চিত্রার্পিত প্রেম পর্ব-১৫

0
7

#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| পঞ্চদশ পর্ব ||

[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]

সকাল হয়ে গিয়েছে কিন্তু রুশিতার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সত্যি বলতে, লোকাল থানায় খুব বেশি সদস্য নেই। তাই সঠিক ভাবে খোঁজা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণ রাত পেরিয়ে গিয়ে এখনও রুশিতাকে না পাওয়াটা ভাবাচ্ছে সবাইকেই।

গত রাতে কেউই দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র কেটেছে গোটা রাত। সবাই অপেক্ষা করেছে ভালো কোনো খবরের, কিন্তু হতাশ হয়েছে। আর এখন, ওদের চিন্তা হচ্ছে রুশিতার অস্তিত্ব নিয়েই। মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে তো?

সব থেকে চিন্তায় বোধহয় আছে আদিত্য। অপরাধ বোধ ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ওর হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলাফল এটা। জঙ্গলে যাওয়ার পরেও বড় দাদা হিসেবে ওরই দায়িত্ব ছিল সবার উপরে নজর রাখা। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও। এখন রুশিতার কিছু হলে কি করে পরিবারের সামনে মুখ দেখাবে ও?

জঙ্গলের বাইরে যে বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি রয়েছে সেখানে মাটির উপরেই মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল আদিত্য। ওর পাশে এসে বসে ওর কাঁধে হাত রাখলো আয়ুশ। তারপর বললো,

“চিন্তা কোরো না আদিদা, রুশুদির কিছু হবে না। ঠিকভাবে খোঁজা হয়নি তো, তাই পাওয়া যাচ্ছে না এখনও।”

আদিত্য আয়ুশের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। তারপর বললো,

“আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই আয়ুশ। আমি জানি আমি কত বড় ভুল করেছি। একটা গোটা রাত কেটে গিয়েছে, বুঝতে পারছিস তুই? ওই জঙ্গলে একটা মেয়ে সারারাত একা রয়েছে। কি অবস্থা ওর ভাবতে পারছিস? কাল সারারাত আবার বৃষ্টি হয়েছে। কে জানে জঙ্গলের কতটা গভীরে গিয়েছে ও। কোনদিকে গিয়েছে তাও জানিনা আমরা। ওকে সুস্থ অবস্থায় খুঁজে পেলেই হয় এখন।”

আয়ুশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,

“রুশুদি সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক এটাই আমরা সবাই চাই আদিদা। কিন্তু তুমি সব দোষ নিজের উপর নিতে পারো না। আমরা সবাই যেখানে একসাথে ছিলাম, সেখানে রুশুদি অসচেতন ভাবে অন্যদিকে চলে গিয়েছে। সেটা সম্পূর্ণই ওর নিজের সিদ্ধান্ত ছিল। এখানে তোমার দোষ কোথায়?”

“আমার ওকে দেখে রাখা উচিত ছিল আয়ুশ। এখানে শুভ্রাদির পরে সব থেকে বড় আমি। কাকামণি আমার উপরে সবার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। সেখানে সন্ধ্যা হওয়ার পরেও গাইড না নিয়ে জঙ্গলে ঢোকা, সবার উপর সমান ভাবে নজর না রাখা, এগুলো আমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। আমার দোষ কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না।”

আদিত্য উঠে গেলো। আয়ুশ আর কিছু বললো না। আদিত্যর জন্য খারাপ লাগলো ওর। যতটা দোষ সবাই আদিত্যকে দিচ্ছে, ততটা দোষ আদৌ আদিত্য করেছে বলে আয়ুশের মনে হয় না। কিন্তু এখানে কথা বলা বেকার। এখন কিছু বললেই সবাই রেগে যাবে।

সবাই আলোচনা শুরু করেছে এখন বাড়িতে খবর দেওয়া উচিত কিনা। এতক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও বাড়িতে খবর না দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে বলে মনে হলো না কারোরই। কিন্তু তালুকদার সাহেবকে জানাতেও ভয় পাচ্ছে ওরা। তালুকদার সাহেবের মেজাজ সম্পর্কে ওরা সবাই কমবেশি অবগত। আর এখন এই খবরটা জানলে তালুকদার সাহেবের রাগ যে ওদের সকলের উপরেই এসে পড়বে, সেটা ওদের কারোরই অজানা নয়। এই বিষয়টা ওদের আরেকটা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

