তোমাতে সূচনা তোমাতেই সমাপ্তি পর্ব-২৪

0
25

#তোমাতে_সূচনা_তোমাতেই_সমাপ্তি
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২৪

পুরো একটা দিন কেটে গেছে, আদনান রোজার সঙ্গে কথা বলেনি। রোজা অবশ্য বলার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু লাভ হয়নি। দুপুরের দিকেই আদনান বেরিয়ে গেছিলো, অনেকটা রাত হয়ে গেছে এখনও নারী ফেরেনি। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে, রোজা বুঝলো সে বুঝি বড্ড অভিমান করেছে। রাত নয়টার পরে বাসায় আসলো আদনান, ড্রইংরুমে বসে ওর অপেক্ষাতেই ছিলো রোজা…

‘ এতো দেরি হলো যে আসতে ‘

আদনান উত্তর দিলো না, জুতো খুলে রেখে সোজা চলে যাচ্ছিলো তখনই রোজা বললো…

‘ আমি খাবার বেড়ে রেখেছি, হাতমুখ ধুয়ে এসে..’

‘আমি খাবো না ‘

‘ আমি জানি তুমি এখনও খাওনি, অনেক রাত হয়েছে। না খেয়ে ঘুমালে…’

রেগে গেলো আদনান…

‘বলছি তো আমি খাবো না, কেনো জোর করছো আমায়? সবকিছুতে তুমি নিজের মর্জি জোর করে চাপিয়ে দিতে পারো না, এই অধিকার তোমার নেই’

সারাদিন কেটে গেছে কিন্তু তার রাগ একটুও কমেনি, রোজাও আর নরম স্বরে কথা বললো না..

‘না খেয়ে থাকলে কি সমস্যার সমাধান হবে?’

‘তো তুমি কি বলতে চাইছো, এতো বড় একটা বিষয় জানার পরে আমি কোনো রিয়েক্ট করবো না? সবকিছু স্বাভাবিক ভেবে দিন কাটাবো?’

‘তাছাড়া আর কি করবে? যা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিকভাবেই নিতে হবে। এই বিষয় নিয়ে তো আর আমরা রোজ ঝামেলা করতে পারবো না আর চাইলেও এখন কিছু বদলাবে না’

‘ ইয়াহ রাইট! কারণ তুমি তো কোনো সুযোগই ছাড় দাওনি। নিজে যেটা করতে চেয়েছো সেটাই করেছো। তুমি তো ভীষণ হ্যাপি তাইনা?’

রাগে ফুঁসছে আদনান, এখন কথা বললেই আরো কথা বাড়বে যা রোজা করতে চাইছেনা। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে রোজা বললো…

‘আদনান প্লিজ! এই সময়টা আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে নয় বরং দুজনে মিলে ইনজয় করতে চাই। একসঙ্গে বেবির আগমনের অপেক্ষা করতে চাই’

‘সরি, বাট আই কান্ট ডু দিজ! সব জানার পরেও তোমার মতো না জানার ভান করে থাকতে পারবো না আমি’

আদনান রুমে চলে গেলো, কিছুক্ষণ পরে রোজাও ঘরে এলো। ঘর অন্ধকার করে চেয়ারে বসে আছে আদনান, রোজা ভেতরে এলে লাইট জ্বালিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে বিছানায় বসলো। মিনিট দশেক দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। না রোজা কিছু বলছে আর না আদনান! নীরবতা ভেঙে রোজা বললো…

‘আমি জানি তুমি আপসেট, কিন্তু তোমাকে যদি আগেই এই কথাটা বলতাম তাহলে তুমি আমায় বেবি রাখতে দিতে না’

‘ হ্যাঁ দিতাম না! বেবি আমার জন্যে এতোটা জরুরি নয়, তুমি আমার জন্যে জরুরি। বেবি চাইলে আমরা পরেও নিতে পারতাম! লাইফ রিস্ক আছে জেনেও এমন একটা বোকার মতো সিদ্ধান্ত আমি তোমায় নিতে দিতাম না!’

‘ কনসিভ করাটা আমার জন্যে এত সহজ হতো না, ডাক্তার বলেছে আমি চাইলেই কনসিভ করতে পারতাম না। এই বাচ্চা অ্যাবোর্ট করার পর যদি আমি আর কখনও মা না হতে পারতাম তাহলে?’

‘ সো হোয়াট? আমরা দুজনে একে অপরের জন্যে যথেষ্ট, আমরাই একে অপরের পরিপূরক হতাম ‘

‘একটা সন্তান ব্যতীত জীবনের পূর্ণতা উপভোগ করা সম্ভব নয়’

‘ ডাক্তার কি বলেছে আমি সবই শুনেছি রোজা, ডেলিভারি সময় তোমার প্রবলেম হতে পারে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার জীবনে পূর্ণতা কিভাবে আসবে? আমার জীবন শূন্য করার জন্যে তুমি এতো ব্যাকুল কেনো, বলো আমায়? কি লাভ হলো তোমার?’

