কমলা রঙের রোদ পর্ব-২৫+২৬

0
4

#কমলা_রঙের_রোদ [২৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

স্মরণ চাকরি পেয়েছে এটা জেনে মানছুরার থেকে বেশি খুশি আর কে হবে? স্মরণের যেকোনো উপার্জন তার নিজের উপার্জন। সেই ছোটবেলা থেকেই চাইত স্মরণ জীবনে বড়ো কিছু করুক। মানছুরা ভেবেছিল স্মরণ খুশির বিয়ের বিষয়ে ভাইজানের সাথে কথা বলবে। কিন্তু স্মরণ চাকরি পাওয়ার কথা জেনে সেটা আর করতে পারছে। এখন যদি বিয়ের কথা বলে তাহলে নিজের চোখেই সে লোভী হয়ে যাবে। যদিও স্মরণের চাকরি হওয়ার খবর জানার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরী বানু নাতির আনা মিষ্টি মুখে দিয়ে গর্বিত গলায় বললেন,

-আমার নাতি যে অকর্মা না এইডা তোমারে আমি আগেই কইছিলাম। দেখছ, চাকরি পাইয়া কেমুন মিষ্টি লইয়া আইছে! এইবার তো তুমি বিয়াডা দিবা বউ।

মানছুরা কাপড় ভাঁজ করতে করতে শাশুড়ির কথা শুনলেন। পরী বানু মনে মনে ধরেই নিয়েছেন এবার স্মরণের হাতে খুশিকে তুলে দিতে মানছুরা আর কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু মানছুরাকে কোন জবাব না দিতে দেখে পরী বানু নাতির আরও একটু গুণগান করে বললেন,

-স্মরণ হইলো ওর বাপের মতো। বড়ো বউয়ের মোহাব্বতে আমার পোলাডা আইজও পাগল। তোমার বইন যাওয়ার পর মাথাডাই খারাপ কইরা ফেলছে। হের পোলাও যে বউরে এতটাই ভালোবাসবো এতে কোন সন্দেহ নাই।

-আমি খুশি স্মরণের বিয়ের কথা ভাইজানকে বলতে পারব না আম্মা।

কথাটা পরী বানুর কানে বিস্ফোরণের মতো শোনাল। এই বউয়ের মাথা কি আসলেই খারাপ। পাগল তো তার বড়ো ছেলে না। পাগল তার ছোট ছেলের বউ। দুই দিন আগে নিজের মুখেই বলেছে, স্মরণ খুশির বিয়ের ব্যাপারে ভাইজানের সাথে কথা বলবো। আজ বলছে, বলতে পারবে না। পরী বানু তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,

-কেন কইতে পারবা না? অতদিন কইছো আমার নাতি বেকার। কাজকর্ম করে না। তোমার মাইয়ারে খাওয়াতেই পারবো না। এহন তো চাকরি পাইছে। এহন কেন তোমার আপত্তি? তোমার মাইয়া কি হাত্তি যে আমার নাতি ওরে পালতে পারব না।

ভাঁজ করা কাপড় গুলো হাতে নিয়ে মানছুরা রাখতে যাচ্ছিল। পরী বানু হাত ঝারা মেরে মানছুরার হাত থেকে কাপড় গুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন,

-তোমার মতো মাইয়া মানুষ আমি জীবনে দেখি নাই। তোমারে আল্লাহ কোন মাটি দিয়া বানাইছে? এত্ত জিদ কেন তোমার?

একটা মানুষের পক্ষে যতটা রাগ করা সম্ভব পরী বানু এই মুহূর্তে সেই পরিমাণেই রেগে আছেন। মানছুরা শাশুড়িকে কিছু বলল না। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরী বানু পেছন থেকে চেঁচামেচি শুরু করলেন।

-তুমি অনেক বেশি বুঝো। ময়মুরুব্বির কথা তোমার গায়ে লাগে না। নিজেরে পণ্ডিত মনে করো।

