#চিত্রার্পিত_প্রেম
#সুমেধা_সরকার
|| সপ্তদশ পর্ব ||
[অনুমতি ছাড়া কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।]
শান্তিনিবাসে আজ এসেছে শ্রাবণ। সাথে ওর মা বাবাও আছেন। শেখর মল্লিক অবশ্য আসতে একেবারেই ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু শ্রাবণের জেদের কাছে তিনি হার মেনেছেন। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে এখন রণজিৎ তালুকদারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
তালুকদার সাহেব এই বিয়েটা নিয়ে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। বাড়ির প্রতিটা সদস্যের সাথে তিনি ঝামেলা করেছেন এটা নিয়ে। এমনকি একবার রুশিতার ডিভোর্সের কথাও তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু সোহিনী দেবীর তীব্র আপত্তির সামনে তিনি বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। এখন শ্রাবণদের সাথেও তার কথা বলার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু সোহিনী দেবীর জোরাজুরিতেই তাকে এখানে থাকতে হচ্ছে।
শান্তিনিবাসের ড্রইংরুমে বসানো হয়েছে শ্রাবণদের। চা, লুচি, আলুরদম খেতে দেওয়া হয়েছে ওদের। যদিও শ্রাবণ বারবার বলেছিলো এখন ওরা কিছু খাবে না। কিন্তু সোহিনী দেবী শুনলে তো! উনি জোর করে খেতে বসিয়ে দিলেন ওদেরকে।
শেখর মল্লিক রণজিৎ তালুকদারের দিকে তাকিয়ে একটা কৃত্রিম হাসি হেসে বললেন,
“আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক সেই গড়েই উঠলো, কি বলো রণজিৎ?”
রণজিৎ তালুকদারও হাসলেন, সেটাও কৃত্রিম হাসি। তারপর বললেন,
“হ্যাঁ, তবে দুর্ঘটনাবশত।”
সোহিনী দেবী এতক্ষণ শ্রাবণের মা উমা দেবীর পাশে বসে বিভিন্ন কথাবার্তা বলেছিলেন। অল্প সময়েই তাদের মধ্যে বেশ গল্প জমে উঠেছিল। আসলে, দুই গৃহবধূ এক হলে যা হয় আরকি। এবার সোহিনী দেবী বললেন,
“আমি যাই, একটু রুশিতাকে দেখে আসি।”
তারপর দোতলায় রুশিতার ঘরে আসলেন। রুশিতার ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ভিতরে রুশিতা চুপচাপ বসে আছে বিছানার উপর। সোহিনী দেবী ঘরে ঢুকে ওকে দেখে বললেন,
“একি রুশু, তুমি এখনও তৈরী হওনি? শ্রাবণ তোমাকে নিতে এসেছে, ওরা নিচে বসে আছে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। ব্যাগও তো গোছাওনি এখনও। আমি কি ব্যাগ গুছিয়ে দেবো?”
রুশিতা ওর মার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। তারপর বললো,
“আমাকে তাড়ানোর জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে উঠলে কেন মা? আমি কি তোমার কাছে বোঝা হয়ে উঠেছি এখন?”
রুশিতার কথা শুনে সোহিনী দেবীর অন্তর কেঁপে উঠলো। মেয়ের কণ্ঠস্বরে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন তিনি। উনি রুশিতার পাশে গিয়ে বসলেন। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমার কাছে তুমি কখনোই বোঝা হবে না। তোমাকে তাড়ানোর চেষ্টাও করছি না। তবে এখন হয়তো সাময়িক ভাবে তোমায় বিদায় জানানোর সময় এসেছে। একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে হলেও তো বিয়েটা হয়েছে। তাই শশুরবাড়িও তোমায় যেতে হবে। আর ওনারাও তো সবটা মেনে নিয়ে তোমাকে নিতে এসেছেন। তাই ওনাদের অসম্মান করা কি উচিত হবে?”
“অসম্মান করছি না মা। চলে তো আমি যাবোই। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে জানোতো? তোমাদের ছেড়ে, এই বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।”
“জানি রে মা। তবে একটা কথা বলি রুশু, আমাদের বাড়ির নাম শান্তিনিবাস হলেও এখানে আদতে শান্তি নেই। এমনিতেও এই বাড়ির পরিবেশ তোমার পক্ষে বিষাক্ত হয়ে উঠছিলো তোমার বাবার কার্যকলাপের ফলে। একপক্ষে খুশি হও, এখন থেকে অন্তত প্রতিটা পদক্ষেপে তোমার বাবার অদ্ভুত সিদ্ধান্ত মানতে হবেনা তোমায়।”
“এই একটা বিষয়ই স্বস্তি দিচ্ছে আমায়।”
“বেশ, তাহলে তৈরী হয়ে নাও তুমি। শাড়ি পরবে কিন্তু আজ। আমি নিচে গেলাম।”
সোহিনী দেবী চলে গেলেন। রুশিতা কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর ওর ট্রলিব্যাগটা টেনে নিলো। জামাকাপড় ও অন্যান্য দরকারি জিনিস গুছিয়ে নিলো তার মধ্যে। কলেজের বইগুলো ঠিক করলো পরে এসে নিয়ে যাবে। তারপর কাবার্ড থেকে বেছে বেছে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি বের করলো। এটাই এখন পরবে বলে ঠিক করলো ও।
সোহিনী দেবী নিচে এসে বললেন,
“রুশিতা তৈরী হচ্ছে, এখনই চলে আসবে নিচে। আসলে, একটু মনটা খারাপ ওর।”
উমা দেবী বললেন,
“স্বাভাবিক, পরিবারকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে ওকে। তার উপর বিয়েটাও এমন পরিস্থিতিতে হলো! মেয়েটার উপর দিয়ে না জানি কতই না ঝড় বয়ে গিয়েছে।”
সোহিনী দেবী শুধু সামান্য ঘাড় নাড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, মেয়ের বাবার মনে এই কথাগুলো এলো না একবারও, অথচ মেয়ের শাশুড়ি ভাবলেন কথাগুলো। সত্যি, অদ্ভুত পরিবেশে থাকেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ বললো,
“আমি কি রুশিতার সাথে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে পারি?”
