অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-৭+৮

0
1

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৭+৮

গ্রামের আঁকাবাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মেঘ, জোনাকি। দু’জনার হাতেই দু’জনার লাগেজ। মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। একপাশে ছোট খাল, অন্যপাশে ধানের জমি। যেখানে পাকাধান দুলছে বাতাসে। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় ভেসে আসছে পাকা ধানের গন্ধ। সেই গন্ধে মন জুড়িয়ে যায়। আগে শোনা হয়েছিল এমন দৃশ্যের কথা, আজ চোখে দেখা হল মেঘের। সে আপন মনেই গেয়ে উঠলো–

ও আমার দেশের মাটি, তোমার তরে ঠেকাই মাথা।

জোনাকি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মেঘের দিকে তাকালো। মেঘে চারপাশ দেখতে ব্যস্ত। তাঁর চোখেমুখে লেগে আছে মুগ্ধতা। সে হয়তো এর আগে কখনো গ্রাম দেখেনি। তাঁদের বাড়িটা একটু ভেতরে, তাই পায়ে হেঁটেই বাকিটা পথ অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু কখনো বিরক্ত লাগে না হেঁটে যেতে। রাস্তার দুই পাশের এমন সুন্দর মনোরম পরিবেশে যা দেখলে শরীর কিংবা মনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সাত বছর পর নিজের গ্রামে আসায় তাঁর শরীরে কোন ক্লান্তি নেই, যদিও বমি করলে খারাপ লাগতো! কিন্তু সত্যি এবার মেঘের কথা ঠিক হয়েছে। সে এবার বমি করেনি। আজ মেঘের থেকে অনেক কিছুই শিখে নিয়েছে। এই যেমন বাস যেখানেই দশ মিনিটের জন্য থেমেছে, সেখানেই জোনাকিকে মেঘ নামিয়ে বলেছে একটু বাহিরের হাওয়া গায়ে মাখো দেখবে ভালো লাগবে। তারপর ঠান্ডা খাবার কিনে দিয়ে সেগুলো বারবার খাইয়েছে। যখনই একটু খারাপ লেগেছে, তখনই মেঘ জোর করে জোনাকির মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে বলেছে! চোখ বুঁজে থাকো ঠিক হয়ে যাবে। এক সময় সে দেখলো তাঁরা নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সত্যি জোনাকির জীবনে আজ খুব সুন্দর একটা জার্নি হয়েছে। এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই তাঁরা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ালো মেঘ। সে এখনো চারিপাশ দেখতে ব্যস্ত। জোনাকিদের বাড়িতে ঢুকলেই প্রথমে একটি সরু খাল। যেখানে নদীর জোয়ার-ভাটার পানি আসা যাওয়া করে। তারপরেই দেখা যাচ্ছে একটা মসজিদ। আরো একটু ভেতরে গেলেই বিশাল এক উঠোন। উঠোনের চারিদিকে ঘর। প্রতিটা ঘর অদ্ভুত রকমের সুন্দর। কাঠের তৈরি বাড়ি, নানান রঙের বাহার। ঘরের সামনের দিকে কম হলেও পাঁচটি জানালা। বিশাল এক দরজা। যে দরজায় হাজারো রকমের নকশি। কোন দরজায় ফুল পাখি, কোন দরজা জুড়ে পাতা। এতো সুন্দর বাড়ি দেখে মেঘ যেন থমকে দাঁড়ালো। সে নিজের অজান্তেই বললো–

_ এই জন্যই বুঝি তুমি এতো সুন্দর জোনাকি।

মেঘের কথাটা পুরো শোনা হলো না জোনাকির। তাই সে মেঘকে বললো–

_ কি বললেন?

_ কিছু না।

_ আচ্ছা।

তারপর ওরা আরো একটু হেঁটে সোজাসুজি একটি ঘরের সামনে দাঁড়ালো। লাগেজটা রেখে জোনাকি মুখ দিয়ে কেমন একটা আওয়াজ করলো। মেঘ চোখ কুঁচকে জোনাকির দিকে তাকালো। কিন্তু সে বুঝতে পারলো না এই ডাকের অর্থ কি? কিন্তু সে না বুঝলেও কেউ হয়তো বুঝেছে। তাই তো ঘর থেকে হুরমুর করে বেরিয়ে এলো এক মহিলা। যাঁর পরনে ছাপা শাড়ি, মুখে পান এবং মাথায় ঘোমটা। তিনি জোনাকিকে দেখেই মাগো বলে ঝাপিয়ে পড়লো। মহিলাটা সম্পর্কে জোনাকির মামি। তাঁর কোন ছেলেমেয়ে নেই। জোনাকিই তাঁর প্রান। তাঁর চোখের জ্বলে ভেসে গেলো জোনাকির পিঠ। কিন্তু সেই জ্বলে কোন কষ্ট নেই, আছে ফিরে পাবার আনন্দ। এক সময় কান্নার গতি কমে আসতেই জোনাকির মুখ সামনে তুললেন।

_ এতো বছর পর মনে পড়লো আমায়।

_ রোজই তো ফোন করি, তাহলে মনে পড়বে কেন?

