চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১২

0
58

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| দ্বাদশ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

চারদিনের জন্য পুরুলিয়া বেড়াতে এসেছে রুশিতারা। উদ্দেশ্য, এখানের পাহাড়গুলো ঘুরে দেখা এবং বিখ্যাত ছৌ নাচ দেখা। এছাড়াও সাঁওতাল নৃত্য দেখা এবং অন্যান্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখাও ওদের উদ্দেশ্য।

শহরের কোলাহল থেকে কিছুদিনের জন্য পরিত্রাণ পেতেই মূলত এখানে আসা। ওদের সাথে বড় কেউই নেই। শুধু ওরা কাজিনরা মিলেই এসেছে। আদিত্য আর শুভ্রা, ওদের মধ্যে সব থেকে বড় এই দুজনের উপরেই রণজিৎ তালুকদার ওদের সকলকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন।

এখানে ওরা একটা বাংলো ভাড়া করে তাতে রয়েছে। রণজিৎ তালুকদারই ঠিক করে দিয়েছেন এই বাংলোটা। রান্নার জন্য ওদের সাথে এসেছে একজন রাঁধুনি ও দুজন হেল্পার। দুপুর এবং রাতের খাওয়া বাড়িতেই খেতে হবে, বাইরে খাওয়া যাবে না। এটাও তালুকদার সাহেবের কড়া নির্দেশ। উনি সামনে না থেকেও যেন সর্বক্ষণ ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন ওদের উপরে।

বাংলোয় ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সবাই। সাড়ে আট ঘন্টার টানা জার্নি করে কলকাতা থেকে এসে পৌঁছেছে ওরা। আরও কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছাতে পারতো, কিন্তু রাস্তায় যানজটের কারণে এতটা দেরি হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রত্যেকেই ভীষণ ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সবাই-ই উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

বাংলোয় মোট ছয়টা ঘর আছে। আর ওরা মানুষ আছে ৯ জন এবং রাঁধুনি এবং ড্রাইভারদের ধরলে ১২ জন। ঠিক হলো, দোতলায় একটা ঘরে রুশিতা আর উর্জা, একটা ঘরে শুভ্রা আর উর্মি এবং একটা ঘরে তাপ্তি আর প্রজ্ঞা থাকবে। এক তলায় একটা ঘরে আদিত্য, আয়ুশ আর উদিত একসাথে থাকবে। বাকি দুটো ঘরে রাঁধুনি আর ড্রাইভাররা ভাগাভাগি করে থাকবে।

ঘর ভাগাভাগি হয়ে যেতেই যে যার জন্য বরাদ্দ ঘরে চলে গেলো। এই বেলা সবাই বাড়িতেই থাকবে বলে ঠিক হলো। বিকেলে ঘুরতে বেরোনো যাবে। ততক্ষণ নাহয় বিশ্রাম করা যাক।

বাংলোর প্রত্যেকটা ঘরের সাথেই অ্যাটাচড বাথরুম রয়েছে। রুশিতা আর উর্জা নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা লক করলো। তারপর প্রথমে উর্জা বাথরুমে গেলো স্নান করতে এবং ড্রেস চেঞ্জ করতে। রুশিতা বিছানার উপর গিয়ে বসলো।

রুশিতাকে ইতিমধ্যেই একবার ওর হবু বরের সাথে দেখা করতে হয়েছে। তার নাম, সুপ্রতিম ব্যানার্জী। ফোনেও তার সাথে কথা বলতে হচ্ছে রুশিতাকে। যে কারণে ও খুবই বিরক্ত। তার থেকেও বেশি বিরক্ত এই কারণে যে, ওর কাজিনরা সারাক্ষণ ওকে সুপ্রতিমের নাম নিয়ে টিজ করে যাচ্ছে। রুশিতা কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে, এই বিয়ে কিছুতেই হওয়ার নয়। যে ভাবেই হোক ও এই বিয়ে ভেঙেই ছাড়বে।

সুপ্রতিম ছেলেটাকে দেখতে খারাপ নয়। বরং, বেশ আকর্ষণীয় তার চেহারা। যে কোনো মেয়েরই তাকে পছন্দ হতে বাধ্য। তবে অবশ্যই, যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। রুশিতার ক্ষেত্রে বিষয়টা আলাদা। ও প্রথম থেকেই বিয়েতে রাজি নয়, সুপ্রতিমকে দেখার আগে থেকেই। সুপ্রতিমের সাথে দেখা করতেও ওকে এক প্রকার জোর করেই পাঠানো হয়েছিল। এই কারণে প্রথম থেকেই সুপ্রতিম সম্পর্কে ওর মন বিষিয়ে রয়েছে। তাই, সুপ্রতিম যত সুদর্শনই হোক না কেন, রুশিতার তাকে কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না।

রুশিতার ভাবনার মধ্যে ছেদ ঘটিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো উর্জা। রুশিতার সামনে এসে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

“কি ব্যাপার, মহারানী কি হবু জামাইবাবুর চিন্তায় মগ্ন নাকি?”