সোহিনী দেবী সাথে সাথে উত্তর দিলেন,
“অবশ্যই। চলো, আমি তোমাকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি।”
রুশিতার ঘরের সামনে গিয়ে সোহিনী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন রুশিতা তৈরী হয়েছে কিনা। রুশিতা ভিতর থেকে হ্যাঁ বললে উনি দরজা খুলতে বললেন। রুশিতা দরজা খুলে দিলো। শাড়ি পরা হয়ে গেলেও এখনও চুল বাঁধা বাকি ওর। শ্রাবণকে সামনে দেখে ও একটু ঘাবড়েই গেলো। তারপর বললো,
“কি হয়েছে, কোনো সমস্যা?”
সোহিনী দেবী বললেন,
“না, শ্রাবণ তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়। তোমরা কথা বলো, আমি যাই।”
বলেই উনি চলে গেলেন। রুশিতা শ্রাবণকে ইশারায় বললো ভিতরে আসতে। শ্রাবণ ঘরের ভিতরে এসে বিছানার উপর বসলো। রুশিতা চুল বাঁধতে বাঁধতে বললো,
“কিছু বলবেন?”
শ্রাবণ রুশিতাকে ভালো করে দেখছিলো। এই প্রথম রুশিতাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলো ও। সত্যি বলতে, খুব একটা খারাপ লাগলো না ওর। অবশ্য, নিজের স্ত্রীকে খারাপ লাগার কোনো কারণও নেই। রুশিতার কথায় শ্রাবণের ধ্যান ভাঙলো। সে বললো,
“হ্যাঁ। দেখো, তোমার আমার বিয়েটা একটা অদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে। তুমি জানো কিনা জানিনা, তবে আমাদের বাবাদের মধ্যে সম্পর্কটা বিশেষ ভালো নয়। আমাদের বাড়িতে যাওয়ার পর আমার বাবা হয়তো বিশেষ ভালো ব্যবহার করবেন না তোমার সাথে। আমি বাড়ি না থাকাকালীন কোনো খারাপ ব্যবহার উনি করলে অবশ্যই আমাকে জানাবে।”
রুশিতা তাকিয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণের পরবর্তী কথাগুলো শুনতে চাইছে সে। শ্রাবণ বলতে থাকলো,
“মা, কাকি এবং আমার ভাইবোনদের সাথে তোমার মিল হবে বলেই মনে হয়। তবুও, কোনো রকম সমস্যা হলে আমায় জানাবে। আর, তুমি কি স্টুডেন্ট?”
রুশিতা হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়লো। শ্রাবণ বললো,
“তাহলে তোমার বইপত্রও তো নিয়ে যেতে হবে। গুছিয়ে নিয়েছো সেসব?”
“আচ্ছা বেশ। চলো তাহলে।”
শ্রাবণ আর রুশিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে একসাথে নামতে থাকলো ওরা। সবাই তখন ওদের দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। এক সুপুরুষ যুবক সাথে আরেক সুন্দরী কন্যা নেমে আসছে একসাথে। উর্জা ওদের দেখে বিড়বিড় করে বললো,
“দুজনকে মানিয়েছে দারুন। কারো নজর না লেগে যায়।”
শ্রাবণ নিচে এসে তালুকদার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমরা তাহলে আসি এখন?”
তালুকদার সাহেব ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। বেরোনোর আগে রুশিতার মা – জেঠি – কাকিরা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। ওকে জড়িয়ে ধরলো ওর বোনরাও। সবাই কাঁদলেও রুশিতা কাঁদলো না। ও যেন অদ্ভুত রকমের শক্ত হয়ে গিয়েছে একদিনেই।
শ্রাবণের গাড়িতে গিয়ে উঠলো রুশিতা। গাড়ির জানলা দিয়ে হাত নাড়লো ওর ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে। তারপর শ্রাবণ গাড়িতে স্টার্ট দিলো। রুশিতা এগিয়ে চললো ওর শশুড়বাড়ির উদ্দেশ্যে।
_______________________
ঘরে বসে বসে ছুরিতে ধার দিচ্ছে SB। ওর সামনে দেওয়ালে একটা ভিশন বোর্ড। তাতে টাঙানো ওর নেক্সট টার্গেটের ছবি। এতদিন ইচ্ছামতো যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে এনেছে SB। এই প্রথম ও কোনো মেয়েকে টার্গেট করেছে ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে। ভাবতে অবাক লাগতে পারে, একটা মেয়ের সাথে সাধারণভাবে SB- র কি শত্রুতা থাকতে পারে? কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও এটাই সত্যি যে এই মেয়েটার সাথে ওর ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে।
SB- র জীবনের সব থেকে বড় নৃশংস কেস হবে এটা। এই মেয়েটাকে চূড়ান্ত ভাবে অত্যাচার করবে ও। ওর মনে এই মেয়ের প্রতি জমে আছে তীব্র আক্রোশ এবং ক্ষোভ। তাছাড়া, এই মেয়েকে মারলে একসাথে ওর আরও কিছু শত্রু দুর্বল হয়ে পড়বে। এক ঢিলে অনেক পাখি মারার সুযোগটা কিছুতেই ছাড়া যায়না। বিষয়টা ভাবতেই আনন্দ হলো SB- র।
চলবে…….