খুশি পড়ার টেবিলে বসে ছিল। যদিও সে পড়ছিল না। দাদীর চেঁচামেচি শুনে বাইরে বেরিয়ে এলো। মাকে উঠানে আম গাছটার নিচে বসে থাকতে দেখল। দাদী নিশ্চয় মার সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া লেগেছে। মা দাদীর ঝগড়া দেখা তার জন্য নতুন কিছু না। দাদী এখন ঝগড়া করে একটু পরেই আবার ছেলের বউয়ের সুনাম করে। তবে আজ মনে হয় সিরিয়াস কিছু হয়েছে। নয়তো মা তো কোনদিন দাদীর কথা শুনে চোখের পানি ফেলে না। মাকে কাঁদতে দেখেও খুশি মার কাছে যেতে পারছে না। সে কারো দুঃখ ভাগ করে নিতে জানে না। কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। খুশবু এই কাজগুলো খুব ভালো পারে। এখন খুশবু থাকে ছুটে মার কাছে যেত। হয়তো কোনকিছুর পরোয়া না করে মার চোখের পানিও মুছে দিত।

🌸

বাড়ির জন্য আজ খুশবু একটু বেশিই মন খারাপ করছে। সান মায়ের সাথে মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সকাল থেকে যে খুশবুর মন খারাপ এটাও বুঝতে পেরেছে।
সান খুশবুর সাথে কথা বলল। তার বউয়ের যদি খুব বেশিই মন খারাপ হয় তাহলে যাবে না মিটিংয়ে। বউয়ের মন খারাপের থেকে মিটিং বড়ো না।

-তোমাকে একা রেখে যাচ্ছি বলে মন খারাপ? মিটিং এক ঘন্টার বেশি সময় নিবে না। কথা আমি আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।

খুশবু হতাশ নয়নে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আপনার জন্য কেন আমার মন খারাপ হবে? এক ঘন্টা কেন, আপনি দশ ঘন্টা লাগান।

সান ব্যথিত হওয়ার অভিনয় করল। বুকে হাত দিয়ে বলল,

-তোমার কথা এখান টায় ভীষণ লাগে।

হঠাৎ খুশির বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল খুশবুর। খুশি বলেছিল, তোর কথায় নিমেরা রস মেশানো থাকে। মানুষকে এত কষ্ট দিয়ে কথা বলিস না। অভিশাপ লাগবে। খুশবু বুঝতে পারে না সত্যিই কি তার কথায় মানুষ কষ্ট পায়? তাই সানের সাথে একটু নরম হলো। মিনমিন করে বলল,

-আপনি আপনার মায়ের সাথে যাচ্ছেন। ওখানে গিয়েও ফেরার তাড়া দেখালে উনি আপনার উপর অসন্তুষ্ট হবেন।

খুশবুকে নিজের কথা থেকে পল্টি খেতে দেখে সান হাসলো। মুখে যতই কঠিন হতে চাক। মনে মনে ঠিকই কেয়ার করে। সান টাই বাঁধতে বাঁধতে খুশবুর দিকে দেখল। তখনই বলে উঠল,

-টাই বাঁধতে পারো?

-হ্যাঁ?

-জিজ্ঞেস করেছি টাই বাঁধতে পারো নাকি?

-কোনদিনও বাঁধি নি। তাই জানিও না।

-একবার তাহলে চেষ্টা করে দেখো তো। জীবনে সব জিনিস একবার করে চেষ্টা করতে হয়। আসো আমার টাই বেঁধে দাও।

খুশবু হাত-পা গুটিয়ে নিয়ে বলল,

-পাগল! আমি পারি না।

-না পারলেও ক্ষতি নেই। আমি শিখিয়ে দেব।

-আমার শেখারও দরকার নেই।

-আছে।

এই বলেই সান খুশবুর হাত ধরে টেনে ওকে দাঁড় করিয়ে ফেলল। খুশবু মনে মনে ভাবছে, এ কোন জ্বালায় পড়ল সে!

-বররা অফিসে গেলে বউরা কত যত্ন করে টাই বেঁধে দেয় টিভিতে দেখোনি?

-আমাদের বাড়িতে টিভি নেই।

-এজন্যই তুমি এত আন রোমান্টিক।

সামনে মুখ বাঁকানোর ধরন দেখে খুশবু হেসে ফেলতে গিয়েও হাসল না।

-আপনি কি সব কিছু নিয়েই এমন জেদ করেন?

সান অবাক হয়ে বলল,

-জেদ কোথায় করলাম!

-আপনি মনে করেছেন আমাকে আপনি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন। যেটাই হোক। এখন আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে। যেভাবেই হোক বিয়েটাও করে ফেলেছেন। এটা কি একপ্রকার জেদ না?

