মনের অনুরণন পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
3

#মনের_অনুরণন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ২০(অন্তিম পর্ব)

হালিমা বেগম কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থাকলেন, কিন্তু তারপর মুচকি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা যেমন চাও। তবে একদিন তোমাদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

আয়েশা বেগম, সামিয়ার মা, তার দু’কাঁধে হাত রেখে বললেন, “সামিয়া, তুমি জানো আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। আমরা সবাই একে অপরের সুখের জন্য যত্নশীল। কিন্তু আমি চাই, তুমি এবং আব্রাহাম নিজেদের মধ্যে ভালোভাবে কথা বলো। সম্পর্কের ভিত্তি হবে বিশ্বাস এবং সম্মান।”

সামিয়া কিছুটা দ্বিধায় পড়ল। তার মনে একদিক থেকে আব্রাহামের প্রতি আকর্ষণ ছিল, অন্যদিকে তার মনে চিন্তা ছিল যে সম্পর্কের গভীরতা কতোটা হতে পারে। আব্রাহাম চুপচাপ বসে ছিল, তার চোখে ছিল ভাবনা আর কৌতূহল। সে জানত, এই মুহূর্তটি তার জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

রেদোয়ান, আব্রাহামের বন্ধু, তার দিকে ফিরে বলল, “ভাই, আমি তোকে বলেই ছিলাম, তুই যা ভালো মনে করিস সেটাই কর। সময় লাগুক, কিন্তু তোর সিদ্ধান্ত যেন পরিষ্কার হয়।”

আব্রাহাম মৃদু হেসে বলল, “তুই ঠিক বলেছিস, রেদোয়ান। সময়ই একমাত্র সমাধান। আমি জানি, সামিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের গভীরতা বোঝা জরুরি।”

ইয়ানা সামিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল, তার চোখে মিষ্টি হাসি। “আপু, তোমরা দুজনেই বেশ বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছো। পরিবার নিয়ে ভাবা ঠিক, কিন্তু নিজেরা যা ঠিক মনে করো, সেটাই হওয়া উচিত।”

সামিয়া অন্যমনস্কভাবে হেসে বলল, “হ্যাঁ, ইয়ানা। আমি চাই, আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি যেন দুজনের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।”

কথাগুলো বলার পর সবাই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল ঘরের বিভিন্ন কোণে। সামিয়া কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যেন বড় একটা বোঝা নামল তার বুক থেকে। আবরাহাম যেন ভাবনার গভীরে ডুব দিল। তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল—সামিয়া কি সত্যিই তার প্রতি আগ্রহী? তাদের সম্পর্ক কি সত্যিই আরও গভীর হতে পারে?

——————

কেটে গেছে কয়েক বছর। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। সামিয়া এখন ভার্সিটিতে পড়ে। আবরাহাম নিজের অতীত কাটিয়ে উঠেছে। সময় যেন তাদের সমস্যার সমাধান দিয়ে দিয়েছে। জীবনকে আরো সুন্দর করে দিয়েছে। দুইজন দুইজনকে আরো গভীর ভাবে চিনিছে, জেনেছে। প্রেমানুভূতি জাগ্ৰত হয়েছে খুব সুন্দর ভাবে। আবরাহাম নিজের ব্যস্ততার মাঝেও সামিয়াকে সময় দিয়েছে। ওকে বোঝার চেষ্টা করেছে। নিজের জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে।

দীর্ঘ তিন বছর পরের সকালে সামিয়া একটি নতুন দিনের সূচনা উপলব্ধি করছিল। সূর্যের প্রথম আলো গাছের পাতা ও ফুলে ঝলমল করছিল। তার চোখে আলো ছিল, মনে মনে সে বুঝতে পারছিল, আজকের দিনটি তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সে আজ একটি বিশেষ শাড়ি পরেছিল, যা তাকে আবরাহাম পছন্দ করে দিয়েছে। মিষ্টি রঙের শাড়ির মাঝে সোনালি রঙের সুতার কাজ, হাতে মেহেদী দিয়ে নেতামশাই নাম লেখা।

