অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-০৩

0
1

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৩

কষ্টে যখন পুরো শরীর মাখামাখি, তখন অন্ধকার রাতটা খুব ভালো লাগে। তখন মনে হয় এই অন্ধকারের মতো সঙ্গী আর দু’টো নেই। একমাত্র অন্ধকার জানে প্রতিটা মানুষের কষ্টটা কতো গভীর। দেখবেন দিনের আলোয় আমরা নিজেকে সামলে নিলেও, রাতের আঁধারের কাছে হেরে যাই। তখন হাজারো স্মৃতি রোমন্থন করে জেগে ওঠে মন গহীনে। বেঈমান চোখ গুলো কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাই হয়তো সবাই বলে, দিনের আলোয় হাসতে জানলেও রাতের আঁধারের কাছে সবাই অসহায়। মাথার বালিশটা চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটা গুনে রাখে। ওকে যদি কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো ও বিরক্ত হয়ে বলতো! প্লিজ আর কাঁদিস না আমার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু দুঃখজনক এটা কল্পনা আমাদের। জোনাকি নিজের হাত খামচে ধরে কান্না আঁটকে রাখছে। মানুষটা নিজ থেকে কখনো তাঁর সাথে কথা বলেনি! যখনই সবাই ফোনে কথা বলতো, তখন সে ফোনটা কানে তুলে নিয়ে অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলতো। কেমন আছেন, কি করছেন, খেয়েছেন কিনা ব্যাস এতোটুকু। কিন্তু মানুষটা বুঝতেই পারতো না সে তাঁর বিবাহিত স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। এই লুকিয়ে কথা বলার বড় এক কারণ! ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী তিনমাস তেরো দিন স্বামী স্ত্রীর যোগাযোগ না থাকলে, যে মোহাব্বত আল্লাহর নেয়ামত থাকে, সেটা কমে যায়। ডির্ভোস এতোটা সহজ নয় যে চাইলেই হয়ে যায়(এই বিষয়টা আমি আমাদের এক দ্বীনদার ফুফির থেকে জেনে বললাম যদি কোন ভুল হয় ক্ষমা করবেন)
মানুষটাকে নিজের অজান্তেই জোনাকি নিজের মনে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। এই মানুষটা হালাল, তাই চাইলেই সেই জায়গা থেকে তাঁকে সরানো সম্ভব নয়। চোখের কোণ বেয়ে আরো একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই তা কেউ পরম যত্নে মুছে দিলো। জোনাকি অবাক হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো, হলদে আলোয় এক চিরচেনা মুখ। এক হাতে খাবারের প্লেট, অন্য হাতে পরম আবেশে তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে। কিছুটা অবাক হলো মেঘকে দেখে। একটু আগের মানুষটার সাথে এই মানুষটার একটু তফাৎ আছে। তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে বসলো জোনিকি। দৌড়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালাইতে মুখটা স্পষ্ট হলো। সত্যি সত্যি মেঘ এসেছে। কিন্তু কেন? আর হাতেই বা খাবারের প্লেট নিয়ে এখানে কেন এসেছে? সে যে খায়নি কই একবারও তো মুখ ফস্কে বলেনি সে ?

