অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-০৯

0
1

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৯

টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো আকাশ থেকে। দকমা হাওয়ায় জানালার পর্দা উড়তে রইলো। হাওয়ার বেগ একটু বেশি হতেই বারি খেতে রইলো জানালা। শব্দ হলো ধরাম ধরাম। হাল্কা শীত শীত, সাথে তীব্র শব্দে ঘুম ছুটে গেলো জোনাকির। আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকাতেই অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা হলো না। তখনই বিজলি চমকে উঠতেই তাঁর আলোয় কিছু সময়ের জন্য সব পরিষ্কার দেখা গেলো। সবটা পরিষ্কার হতেই জোনাকি বুঝতে পারলো পাশে মেঘ নেই। ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে আগে জানালা বন্ধ করলো। তারপর বারান্দা থেকে শুরু করে পুরো ঘরে খুঁজলো মেঘকে। কিন্তু মেঘ কোথাও নেই। বাকি দেখা দু’টো রুম, এক রুমে জোনাকির মা, অন্য রুমে মামা-মামী। কিন্তু ওদের ঘরে মেঘের যাওয়ার কথা নয় বা যাবেও না! তাহলে গেলো কোথায়? বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, সাথে বাতাস আর বিজলী। এই ভয়াবহ সময়ে কোথায় মেঘ? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই জোনাকির ভয় হলো। কোন রকম নিজেকে সামলে বড় ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। একি সদর দরজা তো খোলা। সদর দরজার সামনেই বড় ঘর, যে ঘরে অতিথি, মেহমানরা বসে গল্প করে। তার ডান পাশে জোনাকির ঘর এবং ছোট্ট বারান্দা, বাম পাশের দু’টো রুম, একটিতে জোনাকির মা এবং মামা-মামী থাকেন। উপরে পাটাতন। কিন্তু সেখানে এখন ধানের বস্তা ছাড়া কিছু নেই। তাহলে কি লোকটা এই বৃষ্টিতে বাহিরে আছে। এ কথা ভেবেই জোনাকির কেন জানি ভয় বারতে রইলো। সে কোন রকম একটি ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলো খালপাড়ে কারো উপস্থিতি। নিজের এলাকা, তাই ভয় কম কৌতুহল বেশি ছিলো জোনাকির। পিছন থেকে যতোটা বুঝলো, এটা মেঘ। কোন রকম হাঁটার গতি বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এলো জোনাকি। কিছুটা সামনে আসতেই পুরোপুরি শিউর হলো সে। হ্যা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা মেঘ। কিন্তু এতো রাতে সে এখানে কি করছে, তা-ও বৃষ্টিতে ভিজে। মেঘের একদম কাছাকাছি গিয়ে মেঘের পিঠে হাত দিলো। হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে মেঘ ঘুরে তাকালো। সে চমকায়নি, খুব স্বাভাবিক ভাবে জোনাকির দিকে তাকিয়ে আবারও মুখ ফিরিয়ে খালের পানিতে তাকালো। যেখানে নদীর জোয়ারভাটা এবং বৃষ্টির পানি এক হচ্ছে। বড় বড় গোল বৃত্তির মতো আকার হয়ে প্রতিটা ফোঁটা নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে। নৃত্য করছে মনের মতো। কয়েক সেকেন্ডে মিশে যাওয়া এই নদীর পানি আর বৃষ্টির পানি কেউ আলাদা করতে পারবে না। বোঝাই যাবে না, কোনটা নদীর পানি, কোনটা বৃষ্টির। এমন অপরূপ দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত মেঘ। ওদিকে ঝড়ের বেগ কমার বদলে বারতে রইলো। মেঘের কোন ভাবান্তর না দেখে জোনাকি বললো

_ এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন ঠান্ডা লেগে যাবে তো? আর কখন এলেন এখানে! কোন সমস্যা?

