#কমলা_রঙের_রোদ [২৭]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
গতকালের বাড়ি যাবার আগ্রহ আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই দেখে সান চোখ বাঁকিয়ে বলল,
-বাড়ি যাবে না আজ?
-না।
খুশবুর সোজাসাপ্টা উত্তর শুনেও সান বলে চলল,
-হঠাৎ মন পরিবর্তনের কারণ জানতে পারি?
-পারেন না।
খুশবুর কথা বলতে ভালো লাগছে না। বিয়ের পর সবাই তাকে এভাবে পর করে দিবে জানা থাকলে বিয়েটাই করত না। সান জানে খুশবুর কী হয়েছে। খুশবুর ভাই রাতে তাকে কল দিয়েছিল। উনি নিজেই খুশবুকে নিতে আসত কিন্তু চাকরির দ্বিতীয় দিনে ছুটি নেওয়া বা অফিস মিস করা কোনভাবেই সম্ভব না বলে সানের উপর দায়িত্ব দিয়েছে যেভাবেই হোক খুশবুর রাগ ভাঙিয়ে যেন বাড়ি নিয়ে যায়। সান এখন সেই চেষ্টাই করছে।
-শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি৷ এখন তুমি বলছো যাবে না? এটার কি কোন মানে হয়?
খুশবু রাগ দেখিয়ে বলল,
-আপনার এতই যদি যেতে ইচ্ছে হয় তাহলে যান না। আপনাকে তো আমি বাধা দিইনি।
-বউ ছাড়া গেলে আপ্যায়ন কম পাবো।
-আপনি প্লিজ আমার মেজাজ গরম করবেন না তো।
-আর যদি করি?
-তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
-কী খারাপ হবে?
সান মুখে হাত চেপে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে বলল,
-জামাই পিটাবে! হায়, এসব চিন্তা কল্পনাতেও এনো না। আল্লাহ পাপ দিবে।
খুশবু নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এই লোকের সাথে কথা বললে এখন নিজের চুলই ছিঁড়তে ইচ্ছে করবে। সান মুচকি হেসে ভাবছে, এই রাগ কুমারীর সাথে জীবন কাটানো এতটাও সহজ হবে না। রাগ যেন নাকের ডগায় বসে থাকে।
🌸
খুশি গালে হাত দিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। আজও স্মরণ অফিসে যাওয়ার আগে তাকে শুনিয়ে দাদীকে পাত্রী দেখতে বলে গেছে। স্মরণ বিয়ে করবে এটার জন্য কষ্ট পাচ্ছে না সে। কিন্তু স্মরণ তাকে ভুল বুঝেছে। বিয়েতে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তটা খুশি কেন নিয়েছে তা শুধু সে-ই জানে। স্মরণ তার সিদ্ধান্তে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এখন যে ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। দাদী কখন ঘরে এসেছে খুশি লক্ষ্য করেনি৷ পরী বানু কতক্ষণ খুশির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এই মেয়ে দিনদুনিয়া ভুলে কোন ভাবনায় ডুবে আছে?
-কার কথা ভাবতাছোস?
খুশি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দাদীকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলল,
-কারো কথাই ভাবছি না।
-না ভাব। কিন্তু তোর জন্যে একটা সুখবর আছে।
নিরাসক্ত গলায় খুশি বলল,
-কী সুখবর?
-তোর ঘাড়ত্যাড়া মা আর বড় আব্বা মিল্লা তগোর দুইডার বিয়া দিব ঠিক করছে।
খুশি কতক্ষণ পলকহীন চোখে দাদীর দিকে তাকিয়ে থেকে পরমুহূর্তে বলে উঠল,
-অসম্ভব। ইহকালে কেন পরকালেও আমি তোমার নাতিকে বিয়ে করব না। তোমার নাতির আসল চেহারা আমার দেখা হয়ে গেছে।
পরী বানু হতভম্ব হয়ে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন একটা খুশির খবর দেওয়ার আগে ভেবেছিলেন খুশি হয়তো তার গলা জড়িয়ে ধরে নেচে উঠবে। কিন্তু এই মেয়ে তো উল্টো সুর ধরেছে।
-বিয়া করবি না কেন!
-বিয়ে করার শখ মিটে গেছে তাই করব না।
-তোর মারে এই কথা কইতাম?
