#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| পঞ্চম পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
শুভ্রাকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। ছেলের বাড়ির লোকের সামনে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরে বসে আছে শুভ্রা। টুকটাক প্রশ্ন করা হচ্ছে ওকে। ও শান্ত স্বরে উত্তর দিচ্ছে। ওর পাশেই বসে আছেন ওর মা, মলিনা দেবী।
উর্মি, রুশিতা, উর্জা, তাপ্তি আর প্রজ্ঞা বসার ঘরের দরজার বাইরে পর্দার আড়াল থেকে সব দেখছে। ওরা ভিতরে থাকার অনুমতি পায়নি। ঘরের ভিতরে শুভ্রা ছাড়া সব বড়োরা আছে। কিন্তু শান্তিনিবাসের এই কিচিরমিচির পাখিরা কৌতূহল চেপে রাখতে পারছে না কিছুতেই। তাই গুপ্তচরবৃত্তিই একমাত্র উপায় এই মুহূর্তে।
এর মধ্যে প্রজ্ঞা দুইবার জোরে হাঁচি দিতে গিয়েছে। উর্মির চোখ রাঙানি দেখে কোনো রকমে সামলেছে নিজেকে। নাহলেই ওদের এই গোপনে সব কিছু দেখায় জল ঢালা হয়ে যেত। আর তারপর রণজিৎ তালুকদারের রাগ থেকে ওদের কেউ বাঁচাতে পারতো না।
পাত্র অর্থাৎ অনিকের মা এবার মৃদু হেসে তালুকদার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা, আমাদের মধ্যে যা কথা হওয়ার তো হচ্ছেই। এবার যদি অনিক আর শুভ্রা একটু নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেয়, তাহলে ভালো হয়। কি বলেন দাদা?”
রণজিৎ তালুকদার ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। ওদের নিজেদের মধ্যে কথা হওয়াটা দরকার। হাজার হোক, ওদের জীবন। সিদ্ধান্তটা ওদেরকেই নিতে হবে।”
ওনার কথা শুনে হাসি পেলো শুভ্রার। হাসি পেলো পর্দার আড়ালে থাকা বাকিদেরও। তালুকদার সাহেব বাচ্চাদের কত যে সিদ্ধান্ত নিতে দেন, সেটা ওদের থেকে ভালো আর কে জানে!
রণজিৎ তালুকদার ইশারা করলেন মলিনা দেবীর দিকে তাকিয়ে। মলিনা দেবী দাদার ইশারার অর্থ বুঝলেন। তিনি শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শুভ্রা মা, যাও, অনিককে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। কথা বলো তোমরা।”
শুভ্রা মার কথা শুনে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো। খুব দ্রুত উঠতে বা হাঁটা চলা করতে তাকে বারণ করা হয়েছে। ছেলের বাড়ির সামনে নাকি শান্ত শিষ্ট হয়ে থাকতে হয়। অবশ্য, শুভ্রা এমনিতেই যথেষ্ট শান্ত।
শুভ্রা অনিকের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
“আসুন।”
অনিক বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়ালো। শুভ্রা দরজার দিকে এগোলো। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা উর্মি, রুশিতারা হুড়মুড় করে দৌড় লাগালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ওরা।
শুভ্রা বসার ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির দিকে এগোলো। ওদের সব মেয়েদেরই ঘর দোতলায়। অনিক শুভ্রার পিছন পিছন এগোলো। শুভ্রার ঘরে ঢুকে অনিক একটু দাঁড়ালো। তারপর শুভ্রার বিছানায় গিয়ে বসলো। শুভ্রা এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। তারপর এক সময়ে অনিকই নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো,
“বাহ্, তোমার ঘরটা তো অনেক গোছানো!”
শুভ্রা হাসলো। তারপর বললো,
“হ্যাঁ, আমি সব কিছু গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করি।”
“আমার ঘর আবার একেবারেই এলোমেলো। প্রথম প্রথম হয়তো তোমার অসুবিধা হবে। একটু গুছিয়ে নিও।”
শুভ্রা কিছু না বলে হাসলো। অনিক বললো,
“তুমি কি এরকমই চুপচাপ? নাকি ভয় পাচ্ছ আমায়?”