_________________

সকালবেলা রুশিতার ঘুম ভাঙলো চেঁচামেচির আওয়াজে। বাইরে একটা বড় শোরগোল হচ্ছে সেটা ও টের পাচ্ছে। একটা বড় হাই তুলে ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে দেখলো বাড়ির সামনে একটা বড় জটলা হয়ে আছে, আর শ্রাবণ কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। রুশিতাকে দেখেই সবাই হৈহৈ করে উঠলো। একজন মহিলা বললেন,

“ওইতো, এটাই তো সেই মেয়েটা। কাল রাতে তো কুর্তি পরে ছিল, এখন আবার পোশাকও পাল্টে গিয়েছে দেখছি। এটা জঙ্গল হলেও এখানে আমরা বসবাস করি। এখানে এসব নোংরামি চলবে না।”

মহিলার কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেলো রুশিতা। আরো কয়েকজনের কথা শুনে ও যা বুঝলো, তা হলো গত রাত্রে রুশিতার এখানে থাকা নিয়ে এরা বাজে ইঙ্গিত করছে। রুশিতা অবাক হলো, এবং রাগও হলো ওর। কি বাজে মানসিকতার লোক এরা? ও তো শুধু এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। আলাদা ঘরে ভিতর থেকে দরজা আটকে সারারাত কাটিয়েছে। তাও এসব কথা শুনতে হচ্ছে ওকে?

এদিকে শ্রাবণ বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেও লোকগুলোকে সামলাতে পারছে না। এই গ্রামবাসীগুলো নাছোড়বান্দা মনোভাব নিয়ে ঝামেলা করেই যাচ্ছে। ওদিকে হরিপদ কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শহর থেকে আসা মানুষগুলোর হেনস্থায় সে অত্যন্তই দুঃখিত।

এর মধ্যেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে একজন মহিলা বলে উঠলেন,

“আচ্ছা, রাত যখন কাটিয়েই ফেলেছে তখন তো আর কিছু করার নেই। এদের দুজনকে এবার বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।”

কথাটা শুনেই চমকে উঠলো রুশিতা। এখন ওকে বিয়ে করতে হবে? এগুলো কি ইয়ার্কি নাকি? আর ইনি তো এমনভাবে ইঙ্গিত করছেন যেন ওরা কত কিছু করে ফেলেছে। অথচ সামান্য বাক্য বিনিময় ছাড়া ওদের মধ্যে কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত কিনা কলঙ্কের বদনাম নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে ওকে? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।

শ্রাবণের অবস্থাও তথৈবচ। এখানে ও এসেছে একটা কেস সল্ভ করতে। আর ওকে কিনা এখান থেকে বউ নিয়ে ফিরতে হবে? রুশিতাকে সাহায্য করতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়লো ও! নাহ্, এসব দাবি মেনে নেওয়া যাবে না। ও একপ্রকার চিৎকার করেই বললো,

“বিয়ে দিয়ে দিতে হবে মানেটা কি হ্যাঁ? আপনারা কি পাগল হয়ে গেছেন? কোনো বিয়ে – টিয়ে হবে না এখানে। ফাজলামি পেয়েছেন নাকি সব কিছু?”

বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া মহিলাটিও সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,

“বাড়িতে মেয়েছেলে নিয়ে এসে নোং’রা’মি করতে সমস্যা নেই, বিয়ে করতেই যত সমস্যা? বিয়ে তোমাদের করতেই হবে। নাহলে আমরাও বেঁধে রাখবো দুজনকে। এই এই, দড়ি আনো তো, গাছের সাথে বাঁধো এই দুজনকে। তারপর লাঠি দিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই দিলেই সোজা পথে আসবে এরা।”

অবস্থা বেগতিক হয়ে গেলো। সত্যিই কিছু মানুষ দৌড়ালো দড়ি আনতে। শ্রাবণ আর রুশিতা কিছুক্ষণ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে ওরা দুজনেই। অতঃপর, বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হতে হলো ওদের। নাহলে হয়তো গণপিটুনিতে ম’র’তে হতো আজ ওদের।

