মনের অনুরণন পর্ব-১৪+১৫

0
1

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৪

দুপুরের আড্ডা শেষে সবাই মিলে বিকেলে বের হয়েছে গ্ৰাম ঘুরে দেখতে। রায়ান আর রাদিফ সবাইকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে সব। আবরাহাম চুপচাপ সব ঘুরে ঘুরে দেখছে। হুট করে সামিয়া আবরাহামের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে নরম কন্ঠে বলল,
“আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন!”

আবরাহাম ভ্রুকুচকে সামিয়ার পানে তাকালো। সামিয়া জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবরাহামের দিকে।

আবরাহাম সামিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, যেন তার প্রশ্নের মানে বুঝতে চেষ্টা করছে। সামিয়ার মুখে কৌতূহলের ছাপ স্পষ্ট। আবরাহাম ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকালো, তার গলার স্বর নরম হলেও কিছুটা গম্ভীর,
“না, বিরক্ত হচ্ছি না।”

সামিয়া একটু হেসে বলল,
“মনে হলো আপনি হয়তো এইসব পছন্দ করছেন না।”

আবরাহাম এক দৃষ্টিতে সামনের সবুজ ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে বলল, “সবকিছু পছন্দ করতেই হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই।”

সামিয়া কিছুটা চুপ করে রইল। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া, আর দূরে গাছপালার মাঝে মেঘের ছায়া পড়েছে। তারা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলো। সামিয়া আবার বলল,
“কিন্তু এত সুন্দর জায়গায় এসে কিছু তো অনুভব করছেন, তাই না?”

আবরাহাম একটু থামল, তারপর গভীর গলায় বলল,
“হয়তো,কিন্তু অনেক কিছুই যে সুন্দর, তা সত্ত্বেও মনের ভার কাটে না।”

সামিয়া এবার নিঃশব্দে আবরাহামের পাশে হাঁটতে থাকলো, তার চোখে গভীর চিন্তা।

আবরাহামের কথাগুলো সামিয়ার মনে যেন এক গভীর প্রতিধ্বনি তুলল। কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপচাপ হাঁটছিল, চারপাশে গ্রাম্য প্রকৃতির নীরবতা যেন তাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠছিল। সামিয়া তার নীরবতা ভাঙল, আরও কোমল স্বরে বলল,
“সবাই ভাবে আপনি খুব শক্ত মানুষ, কিন্তু আমি বুঝতে পারি যে, ভেতরে অনেক কিছু লুকিয়ে রাখেন।”

আবরাহাম কোনো জবাব দিল না, শুধু এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। সামিয়া বুঝতে পারল সে কোনো কথার উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। কিছুটা সময় পরে, আবরাহাম হঠাৎ থেমে দাঁড়াল, তার চোখে গম্ভীরতা,
“আমার ব্যাপারে জানতে চাওয়া সহজ নয়, সামিয়া। আমি যা লুকাই, সেটা কাউকে দেখাতে চাই না।”

সামিয়া একটু থতমত খেয়ে গেলেও, হাল ছাড়ল না। সে হেসে বলল,
“আমি তো আপনাকে বুঝতে চাওয়া বন্ধ করিনি। হয়তো একদিন আপনি নিজেই সব বলে দেবেন।”

আবরাহাম সামিয়ার দিকে এক ঝলক তাকাল, তার চোখে মৃদু বিস্ময়। সামিয়ার এই সাহসী জবাব তাকে কিছুটা নাড়া দিল, কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। দু’জনেই আবার চলতে শুরু করল, তবে এবার নীরবতা ছিল আরও গভীর, যেন তাদের মধ্যে কিছু অদৃশ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

আনিসা আর রেদোয়ান গ্রামের ছোট্ট বাজারের পাশ দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ আনিসার নজর পড়ল এক গ্রাম্য দোকানের সামনে রাখা ছোট্ট মাটির পুতুলগুলোর দিকে। সে খুব উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেল আর একটি পুতুল তুলে নিয়ে বলল,
“রেদোয়ান, দেখুন! ছোটবেলায় এদের নিয়ে কত খেলা করতাম!”

রেদোয়ান মুচকি হেসে বলল,
“তুমি এখনও তো পুতুল নিয়ে মেতে আছো!”

আনিসা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“পুতুল নিয়ে মজা করার কোনো বয়স আছে নাকি? আপনি বুঝবেন না!”

