#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২১
রিপোর্টগুলো বাড়ি আনেনি রোজা, ও চায়না আদনান ওর কম্প্লিকেশ সম্পর্কে জানুক। আদনান জানলে হয়তো সেই একই কথাই বলেন যা ডা. জোহরা বলেছে। রোজা কোনো মূল্যেই নিজের সন্তানকে হারাতে চায়না। বাড়ি আসার পর থেকেই রোজা লক্ষ্য করলো আদনান বেশ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ডিনার টাইমেও খাওয়ার দিকে মনোযোগ ছিলো না ওর, যেনো কোনো এক বিষয় নিয়ে গভীর ভাবনায় মশগুল আছে। ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটার কাছাকাছি, কিন্তু আদনানের চোখে ঘুম নেই বিধায় বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। মোস্তফা সাহেবের কথাগুলো একান্তে ভাবছিলো। তার বলা কথাগুলো মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস পড়লো আদনানের। একজন অনাথের কাছে জন্মদাতা পিতার পরিচয় জানতে পারাটা হয়তো কিছুটা আনন্দের কিন্তু স্বেচ্ছায় যে পিতা মাতা সন্তানকে অনাথ হতে বাধ্য করেছে তাদের পরিচয় জানার পর তাদের প্রতি ঠিক কেমন মনোভাব পোষণ করা উচিত জানা নেই ওর। সব জানার পর মোস্তফা সাহেবের প্রতি তীব্র ঘৃ’না জন্মেছে আদনানের মনে, তা হয়তো কখনোই দুর হবেনা। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রোজা…
‘তুমি এখনও জেগে আছো কেনো?’
‘তুমি কেনো জেগে আছো?’
রোজাকে ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আদনান…
‘আমার কথা বাদ দাও, তোমার যে এখন ঠিকমতো ঘুমাতে হবে সেটা মনে আছে? এমনিতেই অনেক সকালে উঠতে হয় তোমায়, রাতে আগে না ঘুমালে এনার্জি পাবে কিভাবে?’
‘তুমি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছো সেটা বুঝেও আমি ঘুমাই কিভাবে বলো? কিছু হলে আমার সঙ্গে শেয়ার করো’
‘ আই অ্যাম ফাইন!’
‘ নো, ইউ আর নট! বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছি আমি, কিছু একটা নিয়ে ভাবছো তুমি। কি হয়েছে? বলো আমায়’
নিরব রইলো আদনান, রোজা এবার চিন্তায় পড়ে গেলো। ব্যবসায় আবার কোনো ক্ষতি হলো না তো?
‘এনিথিং সিরিয়াস? তোমার ওয়ার্ক রিলেটেড কোনো টেনশন?’
‘ ওয়ার্ক রিলেটেড নয়, আমার লাইফ রিলেটেড’
রোজা ওর কথার মানে বুঝলো না, কিন্তু আদনানের কথার সুর শুনেই বুঝতে পারছে গুরুতর কোনো ব্যাপার!
‘যা হয়েছে তাতে কেউই আমাকে সাহায্য করতে পারবেনা রোজা, আজকে আমি এমনকিছু কথা জেনেছি যা হয়তো আমার না জানাই ভালো ছিলো। নিজের প্রতি এতো রাগ হচ্ছে আমার, আই জাস্ট হেইট মাইসেলফ রোজা!’
কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার গলা কেঁপে উঠছিলো আদনানের, রোজা ওকে এভাবে দেখে অভ্যস্ত নয়। ওর এই অবস্থা দেখে চিন্তা বাড়লো রোজার, বুঝলো যা ঘটেছে সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করলে আদনানের দুঃখ হয়তো বাড়বে বৈ কমবেনা।
‘ ইউ নো হোয়াট রোজা? আমি সবসময় ভেবে এসেছি আই ওয়াজ লাকি। তোমাকে কখনো বলেছি কিনা মনে নেই, আই ওয়াজ অ্যাডপ্টেড! যে বাড়িতে বড় হয়েছি তারা আমাকে অনেক ভালোবেসেছে, মাঝে মাঝে নিজেকে এই বিষয়টা নিয়ে লাকি ভাবতাম কিন্তু আমাকে অ্যাডপ্টেড কেনো হতে হয়েছে সেটা জানার পর…লালন পালন করতে না পারলে তো বেবি নেওয়াই উচিত না তাইনা বলো? নামের মা বাবা হয়ে লাভ কি?’