কিন্তু মেঘ বলতে পারলো অনেক বড় সমস্যা। আর সেই সমস্যার সমাধান একমাত্র তুমি। কোন রকম নিজেকে সামলে বললো।

_ ভালো লাগছিলো না, তাই এখানে এসেছিলাম! কিন্তু কখন বৃষ্টি এলো বুঝতে পারিনি।

_ সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু বৃষ্টি দেখে ঘরে যাননি কেন? দেখুন তো কিভাবে ভিজে গেছেন। যাক বাদ দিন, চলুুন ভেতরে চলুন কাপড় পাল্টে নিন।

_ তুমি ঘরে যা-ও, আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো।

_ কেন বুঝছেন না, এতোদিন আপনি অন্য দেশে ছিলেন, হঠাৎ এখন বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ হবে।

_ আমেরিকাও বৃষ্টি হয়।

_ জানি, কিন্তু সেই বৃষ্টিতে ভেজার কোন গতি থাকে না। শীতকালে বৃষ্টি, আরে ভাই জৈষ্ঠ্যমাসের আম কাঁঠাল পাকার গরমেও একটু বৃষ্টিতে ভিজলে হাঁচি শুরু হয়, সেখানে শীতকালে বৃষ্টি আল্লাহ মাফ করো। চলুন চলুন। কথাটা বলেই মেঘের হাত ধরে টেনে বাড়িতে গেলো। ঘরে নিয়ে গিয়ে লাগেজ থেকে জামাকাপড় বের করে দিয়েই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো জোনাকি। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো সর্ষের তেল নিয়ে। মেঘের সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো।

_ হাতে, পায়ে, বুকে এবং মাথায় দিন।

জোনাকির কথায় কোন কথা বললো না মেঘ, সে চুপচাপ সেটাই করলো যেটা জোনাকি বললো। কিন্তু জোনাকি যখন বললো-

_ এবার ঘরে চলুন।

_ আমি তোমার ঘরে যাবো না জোনাকি।

মেঘের কথায় অনেকটা অবাক হলো জোনাকি। কোনরকম নিজেকে সামলে বললো।

_ কেন, আর কোথায় ঘুমাবেন।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে মেঘ বললো

_ বড় ঘরে। এখানে অনেক বড় একটা বিছানা পাতা আছে, যদিও বাতাসে বিছানায় কিছু ময়লা পড়েছে। সমস্যা নেই ঝাড় দিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তুমি শুধু মশারিটা টাঙিয়ে দাও। আমি মশারী টাঙাতে পারি না।

মেঘের এহেন কথায় জোনাকি কি বলবে খুঁজে পেলো না। যখন অতিথি মেহমানের বেশি চাপ হয়, তখন ঘুমাতে দেওয়ায় সমস্যা হয়। তাই তাঁর মামা বড় ঘরে একটা বিছানা পেতে রেখেছে। বেশি মেহমান হলে সেখানেই ঘুমায়। কিন্তু মেঘ হঠাৎ ওখানে কেন ঘুমাতে চাইছে।

_ কিন্তু–

জোনাকিকে থামিয়ে মেঘ বললো।

_ প্লিজ প্রশ্ন করো না, মাথাটা ধরেছে, বৃষ্টিতে হয়তো একটু বেশি ভেজা হয়ে গেছে ।

জোনাকি চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। তাই চুপচাপ বিছানা পরিষ্কার করে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে দিলো। মেঘ বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে বললো–

_ প্লিজ জোনাকি, এরপর থেকে ঘুমানোর আগে গায়ে কাঁথা দিয়ে ঘুমিয়েও। তোমার উন্মুক্ত বুক আর পেট দেখে আমি সব সময় নিজেকে না সামলেও রাখতে পারি। আফর্টোরাল আমি পুরুষ মানুষ। বড্ড এলোমেলো লাগছিলো তোমাকে দেখে, তাই পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম বাহিরে। কারণ কন্ট্রোলটা বড্ড বেসামাল! তাঁকে ক্ষণিকের জন্য বেঁধে রাখা যায় আঁটকে নয়। ভেবো না আমি তোমাকে লজ্জা দিতে এই কথা গুলো বলেছি, আমার দ্বারা যেন তোমার কোন ক্ষতি না হয় তাঁর জন্য সাবধানে থাকতে বলেছি। আমি যতো অপরাধ করেছি, তাঁর ক্ষমা পাবো কিনা জানি না! নতুন করে আর কোন অপরাধ করতে চাই না। তাই প্লিজ —