শুভ্রা অবাক কণ্ঠে বললো,
“ওমা, ভয় পাবো কেন?”
“পেতেই পারো।”
“নাহ্, মোটেই পাচ্ছিনা।”
“বেশ, তাহলে ভালো। শোনো, আমাদের বিয়ের এখনও অনেকটা দেরি আছে। কারণ এর মধ্যে কোনো শুভদিন নেই। মা আলোচনা করছিলেন তোমার মামার সাথে। এতে আমাদের ভালোই হলো, আমরা নিজেদের মধ্যে পরিচিত হতে পারবো, একে অপরকে জানার সময় পাবো।”
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক। আর হুট্ করে বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুতও ছিলাম না। তাই একটু সময় পেলে ভালোই হবে।”
“তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম, তুমি প্রস্তুত নও। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
“আমাকে বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?”
“আপত্তি থাকবে কেন?”
“আপত্তি থাকার অনেক কারণই হতে পারে। সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আছে কিনা জানতে চাইছি।”
“নাহ্, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি এই বিয়েতে রাজি আছি।”
“যাক, বাঁচা গেলো। যদি বিষয়টা এমন হতো, যে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে বিয়ে করানো হচ্ছে আমার সাথে, তবে আমি বিয়েটা ভেঙে দিতাম। কারণ জোর জবরদস্তি করে আর যাইহোক, সংসার হয়না।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। হ্যাঁ, প্রথমে বিয়েতে ওর সম্মতি ছিল না ঠিকই। তবে সে কথা ও কাউকে জানাতে পারেনি, সেই সাহস হয়নি। আর এখন অনিককে দেখে, অনিকের সাথে কথা বলে ওর মনে হচ্ছে, এই ছেলেটা অতটাও খারাপ না। এর সাথে শুভ্রা দিব্যি সংসার করতে পারবে। তাই এখন আর বিয়েতে শুভ্রার কোনো আপত্তি নেই।
অনিক বললো,
“আচ্ছা, তোমার ফোন নাম্বারটা দাও তো। পার্সোনাল ফোন আছে তো তোমার?”
“হ্যাঁ, আছে।”
“বেশ। নাম্বার দাও।”
শুভ্রা নাম্বারটা বললো। অনিক নিজের ফোনে সেভ করে নিলো নাম্বারটা। তারপর বললো,
“আমি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করবো বাড়ি ফিরে। সেভ করে নিও। ইয়ে, ফেসবুক করো?”
“না, আমি হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া আর কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ইউস করি না।”
অনিক বেশ অবাক হলো শুভ্রার কথাটা শুনে। বিস্মিত ভাবে বললো,
“বলো কি, এই যুগে এসেও তুমি সোশ্যাল মিডিয়া ইউস করো না? তুমি তো ভিন গ্রহের প্রাণী হে!”