রুশিতা বিরক্ত হলো। তারপর বললো,

“একটা সত্যি কথা বলি উর্জা? এই লোককে বিয়ে করার থেকে ভালো আমি কোনো পুলিশকে ধরে বিয়ে করে নেবো।”

রুশিতার পুলিশদের প্রতি ক্ষোভের কথা উর্জার অজানা নয়। তাই এই কথাটা শুনে ও প্রথমে একচোট হেসে নিলো। তারপর হাসতে হাসতেই বললো,

“বাহ্ ভাই বাহ্! অমন সুন্দর ছেলেটাকে তোর পছন্দ হলো না, এদিকে যে পুলিশ তোর দুই চোখের বিষ, তাদের একজনকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি? যাক, আমি সুপ্রতিমদাকে বলবো পুলিশের চাকরি নিতে। তারপরই নাহয় বিয়ে করিস তুই।”

রুশিতা চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো উর্জার দিকে। তারপর নিজের জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো স্নান করতে। আর উর্জা রুশিতার ছুঁড়ে দেওয়া বালিশটা ক্যাচ ধরে নিয়ে হাসতে থাকলো। রুশিতাকে জ্বালিয়ে ও সবসময়ই ভীষণ মজা পায়।
____

দুপুরে খেতে বসেছে রুশিতারা সবাই মিলে। সাধারণ বাঙালি খাবারই রয়েছে পাতে। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগের ডাল, পনিরের তরকারি, কাতলা মাছের কালিয়া। মাছটা নাকি এলাকারই পুকুর থেকে ধরে আনা, একেবারে টাটকা মাছ।

জার্নি করে আসার ফলে কেউই বেশি খেতে পারছে না। যদিও রান্না খুবই সুস্বাদু হয়েছে। সবাই-ই অল্প অল্প করে খেয়ে উঠে পড়লো। তারপর হাত – মুখ বাংলোর উঠোনে বেরিয়ে এলো ওরা। উঠোনের একপাশে ছোট্ট একচিলতে ফুলের বাগান রয়েছে। এই নভেম্বরের শীতের মরসুমে সেখানে কিছু গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফুটেছে।

রুশিতা, উর্জা, তাপ্তি ফুলগাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ফটো তুললো। বেড়াতে আসলে সব জায়গায় দাঁড়িয়েই ফটো তোলাটা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে ওরা। তাই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফটো তোলা চললো। ওদের দেখাদেখি উর্মি আর শুভ্রাও কিছু ফটো তুললো। তখন আর প্রজ্ঞা বেচারিই বা বাদ যায় কেন? সেও দাঁড়িয়ে পড়লো পোজ দিয়ে!

এরপর কিছুক্ষণ উঠোনে হাঁটাহাঁটি করলো ওরা। উদ্দেশ্য, খাবার হজম করা। অল্প খাওয়াতেই পেট যেন ভার হয়ে রয়েছে। সত্যি বলতে এতটা পথ আসার ফলে ওদের উপর দিয়ে যে ধকলটা গিয়েছে, সেটার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে ওদের।

ওদেরকে রেখে আদিত্য একটু বেরিয়েছিল। আসলে, ছোট ভাইবোনদের সামনে এতক্ষণ সে সিগারেট খেতে পারেনি। আর এখন তার নেশাটা চাগাড় দিয়ে উঠছে। তাই খুঁজতে বেরিয়েছিল কাছাকাছি কোনো মুদিখানার বা চায়ের দোকান আছে কিনা। আর পেয়েও গিয়েছে একটা ছোট চায়ের গুমটি। সেখান থেকে একটা সিগারেট আর এককাপ চা খেয়ে বাংলোয় ফিরে আসলো আদিত্য।

এদিকে শুভ্রা ফোনে অনিকের সাথে কথা বলেই যাচ্ছে অনেকক্ষণ দেখে। সেটা দেখে উর্মি মুচকি হাসলো। সত্যি, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজেও এমন প্রেমালাপ হয়! ওকে হাসতে দেখে তাপ্তি ওর বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বললো,

“কি ব্যাপার উর্মিদি, হাসছো কেন?”