রেদোয়ান মজা করে বলল,
“ঠিক আছে, তোমাকে বুঝতে হবে না। বরং দেখি, এই পুতুলগুলোর মধ্যে কোনটা বেশি সুন্দর।”

দোকানের পাশে রাখা আরও কয়েকটি পুতুল হাতে নিয়ে রেদোয়ান বলল,
“এই দেখো, এটা তোমার মতোই মিষ্টি!”

আনিসা হাসি থামিয়ে বলল,
“এই পুতুলটা আমার মতো! এটা তো দেখতে একদম ভয়ঙ্কর!”

রেদোয়ান নিজেকে সামলে বলল,
“ওহ! তাহলে তুমি স্বীকার করছ, আমি ভয়ঙ্করদের সঙ্গেই থাকি!”

আনিসা এবার তাকে ঠেলে দিল আর বলল, “বাজে কথা বলবে না!”

আবরাহাম এগিয়ে এসে বলল,
“এবার থাম আর ঝগড়া করতে হবেনা।”

আনিসা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। আবরাহাম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা নে পছন্দ কর। আমি কিনে দিচ্ছি।”

আবরাহামের কথায় কপালে ভাঁজ পরলো রেদোয়ানের। রেদোয়ান নাক মুখ কুচকে বলল,
“ওর কি এখনো পুতুল খেলার বয়স আছে যে ও পুতুল কিনবে?”

আবরাহাম মুচকি হেসে বলল,
“আমার ছোট্টবোনটা চিরকাল আমার কাছে ছোটই থাকবে বুঝলি।”

আনিসা হাসিমুখে পুতুলটা হাতে নিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
“তাহলে আমি এই পুতুলটাই নেব,” বলে আবদারের স্বরে বলল,
“তুমি তো আমাকে এতো কিছু কিনতে দাও না!”

আবরাহাম হেসে মাথা নেড়ে দোকানদারকে টাকা দিয়ে দিল। রেদোয়ান হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“একটা পুতুল কিনে দিলে কি বোনের দায় শেষ?”

আনিসা মুখ ভার করে বলল,
“তোমার মতো কাউকে এই ধরনের মিষ্টি জিনিস বোঝানোই বৃথা।”

আবরাহাম একটু মজা করে বলল,
“হ্যাঁ, রেদোয়ানের মতো মানুষগুলোকে কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই।”

রেদোয়ান হাসতে হাসতে বলল,
“তাই বলে আনিসার পুতুলপ্রেম?”

আনিসা দুষ্টুমি করে বলল,
“পুতুলপ্রেম কিছু বললে খবর আছে বলে দিলাম!”

রেদোয়ান তার হাত ধরে টান মেরে বলল,
“চলো, দেখা যাক গ্রামের অন্য দিকে আর কী কী আছে। পরে খবর করো আমার।”

আবরাহাম কেবল মুচকি হাসল। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে তারা আবার পথে নেমে গেল।

গ্রামের পথগুলোতে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশের প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায়, খেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দূরে, গমের ক্ষেতগুলো সোনালী রঙে দোলা দিচ্ছে, যেন কোনো কল্পনায় রূপায়িত হয়েছে। সেখানে পাখির কলরব, গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু টোকা, আর শিশুদের হাসির শব্দ মিলেমিশে এক অপূর্ব সঙ্গীত সৃষ্টি করেছে।

নিঝুম মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে তাকিয়ে আবরাহামকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আবরাহাম সেদিকে পাত্তা দিচ্ছেনা। কিন্তু সামিয়ার গা জ্বলছে নিঝুমের এমন হাবভাব দেখে। তার মনে হচ্ছে নিঝুমকে মে*রে বালি চাপা দিতে। সামিয়া বেশ কিছুক্ষণ আকাশ পাতাল ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক করলো।

মীম আর মাইশা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মজা করে কথা বলছে, আর সামিয়া ইয়ানার সাথে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামিয়া হঠাৎ বলল,
“এত সুন্দর পরিবেশে আমি তো একদম মুগ্ধ!”
ইয়ানা সায় দেয়,
“অবশ্যই, এখানে আসা মানে এক অন্য জগতে প্রবেশ করা।”

ইহসান একটা মিষ্টি ফুল তুলে এনে বলল, “দেখো, এই ফুলটার গন্ধ কত সুন্দর!”
নিঝুম আর মীম ওই পাতা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিতে চেষ্টা করলো।