কথা গুলো বলেই মেঘ শুয়ে পড়লো কাঁথা মুড়ি দিয়ে। সে এখন মুখোমুখি হতে চায় না জোনাকির। মনটা এমনই বিষে আছে, আর বিষিয়ে দেওয়ার মানে নেই। নিজের ঘরেই ফিরে যাচ্ছিল জোনাকি। মেঘের কথায় থমকে দাঁড়িয়েছিলো সে। কিন্তু মেঘের কথা গুলো শুনে পুরো বরফের মতো জমে উঠলো। ঘুমের মধ্যে এলোমেলো হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোন পুরুষের মুখে তাঁর এলোমেলো হয়ে থাকাটা শোনাটা কতটা লজ্জার তা এই প্রথম বুঝলো জোনাকি। পিছন ফিরে আর ইচ্ছে হলো না মেঘের চোখে চোখ রাখার। এই মুহূর্তে ঘরে যেতে পারলেই সে বাঁচে। তাই কোন রকমে দৌড়ে ঘরে চলে এলো।

——————–

আলোয় আলোকিত হয়েছে বাড়ি। বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে বলে কথা। আলতাফ হোসেন কোন ছেলের বিয়েতে কমতি রাখেনি, আর নিজের ছেলের বেলায় তো কোন কথাই নেই। আর তাঁর সাথে যোগ হয়েছে ওরা তিন ভাই, তাই এতো এলাহী কান্ড। বাড়ির প্রতিটা মানুষের চোখেমুখে আনন্দ। কোমরে আঁচল গুঁজে বাড়ির মেয়ে বউরা কাজ করছে, সাথে পুরুষেরা। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়েছে স্টেজ। সেখানেই সব পুরুষেরা ঘিরে বসে আছে। পর্যবেক্ষণ করছে কাজের। বাড়ির মেয়ে বউরা হলুদ বাটার ওখানেই হাসিতামাশায় মেতে আছে। বিয়ের এক সপ্তাহের জন্য কাজের লোক রাখা হয়েছে রান্নার জন্য। বউভাতের অনুষ্ঠানের জন্য তো বাবুর্চি আছেই। সব কিছু গুছানো হতেই আলিফকে নিয়ে আসা হলো স্টেজে। একে একে সবাই তাঁকে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। ফর্সা গালে হলুদের ছোঁয়া পেতেই চকচক করে উঠলো তাঁর মুখ। আলিফকে হলুদ লাগানো শেষ হতেই সবাই সবাইকে হলুদ মাখাতে ব্যস্ত। শাপলাকে দৌড় করাচ্ছে রূপ হলুদ দেবে বলে। শাপলা চারিদিকে ছুটছে সে হলুদ মাখবে না বলে। তাঁর ফেসিয়াল করা মুখখানা সে হলুদ মেখে নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু রূপ তাঁর হাতের হলুদ মাখিয়েই ছারবে। ওদের ছুটাছুটি দেখে সবাই হাসাহাসি করছে। হাসতে হাসতে জোনাকির চোখ পড়লো মেঘের উপর। মেঘের ঠোঁটেও তখন হাসি। সেই হাসিতে যে কেউ ঘায়েল হতে পারে। কি সুন্দর সেই হাসি। হাসলেই থুঁতনি ভাগ হয়ে যায়। সবাই তো টোল হাসিতে ঘায়েল হয়েছে, কিন্তু এই প্রথম জোনাকি ঘায়েল হলো থুঁতনির ভাগ হওয়া দেখে। সেদিনের রাতের পর মেঘ খুব কম জোনাকির সামনে এসেছে। কোন প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনি। লজ্জায় জোনাকিও কিছু বলতে পারেনি মেঘকে। পুরো একটা দিন গ্রামে থেকে তাঁরা শহরে ফিরে এসেছে। বাসেও তেমন তাঁদের কথা হয়নি। দুই একটা কথা আর চোখাচোখি হয়েছে এই যা। এবারও হলো তাঁদের চোখাচোখি। জোনাকি যখন মেঘের হাসি দেখতে ব্যস্ত ছিলো তখন মেঘ হঠাৎ জোনাকির দিকে তাকালো। আবারও দুজনার চোখাচোখি হয়ে গেলো। দু’জনেই চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকালো। তাঁদের এই চোখাচোখি হওয়ার মাঝেই রূপ সফল হলো শাপলাকে হলুদ মাখাতে। তাঁর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। আর মুখটা কাচুমাচু করে শাপলা সবার সামনে এলো। শাপলার চুপসে যাওয়া মুখখানা দেখে সবাই আরেক দফা হেঁসে দিলো। এমন হাসি তামাশার মাঝেই শেষ হলো গায়ে হলুদ।

