মনের অনুরণন পর্ব-১৬+১৭

0
3

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৬

আবরাহাম ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগল। সামিয়া সেটা লক্ষ্য করল এবং তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার তো শীত লাগছে, হুডিটা আনেননি কেন?”

আবরাহাম ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে বলল,
“বের হওয়ার সময় ভাবিনি ঠাণ্ডাটা এতোটা বাড়বে।”

সামিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল, তারপর তার কাঁধ থেকে শালটা খুলে আবরাহামের দিকে বাড়িয়ে দিল। আবরাহাম প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল, কিন্তু সামিয়ার অনুরোধ মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারল না। সে শালটা গ্রহণ করল, কিন্তু বলল,
“তুমি নিজে তো শীতে কাঁপছো। শালটা তোমারই দরকার।”

সামিয়া মৃদু হেসে বলল,
“আমি ঠিক আছি। আপনি পড়ুন। আমি সোয়েটার পড়েছি।”

আবরাহাম শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল, আর দুজনে একসাথে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। দূরে আকাশে মিটমিটে তারা, আর বাতাসে শীতের হিমেল পরশ। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, যেন এই নীরবতাতেই তারা একে অপরের সঙ্গ খুঁজে নিচ্ছিল।

সামিয়ার চোখে সেই পুরনো চাহনি, আর আবরাহামের মনে আবার সেই অস্থিরতার অনুভূতি। কিন্তু এই মুহূর্তে, তারা দুজনেই কথা না বলার মাঝেই একধরনের শান্তি অনুভব করছিল।

তাদের চারপাশে গ্রামটা ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু তাদের মনে নানা ভাবনা জেগে ছিল।

আবরাহাম শীতের শালের উষ্ণতা পেয়ে একটু আরাম অনুভব করল, কিন্তু তার ভেতরের অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। সামিয়ার সাথে এই অদ্ভুত, নীরব সংযোগ তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল।

সামিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“অনেক সময় নীরবতাই সবচেয়ে বড় কথা বলে, তাই না?”

আবরাহাম সামিয়ার কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলল না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

আবরাহাম শালটা শক্ত করে ধরল, তার ভেতরে অজানা উত্তেজনার স্রোত বয়ে গেল। তার মনের গভীরে লুকানো অনুভূতিগুলো যেন ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে, কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। সামিয়ার দিকে তাকিয়ে সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শব্দগুলো আটকে রইল।

সামিয়া তখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চুলের কিছু অংশ হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। সে হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“আপনার কি কখনো মনে হয়, আমরা যা বলতে চাই, তা বলা হয়ে ওঠে না?”

আবরাহাম একটু থমকে গেল, সামিয়ার প্রশ্নটা যেন তার নিজের মনের গভীরে ধাক্কা দিল। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে গভীরভাবে বলল,
“হ্যাঁ, অনেক সময়ই মনে হয়… কিছু কথা বলার আগেই হারিয়ে যায়।”

সামিয়া আবার নীরব হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“তাহলে হয়তো কিছু কথা বলার প্রয়োজন নেই, শুধু অনুভব করলেই হয়।”

আবরাহাম সামিয়ার কথার গভীরতা অনুভব করল। এই মুহূর্তে, তাদের মাঝের নীরবতা, তাদের অনাবিষ্কৃত অনুভূতিগুলো যেন কোনো অদৃশ্য সেতু তৈরি করছে। দূর আকাশে তারা ঝিকিমিকি করছে, আর শীতের বাতাস তাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সামিয়া তখন ধীরে ধীরে একটু দূরে সরে গিয়ে বলল,
“আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। ঠান্ডা বাড়ছে। আর আমাদের একসঙ্গে কেউ দেখলে ফেললে সমস্যা হবে।”

আবরাহাম কিছু না বলে সম্মতি দিল। তারা ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নামতে শুরু করল। নেমে এসে দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। সামিয়া একটু দ্বিধায় আবরাহামের দিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“ভালো করে ঘুমাইয়েন।”

আবরাহাম এক মুহূর্তের জন্য থেমে সামিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তার মন যেন অনেক কিছু বলতে চাইল, কিন্তু সেসব কথা বলা হলো না। সে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল এবং বলল,
“তুমিও।”