-জানি না। মন চাইলে বলতে পারো।
🌸
পুরো বাড়ি খুঁজে অবশেষে খুশবুকে ছাদে পেলো। সানকে দেখে খুশবু কপাল কুঁচকিয়ে বলল,
-এখানেও বিরক্ত করতে চলে এসেছেন?
সান তার ফোনটা খুশবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-শ্বাশুড়ি মা তার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন।
মার কল শুনেই খুশবু খপ করে ফোনটা নিয়ে গেল। তার নতুন নাম্বার মাকে জানানো হয়নি। তাই এখনও সানের ফোনেই কল করছে।
-হ্যালো মা!
খুশবু মার সাথে কথা বলছে সান পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলা শেষে খুশবু কী বলবে এটাও সান জানে। মায়ের সাথে কথা বলে খুশবুর মুখ খুশিতে ঝলমল করতে লাগল। সানের দিকে তাকিয়ে বিনীত গলায় বলল,
-আমাকে একটু বাড়ি নিয়ে যাবেন?
-তুমি তো বলেছিলে যাবে না।
-এখন যাব।
-কিন্তু এখন তুমি যেতে চাইলেও আমার মন পাল্টে গেছে।
খুশবু কঠিন চোখে সানকে দেখছে। তার সাথে বিটলামি শুরু করেছে লোকটা!
-ঠিক আছে। আপনার যেতে হবে না। আমি আমার বাড়ির ঠিকানা জানি। আর কীভাবে যেতে হবে এটাও জানি।
🌸
খুশবু যতটা উৎসাহ নিয়ে বাবার বাড়ি এসেছে, এখানে আসার পর খুশির কথা শুনে উৎসাহে তো ভাঁটা পড়েছেই সাথে রাগে খুশির গলা চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে। এদের সমস্যা কী? সব যখন ঠিক হয়ে গেছে মা-ও মেনে নিয়েছে এখন এরা বলছে বিয়ে করবে না! ফাইজলামি পেয়েছে নাকি?
-সত্যি তুই বিয়ে করবি না!
-না।
খুশির সোজা উত্তর। খুশবু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-কেন করবি না?
-অনেক কারণ আছে।
-তার থেকে দু’একটা বল শুনি।
খুশি এবার সরাসরি খুশবুর দিকে তাকাল। সে খুশবুকে জবাবদিহি করছে দেখে চোখ ছোট ছোট করে ফেলল।
-কী হলো বল।
-এই তুই আমার সাথে এমনভাবে কথা বলছিস কেন? একদম পাকনামি করবি না৷ তুই আমার ছোট তাই ছোটদের মতই আচরণ কর। বিয়ে হয়ে গেছে বলে খুব বড়ো হয়ে গেছিস ভাবিস না।
খুশবু হাঁ করে রইল। দোষ কে করছে আর শাসন কাকে করছে। বাড়ি আসার পর থেকে খুশবু সানকে ফেলে বোনের ঘরে গিয়ে বসে আছে। ও বেচারা কতক্ষণ বড় চাচার সাথে কথা বলে এখন দাদীর ঘরে বসে আছে। দাদী অবশ্য তাকে বোর হতে দিচ্ছে না। খুশবুর সম্পর্কে অজানা সব তথ্য তাকে জানিয়ে দিচ্ছে।
-একটা পাগলরে বিয়া করছো রে ভাই৷ পাগল না হইলে কি এহনও তোমার খোঁজ নিতে আসে না?
-আপনার সাথে তো আমার ভালোই সময় কাটছে দাদী। আপনার নাতনির প্রয়োজন নেই।
ছেলেটার কথাবার্তা আচরণে পরী বানু মনে মনে সন্তুষ্ট হলেন। ওই পাগলকে সামলানোর জন্য এমন একটা মানুষই দরকার ছিল। বিয়েটা কীরকম পরিস্থিতিতে হয়েছিল সেজন্য পরী বানু একটু চিন্তায় ছিল।
-তুমি তো আমার নাতিরে মোহাব্বত করো। ওই পাগলও কি তোমারে মোহাব্বত করে ভাই?
