#বুকপকেটে_তুমি
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৯
সেলিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।নীলাঞ্জনা দুটো কফি হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।এক কাপ সেলিমের হাতে দিয়ে হাতে দিয়ে আরেকটা নিজের কাছে রাখলো। সেলিম কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “বাহ ! কফি তো ভালোই বানাও। এখন থেকে এটাই তোমার প্রতিদিনের রুটিন। প্রতিদিন সকালে আমার জন্য কফি বানাতে হবে। আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙবে তোমার হাতে কফি খেয়ে”
নীলাঞ্জনা হেসে বলল, “ঠিক আছে জনাব”
সেলিম বলল, “তোমার অফিসে যাচ্ছো কবে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “ছুটি শেষ হলেই যাব”
সেলিম বলল, “ছুটি কদিন পেলে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “পাঁচদিন ছুটি।”
সেলিম বলল, “মানে দুই তারিখ। শোনো নির্বাচন পাঁচ তারিখ এর আগে তোমার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। নির্বাচনের ঝামেলা শেষ হলে তারপর অফিসে যাবা।”
নীলাঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে কোন ব্যাপার না।এই কদিন আমি বাড়ি থেকেই ডিউটি করতে পারবো।”
সেলিম বলল, “সেটা তোমার ইচ্ছে। শুধু বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। পরিস্থিতি ভালো না। ইদানিং অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে”
নীলাঞ্জনা বলল, “কে মারা গেল?”
সেলিম বলল, “নিখোঁজ হওয়া আর মরে যাওয়া একই। ওদের আর কোনদিন খুঁজে পাবা না।এই পর্যন্ত প্রজেক্ট কে নিয়ে যত মানুষ বিরোধীতা করেছে সবাই নিখোঁজ”
নীলাঞ্জনা বলল, “তুমি প্রজেক্ট কে নিয়ে কিছু জানো?”
সেলিম বলল, “অনেক কিছু জানি”
নীলাঞ্জনা বলল, “তাহলে ওইদিন শোতে এরিয়ে গেলে যে।”
সেলিম বলল, “তোমার ভালোর জন্য করেছি।এই আলাপ বেশি আগালে তোমার ক্ষতি হতে পারে।তাই আমি বিষয়টা এরিয়ে গেছি।এইসব কথা বার্তা গোপনে করতে হবে।হয়তো দেখা গেল তোমার বেস্টফ্রেন্ড কিংবা কোন সহকারী এই গ্রুপের সাথে জড়িত। মানে কথার কথা বললাম আরকি”
নীলাঞ্জনা বলল, “প্রজেক্ট কে টা আসলে কি?”
সেলিম বলল, “প্রজেক্ট কে হলো একটা মিশন। একটা গ্রুপ আছে।এরা বিভিন্ন খারাপ কাজে লিপ্ত মানুষদের তাদের বানানো টর্চার সেলে বন্দী করে রাখে। তাদের শাস্তি দেয়া হয়। সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড। যেসকল মানুষ অনেক খারাপ কাজ করে তাদের মেরে ফেলে। বাকিদের বন্দি করে রাখলেও অনেক কঠিন শাস্তি দেয়া হয়। শান্তির মধ্যে ও আবার ভেদাভেদ আছে। টর্চার সেলের রুমগুলো খুব ছোট আর ঠিকমতো দাড়ানো যায় না। চব্বিশ ঘন্টা ওই জায়গা অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে থাকে।তাই কেউ ওই জায়গায় বেশিদিন বেঁচে থাকতে চায় না।শুনেছি এই টর্চার সেল ৫০০ ফুট মাটির নিচে”
নীলাঞ্জনা বলল, “প্রজেক্ট কে তো গোপনীয় ।এটা মানুষ জানলো কি করে?”
সেলিম বলল, “এরাও হয়তো একসময় ওই গ্রুপের সদস্য ছিল। প্রথমত এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার নিয়ম নেই। অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য আইন আছে। দ্বিতীয় বিষয় হলো অনেক মানুষ অল্প অপরাধ না করেও শাস্তি পায়। যেগুলো খুব সামান্য অপরাধ।”
নীলাঞ্জনা বলল, “যেমন”
সেলিম বলল, “কিছু দিন আগে এক গরীব মহিলা অর্থের অভাবে সন্তান বিক্রি করে দেয়।তাকে সন্তান বিক্রি করার অপরাধে টর্চার পেল নিয়ে। এই অভাবী মা যখন মানুষের ঘরে ঘরে সাহায্য চেয়েছিল তখন তো কেউ সাহায্য করেনি।সে সন্তান বিক্রি করে দিয়েছে যাতে তার শিশু একটা ভালো পরিবার পায়।তার কাছে থাকলে তো না খেয়ে মরে যেত”
নীলাঞ্জনা বলল, “এই ঘটনা আমাদের চ্যানেলে কভার করা হয়েছিল। অভাবের তাড়নায় সন্তান বিক্রি করে দেয় মা”
সেলিম বলল, “দুনিয়ায় অনেক কিছুই ঘটে। কয়জন এসবের খবর রাখে। এমন ঘটনা অহরহ ঘটে”
নীলাঞ্জনা বলল, “নুরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে থানায় কেস করতে যাব ভাবলাম।এর আগেই সে নিখোঁজ হয়ে গেল।এই ব্যাপারে আমি বাইরের কারো সাথেই আলাপ করিনি।এই বিষয়ে শুধু দুইজন জানতো অনামিকা ছাড়া।এক অর্ক আরেক নাদিয়া। কিন্তু নুরুল ইসলাম খান কে নিখোঁজ করলো কোন ইস্যুর ভিত্তিতে।”
সেলিম বলল, “তোমার দুই সাথি যে তাদের সাথে জড়িত না তা কে বলল?”