সন্ধ্যার আলো যখন ধীরে ধীরে আঁধারের দিকে যাত্রা করছে, তখন তারা সবাই সিদ্ধান্ত নিল বাড়ির দিকে ফিরবে। পথের মাঝে গাছের ছায়ায় হাঁটার সময় তারা একে অপরের সাথে স্মৃতিচারণা করতে করতে এগোচ্ছিল। গ্রামে ফিরতে ফিরতে তাদের হৃদয়ে এক নতুন উন্মাদনা আর আনন্দের অনুভূতি বিরাজ করছিল।

গ্রামের সরল জীবনযাত্রার মাঝে হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো যেন তাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় লিখে দিল। তারা যখন বাড়ির দরজায় পৌঁছাল, তখন সন্ধ্যার স্নিগ্ধ বাতাসে নিজেদের অনুভূতির কথা বলতে বলতে, হাসির জগতে প্রবেশ করল।

বিকেলের সেই আনন্দময় সন্ধ্যার পর, ঘর ফেরার পথে সবাই যেন এক নতুন রং নিয়ে ফিরে এসেছে। আবরাহাম তার ভাবনায় ডুব দিয়ে হাঁটছিল, কিন্তু সামিয়ার সাথে কথোপকথনের সময় তাকে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

সবাই হৈ চৈ করছে, হাসি ঠাট্টা করছে।এই হাসিঠাট্টার মাঝে, আবরাহাম এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল, ভাবনাগুলো আবার তাকে ঘিরে ধরেছিল। সামিয়া তাকিয়ে দেখল, আবরাহাম এখনো তার ভেতরের বোধগুলো নিয়ে দ্বন্দ্বে।

“কী ভাবছেন?”
সামিয়া সাহস করে জিজ্ঞেস করল।

আবরাহাম অবাক হয়ে সামিয়ার দিকে তাকাল।
“কিছু না, শুধু ভাবছিলাম…”

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৫

সামিয়া কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো আবরাহামের দিকে। আবরাহাম আড়চোখে একবার সামিয়ার দিকে তাকালো। তখনই ওদের ডাক পড়লো।

সন্ধ্যা নামতেই চারদিকে হালকা শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। বাতাসে একটু একটু ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল, আর ঘরের উঠানে সবাই মিলে একত্রিত হয়েছিল আড্ডার জন্য। বড় থেকে ছোট সবাই সেখানে উপস্থিত, হাসি-ঠাট্টা আর গল্পে মেতে উঠেছে। সন্ধ্যার নরম আলো আর গ্রামের নির্জনতা মিলেমিশে এক বিশেষ পরিবেশ তৈরি করেছিল।

উঠানে একটা গোল টেবিলের চারপাশে সবাই বসে আছে। সামনের টেবিলে নানারকমের নাস্তার আয়োজন—গরম গরম পিঠা, শিঙাড়া, চপ, মুড়ি-মুড়কির সাথে গরম চা। চারপাশে বসে গল্পের তালে তালে মাঝে মাঝে খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে সবাই। রায়ান আর রাদিফ কৌতুক করে সবাইকে হাসাচ্ছে, আর অন্যরা তাদের মজার কথা শুনে হেসে কুটিকুটি। মিম আর মাইশা একপাশে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, নিঝুম মাঝে মাঝে অন্যদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিচ্ছে। ইহসান তার মজার কথায় সবাইকে মাতিয়ে রাখছে।

আবরাহাম একটু দূরে বসে, গা থেকে হুডি ঝুলিয়ে দিয়ে শীতের বাতাসে চুপচাপ চা খাচ্ছে। সে আড্ডায় পুরোপুরি অংশ নিচ্ছে না, বরং মাঝে মাঝে অন্যদের কথার মাঝে মৃদু হাসি দিয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে আছে। সামিয়া তার একটু সামনে বসে আছে, আবরাহামের দিকে একবার একবার চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আবরাহাম আড়চোখে একবার তাকালেও, দুজনের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছে না। তাদের চারপাশের হাসির মধ্যে একটা নীরব টান বিরাজ করছে।

আড্ডার মাঝে, গ্রামের সন্ধ্যার মৃদু বাতাসে গাছের পাতার মর্মর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। দূরে কারো ঘর থেকে মিটমিটে আলো দেখা যাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে কোনো পাখি ডেকে উঠছে। সন্ধ্যার এই শীতল পরিবেশে সবাই একসঙ্গে বসে মজা করছে, যেন এই আড্ডার মাঝেই তারা গ্রাম্য জীবনের সরলতা আর আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে।

