প্রাণপ্রিয় পর্ব-১৮

0
1

#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১৮]
~আফিয়া আফরিন

অনু ঘুরে তাকাল। বেশ সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো। বলল, ‘আমাকে ডাকছেন? জী বলুন!’

অনুর নির্বিকার ভঙ্গিতে উনি সহসাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তাই তো, ঠিক’ই আছে; সে অপরিচিত মানুষ’ই তো। চেনার আশা করাটা এখানে নিতান্তই বোকামি।অনু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কিন্তু সেই আগের চাহনি আর নেই। আগের মত উথাল পাতাল দৃষ্টিটাও সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। এখন কি এই দৃষ্টিতে তার জন্য শুধুই ঘৃণা অবশিষ্ট রয়েছে!
উনি বললেন, ‘কিছু কথা ছিল। আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে খুঁজছিলাম, কিন্তু…..’

‘পান নাই তাই তো? পাবেন কীভাবে? খোঁজার প্রয়াস তো দু’দিক থেকে থাকতে হয়। আমার দিক থেকে কখনোই ছিল না। যাইহোক, কী বলবেন যেনো বলছিলেন?’

উনি পুনরায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। অনুর কথার ধাক্কা গুলো নিতে পারছিলেন না। সে এমন ছিল না, কেমন হয়ে গেছে যেনো; অদ্ভুত! অবশ্য তার জন্য দায়ী সে নিজেই।
তিনি বললেন, ‘কিছু বিষয় ক্লিয়ার করা প্রয়োজন।’

‘ঠিক আছে করেন।’

উনি আশেপাশে তাকিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন, ‘তুমি জানতেই আমার মা অনেকদিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। লাস্ট আমি যখন বাড়ি গিয়েছিলাম সেদিন’ই আমার বাবা সেদিন এক্সিডেন্ট করল,স্প’ট ডে’ট। তারপর মায়ের অসুস্থতা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সবমিলিয়ে আমি অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। তাই যোগাযোগের চেষ্টাও পারি নাই। কিছু ভালো লাগতেছিল না, মনে হচ্ছিল সাজানো গোছানো জীবনটা হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেছে। মা হঠাৎ একদিন বললেন, ঠিক হঠাৎ না; এর আগেও আমাকে এই কথা বলা হয়েছিল কিন্তু আমি সেভাবে গায়ে মাখি নাই। আমাকে বললেন, বিয়ের কথা! বরাবরের মতই বিষয়টা পাত্তা দিলাম না। কিন্তু ও বাবার বন্ধুর মেয়ে, আমার বাবার সাথে তিনিও সেইদিন এক্সিডেন্টে মা’রা গেছেন। বাবা ছাড়া মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না। উনারা খুব বিপাকে আছে। মা আমাকে কথা বলতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কে বা কারা বিপাকে আছে, তা দিয়ে আমি কি করব? আর পৃথিবীর সব মানুষ বিপাকে পড়লে তাদের উদ্ধার করার দায়িত্ব কি আমার? আমি সোজাসুজি না বলে দিলাম, কারণ একজনের কাছে ওয়াদা বদ্ধ আছি; তাকে কীভাবে ছাড়ব?’
উনি থামলেন। অনু নির্বিকার, তবে মনে মনে না হেসে পাল না। ওয়াদা বদ্ধ? কী লাভ হলো?
সে ফের বলতে শুরু করল, ‘আমি ফিরে আসতে চাইলাম, কিন্তু মাকে একা রেখে যেতে সাহস করলাম না। অবশেষে একদিন মায়ের অসুস্থতার কাছে আমি হার মেনে গেলাম। বিয়েটা করতে একপ্রকার বাধ্য হলাম। সেদিন রাতেই সবকিছু ছেড়ে ঢাকা চলে এসেছি। পরদিন সকালে তোমার কলেজ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি জানতাম, তুমি আসবে! এসেছিলেও, অপেক্ষাও করেছিলে আমার জন্য, আমি বুঝেছিলাম। আমি ছিলাম ওখানে, সজীবের বাসায়। প্রতিদিন যেতাম, কিন্তু তোমার সামনে আসার সাহস হয় নাই। তোমাকে রোজ দেখতাম। বাড়ি থেকে ফোন করত, যেতাম না। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আমি জানতাম, তুমি সজীবের কাছে আমার খোঁজে আসবে; তাই বলে রেখেছিলাম যেনো সত্যি কথাটাই তোমাকে বলে। নয়ত……!’ তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথা শেষ করলেন না। দীর্ঘক্ষণ নিরবতার পর ফের বলতে আরম্ভ করলেন, ‘সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তুমি যেদিন সজীবের কাছ থেকে আমার খোঁজ নিতে এসেছিল, সেদিন আমি ওখানেই ছিলাম। কতবার যে তোমার সামনে উপস্থিত হতে চেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু অপরাধবোধ আমাকে বারবার আটকে দিয়েছে, পিছু হটতে বাধ্য করেছে।’

