্রদ্বীপ রুদ্র।

রুদ্রর শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ার ব্যাপারটা বিরক্ত লাগে হিয়ার কাছে।চোখের চশমা ঠিক করে হিয়া বলে,”এভাবে শব্দ করে করে কেউ চা খায়? আর আমাকে বললেও তো আমি চা বানিয়ে দিতে পারতাম।”

রুদ্র হিয়ার চোখের থেকে চশমা নিয়ে চশমায় ফু দেয়,তারপর একটু পরিস্কার করে হিয়ার চোখে চশমা পড়িয়ে দেয়।তারপর বলে,”তুই আমাকে হয়তো অন্য চা বানিয়ে দিবি।কিন্তু বিশ্বাস কর তোর ছোয়া লেগে যে স্বাদ এই চায়ে আমি পাই এটা অন্য কোনো চায়ে পেতাম না।”

“সারাদিন অন্যান্য মেয়েদের সাথে থেকে মদের স্বাদ নেওয়া বুঝি কম হয়ে যায়।এখন আমার কাছে এসেছেন!”

“মদ আর অন্যান্য মেয়েরা তোর কাছে জিরো রে হিয়াপাখি।”

“কথা বলবেন না আপনি আমার সাথে।নষ্ট পুরুষ মানুষ কোথাকার।আমাকে আবার চা বানাতে হবে।”

রুদ্র বাকা হাসি দিয়ে হিয়ার মাথার চুলে এক টান দিয়ে বের হয়ে যায়।হিয়া ব্যাথা পায় প্রচুর।কিন্তু রুদ্রর সাথে কথা বাড়ায় না।

যেতে যেতে রুদ্র বলে,”চোখের নিচে কালো দাগ জমেছে হীয়াপাখি।প্রেমের উপন্যাস না পড়ে ক্লাসের বইগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়।অন্তত রেজাল্ট ভালো হবে।কি লাভ যদি প্রেমের উপন্যাস পড়েও এই রুদ্রর প্রেমে না পড়লি!”

রুদ্রর কথায় হিয়ার ঠোঁটের গোড়ায় কিঞ্চিৎ হাসির দেখা দিলো।চা বানিয়ে সে পড়তে থাকে গল্পের বই।হিয়া ও সিয়া ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে।সিয়া হিয়ার থেকে দশ মিনিটের বড়।সিয়া সাইন্স নিয়ে পড়াশোনা করছে।সিয়ার সপ্ন ডক্টর হওয়া আর হিয়া পড়াশোনায় অত মনোযোগী না তাই সে আর্স নিয়ে পড়াশোনা করে।হিয়ার কোনো সপ্ন নেই,তবে হিয়ার নেশা গল্পের বইয়ের প্রতি।

সকালে~~
রাজ ও পিয়াশ সাথে মায়ার এসিস্ট্যান্ট বসে আছে একটি কক্ষে।মিটিংয়ের জন্য রাজকে ডাকা হয়েছে অথচ মায়া এখনও আসেনি।মায়ার লোকেরা কল করতে থাকে মায়াকে।

পিয়াশ মায়ার এসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞাসা করে,”তোমাদের ম্যাডাম আমাদেরকে ইনভাইট করে সে নিজেই এখানে উপস্থিত নেই।তাহলে এই মিটিংয়ের মানে কি?আমাদের মন্ত্রী মশাই এর কি সময়ের মূল্য নেই?”

ঠিক সেই সময় মায়া হাজির হয়।মায়া বলে,”মন্ত্রী মশাই এর সময়ের দাম আছে বলেই তো এক্সেক্ট টাইমে মায়া এসেছে।দশটায় মিটিং মন্ত্রী মশাই এর যদি তাড়াহুড়া বেশি থাকতো তাহলে আগে থেকেই বলে দিতো।আমরা তার সুযোগ বুঝেই সময় নিতাম।দশটা বলেছি ঠিক কাটায় কাটায় দশটায় পৌঁছেছি।এক মিনিট এদিক ওদিক করিনি।”

মায়াকে দেখে রাজ পিয়াশকে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে। পিয়াশ রাজের কাছেই ছিলো।রাজ পিয়াশের কানে কানে বলে,”ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ারনিং দিচ্ছি তোমাকে।আমার মায়াবতীর জন্য আমি সবকিছু সহ্য করবো।তুমি এর ভিতর বাম হাত ঢুকাবে না।”

“কিন্তু স্যার ওনার জন্য তো আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করলেন।”

“আমার মায়াবতীর জন্য অপেক্ষা করবো না তো কি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো?কি বলতে চাও তুমি?এই বয়সে বউ না খুঁজে পি এর লেজ ধরে থাকবো!”

পিয়াশ আর কিছু বলে না। এ বেটা বউ না হয়েই বউ বউ বলে মুখের ফেনা উঠিয়ে দিচ্ছে।বউ হওয়ার পর কি করবে কে জানে!রাজ ও মায়া কথা বলে উদ্বোধনের সময় ও নিয়ম কানুন ঠিক করে নিলো।রাজের মতামতের উপর ডিপেন্ড করেই উদ্বোধন করা হবে।মিটিং শেষে মায়া রাজ ও পিয়াশ বাদে সবাই চলে যায়।রাজ পিয়াশকে ইশারা করে যেতে বলে। পিয়াশ চলে যায় মিটিং রুম থেকে।

মায়া তার পেপার্সগুলো নিয়ে বের হবে ঠিক তখনই রাজ এসে মায়ার ডান হাত ধরে বলে,”হাত কেটেছে কিভাবে?”

মায়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলে,”মায়ার অনুমতি ব্যাতিত মায়ার শরীরে কেউ টাচ করতে পারে না।মাইন্ড ইট মিস্টার শাহমীর রাজ।”

বলেই যেই মায়া ঘুরে তাকায় ওমনি রাজ আবারও মায়ার বাম হাতের বাহু ধরে নিজের কাছে আনে।মায়াকে এক ঝটকায় টেবিলের উপর বসিয়ে মায়ার দুই পাশে হাত রাখে।তারপর মায়ার চোখে চোখ রেখে মায়াকে বলে,”আব্বে এই মায়াবতী। শাহমীর রাজ কারো অনুমতিতে চলে না।কেউ অধিকার দিক বা না দিক!অধিকার কেরে নিতে জানে এই শাহমীর রাজ।একবার যখন এই মায়ার মায়াতে রাজের মনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে মনে রাখবে এই মায়াবতী শুধু আমার।”

বলেই রাজ চলে যায়।রাজ যাওয়ার পরও মায়া টেবিলের উপর বসে রাজের কথাগুলো ভাবছে।আজ প্রথম কেউ তার প্রতি অধিকার নিয়ে কথা বলেছে।স্মিত হাসলো মায়া।বার কয়েক আওড়ালো,”শাহমীর রাজ, ডিয়ার মন্ত্রী মশাই।”

চলবে…?