অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-৫+৬

0
2

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৫+ ৬

পুরো ড্রইংরুমে আনন্দের মেলা বসেছে। এই মেলার চমৎকার একটা বিষয় হচ্ছে বাড়ির মানুষ গুলো। প্রতিটা মানুষের চোখেমুখে লেপ্টে আছে খুশি! এই খুশির কি নাম দেওয়া যায় তা জানা নেই কারো। জীবনের প্রথম সুখ হচ্ছে পরিবার। পরিবার থেকে বিছিন্ন হওয়া মানুষ গুলো জানে তাঁদের জীবনে কি নেই? পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারলেই কারো আনন্দ লাগে। নিজের জীবনের মূল্যবান জিনিস ত্যাগ করতে হয় যখন পরিবারের জন্য, সেখানও আনন্দ মিশে থাকে। কখনো নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে সবার তৃপ্তি দেখে কেউ আনন্দ পায়। কেউ সবাইকে রাগিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। কখনো কেউ এক পরিবারে থেকে পরিবারের ক্ষতি চেয়ে আনন্দ পায়। সবার আলাদা একটি আনন্দমহল থাকে। সেই মহলে সে তাঁর মতো করে আনন্দ নিয়ে বাস করে। সাদা পাঞ্জাবি পড়ে মুরুব্বির মতো করে বসে আছে আলতাফ হোসেন। আর তাঁকে ঘিরেই বসে আছেন সবাই। সবার ঠোঁটের কোণে জ্বলজ্বল করছে হাসির রেখা। মনি সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে, তাঁকে সাহায্য করছে মনোয়ার বেগম। শাপলার আর মনির ছেলে দু’জনেই এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়দৌড়ি করছে। আলিফ নিজ মনে সবার কথা শুনছে, আর মাঝে মাঝেই মুচকি হাসছে। রূপ মেঘের জন্য চাকরি ঠিক করেছে সেটা নিয়েই আলোচনা করছে ফোনে। শাপলা কথা বলছে বিয়ের শপিংয়ের। মেয়ে যেহেতু আগে থেকেই ঠিক করা তাই তাঁদের বারতি কোন ঝামেলা নেই। বিয়ের তারিখ আলতাফ হোসেন গেছেকাল রাতেই ঠিক করে ফেলেছেন। হাতে বাকি মাত্র চারদিন। আগামী শুক্রবার বিয়ে, আজ বারে সোমবার। তাই যতদ্রুত সম্ভব সব গুছিয়ে ফেলতে হবে। এমনই এক আনন্দের মেলায় সামিল হতে মেঘ, নিঝুম আর জোনাকি উপস্থিত হলো। মেয়েকে দেখে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে পানি জমলো মনোয়ারা বেগমের। কিন্তু স্বামীর ভয়ে সে এগিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলেন না। এ-র আগে বহুবার তাঁর দেখা হয়েছে মেয়ের সাথে। কিন্তু বাড়িতে নয় বাড়ির বাহিরে। যত বড় ভুল করুক সন্তান, বাবা-মা তা ক্ষমা করেই দিবেন। তাঁর স্বামীর অতি আদরের মেয়ে নিঝুম। কিন্তু কথায় আছে অতি আদরের জিনিস পিঁপড়ায় খায়। মেয়ের ছোট্ট ভুলের জন্য মেয়েকে চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখেছেন তাঁরা। তাই তাঁকে শাস্তিযোগ্য হিসেবে দিয়েছেন বাড়ি থেকে পুরো পরিবার থেকে দূরে রেখে। কিন্তু তাঁর দায়িত্ব থেকে কেউ সরে আসেনি। হোস্টেলের খরচ থেকে শুরু করে সব কিছুর দায়িত্ব একজন বাবা হিসেবে পালন করেছে আলতাফ হোসেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে বলে সে অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে, এমন বাবা তিনি নন। তাই তো এই পদক্ষেপ। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তাঁর। বসা থেকে উঠে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। জোনাকি নিঝুম কে ইশারা করলো বাবা-র কাছে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু নিঝুমের ভয় হতে রইলো যদি বাবা রেগে যায়। তখন মেঘ চোখের ইশারায় বললো, — এমন কিছু হবে না তুই যা। নিঝুম দৌড়ে গিয়ে বাবাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।

