মনের অনুরণন পর্ব-১০+১১

0
2

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১০

আয়েশা বেগমের কথায় আবরাহামের মুখটা চুপসে গেল। ধীর কন্ঠে মাথা নিচু করে বলল,
“বাবা চার বছর আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”

আয়েশা বেগম আবরাহামের কথায় স্থির হয়ে গেলেন। তার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। আব্রাহামের বিষণ্ণ কণ্ঠে বলা কথাগুলো যেন তার হৃদয়ের গভীরে আঘাত করল। কিছুক্ষণ যেন বোবা হয়ে রইলেন তিনি। ধীরে ধীরে, খুবই কষ্টের সাথে বললেন,

“ভাইজান আর নেই? আর আমিই কিছু জানলাম না…!”

তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এলো, চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগল। আবরাহামের মাথা নিচু, তারও চোখে শোকের ছাপ। আয়েশা বেগম ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে আবরাহামের কাঁধে হাত রাখলেন।

“রিয়াদ ভাইজান… তিনি তো সবসময় আমাদের সবার মঙ্গল চেয়েছেন। এত বড় একটা দুঃসংবাদ আমি জানতে পারলাম না। এত দূরে ছিলাম, এত দূরে..!”

আবরাহাম ধীরে ধীরে মাথা তুলল, তার চোখেও অশ্রুর ছায়া।

“ফুপি, অনেক কিছুই বদলে গেছে। বাবার চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের জীবনে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই।”

আয়েশা বেগম নীরব হয়ে আবরাহামের কথা শুনছিলেন। চারপাশের বাতাসে বৃষ্টির শব্দ মিশে ছিল, যেন তাদের শোকের সাথে প্রকৃতিও মিলেমিশে শোক পালন করছে।

আয়েশা বেগম ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। আবরাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি তার মধ্যে সেই ছোট্ট শিশুটিকে খুঁজে পাচ্ছিলেন, যে একসময় তার চারপাশে দৌড়াতো, হাসতো। কিন্তু এখন সেই ছোট্ট রিয়াদ ভাইজানের ছেলে আবরাহাম এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

“আমাদের জীবনগুলো কতটা বদলে গেছে, এক মুহূর্তে সব কিছু ভেঙে পড়ে,” আয়েশা বেগম চোখ মুছে বললেন।

আবরাহাম মাথা নাড়ল। তার ঠোঁটে সামান্য কাঁপল।

“তুমি জানো ফুপি, বাবার মৃত্যুর পর আমি অনেক কিছু মেনে নিয়েছি। আমার জীবন যেন একধরনের শূন্যতায় ভরে গেছে। আমি সবসময় ভাবতাম, তুমি এবং বাকিরা হয়তো আর আমার জীবনে নেই… কিন্তু আজ এখানে দাঁড়িয়ে, তোমার সামনে, আমি বুঝতে পারছি, কিছু সম্পর্ক কখনো সত্যিই হারিয়ে যায় না।”

আয়েশা বেগম আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, “তোর দাদী সব সময় বলতেন, তুই একদিন ফিরে আসবি। আমি ভাবিনি, তুই এভাবে ফিরবি, এত শূন্যতা নিয়ে।”

আবরাহাম আর কিছু বলতে পারল না। আয়েশা খানিকবাদে বললেন,
“ভাবি!”

আবরাহামের মুখের রঙ যেন পাল্টে গেল। মুহূর্তেই নাকের অগ্ৰভাগ লাল বর্ণ ধারন করলো। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল, যেন একটা তিক্ত স্মৃতি তার মনের কোণে আলোড়ন তুলল।
রেদোয়ান এতটাসময় চুপ থাকলেও। এখন আর পারলোনা। ধীর পায়ে আবরাহামের কাছে এগিয়ে এসে ওর কাধে হাত রাখলো। আবরাহাম মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। রেদোয়ান আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি আমি না হয় বলি।”

আয়শা বেগমের ভ্রুযুগল কুচকে গেল। ইকবাল সাহেব আর সামিয়া নিরব দর্শক। আয়েশা বেগম এবার চোখ তুলে রেদোয়ানের দিকে তাকালেন।