_ একটু কন্ঠে কি পরাণ জুড়ায় যদি সামনে থেকে না দেখি।

_ হুম বুঝেছি, এবার আমাকে ছেড়ে পিছনে তাকাও। দেখো কে এসেছে?

_ কে?

এই কথা বলেই জাহানারা বেগম তাকালেন। দেখলেন মেঘ দাঁড়িয়ে আছে।

_ জামাইরে জনু।

_ হুম।

_ আগে বলবি তো? দেখ দাঁড়ায় আছে।

তারপর তিনি মেঘের দিকে এগিয়ে গেলেন। মেঘের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো–

_ মাসআল্লাহ, আমাদের জনুর মতোই সুন্দর জামাই।

তারপর জোনাকিকে টেনে মেঘের পাশে দাঁড় করালেন। গভীর চোখে পরখ করে হঠাৎ মেঘের আঙুলে কামর দিলেন। কিন্তু মেঘ খুব স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। জোনাকি কিং চিৎ চিৎকার করে বললো–

_ কি করছো মামি ব্যথা পাবে তো? আর তিনি এসবে অভ্যস্ত না।

_ তুই চুপ থাক। জামাই আমাদের মাসআল্লাহ ভারি সুন্দর। আর তোদের তো যেন চাঁদ আর জোসনার মতো জুটি। আমারি চোখটা ভরে উঠছিল! যদি নজর লেগে যায় তখন?

_ ধূর্ত কি যে বলো। মা কোথায়?

_ শিউলি তলায়। তুই যাবার পর বেশি সময়টা ওখানেই থাকে।

_ আমি যাচ্ছি, তুমি উনাকে ঘরে নিয়ে যাও।

_ আচ্ছা, আসো বাবা।

ওদের কথায় মেঘ বললো–

_ মামি আমিও জোনাকির সাথে যাবো।

_ আপনি ঘরে গিয়ে রেস্ট করুন, শরীর ক্লান্ত আপনার।

_ জার্নিটা তুমিও করেছো, তুমি যদি ক্লান্ত না হও আমিও হইনি।

_ বোঝার চেষ্টা করুন।

_ থাক না, জামাই যখন যেতে চাচ্ছে যাক। তুই কথা বারাস না। জোনাকিকে চুপ করিয়ে কথাটা বললো মামি। জোনাকি আর কিছু বললো না। ও জানে বলেও লাভ নেই মেঘ শুনবে না। আর মামিও জোর করবে। তাই কোন কথা না বলেই মেঘকে সাথে নিয়ে চললো শিউলি তলায়। শিউলি তলা বাড়ির পেছনে। সেখানে যেতেই দেখা মিললো মায়ের। গাছের গোড়া ইট সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে। সেখানেই শুয়ে আছেন হেনা বেগম, ওরফে জোনাকির মা। শুকিয়ে গেছে হেনা বেগম। সুন্দর চেহারায় পড়েছে বয়সের ছাপ। এই সাত বছরে যেন একটু বেশি বয়স বেড়েছে। মানুষটা জীবনে কম সহ্য করেনি, আজও করছে। নতুন করে যখন বেঁচে থাকার কোন সম্ভল ছিলো না, তখন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে ছিলো সে। সেই মেয়ে আজ কতবছর তাঁর সাথে দেখা করে না। মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে কথা বলতো। মেয়ের কড়া নিষেধ ছিলো, ফোনে কথা বলার সময় একদম কাঁদবে না। কাঁদলে ফোনেও আর কথা বলবো না। তাই একটু কথা বলার লোভে আঁচলে মুখ চেপে কান্না আঁটকে কথা বলতো। কথা শেষ হতেই হাউমাউ করে কেঁদে ভাসাতো। জোনাকিও কম নয়। সে-ও প্রতিবার কথা শেষ হতেই বালিশে মুখ চেপে কান্না আঁটকে রাখার চেষ্টা করতো। মায়ের ভুলের জন্য মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনি, এটা সবাই জানলেও আসল কারণ তো অন্য কিছু। মেঘ পালিয়ে যাওয়ার খবর গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। স্বামী হারানো মা’কে গ্রামের অনেক মানুষ কথা শুনিয়েছিলো। কথা গুলো বিষের তীরের মতো আঘাত করেছিলো জোনাকির বুকে। ছুরির আঘাতে মানুষ ক্ষতবিক্ষত না হলে-ও কথার আঘাতে হয়। তাঁর মা-ও হয়েছিলো সেদিন। তাঁরা বলেছিলো! বিয়ে ভাঙার ভয়ে স্বামীর সাথে মেয়ের দেখা করা-ও নি, দেখো সেই ছেলে তোমার মেয়েকে ফেলে চলে গেছে। দেখো গিয়ে কোথাও লটরপটর চলছে। কোথাও শান্তি দিলে না মেয়েটাকে। নিজের জীবন তো নষ্ট করলেই সাথে মেয়ের। হয়তো জোনাকির বাবা টের পেয়েছিলো, ছেলে ভালো না! তাই হয়তো মেয়েটাকে দেখার কথা বলে আঁটকে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু তাঁর আগেই বেচারা পরপারে পাড়ি জমালো। আরো অনেক কথা। তাঁরা জোনাকিকে দেখে একটু বেশিই বলেছিলো। যেন জোনাকির মন বিষে যায়। জোনাকি মায়ের থেকে সরে আসতেই সবাই চুপ হয়ে যায়। তখনই জোনাকি বুঝেছিলো এদের মুখ বন্ধ করতে হলে মায়ের সাথে দেখা করা যাবে না। যতোদিন মেঘ না ফিরে আসে। ক্ষীণ পরিমান আশা নিয়েই পড়ে ছিলো মেঘের বাড়ি। আর সত্যিই তাঁর মা ভুল করেছিলো। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি। আজ কেউ গলা উঁচু করে কোন কথা বলতে পারবে না তাঁর মা’কে। কারণ মেঘ তাঁর সাথেই আছে। আর এই সাত বছরে মা বুঝেছে, কাছের মানুষটাকে দেখতে চাইলে, দেখতে না পেলে কত কষ্ট হয়। সে-ও তো পুড়েছে। বাবা হারানোর শোকে, স্বামী চলে যাওয়ায়, মায়ের সাথে দেখা করতে না পরার যন্ত্রণায়। আমরা যতোই বলিনা কেন, সমাজের কথায় আমাদের কিছু যায় আসে না! কিন্তু হয় না এমন। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে জোনাকি মা বলে ডেকে উঠলো।