সামিয়া চলে যেতে শুরু করল, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার পিছন ফিরে আবরাহামের দিকে তাকাল। এই এক মুহূর্তের চোখের যোগাযোগে অনেক কথা লুকিয়ে ছিল। তাদের অপ্রকাশিত অনুভূতির ভার যেন বাতাসেও অনুভূত হলো।

সামিয়া রুমে ঢুকতেই ওর নানি হালিমা বেগমের মুখোমুখি হলো। উনি তীক্ষ্ণচোখে সামিয়ার দিকেই তাকিয়ে আছেন। সামিয়া মাথা নুইয়ে ফেলল।

হালিমা বেগম সামিয়ার কাছে এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে বললেন,
“এই সময়ে বাইরে কী করছিলি?”

সামিয়া নরম স্বরে বলল,
“কিছু না, নানি। একটু বাতাস খাচ্ছিলাম।”

হালিমা বেগম গভীর নজরে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন তার মুখ থেকে কোনো অপ্রকাশিত সত্য বের করার চেষ্টা করছেন। তারপর একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তুই তো জানিস, এই বাড়িতে তোর প্রতিটা কাজের দিকে সবাই নজর রাখে। সাবধান থাকবি। এই নীরবতার পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে, সাবধানে চলবি, বুঝলি?”

সামিয়া কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নানির কথায় লুকানো সতর্কবার্তা তার মনের গভীরে গেঁথে গেল।

হালিমা বেগম আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামিয়ার কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখে বললেন,
“ঘুমোতে যা এখন, অনেক রাত হয়েছে।”

সামিয়া ধীরে ধীরে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়ল। তার মাথায় একাধিক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে—আবরাহাম, নানির সতর্কতা, এই অদ্ভুত অনুভূতিগুলো। শীতের রাতে, তার মনে যেন আরও বেশি প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, যার উত্তর সে নিজেই খুঁজে পাচ্ছে না।

আবারও, তার চিন্তা আবরাহামের দিকে ফিরে গেল।

সামিয়া বিছানায় শুয়ে পড়ল, কিন্তু তার চোখে একটুও ঘুম নেই। আবরাহামের মুখ, তার নীরবতা সবকিছু একটার পর একটা মনে পড়ছে। অজানা অনুভূতি তার মনকে ক্রমশ ভারী করে তুলছে।

ওপাশে ঘুমন্ত নানির নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে, কিন্তু সামিয়ার মনে ঝড় বইছে। আবরাহামের দিকে তাকিয়ে থাকা তার চোখের সেই মুহূর্তগুলো বারবার মনে পড়ছে। কেমন এক ধরনের টান সে অনুভব করছে, যা আগে কখনও অনুভব করেনি।

সে জানে, আবরাহামেরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু কেনো তারা দুজনেই কিছু বলতে পারল না?

মাথার ভিতর এই সব প্রশ্ন ঘুরতে ঘুরতে, সামিয়া বিছানায় শুয়ে কাতবদল করতে লাগল।

হঠাৎ হালিমা বেগম ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন,
“এখন ঘুমা অনেক রাত হয়ে গেছে। পরে তোর ওনার কথা ভাবিস।”

সামিয়া হালিমা বেগমের কথায় মৃদু কাঁপে উঠল। তার নানির এভাবে তার মনের গভীরে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা তাকে সবসময়ই অবাক করে। সামিয়া জানে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নানির চোখ এড়ায় না। শুয়ে শুয়ে সে ভেবে চলল, সত্যিই কি তার মনে আবরাহাম সম্পর্কে কিছু গোপন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে?

সামিয়ার মন এখন আরও বিভ্রান্ত হয়ে উঠল। সে কি এভাবে এগিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারবে? নানির সতর্কতা তার মনকে দ্বিধায় ফেলে দিল।

সামিয়া বিছানায় শুয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল। নানির কথা তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে, কিন্তু আবরাহামের প্রতি তার আকর্ষণকে সে অস্বীকার করতে পারছে না। মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো একটার পর একটা ভেসে আসছে—আবরাহাম কি তার প্রতি একইরকম অনুভব করছে? নাকি এটা কেবল সামিয়ার নিজের কল্পনা?