——————–
মেঘ ঘরে এসেই ওয়াশরুমের দিকে পা বারালো। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা। মেঘের বুঝতে বাকি নেই ভেতরে কে? খুব ক্লান্ত লাগছে, শরীরটা ব্যথাও করছে। তাই কোন রকম এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুম নেমে এলো তাঁর চোখে। হঠাৎ চোখেমুখে পানি পড়তেই চমকে চোখ খুললো মেঘ। চোখ খুলতেই সর্দ গোসল করা জোনাকির মুখখানা দেখতে পেলো। চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু পানি, ভেজা চুল। শাড়ির কয়েক জায়গা ভেজা। চুল থেকে ভেসে আসছে শ্যাম্পুর সুগন্ধ। হঠাৎ করে মেঘ ঘোরে চলে গেলো। এভাবে পুরুষের দিকে কোন নারী এগিয়ে গেলে, কোন পুরুষের সাধ্যি আছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার। মেঘও পারলো না। হেঁচকা টান দিয়ে জোনাকিকে মেঘের বুকে টেনে নিলো। মেঘের হঠাৎ আক্রমণে জোনাকি ভয় পেলো। অসময়ে মেঘকে ঘুমাতে দেখে জোনাকি কৌতুহল নিয়ে মেঘের সামনে গিয়েছিলো। তাঁর জ্বর এসেছে কিনা দেখতে। যখনই সে হাতটা বারাবে, তখন মেঘ চোখ খুলে তাকালো। জোনাকির আর সাহস হলো না বারানো হাতটা আরো একটু বারানোর। কিন্তু হঠাৎই মেঘ তাঁকে টান দিয়ে বুকে টেনে নিতেই তাঁর সমস্ত ভাবনা উল্টে পাল্টে গেলো। সে চেয়েও যেন মেঘের থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। একেই বুঝি বলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। জোনাকির ভাবনার মাঝেই মেঘ জোনাকির ঘারের চুলের মাঝে নাক ডুবালো। হামলে নিতে রইলো জোনাকির চুলের সৌরভ। জোনাকি নামম নেশা আরো গারো হতেই জোনাকির কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল মেঘ। শিউরে উঠলো জোনাকি। হঠাৎই জোনাকির শরীর কাঁপতে রইলো ভয়ানক ভাবে। জোনাকি কাঁপছে দেখেই মেঘ নিজের হুঁশে এলো। কোনরকম জোনাকিকে ছেড়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। একটু আগের ঘটনার জন্য তাঁর আফসোস হতে রইলো। যতোই সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে চাইছে, ততোই যেন জোনাকির নেশায় মাতাল হয়ে যাচ্ছে। কি ভাবলো জোনাকি। রাগের মাথায় মেঘ দেয়ালে আঘাত করলো। ধুপ করে শব্দ হতেই জোনাকি আবারও কেঁপে উঠলো। মেঘ তৎক্ষনাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুটা পথ যেতেই দাঁড়িয়ে পড়লো, জোনাকির দিকে না তাকিয়েই বললো।

_ বলেছিলাম এভাবে আমার সামনে এসো না, তবুও কেন কথা শুনছো না জোনাকি। আমাকে এভাবে তোমার কাছে অপরাধী বানিও না। আমি তোমার চোখে আমার জন্য ভালোবাসা না দেখতে পারলেও! আমার জন্য ঘৃণা দেখতে পারবো না। তাই দোহাই তোমার এভাবে আর কখনো আমার সামনে এসো না।

