তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-০৫ এবং বোনাস পর্ব

0
24

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৫

কাজে মন দিতে পারছে না রোজা, নিষাদের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত না প্রত্যাখ্যান করা উচিত তাও ভেবে পাচ্ছেনা। সুজানার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়েই আলাপ করেছে রোজা, সবটা শোনার পর সুজানা বলে…

‘ সবাই তোকে দোষী করেছে, সেখানে এই ছেলে তোর কোনো দোষ না দিয়ে সরাসরি তোকে বিয়ে করতে চাইছে। আমার তো মনে হয় ছেলেটার মন অনেক ভালো, তোকে বেশ পছন্দও করে ‘

‘ উনি ছেলে হিসেবে ভালো সেটা আমিও বুঝি, ওনার সঙ্গে অল্পদিনের আলাপ হলেও তা বোধ করেছি আমি কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কি করা উচিৎ ‘

‘ তুই কি ওনাকে পছন্দ করিস?’

‘ পছন্দ বলতে তেমন কিছুনা, বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছিলো। কয়েকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, ভালো লাগে আর কি। তুই তো জানিসই সবটা ‘

‘ হুম, তুই তো বলেছিলি সে নাকি বেশ ডিসেন্ট টাইপের। দেখ আমার মনে হয় তোর এই বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত, হতে পারে এর মাধ্যমেই তোর বাবার রাগ তোর ওপর থেকে পড়ে গেলো’

‘ কিন্তু, নিষাদের পরিবারের লোক ওনার জন্যে মেয়ে দেখছে এ অবস্থায় আমি রাজি হলে উনি ওনার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে…’

‘ সেসব তোর ভাবার দরকার নেই, তুই নিজের দিকটা ভাব। সে যখন তার পরিবারের আপত্তি জেনেও স্বেচ্ছায় এগিয়েছে তাহলে তোর এগোতে সমস্যা কোথায়? আমার মনে হয় বিয়েটা করলে মন্দ হবেনা ‘

রোজা চিন্তায় কপাল চেপে ধরলো, মাথায় ব্যথা হচ্ছে মেয়েটার!

‘ আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে মোটেও নেই রে, কিন্তু…’

‘ আমি বুঝতে পারছি রোজা। বিয়েটা সারাজীবনের সিদ্ধান্ত, আর তোর সঙ্গে একটা অঘটন ঘটেছে। তার জন্যে তোর পরিবার তোকে বাড়ি থেকে বের করেছে বিয়ে ভেঙেছে তোর। সবকিছু ভেবে তুই এবার সিদ্ধান্ত নে কি করবি, তবে আমার মনে হয় বিয়েটা করাই ভালো হবে তোর জন্যে ‘

ভাবনায় পড়লো রোজা, মায়ের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে নাকি আগে নিষাদের সঙ্গে কথা বলবে এ নিয়েই দারুন দোটানায় পড়লো তবে সুজানা ওকে আশ্বাস দিচ্ছে নিষাদের প্রস্তাবে রাজি হওয়াই ভালো হবে। ওদিকে…গেস্টদের সঙ্গে কথা বলছিলো আদনান, এখন আংটি বদল শুরু হবে। সবাইকে স্টেজের দিকে ডাকা হচ্ছে। আদনান হেঁটে যেতে যেতে হাতঘড়ির দিকে তাকালো, পাশ থেকে তানভীর বললো…

‘ বারবার ঘড়ি দেখছিস যে? কারো অপেক্ষায় আছিস?’

‘ ইয়াহ! আমার হবু বৌয়ের জন্যে একটা গিফট আসার কথা। সেটা আসার সময় হলো কিনা চেক করছি ‘

‘ কি বলিস? গিফটও রেডি করেছিস তুই? একটা টি শার্ট কিনতে গেলেও তো আমাকে সঙ্গে যাওয়ার জন্যে কল করে পাগল করে দিস। সেখানে হবু বউয়ের জন্যে গিফট রেডি করলি আমি জানতেই পারলাম না?’