হঠাৎ করে মাইশা আর মীম মিলে গ্রামের প্রাচীন কাহিনী শোনাতে শুরু করল—রাতের বেলায় গ্রামের বাইরে গেলে নাকি জ্যান্ত ভূত দেখা যায়! সবার চোখে মুখে তখন রহস্য আর ভয়ের ছাপ, বিশেষ করে ছোটরা। নিঝুম তখন মুখে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে সবাইকে আরও মজা দিচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য আবরাহামও চুপচাপ সেই গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়ল। সামিয়ার চোখে হঠাৎ দুষ্টুমির ঝিলিক দেখা গেল। সে একটা ভয়ের গল্প শোনাতে চাইল, আর সবাই তার কথায় কৌতূহলী হয়ে উঠল।

গল্পের মাঝেই রেদোয়ান আস্তে আস্তে আনিসা কাছে গেল। আনিসা মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছিলো। রোদোয়ান একটা পাতা আনিসার গায়ে ছেড়ে দিলো। আনিসা ভয়ে চোখবুজে চেঁচিয়ে উঠবে তার আগেই ইয়ানা ওর মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলল,
“আপু রেদোয়ান ভাইয়া ছিলো।”

সবাই হাসা শুরু করলো। আনিসা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।

আবরাহাম ওদের কাহিনী দেখে মৃদু হাসলো। সামিয়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবরাহামের সেই হাসি মাখা মুখের দিকে। হুট করেই আবরাহাম সামিয়ার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। সামিয়া খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল।

আবরাহাম সেদিকে তাকিয়ে একটা তপ্তশ্বাস ফেলল।

এভাবেই গল্প আর হাসি-ঠাট্টায় সময় কেটে যাচ্ছিল। শীতের বাতাসে সবাই আরও কাছাকাছি এসে বসল, যেন তাদের মধ্যে আরও গভীর বন্ধন তৈরি হচ্ছে।

রাতের খাবার শেষ করে সবাই রুমে চলে গেছে যে যার মতো। একে তো গ্ৰামে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমায় তার উপরে হালকা শীত পড়েছে।

আবরাহাম বিছানায় শুয়ে এপাশ অপাশ করছিলো।

আবরাহাম বিছানায় শুয়ে, চারপাশের নিস্তব্ধতা উপভোগ করার চেষ্টা করছিল। বাইরে হালকা শীতের আমেজ, আর মাঝে মাঝে পাতা ঝরে পড়ার শব্দ তার মনকে আরও অস্থির করে তুলছিল। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলেও, ঘুম আসছিল না। বারবার মনে পড়ছিল আজকের আড্ডার মুহূর্তগুলো—সামিয়ার কপাল কুচকানো, তার নীরব দৃষ্টি, আর সেই চোখাচোখির মুহূর্তটা।

আবরাহাম ভেবেই পাচ্ছিল না, কেন সামিয়ার দিকে তাকালে তার ভেতরে এমন অস্বস্তি কাজ করে। সামিয়ার চেহারায় যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যা তাকে বিভ্রান্ত করছিল। সে আবারও বিছানায় ঘুরে শুয়ে পড়ল, তার মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল—তার অতীত, বর্তমান, আর এই গ্রাম্য জীবনের সাথে তার নতুন করে গড়ে ওঠা সম্পর্ক।

কিন্তু সেসব চিন্তা ছাপিয়ে সামিয়ার চেহারাই বারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। তার চোখে লজ্জা আর গভীর দৃষ্টি, সেই মুহূর্তগুলো যেন বারবার ফিরে আসছিল তার মনে। আবরাহাম মনে মনে একটু বিরক্ত হলো—নিজের উপর, এই দুর্বলতার জন্য। তবে সে জানত, এই অনুভূতিগুলোকে সহজভাবে নেবার মতো শক্তি তার নেই।

বাইরে হালকা বাতাস বইতে লাগল। শীত একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছিল, আর আবরাহাম জানালার বাইরে তাকিয়ে গ্রামটির শান্ত পরিবেশে ডুবে গেল।

আবরাহাম জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করল। গ্রামের এই নিস্তব্ধতা, বাতাসে শীতের মৃদু আমেজ—সবকিছু যেন তাকে তার পুরোনো জীবনের কোনো এক অজানা দুঃখের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হবে না। সামিয়ার দিকে তাকালে যে অস্বস্তি অনুভব করছিল, সেটাও যেন এই শূন্যতারই একটা অংশ।