_ জোনাকি সত্যি আমি সব ঠিক করতেই ফিরে এসেছি। আমি অন্য সবার মতো নিজের ভেতরে কোন কিছু আঁটকে রাখতে পারি না। মনে এক রেখে মুখে আরেক কথা বলতে এটাও পারি না। কিন্তু যেটা করতে চাই মন থেকেই করি। হ্যা এটা ঠিক আমার উচিত হয়নি সেদিন তোমাকে ফেলে চলে যাওয়া। কিন্তু আমি তবুও গিয়েছিলাম। কিন্তু জানো আমার কেন জানি দিন শেষে একবার হলেও তোমার কথা মনে পড়তো। তুমি বাড়ির সবার মতো আমার সাথে কথা বলতে এটা আমি জানতাম। কখনো নিঝুম সেজে, কখনো বড় ভাবি বা কখনো শাপলা। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষের কন্ঠ আমার চেনা শুধুমাত্র তোমার কন্ঠটাই আমার অচেনা ছিলো। তুমি প্রথম প্রথম যখন কথা বলতে বুঝতে পারিনি, কিন্তু তুমি নিজেই আমার কাছে ধরা দিলে। যখন তুমি তিনটা প্রশ্ন ছাড়া আর কোন কথা বলতে না, বা খুঁজে পেতে না কথা বলার মতো। তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম মানুষটা অন্য কেউ না, যাঁর দায়িত্ব এড়াতে আমি এতো দূরে চলে এসেছি সেই বিবাহিত স্ত্রী। আস্তে আস্তে তোমার প্রতি আমার দূর্বলতা তৈরি হয়। সেটা তৈরি হতেও সময় লেগেছে তিন বছর। তাঁর পরের দুই বছর নিজের কাজে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আর তোমার খোঁজ নিতে পারিনি। কিন্তু যেদিন তোমার একটি ভিডিয়ো দেখলাম যেখানে তুমি বাচ্চাদের পড়াচ্ছো, বিশ্বাস করো সেদিন আমার প্রথম মনে হয়েছে আমি জীবনে যদি বড় কোন অন্যায় করে থাকি! সেটা তোমাকে ফেলে এসে করেছি। যেদিন থেকে আমি ভেতরে ভেতরে অনুশোচনায় পুড়তে রইলাম, সেদিন থেকেই আমার কাছের বন্ধু গুলো আমার সাথে বেঈমানী করতে শুরু করলো। একটা সময় ওদের বেঈমানির কাছে হেরে গিয়ে নিজের তিল তিল করে জমানো সব কিছু হারিয়ে ফেললাম। ভেবেছিলাম শূন্য হাতে বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু তিন গুণ নিয়ে ফিরবো। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাকে ঠিক তোমার কাছে ঠিক সেভাবেই দাঁড় করিয়েছে, যেভাবে একদিন তোমায় ফেলে চলে গিয়েছিলাম। হুম শূন্য হাতে তোমার থেকে পালাতে চেয়েছি, ঠিক সেভাবেই শূন্য হাতে তোমার দুয়ারে এসেছি। এবার ইচ্ছে তোমার আমাকে ঘরে তুলবে নাকি দুয়ার থেকেই ফিরিয়ে দেবে। জোনাকি এটা ঠিক যে তোমার মন ছুঁতে পারেনি, তাঁর কোন অধিকার নেই তোমার শরীর ছুঁয়ে দেওয়ার। কিন্তু জোনাকি ভেবে দেখো ভালোবেসে যদি কেউ তোমায় জড়িয়ে ধরে তাতে কিন্তু তোমার শরীরটা ছুঁয়ে দেওয়া হবে। কারো ইচ্ছে হলো ভালোবেসে তোমায় চুড়ি পড়িয়ে দিতে, তাহলেও কিন্তু তোমার হাতটা তাঁর ছুঁয়ে দিতে হবে। ভালোবাসলে মনের সাথে সাথে শরীরটাও চলে আসে জোনাকি। আমার কথা গুলো ভেবে দেখো। আমার উচিত হয়নি তোমাকে কথাটা ওভাবে বলার। জোনাকি আমি পুরুষ, আমাদের কন্ট্রোল ক্ষমতা তোমাদের থেকে অনেক কম, তাই ভুল বেশি আমাদের হয়। আমি তোমাকে আমার করে পেতে চেয়েছি, হ্যা এটা ঠিক এটা আমি তোমার শরীরকেই বুঝিয়েছি, কিন্তু যদি তুমি পজিটিভ না-ও, তাহলে এটাও বোঝা যায় তোমার মন শরীর দু’টোই আমি আমার করতে তোমায় আমি চেয়েছি। এখন বুঝে নেওয়া তোমার দায়িত্ব। আমি কিন্তু একবারও বলিনি, তোমার শরীর আমার প্রয়োজন। আমি স্বীকার করছি, আমার ভুল হয়েছে কথাটা আজকে এবং এভাবে বলা উচিত হয়নি। অন্যের রাগ খাবারে দেখাতে নেই। এটা তো তুমিই বলো। তাহলে আজ কেন আমার রাগ গুলো খাবারে দেখাচ্ছো। কাল সকাল থেকে সাত বছরের যতো কষ্ট যতো অভিমান সব আমাকে দিয়ে না-হয় নিজেকে হাল্কা করো। আমি গেলাম। খেয়ে নিও।