বিয়ের আয়োজন ছিল উন্মাদনার। তার পরিবার অতিথিদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সামিয়া জানত, আজ তার এবং আবরাহামের জন্য এক নতুন পথের যাত্রা শুরু হবে। আবরাহামও এই দিনটির জন্য প্রস্তুত ছিল। সে জানত, সামিয়া তার জীবনের সবকিছু, এবং সে চেয়েছিল আজ তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে। সেও নেভি ব্লু রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে। যা সামিয়া তাকে পছন্দ করে দিয়েছে।

সকালবেলা, আবরাহাম সামিয়ার বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। তার চোখে এক ধরনের দৃঢ়তা ছিল। সামিয়া দেখল, আবরাহাম কতটা উৎসুক। সামিয়াকে দেখেই আবরাহাম পলকহীন তাকিয়ে রইলো তার দিকে। সামিয়া খানিকটা লজ্জা পেলো আবরাহামের এমন দৃষ্টিতে। রেদোয়ান আবরাহামকে ধাক্কা দিতেই আবরাহাম বেশ বিরক্ত হলো। রেদোয়ান দাঁত পিষে বলল,
“ভাই তোরই তো বউ হবে। রাতে তাকিয়ে থাকিস যতো ইচ্ছে হয়। এখানে বড়রা আছে একটু তো লজ্জা কর।”

আবরাহাম ভ্রুযুগল কুচকে হিসহিসিয়ে বলল,
“লজ্জা করলে বাপ ডাক কেমনে শুনবো। তুই থাক তোর লজ্জা নিয়ে। আমার বউ আমি তাকাবো। তুইও তো আমার বোনের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিস তাতে তো আমি কিছু বলিনা।”

রেদোয়ান আমতা আমতা করতে করতে চলে গেল সেখান থেকে।

একটু পরেরই সামিয়াকে আবরাহামের পাশে বসানো হলো। আবরাহাম নরম কন্ঠে বলল,
“আজ তোমাকে আমার স্বপ্নের চিঠিকন্যার মতো লাগছে জান।”

আবরাহামের কথায় সামিয়া লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল।

যখন বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলো, পুরো পরিবার একত্রিত হল। আয়েশা বেগম, সামিয়ার মা, আবরাহামকে দেখে বললেন,
“তুমি সামিয়াকে খুশি রাখতে পারবে তো?”

আবরাহাম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিল, “আমার চেষ্টা সবসময় থাকবে, আশা করি আমি তার জন্য সবকিছু করতে পারব। আমি জানি, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমরা আমাদের সম্পর্ক গড়ে তুলবো।”

বিয়ের শপথের সময়, আবরাহামের হাত সামিয়ার হাতের ওপর রেখে বলল,
“আমি তোমাকে আমার জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করছি, সুখে ও দুঃখে।”

সামিয়া বলল,
“আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস এবং ভালোবাসা।”

তাদের শপথের সময়, চারপাশে একটি পবিত্র আবহ তৈরী হলো। যেন সৃষ্টিকর্তা তাদের ভালোবাসায় উপস্থিত।

বিয়ের পরপরই একটি আনন্দের উৎসব শুরু হলো। অতিথিরা তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জানাতে আসতে লাগলেন। হাসি, গান, এবং আনন্দের মাঝে সময় গড়িয়ে গেল। আব্রাহাম এবং সামিয়া তাদের বন্ধুদের সঙ্গে মজা করছিলেন, কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা নিঃশব্দ বোঝাপড়া ছিল।

আবরাহাম এবং সামিয়া তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তারা জানতেন, এই সম্পর্কের অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, কিন্তু তারা একসাথে সবকিছু সামাল দিতে প্রস্তুত ছিল।

রেদোয়ান, ইয়ানা, এবং অন্যান্য বন্ধুরা আনন্দে নাচছিল।

——————-

বিয়ের উৎসবের শেষ রাতে, আবরাহাম এবং সামিয়া একসাথে বাগানে হাঁটছিলেন। পূর্ণিমার আলোতে চারপাশটা রূপালি ঝিলমিল করছিল, আর বাতাসে ছিল নতুন দিনের উদ্দীপনা। সামিয়া তার মিষ্টি হাসি নিয়ে আবরাহামের হাত ধরে হাঁটছিল, আর আবরাহামের চোখে উচ্ছ্বাস আর স্নেহের দীপ্তি।