রেদোয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগল,
“আবরাহামের বয়স তখন আট, আনিশা জন্মগ্ৰহণ করেছে ছয়মাস হবে। তখন থেকে নীলিমা আন্টির সম্পর্ক হয় অন্য পুরুষের সাথে। এ নিয়ে আঙ্কেল আর আন্টির মধ্যে অনবরত ঝামেলা হতেই থাকে। যার অনেকটাই প্রভাব পড়েছিলো ছোট্ট আবরাহামের উপর। দিন যাচ্ছিলো ঝামেলা যেন বেড়েই যাচ্ছিলো। আমি ছোট থেকেই ওর পাশে আছি। আমি অনেক চেষ্ট করতাম ওকে ভালো রাখার। এক পর্যায়ে নীলিমা আন্টি আনিসা আর আবরাহামের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার শুরু করেন। তখন আঙ্কেল বাধ্য হয়েই আন্টিকে ডির্ভোস দেয়। এরপর থেকে তিনিই আনিসা আর আবরাহামকে একা হাতে মানুষ করেছেন।”

একদমে কথাগুলো বলে থামলো রেদোয়ান। দৃষ্টি তার আবরাহামের রক্তলাল মুখের দিকে। নীলিমা বেগমের নাম সে শুনতেই পারেনা। রেদোয়ান বুঝতে পারছে আবরাহামের অবস্থা।

রেদোয়ানের কথা শেষ হতেই ঘরের ভেতরে নীরবতা নেমে এল। আয়েশা বেগম হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, যেন তার ভাইয়ের পরিবারের এত বড় ঘটনাটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তার কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা হয়ে এল, “নীলিমা… এভাবে? রিয়াদ ভাইজান কি সহ্য করলেন… আর আমি কিছুই জানলাম না?”

আবরাহাম চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার মুখের রক্তিম আভা ধীরে ধীরে তার তিক্ত স্মৃতির ভার নিয়ে আরও গাঢ় হয়ে উঠছে। রেদোয়ান হাত রাখল তার কাঁধে, বোঝার ভঙ্গিতে।

আয়েশা বেগম ধীরে ধীরে আবরাহামের কাছে এগিয়ে এলেন। “তুই এত কিছু সহ্য করেছিস… আমি তো কিছুই জানতাম না, কিছুই করিনি তোর জন্য।”

আবরাহাম কিছু বলল না, শুধু বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আয়েশা বেগমের হৃদয়ে শোকের ভার যেন আরও ভারী হয়ে উঠল, তার চোখে আবারও অশ্রু জমে উঠল।

সামিয়ার চোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। লোকটা এত কষ্ট বুকে নিয়ে আছে ভাবতেই কান্না পেল সামিয়ার।

রুম জুড়ে আবারো একরাশ নিরবতা বিরাজ করলো। আয়েশা বেগম বললেন,
“অনেক হয়েছে আর না। এখন থেকে আমি তোদের মা। তোদের দুইভাই বোনকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।”

ইকবাল সাহেব এবার বললেন,
“আব্বা তো মারা গেছে। আমার মনে হয় আম্মাকে সব জানানো উচিত। আর কিজন্য তোমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। কিছু তো বললে না।”

আয়েশা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আব্বা বরাবরই চেয়েছেন ভাইজান যেন আমাদের কম্পানিটার দায়িত্ব নেন। কিন্তু ভাইজানের ইচ্ছে ছিলো সে রাজনীতি করবে। এই নিয়ে ঝামেলা হয় অনেক। পরবর্তীতে আব্বা বলেন ভাইজান যদি রাজনীতি করতে চান তাহলে তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে রাজনীতিতে যেতে পারবেন। ভাইজান আর আব্বা দুইজনই বেশ তেড়া আর জেদী ছিলো। কেউ কারো থেকে কম না। পরে ভাইজান বাসা ছাড়েন।”