_ মা–

চিরচেনা কন্ঠ শুনে থমকে উঠলো হেনা বেগম। চোখ ঘুরিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। নারীছেড়া ধনকে দেখে আলো বলে ডেকে উঠলো। দ্রুত বেগে দৌড়ে আসতেই মুখ থুবড়ে পড়লো। কিন্তু পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার আগেই চারটা শক্ত হাত তাঁকে আঁকড়ে ধরলো। পড়তে গিয়েও যখন পড়লো না তখন মুখ তুলে সামনে তাকালো হেনা বেগম। তাঁকে আগলে আছে তাঁর মেয়ে আলো। সাথে আরো একটি ছেলে। কিন্তু ছেলেটাকে চিনতে পারলো না। কিছু একটা মনে পড়তেই মেয়েকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে নিলো হেনা।

_ আলো মা আমার, তুই এসেছিস আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে। ও মা মারে তোর আমার কথা মনে পড়ছে। সোনা মা আমার, যাদুমনি। কত বড় হয়ে গেছিস। আমার আলো আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমার ময়না পাখিটা কি উত্তরের হাওয়ায় উড়ে এসেছে, নাকি দক্ষিণের হাওয়ায় বলেই এগালে ওগালে চুমুতে ভরিয়ে দিলো হেনা বেগম। মায়ের আদর পেয়ে জোনাকি ছোট্ট বাচ্চাদের মতো মায়ের বুকের সাথে মিশে রইলো। সে-ও মায়ের মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো। এমন প্রাণ প্রিয় ভালোবাসা দেখো মেঘের চোখের কোণে পানি জমলো। জোনাকি মায়ের বুকে মিশেই বললো–

_ না আমি উত্তরের হাওয়ায় উড়ে এসেছি, না এসেছি দক্ষিণের হাওয়ায়। মায়ের আঁচলটা মাথায় তুলতেই, ভাসিয়ে নিয়ে এলো মায়ের ভালোবাসায়। মায়ের ভালোবাসা বললো, অপেক্ষা করছে আলোর মা। সে নাকি আজ খায়নি দুধ মাখা ভাত। তাইতো আলো এসেছে ফিরে যত্ন করে ভাত খাওয়াবে বলে। খাবে কি আমার মা, তাঁর মেয়ের হাতের দুধ মাখা ভাত।
( কপি করা নিষেধ)

_ হ্যা হ্যা খাবো তো খুব মজা করে খাবো। সাথে তাঁকেও খায়াবো।

_ আচ্ছা, দেখি আলোর মায়ের চোখ দু’টো। ইসস ভিজে গেছে তো? জ্বর এসে যাবে তো চোখের।

_ কিন্তু আলো তো বলেছিলো চোখ ভিজলে নাকি জ্বর হয়না কাশি হয়।

_ এখন আলো বড় হয়ে গেছে, তাই সে এখন কোন ভুল বলে না! চোখ ভিজলে আলোর মায়ের, আলো রাগ করে চলে যাবে বরের হাত ধরে। তখন দেখবে আলোর মা আর কাঁদে কীভাবে।

হেনা বেগম নিজের চোখ মুছে জোনাকির চোখ মুছে দিলেন। মেয়েকে নিজের বাম পাশে এনে মেঘকে কাছে ডাকলেন। মেঘ পাশে দাঁড়াতেই, তাঁকেও আগলে নিলেন নিজের বাহুডোরে।