“আজকের দিনটা আমাদের জন্য কতটা বিশেষ, তাই না?” আবরাহাম বলল, তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের আবেগ ছিল।

সামিয়া হেসে বলল,
“হ্যাঁ, আজকের দিনটি যেন আমাদের নতুন জীবনের সূচনা।” তাঁর কথায় এক ধরনের আনন্দ, এবং একটু আতঙ্কও ছিল, যেন নতুন পথে পা রাখতে যাচ্ছেন।

আবরাহামের হাত শক্ত করে ধরা, সামিয়ার মনে হতে লাগল যেন সব প্রতিকূলতা একসাথে পার করতে পারবেন।
“জীবনের সব চ্যালেঞ্জ সামলাতে প্রস্তুত, আমরা একসাথে আছি, তাই না?” আবরাহাম বলল, তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল।

সামিয়া মাথা নেড়ে বলল,
“অবশ্যই। আমরা আমাদের ভালোবাসার শক্তিতে সবকিছু মোকাবেলা করতে পারব।” তাঁর কথায় আত্মবিশ্বাসের একটি ঝলক ছিল, যা আবরাহামের হৃদয়ে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল।

তাদের মাঝে এক মুহূর্তের নীরবতা ঘনিয়ে এলো। সামিয়া ধীরে ধীরে আবরাহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি জানো, আমি কখনোই অতীত নিয়ে ভেবেও দুঃখিত হতে চাইনি। আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারি?”

আবরাহামের চোখে এক ধরনের মায়া ও সমর্থন। সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, বলল,
“হ্যাঁ, আমরা আমাদের অতীতের গ্লানি ভুলে এগিয়ে যেতে পারি। আমাদের হৃদয়ে যে ভালোবাসা আছে, সেটাই আমাদের পথ দেখাবে।”

সামিয়া মাথা নিচু করে একটি মিষ্টি হাসি দিল, যেন তার মনে নতুন আশার বীজ পোঁতার চেষ্টা করছে।
“তাহলে, আমরা একসাথে এগিয়ে যাব, আমাদের নতুন স্বপ্ন নিয়ে।”

সেই মুহূর্তে, আবরাহাম সামিয়াকে কাছে টেনে নিলেন। তাদের হৃদয় ধড়ফড় করছিল, যেন সব কষ্ট আর দুঃখের স্মৃতি দূর হয়ে গেছে। সামিয়া অনুভব করল, এই ভালোবাসা তাদেরকে নতুন করে বাঁচতে সাহায্য করবে।

আবরাহাম সামিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নেশালো কন্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি চিঠিকন্যা। সারাজীবন আমার প্রেমানুভূতিতে সিক্ত করে তোমাকে আমার প্রিয়সী করে রাখতে চাই চিঠিকন্যা। তুমি কি আমার কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে চাও ছায়াবিথীনি।”

সামিয়া লাজুক হেসে বলল,
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি নেতামশাই। নেতামশাইয়ের গোপন ভক্ত থেকে তার মনের রাণী হয়ে থাকতে চাই সারাজীবন।”

আবরাহাম মুচকি হেসে সামিয়ার কপালে দীর্ঘ এক উষ্ণ পরশ দিলো। সামিয়া চোখ বুজে তা অনুভব করলো।

আবেগে ভরা সেই মধুর মুহূর্তে, তারা একে অপরকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করল। অতীতের জ্বালা থেকে মুক্ত হয়ে, তারা বুঝতে পারল, জীবন শুধুমাত্র সামনে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই সুন্দর হতে পারে।

এভাবে, তাদের জীবন নতুন আনন্দের সূচনা হলো, যেখানে তারা একে অপরের জন্য আশ্রয়, সমর্থন, এবং ভালোবাসা খুঁজে পেল। এবং তারা শিখল, অতীত নিয়ে পড়ে না থেকে এগিয়ে গেলে জীবন আরও সুন্দর এবং অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।

#সমাপ্ত