এদিকে, ঘরের অন্য প্রান্তে হালিমা বেগম পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। সামিয়ার দিকে অন্ধকারে তাকালে বোঝা যায় তার চোখে ঘুম নেই। আবরাহামের সেই নীরবতা, তার চোখের চাহনি সবকিছু মিলে যেন একটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছে তার মনে। তার মনের মধ্যে আজকের এই কথাগুলো বারবার ভেসে উঠছে। সে জানে, এই অনুভূতি তাকে সহজে ছাড়বে না, কিন্তু আপাতত সে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো, এবং সে গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

অন্যদিকে আবরাহাম নিজের রুমে ফিরে এল। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে নিজের বিছানায় বসে পড়ল। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে শালের উষ্ণতা এখনও অনুভব করছে, যেন সামিয়ার উপস্থিতি তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু ঘুম আসতে চাইল না। আবরাহামও অবশেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমের মাঝে হারিয়ে গেল, সামিয়ার সাথে তার এই সংযোগের অস্থিরতা এবং শীতল শান্তির মাঝখানে।

————————–

ফজরের আযান কানে বাজতেই ঘুম ভেঙে গেল আবরাহামের। আবরাহাম ফজরের আযানের শব্দ শুনে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। ঘরটা তখনও অন্ধকারে ঢাকা, কিন্তু বাইরে থেকে আসা আযানের সুর ভেতরে এক ধরনের শান্তি এনে দিল। বিছানা থেকে উঠেই সে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিল, যেন রাতের সমস্ত অস্থিরতাকে মুছে ফেলতে চাইছে।

সে কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে মনে মনে রাতে ঘটে যাওয়া সবকিছু ভাবতে লাগল—সামিয়া, তার শাল দেওয়া, আর সেই নীরবতায় লুকানো কথাগুলো। আবরাহামের মন যেন এক অজানা দ্বিধায় ভুগছে, তবে সে এখন এই চিন্তাগুলো থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে।

তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশে ফজরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, আর গ্রামটা নতুন দিনের শুরুতে সজাগ হচ্ছে। হালকা শীতের বাতাস জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো, আর আবরাহাম অনুভব করল সেই তাজা শীতলতার স্পর্শ।

“নতুন দিন, নতুন শুরু,” আবরাহাম মৃদু স্বরে বলল।

সঙ্গে সঙ্গে সে শালটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে আবার সামিয়ার কথা মনে পড়ল। সেই মুহূর্তগুলো এতটা স্পষ্ট যেন সবকিছু এখনও ঘটছে। কিন্তু আবরাহাম জানে, তার সামনে অনেক কিছু আছে যা তাকে ভাবতে হবে, আর এর জন্য তাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আবরাহাম মনে মনে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করল এবং ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল, যেন রাতের সমস্ত অস্থিরতা দূরে সরিয়ে নতুন দিনের আলোতে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায়।

#চলবে

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৭

গ্ৰামে আবরাহাম আর সামিয়াদের আসার দুইদিন হয়েছে আজ। আবরাহাম আর সামিয়ার সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে খানিকটা।

সকালে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছিলো আবরাহাম। হঠাৎ বাড়ির পিছনের ঘাটের পাড়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ আটকে গেল তার।

সামিয়ার পড়নে সাদা রঙের একটা গোল জামা। চুলগুলো হাত খোপা করায় সামনের ছোট চুলগুলো কপালে পড়ে আছে। ধূসর রঙের শালের এক অংশ মাটিতে গড়াগড়ি করছে সেদিকে তার কোনো খবর নেই কারণ সামিয়া ব্যস্ত শিউলি ফুল তুলতে।

আবরাহাম পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে সামিয়ার পানে।

আব্রাহাম দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, যেন সময় থমকে গেছে। সামিয়ার মগ্নতা তাকে আকর্ষণ করে, আর তার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে আসে। ভোরের হালকা কুয়াশার মধ্যে সামিয়ার ধবধবে সাদা পোশাক যেন আব্রাহামের চোখে আরেক আলোকচ্ছটা নিয়ে আসে।