_ আমার ভুল হয়েছে বাবা, আমাকে মাফ করে দাও। আর শাস্তি দিওনা আমায়, আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ বাবা, আমাকেও বলার সুযোগ দাও, আমারও সব আছে। একটা বটবৃক্ষের মতো বাবা আছে, মমতাময়ী মা আছে, হিরোদের মতো চার ভাই আছে, চাঁদের মতো দুটো ভাইপো আছে, বোনের মতো তিন ভাবি আছে! প্লিজ বাবা প্লিজ।

মেয়ের কান্না মিশ্রিত কন্ঠ কোন বাবা-ই উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই তিনিও পারলেন না। তাই সাত বছর পর এই প্রথম কথা বললেন মেয়ের সাথে আলতাফ হোসেন।

_ আর্দশ একজন স্বামী আছে, সেটা কেন ভুলে গেলে।

বাবা-র মুখে নিজের আরো একটি প্রিয় মানুষের নাম শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো নিঝুম। তারমানে তাঁর বাবা সত্যি তাঁকে ক্ষমা করেছে। এবার সরাসরি বাবা-র বুকে ঝাপিয়ে পড়লো নিঝুম।

আলতাফ হোসেন মেয়েকে পরম আদরে জড়িয়ে নিতেই ছুটে এলো মনোয়ারা বেগম। তিনিও মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। এমন দৃশ্য দেখে পরিবারের প্রতিটা মানুষ খুশি হলো। যদি পরিবারটা এক সূত্রে বাঁধা থাকে, তাহলে একজনের হারিয়ে যাওয়ার প্রভাব সবার উপরেই পরে। যেমন মেঘের চলে যাওয়ার সাথে সাথে এই পরিবারের খুশিও হারিয়ে গিয়েছিলো। আজ তাঁর ফিরে আসার সাথে সাথে সব খুশি ফিরে এলো। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।

—————

ঘড়িতে সময় রাত পৌঁনে এগারোটা। বিছানার এক কোণে বসে সাদাত হোসাইনের লেখা নির্বাসন উপন্যাসটা পড়ছে মেঘ। বইটা সে আরো একবার পড়েছিলো আজ আবার পড়তে নিলো। বইটায় এতো মুগ্ধতা যে ইচ্ছে করে বারবার পড়তে। বইয়ের মাঝে যখন খুব গভীর ভাবে মিশে ছিলো মেঘ, তখন জোনাকি ঘরে এলো। জোনাকি ঘরে আসতেই মেঘের ধ্যান ভেঙে গেলো। আড়চোখে একবার জোনাকিকে দেখে আবারও বইয়ের মাঝে মনোযোগ দিলো। জোনাকি আয়নার সামনে বসলো। আয়নায় চোখ দিয়ে নিজের চুল গুলো ঠিক করতে করতে বললো–

_ ধন্যবাদ।

জোনাকির মুখে ধন্যবাদ শুনে মেঘ চোখটা সরু করে তাকালো, আসলে সে বোঝার চেষ্টা করছে জোনাকি কাকে বলেছে।

_ কি বললে?

_ বললাম ধন্যবাদ।

_ কেন?

_ আপনার ফিরে আসাটা খুব দরকার ছিলো, সবার জন্য।

_ আর তোমার জন্য?