সান দাদীর চিন্তার কারণ বুঝতে পারছে। সে দাদীর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে খুশবু হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেই বলতে লাগল,
-তোমার নাতনি পাগল হয়ে গেছে দাদী। ওই পাগলের সাথে আমাকে আর কথা বলতে বোলো না। মাথায় রক্ত উঠিয়ে দিয়েছে।
সানের সামনে এভাবে কথা বলায় পরী বানু ইশারা ইঙ্গিতে খুশবুকে থামতে বললেও কাজ হলো না। খুশবু বরং আরও বেশি বেশি করে খুশির বদনাম করছে। পরী বানু হতাশ চোখে সানের দিকে তাকাল। ছেলেটা কী মনে করবে? খুশবু গজগজ করতে করতে দাদীর কাছে তার বড়ো নাতনির বিচার দিচ্ছে।
-তোমার নাতনির দাম বেড়েছে। আগেই আমি ওইটাকে দেখতে পারতাম না৷ এখন তো আরও পাচ্ছি না। স্মরণ ভাইয়ের মধ্যে কিসের কমতি আছে? বিয়ে কেন করবে না?
খুশবু কিছুতেই রাগ কমাতে পারছে না। দাদীর বোঝ দেওয়ায়ও কাজ হচ্ছে না। সান কতক্ষণ চুপচাপ দেখছিল। এবার খুশবুর হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে দিল। খুশবুর কাঁধের উপর হাত রেখে আরেকটু কাছে টেনে এনে বলল,
-চুপ। একদম চুপ করে যাও। বাবারে বাবা, কত্ত রাগ! এত বেশি মাথা গরম করলে মাথার সব চুল পেকে যাবে৷ হার্টের সমস্যা হবে। আমি চাই না আমার বউয়ের হার্টের সমস্যা হোক।
সানের এমন কাজে খুশবু পুরাই হতভম্ব। এর আগে সান কখনও এমন আচরণ করেনি। খুশবু জমে বসে আছে। পরী বানু মিটমিট করে হাসছে।
-দাদী আপনার নাতনির যে রাগ! ভবিষ্যতে না আমাকে আবার টাকলা বউ নিয়ে সংসার করতে হয়।
পরী বানু হাসতে হাসতে বললেন,
-বেশি রাগ দেখাইলে মাথাত ঠান্ডা পানি ঢাইলা দিবা।
খুশবু বুঝতে পারল দাদীকে দেখানোর জন্য সাব এসব করছে। তাই সে কোন প্রতিবাদ করল না।
সন্ধ্যায় স্মরণ বাড়ি এসে দেখল খুশবু এসেছে। মনে মনে খুশবু বরের প্রশংসা করল। যাক তাকে ছাড়া অন্য একজনও এই মেয়ের রাগ ভাঙাতে পারে। তবে স্মরণ খুশবুর সাথে কথা বলতে গেলে খুশবু মুখের উপর বলে দিল,
-তুমি আমার সাথে কথা বলবে না স্মরণ ভাই। আমি তোমার কেউ না। আর আমিও তোমাকে চিনি না।
-আমাকে চিনিস না তাহলে ভাই কেন ডাকলি?
খুশবু কটমট করে তাকিয়ে বলল,
-ঠিক আছে। তুমি আমার ভাইও না।
স্মরণ আপাতত খুশবুকে ছেড়ে দিল। দু’দিন পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। রাতে সবাই একসাথে খেতে বসল। টেবিলে চেয়ার কম পড়লে খুশবু গিয়ে ঘর থেকে বাড়তি দুইটা চেয়ার এনে দিল। কতগুলো দিন পর পরিবারের সাথে খেতে বসেছে! খুশবু স্মরণের সাথে রাগ করেছে। ওদিকে আবার খুশি স্মরণ কেউ কারো সাথে কথা বলে না। টুকটাক যা কথা হচ্ছে তা হাসান আর সানের মধ্যেই। সান কী করে, ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কী এসবই জানতে চাচ্ছেন। টেবিলের নিচ দিয়ে ভুলবশত সানের পা খুশির পায়ের সাথে লেগে গিয়েছে। খুশি ধরে নিয়েছে এটা হয়তো স্মরণের কাজ৷ মনের ঝাল মেটাতে খুশি দ্বিগুণ জোরে সানের পায়ে পাড়া দিলে ব্যথায় বেচারা শব্দ করে আহ বলে উঠল। পাড়া তো দিয়েছে স্মরণের পায়ে চিৎকার তাহলে খুশবুর বর করল কেন? খুশি ঝট করে স্মরণের মুখের তাকাল। স্মরণকে নির্বিকার দেখে নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল। মানছুরা, পরী বানু ততক্ষণে সানকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
-কী হয়েছে বাবা? তরকারিতে কি ঝাল বেশি হয়ে গেছে?