শিউলি ফুলগুলোর নরম কোমলতা আর সামিয়ার নির্ভেজাল নিষ্পাপ আচরণ মিলেমিশে এমন একটি দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে, যা আবরাহামের মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা জাগিয়ে তোলে।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আবরাহাম নিজের অজান্তেই সামিয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায়। শালের মাটিতে গড়াগড়ি দেখে সে আস্তে করে সামিয়ার দিকে হাঁটা দেয়, যেন ওই শালের অংশ তুলতে চায়।

সামিয়া তখনও শিউলি তুলছে, আবরাহামের উপস্থিতি খেয়াল করেনি। কাছে গিয়ে আবরাহাম ধূসর শালের সেই অংশ তুলে ধরে, সামিয়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। সামিয়া একটু চমকে পেছন ফিরে তাকায়। তার চোখে কিঞ্চিৎ বিস্ময়।

“এটা,” আবরাহাম শালটা সামিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, তার কণ্ঠে একটা অদ্ভুত কোমলতা।

সামিয়া হালকা হাসে,
“ওহ, ধন্যবাদ। খেয়ালই করিনি।”

“তুমি এতটা মনোযোগী হয়ে গিয়েছিলে, বুঝতেই পারোনি আমি এসেছি,” আবরাহাম বলে, তার গলায় মৃদু হাসির আভাস।

সামিয়া মৃদু হাসে,
“শিউলি ফুল তুলে বাসায় নিয়ে যেতে ভালো লাগে। আমার খুব পছন্দ এই ফুলগুলো।”

আবরাহাম আবারও সামিয়ার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়, যেন প্রতিটি কথার পেছনে আরও কিছু অনুভব করছে।
“তোমার এই নির্জনতায়, এই প্রশান্তিতে কিছু একটা আছে,” আবরাহাম বলে ফেলে, যেন নিজের কথাতেই হারিয়ে যায়।

সামিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আমাদের সবারই কিছু না কিছু ভাবনা থাকে। কিছু কথা থাকে যা বলা হয় না, কিন্তু থেকে যায় মনের গভীরে।”

আবরাহামও নিরবতা রেখে সামিয়ার কথাগুলো শুষে নেয়।

আবরাহাম সামিয়ার কথাগুলোর গভীরে ডুবে যায়, যেন তার নিজেরও কিছু অপ্রকাশিত অনুভূতি সেখানে মিশে আছে। সেই নিরবতায় দুজনের মধ্যে যেন একটা অদৃশ্য সংযোগ তৈরি হয়, যা আগে কখনো ছিল না। তাদের মাঝে এক ধরনের বোঝাপড়া জন্ম নেয়, যা তারা মুখে প্রকাশ করে না, কিন্তু অন্তরে অনুভব করে।

আবরাহাম সামিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে শিউলি ফুলগুলোর দিকে তাকায়। সামিয়া আবারও শিউলি ফুল তুলতে মন দেয়, কিন্তু আবরাহামের উপস্থিতি এখন তার মাথার মধ্যে বাজছে। সামিয়ার হাত থেকে একগুচ্ছ শিউলি পড়ে যায়, এবং তখন আবরাহাম এগিয়ে গিয়ে তা তুলে নেয়।

“তোমার ফুলগুলো…”
বলে আবরাহাম, কিন্তু তার চোখে একটা প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে। যেন সে জানতে চাইছে, সামিয়ার মনের ভিতরেও কি কোনো অশান্তি আছে, যেমনটা তার নিজের মধ্যে চলছে।

——————

দুপুরের দিকে আবরাহাম উল্টো হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে। আবরাহামকে অনেকবার বলার পরেও সে যায়নি। হঠাৎ করেই হালিমা বেগম ডেকে উঠলেন,
“আসবো”

আবরাহাম ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
“দাদি আমার রুমে আসতে তোমার পারমিশন নিতে হবেনা।”

হালিমা বেগম মুচকি হেসে আবরাহামের পাশে এসে বসলেন। বেশকিছুসময় কথা বলার পর হালিমা বেগম বললেন,
“একটা কথা বলবো, সত্যি কথা বলবি কিন্তু!”