—————-

সকালের কড়া রোদ গায়ে না লাগলেও চোখে পড়ে ভিষণ করে। পাখিদের নীড় ছেড়ে যখন তাঁরা নিজেদের কর্মস্থলে যায়, তখন বেশ লাগে। এই পৃথিবীতে সবাই কর্মজীবি। সবাই সবার দিক থেকে ব্যস্ত। এই কর্ম জীবনের উৎস হচ্ছে জীবনে ভালো করে বেঁচে থাকা। কোমরে আঁচল গুঁজে বাড়ির প্রতিটা বউ কাজ করছে। কেউ নাস্তা তৈরি করছে, কেউ তা পরিবেশন করছে, কেউ সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছে। সকাল সাতটা থেকে আয়োজন শুরু হয় নয়টা পর্যন্ত সেই আয়োজন চলতে থাকে। সারে নয়টার মাঝেই পুরো বাড়ি ফাঁকা। এই দৃশ্য সব থেকে বেশি শহরের দিকে দেখা যায়। কমবেশি সবাই নাস্তার টেবিলে উপস্থিত আছে, শুধু মেঘ এবং তাঁর বড় ভাই বাকি। মেঘ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি, আর পলাশ ওরফে মেঘের বড় ভাই, তিনি কিছু কাজের জন্য সিলেট গেছে। সবাই ব্যস্ততা নিয়ে নাস্তা করছে, শুধু মনি এবং মনোয়ারা বেগম ছাড়া। কারণ তাঁরা দু’জন ছাড়া সবাই চাকরি করে। শাপলা একজন ডাক্তার। সে বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করতো, তাই এই বাড়ির কেউ বিয়ের পর চাকরি ছাড়ার কথা বলেনি। আর জোনাকির জীবনে যে ঝড় বয়ে গেছে, সেটা সামলে ওঠার জন্যই জোনাকির এই ব্যস্ত জীবন বেছে নেওয়া। নাস্তা শেষ করে আলতাফ হোসেন সবার উদ্দেশ্যে বললো–

_ মেঘকে কেউ টাকা দিবে না। ওকে ওর জীবনকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সবাই সহযোগিতা করো। ছোটবেলা থেকে কোন অপূর্ণতা ওকে ছুঁতে পারেনি, তাই আজ ওর এই অর্ধপতন। এখন থেকে ওকে বুঝতে হবে জীবন কতটা কঠিন। হাতে গড়া জীবনকে ও যেমন নষ্ট করেছে, সেই জীবন গড়তে কতটা কষ্ট এবং পরিশ্রম করতে হয় সেটা ওকে বুঝতে হবে । ওকে বুঝতে হবে যতটা সহজ সব কিছু দেখা যায়, আসলে ওতটাও সহজ নয় জীবন।

ছোট বাবা-র কথা শুনে রূপ বললো।

_ এতটা শাস্তি দেওয়া ঠিক হবে?

