#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৮
সামিয়া অনেকক্ষণ যাবত দেখছে আবরাহাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিয়া রাতের খাবার শেষ করে আবরাহামের রুমে একটা টুকি দিলো। আবরাহামকে রুমে ভিতর দেখতে না পেয়ে কপাল কুচকালো সে। তখনি পিছন থেকে ভরাট গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“আমাকে খুঁজছো?”
আচমকা আবরাহামের কথায় চমকিত হলো সামিয়া। সামিয়া মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল আবরাহাম মাত্র কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, দরজার ফ্রেমের গায়ে হেলান দিয়ে, তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সরাসরি সামিয়ার দিকে নিবদ্ধ। হলওয়ের মৃদু আলো তার মুখে ছায়া ফেলছে, যার কারণে তার অভিব্যক্তি পড়া কঠিন।
“আমি… আমি খুঁজছিলাম না—”
সামিয়া কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল, নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল, যদিও তার দ্রুত স্পন্দিত হৃদয় তাকে স্বাভাবিক থাকতে দিচ্ছিল না।
আবরাহাম এক পা এগিয়ে এলো, তার উপস্থিতি যেন তাদের মাঝে জমাট বাঁধা নীরবতা ভেঙে দিল।
“তাহলে খুঁজছিলে না?”
তার কণ্ঠ ছিল নরম, কিন্তু তাতে এক ধরনের কৌতূহল মিশ্রিত ছিল।
সামিয়া চোখ নামিয়ে নিল, তার গাল লাল হয়ে উঠলো।
“আমি ভেবেছিলাম আপনি ঘরে নেই।”
কিছুক্ষণ নীরবতা, যেন চারপাশের বাতাসও তাদের শব্দ শুনতে চাচ্ছে। আবরাহামের চোখে মৃদু কোমলতা এল, যদিও তার সুরটা একটু ঠাট্টার মতো লাগলো।
“তাহলে, তুমি আমাকে খুঁজছিলে?”
সামিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরল, কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তার প্রশ্নের ওজন অনুভব করছিল, যদিও আবরাহামের কথা ছিল হালকা। তার এক অংশ পিছিয়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু আরেক অংশ আবরাহামের গভীর দৃষ্টির দিকে তাকিয়েই থাকল, যেন তার চোখের পেছনের অজানা কিছুতে আকৃষ্ট হয়েছে।
সামিয়া একটু দ্বিধা নিয়ে আবরাহামের দিকে তাকাল, তারপর আস্তে করে বলল, “আমরা ছাদে যাই? একটু কথা বলতে চাই।”
আবরাহাম তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকাল। দুজনই ধীরে ধীরে ছাদের দিকে হাঁটল। ছাদে পৌঁছানোর পর হালকা বাতাস বইছিল, আকাশে অল্প কিছু তারা দেখা যাচ্ছিল। চারপাশে শান্ত, নিঃশব্দ পরিবেশ, কিন্তু তাদের মধ্যে যেন চাপা উত্তেজনা চারদিকে নীরবতা, হালকা জ্যোৎস্না চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আকাশের অল্প কিছু তারার আলো তাদের উপর পড়ছিল। আবরাহাম হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে এক কোণে দাঁড়ালো, তার চোখ দূরের অন্ধকারে নিবদ্ধ, যেন সেই অতীতে ডুবে গেছে, যা সে এতদিন সামিয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল।
সামিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তার মনের ভেতরে অজানা শঙ্কা। তারপর সে আস্তে করে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার চুপচাপ থাকার কারণটা কি?”
আবরাহাম এক গভীর শ্বাস নিল, তারপর মাথা নিচু করে সামিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। তার চোখে এক ধরনের বিষণ্নতা ছেয়ে গেল।
“তুমি জানতে চাও, কেন আমি এতটা দূরে থাকি, তাই না?”
সামিয়া ধীরে মাথা নাড়ল।
“ফারিয়া,”
আবরাহাম হঠাৎ করে বলল, যেন নামটা উচ্চারণ করতেই তার মনে পুরোনো ক্ষতগুলো আবার জেগে উঠল।
“একসময় সে ছিল আমার সবকিছু। আমাদের সম্পর্কটা ছিল খুব গভীর, খুব জটিল। আমি ভেবেছিলাম, সে-ই আমার ভবিষ্যৎ।”
সামিয়া ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তার মনোযোগ আবরাহামের প্রতিটি কথার দিকে নিবদ্ধ।
“তারপর কী হলো?”