খুশবু নিজেও সানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খেতে খেতে চেঁচিয়ে উঠল কেন? সান শাশুড়ী মাকে কী জবাব দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই বলল,
-পায়ে হয়তো কিছু কেটেছে।
পায়ে কিছু কেটে শুনে পরী বানু সাপে কেটেছে মনে করে আরও হৈচৈ লাগিয়ে দিল। টেবিলের নিচে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। খুশি লজ্জায় সানের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। খুশবুও একটু চিন্তিত হলো। কলপাড়ের পেছনে যে জঙ্গল সাপ আসতেই পারে। ভীত মুখে খুশবু জিজ্ঞেস করল,
-সত্যিই সাপে কেটেছে?
সবাই এখন সাপ খুঁজতে ব্যস্ত হলেও স্মরণের চোখ খুশির দিকে। স্মরণ ঠিকই বুঝে ফেলেছে। এটা কোন সাপের কাজ না। অঘটন যা ঘটানোর এই মানুষরূপী নাগিনই ঘটিয়েছে। তা নাহলে ওভাবে মুখ লুকিয়ে রাখত না।
চলবে
#কমলা_রঙের_রোদ [২৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
সানের সাথে স্মরণের তেমন একটা আলাপ হয়নি। কখনও তেমন পরিবেশই তৈরি হয়নি। আজ খাওয়ার পর দু’জন একসাথে হাঁটতে বেরিয়েছে। প্রথম দু’জনই ইতস্তত করছিল। স্মরণ খুশবুকে নিয়ে কথা শুরু করলে সানও আস্তে আস্তে ফ্রী হলো। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন দোকানের কাছাকাছি চলে এসেছে। স্মরণকে দেখে মাজু দোকানদার গলা উঁচিয়ে ডাকল।
-স্মরণ ভাই। কই যাও?
স্মরণ সানকে নিয়ে দোকানের ছাউনির তলে গিয়ে দাঁড়াল। মাজু সানকে দেখিয়ে বলল,
-ইনি কে?
স্মরণ চকলেটের বয়াম খুলে চকলেট গুনে নিতে নিতে বলল,
-তোমাদের এলাকার জামাই।
তার মানে এটা খুশবুর বর! মাজু উচ্ছসিত হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সানের সাথে হাত মেলাল। আবেগে গদগদ করে বলল,
-দুঃখিত ভাইজান৷ আপনাকে চিনতে পারি নাই। খুশবু আমার আপন বোনের মতো। আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছা ছিল। আপনি আমার দোকানে আসছেন আমি ধন্য হয়ে গেলাম।
স্মরণ আড়চোখে সানকে দেখছে। সান লজ্জা না পেলেও একটু অপ্রস্তুত হয়েছে। অচেনা একটা লোক কতটা আন্তরিকতার সাথে তাকে আপন করে নিয়েছে।
-বেশি প্রশংসা করে ফেললে কিন্তু জামাই লজ্জা যাবে।
মাজু হেসে নিজ জায়গায় ফিরে গেল। স্মরণ সানকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করল,
-চা চলবে?
