চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-০৯

0
7

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| নবম পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

“ব্রেকিং নিউজ। রাতের অন্ধকারে লরির সাথে ধাক্কায় গুরুতর আহত ইন্সপেক্টর শ্রাবণ মল্লিক। তিনি কলকাতার নির্মম ধর্ষণ কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন।
লরিটিকে ঘটনাস্থলেই পাওয়া গিয়েছে। সম্পূর্ণ ফাঁকা একটি লরি ছিল এটি। লরি চালক পলাতক। সন্দেহ করা হচ্ছে, এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ঘটনা, যাকে দুর্ঘটনার মোড়ক দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তদন্ত বন্ধ করানোর জন্যই শ্রাবণ মল্লিককে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে।”

প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে এখন এই একটাই খবর ঘুরছে। প্রতিটা খবরের কাগজের হেডলাইনও এই একটাই। সারা কলকাতা আবারও উত্তাল। শ্রাবণ মল্লিক তদন্তে গতি এনেছিল। বেশ কিছু অজানা তথ্য সামনে আনছিল সে। কিন্তু এবার তাকেই সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত!

গতকাল রাত থেকে হসপিটালে শেখর মল্লিক এবং তার পরিবার। শ্রাবণকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে। মাথাতেও বড় রকমের ফ্র্যাকচার হয়েছে। ডাক্তাররাও আশার কথা কিছু শোনাতে পারছেন না। যদিও বা শ্রাবণ বেঁচেও যায়, তবুও স্মৃতিভ্রংশ অথবা পক্ষঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর তার আগে, শ্রাবণের বেঁচে ওঠার সম্ভাবনাই তো ক্ষীণ।

উমা দেবী চিন্তায় চিন্তায় অজ্ঞান প্রায়। প্ৰিয় ছেলের এই অবস্থা উনি মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। ওনার ছোট জা, শ্রীনাথ মল্লিকের স্ত্রী কবিতা দেবী ওনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। সান্ত্বনা দেওয়ার মত ভাষা ওনার কাছেও নেই। ভাশুরপোর এই অবস্থায় তিনিও শোকাহত। শ্রাবণ পরিবারের সকলেরই প্ৰিয় ছিল। আজ সে যখন জীবন – মরণের সন্ধিক্ষণে, তখন সবার চোখেই জল।

ঈশিতা আর নিশিতা একপাশে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছে। দুঃস্বপ্নেও ওরা আজকের দিনটার কথা কল্পনা করতে পারেনি। যতবার দাদাভাইয়ের রক্তাক্ত মুখটার কথা ভাবছে, বুকটা হাহাকার করে উঠছে। ওদের সুখের জীবনে এরকম বড় আঘাত হানলো কে? তাকে হাতে পেলে ওরা হয়তো টুকরো টুকরো করে ফেলতো।

প্রিয়ম শেখর মল্লিকের সাথে ছোটাছুটি করছে, ডাক্তারদের সাথে কথা বলছে। দাদার এই অবস্থায় সে নিজেও মর্মাহত, কিন্তু ভেঙে পড়লে তো তার চলে না। হাজার হোক, দাদার পর সেই বাড়ির একমাত্র ছেলে। সবাইকে সামলে রাখার দায়িত্ব তো তার মাথার উপরেও আছে।

হঠাৎই হসপিটালে হইচই শুরু হয়ে গেলো। স্টাফদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা দেখা গেলো। বাকিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেখর মল্লিকের সামনে এসে দাঁড়ালেন রণজিৎ তালুকদার। যাকে দেখে, যারপরনাই অবাক হলো সবাই।

আসল বিষয়টা হচ্ছে, শ্রাবণের এক্সিডেন্ট যেখানে হয়েছে, সেই এলাকাটা রণজিৎ তালুকদারের বিধানসভা এলাকার অন্তর্গত। নিজের এলাকায় এমন একটা দুর্ঘটনা হওয়াতেই তালুকদার সাহেব হসপিটালে এসেছেন, নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে। নিজের স্বার্থ ছাড়া তিনি কোনো কাজ করবেন, এটা তো ভাবাও ভুল হবে।

শেখর মল্লিক তালুকদার সাহেবকে দেখে এগিয়ে আসলেন। তালুকদার সাহেব হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। মল্লিকমশাই প্রতি-নমস্কার জানালেন। তারপর বললেন,

“কি ব্যাপার তালুকদার, তুমি এখানে?”

“আমার এলাকায় দুর্ঘটনা হয়েছে শেখর। তার উপর, তুমি আমারই দলের বিধায়ক। আমরা সহকর্মী। এই সময়ে না এসে পারি?”

“এতো মধুর সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই। বিষয়টা এমন না তো, যে এর পিছনে তোমার হাত রয়েছে আর তুমি সন্দেহের তালিকা থেকে দূরে থাকার জন্য এখানে এসেছো?”

“সন্দেহ করা ভালো, তবে এতো সন্দেহ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর শেখর। তোমার সাথে আমার সম্পর্ক অতিরিক্তই তিক্ত হলেও, শ্রাবণের সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তাই এখানে আমি শুধুই মানবিকতার খাতিরে এসেছি।”

শেখর মল্লিক আর কিছু বললেন না। যেহেতু শ্রাবণকে দেখার উপায় নেই, তাই তালুকদার সাহেব শেখর মল্লিকের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তারপর সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। মল্লিকমশাই যদিও তালুকদার সাহেবের এই হঠাৎ আগমনকে সন্দেহের তালিকা থেকে সরাতে পারলেন না।
____

নিজের ঘরে বসে মোবাইলে গেম খেলছিল উদিত। গেম যখন বেশ জমে উঠেছে, তখনই ঘরে এসে ঢুকলো আয়ুশ। এসেই উদিতের মাথায় বেশ জোরেই একটা গাট্টা মারলো ও। তারপর ধপ করে বসে পড়লো উদিতের পাশে। উদিত গেমটা এক্সিট করে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কি হয়েছে?”