‘ আমার হবু বৌয়ের জন্যে আমি গিফট রেডি করবো। তুই তো পর পুরুষ, তুই জেনে কি করবি?’

‘ বাহ বাহ! বন্ধু হওয়ার কি দারুন প্রতিদান দিলি! সাহায্যই তো করতে চেয়েছিলাম তার জন্যে এভাবে বলতে পারলি?’

প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসলো আদনান, হেঁটে গিয়ে স্টেজে গিয়ে দাঁড়ালো ও। ওর বাগদত্তাও এলো, মেয়েটার আনন্দ যেনো চোখমুখ দিয়ে উপচে পড়ছে। আদনানও মেয়েটার সঙ্গে সায় দিচ্ছে, অতিথিরা সবাই একজোট হলেন। আংটি বদলের অনুষ্ঠান শুরু হলো, তখনই এক ছেলের আগমন ঘটলো। ছেলেটাকে দেখে আদনানের বাগদত্তা চমকে ওঠে, কিন্তু আদনান এতক্ষণ ওর অপেক্ষাতেই ছিলো। ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার বহু পুরনো সম্পর্ক, মেয়েটা ছেলেটাকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলো। মেয়েটার উদ্দেশ্য ছিলো বিয়ের পরও নিজের প্রেমিকের সঙ্গে পরকীয়া চালিয়ে যাবে। আদনানের কিছুটা সন্দেহ হওয়ায় বাবা বিয়ে ঠিক করার পর আদনান মেয়েটার ব্যাপারে সবকিছু খোঁজ নিয়ে বের করে। মেয়েটা ছেলেটাকে যে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছে আদনান তার দ্বিগুণ টাকা দিয়ে ছেলেটাকে বলে এই এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠানে এসে ঝামেলা করতে। যদিও ছেলেটা শুরুতে রাজি হচ্ছিলো না পরে আদনান আরো বেশি টাকা অফার করতেই আর সে টাকার লোভ সামলাতে পারেনি।আদনান আগে থেকেই সব প্ল্যান করে নিয়েছিলো, ছেলেটাকে সে হিসেবে সব বুঝিয়েও দিয়েছিলো। টাকার লোভে পড়ে ছেলেটাও রাজি হয়ে যায়, যে প্ল্যান ছিলো সে অনুযায়ীই কাজ হয়েছে। ছেলেটা এসে এই অনুষ্ঠানে ব্যাপক ঝামেলা তৈরি করে, সবার সামনে নিজেকে ওই মেয়েটার প্রেমিক বলে দাবি করে। ভরা অনুষ্ঠানে মোটামুটি উভয় পক্ষেরই বেইজ্জতি হয়, মেয়েটার বাবা সবকিছু থেকে বাঁচতে মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসে ওখান থেকে। অতিথিরাও ভীষণ অসন্তুষ্ট, কিন্তু এনায়েত সাহেব ঠিকই বুঝেছেন এটা কার কাজ! ছেলেকে স্টেজ থেকে টেনে নামিয়ে একপাশে এনে উনি বলেন…

‘ এসব তুই ইচ্ছে করে করলি তাইনা?’

‘ আমি কিছুই করিনি বাবা, মেয়েটা প্রেমিক থাকা সত্বেও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। এখন ওর প্রেমিক এসে সিন ক্রিয়েট করলো এটা ওদের দোষ’

‘ আমার সঙ্গে গেম খেলিস না আদনান, এখানে যা হলো তাতে সবাই শকড শুধু তুই ছাড়া। তারমানে তুই সব জানটি এখানে কি হবে ‘

উত্তর দিলো না আদনান। কারণ এনায়েত সাহেব তার ছেলের সম্পর্কে সবই জানেন, এখানে অস্বীকার করে লাভ হবেনা। এনায়েত সাহেব ভীষণ রেগে গেলেন…

‘ তোর বিয়েতে রাজি হওয়ার বিষয়টাই আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিলো, এতো সহজে রাজি হয়ে গেছিলি! এখানে আজ যে ঘটনা ঘটলো তার কতোটা খারাপ ইম্প্যাক্ট পড়বে সেই খেয়াল আছে তোর? মেয়েটার বাবা যে আমাদের ইনভেস্টর সেটা মাথায় আছে?’