মেঘের কথায়, জোনাকি কথা হারিয়ে ফেললো, কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না। তাই সে চুপ করেই রইলো। জোনাকিকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ বললো।

_ গোছগাছ হয়েছে, আমাদের কিন্তু কাল ভোরেই যাত্রা করতে হবে। হাতে মাত্র তিনদিন আছে, কাল বুধবার আমাদের বৃহস্পতিবারের মাঝেই ফিরতে হবে।

_ হুম আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি।

_ আমার জিনিসপত্র গুলো গুছিয়েছো।

_ আপনার জিনিস মনি ভাবি সন্ধ্যায় গুছিয়েছ।

_ ভাবি গুছিয়েছে কেন, তুমি?

কথাটা বলেই চুপ করে রইলো মেঘ। সব জেনেও বোকার মতো প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। এতে করে জোনাকি অস্বস্থিতে পড়ে যায়। আর মেঘ চায় না জোনাকি তাঁর কোন কথায় অস্বস্থি অনুভব করুক। তাই বইটা বন্ধ করে টেবিলে রাখলো। চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। জোনাকির উদ্দেশ্যে বললো–

_ অনেক রাত হয়েছে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো, অনেক রাত হয়েছে! কাল সকালে উঠতে হবে। আর আজ নিঝুমের ঘর তো ফাঁকা নেই, তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো, কথা দিচ্ছে বিরক্ত করবো না।

তারপর মেঘ চোখ বুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। জোনাকি লাইট নিভিয়ে মেঘের পাশেই শুয়ে পড়লো। দুজনার মাঝে বিস্তার ফারাক। দু’জন দু’দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। কারো চোখেই ঘুম নেই। দুজনেই নিজের ভেতরের লালিত সত্তাকে অনুভব করছে। সময়ের পরিবর্তন বুঝি এভাবেই হয়। কিছুদিন আগেও তো কেউ জানতো না, এতো বছর পর তাঁদের এভাবে দেখা হবে। এটাও তো কেউ জানতো না, পবিত্র বন্ধনে এতো টান। ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগিয়ে গেলেও ঘুমের দেশে এগিয়ে যেতে পারেনি এক দম্পতি। তাঁদের ভেতরে চলছে এক টানাপোড়েন। শেষে কি হবে তাঁদের সম্পর্কের গতি। কোথায় গড়িয়ে যাবে সময়ের চাকা। মেঘ কি পারবে অভিমানের পাহাড় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে! কিনবা জোনাকি কি পারবে সকল রাগ অভিমান দূরে সরিয়ে মেঘকে আপন করতে। হবে কি শুরু তাঁদের জীবনের নতুন কোন অধ্যায়।

পর্ব ৬

আমাকে যদি তোমার নাই পড়বে মনে, তাহলে আমায় ভালোবেসো না।

আমাকে যদি স্মৃতির পাতায় রাখতে চাও, তাহলে আমায় ভালোবেসো না।

আমাকে যদি একটি শুকনো পাতার মতো মুড়িয়ে ডিঙিয়ে যাও, তাহলেও আমায় ভালোবাসতে হবে না।

আমাকে তোমার স্বপ্ন ভাঙার কারণ করতে চাও, তাহলেও বলবো আমায় ভালোবাসতে হবে না।

আমাকে না-হয় তুমি দূরের ওই চাঁদের জোছনা মনে করে গায়ে মেখো, ভয় নেই শরীর পুরবে না। কিংবা শিশির বিন্দু ভেবে পা ভিজিও মনের সুখে। চিন্তা নেই রোদের তাপে আমি হারিয়ে যাবো। বিরক্তের কারণ হবো না। আমি না-হয় চিলেকোঠার একটা কোণে ভাঙা আসবাবপত্র হয়ে রবো, তুমি মাঝেসাঝেই ছুঁয়ে দিয়ো। দুঃখ পেয়েও না, তোমার ক্ষতি হবে না। আমাকে না-হয় তুমি ওভাবেই রেখো আমি কষ্ট পাবো না। কিন্তু তুমি যদি আমাকে বুকে তুলে ফেলো দাও, আমি সইতে পারবো না। হয়তো আমি মরেই যাবো, তোমাকে না পাওয়ার বেদনায়।
(কপি করা নিষেধ।)