_ এভাবেই সারাজীবন দু’জনেই আমার দুই পাশে থেকো। দুজনেই আমার হৃদয়ে অংশ। দু’জনকেই ছাড়া আমার হৃদয়টা অচল।

—————-

একটি পরিপাটি ঘরে মেঘকে নিয়ে এলো এই বাড়ির মেজো বউ, যিনি জোনাকির মেজো মামি। লাগেজ গুলো রেখে তিনি চলে গেলেন। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই মেঘ অবাক হলো। ঘরটা জোনাকির, মেজো মামি বলেছেন। পুরো ঘরে কারুকাজে ভরপুর। কত কি ঘরের ভেতরে। ঘরের মাঝখানে একটি পালঙ্ক, পাশেই ডেটিং টেবিল, এক কোণে কাঠের একটি আলনা,তাঁর পাশেই রয়েছে ছোট একটা আলমারি। এই জিনিস গুলো ছাড়া-ও রয়েছে অনেক কিছুই। মাথার উপর একটি ঝাড়বাতি। যা হাতের তৈরি। কিন্তু কি দিয়ে তৈরি বোঝা যাচ্ছে না। মেঘ হাত দিয়ে দেখলো, তারপর বুঝতে পারলো কি দিয়ে তৈরি। বোতলের মুটকি সুন্দর করে কেটে ফুল তৈরি করা হয়েছে, সাথে ওয়ান টাইম প্লেট গুলো সুন্দর করে কেটে মালা গেঁথে সাজানো হয়েছে। মাঝখানে ছোট একটি লাইট। ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে এতো সুন্দর ঝাড়বাতি মেঘ আগে কখনো দেখেনি। তারপর আছে বড় এক ফুলদানি। যে ফুল গুলো কাগজের তৈরি। কাছে গিয়ে হাত বোলালো। ছোট ছোট কুঞ্চি কেটে তাতে রঙিন কাগজ মোড়ানো হয়েছে। তারপর কুঞ্চির মাথায় হাতে কাটা কাগজের ফুল আঠা দিয়ে লাগানো। লাল, হলুদ, সবুজ রঙের ফুল গুলো। ভাগ ভাগ করে ফুল গুলো সাজানো। প্রথমে সবুজের মাঝে লাল, তারপর লালের মাঝে সবুজ, এরপর হলুদের মাঝে লাল। লালের মাঝে হলুদ, সবুজের মাঝে হলুদ। দেখলে মনে হবে সত্যি সত্যি ফুল। তারপর একটু দূরেই ঝুলে আছে কাগজের তৈরি কলম দানি। একটি শক্ত কাগজ মুড়িয়ে, তাতে রঙিন কাগজ মোড়ানো হয়েছে। হলুদ রঙের উপরে রংতুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে একটি গাছ, গাছে কিছু ফুল ফল ঝুলছে, অন্য ডালে একটি পাখি বসে আছে, এবং একটি পাখি উড়ে আসছে। এরকমই পুরো ঘরে কোন না কোন কিছু তৈরি হাতের। অনেক কিছুই চিনতে পারছে না মেঘ। প্রতিটা জিনিস জোনাকির হাতের তৈরি তা ভালোই বুঝতে পারলো মেঘ। ছোট থেকেই জোনাকি খুব পরিপাটি থাকা মানুষ। আজ মেঘ বুঝলো কেন তাঁর ঘরের একটি জিনিসও এদিক ওদিক হয়নি। যে গোছালো সে সব জায়গাতেই গোছালো। এই ঘরে ওয়াশরুম নেই। এই ঘর কেন গ্রামের কোন ঘরের ভেতরে ওয়াশরুম থাকে না। তাঁরা এই বিষয়ে খুব খিটখিটে। হাতমুখ সে কলপাড়ে ধুয়ে এসেছে, এখন শুধু পোষাক চেঞ্জ করলেই হবে। নিজের লাগেজ থেকে একটি ট্রাউজার, একটি টিশার্ট বের করলো। ঝটপট চেঞ্জ করতেই জোনাকি হাতে নাস্তা নিয়ে ঢুকলো। ছোট একটি টেবিল পাশের ঘর থেকে এনে, নাস্তা সাজিয়ে মেঘের সামনে দিলো।

_ আমরা আসবো তা তো বলা হয়নি! তাই রান্না হয়নি। একটু কষ্ট করুন আরেকটু পরেই রান্না শেষ হলে খেতে দিবো।

_ সমস্যা নেই, আন্টিকে বলো তাড়াহুড়ো না করতে।

_ হুম বলবো, কিছু কথা ছিলো।

_ হুম বলো।

_ যখন সবাই শুনবে আপনি এসেছেন, সবাই আসবে আপনায় দেখতে। অনেকে অনেক রকম কথা বলবে প্লিজ মানিয়ে নিয়েন।

_ অন্যায় যখন করেছি, কথা তো শুনতেই হবে! তাই চিন্তা করো না।

_ মা খুব চিন্তায় আছে আপনায় নিয়ে।

_ আন্টিকে গিয়ে বলো চিন্তা না করতে। আর আমাকে জামাই কম ছেলে যেন বেশি ভাবে। তাই কোন ফর্মালিটি করার দরকার নেই। বড় মাছ, গরুর গোশত, নানান পিঠা, ফলমূল না দিলেই নয়! এমন চিন্তা যেন না করে। বলে দিও।