‘ সবই জানি আমি, তাই বলে যে মেয়ের বাইরে সম্পর্ক আছে সে বিয়ের পর যে আবারো পুরোনো সম্পর্কে ফিরবে না তার কি গ্যারান্টি?’

‘ থাকলে থাকুক, সেটা তোর দেখার বিষয় না। এখনকার যুগে কেউই লয়াল নয় আদনান, এই বিয়েটা একটা বিজনেস ডিল হিসেবে মেনে নিলেই ঝামেলা মিটে যেতো ‘

‘ আই অ্যাম সরি বাবা, এটা আমার পক্ষে করা সম্ভব হবেনা। যে আমার প্রতি লয়াল নয় তাকে আমি নিজের কাছে রাখতে রাজি নই। সে হোক আমার ভাই, ফ্রেন্ড, কলিগ বা অন্যকেউ। তাছাড়া দুজন ভালোবাসার মানুষ আমার জন্যে আলাদা হয়ে যাবে সেটা আমি মেনে নিতে পারবো না ‘

‘ ইয়ার্কি করিস না আদনান, তুই আজ যা করলি তাতে আমি হতাশ! নিজের বাবার সঙ্গে এমন খেলা খেলতে পারলি তুই?’

‘ বাবা, মেয়েটা যদি বিয়ের পর ওর প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যেতো সেটা কি আমাদের পরিবারের বদনাম হতো না? তার থেকে যা হওয়ার আগেই হয়েছে, এটাই কি ভালো নয়?’

‘ জ্ঞান দিস না আমাকে আদনান!’

‘ বাবা আমি…’

পুরো কথা শেষ করতে পারেনি আদনান, তার আগেই বাবার হাতে থা’প্প’ড় খেলো। অবশ্য এরকম কিছুর জন্যে আদনান আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো, বিয়েটা হলে বিরাট মাপের আর্থিক লাভ হতো কিন্তু সেটা এখন আর হবেনা আর এনায়েত সাহেব অর্থকেই জীবনের সকল কিছুর উর্ধ্বে রাখেন!

‘ আর একটা কথা বলবি না তুই! আজ এখানে কতো মানুষ এসেছিলো দেখেছিস? সবাই কি বলবে? এনায়েত সিদ্দিকী তার ছেলের জন্যে সঠিক পাত্রী নির্বাচন করতে পারেনি। অথচ তুই বিয়ে করতে চাস না বলেই এতো কাহিনী করলি, সবটা মেনে নিলেই আর কিছু হতো না। এখন মনে হচ্ছে তোকে নিজের ছেলেদের থেকেও বেশি বিশ্বাস করাটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে, সুযোগ পেলে তুই শুধু নিজের দিকটাই ভাববি। আমার ভালো মন্দ দেখবি না ‘

আদনান মাথা নিচু করে এনায়েত সাহেবের বলা প্রতিটা কথা শুনলো, এনায়েত সাহেব জন্মদাতা পিতা না হলেও আদনানকে নিজের ছেলের থেকে কোনো অংশে কম মনে করেন না। বিয়ের পর কয়েক বছর সন্তান না হওয়ায় এনায়েত সাহেব ও তার স্ত্রী আদনানকে দত্তক এনেছিলেন, আদনানের বয়স তখন তিন – সাড়ে তিন বছর হবে। ওকে লালন করা অবস্থাতেই এনায়েত সাহেবের স্ত্রী পরপর দুই সন্তানের জননী হন। ফারহান ও ঈশান এনায়েত সাহেবের ঔরসজাত সন্তান। এক যুগ আগে এনায়েত সাহেব ও তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটে, এরপর থেকে ছেলেরা ওনার সঙ্গেই থাকেন। ছোটো থেকেই আদনানকে বেশি স্নেহ ও শাসন করতেন উনি, আদনানকে যেনো নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলেছেন। উনি যেভাবে চালনা করেন আদনান সেভাবেই চলতো, বড় হওয়ার পর আদনানকে এনায়েত সাহেব জানান তিনি ওর আসল পিতা নন। আদনানের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এতো বছর প্রতিপালনের প্রতিদান হিসেবে এনায়েত সাহেবের সব কথা ওকে শুনতে হবে। আদনানও সব আদেশ মাথা পেতে নিতে শুরু করে, কষ্ট হলেও বাবার দেওয়া সব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। আদনান কাজকর্মে পারদর্শী হওয়ায় ওর মাধ্যমে লাভ বেশি হয় দেখে এনায়েত সাহেব ওকেই মাথায় তুলে রাখেন মধ্যে থেকে ফারহান ও ঈশান বঞ্চিত হয়। নিজের ছেলে না হওয়া সত্বেও আদনানের প্রতি এই টান ফারহান মেনে নিতে পারেনা। এই নিয়ে ছোটো থেকেই আদনানের সঙ্গে ওর ঝামেলা চলছে! এনায়েত সাহেব চলে যাওয়ার পর আদনানের কাছে আসে ফারহান…