এমনই কিছু কথা নিজ মুখে আওড়াল জোনাকি ওই দূর আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে। হয়তো আর দুই একদিনের মাঝেই চাঁদ তাঁর পূর্ণতা পাবে, কিন্তু জোনাকির পূর্ণতা কোথায়। এখন গভীর রাত। কতটা গভীর তা জোনাকি জানে না। বহু চেষ্টা করেও যখন জোনাকি নিজের চোখে ঘুম আনতে ব্যর্থ হলো, তখন সে চুপিচুপি ছাঁদে চলে এসেছে। আপন মনে এক কবিতা আবৃত্তি করে চুপচাপ বসে আছে ছাঁদের এক কোণে। পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা তাঁর স্বামী। যেখানে তাঁর বুকে লেপ্টে থাকার কথা! সেখানে তাঁর পাশে ঘুমাতেই অস্বস্তি লাগছে। একেই বলে চেনা মানুষটাও অচেনা হয়ে যায়, যদি সে ভালোবাসার পরিবর্তনে কষ্ট দিয়ে থাকে। বাতাসে এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো নিজ আনন্দে চোখেমুখে আছড়ে পড়লো। সেই চুল গুলো কেউ পরম যত্ন গুছিয়ে কানের কাছে গুঁজে দিলো। এতোরাতে কে এখানে ভাবতেই জোনাকি চমকে উঠলো। পাশে তাকাতেই দেখলে সে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলোয় তাঁর মুখটা স্পষ্ট। তার চোখেমুখে এক মুগ্ধতা লেপ্টে আছে। কি দেখে সে এতো মুগ্ধ। তাঁকে দেখে। হঠাৎ নিজের কথায় চমকে উঠলো জোনাকি। কি ভাবছে সে। মেঘ তাঁকে দেখে কেন মুগ্ধ হবে? এখানে মুগ্ধ হবার মতো অনেক কিছুই আছে। আকাশে চাঁদ, এই গরমে শীতল বাতাস, চেনা অচেনা ফুলের সৌরভ। মুগ্ধ কি মানুষ শুধু পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে হয়, আরো অনেক কিছু দেখেই হয়। নিজের বোকা ভাবনার জন্য নিজেই মনে মনে হেসে উঠলো জোনাকি। সেই হাসির রেখা কিছুটা ঠোঁটে ফুটে উঠলো। হঠাৎই সেদিকে তাকিয়ে মেঘ বললো।

_ শুনেছি নারীদের দুই রকম ভাবে হাসলে বেশি সুন্দর লাগে। এক, যখন সে নিজের হাসি কন্ট্রোল করার জন্য মুখ ঢেকে ফেলে। আর দুই, যখন সে নিজ মনে কিছু ভেবে হেসে ফেলে, যাঁর কিছু অংশ তাঁর অজান্তেই তাঁর ঠোঁটে ফুটে ওঠে। আমি জানতাম না, বন্ধুরা বলেছিলো! কিন্তু আজ বিশ্বাস হলো তোমার হাসি দেখে।

এভাবে মেঘের মুখে নিজের প্রসংশা শুনে জোনাকির হৃদয়ে কোথাও ধাক্কা খেলো। মানুষটা কেমন করে তাঁর প্রশংসা করলো। কখন এলো সে, আর কেনোই বা এলো। তাঁর ঘুম আসছিলো না কোন ভাবেই। তাই সে চুপিচুপি চলে এসেছে। মানুষটাকে দেখলেই কেমন ভেতরে বাহির পুড়তে থাকে। আর হৃদয়টা মরিচের মতো জ্বলতে থাকে। মনে হয় সেখানে শখানেক বরফের চাক দিলেও তা কমবে না। কেন হয় তাঁর এমন। সে নিজের মনকে শাসিয়ে উঠলো। আর মেঘের উদ্দেশ্যে বললো–