তার কণ্ঠে মৃদু উত্তেজনা, আবার কিছুটা শঙ্কা।
আবরাহাম কণ্ঠে কষ্ট মিশিয়ে বলল,
“ফারিয়া আমাকে ভালোবাসত, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে কীভাবে ভেঙে পড়ছিল। আমি তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে চেয়েছিল মুক্তি। আমি বুঝতে পারিনি যে, আমি তাকে বিষিয়ে তুলছি। এক সময় সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।”
সামিয়া স্তব্ধ হয়ে আবরাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদয় কেমন জানি ভারী হয়ে উঠল, কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখল। “আপনার কি মনে হয়, সবটাই আপনার ভুল ছিল?”
আবরাহাম মাথা নিচু করে বলে,
“হয়তো না। কিন্তু আমি নিজেকে কলঙ্কিত মনে করি। আমি তার জীবনে অন্ধকার এনে দিয়েছিলাম। তাই সে চলে যাওয়ার পর থেকেই আমি নিজেকে আলাদা করে ফেলেছি। আমি মনে করি, হয়তো আমি ভালোবাসার যোগ্য নই।”
সামিয়া নীরবে আবরাহামের কথা শুনছিল, তার মনে যেন এক ধরনের মমত্ববোধ জেগে উঠল। সে কিছুক্ষণ পরে খুব নরম গলায় বলল,
“কিন্তু ভালোবাসা কোনো যোগ্যতার প্রশ্ন নয়। আমরা সবাই ভুল করি, কিন্তু তাতে আমরা কলঙ্কিত হয়ে যাই না।”
আবরাহাম সামিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন তার কথাগুলো শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়েছে।
“তুমি সবসময় এতটা সহজভাবে জীবনকে দেখে ফেলো, সামিয়া,” সে বলল, তার কণ্ঠে এক ধরনের প্রশংসার সুর।
সামিয়া হালকা হাসল, কিন্তু তার চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল।
“জীবন সহজ নয়, কিন্তু আমরা যখন নিজের প্রতি দয়া দেখাই, তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়।”
আবরাহাম কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর হঠাৎ বলে উঠল,
“তোমার কথা শুনতে ভালো লাগে, সামিয়া। আমি চাই… আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকো, কিন্তু আমার অতীতের কালো দাগগুলো তোমার মতো কারো জীবনে আঘাত আনবে নাতো!”
সামিয়া আবরাহামের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদয়ে যেন এক ধরনের উষ্ণতা জেগে উঠল, যদিও সে সেই অনুভূতিটা সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারল না।
“আপনি যদি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন, তাহলে আপনার অতীত কোনো বাধা হবে না,” সে বলল, তার কণ্ঠে এক দৃঢ়তা।
আবরাহাম সামিয়ার কথা শুনে কিছুক্ষণ নীরবে থাকল, তারপর একটু হাসল।
“তুমি সত্যিই এক অদ্ভুত মেয়ে, সামিয়া। তোমার চোখে পৃথিবীটা অনেকটাই ভিন্ন রকম মনে হয়।”
সামিয়া হেসে বলল,
“তাহলে সেই পৃথিবীটাকে একটু চেষ্টা করেই দেখুন। হয়তো আপনি কলঙ্কিত নন। হয়তো আপনি নিজের জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে পারেন।”
আবরাহাম তার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল, যেন সামিয়ার এই কথাগুলো তাকে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
খানিকক্ষণ নিরব থেকে আবরাহাম হুট করেই বলে উঠলো,
“চিঠিকন্যা তুমি কি তাহলে কলঙ্কিত জীবনই বেছে নিতে চাচ্ছো।”
আবরাহামের মুখে চিঠিকন্যা নামটা শুনে থমকালো সামিয়া। তাহলে আবরাহাম.., নিজে মনে ভেবেই অস্থির হয়ে পড়লো সে। তারপরেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
“মানে!”
আবরাহাম আকাশপানে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“সামিয়া আই থিঙ্ক ইউ ডোন্ট নো হু আই এম! একটা মেয়ে দিনের পর দিন তার প্রেমানুভূতি চিঠির মাধ্যমে আমাকে দিচ্ছে তাও নাকি পরিচয় গোপন করে। আচ্ছা বলো তো এই আবরাহাম খান রিহানের পক্ষে কি সামন্য একটা চিঠিকন্যাকে খুঁজে বের করা এতোই কঠিন!”