‘ বাবার এক্সপেকটেশন এভাবে ধুলিস্যাৎ করে দিতে দুবার ভাবলি না তুই আদনান? তুই না বাবার পছন্দের ছেলে?’

স্মিত হেসে ফারহানের কাধ চাপড়ে আদনান বলে…

‘ ইউ আর রাইট ফারহান, আজকে বাবার আশায় পানি পড়ে গেলো আমার জন্যে। বাবা আমার ওপর ভীষন রেগে আছে। এই সুযোগটা তুই কাজে লাগাতে পারিস, হতে পারে বাবা আমাকে ছেড়ে তোর ওপর ভরসা করা শুরু করলো?’

আদনানের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো ফারহান…

‘ অবশ্যই করবো! তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা, আপাতত তুই নিজের চিন্তা কর ‘

‘ ইউ আর রাইট! আই থিঙ্ক আমার এখন নিজেকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত ‘
_______________________________________

বালিশে শুয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরছে রোজা, চোখে ঘুম নেই। মাথায় ঘুরঘুর করছে অনেককিছু, নিষাদের কাছে কিছুদিন সময় চেয়ে নিয়েছে রোজা। এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত একটা নিতে হবে, ওদিকে..বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকক্ষণ হলো বারে এসেছে আদনান, ওয়াইনের গ্লাস ঘোরাতে ঘোরাতে এক ধ্যানে ভেবে চলেছে কিছু। পাশেই বসে আছে তানভীর, বন্ধুকে এই অবস্থায় একলা ছাড়া মোটেও বন্ধুসুলভ কাজ হবেনা বিধায় ওর সঙ্গে এসেছে…

‘ তুই আর বিয়ে! অসম্ভব! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু আঙ্কেলকে এভাবে রাগানো তোর উচিত হলো না ‘

আদনান একবারেই ওয়াইনটুকু পান করে বললো…

‘ বাদ দে ইয়ার! আমি এখন এইসব নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি না, এমনিতেই মাথা ব্যথা করছে ‘

‘ বাদ দিলে তো লাভ হবেনা, বাড়ি ফিরতে হবে তো তোকে। আঙ্কেল মনে হয় না এতো সহজে তোকে ক্ষমা করবে ‘

নিজের ওপরই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদনান, মাঝে মাঝে নিজেকে কেমন ভ্যালুলেস মনে হয় ওর যেনো ও শুধু এনায়েত সাহেবের মর্জিতে চলা এক রোবট যার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা, মন্তব্য বা অনুভূতি নেই!

‘ আই অ্যাম টায়ার্ড তানভীর! বাবা কি ভাববে, বাবা কি বলবে, বাবা কিসে রাগ করবে এসব ভাবতে ভাবতেই লাইফের আটাশ বছরের বেশি সময় পার করে দিলাম। আই কান্ট টেক দিজ এনিমোর!’

‘ তাহলে কি করবি?’