কথা গুলো বলেই মেঘ গটগট করে বেরিয়ে গেলো। জোনাকি তখনও বিছানার এক কোণে ঘাপটি দিয়ে বসে রইলো। সে তো ইচ্ছে করে তাঁর সামনে যায়নি। জ্বর এসেছে কিনা সেটাই দেখতে গিয়েছিলো। কে জানতো এমন হবে। হঠাৎ জোনাকি নিজের কপালে হাত রাখলো। চোখ বুঁজে অনুভব করতে রইলো স্বামীর প্রথম ছোঁয়া। ভুল বসত ছোঁয়াটা মেঘ দিলেও সেই ছোঁয়ায় ভালোবাসা ছিলো। অতিরিক্ত ভয়ে তখন সেটা না বুঝলেও এখন ভালোই বুঝতে পারলো জোনাকি। মানুষটা সত্যিই তাঁকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু এতো সহজে কি আর সব মেনে নেওয়া সম্ভব। সাত বছরটা কম সময় নয়।

————-

সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদের উদ্দেশ্যে হাঁটছে মেঘ। নতুন বর-বউ নিয়ে সবাই ছাঁদেই আড্ডা দিচ্ছে। সে বরযাত্রী নিয়ে বাড়ি ফিরেই এক বন্ধু সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। বাড়িতে ফিরে জানলো, সবাই ছাঁদে আড্ডা দিচ্ছে। হাত ঘড়িটা সামনে তুলে ধরতেই দেখলো সময় পৌনে বারোটা। গেছে কাল থেকে জোনাকিকে অনেক এভয়েড করেছে সে। কাউকে এভয়েড করাও যে কত কষ্টের তা মেঘ হারে হারে টের পাচ্ছে। সারাজীবন জানতো কেউ এভয়েড করলে বেশি কষ্ট হয়! কিন্তু সেই জানাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সে বুঝলো, কাউকে এভয়েড করা বেশি কষ্টের যখন মানুষটা একান্ত নিজের হয়। একতলা সিঁড়ি বেয়ে দুইতলার সিঁড়িতে পা বাড়াতেই জোনাকির উত্তেজিত কন্ঠ শুনতে পেলো। কানটা খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করলো কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে। যখন বুঝতে পারলো তখন খুব অবাক হলো, বড় ভাইয়ার ঘর থেকে। জোনাকি মনি ভাবিদের রুমে কি করছে তা-ও এই সময়ে। ছাঁদের দিকের এগিয়ে যাওয়া পা-টা পিছিয়ে মনিদের রুমে পা বারালো মেঘ। দরজার সামনে দাঁড়াতেই জোনাকির কন্ঠ আবারও শুনতে পেলো।

_ বড় ভাইয়া আপনি কিছুতেই একজন মায়ের অনুমতি ছাড়া একটা বাচ্চাকে নষ্ট করতে পারেন না। এটা আইন বা ইসলাম কোনটাই মানবে না। আমাদের ইসলামে বাচ্চা নষ্ট করা পুরোপুরি হারাম। আর আপনি কেন ভাবিকে বারবার জোর করছেন বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। বাচ্চাটা ভাবির একার নয়, আপনারও তাহলে?

_ এই বাচ্চা আমি চাই না।

_ আপনি চাওয়া না চাওয়ার কে?

_ আমি এই বাচ্চার বাবা।

_ ঠিক তাই, তাই তো সে পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছেন তাই না?

_ জোনাকি তুমি আমাদের মাঝে কথা বলো না। তুমি বাইরের মানুষ হয়ে আমাদের মাঝে কথা বলতে পারো না।

_ আমি বাইরের মানুষ ভাইয়া।

_ হ্যা বাইরের মানুষ, আজ আমার ভাই ডির্ভোস দিলে কাল এই বাড়ি থেকে তোমায় বেরিয়ে যেতে হবে ভুলে যেও না।

পলাশের কথায় চমকে উঠলো জোনাকি। মনি খাটের কোনে বসে আছে, তাঁর চোখ ভেসে যাচ্ছে নোনাপানিতে। পলাশের এহেন কথায় তাঁর কষ্ট আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। তাঁর হয়ে কথা বলার জন্যই তো জোনাকিকে পলাশ এতো বড় কথা বললো। ঠিক আছে এই বাচ্চা নিয়ে সমস্যা তাহলে এই বাচ্চাই থাকবে না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মনি। চোখের পানি মুছতেই আরো এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো সে। এবার আর সেই পানি মুছলো না। পলাশের উদ্দেশ্যে বললো।