“সারাদিন গেমই খেলে যা। খোঁজ খবর কিছুই রাখিস না দেখছি।”

“কিসের খোঁজ খবর? কি হয়েছে বলবি তো?”

“রেপ কেসের তদন্ত করছিলো যে পুলিশ অফিসার, শ্রাবণ মল্লিক, তার এক্সিডেন্ট হয়েছে। এমনিতে দুর্ঘটনা মনে হলেও সবাই ভাবছে যে এটা পরিকল্পিত ভাবে খু’নের চেষ্টা।”

“বলিস কি রে? তার অবস্থা কেমন এখন? বেঁচে আছে?”

“অর্ধমৃত। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। আইসিইউতে আছে। আর এই পুলিশটা কার ছেলে জানিস? শেখর মল্লিকের ছেলে।”

“পাশের বিধানসভা এলাকার বিধায়ক না? জেঠুমনির দলের লোক তো। এর মানে তো রাজনীতিতেও তোলপাড় হবে।”

“হবে আবার কি? শুরু হয়ে গিয়েছে অলরেডি। ওকে খু’নের চেষ্টাটা বড় কাঁচা কাজ হয়ে গেছে। জেঠুমণিও তো আজ হাসপাতালে গিয়েছিলো।”

“তাই? কিন্তু জেঠুমণির সাথে তো ওই লোকের সম্পর্ক বিশেষ ভালো না।”

“জানি। সবই রাজনীতি রে! জেঠুমণিও গেছে নিজের ইমেজ ঠিক রাখতে। নাহলে যেত বলে মনে করিস তুই?”

“হুহ, ঠিক বলেছিস। সব স্বার্থপর চারদিকে।”

“একেবারেই তাই। এই একটা লোক তাও একটু ঠিকভাবে তদন্ত করতে নেমেছিল। একেও সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। কে জানে কাদের মদত আছে এর পিছনে?”

“সরকারেরও থাকতে পারে। কারণ টিভির পর্দায় সরকারি মন্ত্রীসভা যতই বড় বড় কথা বলুক, বাস্তবে তারা চায়না যে তদন্ত হোক। কারণ কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসতে পারে।”

“হ্যাঁ। অনেকের অনেক স্বার্থ আছে এর পিছনে। একটা যা দায়িত্ববান পুলিশ ছিল, তাকে রাখলো না। এরপর কেসটা ক্লোজ হয়ে যাবে। আর মেয়েদের সাথে যা হচ্ছে, চলতেই থাকবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।”

“জানি। আমারও এটাই ধারণা।”

ওদের আলোচনা চললো আরও অনেকক্ষণ। নিজেদের রাগ ক্ষোভ একে অপরের সামনে উগড়ে দিলো ওরা। এবং সব শেষে, দুজনকেই গ্রাস করলো একরাশ হতাশা। এই হতাশা কি শেষ হওয়ার নয়? মহানগরী কি সুস্থ জীবনে ফিরবে না আর?
____

টিভি চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো স্তম্ভিত রুশিতা। টিভির পর্দায় এই মুহূর্তে যা দেখাচ্ছে, তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। নিজের দুই চোখকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এতো কাকতালীয় ঘটনাও হয় কখনও?

টিভির পর্দায় ইন্সপেক্টর শ্রাবণ মল্লিকের দুর্ঘটনার খবর দেখাচ্ছে। ইনসেটে বারবার দেখানো হচ্ছে শ্রাবণ মল্লিকের ছবি। আর সেই ছবি দেখেই অবাক রুশিতা। এই লোকটার সাথেই তো আগেরদিন ওর ঝামেলা হয়েছিল। হ্যাঁ, শ্রাবণ মল্লিকই তো নাম বলেছিলো লোকটা।

শ্রাবণ তাহলে সত্যিই সৎ পুলিশ অফিসার। অথচ রুশিতা তাকে কতই না খারাপ ভেবেছিলো। অত্যন্ত খারাপ ব্যবহারও করেছিল ও। যদিও বাস্তবিকই সেইদিন দোষটা ওর নিজের ছিল। এখন সেই কথাগুলো ভাবতেই খারাপ লাগছে।

পুরো খবরটা শোনার পর ভীষণ রাগ হলো রুশিতার। এই রাজ্যে কি ভালো লোকেরা বাঁচতে পারবে না? একজন পুলিশ অফিসারের সাথেই যদি এমন হয়, তবে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কি হবে? কোথায় যাবে ওরা?

এগুলো সবই তদন্ত বন্ধের চক্রান্ত, সেটা বুঝতে বাকি নেই রুশিতার। অনেক ঠান্ডা মাথার কাজ এটা। অনেকদিন ধরে ভাবনা চিন্তা করে কাজটা করা হয়েছে। এর পিছনে প্রভাবশালী লোকের মদতও থাকতে পারে।

টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে, হসপিটালে গিয়েছিলেন রণজিৎ তালুকদার। দেখে অবাক হলো রুশিতা। বাবা গিয়েছিলেন? কিন্তু কেন? এখানে আবার বাবার কি স্বার্থ থাকতে পারে? বুঝতে পারলো না রুশিতা।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে, রুশিতার মাথায় ঘুরতে থাকলো শ্রাবণের কথা। পুলিশদের ঘৃণা করা রুশিতার আজ একজন পুলিশের জন্য ভীষণ মন খারাপ হলো। জীবনে এই প্রথমবার।

চলবে…..