খালি ওয়াইনের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে কিছু সময় মৌন রইলো আদনান, এরপর পকেট থেকে ফোন করে সেক্রেটারি সাদিককে ফোন করে বললো…

‘ সাদিক, তোকে দুইদিন সময় দিলাম। ডা. রোজার সকল ইনফরমেশনের একটা ফাইল রেডি করে আমার ডেকে রেডি রাখবি ‘

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#বোনাস_পর্ব

রোজা ডিউটি শেষ করে হসপিটাল থেকে বেরোতেই একটি গাড়ি এসে থামলো, গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ভেতর বাইরে উঁকি দিলো নিষাদ। রোজা আর নিজেই ওকে ডেকেছিলো কথা বলার জন্যে, কিন্তু নিষাদ যে সোজা ওকে নিতে হসপিটালে চলে আসবে এটা ভাবেনি…

‘ আপনি এখানে কেনো! আমি তো আপনাকে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম ‘

‘ একা ওখানে বসে থেকে কি করতাম? ভাবলাম আপনাকে পিক করে নিয়ে যাই ‘

‘ শুধু শুধু আপনার কষ্ট করার প্রয়োজন ছিলো না ‘

‘ ইটস ওকে, আসুন ‘

রোজা গাড়িতে উঠে বসলো, এরপর কিছু সময়েই দুজনে পৌঁছে গেলো নিজ গন্তব্যে। রোজা নিজের মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে এ বিষয়ে, রোজার মায়েরও একই মত। নিষাদ নিজে থেকে যখন এগিয়েছে, বিয়েটা করে নেওয়াই উত্তম! শেষমেশ রোজাও নিষাদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছে। ওদিকে…আদনানের কথামতো সাদিক রোজার বিষয়ে খবরাদি সংগ্রহ করে বসকে এনে দিয়েছে। আদনান অফিসের কাজ শেষ করে এখন ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত হয়েছে। সাদিক সকল ইনফো লিখে একটা ফাইল বানিয়ে দিয়েছে, আদনান তাতেই নজর বুলাচ্ছে…

‘ ডা. রোজা নিজের কলিগের সঙ্গে থাকে? তার বাড়ি শহরের বাইরে নাকি?’

‘ না বস, এই শহরেই তার বাড়ি। হসপিটাল থেকে তার বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয় ‘

‘ তাহলে কলিগের সঙ্গে থাকে কেনো?’

‘ সেটা তো বলতে পারছি না বস, আসলে অল্প সময়ে যতোটা তথ্য বের করতে পেরেছি আর কি। আপনি বললে সেটারও খোঁজ নিয়ে নেবো ‘

আদনান মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে ব্যস্ত, যদিও এখানে বিস্তর কোনো তথ্য নেই তবে যেটুকু আছে তাই অনেক। এর মাঝে সাদিক বলে বসলো…

‘ আরেকটা জিনিস আছে বস, এখানে লিখতে ভুলে গেছি। একটা ছেলে কিছুদিন যাবত ডা. রোজার সঙ্গে দেখা করতে আসে, আমি যাকে এই কাজে লাগিয়েছি সে কয়েকবার দেখেছে ওনার সঙ্গে ছেলেটাকে একটা রেস্টুরেন্টে ‘

ছেলের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো আদনানের!

‘ ছেলে? কে সে?’

‘ ছেলেটার সম্পর্কে এখনও ডিটেইলস বের করতে পারেনি, শীঘ্রই বের করে এনে দেবে ‘

‘ রেস্টুরেন্টে মিট করছে দুজনে? তারমানে তারা পূর্ব পরিচিত ‘

‘ ওনার প্রেমিকও হতে পারে ‘

‘ তোর এটা কেনো মনে হলো?’