_ হুম।

_ জোনাকি।

_ হুম।

_ তোমার কিছু পার্সোনাল কথা আমি পড়ে ফেলেছি।

_ মানে।

_ আসলে—-

জোনাকি মা তোকে বুবু ডাকে।

হঠাৎ মামির ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো জোনাকি। মুচকি হেসে নাস্তা মুখে দিলো মেঘ।

পর্ব ৮

খেঁজুর পাতার পাটি বিছিয়ে সাজানো হয়েছে নানান খাবার। রুই মাছ, করলা ভাজি, মুড়িঘণ্ট, পাতলা মুসুর ডাল, দেশি মুরগী। আপাতত এগুলোই মেঘের সামনে দেওয়া হয়েছে। এতো এলাহি কান্ড করা-ও পরে-ও হেনা বেগমের মন ভরলো না। তাঁর মনটা খুচখুচ করতে রইলো নানা চিন্তা করে। এই প্রথম মেঘ তাঁদের বাড়িতে এলো, তাঁকে কিনা বাড়ির পোষা মুরগী জবাই করে খেতে দিচ্ছে। আজ যদি জোনাকির বাবা থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এমন হতো না। এসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ঘনো হয়ে এলো হেনা বেগমের। মায়ের দীর্ঘশ্বাসের কারণ জোনাকি বুঝতে পারলো, তাই বললো–

_ যা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলছো, তা ভেবো না। কারণ সে ছেলেমানুষ হলে কি হবে অনেক বুঝদার।

_ কিন্তু আলো?

_ যা দিয়েছো সেটাই সে তৃপ্তি নিয়ে খাবে দেখো তুমি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো।

ও জনু, নে মা জামাই বাবা এসে গেছে, এবার তোরা খেতে বস তো?
মা মেয়ের কথার মাঝেই মেঘ আর জাহানারা বেগম এলেন। মেঘ বসতেই তাঁকে ভাত বেড়ে দিলো হেনা বেগম।

_ আপনারা খাবেন না আন্টি।

_ আমরা তো খেয়েছি বাবা। এখন তোমরা খাও।

_ সেই সকালে খেয়েছেন, দুপুরেই আমরা এলাম। রান্নার তোরজোর করেছেন কখন খেলেন।

_ তোমরা খেয়ে না-ও, আমরা পরে খাবো। হে-রে আলো তুইও বসে পড়।

_ না মা, আমিও তোমাদের সাথে খাবো। উনি খেয়ে নিক তারপর।

_ আন্টি একটা কথা বলি।

_ হ্যা বাবা বলো।

_ সারাজীবন তো দেখে এলাম, ঘরের মানুষ গুলো মেহমানকে বেড়ে খাওয়াচ্ছে! আজ একটু ভিন্ন রকম হলে কি খুব দোষ হবে।

_ বুঝলাম না বাবা, কি বলছো।

_ জোনাকি।

_ হুম।

_ ভিন্ন কিছু দেখবে।

এই কথা বলেই মেঘ বসা থেকে উঠে বসলো। হেনা বেগম আর জাহানারা বেগমকে পাটিতে বসালেন। হেনা বেগমের হাতের তালপাখাটা নিয়ে জোনাকির হাতে দিয়ে বললো বাতাস করো। তারপর প্লেটে করে খাবার দু’জনকেই বেড়ে দিলো। প্রথমে মাছ দিয়ে প্লেট সাজিয়ে বললো–

_ নিন শুরু করুন। সব সময় তো মেহমানকে বেড়ে খাওয়ান, আজ মেহমান আপনাদের বেড়ে খাওয়াবে। নিন নিন শুরু করুন। কোন কথা নয় খাওয়া শুরু করুন।

মেঘের এমন কান্ডে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। হেনা বেগম তো নিজের চোখের জ্বল আঁটকে রাখতে পারলেন না। তাঁরা গ্রামের মানুষ, সপ্তাহে হাঁটের দিনে বাজার করতে হয়। যেদিন বাজার করা হয় সেদিন আর পরের দু’দিন ভালোই যায়! কিন্তু বাকি পাঁচ দিন একটু কষ্টেই কাটে। নিজেদের পুকুর থাকলে বা ছোট ছেলে থাকলে নদীতে মাছ ধরতে গেলে যদি মাছ খাওয়া হয় নাহলে না। আর গোশত, সেটা মাসেও একবার জোটে কিনা কে জানে? তাই গ্রামের বাড়িতে মেহমান এলে, পরিবারেরও একটু সুবিধা হয়। মেহমানের উসিলায় তাঁদেরও ভালোমন্দ খাওয়া হয়। মেঘ আবারও সবাইকে তাড়া দিলো–

_ কি হলো খাচ্ছেন না কেন? আপনাদের খাওয়া শেষে আমরা দুজন খেতে বসবো। আপনারা যেমন আমাদের খাইয়ে পরে নিজেরা খেতে চেয়েছিলেন সেভাবে। আর জোনাকি ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন বাতাস করো।

_ হ্যা, হু।

_ কি বলছো?

