#এক_মুঠো_বুনোপ্রেম
পর্ব ১৪
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
লিও শুধু একটা প্রশ্নই ভয়ার্ত আর্শিকে জিজ্ঞেস করলো,
” ছোটোবেলার কোন স্মৃতিটা আপনার মনে পড়ে?”
রিলাক্সিং মিউজিক বাজছিলো মিউজিক সিস্টেম জুড়ে। তবুও আর্শি রিলাক্স হতে পারছিলো না। ডক্টর লিও তার হাতে একটা স্টপ ওয়াচ ঝুলিয়ে আর্শিকে সেই ঘড়ির ডায়ালের দিকে মনোযোগী হতে নির্দেশ দিলো। তবে আর্শির দৃষ্টি সেদিক থেকেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিলো।
ডক্টর আবার জিজ্ঞেস করলো,
” বলুন, কোন স্মৃতিটা আপনার মনে পড়ে!”
আর্শি ভয়ার্ত স্বরে শুধু একটা নামই বলতে পারলো,
” প্রহ! ”
তারপর সে কাঁপতে লাগলো।
.
.
লিও অপরাজিতাকে ভেতরে ডাকলো। ডক্টর লিও অপরাজিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
” ওর কি সিজোফ্রেনিয়া আছে নাকি?”
অপরাজিতা শুকনো মুখে ‘না’ বোধক মাথা নাড়লো। অর্থাৎ আর্শির সিজোফ্রেনিয়া রোগ নেই।
লিও চেয়েছিলো আরো মিনিট পাঁচেক তাকে শুধু পর্যবেক্ষণ করতে। কারন শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করেই রোগী সম্পর্কে বহু কিছু বলে দেওয়ার মতন একজন দক্ষ ডাক্টার হলেন ডক্টর লিও।
কিন্তু না! আর্শিকে তার চেম্বারে রাখা আর সম্ভব নয়। প্রচন্ড ভয় তার চেহারায় স্পষ্ট। লিও কোনো মেডিসিন ও দিতে পারবে না, এমতাবস্থায়। আর অপরাজিতা বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর দিতে লাগলো। লিও ও বুঝতে পারলো, এখন যত দ্রুত সম্ভব আর্শির স্থান পরিবর্তন করাই শ্রেয়।
ডক্টর লিও এষকে ভেতরে ডাকলেন।
অপরাজিতা আগেই বলেছিলো, এষ হচ্ছে আর্শির হবু বর। তাই এষকে নতুন করে পরিচয় করানো হলো না। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য লিও তাকে স্বল্প ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, ” আপনিই মিস্টার এষ ?”
এষ মাথা ঝাঁকলো।
ডক্টর জাফরিন ডক্টর লিওয়ের একটা পার্সোনাল নাম্বার সম্বলিত ভিজিটিং কার্ড এষের হাতে কৌশলে তুলে দিলো। এষ বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা কি? সে এক মুহূর্ত চেয়ে রইলো সে কার্ডের দিকে। সে দ্রুত পকেটে গুঁজে নিলো কার্ড টা।
অত:পর ডাক্টারের নির্দেশে অপরাজিতা আর এষ আর্শিকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ আগে মুখে হাসি লাগিয়ে রাখা ডক্টর লিওয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে খেয়াল করলো, ডক্টর জাফরিন তাকে আরো কিছু বলতে চাইছে।
জাফরিন লিওয়ের দিকে এগিয়ে এলো। বেশ প্রতিবাদি স্বরেই বললো,
” ডক্টর, মিসেস অপরাজিতা মিথ্যে বলছিলো, আর আপনি বুঝেও কোনো প্রতিবাদ করলেন না কেনো? উনার উদ্দ্যেশ্য তো পেইসেন্ট কে পাগল করে দেওয়া দেখতে পাচ্ছি, ডক্টর বসাক যে মেডিসিন গুলো দিয়েছেন, ওগুলো সবই অযথা! রোগীর কোনো উন্নতিই হচ্ছিলো না, বরং আগের সবই সে ভুলে গিয়েছে! সে ধীরে ধীরে ”
ডক্টর লিও ডক্টর জাফরিনকে অভিবাদন জানিয়ে বললো,
” কুল ডাউন ডক্টর জাফরিন! ইউ আর সো জিনিয়াস, ডক্টর জাফরিন, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে আপনি অনেক নতুন হওয়া স্বত্ত্বেও অনেক কিছু জেনে গেছেন। কে কখন সত্য বলছে, আর কে কখন মিথ্যে বলছে, বাহ্যিক লক্ষণ দেখে তা ও ধরে ফেলতে পারেন! আই রিয়েলি ইমপ্রেসড!”
জাফরিন হেসে বললো,
” ইটস ইউর কম্পলিম্যান্ট ডক্টর লিও, আপনার সহকারী হয়েছি বলেই, আপনার থেকে আমি সব শিখেছি। অল ক্রেডিট গোজ টুয়ার্ড ইউ!”