আবরাহাম হাসি দিয়ে বলল,
“দাদি, তোমার কথার বাইরে কখনো কিছু বলেছি নাকি? বড় হয়েছি দূরে ছিলাম বলে তোমার কথার বাহিরে যাবো এমনটাও না।”

হালিমা বেগম গম্ভীর হয়ে গেলেন,
“তুই তো বড় হইলি, অনেক কষ্ট করলি জীবনে। কিন্তু আমি তোকে একা দেখে কষ্ট পাই।”

আবরাহাম কপাল কুঁচকালো,
“একা? তুমি তো জানো, দাদি, আমি ভালো আছি। কাজ, দায়িত্ব—সব কিছুতে ব্যস্ত থাকি। একা কই?”

হালিমা বেগম তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন,
“কাজ আর দায়িত্ব তো সারা জীবনই থাকবে। কিন্তু একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়, যার সাথে তুই সবকিছু ভাগ করে নিতে পারবি। যার সাথে তোর সুখ-দুঃখের কথা বলা যাবে।”

আবরাহাম এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। অতীতের কষ্টগুলো তার মনে উঁকি দিতে শুরু করলো—ফারিয়া, তার ব্যর্থ সম্পর্ক, আর সেই কলঙ্কিত অনুভূতি।

“তুমি যা ভাবছো দাদি, তা সহজ নয়,” আবরাহাম নরম গলায় বলল। “আমার অতীত আমাকে এখনও তাড়া করে। আমি নিজেকে সেই ধরনের সুখের যোগ্য মনে করি না।”

হালিমা বেগম নরম গলায় বললেন,
“তোর অতীত যতই কঠিন হোক, জীবন তো এগিয়ে চলে। আর সামিয়া তোকে বুঝবে, তোকে গ্রহণ করবে। তুই ওকে কি চিনিস না?”

আবরাহাম দাদির মুখে সামিয়ার নাম শুনে খানিকটা থমকালো। সামিয়ার সরলতা আর আন্তরিকতা তাকে আকর্ষণ করে, কিন্তু তার মনে সেই পুরোনো অস্বস্তি ফিরে আসে—সে কি সত্যিই সামিয়াকে সুখী করতে পারবে?

“দাদি, তুমি তো জানো না… আমার ভিতরে অনেক কিছু চাপা পড়ে আছে। আমি সামিয়াকে এই সবের মধ্যে টেনে নিতে চাই না,” আবরাহাম বলল, কণ্ঠে কষ্টের স্পর্শ।

হালিমা বেগম তার নাতির হাত ধরে বললেন, “সামিয়া তোকে নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। তোকে বোঝার ক্ষমতা ওর আছে। আর জীবন একা চলার জন্য নয়, তুই তোর ভাগ্য মেনে নে।”

আবরাহাম কিছুক্ষণ দাদির কথায় চুপচাপ রইল। ভিতরে তোলপাড় শুরু হলো, তার ভাবনার সঙ্গে কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রাম যেন মিলে যাচ্ছে। হালিমা বেগমের কথা সে বুঝতে পারছে, কিন্তু তার নিজের ভেতরের যন্ত্রণাগুলো তাকে এত সহজে মুক্তি দিচ্ছে না।

“দাদি, সামিয়া আমার থেকে অনেক ছোট। ওর জীবন এখনও শুরু, স্বপ্ন দেখা বাকি। আর আমার জীবনের অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি, অনেক ভুল, অনেক কালো দাগ আছে। আমি কি ওকে সেই অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিতে পারি?” আবরাহাম ধীরে ধীরে বলল, যেন নিজের মনেই প্রশ্ন করছে।

হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
“তুই সবসময় অতীতের পেছনে পড়ে থাকিস, আবরাহাম। জীবন তো এগিয়ে যায়, ভুলের পরেও মানুষ নতুন করে শুরু করতে পারে। আর সামিয়া তোর থেকে ছোট, ঠিক আছে। কিন্তু ওর যে মনের শক্তি, যে বুদ্ধি—তা তো তোর থেকে কোনো অংশে কম নয়। সামিয়াই পারবে দেখিস।”

আবরাহাম অবাক হয়ে দাদির দিকে তাকাল।
“তুমি বলছো, সামিয়া এই সম্পর্কের ভার সামলাতে পারবে?”