_ না, না কিছু না।

তারপর জোনাকি জোরে জোরে বাতাস করতে রইলো। হেনা বেগম আর জাহানারা বেগম মনের তৃপ্তি নিয়ে খাবার মুখে তুললেন। মুখের তৃপ্তির থেকে মনের তৃপ্তি বড় তৃপ্তি, যা তাঁদের আজ হলো। এক সময় তাঁদের খাওয়া শেষ হতেই মেঘ জোনাকি খেতে বসলো। মেঘ মাছ, পাতলা মুসুরির ডাল দিয়েই তৃপ্তি নিয়ে খাবারটা খেলো। যখন হেনা বেগম গোশত দিতে গেলেন তখন মেঘ বললো–

_ আন্টি বেলা এখনো একটা পরে আছে! একবেলায় সব খাইয়ে কি আমায় বিদায় করবেন নাকি। আমি কিন্তু বাবা দু’দিন না থেকে যাচ্ছি না। সে আপনি তাড়িয়ে দিলেও না।

মেঘের কথায় সবাই হেঁসে দিলো। আর জোনাকির চোখে আনন্দের অশ্রু টলটল করে উঠলো। কিছু মনের তৃপ্তি আর চোখের তৃপ্তি বড় সুখের হয়! চাইলেও চোখের জ্বল আঁটকে রাখা যায় না।

—————

আকাশে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। আকাশের লাল রঙের ছোঁয়া ঢেকে গিয়ে কালো রঙের ছোঁয়া লেগেছে। মেঘের জন্য নাস্তা বানাতে ব্যস্ত ছিলো হেনা বেগম আর জাহানারা বেগম। কিন্তু মেঘ তাঁদের ডেকেছে। মাঠ থেকে ফিরে এসেছে জোনাকির মামা দেলোয়ার হোসেন। তাঁকেও ডাকা হয়েছে। সাথে ডাকা হয়েছে, জোনাকির মেজ মামি, ছোট মামি এবং মামাদের। সবাই জোনাকির ঘরে বসে ফুসুরফাসুর করছে। শুধুমাত্র কথা নেই, হেনা বেগম, জাহানারা বেগম এবং দেলোয়ার হোসেনের মুখে। তাঁদের কপালে চিন্তার ছাপ। কি জন্য ডেকেছে তাঁদের, কোন খারাপ খবর নয়তো। এমন চিন্তার মাঝেই মেঘ আর জোনাকি ঘরে ঢুকলো। মেঘের হাতে, তাঁর লাগেজ। জোনাকি নিজের মায়ের পাশে দাঁড়াতেই হেনা জানতে চাইলেন।

_ কিরে, সবাইকে জামাই বাবা ডেকেছে কেন?

_ আমি নিজেও জানি না মা। আমায় বললো সবাইকে ডাকতে। সবাইকে ডেকে নিয়ে তাঁর কাছে গেলেই দেখলাম, সে লাগেজের চেন আটকাচ্ছে। লাগেজ তো আমার ঘরে ছিলো, সেটা বারান্দায় গেলো কি করে।

_ আরে জামাই তো নিয়ে গেলো। আমিই তো দেখলাম।

কথাটা বলে উঠলো জাহানারা বেগম।

_ জোনাকি–

ওদের চুপিচুপি কথার মাঝেই মেঘ ডেকে উঠলো জোনাকিকে।

_ হুম।

_ এদিকে এসো।

মেঘ লাগেজের চেন খুলে সেখান থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বেড় করলো। জোনাকির হাতে দিয়ে বললো।

_ এটা আন্টিকে দিয়ে এসো।

_ কি আছে এতে? আস্তে আস্তে বললো–

_ তাঁকে দাও সেই খুলে দেখুক, কি আছে এতে। তাঁর জামাই কি এনেছে তাঁর জন্য। যা-ও

_ জোনাকি বাক্সটা হাতে নিয়ে মায়ের সামনে এগিয়ে গেলো। মায়ের হাতে দিলো। হেনা বেগম হাতে নিয়ে বললো।

_ কি আছে?

_ খুলে দেখো।

হেনা বেগম বাক্সটা খুলতেই দেখা গেলো, একটা ছোট্ট নাক ফুল এবং সেটা হিরার। নাকফুল দেখে চমকে উঠলে সে।

_ আলোরে এটা তো নাকফুল, তা-ও আবার হিরার।

মায়ের কথা শুনে চমকে উঠলে জোনাকি। কিন্তু সবার সামনে সেটা প্রকাশ করলো না। মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো–

_ তোমার সেই নাকফুল তো ফিরে পাবে না, তাই এটা।

_ কিন্তু মা এসব পরার কি বয়স আছে।

_ কে বললো বয়স নেই আপনার। মনে রাখবেন আন্টি মনের শান্তি বড় শান্তি। সেখানে বয়সের কোন অধিকার নেই বাঁধা দেওয়ার। আপনার ছেলে আপনায় দিয়েছে সেখানে বয়স কেন আটকাবে।