_ আমি চাই ও নিজের সাথে সাথে অন্য সবার দায়িত্ব নেওয়া শিখুক। যে দায়িত্ব নিতে ও ভয় পেয়েছে, সেই দায়িত্ব ওকে নিখুঁত ভাবে পালন করতে হবে, তুমি কি বলো জোনাকি।

_ আপনি যা ভালো বোঝেন।

_ তোমার থেকে এটাই আশা করেছি। তোমার মা কাল ফোন করেছিলো রাতে। তাঁকে সব খুলে বলায় তিনি তোমায় আর মেঘকে দেখতে চেয়েছে। তাঁর একটা ভুলের শাস্তি তুমি সাত বছর তাঁর সাথে দেখা না করে দিলে। এবার অন্তত তাঁকে ক্ষমা করো। তিনি খুব অসুস্থ, স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে, তুমি মেঘ যা-ও তাঁর সাথে দেখা করে আসো! আর দাওয়াত দিয়ে আসো আলিফের বিয়ের। পরিবারের প্রতিটা সদস্য যখন এক হয়েছি, এবার আলিফের বিয়ে দিতে চাই। আর নিঝুমকে বলো ও যেন আসে বিয়েতে। আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

আলতাফ হোসেনের মুখে নিঝুমের কথা শুনে, জোনাকি বিষম খেলো। মনি ওকে পানি এগিয়ে দিতেই তা ঢকঢক করে খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে রইলো। বাবা কি করে জানলো নিঝুম তাঁর সাথে কথা বলে। আল্লাহ উনি কি সব জানেন নাকি।

_ মানে বাবা বলছিলাম যে নিঝুম–

_ আমার সামনে কথা ঘুরানোর কোন দরকার নেই। ছেলেমেয়েরা যতোই নিজেদের লুকাতে চাক তাঁরা বাবামায়ের কাছে ধরা পরবেই। তাই তুমি যে নিঝুমের সাথে কথা বলো, এটা গোপন রাখার কোন দরকার নেই।

কথা গুলো বলেই আলতাফ হোসেন খাবার টেবিল ছেড়ে চলে গেলেন। জোনাকি মাথা নিচু করে বসে ছিলো। তখন মনোয়ারা বেগম বললেন।

_ কিরে তুই নিঝুমের সাথে কথা বলিস, আমাকে তো একবারও বললি না।

_ তোমাকে বলতে চেয়ে বলা হয়নি, বাবা-র ভয়ে। কিন্তু দেখো সেটাই হয়ে গেলো।

_ মেয়েটাকে কতদিন হলো দেখি না। বাবা-র সাথে জেদ করে আমাকেও শাস্তি দিলো।

_ বাদ দিন, বাবা যে সব মেনে নিয়েছে এটাই অনেক।

_ হ্যারে ওই ছেলেটা দেখতে কেমন কি করে? এতোদিন জানতে চাইলেও ভয়ে জিজ্ঞেস করিনি। শুনেছি ছেলেটা নাকি অনেক বড় মনের মানুষ। নিজেই একটা এতিমখানা চালায়।

_ হুম বড় মা খুব ভালো মনের মানুষ। মাঝে মাঝেই আমাদের স্কুলে আসে, তাঁর ভর্তি করে দেওয়া বাচ্চাদের খবর নিতে, সাথে আমার সাথে দেখা করে, কথা বলে। আমিও বলি। একাকিত্ব জীবনে সবার সাথে গল্প করে সময় কাটাই। আর কি করবো।

কথাটা জোনাকি মন খারাপ করে বললো। তখন মনি বললো–

_ জানি সব কিছু এতো সহজে ঠিক করে নেওয়া সম্ভব না। তবুও বলি ভাই ঠিক করে না-ও। যতোই হোক স্বামী তো? আর আমরা বাঙালি মেয়েরা তো সারাজীবন স্বামীদের ক্ষমা করেই গেলাম। কথাটা বলে সবার অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মনি।

_ দেখি সময় কি বলে! সময় না-হয় বলুক কি করবো?