খুশবু টাই বাঁধার অহেতুক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাকে দিয়ে হবে না আগেই জানত। সান গম্ভীর হয়ে খুশবুকে দেখছে। খুশবু কি তাহলে এমনটা মনে করে? সে জেদ থেকে খুশবুকে বিয়ে করেছে! তার ভালোবাসা এই মেয়ের চোখে কেন ভাসছে না? সান খুশবুর হাত থেকে টাই নিয়ে নিল। গম্ভীর গলায় বলল,

-তুমি আমার জেদ না। তবে আমি এটাই ভেবে পাচ্ছি না আমার ভালোবাসা কেন তোমার চোখে পড়ছে না? আমি কি করলে তোমার বিশ্বাস হবে সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই সারা জীবনের জন্য নিজের করে পেতে চেয়েছি।

সানকে এটুকু কথায় ওমন মুখ ফুলিয়ে রাগ করতে দেখে খুশবু ভাবল, ভীষণ আরাম আয়েশ প্রাচুর্যে বড়ো হওয়া ছেলে গুলোর মন মনে হয় এমন নাজুকই হয়। কথায় কথায় এরা মুখ ফোলায়। শাশুড়ি মা ছেলের অভ্যাস নষ্ট করে রেখেছেন।
মা ছেলে বেরিয়ে গেলে খুশবু একা বাসায় করার মতো কোন কাজ খুঁজে পেলো না। তবে এক ঘন্টাও তাকে একা থাকতে হয়নি। এর মাঝেই মাহিয়া এসে হাজির। মাহিয়াকে দেখে খুশবু কত বেশি খুশি হয়েছে বলার বাহিরে। বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-তুই-ই আমার সুখ দুঃখের একমাত্র সাথী দোস্ত। তুই কীভাবে জানলি আমি একা আছি?

-আমাকে ভূতে এসে জানিয়ে যায়নি। তোর জামাই কল করেছিল। বলল, তুই একা আছিস। দশ মিনিটের মধ্যে যেন তোর কাছে আসি। কত ভালোবাসে তোকে দেখেছিস!

খুশবু গাধা বা তার চোখ নেই এমন না। সে-ও দেখে। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। ভালোবাসা জিনিস টায় তার বিশ্বাস নেই। মানুষের মন পাল্টাতে খুব বেশি সময় লাগে না। খুশবু মানুষকে ভালোবাসতে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। তার বাবা বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তার মাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিল। প্রথম স্ত্রীকে যে উনি ঠকাচ্ছেন সেটা হয়তো একবার ভাবেও নি। আচ্ছা খুশবু ধরে নেয় প্রথম স্ত্রীর প্রতি উনার ভালোবাসা ছিল না। কিন্তু তার মা-ও তো বিবাহিত জেনেও বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সেই ভালোবাসা সে পৃথিবীতে আসতে আসতে শেষ হয়ে গেল? মা বাবাকে সহ তাকেও ত্যাগ করেছে। খুশবু মানে, জন্ম দিলেই শুধু মা হওয়া যায় না। ওই মহিলার কথা সে ভাবেও না। কিন্তু যে মা আছে সে মা-ও তো তাকে গ্রহণ করেনি।

-কিরে কোন ভাবনায় তলিয়ে গেলি? ভাইয়াকে নিয়ে ভাবছিস না! হুম হুম, বুঝি বুঝি। নতুন নতুন বিয়ে। ভালোবাসা তো উপচে পড়বেই।

-তোর ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতে আমার বয়েই গেছে।

-কেন? ভালোবাসিস না আমার ভাইকে?

খুশবু মনে মনে বলল,

-আমি ভালোবাসতে ভয় পাই মাহি। সম্পর্কে ধোঁকা হয়তো আমি সহ্য করতে পারব না। তাছাড়া ভালোবাসা মানুষের জীবনে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।

চলেব

#কমলা_রঙের_রোদ [২৬]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

হাসান মানছুরাকে ডেকেছে। ভাইজান কী জন্যে ডেকেছেন মানছুরা জানে না। অনেকক্ষণ ধরে মানছুরা সামনে বসে থাকলেও হাসান কিছু বলছে না। অবশেষে মানছুরাই বলল,

-ভাইজান আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?

এককালে শিক্ষকতা করলেও এখন সে কোন কথাই গুছিয়ে ঠিকঠাক মতো বলতে পারে না। এই কথাটা কীভাবে বলবে এটা নিয়েও ভাবনায় পড়ে গেছে।

-কথাটা আমি তোমাকে বললেও এই কথা কিন্তু আমার না।

-কী কথা ভাইজান।

-তুমি যেন কী মনে করো! রাগ করবে না তো?