অনিকের বলার ধরণ দেখে শুভ্রা হেসে ফেললো। হাসলো অনিকও। তারপর আর সামান্য কিছু কথা বলে ওরা দুজন নেমে এলো নিচে, একতলায়। যেখানে বসার ঘরে সবাই অপেক্ষা করছে ওদের জন্য।
____
কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে রুশিতা। পরপর দ্রুত বেগে গাড়ি যাচ্ছে। পার হওয়ার জন্য সময়ই পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে রুশিতা খুব একটা ভালোভাবে রাস্তা পেরোতে পারেনা। অন্যদিন তো উর্জা থাকে ওর সাথে। কিন্তু আজ উর্জাও নেই, সে কলেজ আসেনি। তাই রুশিতা আজ বেশ ঝামেলাতেই পড়েছে।
রুশিতা আশপাশে তাকিয়ে দেখছে, আরও কেউ রাস্তা পেরোনোর চেষ্টায় আছে কিনা। কিন্তু নাহ্, তেমন কাউকে চোখে পড়লো না। সবাই যে যার মতো ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ওর দিকে তাকানোরও ফুরসৎ নেই কারো। রুশিতা হতাশ হলো। আর কেউ রাস্তা পেরোলে ও তার সাথে একসাথে পার হয়ে যেত। কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ। তাই ও আবারও দুইদিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে থাকলো, আর অপেক্ষা করতে থাকলো কতক্ষনে এই গাড়ির জোয়ার থামবে।
একটু পর গাড়ির ভিড় একটু হালকা হতেই রুশিতা রাস্তা পেরোতে শুরু করলো। কিন্তু মাঝ রাস্তা অবধি যেতেই ঘটলো বিপত্তি। একটা বাইক এসে কোনো রকমে রুশিতার গা ঘেঁষে ব্রেক কষলো। আরেকটু হলেই রুশিতার গায়েই ধাক্কা লাগতো। বাইকের আরোহী চিৎকার করে উঠলো,
“হোয়াট দা হেল! দেখে রাস্তা পেরোতে পারেন না? চোখ কোথায় থাকে?”
রুশিতা তাকিয়ে দেখলো, আরোহী একজন পুলিশ। পুলিশ দেখেই ওর মেজাজটা চড়ে গেলো। এদিকে সেই পুলিশ রাস্তার অপর পাড়ে নিজের বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে তারপর রুশিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন সেদিকের ফুটপাথে। তারপর বললেন,
“ঠিক করে রাস্তা পেরোতে কি সমস্যা হয়?”
রুশিতা এতক্ষণ পুলিশদের প্রতি ওর রাগটা চেপে রেখেছিলো। এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,
“নিজেদের ডিউটি ঠিক করে পালন করতে কি হয়? অমেরুদণ্ডী প্রাণী যতসব!”
পুলিশটি স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ অবাক হলো রুশিতার কথায়। সে রেগেমেগে বললো,
“হেই, তোমার সাহস কিভাবে হয় ইন্সপেক্টর শ্রাবণ মল্লিকের সাথে এভাবে কথা বলার?”
“কেন, আপনি কি ইন্সপেক্টর চুলবুল পান্ডে যে আপনার সাথে এভাবে কথা বলা যাবে না?”
“হোয়াট! চুলবুল পান্ডে! এই মেয়ে, তোমার কি মাথার সমস্যা আছে নাকি?”
“নাহ্, একেবারেই নেই। আর অতো অ্যাটিটিউড দেখানোরও কিছু নেই। আমি ঠিকভাবেই রাস্তা পেরোচ্ছিলাম। আপনি ত্যাড়া ব্যাঁকা ভাবে বাইক চালাচ্ছিলেন।”
“তুমি কি বলতে চাও, আমি নিজে পুলিশ হয়ে ট্রাফিক রুলস ভাঙবো? আমি পুলিশের উর্দিটা টাকা কামানোর জন্য না, দায়িত্ব পালনের জন্য পরি ঠিক আছে? তুমি চোখ আকাশে তুলে রাস্তা পার হচ্ছিলে, আর এক্সিডেন্ট হলে দোষ হতো আমার। সব সময় এটাই হয়, পথচারীদের দোষ হয়না কখনও। সো নেক্সট টাইম থেকে ভদ্র ভাবে রাস্তা পেরোবে ওকে?”
কথা শেষ করেই শ্রাবণ গিয়ে নিজের বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো। তারপর হুশ করে বেরিয়ে চলে গেলো। রুশিতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো চুপচাপ। তারপর হাঁটতে শুরু করলো। আর হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে হাজারটা গালি দিতে থাকলো শ্রাবণকে। রাস্তার পাথরগুলোয় লাথি মারতে মারতে এগোলো ও। ওর সব রাগ বর্ষিত হতে থাকলো এইসব জড় পদার্থের উপর।
চলবে….