উর্মি আঙুল তুলে শুভ্রার দিকে নির্দেশ করে বললো,

“ওদিকে দেখ, ফোনে প্রেমালাপ চলছে!”

তাপ্তি উর্মির আঙুল বরাবর তাকিয়ে বুঝতে পারলো বিষয়টা। তারপর হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো,

“তোমার হিংসে হচ্ছে বুঝি? দাঁড়াও, তোমারও বিয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে!”

উর্মি চোখ পাকিয়ে তাকালো তাপ্তির দিকে। তাপ্তি হাসতে থাকলো।
____

“একটা বিশেষ কাজে তোমাকে আজকেই পুরুলিয়া যেতে হবে শ্রাবণ।”

“কিন্তু স্যার, আমার হাতে তো অলরেডি একটা কেস রয়েছে। সেটা ছেড়ে আমি অন্য কাজে কিভাবে যাই?”

ইন্সপেক্টর রুদ্র চৌধুরীর কথায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো শ্রাবণ। রুদ্র চৌধুরী নিজের চশমাটা চোখ থেকে খুলে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। তারপর হতাশ ভাবে বললেন,

“আমি ভীষণই দুঃখিত শ্রাবণ। কিন্তু ওই কেসটা আর তুমি হ্যান্ডেল করছো না। ইভেন, লোকাল কোনো কেসেই তোমায় রাখা হচ্ছে না।”

“কেন স্যার?”

“উপরমহলের নির্দেশ এটা। যার বিরোধিতা করতে তুমি বা আমি কেউই পারবো না।”

“উপরমহল কি এমন নির্দেশের পিছনে কোনো কারণ দর্শিয়েছে?”

“কারণ দর্শাতে তারা বাধ্য নয় তা তুমি ভালোই জানো। তবুও এই দফায় তারা কারণ উল্লেখ করেছে। নির্দেশনামা অনুযায়ী, তোমার নিরাপত্তার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই নাও, নিজেই পড়ে নাও।”

রুদ্র চৌধুরী শ্রাবণের দিকে এগিয়ে দিলেন একটা কাগজ। শ্রাবণ সেটা হাতে নিয়ে এক ঝলক চোখ বুলালো। তারপর সেটা টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে রেখে দিলো। বিরক্তি ওর চেহারায় ফুটে উঠছে। কিন্তু তবুও ও মুখে কোনো বিরক্তি প্রকাশ করলো না। কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো,

“পুরুলিয়া যাওয়ার বিষয়টা একটু বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবেন স্যার?”

রুদ্র চৌধুরী সম্পূর্ণ কেসটা বুঝিয়ে দিলেন শ্রাবণকে। ওর হাতে কেস ফাইল তুলে দিলেন। তারপর বললেন,

“একঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লে রাত দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে। স্টেশনে লোক থাকবে তোমার জন্য। তবে, থাকতে হবে বনের মধ্যে, বনদফতরের বাংলোয়। আর, তাও একা। কারণ ওখানের যে অফিসার দায়িত্বে আছেন, তিনি গেছেন ছুটিতে। স্থায়ী কর্মীও নেই আপাতত।”

শ্রাবণ হাসলো। তারপর বললো,

“সমস্যা নেই স্যার। পুরুলিয়ার জঙ্গলে হাতি আছে বলে শুনেছি, তবে তারা বনদফতরের বাংলোয় হামলা করবে না বলেই আশা করা যায়। এখন তবে আসি স্যার। জয় হিন্দ!”

শ্রাবণ বেরিয়ে এলো থানা থেকে। একরাশ হতাশা, বিরক্তি আর ক্ষোভ ওর বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে। ও বুঝতে পারছে, ওকে ইচ্ছা করেই কেসটা থেকে সরানো হলো। ভিতরের অনেক কারচুপি ও জেনে ফেলছিলো যে! কিন্তু এখন রেগে থাকলে হবে না। যে দায়িত্ব ও পেয়েছে, সেটা আগে পূরণ করতে হবে। কোনো কর্তব্যেই ফাঁকি দেওয়া চলবে না।

চলবে……