ভাইজানকে এতটা ইতস্তত করতে দেখে মানছুরা অভয় দিয়ে বলল,

-আপনি বলুন। আমি কিছুই মনে করব না। আর আপনার কথায় রাগ কেন করব?

মানছুরার মুখ থেকে এই কথা শুনে তিনি যেন সাহস পেলেন। নিষ্পাপ হেসে বললেন,

-তোমার বোন আমার সাথে রাগ করেছে। আমি কেন তোমাকে বলি না। আমি জানি তুমি একটু রাগী। তোমার বোন তো আর তোমাকে ভয় পায় না।

মানছুরা গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কত ডাক্তারই তো দেখিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি। ভাইজানের বুবুকে দেখা বন্ধ হয়নি। মানছুরা মমতার চোখে মানুষটাকে দেখছে। বুবুর কথা বলার সময় ভাইজানের চোখ কেমন চকচক করতে থাকে।

-বুবু আমাকে কী বলতে বলেছে?

-কিছু বলতে বলেনি৷ তোমার মেয়েটাকে চেয়েছে।

মানছুরা একটু ঘাবড়ে গেল। যদিও সবই ভাইজানের কল্পনা। তারপরও মায়ের মন। বুবু কি খুশিকে নিয়ে যেতে চায়।

-খুশিকে তোমার বুবুর অনেক পছন্দ। ওকে ছেলের বউ করতে চায়। যদিও আমি তোমার বুবুকে বলেছি, আমার ছেলে তো কোন কাজের না। শুধু শুধু মেয়েটার জীবন নষ্ট হবে। কিন্তু তোমার বুবু কেমন জেদি জানোই তো। আমার কথা শুনবে তো দূর এই কথা বলার জন্য আরও আমার সাথে রাগ করেছে। নিজের ছেলেকে কেন আমি ওরকম ভাবি।

মানছুরা ফ্যালফ্যাল চোখে ভাইজানের দিকে তাকিয়ে আছে। বুবু কি সত্যিই খুশিকে ছেলের বউ করতে চায়? বুবু ভাইজানের কল্পনা। ভাইজান চায় বলেই হয়তো বুবুর হয়ে এই কথা বলছে। মানছুরাকে চুপ করে থাকতে দেখে হাসান দুঃখী মুখ করে বলল,

-আমি তো জানতাম। তোমার কোন দোষ নেই। মেয়ের মা তুমি। তোমাকে তো চিন্তাভাবনা করেই কাজ করতে হবে।

-ভাইজান বুবু কি সত্যিই চায় আমার খুশিকে স্মরণের বউ করতে?

হাসান মানছুরার চোখে চোখ রেখে বলল,

-তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করো না?

মানছুরা নিজের এমন প্রশ্নে লজ্জিত হলো। বুবু বেঁচে থাকলে হয়তো তার জীবনটা এতটা কঠিন হতো না। বুবু তাকে আগলে রাখত। বুবুর কথা মনে পড়লে মানছুরার চোখ ভিজে এলো।

-বুবু যদি এটাই চায় তাহলে আমারও কোন আপত্তি নেই।

হাসান খুশিতে বাচ্চা ছেলের মতো হাত তালি দিয়ে উঠল। হঠাৎ মানছুরার নিজের বড্ড হালকা লাগছে। বুকের উপর কিছু একটা যেন চেপে বসেছিল। যা এই মুহূর্তে নেমে গেছে। ঘর থেকে বেরোবার সময় মানছুরা শুনলো ভাইজান কারো সাথে কথা বলছে।

-তুমি ঠিকই বলেছিলে। মানছুরা তোমার কথা ফেলবে না। আমি তোমার কাছে হেরে গেলাম। তোমার বোন তোমাকে জিতিয়ে দিয়েছে।