অনেকক্ষণ পর অনু কথা বলল। জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর তো ঢাকাতেই রয়ে যেতে চাইলাম, ছিলাম’ও প্রায় ছয়মাস। বাড়ি যাওয়ার টান অনুভব করতাম না। মা বারবার ফিরতে বলত, কিন্তু গিয়ে কি করব? তাই রয়ে গেলাম দিনের পর দিন। হঠাৎ খবর এলো, মা মারা গেছে। ছুটে যেতে চাইলাম, কিন্তু সেটাও হলো না। এইদিকে কীসের আন্দোলনের কারণে সব গাড়ি আটকে দিয়েছে, সারাদেশে ধর্মঘট। ভাবলাম, হেঁটেই রওনা দিব। তাই করলাম, সাথে সজীব অবশ্য ছিল। সেদিন সারারাত হাঁটলাম, পরদিন দুপুরে গাড়ি পেলাম। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত। ততক্ষণ মামারা মাকে দা’ফন করে ফেলেছে। জীবনে দ্বিতীয়বারের মত নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। মায়ের একটামাত্র ছেলে হিসেবে শেষ দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলাম না, পারলাম না কারো প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে! তারপর ওখানেই থেকে গেলাম। নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হতো। কী করতাম, নিজেই বুঝতে পারতাম না। ঘরে তো একজন ছিল, সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। আমাকে বোঝাতে চাইত। আশ্চর্য হয়ে যেতাম, কেনো আসবে আমাকে বোঝাতে! জীবন নিয়ে এমন’ই এক হতাশার পর্যায়ে চলে গেলাম। এরপর এলো আমার বাবার গোষ্ঠীর মানুষেরা। বাড়িঘর’সহ সহায় সম্পত্তি যা ছিল, দখল করে নিল। আমাদের থাকল না আর কিছুই। সবকিছুর পর ওর দায়িত্ব এড়াতে পারি নাই। সেদিন হয়ত ওকে ওইভাবে ছেড়ে দিলে নিজেকে আর মানুষ মনে করতে পারতাম না। তাই হাত ধরলাম, বেড়িয়ে গেলাম অজানার উদ্দেশ্যে। জীবনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ্ষচেষ্টা করলাম। কাউকে কিছু বলি নাই। সবাই বলেছিল, চাচাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে, কিন্তু ছেড়ে দিয়েছি। কী করব আমি এসব দিয়ে? যা চেয়েছিলাম তা তো পাই নাই, তবে যা চাই নাই তা পেয়ে আমার কি লাভ? এরপর অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেল, ঢাকা আসা হয় নাই। নিজেকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যাইহোক, বেঁচে থাকতে হবে তো। ঢাকা এলাম আনেক বছর পর, সপরিবারে। আহির তখন ছোটো। এখানে আসার পর একবার খুব করে ইচ্ছে হলো, একনজর দেখার। গিয়েছিলাম তোমার কলেজে, পরপর দু’দিন দাঁড়িয়ে থেকেও তোমার দেখা পাই নাই। তারপর গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়ির ওইদিকে। সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম, তোমরা এই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছো। বুঝলাম, হারিয়েছি; সবদিক থেকেই হারিয়েছি। আমার তখন সেই আশা করাটা অন্যায় তবে মন তো এতো ন্যায় অন্যায় মানে না। বারবার ছুটে গিয়েছিলাম, নিজের কাজে নিজে বিরক্ত হতাম, নিজেকে আটকানোর চেষ্টা করতাম; তখন ব্যর্থ হতাম কিন্তু একসময় সফল হলাম। সব পিছুটান পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। এগোতে এগোতে অনেক এগিয়েছি, আজকের এই পর্যায়ে এসেছি। এইতো ভালোমন্দ মিলিয়ে চলছে জীবন। তোমাকে খুঁজছিলাম মূলত নিজে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। একবার কনফিউশন ক্লিয়ার করে দিলে নিজে মুক্তি পেতাম।’

‘আপনার জীবনের ঘটনাটা খুবই দুঃখজনক। তো এখন কি অপরাধবোধ থেকে মুক্তি মিলল?’