তারপর মেঘ আস্তে আস্তে লাগেজ থেকে সবার জন্য আনা জিনিস গুলো বের করলো। সব গুলো জোনাকির হাত দিয়েই সবাইকে দেওয়ালো। জোনাকিও সব সুন্দর ভাবে সবার হাতে তুলে দিলো। সে এমন ভাব করলো, যেন কেউ বুঝতে না পারে, সে এই গিফটের বিষয়ে কিছু জানতো না। সবার জন্যই মেঘ তাঁদের স্বপ্নের জিনিস গুলো এনেছে। জাহানারা বেগমের জন্য, একটা নিল শাড়ি! তাঁর না পাওয়ার সব থেকে আফসোস একটি নিল শাড়ি। অভাবের তাড়নায় সেই স্বপ্ন সে ভুলে গেছে অনেক আগেই। একদিন বলেছিলো জোনাকিকে, সেই বোধহয় মেঘকে বলেছে। খুশিতে ডগমগ হয়ে এলো জাহানারা বেগমের চোখমুখ। দেলোয়ার হোসেনের জন্য এনেছে একটি সাউন্ড বক্স। যেটায় সে নিজের ইচ্ছে মতো ওয়াজ, গজল, গান শুনতে পারবে। অনেক শখ ছিলো তাঁর এমন একটি জিনিসের! কিন্তু যখন কেনার সামর্থ্য ছিলো, তখন বাড়িতে কারেন্ট ছিলো না। কিন্তু এগুলো কারেন্ট ছাড়া কিভাবে চলবে। তাই আর কেনা হলো না। এখন বাড়িতে কারেন্ট থাকলেও এই বয়সে এসে ছেলেমানুষী করা মানায় না। তাই আর কেনা হয়নি। এইরকম সবারি জন্য কিছু না কিছু তাঁদের পছন্দের জিনিস মেঘ নিয়ে এসেছে। সব বাচ্চাদের জন্য চকলেট, কেক, রং পেন্সিল, গল্পের বই আরো অনেক কিছু। সবাইকে সব কিছু দিতেই সবাই চলে গেলো। সবার মুখেই লেগে ছিলো হাসি। সেই হাসিতে কোন স্বার্থ নেই, সেই হাসিতে লেগে ছিলো প্রাপ্তি। সবাই যেতেই জোনাকি বললো–

_ কিছু কথা আছে খালপাড়ে চলুন।

_ চলো।

——————

জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে খালের পাড়। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় পানিতে শব্দ হচ্ছে ছলাৎছলাৎ। চাঁদের কিরণে ঝলমলিয়ে উঠেছে খালের পানি। দেখতে ভিষণ মিষ্টি লাগছে। কিছু বুনো ফুলের গন্ধ মো মো করছে চারিপাশ। দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁক। মাথার উপরে কোন গাছে ডাকছে ভুতুম। এমন ভালো লাগা হয়তো আর কখনো লাগেনি মেঘের। ভালো লাগা বুঝি এভাবেই ধরা দেয়। নেওয়ার মাঝে মেঘ তৃপ্তি দেখেছে, কিন্তু আজ দেওয়ার মাঝে পেলো। এই তৃপ্তির সাথে সে প্রথম পরিচিত! কিন্তু তাঁর এতো ভালো লাগছে সে বলে বোঝাতে পারবে না। জোনাকি তাঁকে খালপাড়ে আসতে বললেও, সে এখনো আসেনি। কখন আসে কে জানে। তাই মেঘ খালের পাশেই ছোট্ট একটা বেঞ্চি পাতা সেখানেই বসলো। সে বসতেই জোনাকি তাঁর সামনে দাঁড়ালো।

_ এসব কি?

_ কোন সব।

_ সবাইকে গিফট দেওয়া।

_ তাতে কি হয়েছে, আমি তাঁদের জামাই আমি তাঁদের গিফট দিতে পারি না।

_ কেন পারেন না, একশোবার পারেন, হাজারবার পারেন। কিন্তু যে গিফট গুলো দিলেন, সেগুলোর কথা তো আপনার জানার কথা নয় তাহলে?

_ আমি তখন তোমায় বলেছিলাম, তোমার কিছু গোপন কথা আমি পড়ে ফেলেছি সরি।

_ তারমানে আপনি আমার ডায়েরি পড়েছেন।

_ হুম

_ আল্লাহ কখন?