আয়েশা বেগম দম নিয়ে আবরাহামের হাত দুটো ধরে বললেন,
“বাবা তোর দাদির শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। কখন কি হয়ে যায়। তুই কি একটু গ্ৰামে তোর দাদিকে দেখতে যাবিনা শেষ দেখা।”

আবরাহাম আয়েশা বেগমের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। চোখে তিক্ততার ছাপ, যেন দাদির অসুস্থতার খবর তাকে আরও এক দায়িত্বের ভারে ডুবিয়ে দিচ্ছে। মাথা নীচু করে বলল,

“ফুপি, আমি যেতে চাই। কিন্তু সামনেই নির্বাচন, অনেক কাজের চাপ…”

আয়েশা বেগম তার হাতে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন,
“আমি জানি, বাবা। কিন্তু তোর দাদির জন্য সময়টা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে হয়তো আর বেশিদিন আমাদের মাঝে থাকবে না। তুই যদি যেতে পারিস, সেটা তার জন্য অনেক বড় সান্ত্বনা হবে।”

আবরাহাম ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, যেন নিজের মাঝে দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠছে। “ইনশাআল্লাহ, নির্বাচন শেষ হলে আমি গ্রামে যাবো।”

আয়েশা বেগমের মুখে শান্তির ছাপ ফুটে উঠল।
“তোর দাদী তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে, বাবা। তুই একবার দেখে আসিস। সামিয়ার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে আমরা সবাই একসঙ্গে যাবো।”

আবরাহাম নীরবে সম্মতি জানাল, তার মুখের ক্লান্তি যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল।

একপলক চোখ তুলে তাকালো সামিয়ার দিকে। সামিয়া ড্যাব ড্যাব করে এতক্ষণ আবরাহামের দিকেই তাকিয়ে ছিলো বলে দুইজনের চোখাচোখি হলো। সামিয়া থতমত খেয়ে চোখ এদিক ওদিক ঘোড়ালো। আবরাহামের কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো সামিয়ার এমন আচরণে।

আয়েশা বেগমের মুখে এক চিলতে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। তিনি হাসি মুখেই বললেন,
“হ্যাঁ, আমি জানি। তোর দাদির স্বাস্থ্য কিছুটা খারাপ। ওনার জন্য শেষ দেখা হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুই যদি যেতে রাজি থাকিস তাহলে সামিয়া এস এস সি পরীক্ষা শেষ হলে সবাই একসঙ্গে যাবো।”

আবরাহাম গভীরভাবে আয়েশা বেগমের কথা শুনছিল। তার মনে ভেসে উঠছে নানা স্মৃতি, শোক এবং দায়িত্বের ভার। আয়েশা বেগমের সান্ত্বনামূলক স্পর্শে যেন সে কিছুটা সান্ত্বনা পেল, কিন্তু হৃদয়ের ভিতরে গভীর এক ক্ষত রয়েছে যা এত সহজে ভরাট হওয়ার নয়।

অন্যদিকে, সামিয়া আবরাহামের দিকে তাকিয়ে আছে, তার মন জুড়ে বিভিন্ন অনুভূতির ঢেউ। লোকটা এত কষ্টের মধ্যেও এতটা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই চিন্তায় তার চোখে জল এসেছে। কিন্তু তাদের চোখাচোখি হতেই সামিয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, দ্রুত অন্যদিকে তাকাল।

আবরাহাম সামিয়ার সেই আচরণ লক্ষ্য করল, তার কপালে হালকা ভাঁজ পড়ল। মনে হলো, তাদের মধ্যে কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে, এমন কিছু যা কথায় প্রকাশ করা কঠিন।

ঘরে একরাশ নিরবতা নেমে এলো। আয়েশা বেগম সেই নিরবতা ভাঙলেন তার পরবর্তী কথায়, “আমাদের সবার উচিত এখন থেকে একে অপরের পাশে থাকা। এতদিন অনেক দূরে ছিলাম, এখন আর না। তোদের দেখে রাখার দায়িত্ব আমার, বাবা।”