সান সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল। স্মরণ নিজেও সামনের আরেকটা বেঞ্চিতে বসে মাজুর প্রশংসায় বলল,
-মাজুর হাতে জাদু আছে। একবার যে ওর হাতে বানানো চা খাবে সে-ই মাজুর ভক্ত হয়ে যাবে। আমার মনে হয় মাজুর মতো ফাইন চা বাংলাদেশে কেউ বানাতে পারে না।
নিজের প্রশংসা শুনে মাজু লজ্জিত হাসছে। হাত চালাতে চালাতে বলল,
-স্মরণ ভাই খামোখাই আমারে লজ্জা দিতে এসব কয়।
মাজু দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনের হাতে দু’কাপ চা দিয়ে গেল। স্মরণ মাজুর রেগুলার কাস্টমার হলেও সান খোলা পরিবেশে বানানো কোন খাবার খেয়েই অভ্যস্ত নয়। চা কফি খেতেও সে দামী কোন রেস্টুরেন্টেই যায়। স্মরণ অনেক আগেই ধোঁয়া উঠা আগুন গরম চায়েরই ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছে। সান প্রথমে ইতস্তত করে স্মরণকে অমন তৃপ্তি করে চা খেতে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলো। কাপটাও পরিষ্কারই মনে হচ্ছে। চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেও সান দ্বিধায় ছিল। কিন্তু এক চুমুক খেয়েই সব দ্বিধা অস্বস্তি কেটে গেল। স্মরণ মিথ্যা প্রশংসা করেনি। এরকম ভালো চা সান সত্যিই কোথাও খায়নি। দোকানটা ছোট হতে পারে। তবে দোকানীর হাতের জাদুতে চায়ের স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। স্মরণ মাঝে মাঝে সানকে দেখছে। খুশবুকে ভালো রাখতে গেলে সানকে আগে জানতে হবে খুশবু কেমন জীবন কাটিয়ে গেছে। সান হয়তো খুশবু খুব দামি গিফট এনে দিতে পারবে। কিন্তু দেখা যাবে মেয়েটার খুশি খুব সামান্য জিনিসে। দামি কোন গিফট ওকে খুশি করতে পারছে না। চা শেষ করে স্মরণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-আসি মাজু।
সানও দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে মানিব্যাগ বের করছিল। স্মরণ বুঝতে পেরে বলল,
-প্রয়োজন নেই।
দু’জন চা খেলো কিন্তু দাম দিল না এই ব্যাপারটা সান সহজভাবে নিতে পারল না। সানের মুখে অস্বস্তির ছাপ দেখে স্মরণ বলল,
-আচ্ছা দিন।
সান কার্ড ছাড়া ক্যাশ তেমন রাখে না। এক হাজার টাকার নোট ছাড়া ছোট আর কোন নোটই পেলো না। মাজুকে চায়ের দাম দিতে গেলে মাজু হৈচৈ লাগিয়ে দিল।
-আপনার থেকে দাম নিমু! আপনি আমাদের খুশির বর। আপনারে এক কাপ চা-ও খাওয়াতে পারমু না! আল্লাহ যদি আমারে সামর্থ্য দিত আমি খুশবুর জন্য আরও অনেক কিছু করতাম।
স্মরণের কথা না শুনে সান মনে মনে পস্তাচ্ছে। লোকটাকে টাকা দেওয়া ঠিক হয়নি। ভালোবাসা, সম্মানের দাম কখনও টাকা দিয়ে তুলনা করা যায় না। মাজুর চোখে প্রায় পানি এসে পড়েছে। সান বেচারা অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
-আজ আসি মাজু। খুশবু বলছিল কাল নাকি তোমাদের বাড়ি যাবে।
এই কথা শুনে মাজু মুখ মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল। স্মরণের সাথে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সান বলল,
-এ পাড়ায় অনেকেই খুশবুকে চিনে মনে হচ্ছে।
-শুধু চিনে না, এরা খুশবুর ভক্ত।
সান মুচকি হাসল। স্মরণ খুশবুর সম্পর্কে সানকে হালকা একটু ধারণা দিয়ে বলল,
-খুশবু মানুষের সাথে খুব অল্পতেই মিশে যেতে পারে। অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়। খুশবু যেমন সবাইকে আপন করে মনে তেমন এলাকার মানুষ গুলোকেও ওর জন্য সব করতে পারে। এই পাগলের চাওয়া পাওয়া খুব অল্প।
অনেকক্ষণ হয়েছে ওরা বেরিয়েছিল। ফিরতে এত দেরি হওয়ায় মানছুরা চিন্তিত হচ্ছিল। দু’জন ফিরে এসেছে দেখে পরী বানু বললেন,
-জামাইরে নিয়া কই গেছিলি বান্দর? জামাই কি তোর মতো, সারা রাইত ডাকাতি করব। দিনে ঘুমাইব।
-আমার ঘুমের উপর তোমাদের নজর লেগেছে। তাই তো শান্তির ঘুম হারাম করে সকাল সকাল অফিসে দৌড়াতে হয়।
পরী বানু স্মরণের সাথে কথা না বাড়িয়ে সানকে বলল,
-তুমি কেন গেছিলা ভাই? রাইত কি কম হইছে?