‘ না মানে, আজকাল তো সবারই প্রেমিক থাকে তাই…’

‘ হলে অনেককিছুই হতে পারে, আগে থেকেই কিছু গেস করে বসা উচিত কাজ নয়। ছেলেটার সঙ্গে রোজার কি সম্পর্ক সেটা দ্রুত জেনে আমাকে জানাবি ‘

সাদিক খেয়াল করলো ইদানিং আদনান এই বিষয়ে একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছে, কাজের প্রতি মনোযোগ পূর্বের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে যেখানে পূর্বে কর্ম ব্যতীত অন্যান্য কাজে সময় ব্যয় করা আদনানের পছন্দ ছিলো না। সাদিক সাহস করে বললো…

‘ বস, আপনি এখন এসবই করবেন? আরো কত কাজ বাকি আছে, আপনার বাবা আমাকে সেদিন ডেকে অনেক বকেছে। আপনাকে নাকি ফোনেও পাচ্ছেনা। আমার মনে হয় আপনার কাজের দিকে মন…’

‘ তুই আমার সেক্রেটারি না আমার বাবার?’

‘ আ..আপনার ‘

‘ তাহলে? আমি তোর বস, তুই সেটাই যেটা আমি বলবো। আমার বাবা কি বললো সেটা তোর শোনার দরকার নেই, গট ইট?’

‘ ইয়েস বস ‘

আদনানের সঙ্গে তর্ক করার সাহস নেই সাদিকের, ছেলেটার বয়স কম। পরিবারের হাল ধরতে পড়াশুনা চলমান অবস্থাতেই চাকরির জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিলো, কয়েকটা জায়গায় সেক্রেটারির পোস্টে আবেদন করে লাভ হয়নি শেষ অব্দি আদনান ওকে রাখে। বয়সে অনেকটা ছোটো হওয়ায় সাদিককে “তুই” বলে সম্বোধন করে আদনান। শুধু তাই নয় প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সুবিধাও প্রদান করে, তাই আদনানের মুখের ওপর তর্ক করে এই বস সেক্রেটারির সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না সাদিক! ডিনার শেষে নিষাদ রোজাকে জিজ্ঞাসা করলো…

‘ তো রোজা, কি সিদ্ধান্ত নিলেন?’

রোজা যেহেতু আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলো তাই ওর আর ভেবে সময় নষ্ট করতে হয়নি…

‘ আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি ‘

‘ দেখুন, আমি বলেছি বলেই আপনাকে রাজি হতে হবে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। আপনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন’

‘ জ্বি, আমি সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ বিষয়ে আমি আমার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছি। উনিও এ বিষয়ে সমর্থন করেছেন। তাছাড়া আমি চাই কোনো এক বাহানায় হোক, বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিক ‘

রোজার সম্মতি পেয়ে যেনো স্বস্তি পেলো নিষাদ, স্মিত হেসে রোজার হাতের ওপর হাত রেখে বললো…

‘ থ্যাংক ইউ রোজা, আপনি জানেন না আমি কতোটা ভয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো না করে দেবেন। কিন্তু আমি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আপনাকেই চাই ‘

রোজা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে নিষাদকে, লোকটা সত্যিই এতো পছন্দ করেছিলো ওকে? লোকটা যেনো ওকে বিয়ে করার জন্যে মুখিয়ে আছে, এতকিছু হওয়ার পরও বিয়ে করতে নিজেই এগিয়ে এসেছে। এমন এক পুরুষকে স্বামী হিসেবে পাওয়াই কি সৌভাগ্য? জানা নেই রোজার!
____________________________________

আজ ছুটির দিন, প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে কাছের এক সুপার শপে কেনাকাটা করতে আসে রোজা ও সুজানা। ছুটির দিন ব্যতীত তেমন বাড়তি সময়ও পাওয়া যায়না, তাই সপ্তাহের বাজার করে রাখে। সুজানা আজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে বিধায় লিস্ট নিয়ে রোজাকে একাই আসতে হয়েছে। আজ অবশ্য বড় কিছু কেনার নেই, কিছু মশলাপাতি আর ছোটোখাটো জিনিস নেবে। লিস্ট অনুযায়ী কেনাকাটা শেষে দুই প্যাকেট লিচি চকলেট হ্যান্ড বাস্কেটে নিলো রোজা। রাতে ঘুম না এলে বা কাজের ফাঁকে মুখে লিচি চকলেট রাখাটা ওর পুরোনো অভ্যাস। তখনই পেছন থেকে পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো…

‘ ডাক্তার হিসেবে আপনি তো দেখছি বেশ অসচেতন ‘

ঘুরে তাকালো রোজা! আদনানকে দেখে অবাক হলো বটে! আদনান এগিয়ে এসে রোজার বাস্কেট থেকে একটা প্যাকেট নামিয়ে রেখে বললো…

‘ এই চকলেটে প্রচুর সুগার আছে, যা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো নয় ‘

‘ আপনি এখানে কেনো?’