আবরাহাম ধীরে মাথা নাড়ল, যেন তার মনে একটা নীরব অঙ্গীকার তৈরি হচ্ছে।

ইকবাল সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনটা বিশ বাজে। উনি এবার তাড়া দিয়ে বললেন,
“আজ অনেক কথা হয়েছে। এবার সবাই রেস্ট নেও। রাত অনেক হয়েছে।”

আয়েশা বেগমও স্বামীর কথায় সম্মতি দিলেন।

ইকবাল সাহেবের পরামর্শ মেনে সবাই ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে গেল, তবে কারও মনে শান্তি নেই। আবরাহাম আর সামিয়া ঘরের ভেতর আলাদা হলেও তাদের মনে চলছিল এক গভীর অস্থিরতা। আবরাহামের মাথায় দায়িত্ব আর শোকের ভার, আর সামিয়ার মনে আবরাহামের প্রতি এক নতুন অনুভূতির সঞ্চার।

রাতের নিরবতায় বৃষ্টির শব্দ যেন তাদের মনের ঝড়কে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

আবরাহাম ধীরে ধীরে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে চলে গেল। তার মাথায় এখনও আয়েশা বেগমের কথা আর পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় করছে। বিছানায় বসে সে হাতের আঙুলে ঘষল বাবার দেয়া পুরনো ঘড়িতে, যা তার বাবার একমাত্র স্মৃতি হিসেবে তার কাছে আছে। ঘড়িটার টিকটিক শব্দ বৃষ্টির ঝাপটায় মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আবরাহামের মনে সেই স্মৃতিগুলো তীব্রভাবে বেজে উঠছিল।

অন্যদিকে, সামিয়া নিজের ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। আবরাহামের মুখের বিষণ্ণতা তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এতক্ষণ তাকে আবরাহাম কেমন অদ্ভুতভাবে দেখছিল, সেটা ভেবে তার বুক ধকধক করছিল। সে নিজেই বুঝতে পারছে না কেন আবরাহামের প্রতি তার এতটা আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। তার মনের গভীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি সঞ্চারিত হচ্ছিল—যেন এই লোকটা তার জীবনের সাথে কোথাও খুব গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

হঠাৎ, সামিয়ার মনে পড়ল আজকের রাতের সমস্ত ঘটনা, এবং আবরাহামের বিষণ্ণ চোখের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই অজানা যন্ত্রণার কথা। তার মনের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকল, মনে মনে ভাবল,
“নেতামশাইয়ের এত কষ্ট কেন? কেন যেন মনে হচ্ছে আমি তার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি।”

সামিয়ার মনের ভেতরে এই ভাবনার ঢেউ ক্রমাগত বাড়তে থাকল।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১১

আবরাহাম নিজের ঘরের অন্ধকারে বসে স্মৃতির ভারে ডুবে গেল। বাবার মৃত্যুর পর থেকে জীবন যেন এক অন্যরকম বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সে কিছুতেই নিজের শূন্যতা থেকে মুক্তি পায়নি। বাবার সেই শাসন আর ভালোবাসার ভার এখন তার কাঁধে, এবং সেই সাথে বয়ে নিয়ে চলেছে অতীতের কষ্ট, যা তাকে ক্রমাগত ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

মনে মনে আবরাহাম চিন্তা করছিল, কীভাবে একদিনে জীবনটা এতোটা বদলে গেল। বাবার মৃত্যুর পর থেকে যেন সবকিছুই ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বোনকে নিয়ে শৈশবের সব আনন্দের স্মৃতি আজ তার কাছে এক ধরনের শাস্তি হয়ে গেছে। আবরাহাম টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে এক চুমুকে খেয়ে ফেলল, যেন শোকের ভার থেকে মুক্তি পেতে চায়।

কিন্তু সেই মুক্তি কোথাও নেই। বাবা নেই, মা নেই, এমনকি বোনও আজ অনেক দূরে।

আবরাহাম জানালার পাশে এসে দাঁড়াল, বাইরে ঝড়বৃষ্টি আরও বাড়ছে। বৃষ্টির ভারী শব্দ যেন তার ভেতরের সব অস্থিরতাকে আরও প্রগাঢ় করে তুলছে। সে জানালার বাইরে তাকিয়ে নিজের জীবনের এই অবশ্যম্ভাবী একাকীত্ব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু, ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনের কোণে ভেসে উঠল সামিয়ার মুখ।

