তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-১১+১২

0
28

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১১

জামাল সাহেব উচ্চস্বরে রোজাকে ধমকাতে শুরু করলেন, ওনার কণ্ঠস্বর শুনে ছুটে এলেন রোজার মা। পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে উনি চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন…

‘ তুমি হঠাৎ ওর সঙ্গে এমন করছো কেনো?’

‘তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো কেনো করছি, ও আবার আমাদের সম্মান ডুবানোর চেষ্টা করছে। দেখ রোজা, হাতে এখন সময় খুবই কম। এর মধ্যে তুই যদি কোনো ঝামেলা করিস সেটা কিন্তু ভালো হবেনা’

‘ আহা, মাথা ঠাণ্ডা করো তুমি। কি হয়েছে বলবে তো! রোজা, কি হয়েছে মা?’

রোজা মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাবার ঘর থেকে অশ্রুভেজা নয়নে নিরবে বেরিয়ে এলো, বাবার রুক্ষ আচরণে এতদিন কষ্ট না পেলেও আজ ভীষণ কষ্ট পেলো মেয়েটা। একজন বাবা তার মেয়েকে এতোটা অবিশ্বাস কিভাবে করতে পারে? মেয়ে বেরিয়ে যাবার পর রোজার মা রোজার বাবাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু জামাল সাহেব এতোটাই রেগে ছিলেন যে এই বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাইছিলেন না। পরে উপায় না পেয়ে রোজার মা মেয়ের ঘরে আসেন। রোজা তখন বিছানায় বসে চোখের জল ফেলছিলো…

‘ রোজা, সব তো ঠিক ছিলো। হঠাৎ তোর আর তোর বাবার মধ্যে কি হলো? এতো রেগে আছে কেনো সে?’

‘ নিষাদ! মা, আমি ওনাকে বিয়ে করতে পারবো না’

‘কি বলছিস? হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেনো? কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে?’

রোজা মাকে সবটা খুলে বললো, মেয়ের মুখে সব শোনার পর ও ছবিগুলো দেখার পর রোজার মায়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। জামাল সাহেবের মতো তিনি অন্তত মেয়ের কথায় অবিশ্বাস করেননি।

‘এই ছেলেটাকে আমরা সবাই এতো ভালো ভেবেছিলাম, তার আসল রূপ কিনা এই? তোর বাবা কি এগুলো দেখে রেগে গেছে?’

‘না, বরং আমি বিয়ে করতে আপত্তি করবো ভেবে রেগে গেছে। আমার ভবিষ্যতের বিন্দুমাত্র চিন্তা যে বাবার নেই তা আজ আমার বোঝা হয়ে গেছে। আসলে আমি বাঁচলাম না মরলাম তাতেও বাবার কিছু যায় আসেনা’

রোজা মায়ের দিকে তাকিয়ে একরাশ আফসোস জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলো…

‘মা, বাবা আমাকে এত বিশ্বাস কেনো করে বলোতো? আমি তো আগে কখনো কোনো অন্যায় করিনি তাইনা? একটা ভুলের জন্য বাবার কাছে আমি এতটাই খারাপ হয়ে গেলাম? আমি কি তার নিজের মেয়ে নই’

মেয়ের এই অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রোজার মায়ের, বরাবরই জামাল সাহেব মেয়েকে একটু বেশিই কড়া শাসন করে এসেছে। রোজার মা সব দেখেও প্রতিবাদ করতে পারেনি কারণ রোজার বাবার উগ্র মেজাজের সামনে কথা বলার সাহস তার হয়নি! মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে রোজার মা বলেন…

‘তোকে আর কি বলে শান্তনা দেবো রোজা, জানিস তো বাবার কথা। কিন্তু এরকম একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে তো তোর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। তুই নিষাদের ব্যাপারে কিভাবে জানলি এগুলো?’