জাফরিনের বয়স কম; মাত্র বাইশ হবে। এই বয়সেই সে ডক্টর লিওয়ের মতো একজন মাল্টিন্যাশনাল সাইকিয়াট্রিস্ট এর সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। দারুন মেধাবী বলেই সে পেয়েছে বৈকি! সে এখান থেকে ইন্টার্নি সেরে পি এইচ ডির জন্য ফ্রান্সে যাবে। ডক্টর জাফরিনের এসব বিশেষ গুণের জন্য ডক্টর লিও তাকে বেশি সমীহ করে। ডক্টর জাফরিন আবার বলে চললো,
” মিসেস অপরাজিতা তার ঘটনা বিশ্লেষণের সময় বেশ কয়েকবার তার হাতের আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন ভাবে কাঁপছিলো, সেটা ভয় বা আবেগে নয়, বরং মিথ্যে কথা বানানোর জন্য তার ব্রেইন যে একটা আলাদা ইফোর্ট নিচ্ছিলো সে জন্য, পাশাপাশি তার মাথার হেলদুল দেখেও আমি সব আঁচ করতে পেরেছি, কথা বলার সময় ইজি চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়ই তার মাথা আনইজ হয়ে যাচ্ছিলো”
ডক্টর লিও আবার জাফরিনকে অভিবাদন জানালো,
” গ্রেট, ডক্টর জাফরিন, ওয়েল আন্ডারস্টুড!”
জাফরিন আবার বলা শুরু করলো,
” আর আর্শি মেয়েটার মধ্যে আমি তার পালিত মা তথা অপরাজিতার জন্য তেমন মায়া দেখতে পেলাম না, যদিও সে কিচ্ছুটি বলেনি। আমি অপরজিতাকে সৎ মা না বলে পালিত মা ই বললাম, কারন আমার মনে হয় আরশ নাংজু লোকটার সাথে তার বিয়েই হয়নি৷ সে শুধু লিভ টুগেদার করেছিলো আরশের সাথে! আর আর্শিকে ছোটোকাল থেকেই তাকে অনেক ডক্টর দেখানো হয়েছে, কেউ কেউ ওর মাথায় শক ও দিয়েছে, যে কারনে সে ডক্টরদের দেখলেই ভয় পায়। আর তার মাথায় প্রাপ্ত আঘাত টা সুউচ্চ কোনো স্থান থেকে পড়ে যাওয়ার কারনে পেয়েছে, তাকে কেউ বাড়ি মারে নি বা আঘাত করেনি!”
লিও অবাক হয়ে জাফরিনের কথা শুনতে লাগলো।
” তুমি, এত কিছু বলো কিভাবে? ডক্টর জাফরিন?”
জাফরিন হেসে আবার বলে চললো,
” আমি এ ও জানি যে, অপরাজিতা আর আপনার কাছে আসবে না! এমনকি আপনার সাথে আর কোনো যোগাযোগ ও করবে না সে! ”
লিওয়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো,
জাফরিন আবারো মুখে হাসি টেনে এনে বললো,
” এর কারন খুবই স্পষ্ট! আর ইউ ওরিড এবাউট ইট? এটাই সত্য, সে আর আসবে না, আমি হলফ করে বলতে পারি, সে আর আসবে না। তবে মজার বিষয় হলো, অপরাজিতা না আসলেও, ঐ ছেলেটা অর্থাৎ আর্শির ফিয়ন্সি(হবু বর) এখানে আসবে, আর অবশ্যই আসবে এখানে, কারন আমি তাকে আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিয়েছি, সে মাস্ট কল দিবে এখানে। কারন তার এখনো বহু প্রশ্ন মনে গিজগিজ করছে!”
জাফরিন হাসলো।
লিও দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো।
জাফরিন নিজে নিজেই বলে চললো,
” সত্যিই আর্শির কেইস টা অনেক ইন্টারেস্টিং ছিলো। কিন্তু সেটা সে হয়তো শেষ ই করতে পারবে না! আফসোস! মানুষ কেনো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে মিথ্যে বলতে যায়! যেখানে সাইকিয়াট্রিস্ট না বলতেও অনেক কথা বুঝে যায়। মিসেস অপরাজিতা তো অনেক জ্ঞানি! তবে সে কি জানে না এসব?
সব খুলে বললে তো ডক্টর লিও তাকে কো অপারেট ই করতো, হেল্প করতো বৈ আর ক্ষতি তো করতো নাহ! ”
লিও তার কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রাখলো নেক্সট পেইসেন্টের বায়োতে।
আর জাফরিন আর্শির সব তথ্য সম্বলিত রেখে যাওয়া ফাইলে চোখ মেললো।
.
.