‘আদনান, বিষয়টাকে নেগেটিভলি না দেখে পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করো। প্রেগন্যান্সিতে সবারই টুকটাক সমস্যা থাকে। এসব বাদ দিয়ে তোমার অস্তিত্বের অংশ এ দুনিয়ায় আসছে, বাবা হচ্ছো তুমি। এর থেকে আনন্দের কি আদৌ কিছু হতে পারে?’

‘ইউ আর মাই হ্যাপিনেস, আর তোমার বিনিময়ে যে আনন্দ আসবে তা আমি আমার জীবনে চাইনা। আমার বেবি আসছে, অবশ্যই আমি খুশি কিন্তু তাকে পাওয়ার জন্যে তোমাকে হারাতে হতে পারে এটা আমি মানতে রাজি নই’

রোজার এবার ভয় হচ্ছে, ধীরে ধীরে যেনো বেবির প্রতি আদনানের ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করলো না তো? আদনানের কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ওর কম্পলিকেশনের কথা জানার পর বেবির প্রতি এখন বিরক্ত বোধ করছে সে…

‘বেবি প্ল্যানিং তো আমাদের দুজনের একসঙ্গে করা উচিত ছিলো তাইনা? বেবিটা তো তোমার একার নয় আমারও, তাছাড়া তুমি তো এখন বেবি নেওয়ার জন্যে রেডি ছিলে না তাহলে কেনো..’

‘হ্যাঁ আমি প্রস্তুত ছিলাম না, কিন্তু একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসছে জেনে মা হয়ে আমি তাকে মে’রে ফেলবো? এরকম একটা পাপ করতে বলছো তুমি আমায়?’

‘লিসেন রোজা, আমি তোমার মতো আবেগী হয়ে ভাবতে পারছি না। এক তুমি ছাড়া আমার নিজের বলে কেউই নেই, তুমিও সেটা জানো। কতোটা সাফার করে আমি এই অব্দি এসেছি সেই ধারণা হয়তো তোমার নেই, আমি আর লাইফে কষ্ট পেতে চাইনা কিন্তু তুমি এটা কী করলে?’

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কাঁপছিলো আদনানের, কথার মাধ্যমে রাগ প্রকাশের চেষ্টা করছে ঠিকই কিন্তু তার টলটলে চোখদুটো অসহায়ত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। মলিন হাসলো রোজা, একটা চেয়ার টেনে এনে আদনানের পাশে বসলো…

‘পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েই মা হওয়ার স্বাদ পেতে চায়, অন্য সব বাদ দিলেও এই একটা দিকে মেয়েরা ভীষণ লোভী। সুযোগ পেলে মা হওয়ার লোভ কোনো মেয়েই সামলাতে পারেনা’

আদনান ছলছল চোখে তাকালো রোজার দিকে, অভিযোগের স্বরে বললো…

‘আর আমার কি হবে? শুধু নিজের দিকটাই ভাবলে রোজা? সব জেনেও এতো বড় একটা রিস্ক নিলে, তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে সেটা তো ভাবলেই না। এতোটা সেলফিস তুমি জানা ছিলো না আমার’

নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত রোজা, নিজের অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয় সেটাও জানে তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে নিজের সন্তান ও আদনানের কথা ভেবে। এখন আদনানকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে ওর নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়ছে। চোখদুটো ভিজে এসেছে রোজার, তবুও আদনানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো..

‘তুমি শুধু শুধু এতো ভয় পাচ্ছো, দেখবে আমার কিছু হবেনা। সব ঠিক থাকবে’

‘ মিথ্যা শান্তনা দিও না আমায়, আমি জানতাম না তুমি এতো স্বার্থপর। আগে জানলে তোমাকে বিয়ে করে আমার জীবনের কষ্ট আরো বাড়াতাম না’

শত কষ্টের মাঝেও আদনানের কথা শুনে হাসি পেলো রোজার…

‘এতদিন পর আর আফসোস করে লাভ কি?’

আদনান এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলো না, রোজাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। সবসময় যে লোকটাকে শান্ত ও শক্ত স্বভাবের দেখে এসেছে তার এই কান্না রোজাকে অবাক করলো বটে। পর মুহূর্তে রোজা উপলব্ধি করলো ওকে হারানোর ভয় আদনানকে ঝেঁকে ধরেছে। রোজাও জড়িয়ে ধরলো ওকে, আদনান ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো…

‘স্বার্থপর না হলেও পারতে তুমি রোজা, তুমি যদি জানতে আমার মনের মধ্যে এ মুহূর্তে কি চলছে তাহলে বুঝতে পারতে যে তোমাকে হারানোর ভয় আমার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এভাবে আমি থাকবো কি করে?’