‘আছে কেউ একজন, আমার ভালো চায় হয়তো তাই আমাকে এসব জানতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তাতে আমার বিশেষ লাভ হলো বলে মনে হচ্ছে না ‘

‘আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবো, এখনও হাতে সময় আছে। তোর বাবার সঙ্গে কথা বলে বিয়েটা…’

‘বাবার সঙ্গে কথা বলে লাভ হবেনা মা, শুধু শুধু আমার জন্যে তুমিও বাবার রোষের শিকার হবে। আমার বিয়েটা না হওয়া অব্দি উনি শান্ত হবেন না’

‘ তাই বলে সব দেখে তো চুপও থাকা যায়না ‘

রোজা কিছুক্ষণ ভাবলো, বাবার এই আচরণ দেখে ও বুঝে গেছে নিষাদের ব্যাপারে যতো প্রমাণই এনে দিক না কেনো ওর বাবা বিশ্বাস করবেন না কারণ এই মুহূর্তে ওনার কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য! শপিং মলে আদনানের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘুরছে রোজার, এই বিয়েটা করলে ওর পরিবারের কোনো লাভই হবেনা উল্টে ওর জীবন শেষ হবে। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে রোজা ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলো…

‘আচ্ছা মা, আমি যদি বিয়েটা না করি তাহলে কি তুমিও বাবার মতো আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছি’ন্ন করে দেবে?’

‘ এসব কথা কেনো বলছিস রোজা? তুই কি…’

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই রোজার মা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে মেয়ে তার কি করতে চাইছে। ভয় হচ্ছে বটে, কিন্তু বিয়েটা দিয়ে মেয়েকে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়াও তো বোকামির কাজ হবে। রোজা এখনও ঠিক করেনি কিভাবে কি করবে, কিন্তু যেভাবেই হোক বিয়েটা না করার সিদ্ধান্ত অবশেষে নিয়েই নিয়েছে! পরদিন দুপুরে…আদনান রোজার বাবার সঙ্গে দেখা করতে ওনার অফিসে এসেছিলো। রোজার বাবা একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। আদনান আজ রোজার বাবার সঙ্গে কথা বলে বাবা মেয়ের সম্পর্কে যে ভাঙন ধরেছে সেটা ঠিক করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছে। লাঞ্চটাইমে জামাল সাহেব বাইরের এক হোটেলে খাচ্ছিলেন, আদনান সোজা গিয়ে ওনার সামনে বসে পড়ে। জামাল সাহেব কিছু বলার আগেই আদনান বলে…

‘ হ্যালো আঙ্কেল! আমার নাম আদনান, আমি রোজার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই ‘

খাওয়া রেখে আদনানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন জামাল সাহেব…

‘ আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?’

‘আপনার মেয়ে আমাকে বিপদের সময় সাহায্য করেছিলো একজন ডাক্তার হিসেবে। বলতে পারেন আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার ডাক্তার – রোগীর সম্পর্ক ‘

‘ ডাক্তার রোগীর সম্পর্ক হাসপাতাল অব্দি সীমাবদ্ধ থাকে, তুমি ওর বিষয়ে আমার সঙ্গে কি কথা বলতে এসেছো ‘

‘ আপনাদের বাবা মেয়ের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে আমার জন্যে, সেটাই ঠিক করতে এসেছি। আমি আশা করবো আপনি আমার কথাগুলো ঠান্ডা মাথায় শুনে তারপর নিজের মেয়েকে জাজ করবেন ‘

‘ আমার মেয়ের হয়ে সাফাই গাইতে এসেছো তুমি?’

‘ না আঙ্কেল, আপনার ভুল ভাঙ্গাতে এসেছি। মাস দুয়েক আগে রোজা নিখোঁজ হয়ে গেছিলো রাইট? ও নিখোঁজ হয়নি, ইন ফ্যাক্ট ওই ঘটনায় ওর কোনো দোষই ছিলো না। সবকিছু আমার জন্যে হয়েছে ‘

আদনান রোজার বাবাকে সবটা বিস্তারিত বলে, যদিও আদনানের জানা নেই সব জানার পর রোজার বাবা কেমন রিয়েক্ট করবে তবুও সত্যিটা জানানো জরুরি বলে মনে হয়েছে আদনানের। সব শোনার পর জামাল সাহেব উল্টে প্রশ্ন করলেন…

‘ তিনদিন আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে ছিলো আর সেটা তুমি আমাকে বলতে এসেছো? লজ্জা করছে না তোমার?’