দূরের গ্রাম থেকে পুরোহিত ডেকে নিয়ে এসে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো ওদের দুজনকে। নিজেদের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো ওরা দুজন। ওরা কেউই জানে না এরপর ওদের জীবন কোন খাতে বইবে। এভাবে ছেলেখেলার মতো বিয়ে কি আদৌ হয়? কিন্তু কিছু করার নেই। ধর্মীয় মতে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আর কিছুই করার নেই। ডিভোর্স করাতে হলেও সময় লাগবে। আর ডিভোর্স হলেও তো রুশিতার চরিত্র নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলবে। তাই এই বিয়েটা ওকে মানতেই হবে। কিন্তু শ্রাবণ? সে কি মানতে পারবে?

বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরেই সবাই উধাও হয়ে গেলো। এখন আর কারো কোনো মাথাব্যথা নেই ওদের নিয়ে। ওদের জীবনটাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়ে শান্তি পেলো যেন সবাই।

রুশিতা শ্রাবণের বাড়ি ফিরে এসে বারান্দার মেঝের উপরেই ধপ করে বসে পড়লো। বাড়িতে কি জবাব দেবে ও? সবার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? বাবা কতটা রেগে যাবেন? ভাবতেই কেঁপে উঠলো রুশিতা। বাবা মনে হয় ওকে খু’ন’ই করে ফেলবেন। ওর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে শ্রাবণ বললো,

“চলো, তোমার বাড়ির লোকের কাছে যেতে হবে। আমার এখানের কাজ কালই শেষ হয়ে গেছে, আমি আজই ফিরে যাবো। তুমি আমার বাড়ি যাবে নাকি তোমার নিজের বাড়ি, সেই বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। আর তোমায় খুঁজে না পেয়ে তোমার বাড়ির লোক অবশ্যই ভীষণ চিন্তিত। তাই চলো।”

রুশিতা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। তারপর উঠে পড়লো। বিয়ে করতে যাওয়ার সময়েই জামা পাল্টে নিজের কুর্তি – লেগিংস পরে নিয়েছিল ও। এখন আর কথা না বাড়িয়ে শ্রাবণের সাথে এগোলো ও।

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা ভ্যানে উঠলো ওরা। শ্রাবণ নিজের জিনিসপত্র গুছিয়েই এনেছে। ওর সুটকেসটা সঙ্গে আছে। রুশিতা চুপচাপ বসে আছে, ওর চোখমুখ থমথমে। শ্রাবণ একবার রুশিতার দিকে তাকিয়ে তারপর চোখ ঘুরিয়ে নিলো। সবকিছু ভীষণ অদ্ভুত লাগছে ওর এখন।

জঙ্গল থেকে বেরিয়েই রুশিতা ফোন করলো উর্মির ফোনে। সাথে সাথেই রিসিভ হলো কলটা। অপর প্রান্ত থেকে উর্মি এক নাগাড়ে বলতে শুরু করলো,

“রুশু তুই কোথায়? তুই ঠিক আছিস তো? তোর কিছু হয়নি তো? তুই কোথায় বল আমরা আসছি এখনই।”

“তোমরা যেখানেই থাকো বাংলোয় ফিরে যাও উর্মিদি। আমি আসছি। এসেই যা বলার বলছি।”

বলেই রুশিতা কল কেটে দিলো। উর্মিকে উত্তর দেওয়ারও সুযোগ দিলো না।

বাংলোর সামনেই সবাই দাঁড়িয়েছিল। রুশিতাদের ভ্যানটা থামতেই সবাই দৌড়ে এলো। কিন্তু শাখা সিঁদুর পরিহিত রুশিতাকে দেখে থমকে গেলো সবাই। ওদের প্রত্যেকের চোখে মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা কথাও বলতে পারছে না।

শ্রাবণ ভ্যান চালকের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাকে বিদায় করে আদিত্যদের দিকে এগিয়ে এলো। তারপর গত রাত থেকে ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললো ওদের। বেশ কিছুক্ষণ বিস্ময়ে চুপ হয়ে রইলো সবাই। তারপর প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো উর্জার, সে বললো,

“রুশু, তুই শেষ পর্যন্ত পুলিশকেই বিয়ে করলি?”

চলবে……