নীলাঞ্জনা বলল, “জানি না।আয়ান চৌধুরীর বাড়িতে একটা ডায়রি পেয়েছিলাম। যেখানে প্রজেক্ট কে নিয়ে লেখা ছিল।ওই ডায়রি টা হাতে পেলে খুব ভালো হতো”
সেলিম বলল, “নির্বাচনের পর ও বাড়ি যেও।তখন নিয়ে আসতে পারবে”
দেখতে দেখতে পাচ তারিখ চলে এলো।পাঁচ তারিখ সকালে নির্বাচন শুরু হলো। নীলাঞ্জনা তার শ্বশুরের সাথে ভোট দিতে গেল। জীবনের প্রথম ভোট দিলো তাও নিজের স্বামীকে। ভোট দিয়েই আবার বাড়ি ফিরে এলো। সেলিম চাইছিলো না নীলাঞ্জনা বেশি সময় ধরে বাড়ির বাইরে থাকুক। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এলো। হঠাৎ মানুষের মধ্যে হইচই শোনা গেল।একটা ডাস্টবিনের পাশে একটা কাটা মাথা পাওয়া গেছে। মাথা টা খুব বাজে ভাবে থেঁতলে দেয়া হয়েছে তাই মাথাটা কার সেটা বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে এসে হাজির হয়।কাটা মাথা পাঠিয়ে দেয়া হয় মাথা কার সেটা পরীক্ষা করে বের করার জন্য।কাটা মাথা পেয়ে পুলিশ হন্য হয়ে শরীরের বাকি অংশ খুজে বের করতে লাগল।কাটা মাথা যখন পাওয়া গেছে। খুঁজলে শরীরের বাকি অংশ ও খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে। পুলিশের তদন্তে পুরো শহর খুঁজে শরীরের ২৭ টুকরো অংশ খুজে পাওয়া গেল। চারদিকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।কেউ বলছে এটা হয়তো আয়ান চৌধুরীর লাশ আবার কেউ বলছে এটা নুরুল ইসলাম খানের লাশ।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলো নীলাঞ্জনা। পাশেই সেলিম দাড়িয়ে আছে। নীলাঞ্জনা ক্যামেরা নিয়ে জায়গাটার বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ছবি তুলে রাখলো। এবার শুধু কাটা মাথা কার সেটা বের করার অপেক্ষা।
সন্ধ্যায় ভোট গণনা করা হলো। সেলিম তৃতীয় বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হলো। চারদিকে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। এমন সময় থানা থেকে নীলাঞ্জনার কাছে ফোন আসলো।ফোন রিসিভ করতেই অফিসার রাশেদ বলল, “আপনি ঠিক বলেছেন ।আয়ান চৌধুরীকে গুম করে ফেলা হয়েছে।আমি আপনার কথা শুনিনি।মাঝপথে তদন্ত বন্ধ করে দিতে বলেছি”
নীলাঞ্জনা বলল, “কি হয়েছে?”
অফিসার রাশেদ বলল, “কাটা মাথা আয়ান চৌধুরীর। শরীরের সব অংশ অবশ্য উনার না।তার সাথে আরো একজন মানুষের বডির অংশ পাওয়া গেছে”
নীলাঞ্জনা বলল, “মাথা কি দুইটা পাওয়া গেছে?”
অফিসার রাশেদ বলল, “মাথা একটাই।বডি পাওয়া গেছে দুইজনের”
নীলাঞ্জনা বলল, “আরেকটা কার?”
অফিসার রাশেদ বলল, “এখন ও কিছু জানা যায়নি”
নীলাঞ্জনা বলল, “নুরুল ইসলাম খানের নয়তো”
অফিসার রাশেদ বলল, “তুমি এত শিউর হচ্ছো কীভাবে?”