‘ আপনি বিষয়টা নেগেটিভভাবে চিন্তা করছেন, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আপনার মেয়ে শুধু আমার সেবা করেছে আর কিছুই নয়। আমি জানি হয়তো বাইরের লোকের কাছে কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হবেনা কিন্তু আপনি তো রোজার বাবা। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এইটুকু বিশ্বাস নিশ্চয়ই আপনার আছে যে আপনার মেয়ে কোনো অন্যায় করবে না?’

নাক সিটকে জামাল সাহেব বললেন…

‘ এই যুগের ছেলেমেয়ে হয়ে তোমরা একসঙ্গে ছিলে আর বলছো নেগেটিভ কিছু হয়নি? কি বোঝানোর চেষ্টা করছো আমাকে? তোমাকে কি রোজা এখানে পাঠিয়েছে ওর হয়ে কথা বলার জন্যে?’

জামাল সাহেবের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো আদনান, মেয়ের প্রতি দারুন বিদ্বেষ প্রকাশ পাচ্ছে তার কথায়। রোজাকে এতো অবিশ্বাস করে তার বাবা?

‘ আঙ্কেল…’

‘যে মেয়ে বংশের সম্মান ডুবিয়ে দেয়, তাকে বিশ্বাস করার কোনো প্রশ্নই আসেনা। আমার মেয়ে বলে ওর দোষ মাফ হবেনা ‘

‘আপনার শিক্ষায় আপনার মেয়ে বড় হয়েছে, তার প্রতি এতটুকু ভরসা নেই আপনার? সামান্য একটা ঘটনার জন্যেই ওকে আপনি…’

‘ সামান্য ঘটনা? মেয়ে তিনদিন তিন রাত বাড়ির বাইরে ছিলো এটা সামান্য ঘটনা? ওর জন্যে আমার নাক কা’টা গেছে, আমার সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ধারণা আছে তোমার? মেয়ের বাবা হবে যেদিন সেদিন বুঝবে, এসব কথা তখন আর মুখ দিয়ে বের হবেনা’

প্রতিটা বাবার কাছে তাদের মেয়ে রাজকন্যা, মেয়েদের সব দোষ বাবারা মেনে নেন। সবসময় এমনটাই শুনে এসেছে আদনান, কিন্তু আজ জামাল সাহেবের কথা শুনে ওর ভুল কিছুটা ভাঙলো। জামাল সাহেব যেভাবে রোজার সম্পর্কে কথা বলছিলেন তাতে আদনান বুঝলো সব মেয়েরা বাবার রাজকন্যা হয়না।

‘ রোজার সঙ্গে আমার অল্পদিনের পরিচয়, আর আপনার সঙ্গে জন্ম থেকে ওর সম্পর্ক। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে নিজের মেয়েকে একরত্তি ভরসা করেন না আপনি, নিজের শিক্ষার ওপর ভরসা নেই আপনার আঙ্কেল?’

‘অবশ্যই আছে, কিন্তু রোজাকে আমি আমার শিক্ষায় বড় করতে পারিনি। ও সবসময় আমার ইচ্ছের উল্টো কাজ করেছে। ও আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্তার হয়েছে, আর ওর এই ডাক্তারীতেই আমার সম্মান ডুবলো ‘

জামাল সাহেবের প্রতিটা কথাই আদনানকে অবাক করছে, ওনার কথা শুনে মনেই হচ্ছেনা রোজা ওনার নিজের মেয়ে। আদনান ভেবেছিলো ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করবে কিন্তু রোজার বাবার কথা শুনে ওর মেজাজ বিগড়ে গেলো! এখানে কথা বলে বা এই লোককে বুঝিয়ে শুধু সময় অপচয় ছাড়া কিছুই হবেনা তাও আদনান বুঝেছে! চেয়ার থেকে আদনান উঠে দাঁড়াতেই জামাল সাহেব বললেন…

‘ রোজার সামনে বিয়ে নিশ্চয়ই জানো, ওর ভালো চাইলে আর ওর আশেপাশে আসার চেষ্টা করো না। আর ভবিষ্যতে কখনো আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসো না’

বাঁকা হাসলো আদনান…

‘ ইয়াহ শিওর আঙ্কেল! আপনার মেয়ের যাতে ভালো হয় সেই কাজই করবো কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের দেখা হবে কি হবেনা সেই নিশ্চয়তা এখনি দিতে পারছিনা। সম্পর্কের খাতিরে হলেও হতে পারে ‘

‘ মানে?’