সামিয়া… সেই মেয়েটি, যে আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে এত কিছু জানার পরেও নির্বাক ছিল। তার চোখে যেন একটা গভীর দৃষ্টি ছিল, যা আবরাহামের কষ্টের সাথে এক অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে ছিল। সে কেন এমনভাবে তাকিয়েছিল, আর কেনই বা আবরাহাম নিজেও তার থেকে চোখ সরাতে পারেনি।

কিন্তু আবরাহাম জানে, তার জীবনে এতকিছু ঘটনার পর এই অদ্ভুত টান তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার সামনে দায়িত্ব, পরিবার, রাজনীতি, আর সেই অতীতের অসংখ্য ক্ষত, যা আজো তাকে ছেড়ে যায়নি।

রাত আরও গভীর হলো, কিন্তু আবরাহামের ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু মনের গভীরে একটা প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছিল: “কেন সামিয়ার চোখে এমন দৃষ্টি ছিল?”

তার মনে হচ্ছিল, সামিয়া যেন তার সমস্ত যন্ত্রণা দেখতে পেয়েছে, তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলোকে অনুভব করতে পেরেছে। আবরাহাম কখনোই তার আবেগগুলো প্রকাশ করে না, বরং সবসময় নিজের কষ্টগুলো নিজেই বয়ে বেড়ায়, কিন্তু আজ সামিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে অপ্রকাশ্য মনে করেছিল।

সেই চোখের দৃষ্টি… যেন তাকে খুলে দিয়েছে, ভেতরে ঢুকে দেখছে সবকিছু। আবরাহাম অনুভব করল, তার শূন্যতার মতোই সামিয়ার মধ্যেও কিছু গভীর ছিল—একটা অদ্ভুত মায়া, একটা অজানা সম্পর্কের ইঙ্গিত।

———————

এদিকে, সামিয়া বিছানায় শুয়ে ভাবছিল আবরাহামের সেই দৃষ্টি নিয়ে। কেন যেন তার মনে হচ্ছিল, এই লোকটির সাথে তার জীবনের কোনো গভীর সম্পর্ক আছে। যদিও সামিয়া কখনও এমন কিছু ভাবেনি, তবুও আজ তার চোখে সেই বিষণ্ণতা দেখে নিজের অজান্তেই তার প্রতি এক ধরনের মায়া তৈরি হয়েছে। আগে থেকেই তো সে তার নেতামশাইয়ের উপর দুর্বল। তার এখন আবরাহাম নাকি তার কাজিন। ভাবা যায়।

সামিয়া চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক, আবরাহামের সেই যন্ত্রণার পিছনের সত্যিটা সে একদিন জানতে পারবে।

হুট করেই সামিয়া শোয়া থেকে উঠে বসলো। টেবিলের উপর রাখা মোমবাতিটা জ্বালিয়ে ডায়েরি কলম নিয়ে বসলো।

সামিয়া মোমবাতির নরম আলোতে ডায়েরী খুলল। কিছুক্ষণ কলমটা হাতে নিয়ে বসে থাকল, যেন মনে মনে সঠিক শব্দ খুঁজছে। আবরাহামের বিষণ্ণতা, তার দৃষ্টি—এইসব ভাবনা বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল। কেন আবরাহামের চোখে সেই শূন্যতা ছিল? কেন সে এতটা একাকী?