আবরাহামের কথায় সামিয়া খানিকটা লজ্জা পেল। তার মানে উনি জেনে গেছেন যে চিঠিগুলো সে দিয়েছিলো। ভাবতেই আবরাহামের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা সামিয়া।
সামিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তার মনে অস্থিরতা এবং শঙ্কার মিশ্রণ। আবরাহামের কথাগুলো যেন তার ভিতরে কাঁপন সৃষ্টি করেছিল। সে ভেবেছিল তার চিঠিগুলো অজানা থাকবে, কিন্তু এখন জানে যে আবরাহাম সব জানে।
“আপনি কি জানেন সব কিছু?” সামিয়া অবশেষে বলল, তার কণ্ঠে কম্পন ছিল।
আবরাহাম ধীরে ধীরে এক পা এগিয়ে আসল, তার চোখে একটি হাসি ফুটে উঠল।
“তুমি জানো, চিঠিগুলোতে তোমার অনুভূতির প্রতিচ্ছবি ছিল। আমি একপ্রকার টান অনুভব করেছি।”
সামিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, আপনি জানবেন না। আমি ভাবিনি আপনি কখনো জানতে পারবেন।”
আবরাহাম তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “কিছু জিনিস নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্যই তৈরি। তবে কখনো কখনো, সত্যি সামনে আসতেই হয়।”
সামিয়া আবরাহামের দিকে তাকালো,
“আপনি কি মজা করছেন?”
“না,” আবরাহাম বলল, “এটা তো আমার জন্য একটি আনন্দের বিষয়। তুমি যেভাবে তোমার মনের কথা লেখ, সেটা বিশেষ।”
সামিয়া কিছুটা নরম হয়ে গিয়ে বলল,
“কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম আপনি হয়তো আমাকে নির্বোধ ভাববেন।”
আবরাহাম একটু হেসে বলল,
“বাহ! তুমি নিজেকে নির্বোধ ভাবছো, কিন্তু আসলে তুমি খুবই বুদ্ধিমতী। তোমার শব্দগুলো আমার মনে গেঁথে গিয়েছে।”
সামিয়া আরো গুটিয়ে গেল। আবরাহাম তার একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। শীতের মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে সে। গা মাথা সব ভনভন করছে তার। মনের ভিতরের অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। সামিয়া কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি রুমে যাবো।”
আবরাহাম মৃদু হেসে বলল,
“একা যেতে পারবে নাকি এগিয়ে দিতে হবে?”
সামিয়া আর কিছু না বলেই ছুটে চলে যেতে নিলো তখনই আবরাহাম বলে উঠলো,
“আস্তে দৌড়াও পড়ে যাবে তো।”
কে শুনে কার কথা সামিয়া এক ছুটেই নেই। আবরাহাম সামিয়ার কান্ডে হাসলো। আবারো ছাদের কাণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকালো। নিজ মনেই বলে উঠলো,
“তুমি আমার মনের গভীর অনুরণন চিঠিকন্যা।”
#চলবে
#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ১৯
রেদোয়ান আবরাহামকে রুমে না পেয়ে ছাদে আসতেই সামিয়াকে দেখে ভ্রুকুচকায়। আবরাহামের শেষ কথাটা কানে আস্তেই রেদোয়ান তার কাধে হাত রাখলো। আবরাহাম শীতল কন্ঠে বলল,
“ঘুমাসনি এখনো”
রেদোয়ান শীতল দৃষ্টিতে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসিস ওকে?”