_ কখন এলেন।

_আপনার পিছু পিছু।

_ এভাবে কোন নারীকে তাঁর অনুমতি ছাড়া দেখা ঠিক না জনাব।

_ নিজের স্ত্রীকে দেখা পাপও নয় জনাবা।

_ জনাবা, এটা কেমন কথা।

_ পুরুষকে যদি জনাব বলে, নারীকে তাহলে জনাবা বলা উচিৎ।

_ আপনি আমার অনেক বড়, ভেবে দেখলাম আপনায় নাম ধরে ডাকা ভালো দেখায় না। যদিও কিছুবার ডেকে ফেলেছি কিন্তু আর ডাকবো না। তাই এই জনাব বলে সম্মোধন করলাম। অনেকবার আপনার নাম ধরে ডেকে ফেলেছি! পড়ে ভেবে দেখলাম আমার উচিত হয়নি। কিন্তু আমি তো আপনার ছোট আমার নাম ধরে আপনি ডাকতেই পারেন।

_ হুম অবশ্যই পারি। আমি এমন অনেক কিছুই করতে পারি, যা তুমি পারো না। যখন আমি সেগুলো করছি না, তাহলে নাম ধরেও না-হয় ডাকবো না।

_ তাহলে কি বলে সম্মোধন করবেন আমায়।

_ কেন, হে-গো, ও-গো বলে। কথাটা বলেই মুখটিপে হাসলো মেঘ। জোনাকি অবাক নয়নে তাকাতেই, মেঘ বললো–

_ মজা করলাম, এমন কিছু বলেই ডাকবো না চিন্তা নেই।

_ আপনি হঠাৎ এতো ঠান্ডা স্বরে কথা বলছেন।

_ মানে বুঝলাম না।

_ মানে, সকালেও তো আপনি উড়নচণ্ডার মতো আচরণ করছিলেন হঠাৎ এমন আচরণ। আমার তো মনে হলো, আপনি আমেরিকা থেকে নয় পাবনা থেকে এসেছিলেন।

জোনাকির কথায় মেঘের ঠোঁটের হাসিটা চওড়া হলো। মেয়েটা যে তাঁর ব্যবহারে খুশি ছিলো তা বোঝাই গেলো। অথচ এখন জানতে চাইলে ঠিক হাজারটা যুক্তি সামনে দাঁড় করাবে। আজ বুঝতে পারলাম প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক কেন এতো কড়া ছিলেন। কারণ তাঁরা যুক্তিতে পিএইচডি করেছে। এই কথাটা ভেবেই হাসিটা আরো একটু চওড়া হলো। মেঘকে হাসতে দেখে জোনাকি বললো–

_ কি হলো ওভাবে হাসছেন কেন?

_ আমি তো পাবনা থেকে আসা পাগল, তাই হাসছিলাম। জানেন তো পাগলের সুখ মনে মনে। ঠিক তেমনই আমার সুখ টাও মনে মনে।

_ কি জানি বাপু। আপনি থাকেন আমি যাচ্ছি।

_ রাত কত হয়েছে জানেন, একটু পর-ই ফজরের আজান দিবে! এখন ঘুমালে বাস মিস করবো।

_ কিহহ, এতো সময় গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না।

_ মানুষ নিজ জায়গায় থমকে দাঁড়ালে কি হবে! সময় তাঁর আপন গতিতেই এগিয়ে যায়। খারাপ মানুষ বলুন আর ভালো মানুষ, তাঁরা প্রিয় মানুষের জন্য থমকে দাঁড়ালেও সময় দাঁড়ায় না। সে মহান আল্লাহর হুকুমে এগিয়ে যায়। আমরাও মহান রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছেয় চলি, কিন্তু পাপ গুলো নিজ ইচ্ছায় করে থাকি। তাই মহান আল্লাহ পাপ গুলো আমাদের হিসেবের খাতায় একটু দেরি করেই তোলেন, ফেরেশতাদের এটা বলে! যদি আমার বান্দা খাস দিলে দোয়া করে, আমি আল্লাহ মাফ করে দিবো। “আলহামদুলিল্লাহ” অথচ ভালো কাজ করার সাথে সাথে লেখা হয়ে যায় হিসেবের খাতায়। সত্যি মহান আল্লাহ অনেক দয়ালু।