‘ ডোন্ট ওরি, যা হবে ভালোই হবে। শান্ত হও তুমি’

আদনানকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করতে থাকলো রোজা, এদিকে আদনান যে নিজেকে সামলাতে পারছেনা। রাগ হচ্ছে রোজার ওপর কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই, যা হচ্ছে সেটাই মেনে নিতে হবে। সাধারণত সন্তানের আগমনের সংবাদ একজন পুরুষকে সর্বোচ্চ আনন্দ দেয় কিন্তু আদনানের ভয় হচ্ছে যে সন্তানের আগমন না ওর জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের কারণটা ছিনিয়ে নেয়!
_________________________________

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলছে…কনকনে শীত! বর্তমানে সাত মাস চলছে রোজার, ডাক্তার বলেছে ওকে বিশ্রামে থাকতে। এ অবস্থায় জার্নি করে হসপিটালে যাওয়া আসাটা অনেক ধকলের কাজ আর ওর শরীরের অবস্থাও তেমন সুবিধার নয় তাই জবটা ছেড়ে পার্মানেন্টলি বাড়িতে এখন রোজা। ইদানিং কোনো খাবারেই যেনো রুচি নেই রোজার, বলতে গেলে প্রায় খেতেই পারেনা। আদনান যথেষ্ট চেষ্টা করে ওর জন্যে মুখরোচক খাবার বানানোর কিন্তু মুখে রুচি না থাকলে কি জোর করে খাওয়া সম্ভব? আর খেলেও বা, কিছুক্ষণের মধ্যেই ব’মি চলে আসে ওর। আদনান নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রেখে রোজার যত্ন করার চেষ্টা করছে। যা হবার হয়েছে, তা তো আর ঠিক করা যাবেনা। এক বিষয় ধরে এই মুহূর্তে মেয়েটার অযত্ন করা যাবেনা। বিকেলে আজ সবজি খিচুড়ি রান্না করে দিয়েছে আদনান, রোজা ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছিলো। রোজার হাতে খিচুড়ির প্লেটটা দিয়ে একটা চাদর এনে ওর গায়ে জড়িয়ে আদনান বললো…

‘চাদরটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নাও, অনেক ঠান্ডা এখন। সর্দি লাগলে কিন্তু সমস্যা হয়ে যাবে ‘

চাদরটা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে এক চামচ খিচুড়ি মুখে দিতেই মুখ গোমড়া করলো রোজা..

‘ভালো হয়নি?’

‘ ঝাল এতো কম কেনো?’

‘তোমার অতো ঝাল খাওয়া যাবেনা, আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। ঝাল মশলা এসব তোমার কম খেতে হবে, আমি ভাবছি এসব বাদ দিয়েই…’

‘এই না না, এগুলো বাদ দিলে তো আমি কিছু খেতেই পারবো না। আমার বেশি ঝাল মশলা পছন্দ, এমনিতেই এই কম ঝাল খাবার খেতে ভালো লাগছেনা’

‘এভাবেই খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে এখন থেকে ‘

নাকমুখ বন্ধ করে খিচুড়ি খেতে লাগলো রোজা, খেতে খেতে এক পর্যায়ে হুট করেই ও বলে বসলো..

‘আদনান, আমার মনে হয় আমাদের একদিন তোমার বাসায় যাওয়া উচিত!’

অবাক হলো আদনান…

‘ আমার বাসা?’

‘ হুমম, যেখানে তুমি বড় হয়েছো! তুমি বাবা হচ্ছো এই সুখবরটা নিশ্চয়ই তোমার বাবা জানেনা? চলো গিয়ে ওনাকে সারপ্রাইজ দেই?’

‘কি প্রয়োজন এসবের? তাছাড়া আমি সব সম্পর্ক ছি’ন্ন করে চলে এসেছি এরপর ওখানে গেলে কেমন দেখাবে?’

‘যাদের সঙ্গে বলতে গেলে সারাজীবনের সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে কি এতো সহজেই সম্পর্ক ছি’ন্ন হয়? তুমি গেলে দেখবে তোমার বাবা অনেক খুশি হবে, আর আমারও তো ওনার সঙ্গে দেখা করা হয়নি। বৌমা হিসেবে শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করা কি আমার দায়িত্ব নয়?’

‘তো এতদিন তোমার এ কথা মনে না হয়ে এখন কেনো মনে হলো?’

‘আহা, এভাবে জেরা কেনো করছো? চলো না ঘুরে আসি তোমার বাসা থেকে। ঘরে বসে থেকে আমার আর ভালো লাগছেনা’

আদনান প্রথমে রাজী হয়নি কিন্তু রোজা এতো জোরাজুরি করলো যে ও বাধ্য হলো! পরেরদিন দুপুরে আদনান রোজাকে নিয়ে ওর বাসায় গেলো, এক বছরের অধিক সময় পর এ বাড়িতে পা রাখতেই শৈশবের স্মৃতিগুলো যেনো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। জীবনের অধিকাংশ সময়টা তো এখানেই কাটিয়েছে।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]