_ সমস্যা তো এই বাচ্চা নিয়ে, ঠিক আছে আমি নষ্ট করে দিবো এই বাচ্চা। তবুও তুমি জোনাকিকে আর কিছু বলো না। এই কথা মেঘ শুনলে খুব কষ্ট পাবে। সে এটা মেনে নিতে পারবে না, তাঁর ভাই তাঁর স্ত্রীকে এই কথা বলছে।

_ স্ত্রী, মাই ফুট। যদি স্ত্রী বলেই মানতো তাহলে বিয়ের রাতে পালিয়ে যেতো না।

_ পলাশ।

আর কোন কথা খুঁজে পেলো না মনি। অসহায় চোখে জোনাকির দিকে তাকালো। জোনাকি নিজের চোখের পানি লুকিয়ে ঘর ছেড়ে যেতে নিলো। হ্যা সত্যিই তো আজ মেঘ যদি তাঁকে ডির্ভোস দেয় কি সূত্র ধরে এই বাড়িতে থাকবে। তাঁর উচিত হয়নি এতোটা রিয়াক্ট করা। কোন রকম নিজের কষ্ট চাপিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু দরজায় মেঘকে দেখে তাঁর কষ্ট যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে আসতেই মুখ থেকে কেমন একটা আওয়াজ হলো। সে কোন রকম মেঘকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই মেঘ আঁকড়ে ধরলো জোনাকির হাত। হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বাহুতে টেনে নিলো। তারপর এগিয়ে গেলো ভাইয়ের সামনে। হঠাৎ মেঘের উপস্থিতি দেখে ভরকে গেলো পলাশ। মেঘ ভাইয়ের সামনে এগিয়ে দাঁড়ালো। তারপর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো।

_ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে জানিস ভাইয়া! সে আমার স্ত্রী। আমার সুখ দুঃখের সাথী। আমার বা-পাজরের অংশ। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা করা জীবন সঙ্গী। তাঁকে সম্মান না করতে পারিস, কিন্তু অসম্মান করবি না। অন্যায় করেছি তাই ফিরে এসেছি। যদি ডির্ভোস দিতে আসতাম, তাহলে আমি আসতেই জোনাকিকে তাড়িয়ে দিতাম। বাড়ির প্রতিটা মানুষ জানে, আমি সব নতুন করে শুরু করবো। শুধু তুই জানিস না হয়তো। জানিস না বলেই এতো বড় একটা কথা আমার স্ত্রীকে বলার সাহস পেলি। আজ তুই আমার বড় ভাই নাহলে বুঝতেই পারছিস কি হতো এখানে। বাকি রইলো অনাগত সন্তানের কথা। তুই কে তাঁকে মেরা ফেলার। তুই তাঁকে দশমাস গর্ভে নিবি, নাকি মৃত্যু যন্ত্রণা সয্য করে তাঁকে জন্ম দিবি। একটা সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে আল্লাহর হুকুম, রহমত আর একজন মায়ের প্রয়োজন। হ্যা একজন বাবা-র প্রয়োজন কিন্তু! মায়ের যদি ৯৫% দরকার হয় বাবাকে দরকার মাত্র ৫%। তাহলে ভেবে দেখ ওই সন্তানের প্রতি কার বেশি অধিকার। তোর নাকি ভাবির। আরে সন্তান জন্ম দিতে ভাবির সমস্যা হবে তোর না। পাঁচ মাস মুখে ভাবি খাবার তুলতে পারবে না। দশ-টা মাস নিজের ইচ্ছে মতো ঘুমাতে পারবে না। তিনটা মাস ঠিক মতো হাঁটতে পারবে না। পাঁচটা মাস নিচু হতে কষ্ট হবে। হাত পায়ে পানি এসে বিচ্ছিরি দেখাবে। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে একটি প্রান বাঁচিয়ে রাখবে। সব শেষে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে মা হবে। এখানে অবদান কার বেশি তোর না ভাবির। তাহলে তুই কোন অধিকারে ভাবিকে বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলিস। আর রইলো বাকি তোর আসল সমস্যা। তুই না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি তোর মতিগতি দেখে। তোর অফিসের কলিগ এখনো অবিবাহিত তাই তাঁর মাঝে তুই সৌন্দর্য খুঁজে পাস। সে এখনো কারো দায়িত্ব নেইনি, তাই তাঁর মাঝে কোন ক্লান্তি নেই। সে কারো খাবারের খবর নেয় না, তাই তাঁর শরীর এতো ফিট্। তোর, তোর পরিবারের, তোর সন্তানের নিয়ম মতো খাবারের দায়িত্ব ভাবির কাঁধে! তাই সে নিজের খাবার খাওয়ার কথা ভুলে যায়। দিনরাত কাজের মানুষের মতো ভাবি তোর সংসারের জন্য খেটেখুটে মরছে, তাই তাঁর চেহারায় উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে। তোর সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে নিজের শরীরের অর্ধেক এনার্জি নষ্ট করেছে, তাই তার মাঝে তুই আগের মতো তৃপ্তি পাস না। তাহলে ভেবে দেখ তো ভাবির এই অবনতির জন্য কে দায়ি? সে নাকি তুই। ভেবে বলিস। ভেবে কোন সঠিক উত্তর পেলে আমায় জানাস। যদি উত্তরটা যুক্তিপূর্ণ হয়, আমি নিজে দাঁড়িয়ে তোর আর তোর অফিস কলিগের বিয়ে দিবো। আর ভাবি, তাঁর কথা তোর চিন্তা করতে হবে না। আমার স্ত্রী আর পরিবারের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো। আর আমার পরিবারের মধ্যে ভাবিও আছে। চলো ভাবি।