নীলাঞ্জনা বলল, “জানি না। তবে উনি ও তো নিখোঁজ হয়েছে।কেউ কিডন্যাপ করলে তো ফোন দিয়ে টাকা পয়সা চাইতো। সেইরকম কোন কিছুই তো হলো না।”
অফিসার রাশেদ বলল, “এই নিয়ে আমি ও খুব চিন্তিত। নুরুল ইসলাম খান সাহেবের বউ বারবার ফোন দিয়ে স্বামীর খবর জানতে চাইছে। এইদিকে কোন খোঁজ খবর পেলাম না।তুমি এই কেসে হেল্প করলে ভালো হয়”
নীলাঞ্জনা বলল, “কাল সকালে থানায় দেখা হচ্ছে। আমি এই কেস নিয়ে তদন্ত করতে চাই”
অফিসার রাশেদ বলল, “আচ্ছা আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো”
নীলাঞ্জনা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো সেলিম তার পাশে বসে আছে। সেলিম তার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল, “ধরো চা”
নীলাঞ্জনা বলল, “তুমি বানাতে গেলে কেন? আমিই তো বানিয়ে নিতে পারতাম”
সেলিম বলল, “সাড়ে আটটা বাজে”
নীলাঞ্জনা বলল, “তুমি আমাকে ডাক দিলেন না কেন?”
সেলিম বলল, “তুমি ঘুমোচ্ছিলে তাই আর ডাক দেইনি”
নীলাঞ্জনা বলল, “খুব দেরি হয়ে গেল।আমাকে আবার থানায় যেতে হবে। থানায় কাজ শেষ করে একটু ও বাড়ি যাব”
সেলিম অবাক হয়ে বলল, “এত তাড়াতাড়ি”
নীলাঞ্জনা বলল, “থাকবো না।একটু পরেই চলে আসবো”
সেলিম বলল, “আমার ও কাজ আছে। প্রেজেন্ট কে নিয়ে গোপনে কাজ করছি।শুনেছি ওদের টর্চার সেলে অনেক মানুষ এখনো বন্দি জীবন পার করছে। ওদের মুক্তির দরকার। তাছাড়া প্রজেক্ট কে সফল হলে অনেক ক্ষতি হবে”
নীলাঞ্জনা বলল, “কি ক্ষতি?”
সেলিম বলল, “এটক একটা সিক্রেট মিশন। তুমি আমার স্ত্রী তাই তোমার কাছে গোপন করছি না।আসলে প্রজেক্ট কে এর লোকেরা শুরুতে খারাপ মানুষ কে শাস্তি দেওয়ার জন্য টর্চার সেল বানালেও পরে অনেক নিরীহ মানুষ কে টর্চার সেলের মধ্যে বন্দি করে রাখতো। গ্রুপের সদস্যদের যাকে ভালো লাগে না তাকে বন্দী করে রাখে তাদের টর্চার সেলে। এখন এই গ্রুপ একটা ঔষধ তৈরি করছে।এটা খেলে মানুষের মধ্যে সুইসাইড করার প্রবণতা বাড়বে।এই ঔষধ খেলে মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলবে।তাই আমাদের লক্ষ্য হলো ওদের টর্চার সেল থেকে মানুষ কে উদ্ধার করা ও এই ভয়ানক ঔষধ বন্ধ করে দেয়া”
নীলাঞ্জনা বলল, “আমি ও তোমার পাশে আছি। প্রজেক্ট কে নিয়ে আমিও তোমাকে সাহায্য করবো”
সেলিম বলল, “আজ আমার ফিরতে দেরী হবে। আজকে একজনের সাথে দেখা করবো। প্রজেক্ট কে এর সাথে জড়িত মানুষের কিছু তালিকা পাওয়া গেছে।”
নীলাঞ্জনা বলল, “এই টর্চার সেল টা কোথায়?”
সেলিম বলল, ‘জানি না।শোন আমি যদি আজ ফিরে না আসি। আমার অসম্পূর্ণ কাজ তুমি সমাধান করবে। আমার বুকশেলফের পেছনে একটা সিক্রেট রুম আছে। ওখানে প্রজেক্ট কে আর তাদের টর্চার সেল নিয়ে অনেক তথ্য দেয়া আছে”
নীলাঞ্জনা বলল, “হঠাৎ এই কথা বলছো যে?”
সেলিম বলল, “জানি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আজ বাড়ি ফিরতে পারবো না।”
নীলাঞ্জনা বলল, “এইরকম খারাপ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও তো”
সেলিম বলল, “নাস্তা খেয়ে নেও। আমি তোমাকে থানায় নামিয়ে দিয়ে আমার কাজে যাব”
নীলাঞ্জনা হাত মুখ ধুয়ে নিচতলায় চলে গেল। সেলিম তার সিক্রেট রুমে গিয়ে বসে। টেবিলের উপর থেকে একটা ডায়রী বের করে আনমনে কিছু লিখতে থাকে।
চলবে।