হঠাৎ বাইরে থেকে পায়ের শব্দ শুনতে পেল আবরাহাম। সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামিয়া উঠানে দাঁড়িয়ে, মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কালো গাউনের আড়ালে কাঁধ থেকে চুল ছড়িয়ে পড়েছে। আবরাহাম এক মুহূর্তের জন্য সামিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, তার ভেতরে আবার সেই অস্থিরতা ঘনীভূত হতে লাগল। সে বুঝতে পারছিল না, কেন এই মেয়েটি তাকে এতটা ভাবিয়ে তুলছে।

সামিয়া ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল, তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। যেন সে কিছু খুঁজে পেয়েছে, যা আবরাহাম এখনও খুঁজে চলেছে। তার মুখে সেই চিরচেনা হাসি। আবরাহাম কিছু বলতে যাবে, কিন্তু শব্দ গলায় আটকে গেল। তাদের চোখ আবারও একবার মিলল, তবে এবার আর আড়চোখে নয়। সামিয়া সরাসরি আবরাহামের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার মনের গভীরতম ভাবনা পড়ে ফেলছে।

আবরাহাম জানালার পর্দা টেনে নিয়ে আবার বিছানায় ফিরে এল। কিন্তু ঘুম আসছিল না। সামিয়ার সেই প্রশান্ত চোখের দৃষ্টি, আর সেই হাসি যেন তার মন থেকে সরে না।

সামিয়ার দৃষ্টি আবরাহামের মনের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলল, আর তার এই অনুভূতিকে সে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছিল না।

আবরাহাম আর নিজের অস্থিরতা দমাতে না পেরে ধীর পায়ে রুম ছাড়লো। উঠানে এখনো সামিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আবরাহাম সেদিকে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“এখানে কি করছো?ঘুমাও নি কেন?”

সামিয়া ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে বলল,
“আপনি কেন ঘুমাননি!”

“আমাকে উল্টো প্রশ্ন করছো ভয় করে না তোমার!”

“ভয় করবে কেন আপনি বাঘ না ভাল্লুক।”

আবরাহাম সামিয়ার উত্তর শুনে একটু অবাক হয়ে গেল। সামিয়ার এই দুষ্টুমি আর নির্ভীকতা তাকে আরও বিভ্রান্ত করে তুলল। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল, যেন সামিয়ার মুখে এমন মজার প্রতিক্রিয়া আশা করেনি।

“তোমার সাহস তো কম নয়!” আবরাহাম খানিকটা হাসি চেপে বলল।

সামিয়া চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি শুধু সত্য বলেছি।”

আবরাহাম তার ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি নিয়ে, নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলো আড়াল করতে চেষ্টা করল। সামিয়ার এই সহজাত ব্যক্তিত্ব তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল, কিন্তু একইসাথে, সে এই মেয়েটির প্রতি ক্রমশ আকৃষ্ট হচ্ছিল।

“ঠিক আছে, কিন্তু এবার ঘুমাতে যাও। রাত অনেক হয়েছে,” আবরাহাম বলল, যেন কথার ইতি টানার চেষ্টা করছে।

সামিয়া মৃদু হেসে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার চোখে একটা রহস্যময় অভিব্যক্তি রয়ে গেল, যা আবরাহামের মনকে আরও ভাবিয়ে তুলল।

সামিয়া চলে যেতে নিলে আবরাহাম একটু ইতস্তত করে বলল,
“ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটু হাঁটবে আমার সাথে? ছাদে চলো, ওখানে বাতাসটা ভালো লাগবে।”

সামিয়া অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, তারপর একটু হেসে বলল,
“এটি আপনিই তো?”

আবরাহাম সামান্য হাসল,
“শুধু একটু হাঁটার কথা বলছি। ইচ্ছা না হলে দরকার নেই।”

সামিয়া তার কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। সে আবরাহামের এই আচরণের পিছনে লুকানো কারণ খুঁজে বের করতে চাইছিল, তাই একমুহূর্ত ভাবার পর বলল,
“ঠিক আছে, চলুন।”

দুজন একসাথে ধীর পায়ে ছাদের দিকে এগিয়ে চলল।

ছাদে গিয়ে কাণিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো সামিয়া আর আবরাহাম। ছাদে ঠান্ডার প্রকোপ একটু বেশিই। আবরাহাম কিছু না ভেবেই রুম থেকে বের হয়েছিলো। হুডি খুলে শুধু টিশার্ট পড়েই শুয়েছিলো। সে অবস্থায় বের হয়েছে। এখন ঠান্ডা লাগছে। চারিপাশে নিরবতা বিরাজ করছে।

#চলবে