‘ সুপার শপে আপনি যা করতে আসে আমিও সেই একই কারণেই এসেছি ‘

ভ্রু কুঁচকে নিলো রোজা…

‘ আপনি কি আমাকে ফলো করছেন?’

‘ অফ কোর্স নট, আমাদের দেখা হওয়াটা অ্যা কাইন্ড অফ কো ইন্সিডেন্স!’

‘ ফাইন, তাহলে আপনি নিজের কাজ করুন, আমার বিষয়ে কেনো নক গলাচ্ছেন?’

রোজা আবারো প্যাকেটটা হ্যান্ড বাস্কেটে রেখে হাঁটতে শুরু করলো, বিল পেমেন্ট শেষে সুপার শপ থেকে বেরোতেই আদনানও ওর পেছন পেছন এলো…

‘ আপনি আমার চেকটা কি করেছেন?’

‘ ওটা হসপিটালে আমার কেবিনে আছে, দরকার পড়লে এসে নিয়ে যাবেন ‘

‘ ওহ! তারমানে এখনও ফেলে দেননি ‘

আদনান পাশাপাশি হাঁটছে দেখে থেমে গেলো রোজা…

‘ আপনার সমস্যা কি বলুনতো! সুপার শপে দেখা হওয়াটা না হয় অপ্রত্যাশিত ছিলো কিন্তু এখন যে আমায় ফলো করছেন এ বিষয়ে কি বলবেন?’

‘ আমার সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতেও সমস্যা?’

‘ অবশ্যই সমস্যা, আপনাকে আমি সেদিন কি বলেছি মনে নেই? ভুলে গেলে আরো একবার মনে করিয়ে দেই, আমি…’

‘ ওহ প্লিজ! আমি এক কথা বারবার শুনতে পছন্দ করিনা, বলার প্রয়োজন নেই। বাই দ্যা ওয়ে, আমার আপনি করে বলতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। ক্যান আই কল ইউ তুমি?’

উত্তর দিলো না রোজা। আশেপাশে খেয়াল না করেই ও সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলো, হুট করে হাই স্পিডে একটা বাইক চলে আসে। ছেলেটা যে আনাড়ি বাইকার সেটা ওর ড্রাইভিং দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়, আরেকটু হলে দুর্ঘটনা ঘটেই যেতো কিন্তু ভাগ্য ভালো যে আদনান সময়মতো রোজাকে টেনে সরিয়ে এনেছে! হ্যাঁচকা টান খেয়ে রোজা এসে আদনানের বুকের ওপর পড়েছে। ভয় পেয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য রোজা থমকে গেছিলো, পরক্ষণে সরে দাঁড়ায় ও! আদনান চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে…

‘ আর ইউ ওকে?’

‘ ইয়াহ! আই অ্যাম ফাইন। থ্যাংকস!’

‘ শুধু থ্যাংকস? আমি তোমার জীবন বাঁচালাম, শুধু ধন্যবাদ দিয়েই দায়িত্ব পালন শেষ করবে?’

‘ তাহলে কি চান?’

‘ জীবন বাঁচিয়ে তো অনেক বড় কাজ করে ফেললাম আমি, তাহলে বড়সড় কিছুই বিনিময়ে চাওয়া উচিৎ রাইট?’

‘ হ্যাঁ, বলুন! কি চান, সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই দেবো’

রোজার দিকে কিছুটা ঝুঁকে সিরিয়াস একটা ভাব নিয়ে আদনান বলে বসলো…

‘ চলো, বিয়ে করে ফেলি?’

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]