_ অনেক কিছুই জানেন দেখছি তাহলে নামাজ পড়েন না কেন?

_ আমেরিকা থাকতে পড়া হতো, দেশে এসে সব একটু উল্টে গেছে। কিন্তু এখন থেকে আবার নিয়মিত নামাজ পড়বো। আপনি পড়েন তো নামাজ?

_ হুম পড়ি, কিন্তু?

_ বুঝতে পেরেছি, মন খারাপ করবেন না! এটাও আল্লাহর একটা নেয়ামত তাই নামাজ ছুটে যাচ্ছে বলে মন খারাপ করবেন না। আপনাদের এই নেয়ামত না থাকলে আমাদের জন্ম হতো না।

দু’জনার কথার মাঝেই দূর থেকে ভেজে এলো মুয়াজ্জিনের কন্ঠ। সেই সাথে ভেসে এলো মহান রাব্বুল আলামিনের ডাক। তিনি তাঁর আমল করার জন্য আমাদের ডাকছেন। সত্যি এমন শান্তি কোথায় পাবে, যেখানে সৃষ্টিকর্তা নিজে বান্দাকে ডাকেন।

_ তুমি তৈরি হয়ে না-ও, আমি নামাজ পড়ে আসি। আর হ্যা গাড়ি কিন্তু সারে সাতটায়, তাই একটু জলদি করো। কথা গুলো বলেই মেঘ ছাঁদ ত্যাগ করে চলে গেলো। আর জোনাকি আবারও চোখ রাখলো আকাশ পানে। এখনো আকাশ জুড়ে দেখা যাচ্ছে হাজারো তারা, এবং একটি চাঁদ। চাঁদের একটু দূরে জ্বলজ্বল করছে সুখতারা। এই তারাটা ভিষণ প্রিয় জোনাকির। কি সুন্দর দেখতে, সব তারা-র থেকে আলাদা এবং বড়। দিনের আলো আছড়ে পড়তেই হারিয়ে যাবে, চাঁদ সহ হাজরো তারা।

—————

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আধাঘন্টা আগে ওরা বাসস্ট্যান্ডে এসেছে। কিন্তু এখনো বাস আসার কোন নামগন্ধ নেই। বিরক্ত নিয়ে একটি চেয়ারে বসে আছে ওরা। মেঘের ইচ্ছে করছে টিকিট ওয়ালাকে ধরে আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিতে! কিন্তু সাথে জোনাকি থাকায় পারছে না। এখানে এসে ঝামেলা করলে জোনাকি রেগে যাবে, এতে অভিমান কমার বদলে আরো বাড়বে। তাই নিজের রাগ খুব যত্ন করে সামলে রাখছে। কিছুক্ষণ পরই বাস এসে দাঁড়াতে সবাই একে একে বাসে উঠলো। কনট্রেকদার খুব তাড়া দিলো বাসে ওঠার। নিজেরাই দেরি করে এসে এখন নিজেরাই তাড়া দিচ্ছে! একেই বলে বাঙালি। ভুল করবেও তাঁরা চিৎকারও করবে তাঁরা। মাঝখানে বেচারা সাধারণ মানুষ গুলো বিপদে পড়ে। মেঘ সিটনাম্বার মিলিয়ে জোনাকিকে বসিয়ে নিজেও বসলো। কিন্তু জোনাকির মুখটা চুপসে গেলো, যখন দেখলো তাঁদের দূরুত্ব মাত্র কিছুটা। একসাথে বসা নিয়ে তাঁর কোন সমস্যা নেই, সমস্যা সে জার্নি করতে পারে না। সে জার্নি করলেই তাঁর বমি হয়। কিন্তু মানুষটা বমিকে খুব ঘৃণা করে সেটা মনি ভাবির থেকে শুনেছে। এখন উপায়। এদিকে জোনাকির চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মেঘ বললো–