_ সেদিন রাতে, যেদিন তুমি ছাঁদে গিয়েছিলে। ভয় নেই শুধু তোমার পরিবারের আবদারের পাতাটা পরেছি, অন্য কোন পাতা পড়িনি। ওসব তোমার পার্সোনাল, তাই পড়ার জন্যও পার্সোনাল মানুষ হওয়া দরকার। আমি এখনো তোমার ভেতরের মানুষটা হতে পারিনি। আমি তোমার ডায়েরি পড়ে তোমার মনের মতো হতে চাই না। আমি আমার মতো করে তোমার মনের মতো হতে চাই। কৌতুহল থেকে উপরের পাতাটা পড়ে ফেলেছি সরি।

জোনাকি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘের পাশে বসলো। মাঝে অনেকটা ফাঁকা রেখেই বসলো। মাটিতে চোখ রেখে বলতে রইলো–

_ আমার নানু কিছু রেখে যেতে পারেনি মায়ের জন্য একটা নাকফুল ছাড়া। মায়ের খুব পছন্দ ছিলো নাকফুলটা। সে নিজের সব কিছু দিয়ে নাকফুলটা আগলে রাখতো। নিজের নাকে পড়তে চাইলে মুরুব্বিরা বললো, মায়ের নাকফুল মেয়ে পড়লে দুঃখ ছাড়ে না। এটা কুসংস্কার তবুও মা মেনেছিলো। নাকফুলটা আমার জন্য রেখে দিয়েছিলো। কিন্তু বাবা সেটা বিক্রি করে দেয়। মায়ের আরো গয়না বাবা বিক্রি করেছিলো! কিন্তু নাকফুলটা বিক্রি করায় মা খুব কষ্ট পেয়েছিলো, এমন কি মা দু’দিন কষ্টে মুখে ভাত তুলতে পারেনি। কথাটা মামি আমায় বলেছিলো। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম! মা’কে আমি একটা নাকফুল কিনে দেবো। কিন্তু আপনি সেই আশাটা পূরণ হতে দিলেন না।

_ আমি দেওয়া আর তুমি দেওয়া কি আলাদা জোনাকি। মানছি তুমি আমায় মেনে নিতে পারছো না, কিন্তু এমন তো নয় তুমি আমায় ছেড়ে দেবে। আল্লাহ যদি চান সব ঠিক হলেই তো আমি তুমি আমরা হবো। তাহলে কেন এতো দ্বিধা।

_ সে আপনি বুঝবেন না।

_ আমি বুঝতেও চাই না। আমি চাই আমার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলো ভালো থাকুক বেস এতোটুকু।

মেঘের এমন কথায় আর কোন কথা খুঁজে পেলো না জোনাকি। তাই সে চুপ করেই রইলো। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ বসে রইলো। নীরবতা কাটিয়ে মেঘ বললো–

_ আন্টি আঙ্কেল আলাদা কেন ছিলেন জোনাকি।

জোনাকি অবাক হলো না এমন প্রশ্নে। সে খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো।

_ বাবা ব্যবসায় অনেক লস করে। দেনা হয়ে যায় বাজারে। নিজের সব কিছু বিক্রি করে ধারদেনা শোধ করে। তারপর আর ঘুরে দাঁড়ায়নি। সারাদিন পাড়ায়, বাজার দোকানে ঘোরাঘুরি করতো। দাদা ভাবলেন বিয়ে দিলে যদি ভালো হয়। কিন্তু ভালো হওয়ার বদলে দিনকে দিন খারাপ হতে রইলো। একসময় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়লো বাবা। নিজের দাদার সব কিছু বিক্রি করে নেশা করতো। মা অনেক চেষ্টা করেও পারেনি তাঁকে ফেরাতে। এক সময় বাবা মায়ের গহনা নিয়েও নেশা করে। মা বাঁধা দিলে অনেক মারধর করতো। মামাদের একমাত্র বোন ছিলো মা। তাই আমার তিন বছরের সময় মা’কে মামারা নিয়ে এলো। আস্তে আস্তে বাবা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন! কিন্তু তখন সময় গড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মা আর বাবা-র সংসারে ফিরে যায়নি। আর দেলোয়ার মামাও চাননি মা ফিরে যাক। মামার কথা ছিলো, যে বয়সে স্বামীর সঙ্গ দরকার ছিলো তাঁর বোনের, তখনই যখন সে ভালোবাসার বদলে কষ্ট দিয়েছে! তাহলে এখন ফিরে কি লাভ। কিন্তু বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মায়ের সাথে যা হয়েছে তা আমি নিজের চোখে দেখিনি, তাই উপলব্ধি করতে পারি না। তাই বাবা-র প্রতি আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ কিছুই নেই। এর বাহিরে আমি কিছু জানি না। হয়তো আরো কিছু আছে, নাহলে এই জন্য মা বাবাকে ছেড়ে চলে আসতো না! আমার মনে হয়। আমি জানতে চাইনি। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, শুধু বলেছিলো মায়ের খুব দামি জিনিস বাবা নষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু কি সেটা বলেনি। তাই আমারও জানা হয়নি।

_ কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তর অজানাই থাক! এতে হয়তো সবারি ভালো। পিছনে যা ঘটে গেছে তা পিছনেই ফেলে রাখো। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কখনো কখনো অতীত ভুলে যেতে হয়। মনে রেখো যা পাওনি, তা তোমার নয়! যা পেয়েছো তা তোমারি ছিলো তাই সেটা হারায়নি। সব কিছুর জন্যই আলহামদুলিল্লাহ।

চলবে,,,