🌸

রান্নাঘর ফাঁকা ছিল দেখে এই সুযোগে খুশবু রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে ফেলেছে। একটা কাপে চা ঢেলে সানের জন্য রুমে নিয়ে এলো। চা-টা বলা যায় অজুহাত। সে সানকে কাল তার সাথে বাড়ি যাওয়ার কথা বলবে। খুশবু একাও যেতে পারত। কিন্তু দাদী পইপই করে বলে দিয়েছে, জামাইকে ছাড়া বাড়ি এলে আমি তোর ঠ্যাং ভেঙে ফেলব। নাতিন জামাইয়ের কত দরদ! চা নিয়ে ঘরে ঢুকে খুশবু ইতস্তত করতে লাগল। সান ওকে আসতে দেখেছে। তারপরও না দেখার ভান করে থাকল। খুশবু মনে মনে ভাবছে, এই লোক কি কানা? সে এসেছে এটা কি দেখেনি? গলায় সামান্য শব্দ করল খুশবু। সান এদিকে তাকালে বলল,

-আপনার জন্য চা এনেছিলাম।

সান অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

-আমার জন্য! তুমি বানিয়ে এনেছ!

-হুম। এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে?

-কী নেই সেটা বলো। আমার বউ জীবনের প্রথম আমার জন্য ভালোবেসে চা বানিয়ে এনেছে। এই তারিখ ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রেখে বছরে বছরে পালন করা উচিত।

এই লোক শোধরাবার নয়। খুশবু আরও ভেবেছিল সান হয়তো তার উপর রেগে আছে। কারণ বাড়ি ফিরেও খুব একটা কথা বলেনি। সান বউয়ের হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,

-আহ! চা নয় যেন অমৃত।

-এটা কি একটু বেশিই হয়ে গেল না?

-আমার বউয়ের প্রশংসায় কোনকিছুই বেশি না।

-কাল কি আপনার কোন কাজ আছে?

-তোমার জন্য আমি সবসময় ফ্রি।

-কাল আমি বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। অনেকদিন হয়ে গেছে সবাইকে দেখি না। আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?

সান মনে মনে খুশি হয়েছে। খুশবু একটু হলেও তার উপর নির্ভর করছে। সানকে এত বেশি ভাবতে দেখে খুশবু চিন্তায় পড়ে গেল।

-নিয়ে যেতে পারবেন না?

-পারব। কখন যাবে আমাকে জানিয়ে রেখো।

খুশবু চট করে বলে উঠল,

-আমি কিন্তু কয়েকদিন থাকব।

খুশবু বাবার বাড়ি গিয়ে কয়েকদিন থাকবে শুনে সানের মুখ কালো হয়ে গেল। এই কয়েকটা দিন সে কীভাবে থাকবে? বুকে পাথর চেপে তারপরও অনুমতি দিতে হলো।

-আচ্ছা থেকো।

খুশবু কতটা খুশি হয়েছে তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সানের চা খাওয়া শেষ। খুশবু কাপ তুলে নিয়ে যেতে চাইলে সান ওর হাত ধরে ফেলে বলল,

-দাঁড়াও।

-কী?

-চুপটি করে দাঁড়ালেই দেখতে পারবে।

খুশবু দাঁড়িয়ে রইল। সান উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা বক্স নিয়ে এলো৷ ফিরে এসে খুশবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-এটা তোমার জন্য।

-কী আছে এতে?

-খুলে দেখো।

খুশবু দ্বিধা নিয়ে প্যাকেটটা খুলে দেখল নতুন মোবাইল ফোন।

-আজ মিটিংয়ে বসে বোর হতে হতে তোমাকে এত মিস করছিলাম! কিন্তু এবার থেকে আর বোর হবো না। মিটিংয়ে বসেও তোমার সাথে মেসেজ করব।

এই লোক নির্ঘাত পাগল। কাজের সময়ও এসব উল্টাপাল্টা কথা চিন্তা করে!

🌸

স্মরণ আজকে প্রথমদিন অফিসে যাচ্ছে। খালার থেকে দোয়া নিয়ে এসে এবার দাদীর কাছে এসেছে। খুশিও দাদীর ঘরেই ছিল। স্মরণ দাদীর সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল,

-দাদী দোয়া করে দাও।

পরী বানু নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

-জীবনে অনেক বড়ো হ ভাই। অনেক সফল হ।

-বড়ো বা সফল হতে চাই না দাদী। বিয়ে করতে চাই। দোয়া করো যেন এই বছরই বউ ঘরে তুলতে পারি।

খুশি কঠিন চোখে স্মরণের দিকে তাকাল। পরী বানু হাসতে হাসতে বলল,

-বিয়াও হইয়া যাইব। চিন্তা করিস না তুই।

-তোমরা পাত্রী টাত্রী দেখো না। কীভাবে হবে বিয়ে?