‘ সময় হলেই বুঝবেন, এনিওয়ে! আপনি কি যেনো বলছিলেন? মেয়ের বাবা হলে বুঝবো? আমি অবশ্য কখনো বাবা হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি তবে যদি সেই সুযোগ পাই, আমার মেয়েকে অন্তত সকল ব্যাপারে বিশ্বাস করবো। কারণ আমার মেয়েকে বিশ্বাস করতে না পারা মানে নিজেকে অবিশ্বাস করা হবে। আমি অন্তত নিজের শিক্ষার ওপর ভরসা রাখবো। যাই হোক, ভালো থাকবেন ‘

একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওখান থেকে চলে এলো আদনান, রোজার কথা ভেবে চিন্তা হচ্ছে ওর। মেয়েটা নিশ্চয়ই বাড়িতেও প্রতিনিয়ত বাবার এমন রুক্ষ আচরণের সম্মুখীন হয়! একটা বাইরের ছেলের সামনে মেয়ের সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে পারলে না জানি রোজাকে কি কি বলে। এসব ভেবে আদনানের র’ক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। সৎ বাবার কাছে বড় হওয়া সত্বেও আদনান কখনো এমন আচরণ দেখেনি। এখন মেয়েটাকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে আনার কথা ভাবছে আদনান…
________________________________

আদনান তানভীরের সঙ্গে একটা বিজনেস প্ল্যান করছিলো, হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো লাভ হবেনা। কিছু একটা শুরু করতে হবে। কিন্তু রোজাকে কিভাবে এসব থেকে চলে আসতে রাজি করাবে ভেবে পাচ্ছেনা আদনান। কাজের কথার মাঝেই হুট করে ও বললো…

‘ তানভীর! রোজাকে এই বিয়ে থেকে কিভাবে তুলে আনা যায় বলতো। একটা প্ল্যান বল ‘

‘ কি বলছিস! তুলে আনবি?’

‘ এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না, মেয়েটা আমার কথাও শুনছে না। সব জেনে আমি চুপ করে থাকতে পারছি না। ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এই বিয়ে হলে ‘

‘ আচ্ছা, রোজা সব জেনে নিজের জীবন নষ্ট করতে চাইছে। তুই ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস কেনো? বাদ দে না, লাইফে আরো অনেক মেয়ে পাবি ‘

চোখ গরম করে তাকালো আদনান, ওর চাহনি দেখে ভরকে গেলো তানভীর…

‘ ক..কি?’

‘ ভবিষ্যতে আর এমন কথা বলবি না তানভীর! ওই মেয়েটা আমার জন্যে কি সে সম্পর্কে তোর ধারণা নেই’

তখনই আদনানের ফোন বেজে উঠলো, রোজার কল দেখে অবাক হলো বটে। কল রিসিভ করতেই…

‘ আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ‘

‘ তাহলে চলো মিট করি, সামনাসামনি কথা বললে ভালো হবে ‘

‘ এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরোনো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কাল বাদে পরশু বিয়ে। বাবার কড়া নজরদারিতে আছি আমি এখন ‘

আদনান বুঝলো রোজার বাবা ওকে ঘরবন্দী করে রেখেছে, বিয়ে না দেওয়া অব্দি রোজাকে একা ছাড়বে না! পরে ফোনেই রোজার সঙ্গে কথা বলে নিলো, আদনানকে রোজা ওর বিয়ের দিন দেখা করতে বলেছে বিউটি পার্লারে বাইরে। কিন্তু কেনো দেখা করতে বলেছে সেটা স্পষ্টভাবে বলেনি, আদনান অবশ্য জানতেও চায়নি। রোজা নিজে দেখা করতে চেয়েছে এটাই অনেক!