হালিমা বেগম মৃদু হাসলেন,
“ও শুধু সামলাবে না, তোকে ভরসা দেবে, তোর পাশে থাকবে। ওকে ছোট ভেবে তোর ভুল হবে না। ওর ভেতরে অনেক গভীরতা আছে, যা তুই এখনই দেখতে পাচ্ছিস না।”

আবরাহাম কাঁধ নামিয়ে বসে পড়ল।
“তুমি কীভাবে এত নিশ্চিত?”

হালিমা বেগম গভীর গলায় বললেন,
“কারণ আমি ওকে দেখেছি, দেখেছি তোর প্রতি ওর মনোভাব। ও তোকে ভালবাসে, বুঝতে পারিস না? ও তোর মতো একজন মানুষকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত। আর তুই কি ওকে একটুও সময় দিতে রাজি নোস?”

আবরাহাম যেন কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। সামিয়া ছোট, কিন্তু তার সহজাত গুণাবলী আবরাহামকে আকর্ষণ করেছে। তার জীবনে কখনও এমন নিষ্পাপ আর আন্তরিক কেউ ছিল না।

“আমি জানি না, দাদি,” আবরাহাম ধীরে বলল। “ওর জীবনে যদি আমার মতো মানুষের স্থান হয়, তাহলে হয়তো আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু যদি আমি ওকে কষ্ট দিই?”

হালিমা বেগম আবরাহামের হাতে হাত রাখলেন,
“কষ্ট দেওয়া তো মানুষের হাতে নেই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, ভালবাসা আর আন্তরিকতা দিয়ে সবকিছু জয় করা সম্ভব। তুই ওকে সুযোগ দে, নিজের জন্যও একটা নতুন শুরু করতে শিখ।”

আবরাহাম চুপ করে বসে আছে, দাদির কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সামিয়ার প্রতি তার অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, কিন্তু তার নিজের সংশয় তাকে পিছু টানছে। সামিয়ার সরলতা আর শান্ত উপস্থিতি আবরাহামের মনে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিলেও, তার ভেতরে সেই পুরোনো অন্ধকার তাকে ছেড়ে যায় না।

সকালের আলো আরও ফুটে উঠেছে। হালিমা বেগম আবরাহামের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন,
“আর ভাবিস না। সময় নিয়ে ভাব, কিন্তু জীবনের প্রস্তাবগুলো এড়িয়ে চলবি না।”

আবরাহাম মাথা নিচু করে বলল,
“আমি চেষ্টা করবো, দাদি।”

তাদের এই কথোপকথনের পর দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে। সামিয়া রান্নাঘরে সবাইকে সাহায্য করছে, তার হাসি আর কথায় পুরো বাড়ি ভরে উঠেছে। আবরাহাম একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছে। সামিয়ার সহজাত আনন্দ আর প্রাণচাঞ্চল্য তাকে আরও বেশি টানছে।

আনিসা এসে আবরাহামের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি আজ কেমন যেন ভাবনায় ডুবে আছো, ভাইয়া। কোনো সমস্যা?”

আবরাহাম একটু হাসি দিয়ে বলল,
“না, কোনো সমস্যা নেই।”

আনিসা মজা করে বলল,
“তাহলে মনে হচ্ছে কিছু চলছে! দাদির সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল?”

আবরাহাম গম্ভীর হয়ে তাকালো, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল।
“কিছু না, তোর কিছু বোঝার দরকার নেই।”

আনিসা হেসে বলল,
“ঠিক আছে, তোমার গোপন কথা আমি জানতে চাই না। তবে ভাইয়া, তুমি যদি কিছু নিয়ে চিন্তিত থাকো, আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারো।”

আবরাহাম মাথা নেড়ে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

বিকেলবেলা সবাই উঠানে বসে গল্প করছে। সামিয়া আর আনিসা হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। আবরাহাম একটু দূরে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তার চিন্তা সবকিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সামিয়ার হাসি, তার খোলা মনের সহজতা আবরাহামের চিন্তাগুলোকে আরও গভীর করে তুলছে।

#চলবে