কথাগুলো বলতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে আদনান, ওর এ অবস্থা দেখে আর কিছু জানার ইচ্ছে হচ্ছেনা। রোজা সঙ্গে সঙ্গে ওকে জড়িয়ে ধরলো, আলিঙ্গনরত অবস্থাতেই আলতো করে আদনানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো…
‘ইটস ওকে! তোমার যদি বিষয়টা শেয়ার করার ইচ্ছে না থাকে তাহলে জোর করে বলার দরকার নেই, আমি জানতে চাইবো না। আমি জানিনা কি হয়েছে, কোন বিষয়ে নিয়ে তুমি এতোটা আপসেট তবে এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বোকামির কাজ কি জানো? নিজেকে অবহেলা করা। দিনশেষে তুমি একান্তই তোমার, সো ডোন্ট হেইট ইউরসেলফ ওকে? আর আমি আছি তো তোমার সঙ্গে, ইউ আর নট অ্যালোন’
রোজাকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরলো আদনান, নিজেকে শান্ত করার জন্যে লম্বা কিছু নিঃশ্বাসও ফেললো। চোখের পানি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টায় আছে, কারণ যে মা বাবা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যে ওকে ছেড়ে চলে গেছে তাদের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলতে চায়না ও!
___________________________
দিনদিন রোজার শরীর ওকে জানান দিচ্ছে যে ওর সমস্যাগুলো ক্রমেই বাড়ছে, ইদানিং শারীরিক দুর্বলতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। শরীরে র’ক্তের পরিমাণও কম, ওষুধ ও পর্যাপ্ত খাবার খেয়ে তা ঠিক করার চেষ্টা করছে। রেগুলার চেকাপ করছে, মোটামুটি সব সহ্য করে নিচ্ছে কিন্তু বাচ্চার গ্রোথ কম হচ্ছে। এ নিয়েও চিন্তার শেষ নেই, এ কথা জানার পর আদনান ওর খাবারের দিকে বিশেষ নজর রাখছে। চেকাপে আদনান সঙ্গে যায় ঠিকই কিন্তু রোজা ডা. জোহরাকে বারণ করেছে কিছু জানাতে। রোগীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু বলার অধিকার চিকিৎসকদের হয়তো নেই, তাই উনি সব জেনেও চুপ করে আছেন। আদনান শুধু সেটুকুই জানছে যা জানলে ও চিন্তা করবেনা।
‘ আদনান, আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে ‘
‘ ভালো কথা, কি খাবে বলো?’
‘ উম্ম! তোমাকে আনতে হবে না আমিই বানিয়ে খাবো। আমাদের ঘরে শশা আর সয়াসস আছে তো তাইনা?’
‘ হ্যাঁ কিন্তু এগুলো দিয়ে কি করবে?’
‘আমার ক্রেভিংস মেটাবো ‘
‘আস্তে যাও, তাড়াহুড়ো করো না!’
আদনানের কথা যেনো কানেই তুললো না রোজা, একপ্রকার ছুটে রান্নাঘরে চলে গেছে। প্রেগনেন্সিতে রোজা ভালোই ওয়েট গেইন করেছে। স্লিম রোজা এখন অনেকটা গলুমোলু হয়ে গেছে। আদনান রুমে ছিলো, অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও রোজার আসার নামগন্ধ নেই দেখে ও গিয়ে দেখলো ডাইনিং টেবিলে বসে কিছু একটা খাচ্ছে রোজা। এগিয়ে এসে আদনান প্রশ্ন করলো…
‘এগুলো কি!’
‘কিউকিউম্বার উইথ সয়াসস!’
আদনান চেয়ার টেনে বসলো, রোজার খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব মজার জিনিস খাচ্ছেন। মাঝে মাঝেই মেয়েটার উদ্ভট সব খাবার খাওয়ার ক্রেভিং হয়। এইতো কিছুদিন আগে কাচা মরিচ সয়াসস দিয়ে খাওয়ার শখ জেগেছিলো। সেটাও নাকি খুব মজা ছিলো, আদনান লক্ষ্য করেছে যেকোনো খাবারের সঙ্গেই সয়াসস মেয়েটার লাগবেই!
‘উম্ম! আমার কেনো যেনো মনেই হচ্ছিলো যে এভাবে খেলে অনেক মজা হবে, তুমিও খেয়ে দেখো একটু’
‘না তুমিই খাও!’
‘আরে, আরো শশা আছে তো ফ্রিজে। তুমি খাও এটা, টেস্ট করে দেখো। এত্ত মজা!’
রোজার জোরাজুরিতে আদনান একটা শসায় একটু সস মাখিয়ে মুখে দিলো কিন্তু ওর একটুও ভালো লাগেনি, এদিকে রোজা গোগ্রাসে খেয়েই যাচ্ছে। তিনটা শসা একসঙ্গে কেটে এনেছে, আর খাওয়াও প্রায় হয়ে গেছে! এক গ্লাস পানি খাওয়ার পর আদনানের মুখের স্বাদটাই যেনো বিগড়ে গেলো!
‘ রোজা, এসব খেয়ে পেট ভরবেনা তোমার।
আমি তোমায় কিছু বানিয়ে দিচ্ছি ‘
‘ কে বললো আমার খিদে পেয়েছে?’