চলবে…

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১২

আর কয়েক ঘণ্টা বাদেই রোজার বিয়ে, জামাল সাহেব এতকিছুর পরেও মেয়েকে নিষাদের মতো ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তা থেকে পিছু হটেননি। রোজাও নিজের কথা চিন্তা করে এ কয়দিন চুপচাপ বাবার সব সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে এসেছে। রাতে বিয়ে, সন্ধ্যায় রোজা পার্লারে সাজতে এসেছে। সঙ্গে ওর ছোটো বোন। রোজা নিজের পছন্দের পার্লারে সাজতে আসার জন্যে বাবার থেকে অনেক কষ্টে অনুমতি নিয়েছে। কারণ এখানে না এলে ও পালাতে পারবে না, হ্যাঁ! রোজা আদনানের সঙ্গে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাকে নিজের প্ল্যানের কথা আগেই জানিয়ে রেখেছে ও কারণ আজকের পর মায়ের সঙ্গে দেখা হবে কিনা তার ঠিক নেই। রোজার মা ও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়ের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। রোজা আদনানকে সময় ও ঠিকানা জানিয়ে রেখেছিলো, আদনান সময়মতো পৌঁছায় ঠিকই কিন্তু রোজার দেখা পেতে ওকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। ঘন্টাখানেক পর বিয়ের পুরো সাজ শেষ হওয়ার পরেই রোজা ওর বোনকে কিছু একটা কেনার বাহানায় বাইরে পাঠায়, ওর বোন বেরিয়ে যেতেই পার্লারের পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে আসে রোজা। এই পার্লারে দুটো দরজা আছে, সামনের দরজা দিয়ে বেরনো সহজ হবেনা বিধায় পেছনের দরজা দিয়ে বেরোনোর উদ্দেশ্যেই এই পার্লারে এসেছে রোজা। ওখান থেকে হেঁটে একটু সামনে আসতেই আদনানের দেখা পেলো… লাল – সোনালী মিক্স রঙের বেনারসি পরিহিত অবস্থায় কণের সাজে রোজাকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেনো থমকে গেলো ছেলেটা, রোজাকে এ নতুন রূপে দেখে আদনানের বুকে কয়েক দফা অনুভূতির ঢেউ খেলে গেলো। মেয়েটাকে আজ সত্যিই অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। রোজা এগিয়ে এলো…

‘ সরি, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো ‘

রোজার কথায় ধ্যান ভাঙলো আদনানের…

‘ তোমার সঙ্গে আর কেউ আসেনি?’

‘ আমার বোন এসেছে, ওকে আমি অজুহাত দিয়ে বাইরে পাঠিয়েছি। বাবা সবসময় আমার নজরদারি করার জন্যে কাউকে না কাউকে আমার সঙ্গে থাকতে বলেন। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে এ কদিনে আমার ‘

‘ আই থিঙ্ক, আমার জন্যে হয়েছে! সেদিন আমি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করার পরই উনি নিশ্চয়ই তোমাকে ঘরবন্দী করেছেন?’

মলিন হাসলো রোজা…

‘ নিজেকে দোষ দেবেন না আদনান, আপনার দোষ ছিলো না। আমি সবই শুনেছি আপনি বাবাকে কি বলেছেন, আপনি যে আমার জন্যে বাবার সঙ্গেও কথা বলেছেন সেটাই অনেক। কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য যে বাবা আমাকে বিশ্বাস করেননি ‘

জামাল সাহেবের কথাবার্তা শুনেই সেদিন আদনান আয়ত্ত্ব করে নিয়েছিলো রোজার সঙ্গে হয়তো উনি বরাবরই রুক্ষ আচরণ করেন। বিয়ের সাজে মেয়েরা সাধারণত হাসিখুশি থাকে কিন্তু এই সাজে রোজার মলিন মুখটা দেখে আদনানের কষ্ট হলো! মিনিট দুয়েক নীরবতার পর রোজা বললো..

‘ আদনান, আপনি এতোদিন আমাকে অনেকভাবেই সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আজ শেষবারের মতো আমায় সাহায্য করবেন? আপনি বলেছিলেন আমি যদি এসবের পরও নিজের কথা না ভাবি সেটা বোকামি হবে? আমি এই মুহূর্তে শুধু নিজের কথাই ভাবছি, আর আপনি ছাড়া আমি আর কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারবো না ‘

‘ কি সাহায্য চাও?’