_ কি হয়েছে, কোন সমস্যা?

_ বলছি কি আপনি অন্য কাউকে এখানে দিয়ে আপনি তাঁর সিটে গিয়ে বসুন।

_ আমি পাশে বসায় তোমার কি খারাপ লাগছে।

_ না সেরকম কোন বিষয় না।

_ তাহলে, কি সমস্যা আমায় বলো! আমি ম্যানেজ করে নিবো।

_ আমি জার্নি করতে পারি না, আমার প্রচন্ড বমি হয়। আমি শুনেছি আপনি বমি-টমি প্রচন্ড ঘৃণা করেন। আরো শুনেছি–

_ কি শুনেছো?

_ শুনেছি, একবার আপনারা সব বন্ধুরা এক সাথে পিকনিকে গিয়েছিলেন। আপনার পাশের সিটে বসেছিলো আপনার বন্ধু কি যেন নাম মনে পড়ছে না।

_ মোহনা।

_ হে মোহনা, সে একবার বমি করেছিলো বলে,আপনি মাঝরাস্তা থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও আপনাকে তাঁদের সাথে নিতে পারেনি। আপনার অভিযোগ ছিলো এতো মানুষের মধ্যে জার্নিতে বমি করা মেয়েটাই কেন আপনার পাশে বসেছে! অথচ সে আপনার খুব ভালো বন্ধু ছিলো। আর আমি তো বারবার বমি করবো।

_ সে আমার ফ্রেন্ড ছিলো, বউ না! তুমি আমার স্ত্রী, তোমার ভালো গুলো যেমন আমি উপভোগ করবো, তেমনি তোমার খারাপ দিক গুলো সামলে নেওয়ার চেষ্টা করবো। তাই এই বিষয়ে আর কোন কথা নয়। তুমি একবার না হাজার বার বমি করলেও আমি তোমায় ছেড়ে যাবো না। আর এবার জার্নিতে তুমি বমি করবে না দেখো। এবারের জার্নিটা তোমার জীবনের খুব ভালো একটা জার্নি হবে ।

_ কিন্তু।

_ উঁহু, কোন কথা নয়। তুমি জার্নি করতে পারো না, এটা কাল ভাবি আমায় বলেছে। তাই চিন্তা করো না। আমি সব ম্যানেজ করে নিবো।

ওদের কথার ফাঁকেই বাস ছেড়ে দিয়েছে তা ওরা কেউ টের পায়নি। জোনাকি জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে, তখন মেঘ বললো–।

_ জোনাকি।

_ হুম।

_ বাহিরে না তাকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো, দেখবে খারাপ লাগছে না। আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্ক যখন দুই রকমের চিন্তা করে, তখন ওই সমস্যা গুলো দেখা দেয়। তাই বাসে বসে বই কিংবা ফোন জানালার বাহিরে না তাকানোই ভালো! যাঁদের জার্নিতে সমস্যা হয়। সব সময় চেষ্টা করবে পাশের মানুষের সাথে গল্প করার এবং চোখ বন্ধ রাখার। দেখবে আর খারাপ লাগছে না। ভেবো না এখন আমার সাথে গল্প করার জন্য এটা বলেছি, তুমি গুগলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারো।

_ হুম।

_ একটা প্রশ্ন করি।

_ জ্বি করুন।

_ আমি তো বলে যায়নি তুমি তোমার মায়ের সাথে দেখা করবে না! বা তোমার মা তোমায় জোর করেও বিয়ে দেয়নি, তাহলে আন্টির সাথে তুমি দেখা করোনি কেন?

_ তাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আপন মানুষ দেখা না করলে কতটা কষ্ট হয়।

_ মানে?

_ যেদিন আমার বিয়ে হয়, তাঁর আগের রাতে বাবা ফোন দিয়ে বলেছিলো আমাকে সে দেখতে চায়। তাঁর শরীরটা নাকি ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। কিন্তু মা সেটা আমার থেকে গোপন রাখে, বিয়েটা ভেস্তে যাওয়ার ভয়ে। তাই আমিও জানিনি কিছু। বিয়ে হওয়ার পর আপনাদের বাড়িতে চলে গেলাম, আপনি রাতেই পালিয়ে গেলেন। সকালে খবরটা জানাজানি হওয়ার কিছুক্ষণ পর খবর এলো আমার বাবা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। সর্দবিয়ে হওয়া কনে আমি। স্বামী পালিয়ে যাওয়ার জন্য হা-হুতাশ করবো, নাকি চিরতরে বাবা হারানোর শোকে কষ্ট পাবো। ছোট বাবা নিজ দায়িত্বে নিয়ে যায় আমাকে বাবা-র মুখটা দেখাতে। বাবা-র দাফন হতেই ছোট ফুপি জানায় আমাকে বাবা দেখতে চেয়েছিলো, এবং মা’কে ফোনও করা হয়। সব কিছু শুনে মা’কে প্রশ্ন করলে। মা বলে সে ভেবেছিলো আমার বিয়েটা ভেস্তে দেওয়া জন্য বাবা অভিনয় করছে। কিন্তু কেউ নিজের শরীর নিয়ে মিথ্যা বলবে কেন? আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই, যে কষ্ট নিয়ে আমার বাবা পৃথিবী ত্যাগ করেছে সেই একি কষ্ট আমি মা’কে দিবো। হ্যা আমি মানছি তিনি স্বামী রূপে ভালো ছিলেন না! কিন্তু বাবা রূপে তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। সেই মানুষটাই কিনা তাঁর শেষ সময়ে নিজের মেয়ের মুখটা দেখতে পেলো না। আর আমিও আমার বাবা-র মুখে শেষ বুলিটা শুনতে পেলাম না। তাই আমি আপনাদের বাড়ি ফেরার পথে মা’কে বলেছিলাম, আমি সেদিনই ফিরবো যেদিন আপনি ফিরে আসবেন। কারণ একদিনে আমি আমার জীবনের দু’টো মানুষকে হারিয়ে ছিলাম! একজনকে চিরতরে, আরেকজনকে ক্ষণিকের জন্য। আর হারিয়েছিলাম একজনের জন্য তিনি আমার “মা” সে যদি একটু খোঁজ নিতো, তাহলে আমার বাবাকে শেষ দেখা হতো। আপনার মতামত টাও যদি জানা হতো তাহলে আমার জীবন থেকে অন্তত এই সাত বছর চলে যেতো না। সে নিজের অজান্তে করুক আর না-ই করুক, অন্যায়টা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল।

_ আমি যদি ফিরে না আসতাম।

_ তাহলে যেতাম না।

_ যদি তাঁর মৃত্যু খবর শুনতে।

_ জানি না।

আর কিছু বলতে পারলো না জোনাকি। চুপ করেই সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। মেঘ আবারও একবার বুঝতে পারলো, সে আসলে কতবড় অন্যায় করেছে। যে ব্যবহার জোনাকি করছে, তাঁর থেকেও খারাপ ব্যবহার মেঘের পাওনা। তবুও তো জোনাকি খুব শান্ত হয়েই তাঁর সামনে আছে। সত্যি নারী খুব বিচিত্রময়।

চলবে,,