পরের দিন। শুক্রবার বিধায় ভার্সিটির ক্লাশ অফ।
রাতে দেরি করে ঘুমিয়ে আর্শি সকালে ঘুম থেকে উঠলো সকাল এগারোটায়! মাথা ভার হয়ে আছে। সকালে উঠে কোনোদিনই তার টাইম এন্ড ডেইট মনে থাকে না। এত দেরি করে সে কোনোদিন জাগে। তাই মাথাটা ভার হয়ে আছে। টাইম এন্ড ডেইট দেখতে সে ফোনের স্ক্রিনে চোখ দিলো। আর্শির চোখ বিস্ফোরিত হলো নিজের ফোনের স্ক্রিনে। নিজেই যে মানসিক ভাবে এত দুর্বল! তার মধ্যে এধরনের মেসেজ পেয়ে সে প্রেতাত্মা দেখার মতোই ঝটকা খেলো আর্শি।
ডক্টর লিওয়ের চেম্বারে গিয়ে ভয় পেয়েছিলো বিধায় এষ তার কাছে অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিলো। আর্শি শুধু চোখ বুঝে শুয়ে ছিলো আর এষ তার চুলে হাত বুলিয়েছে। অপরাজিতাকে কূটনীতিক মিশনে কয়েক দিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে বলে সে সেসব গুছাতেই ব্যস্ত ছিলো। তাই অপরাজিতাও আর্শিকে সময় দিতে পারেনি। আর্শিকে ঔষধ খাইয়ে শিওরের কাছেই গভীর রাত পর্যন্ত বসে ছিলো এষ, তারপর আর্শির শিওরের কাছে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।
এদিকে আর্শি ঘুম থেকে জেগে যে কারনে ঝটকা খেলো, সেটা ছিলো আরাধ্যার একটা মেসেজে। মেসেজ টা এরকম,
” আর্শি রে! নিহুর জন্য নেহাল পয়জন পান করে নিয়েছে, তাও গভীর রাতে নিহুর বাসার নিচে গিয়ে, আই সি ইউ তে আছে, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, এপোলো হসপিটালে আয় এজ সুন এজ পসেবল ”
এই মেসেজ দেখে আর্শি জোরে চেঁচিয়ে উঠলো,
“হোয়াট!”
উক্ত বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে অন্তত: গোটা পঞ্চাশ এস এম এস পাঠিয়েছে তাকে ক্লাশের সবাই।
ঘুম থেকে উঠেই এতগুলো মেসেজ আর এরকম খারাপ খবর দেখে আর্শির গলা শুকিয়ে এলো। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে গেলো, সেই সাথে পালস রেট ও হার্টবিট। এষ ওর শিওরের কাছেই ঘুমাচ্ছিলো কিন্তু ডেকে তোলার মতো সামর্থ তার ছিলো না।
এক গ্লাস পানি বেড কর্ণার টেবিলে রাখা ছিলো, হাত অতিরিক্ত কাঁপাকাঁপির কারনে সেটা নিতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে গেলো।
আর সেই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো এষের।
এষ ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠতেই দেখে আর্শির এই অবস্থা। গ্লাসের কাঁচে তার পা কেটে গড়িয়ে র’ ক্ত যাচ্ছে।
এষ এক লাফে উঠে গিয়ে আর্শিকে কোলে তোলে নিল।
কিন্তু আর্শি তখন আর নিজের অস্ত্বিত্বে নেই। চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। সে ঢলে পড়লো এষের কোলে।
অপরাজিতাকে ডেকেও কোনো লাভ হলো না। কারন খুব ভোরেই সে নিজের ফ্লাইট শুরু করতে চলে গিয়েছিলো এয়ারপোর্টে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় পাঁচ দিন বিশিষ্ট কূটনৈতিক মিশনে তার গন্তব্য। আর এখন এটা নিশ্চিত যে তার যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে।
তাই এষ দ্রুত তাকে এপার্টমেন্টের কাছাকাছিই একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলো।
এষের মনেও উত্তেজনা। দোটানায় ভুগছে সে। এদিকে নেহাল নামক ছেলেটা মৃত্যুর সাথে লড়ছে, তাকে দেখতে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই, আর্শিকে এমন অবস্থায় রেখে। এর উপর আর্শির ফোনে কলের উপর কল আসছে।
সব আর্শির বন্ধুদের কল। সবাই নেহালের ওখানে। নেহালের অবস্থা সংকটাপন্ন।
ক্লিনিকে আর্শির মাথার কাছে বসে এষ ওর হাতগুলো নিজের মুষ্টির মধ্যে নিয়ে বসে আছে। চিন্তিত, বিষন্ন আর উদভ্রান্ত সে। অপরাজিতা ইন্দোনেশিয়ায় উদ্দ্যেশ্যে উড়ে যাওয়ার আগে এষের ফোনে মেসেজ দিয়ে চলে গিয়েছিলো।
” টেক কেয়ার বোথ অব ইউ” এই লিখে। অপরাজিতাকেউ আর্শির এরকম অবস্থার কথা জানানোর উপায় নেই। সে নির্ঘাত এসব জানলে চিন্তায় আধমরা হয়ে যাবে। তাই এষ খবরটা চেপে গেলো।
তাই নিজেই আর্শির অবস্থার উন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
(চলবে)