রোজা কিছু না বলে আদনানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো, আদনান প্রথমে রোজার এই চাহনির অর্থ বোঝেনি কিন্তু একটু পরেই কৌতুহল বশত প্রশ্ন করলো…

‘ তুমি এখন এখান থেকে পালাতে চাইছো?’

লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে মেয়েটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো, কোথায় আদনান ভাবছিলো রোজাকে বিয়ে থেকে তুলে আনা যায় কিভাবে সেখানে মেয়েটা নিজেই ওর সঙ্গে যেতে চাইছে দেখে আদনান যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে বসলো! মনে মনে বেজায় খুশি হয়েছে সে।

‘ ভেবে দেখো, পরে আফসোস করবে না তো?’

‘ সব ছেড়ে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আফসোস তো একটু হবেই। তবে সারাজীবন আফসোস করার চাইতে কয়েকদিন আফসোস করাই যথেষ্ট ‘

‘ বেশ, তবে..চলো ‘

হাত বাড়িয়ে দিলো আদনান, রোজা চোখ নিচু করে তাকালো। মেয়েটা কোনোদিন ভাবেনি যে তার জীবনে এমন একটা দিন আসবে যখন অচেনা একটা ছেলেকে বিশ্বাস করে ওর হাত ধরে যাওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু জীবন কখন কোনদিকে মোড় নেয় তা কেউই জানেনা। আজ এখান থেকে চলে গেলে কি জীবনের সব দুঃচিন্তার অবসান ঘটবে না নতুন ঝামেলার সুচনা হবে? জানা নেই রোজার! অবশেষে সকল চিনত মাথা থেকে ঝেড়ে আদনানের হাত ধরে অজানা এক ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিলো রোজা…
_________________________________

বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে, গাড়ির ভেতর বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে রোজা। দুপুরের পর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি, খিদেয় পেট চো চো করছে। মাথার ওড়নাটা বড্ড জ্বালাতন করছে, বিধায় বাম হাতে সেটা খুলে সিটে রেখে দিলো। পাশের সিটে হেলান দিয়ে বসে মেয়েটাকে দেখছে আদনান। এতোটা কাছ থেকে এতো সময় ধরে রোজাকে দেখার সৌভাগ্য এই প্রথমবার হচ্ছে তার! অনেকটা দূরে চলে এসেছে দুজনেই, পথে রোজার খিদে পাওয়ায় গাড়ি থামিয়ে আদনান খাবার এনে দিয়েছে। এরপরই শুরু হলো বৃষ্টি, আদনানেরও ক্লান্ত লাগছে বিধায় এখন ড্রাইভিং করছে না।

‘ আপনি খাবেন না কিছু?’

‘ আমি বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছিলাম, তাই খিদে পায়নি। তোমার আরো কিছু লাগবে? এনে দেবো?’

‘ নো থ্যাংকস, এটাই যথেষ্ট ‘

‘ তো, এখন কোথায় যাওয়ার প্ল্যান?’

রোজা একটা ছোটো ব্যাগে নিজের সঙ্গে করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে এসেছে যাতে ভবিষ্যতে কাজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে!

‘আপনি কি আমাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? বাকিটা চেষ্টা করে আমি সামলে নেবো। কোনো একটা হসপিটালে যদি ঢুকতে পারি তাহলেই নিজেকে চালানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে’

রোজার কথা শুনে আদনান কিছুটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো…

‘তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে পারো, আমরা না হয় রুম শেয়ার করে থাকবো ‘

ভ্রু কুঁচকে নিলো রোজা…

‘ কি বলছেন! আমি আপনার সঙ্গে কিভাবে থাকবো?’

রোজার দিকে কিছুটা এগিয়ে এলো আদনান, স্মিত হেসে বললো…

‘একটা ছেলে মেয়ে যেভাবে একসঙ্গে থাকে’

রোজা বুঝতে পেরে আদনানকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো…

‘ এক বিয়ে থেকে পালিয়ে এলাম, এখন আবার সেই ঝামেলাতেই জড়াতে বলছেন?’

‘ আমি ঐ চি’টা’র নিষাদের মতো নই, এতোটা বিশ্বাস যখন করেছো আরেকটু করতে পারবে না? আমাকে বিয়ে করলে মন্দ থাকবে না!’