সান দাদীর সাথে কথা বলার সময় স্মরণ খুশবুকে ডাকল। খুশবু স্মরণের সাথে রাগ করায় এক দু’বার ডাকায় আসেনি। কয়েকবার ডাকার পর খুশবু এসে খেঁকিয়ে উঠে বলল,
-ডাকছো কেন?
স্মরণ পকেট থেকে বিশটা চকলেট বের করে খুশবুকে হাত পাততে বলল,
-নে ধর।
খুশবু যতই রাগ করে থাকুক চকলেটের লোভ সামলাতে পারল না। খুশি চেপে রেখে চকলেট হাতে নিয়ে শুকনো মুখে বলল,
-চকলেট দিয়ে রাগ ভাঙিয়ে ফেলবে ভেবেছ! এত সোজা না।
স্মরণ খুশবুর মাথায় হালকা আঘাত করে বলল,
-তোর রাগ ভাঙাতে আমার ঠেকা পড়েনি।
সান পাশ থেকে পুরো ঘটনাটাই দেখেছে। স্মরণ কীভাবে খুশবুর খেয়াল রাখে। সানও প্রতিজ্ঞা করল, যেভাবেই হোক শ্বশুরবাড়ি থাকতে থাকতেই বউয়ের মন জয় করবেই।
খুশিকে আজ মা দাদীর সাথে থাকতে হচ্ছে। দাদীর নাকডাকার শব্দে কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না। এত জীবন এক বিছানায় একা শুয়েছে। কারো সাথে শুলে অস্বস্তি লাগে। তার উপর আবার দাদী একটু পরপর তার দিকে সরে আসছে। ছোট একটা বিছানা। তিনজন মানুষ চাপাচাপি করে শুয়ে আছে। খুশি উঠে বসে পড়ল। বাইরে থেকে ঘুরবে আসবে কি না ভাববে ভাবতেই মা-ও জেগে গেল। খুশিকে বসে থাকতে দেখেও কিছু না বলে নিজে বিছানা থেকে নেমে গেল। মা মাটিতে পাটি বিছচ্ছে দেখে খুশি বলল,
-খাটেই জায়গা হবে মা। মাটিতে শুলে তোমার ঠান্ডা লাগবে।
মানছুরা কোন জবাব না দিয়ে পাটির উপর একটা চাদর বিছিয়ে বিছানার উপর থেকে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ল।
এদিকে সানের কিছুতেই ঘুম আসছে না। ঘুম আসবেই বা কীভাবে? খুশবু যে তার থেকে দূরে শুয়ে আছে। এঘরে ছোট ছোট দুইটা চৌকি। একটাতে একজন মানুষই শুতে পারবে। ঘরে ঢুকেই সানের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সান বলেছিল,
-খাট দুইটা এত দূরে কেন? একটু কাছাকাছি নিয়ে এলে হয় না?
খুশবু কঠিন মুখে জবাব দিয়েছে,
-কোন প্রয়োজন নেই।
বাড়িতে তো ওরা এক বিছানাতেই থাকত। খুশবু অবশ্য মাঝে বালিশের বেড়া দিয়ে রাখত। মাঝরাতে আবার খুশবুই ওই বেড়া টপকে সানের দিকে চলে আসত। শ্বশুরবাড়ি এসে তাহলে লাভের বদলে ক্ষতি হয়েছে।
🌸
বাড়িতে আজ ছোটখাটো একটা মিটিং বসেছে। মিটিংয়ে আলোচনার প্রধান টপিক স্মরণ আর খুশির বিয়ে। হাসান মানছুরা পরী বানু সহ বাকিরাও উপস্থিত। হাসান খুশির দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলল,
-তুই কী বলিস মা? আমি তোর মতামত জানতে চাই। তুই কি বিয়েতে রাজি আছিস? রাজি না থাকলেও বলবি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
খুশি কোন জবাব দেওয়ার আগেই খুশবু বলে উঠল,
-খুশির আবার মতামত কী বড়ো আব্বু? তোমরা যা ঠিক করবে তা-ই হবে।
হাসান খুশবুর কথা শুনে হাসলেন। বললেন,
-যার বিয়ে তার থেকে তো মতামত নিতেই হবে না।
খুশবু উত্তেজনায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। সান ওর হাত ধরে টেনে বসাল। খুশবু বিড়বিড় করে বলল,
-আমার থেকে তো কেউ মতামত নেয়নি।
কথাটা শুনতে পেরে সানও যথেষ্ট নিচু গলায় বলল,