কথা শেষ করেই জোনাকি বেরিয়ে পড়লো স্কুলে যাওয়ার জন্য। ভুল করে পস্তানোর থেকে ভুল না করাই ভালো। তবুও আমরা ভুল করে ফেলি। জোনাকির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোই কেন ভুল করে। সবাই ভুল করে একদিন ক্ষমা চায়! আর জোনাকিকে ক্ষমা করতে হয়। কেন, কেন তাঁর সাথেই এমন হয়। ছোট্ট ভুল বাবা করলো, তারপর মা, শেষে এসে স্বামী। জীবনের মূল্যবান তিনজন মানুষই ভুল করলো। আর সবাই তাঁর সাথেই করলো৷ কেন সে কি করেছে, যে সবার ভুলের কষ্ট তাঁকেই পেতে হয়। এরকম হাজারো চিন্তা মাথায় নিয়ে হাঁটতে রইলো জোনাকি। হঠাৎ একটি মুদি দোকান জোনাকির চোখ পড়লো। সেখানে তিনজন মহিলা কোন কিছু কিনছে হয়তো। উনাদের দেখে জোনাকি নিজের পায়ের জোর বারিয়ে দিলো। কিন্তু কথায় আছে, যাকে এড়াতে চাইবে সেই তোমার সামনে এসে হাজির হবে। ঠিক তেমনটাই হলো এই মুহূর্তে। তিনজনে মাঝে একজনের চোখ পড়লো জোনাকির দিকে। তাঁর চোখ পড়তেই অন্য সবাইকে হাতের খোঁচা দিয়ে জোনাকির দিকে ইশারা করলো। সাথে সাথেই বাকি দু’জনের চোখটা চকচক করে উঠলো। যেন খুব মূল্যবান কিছু তাঁরা পেয়ে গেছে। দোকান ছেড়ে এগিয়ে এলো জোনাকির দিকে।

_কি গো জোনাকি, এতো তাড়াহুড়ো করে কই যা-ও।

_স্কুলে কাকিমা, দেরি হচ্ছে তো তাই।

_স্কুল তো সেই ন’টায় শুরু মাত্র তো সারে আটটা বাজে। কথাটা বলে উঠলো অন্য একজন।

_একটু তাড়া আছে।

_ বুঝলাম ভাই, তা যা শুনলাম সেটা কি সত্যি।

_কি শুনছেন?

আঙুলের ডগায় চুনটা গালে পুড়ে হাতটা ঝাড়লেন মোটা গড়নের মহিলাটা। মুখটা বেঁকিয়ে বললেন।

_ তা শুনলাম মেঘ নাকি ফিরে এসেছে। এবার কি পুরোপুরি ভাবে তোমায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য এলো নাকি।

_ কি যে বলেন ভাবি, ছাড়তে আসে নাই তো কি সংসার করতে আসছে নাকি। আপনার কথা হয় নাই ভাবি। যদি সংসার করার ইচ্ছে থাকতো, তাহলে কি আর বিয়ের রাতে পালিয়ে যেতো। আর শুনেন ভাবি যাঁরা ওই বিদেশে যায়, তাঁদের চরিত্র বড়ই খারাপ। ওই দেশের ছোট্ট ছোট্ট পোষাক পড়া মাইয়া গুলা বেডাগো গায়ে পড়ে। ওতো সুন্দর সুন্দর মাইয়া গুলার প্রেমে যদি কেউ পড়ে তাঁর কি এই দেশের মেয়েদের ভালো লাগে।

_ ঠিক বলেছেন ভাবি, আমিও আপনার কথায় একমত। কিন্তু আসল কথা কি বলেন তো! বড়লোক বাড়ির পোলারা গরীব মেয়েদের বিশ্বাস করে না, জোনাকি যে তলে তলে প্রেম করে নাই হেই কথা মেঘ জীবনেও বিশ্বাস করবো না। আর শুনেন যাঁরা ভালো সাজার চেষ্টা করে, হেরাই তলে তলে টেম্পু চালায়।

_ ঠিক বলছেন ভাবি, কিন্তু জোনাকি কিছুই করে নাই আমরা জানি। কিন্তু সেটা কি আর মেঘ বিশ্বাস করবে। দোয়া করি সে যেন তোমায় ডির্ভোস না দেয়। আর শুনো যদি মেঘ তোমায় ডির্ভোস দেয়, তাহলে চিন্তা কইরো না। আমার একটা ভাইপো আছে বড়োই ভালো, কিন্তু বউ থাকে না। বউ গুলার চরিত্র খারাপ। মাঝসাঝে একটু নেশা করে। আরে ভাই আজকালের ছেলে একটু আকটু তো নেশা করবেই। কি বলেন ভাবি।