‘ কিন্তু…’

‘ দেখো, রাত হয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হলে বিয়ের জন্যে কাজী পাওয়া যাবেনা তাই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্রুত নাও। নাহলে আজকের রাতটা কিন্তু এই গাড়িতেই কাটাতে হবে ‘

‘ আরেহ! কিছু সময় আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নিলাম আর এখন কিনা বলছেন তাড়াহুড়ো করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে?’

আদনান উত্তর দিলো না, রোজাও ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে। এ মুহূর্তে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই আর না ভরসা করার মানুষ আছে। একমাত্র আদনানই ভরসা, কিন্তু লোকটা সম্পর্কে কিছুই জানা নেই ওর। এভাবে বিয়ে করা কি ঠিক হবে? ভেবে ভেবে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে, পরে রোজা সবকিছু ভেবে দেখলো। আদনান তো এতদিন ওর ভালোই চেয়ে এসেছে, তাকে বিয়ে করলে আর যাই হোক ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। পনেরো মিনিট ভাবনা চিন্তা করার পর আদনানকে বিয়ে করতে রাজি হয় রোজা! যেই ভাবা সেই কাজ, যাওয়ার পথে একটা কাজী অফিস দেখেছিলো আদনান। গাড়ি ঘুরিয়ে সেখানেই আসে, বিয়েটা করে নেয়! আদনানের কাছে সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে, এতো সহজেই রোজা তার হবে তা কল্পনাও করেনি সে। রোজারও একই অবস্থা, যে লোকটাকে দুদিন আগে সহ্য করতে পারতো না আজ তার হাত ধরে সব ছেড়ে চলে এসেছে আবার সম্পর্কে আজ থেকে সেই লোকটিই ওর স্বামী? কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে অনেককিছুই বদলে গেলো, সময় সত্যিই চমকপ্রদ। সময়ের কোন মোড়ে কি অপেক্ষা করছে তা কল্পনাও করা যায়না। কাজী অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি পড়া দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোজা, আদনান প্রশ্ন করলো…

‘ আর ইউ ওকে?’

‘ হুমম! কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, বাড়িতে না জানি এই মুহূর্তে কি পরিস্থিতি। মা যদিও জানে কিন্তু মা জানে এটা যদি বাবা জানতে পারে তাহলে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। একটা খবর নিতে পারলে শান্তি পেতাম ‘

‘ আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তোমার বাড়িতে ফোন না করাই ভালো হবে, তুমি কল করলে পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যেতে পারে। কয়েকদিন যেতে দাও, সব এমনিতেই শান্ত হয়ে যাবে ‘

‘ মনে হয় না, কারণ আমার বাবার সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই। লোকটা একবার কোনো বিষয়ে বেঁকে বসলে সেটা আর কখনো মেনে নেয় না ‘

এই মুহূর্তে রোজার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে আদনান, মেয়েটাকে এমন উদাস দেখতে ভালো লাগছেনা ওর। তাই ওর মুড ঠিক করার জন্যে হেসে আদনান বললো…

‘তুমি বউ সেজে বিয়ে করলে ঠিকই, কিন্তু আমার বর সাজা হলো না। আগে জানালে সব প্রিপারেশন নিয়ে রাখতাম’

আশ্চর্য হয়ে তাকালো রোজা…

‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে করার জন্যে মুখিয়ে ছিলেন?’

‘ অফ কোর্স! কেনো? আমি তো তোমাকে বিয়ের জন্যে প্রোপোজও করেছিলাম, মনে নেই শপিং মলের বাইরে? তুমি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে কাক দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ‘

কথাগুলো বলেই আফসোস করলো আদনান, রোজা এবার আরো অবাক হলো!

‘ আপনি মজা করছিলেন না?’

‘এরকম একটা গুরুতর বিষয় নিয়ে মজা কে করে? যাই হোক, গাড়ি যখন আছে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি? চলো বাসায় যাই ‘

‘ আপনার বাসা?’

আদনান মুচকি হেসে রোজার হাতটা ধরলো..

‘ নাহ! আমাদের বাসা ‘

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]