-ঘরে পাত্রী থইয়া বাইরে পাত্রী কেন দেখমু?

-ঘরের পাত্রীর অনেক দেমাগ। তাই বাইরে থেকেই একটা ধরে আনতে হবে।

এপর্যায়ে খুশি রেগে গিয়ে বলল,

-চাকরি পেয়ে যে কিছু মানুষের অহংকার বেড়ে গেছে সেটা কিছু না। অহংকারে মাটিতে পা ফেলতে ভুলে গেছে। তুমিও বলে দাও দাদী, ঘরের পাত্রীও তাকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে না।

স্মরণ সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। খুশি স্মরণকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্মরণ দাদীর কাছে বিচার দিতে দিতে বলল,

-তেজ দেখেছ দাদী! মেয়ে মানুষের আচরণ এমন হয়? মুখ থেকে কথার বদলে তীর বের হয়।

পরী বানু এই দুইটাকে নিয়ে আর পারেন না। তিনি ভাবতেন খুশবুই শুধু অবুঝ। এখন দেখছেন, এই দুইটা তো আরও বড়ো অবুঝ। পরী বানু স্মরণকে মেরে বললেন,

-তুই-ই তো খোঁচাখুঁচি শুরু করেছিস।

-তোমার নাতনির উচিত আমাকে মানানো। আমার রাগ থাকবেই স্বাভাবিক। আমি তো আর বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম না। একটুর জন্য তোমার নাতনি আমাকে কত বড় ধোঁকা দিতে যাচ্ছিল!

🌸

খুশবু ঠোঁট কামড়ে পায়চারি করতে করতে ভাবছে নতুন ফোন দিয়ে সবার আগে কাকে কল করবে। প্রথম কল স্পেশাল মানুষকেই করা উচিত। খুশবুর স্পেশাল মানুষ একজনই। নম্বর মুখস্তই ছিল। ফোন রিং হচ্ছে। অপেক্ষা শুধু কখন রিসিভ করবে।
চাকরির প্রথম দিন। কাজের মাঝে কে এতবার কল করে ডিস্টার্ব করছে? অন্যান্য কর্মচারীরা তার দিকে দেখছে। স্মরণ সকলের উদ্দেশ্য ক্ষমা মূলক হেসে কল রিসিভ করল।

-হ্যালো। কে বলছেন?

খুশবু গলার স্বর পাল্টে বলল,

-আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।

-জি না। আমিও আপনাকে চিনি। আপনার আমার খালার মেয়ে।

যাহ! গলায় চাপ দিয়ে কন্ঠ কতটা চিকন করে কথা বলেছে তারপরও চিনে ফেলল! সব মজা মাটি করে দিল। খুশবু অভিমানী গলায় বলল,

-কীভাবে চিনেছ এটা যে আমি?

-রং নাম্বারে কল আমার কাছে খুব কমই আসে। আর এলেও তোর মতো কেউ নাটক করে কথা বলে না।

-তারপরও এটা যে আমিই এটা কীভাবে শিওর হয়েছ?

-তুই চিকন গলায় কথা বললে আমি ধরতে পারব না মনে করেছিস?

-চিনে ফেললেও তোমার উচিত ছিল কিছুক্ষণ না চেনার নাটক করা।

-নাটক করার সময় নেই। কাজে আছি।

-তোমার আবার কী কাজ?

-চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা।

স্মরণ ভাই চাকরি পেয়েছে শুনে খুশবু খুশিতে চিৎকার করে উঠল। এদিকে স্মরণের কানে তালা লেগে গেছে।

-সত্যি তুমি চাকরি পেয়েছ! কই আমাকে তো কেউ কিছু জানাল না। তুমি নিজেও তো আমাকে জানাও নি। ওহ আমি তো এখন পর হয়ে গেছি। তোমরা কেন আমাকে মনে রাখবে?

খুশবু কষ্ট পেয়ে কল কেটে দিয়েছে। স্মরণ জানত এমন কিছুই হবে। আগেই জানানো উচিত ছিল। এখন এই পাগলের রাগ কীভাবে ভাঙাবে সে? কষ্ট হবে। স্মরণ পরে আবার কল করলেও খুশবু আর কথাই বলল না। খুশবু ঠিক করল। কাল বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও এখন আর যাবে না। তাকে যখন সবাই পর করে দিয়েছে তাহলে সে আর কেন ওই বাড়িতে যাবে?

চলবে