সে বুঝতে পারছিল, আবরাহামের ভেতরের কষ্টটা শুধু অতীতের কোনো এক ক্ষতের নয়, এটা হয়তো তার পুরো জীবনটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই যন্ত্রণা, সেই বেদনা… সামিয়া নিশ্চিত, আবরাহামের এই একাকীত্বের পেছনে আরো অনেক গভীর কারণ আছে।

সামিয়া খাতার পাতায় ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করল, যেন সে নিজের মনের ভাবনা গুছিয়ে নিচ্ছে। সে লিখল, “কেন যেন মনে হচ্ছে, উনি যা প্রকাশ করছে না, তা তার চোখেই স্পষ্ট। তার দৃষ্টি যেন তার হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে, আর সেখানে আমি এক অজানা গল্পের ইঙ্গিত পাচ্ছি।”

সামিয়া থেমে গেল। তার মনে হচ্ছিল, আবরাহামের যন্ত্রণা বুঝতে পারার জন্য তার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি যেতে হবে। কিন্তু সে কি কখনও আবরাহামের মতো একজন জটিল মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবে?

সে আবার লিখতে শুরু করল, “আমার মনে হচ্ছে, আমি কিছু না জানলেও, ওনার সেই দৃষ্টি আমাকে তার যন্ত্রণার সঙ্গী হতে ডাকে। তার একাকীত্ব যেন আমার হৃদয়ে না বলা কথা ছুঁয়ে যাচ্ছে।”

লেখার সাথে সাথে সামিয়া অনুভব করছিল, তার মনের ভেতরে এক অজানা সংকল্প জেগে উঠছে। আবরাহামের শূন্যতা আর তার অপ্রকাশিত বেদনার গভীরে পৌঁছানোর জন্য সে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করল।

কিছুক্ষণ পর কলম থামিয়ে সামিয়া মোমবাতির দিকে তাকিয়ে রইল। শিখার মৃদু আলো যেন তার মনে অন্ধকার চিন্তার ভেতর আলো ফেলছে।

সামিয়া মোমবাতির আলোয় নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, যেন সেই ক্ষীণ আলোও তার মনের এক অন্ধকার কোণ আলোকিত করছে। আবরাহামের চোখে যে বেদনার ছাপ, তার ভিতরের সেই অপ্রকাশিত অনুভূতি, সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত টান তৈরি করেছে সামিয়ার মনে। সে জানে, এই টান কোনো সাধারণ অনুভূতি নয়—এটা কিছু গভীর, কিছু অজানা।

মনের গভীরে যে প্রতিজ্ঞাটা সামিয়া করল, সেটা শুধু আবরাহামের যন্ত্রণাকে বুঝে নেওয়ার নয়, বরং তার পাশে দাঁড়ানোরও। আবরাহামের সেই নির্লিপ্ত মুখ আর শূন্য দৃষ্টি তার হৃদয়ের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে।

মোমবাতির শিখা ধীরে ধীরে কাঁপতে লাগল, যেন সামিয়ার অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করছে। তার মনে হঠাৎ এক অদ্ভুত জাগ্রত ভাব এল—আবরাহামের সাথে তার যে সম্পর্ক, তা শুধু রক্তের বন্ধনে সীমাবদ্ধ নয়, এটা যেন তার আত্মার এক অদৃশ্য টান।

সামিয়া আবার ডায়েরীর পাতায় কলম ধরল। এইবার সে নিজের অনুভূতির গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করল, লিখল, “আমি জানি না, কেন আমি ওনাকে এতটা অনুভব করছি। কিন্তু এক অদ্ভুতভাবে মনে হচ্ছে, তার যন্ত্রণার সাথেই আমার জীবনও জড়িয়ে আছে। হয়তো ওনার পাশে থাকাই আমার নিয়তি।”

সামিয়া বুঝতে পারল, এই যাত্রা কেবল আবরাহামের কষ্টের রহস্য উদঘাটনের জন্য নয়, তার নিজেরও। এই গভীর সংযোগ তাকে নতুন এক উপলব্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই নিজেকে কেমন বড় বড় লাগছে। সামিয়া একটা তপ্ত নিশ্বাস ঝটপট একটা চিঠি লিখে ফেলল।

সামিয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। রাতের অন্ধকারে ঘরের চারপাশের নীরবতা যেন তার মনের গভীর দোলাচলকেই প্রতিফলিত করছিল। আযানের শব্দ কানে আসার সাথে সাথে সে যেন বাস্তবে ফিরে এল। রাত কেটেছে, কিন্তু তার মনের ভেতরকার যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।

চিঠিটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে সে জানালার দিকে তাকাল। বাইরের আলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে, এবং সেই আলোর সাথে যেন তার মনের ভেতরকার অন্ধকারও ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। কিন্তু আবরাহামের কষ্টের ছাপ, সেই অদ্ভুত চোখের দৃষ্টি, এবং তার সাথে গড়ে ওঠা এই অদৃশ্য টান তাকে ভাবিয়ে তুলল।

নিজের ভাবনার জটিলতা নিয়ে সামিয়া জানত না কীভাবে এই সম্পর্কটা সামলাবে, কিন্তু এতটুকু বুঝল যে, আবরাহাম এবং তার জীবন যেন কোনোভাবে অদৃশ্য এক সুতোর বাঁধনে জড়িত হয়ে গেছে।

ফজরের আযানের প্রতিধ্বনি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এলে সামিয়া চোখ বন্ধ করে আরেকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই নির্ঘুম রাত এবং তার মনের অস্থিরতা আজও শান্তি পায়নি, কিন্তু সে জানত, কোনো একদিন হয়তো আবরাহামের সেই শূন্যতার রহস্য সে উন্মোচন করতে পারবে।

——————-

সেদিন রাতের পর কেটে গেছে কয়েকটা মাস। আবরাহামের জীবনে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, তা কেবল ব্যক্তিগত স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। নির্বাচনে জয়ী হওয়া তার জন্য এক বড় সাফল্য হলেও, ভেতরের শূন্যতা তাকে ছাড়ছে না। দিন যাচ্ছে দায়িত্বের ভার আরও বেড়ে গেছে, কিন্তু সেইসাথে বেড়েছে তার একাকীত্বও।

অন্যদিকে, সামিয়ার জীবনেও পরিবর্তন আসছে। পরীক্ষার চাপ শেষ হয়েছে, কিন্তু আবরাহামের সাথে তার মনের গভীরে গড়ে ওঠা সেই অদ্ভুত টান তাকে ছাড়ছে না। আবরাহামের দুঃখ এবং অপ্রকাশিত যন্ত্রণার রহস্য জানার জন্য সে নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে যায়নি। যদিও তাদের সরাসরি কথা বলার সুযোগ খুব কম হয়েছে, আবরাহামের অনুপস্থিতি যেন আরও গভীর ভাবে সামিয়ার মনে তার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে।

আয়েশা বেগমের সঙ্গে আবরাহামের সম্পর্ক একটু উষ্ণ হয়েছে, যদিও আবরাহাম এখনও তার ভেতরের কষ্টগুলো নিয়ে একাই লড়াই করছে। আনিসা, ইয়ানা, আর ইহসানের সঙ্গে সামিয়ার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, কিন্তু আবরাহামের সাথে তার সম্পর্কটা এক রহস্যময় দূরত্বের মধ্যে আটকে আছে।

যদিও সামিয়ার মনে আবেগের ঝড় বয়ে চলেছে, সে জানে যে তাদের জীবনের এই সম্পর্কের গভীরতাকে একদিন সে বুঝতে পারবে।

সামিয়া এখনো আর চিঠি দেয়না আবরাহামকে। শেষ চিঠি দিয়েছিলো ঝড়ের রাতের লেখা সেই চিঠিটা। যাতে লেখা ছিলো

**বেশ কষ্টে আপনার আগের চিঠির অর্থ বুঝতে পেরেছি। এতো পেঁচিয়ে বলার কি আছে বুঝলাম না। তবে একটা কথা মনে রাখবেন কলঙ্ক থাকুক আর যাই থাকুক এই চিঠি কন্যা আপনাকে ছাড়ছে বলে দিলাম। মিলন আমাদের হবেই। কেউ আটকাতে পারবেনা দেখে নিয়েন। আর হ্যাঁ চিঠি লিখবোনা কয়েকদিন। তাই বলে ভাববেন না আমি আপনার পিছু ছাড়ছি।**

#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)