-আমাকে বিয়ে করা কিন্তু তোমার নিজের সিদ্ধান্ত ছিল।
খুশবু সানের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। ভেংচি কেটে বলল,
-হু এই সিদ্ধান্ত নিতেই আপনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন।
স্মরণ, খুশি এতদিন দাদীর সামনেই শুধু বড় গলা করে বলতে পেরেছে বিয়ে করবে না। এই মুহূর্তে হাসান ও মানছুরার সামনে কেউ একটা টুঁশব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। পরী বানু ওদের খোঁচা দিয়ে বললেন,
-মুখে কুলুপ দিছস কেন? আমারে কী কইতাছিলি অহন ক।
হাসান আগ্রহী দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকাল। বলল,
-তোরা কিছু বলতে চাস? বলার থাকলে বলতে পারিস।
স্মরণ উঠে দাঁড়াল। খুশবু ভয় পাচ্ছে স্মরণ ভাই কি না বলে দিবে! টেনশনে খুশবুকে সমানে পা নাচাতে দেখে সান নিঃশব্দে হাসছে। বিয়েটা যারা করবে তাদের থেকে বেশি টেনশন মনে হয় খুশবুই। সান যতটুকু বুঝতে পেরেছে স্মরণ খুশি কেউই না করবে না। তবে একটু নাটক করছে কারণ ওরা দু’জন চায় পরিবার জোর করে তাদের বিয়ে দিক। স্মরণ কী বলবে শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছে।
-তোমরা যা ভালো করে করো৷ আমার কোন আপত্তি নেই।
এই কথাটা বলেই স্মরণ সবার মাঝ থেকে চলে গেল। খুশি মুখ বাঁকাল। গাধা! ভাবসাব এমন ধরেছে যেন তাকে বিয়ে করে দয়া করছে। হাসান এবার খুশির সিদ্ধান্ত জানতে চাইল। খুশিও এই সুরেই বলল,
-তোমরা যা ভালো মনে করো বড়ো আব্বু।
এদের নাটক দেখে খুশবু হতভম্ব। প্রেমের বিয়েকে এমন একটা রুপ দিয়েছে মনে হবে যেন পরিবার জোর করে ওদের বিয়ে দিচ্ছে। অথচ তার জোর করে বিয়েকে শয়তান লোকটা এমন ভাবে দেখিয়েছে যেন তাদের প্রেমের বিয়ে।
🌸
স্মরণ খুশি বিয়েতে রাজি হলেও এখনও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না৷ এটা দেখে খুশবু নাক উঁচিয়ে বলল,
-কী নাটক! কী নাটক! বাংলা সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রী তোমাদের সামনে কিছুই না।
প্রথমে ঠিক হয়েছিল বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে৷ পরে অবশ্য ঠিক হলো, না ছোটখাটো অনুষ্ঠান করা হবে যেহেতু এটাই বাড়ির শেষ বিয়ে। এর পর এবাড়িতে আর কবে বিয়ে হবে কেউ জানে না। পাড়ার সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। মা দাদীর সাথে খুশবুও গিয়েছিল দাওয়াত দিতে। মাজুদের বাড়িতে দাওয়াত দিতে গিয়ে খুশবু নতুন একটা খবর পেয়ে এলো৷ খুশবুকে দেখে মাজু, তার বউ মাথায় তুলে নাচতে বাকি রাখল শুধু। এরা তাকে আগেই পছন্দ করত। কিন্তু আজ এতবেশী খাতির করার কারণ জানতে পেরে নিজেই অবাক হলো।
-তোর বর স্মরণ ভাইয়ের সাথে আমার দোকানে আসছিল। তুই-ই বল, তোর বরের থেকে কি আমি চায়ের দাম নিতে পারমু? উনি কী করছে জানোস? আমার দোকান পাকা করার জন্য দুই লাখ টাকা দিছে! টাকাটা যে উনি দিছে আমি তো জানতেই পারতাম না। যার হাতে টাকা পাঠাইছে তারে অনেক জোড়াজুড়ির করার পর তোর বরের নাম কইল। তোর বরের মনটা অনেক বড় রে খুশবু।
চলবে