মহিলাটার কথা শুনে সবাই তাঁর সাথে তাল মেলালো। জোনাকির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। এই জন্যই এই মানুষ গুলোর সামনে পড়তে চায় না জোনাকি। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সকাল হয়।

_ আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করে নিয়েছে, মজিনা কাকি। আমি ডির্ভোস দিতে না জমিয়ে সংসার করতে এসেছি। আর বছর শেষে আপনাদের দাদি হওয়ার দাওয়াত দিতে। কে কি মিষ্টি খাবেন আমাকে জানিয়ে দিয়েন, দাওয়াত দেওয়ার সময় বাড়িতে নিয়ে যাবো। আর জেসমিন খালা শুনেন, যদি ছেলে নেশা করলে সমস্যা না হয়। তাহলে দুই একটা মেয়ের সাথে বিছানা ভাগাভাগি করলেও সমস্যা হয় না। কি জোনাকি ঠিক বললাম তো?

হঠাৎ মেঘের কথায় থতমত খেয়ে তাকালো জোনাকি। লজ্জা শরমের বালাই নেই লোকটার তা বোঝাই গেলো। কিন্তু লোকটা যে উনাদের বলা সব কথা শুনেছেন তা বুঝে গেলাম। আমি চেয়েও এখান থেকে সরতে পারছি না। আল্লাহ দয়া করো।

_ মজিনা কাকি আরো একটি কথা, আমি সাত বছর ছিলাম না আমার স্ত্রীর কাছে! তাই যদি আমার স্ত্রী কারো সাথে প্রেম করে সমস্যা নেই। আপনার মেয়ের মতো তো আর স্বামীর সাথে থেকে প্রেমিকের বাচ্চার মা হয়নি। আমার স্ত্রী তাঁর স্বামীর বাচ্চারি মা হবে এবং খুব তাড়াতাড়ি। আর সব থেকে বড় সত্যি। আমার স্ত্রীর জীবনে আমিই প্রথম আমিই শেষ! ঠিক তেমনই আমার জীবনে আমার স্ত্রী-ই প্রথম আমার স্ত্রী-ই শেষ। কথায় আছে, যে যবর যা, যে জাতের জা। যে যেমন তাঁর সাথে ঠিক তেমনটাই মিলে। শুধু বুঝ অবুঝের অমিল থাকে। আমি পবিত্র তাই আমি জানি আল্লাহ আমার জন্য পবিত্র কিছুই রেখেছেন। আমি যদি অপবিত্র হতাম, আমার জন্য সেটাই বরাদ্দ করতেন আল্লাহ। কথা ক্লিয়ার নাকি কোন বেজাল আছে জোনাকি।

_ অসভ্য লোক কোথা কার।

কথাটা বলেই জোনাকি হাঁটতে শুরু করলো। বেচারা মেঘ ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আসলে সে বোঝার চেষ্টা করছে, অসভ্যের কি করেছে। তাঁদের কথা তাঁদে-রি ফেরত দিলো এখানে খারাপ কি করলো।

_ আপনাদের জন্য বউটা আমার রাগ করলো। ধুর কুটনা মহিলা। রাগ ভাঙতে পারছি না, সেখানে আরো রেগে গেলো। ফের যদি আমার বউয়ের পেছনে লাগেন না, হাঁড়ির খবর সব বাজারে তুলে দিবো। আমি সেই আগের মেঘ আছি, শুধু বয়সটা বেড়েছে, বাকি সব আগের মতোই আছে। তাই সাবধান।

এই কথা বলেই দৌঁড়ে জোনাকির পিছু নিলো মেঘ।

বউ ও বউ রাগ করো না, কি ভুল হলো বলে যা-ও। আর ওদের যদি বকা কম দিয়ে থাকি একবার বলো বেশি করে বকে দিচ্ছি।

চলবে,,,