আবরাহাম মৃদু হেসে রেদোয়ানের প্রশ্নের উত্তরে গাইতে লাগল—
“তুমি ছুঁয়েছো হৃদয়,
আমি আকাশে উড়ি আজ।
তুমি দিলে আকাশ ছোঁয়া,
তোমায় ঘিরেই আমার সাজ।
তোমার ছোঁয়া যেন মেঘের মতো,
আলোর পথে চলি।
তুমি আমার প্রার্থনাতে,
তোমার প্রেমেই হারাই।।”
রেদোয়ান আবরাহামের গানের সূর শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে প্রশ্নের জবাব মিলতে শুরু করল, আবরাহামের মুখে লুকানো অনুভূতির পর্দা যেন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে।
——————–
কেটে গেছে আরো একটা দিন। সামিয়া প্রায় সময়ই পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। আবরাহামও কিছু বলেনি আর। নিরবে যতটুকু সময় সামিয়াকে চোখের সামনে দেখেছে ততটা সময় পলকহীন দেখেছে।
হালিমা বেগম সবাইকে একসঙ্গে বসার ঘরে ডেকেছে। সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ থাকলেও আয়েশা বেগম আর ইকবাল সাহেব যথেষ্ঠ স্বাভাবিক। সময় মতো সবাই এসে হাজির হলো বসার রুমে। হালিমা বেগম সবাইকে একপলক দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“আমি কাল রাতে আয়েশা আর ইকবালের সঙ্গে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবরাহাম আর সামিয়ার বিয়ে দিতে চাচ্ছি যদি তারা চায়।”
সামিয়া, আবরাহাম সহ সবাই চমকিত হলো। রেদোয়ান চমকিত হলেও বেশ খুশি হলো। আনিসাও পুলকিত হলো। ইকবাল সাহেব এবার বলে উঠলেন,
“বাবা, আবরাহাম তুমি কি বলো এই বিষয়ে?”
আবরাহাম চোখ বুজে পরপর দুটো তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে নিরেট কন্ঠে বলল,
“আমি এই বিষয়ে আগে সামিয়ার সঙ্গে একান্ত কথা বলতে চাই।”
সামিয়া চুপচাপ শুনছে মাথা নিচু করে। সে যেন হতভম্ব হয়ে গেছে।
হালিমা বেগমের কথায় ঘরটি নীরব হয়ে গেল। সামিয়া কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। তার মনে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আবরাহামের সদ্য বলার মত কথা তার হৃদয়কে দোটানায় ফেলেছে।
“আমি বুঝতে পারি, আবরাহাম। তবে আমাদের পরিবারে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন,” হালিমা বেগম বললেন, তবে তার মুখে উদ্বেগ ছিল।
“সামিয়া, তুমি কি এই ব্যাপারে কিছু বলবে?” আয়েশা বেগম সামিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
সামিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি… আমি এখনও প্রস্তুত নই। বিয়ের জন্য ভাবনাটা খুব তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে।”
আবরাহাম সামিয়ার দিকে এক পলক তাকালো। পুনরায় আয়েশা বেগম, হালিমা বেগম আর ইকবাল সাহেবের দিকে তাকালো।
ইকবাল সাহেব বললেন,
“আবরাহাম আর সামিয়াকে আমাদের সময় দেওয়া উচিত। আমার তাই মনে হয়।”
সামিয়া চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো আবরাহামের সাথে। সামিয়া তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলো। আবরাহামও চোখ সরিয়ে হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
“দাদি সামিয়া এখনো অনেকটাই ছোট। আমি চাই ও সময় নিক। বিয়ে জিনিসটা তো আর ফেলনা নয়। সারাজীবনের প্রশ্ন। সেখানে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি বলে আমি মনে করি।”
সামিয়া এবার সহসা তাকালো আবরাহামের দিকে। আবরাহামের দৃষ্টি হালিমা বেগমের দিকে। হালিমা বেগম এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা সময় নেও। তবে এখানে যতদিন আছো তার মধ্যে আমি তোমাদের মতামত শুনতে চাই।”
আবরাহাম মুচকি হাসলো। সামিয়া তাকিয়েই আছে আবরাহামের দিকে। পাশ থেকে ইয়ানা ধাক্কিয়ে বলল,
“আপু এভাবে তাকিয়ে থেকো না। আবরাহাম ভাইয়ের নজর লেগে যাবে। সরি, জিজুর নজর লাগবে।”
সামিয়া লজ্জা পেল ইয়ানার কথায়। মাথা নুইয়ে ফেলল। ইয়ানা দাঁত বের করে হাসলো।
আয়েশা বেগম সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এখন কাবিন করে রাখি পরে না হয় অনুষ্ঠান করা যাবে।”
“ফুপি আমি সামিয়ার সঙ্গে একান্ত কথা বলতে চাইছিলাম।”
ইকবাল সাহেব সামিয়াকে বললেন,
“সামিয়া তুমি আবরাহামকে নিয়ে ছাদে যাও।”
সামিয়া বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো। আবরাহামও ওর পিছু যেতে লাগল।
সামিয়া ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, হালকা বাতাসে তার চুল উড়ছিল। আবরাহাম তার পাশে এসে দাঁড়াল। সামিয়া একটু দ্বিধা নিয়ে বলল,
“আপনি কি মনে করেন… এই বিয়েটা এত দ্রুত হওয়া উচিত? আমার পড়াশোনা, আমার ভবিষ্যত… এসব বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন?”
আবরাহাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“তোমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তা করো না। তোমার সকল দায়িত্ব আমি নিতে রাজি আছি। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আর আমি চাই তুমি সেটাই করো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি সবসময় সাহায্য করব তোমাকে।”
আবরাহাম কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“ফারিয়া আমার অতীত। আমি জানি সেটা সহজ নয়, কিন্তু আমি এগিয়ে যেতে চাই। তুমি কি এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত?”
সামিয়া কিছুটা থেমে বলল,
“আমার মনে হয়… আমি শুধু জানি না, কিভাবে সামলাতে হবে এসব। আমার সংশয় হয়… আপনি কি আমায় সত্যিই পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারবেন?”
আবরাহাম এবার সরাসরি সামিয়ার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি, সামিয়া। আমি চাই আমরা দুজনেই একে অপরকে সময় দিই, যেন আমরা বুঝতে পারি আমাদের মধ্যে কী সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। কিন্তু বিয়ের বিষয়ে, পরিবারের ইচ্ছা রয়েছে যে কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়েটা হোক। তুমি কি মনে করেন, তুমি প্রস্তুত?”
সামিয়া কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“আমি জানি, পরিবারের চাপ আছে। কিন্তু আমি চাই, যদি বিয়ে হয়, সেটা যেন দুজনের সম্মতি নিয়েই হয়।তবে একটা কথা আপনাকে আপনার অতীত ভুলতে হবে। যদি পারেন তাহলে এখন বিয়ে করতেও আমার সমস্যা নেই।”
আবরাহাম সামিয়ার কথা শুনে গভীরভাবে চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “ফারিয়ার অতীত আমি ভুলতে চেয়েছি, কিন্তু কখনোই পুরোপুরি পারিনি। তবে তোমার সঙ্গে এই সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলে আমাকে অবশ্যই অতীতের ছায়া থেকে মুক্ত হতে হবে। আমি জানি এটা সহজ হবে না, কিন্তু আমি চেষ্টা করব।”
সামিয়া তার চোখে আবরাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে সে আন্তরিক। আবরাহামের সংকল্প দেখে সামিয়ার মনে কিছুটা শান্তি এল, কিন্তু সংশয় পুরোপুরি কাটল না।
“আমাদের দুজনকেই সময় প্রয়োজন,” সামিয়া ধীরে ধীরে বলল। “তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা কারোর জন্যই ভালো হবে না।”
আবরাহাম মাথা নিচু করে সম্মতি জানাল, “ঠিক বলেছো। আমি তোমাকে এবং নিজেকে সময় দেব। আমরা একসঙ্গে যদি কিছু গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেটা সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে।”
এই কথা বলেই আবরাহাম ছাদের কোণে তাকিয়ে থাকা সামিয়ার দিকে শান্ত একটা দৃষ্টি দিল, যেন তার মধ্যেই সে নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।
আবরাহামের কথার পর সামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, বাতাসে তার চুল উড়ছিল, যেন সেই নীরবতার মধ্যে কিছু বলতে চাইছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনার এই ধৈর্য আর সততার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনি যদি সময় নিতে চান, তাহলে আমিও প্রস্তুত। আমি জানি, আমাদের জীবন সহজ নয়, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যদি আমরা একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করি, তাহলে হয়তো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।”
আবরাহাম সামিয়ার চোখে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলল,
“তুমি খুব বুদ্ধিমতী, সামিয়া। আমি তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান জানাই।”
সামিয়া হালকা হাসল, কিন্তু তার মনে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবরাহামের পাশে দাঁড়িয়ে অনুভব করল, যেন জীবনটা এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। কিছুক্ষণ পর তারা দুজনেই ছাদের থেকে নিচে নামতে শুরু করল। নিচে সবাই অপেক্ষা করছিল, যেন এই কথোপকথনের ফল জানার জন্য।
হালিমা বেগম আগ্রহী দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কী সিদ্ধান্ত নিলে তোমরা?”
আবরাহাম শান্তভাবে বলল,
“আমরা কিছুটা সময় নিতে চাই, দাদি। আমরা তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমাদের নিজেদের বুঝতে সময় লাগবে।”
#চলবে