‘খাচ্ছো তাই বললাম, খিদে পায়নি?’
‘উফফ! আমার খিদে পায়নি! আমার এটা খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিলো তাই খাচ্ছি, তুমিও না কিছু বোঝো না’
আদনান থ মে’রে বসে রইলো, শান্ত মেয়েটার এখন রাগ বেড়েছে। একটু এদিক ওদিক হলেই ছ্যাৎ করে ওঠে, ডাক্তার বলেছে হরমোনাল চেঞ্জের জন্যে এমন হচ্ছে। রোজা বিরক্ত হলে আদনান চুপ করে যায়! যা করছে করুক, রোজা খুশি থাকলেই হলো। একটু পরে রোজার মায়ের ফোন এলো, খেতে খেতেই রোজা কল রিসিভ করলো..
‘ শরীরের কি অবস্থা তোর?’
‘ আমি ভালো আছি, বেবিও ভালো আছে। তুমি কেমন আছো মা?’
‘এইতো আছি.. তা হাসপাতালে সারাদিন যে থাকিস ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করিস তো? এ অবস্থায় খাওয়া দাওয়ায় অবহেলা করলে কিন্তু দুজনের ক্ষতি হবে’
রোজা আদনানের দিকে একনজর দেখে হাসিমুখে উত্তর দিলো..
‘তোমার জামাই থাকতে সেই সুযোগ আছে নাকি? দু – তিন ঘণ্টা পর পর আমাকে ফোন করে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়, ইদানিং শান্তিমতো ডিউটি করতে পারছিনা ওর জন্যে আমি’
‘যাক, তুই ভালো আছিস শুনলে চিন্তা একটু কমে আমার.. নাহলে তো’
মায়ের কথা শুনে সন্দেহ হলো রোজার…
‘বাড়িতে সব ঠিক আছে তো মা?’
‘ হ্যাঁ, কি আর হবে?’
‘ আমার মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে। কিছু হয়ে থাকলে বলো আমায়, বাবা কিছু বলেছে তোমাকে?’
‘তোর বাবা কিছু বলেনি, সেও এখন চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারছেনা’
‘কেনো?’
মিনিট দুয়েক নিরব থেকে রোজার মা বললেন…
‘আসলে রাইসাকে দুদিন আগে নিষাদ এ বাড়িতে দিয়ে গেছে আর বলে গেছে ওর সঙ্গে সংসার করবেনা। তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বুঝতে পারছি না কি থেকে কি হলো। আমার মেয়ের কপালটা বুঝি পুড়লো ‘
‘হোয়াট! দিয়ে গেছে মানেটা কি? ও বাড়িতে কি কিছু হয়েছে?’
‘ নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, তারা কিছু বলেনি আর না রাইসা কিছু বলছে। আমি বুঝতে পারছিনা কিছু, তোর বাবা নিষাদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সে একটা কথাও শোনেনি। দুদিন ধরে তোর বাবাও চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ‘
‘ আমি জানতাম এমনকিছুই হবে! বাবার জেদের জন্যে আজ এসব হলো! মা, তুমি রাইসার সঙ্গে থাকো ওকে একলা ছেড়ো না। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি ‘
‘তোকে এখন আসতে হবে না রোজা!’
‘ আমি আসবো মা!’
কল কে’টে দিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো রোজা, আদনান জিজ্ঞাসা করলো…
‘ কি হয়েছে?’
‘ আমি বাড়ি যাবো আদনান ‘
‘কি হয়েছে বলবে তো!’
‘রাইসাকে নিষাদ নাকি বাড়িতে দিয়ে গেছে, আমি জানতাম এমনকিছু একটা হবে। আমি এই ভয়টাই পেয়েছিলাম, নিষাদ যেমন ছেলে তাতে ওর জন্যে বিয়ে ছেলেখেলা মাত্র ‘
‘ রোজা, তুমি আগে শান্ত হও! তোমার এখন কোনো বিষয় নিয়েই উত্তেজিত হওয়া যাবেনা সেটা জানো তো? এমনিতেই হাই প্রেসার আছে তোমার ‘
‘শান্ত হতে পারছি না আমি আদনান, এতো তাড়াতাড়ি যখন ছেড়ে দেওয়ারই প্ল্যান ছিল তাহলে বিয়েটা করেছিলো কেনো ও! আদনান, আমি ও বাড়িতে যেতে চাই এখুনি ‘
‘ রাত হয়েছে রোজা, এখন গিয়ে কি করবে তুমি? কাল সকালে না হয়…’
‘ প্লিজ!’
আদনান জানে রোজাকে ও বাড়ি নিয়ে না যাওয়া অব্দি ও শান্ত হবেনা, তাই বাধ্য হয়ে রাজি হলো!
‘ওকে! আমি তোমাকে নিয়ে যাবো ‘
চলবে…