মেঘ দুই হাতে দুই রমনীকে টেনে নিয়ে এলো। একটু আগেও তাঁদের চোখে পানির ছোঁয়া ছিলো, এখন সে চোখে একরাশ মুগ্ধতা ভর করেছে। মানুষ চাইলে কি না পারে। এই জন্যই বুঝি বলে, যে কথা বলতে জানে, সে কথা বলাতেও জানে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। কারণ সময় যখন কথা বলে, বাকি সবাই সেখানে কলাগাছ হয়ে পড়ে থাকে। মেঘের রুমের সামনে এসে দু’জনের হাত আলগা করে দিলো মেঘ। ঘুরে তাকালো দুজনার দিকে।

_ বাড়িতে একটা খুশির অনুষ্ঠান চলছে। আমি চাইনা তোমাদের বিষাদ ভরা মুখ দেখে কেউ প্রশ্ন করুক। নিজেদের স্থীর করে ছাঁদে এসো। আর হ্যা অবশ্যই মুখে হাসি নিয়ে আসবে। কিন্তু কোন প্লাস্টিকের হাসি নয়, প্রাকৃতিক হাসি। কারণ ওই ঠোঁটের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে হাসি। আমি চাইনা সেটা কখনো হারিয়ে যাক। আমি যাচ্ছি, তোমরা এসো।

মেঘ চলে যেতেই একরাশ ভালোলাগা ঘিরে ধরলো জোনাকিকে। মানুষটা দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। নিজের পরিবার, স্ত্রী এবং স্ত্রীর পরিবারের। এই তো ফেরার দিন গোপনে মামার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো।

_ মামা এই টাকাটা জোনাকির হাতে দিয়ে বলবেন, তাঁর দেওয়রকে কোন গিফট কিনে দিতে। আমার পরিবার এবং জোনাকি জানবে আপনি দিয়েছেন। তাহলে জোনাকি বড় মুখ করে বলতে পারবে, সমস্যার জন্য তাঁর পরিবার আসেনি তো কি হয়েছে, আত্মীয়দের পাওনা তো তাঁদের পাঠিয়ে দিয়েছে।

মেঘের এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে দেলোয়ার। তাঁর চোখের পানি লুকিয়ে সে মেঘকে জড়িয়ে নিয়েছিলো। সেইসব কিছু দেখে নিয়েছিলো জোনাকি। মানুষটার মাঝে এতো ভালো একটা সত্তা লুকিয়ে ছিলো, অথচ সে নিজেই জানতো না।

_ সত্যি মেঘ পাল্টে গেছে তাই-না জোনাকি।

হঠাৎ মনির কথায় জোনাকি ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। কোন রকম নিজেকে সামলে বললো।

_ হুম।

চলবে,,,