‘মিলেছে কিনা জানিনা! তবে অপর পক্ষ থেকে ক্ষমা করলে হয়ত পুরোপুরি অপরাধবোধ থেকে মুক্তি মিলত। তোমার সাথে এভাবে কখনো দেখা হতে পারে, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না।’

‘ঠিক আছে, আমার কোনো অভিযোগ নেই কিছুর উপর বা কারো উপর। অনিতা যাচ্ছে আপনাদের বাড়ি, ও আমার মেয়ের মত; ওকে দেখে রাখবেন।’

‘ঠিক আছে। তোমার হাজব্যান্ড…….!’

অনিতা ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটাল। বলল, ‘আমি জীবনে একজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। সে আমাকে বলেছিল, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি যেনো অপেক্ষা করি। কথার খেলাপ করা আমার স্বভাবে নেই, কখনোই ছিল না। বিয়ে-শাদী তাই করা হয়ে উঠে নাই আর। আচ্ছা আসছি আমি। আপনিও যান, আপনার বড় ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা!’
অনু চলে গেল। উনি ওখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। অপরাধ বোধ কমাতে এসেছিলেন, বেড়ে গেল কিনা তা তার চেহারা ছবি দেখে ঠিক বোঝা গেল না।
.
অনুষ্ঠান শেষে সকলেই ক্লান্ত। বাড়ি ফিরে এসে সবাই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। অনিতা ফিরে এসেই ডায়েরীর খোঁজ করল, কিন্তু খুঁজে পেল না। খুব একটা খেয়াল করল না, কাল যেহেতু বিয়ে আজ তাই রেস্ট নিল। বাসাভর্তি মেহমান, শোরগোলে আরও মাথা ধরেছে।
ফুপির খোঁজ করল দাদীর কাছে গিয়ে। দাদী বলল, ‘কী যে বাপু। তোর ফুপির কোনো খোঁজ আমি জানি? আমারে বলে কিছু? দেখ গিয়ে, কই গেল! আমাদের সাথেই তো এলো। দেখ দেখ, তোর মামীদের সাথে গিয়ে গল্প জুড়েছে কীনা!’

‘আচ্ছা যাই।’
অনিতা সব জায়গায় খুঁজেও অনুকে খুঁজে পেল না। ফোন করলেও তা কয়েকবার বেজে গেল, রিসিভ করল না।

অনু ছাদে ছিল। নিচে চেঁচামেচি ভালো লাগছে না। একটু একাকীত্বে থাকার প্রয়াস জেগেছে। আজ অনেক অনেক দিন পর তার সাথে দেখা হলো। অনেকদিনের তৃষ্ণা মিটে গেল নিমিষেই। অভিযোগ কখনোই ছিল না, কোনো দাবিও রেখে দেয় নাই। সে নিজে ভালো আছে তাই ক্ষমা করে দিয়েছে অনেক আগেই। কারণ সে জানে, ক্ষমা করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। কারো প্রতি চাপা রাগ-ক্ষোভ রেখে নিজে কখনো ভালো থাকা যায় না। নিজের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, জীবন নিয়ে আর কোনো আশা নেই। আবেগ নেই। সেসব দিন পেরিয়েছে। এখন একটাই আশা, যাকে ছোটো বেলা থেকে নিজের কোলেপিঠে করে বড় করেছে সেই মেয়েটা সুখে থাকুক। ও ভালো থাকুক। একসময় ভাবত, অনিতা তার কাছে থাকলে হয়ত তার জীবনের ছায়া পড়বে ওর জীবনে; কুসংস্কার কিন্তু তবুও মনে হতো। এখন শান্তি লাগছে।
অনিতাটা অনেকক্ষণ যাবত ফোন করছে। সে ফোন ব্যাক করল। অনিতা রিসিভ করতেই বলল, ‘আমি একটু বাহিরে এসেছি একটা কাজে। আসছি একটু পর। ফোন করছিলি কেনো?’

‘তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলেই ফোন করলাম। আচ্ছা এসো। রাখছি।’ অনিতা ফোন রেখে দিল। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। একটু আগের মুহূর্তটা মনে পড়ছে। অনু সম্বোধন ছাড়াই কথা বলেছে! সেও ওই একবার’ই ডেকেছিল, আগের মত করেই। নাহ, একটু আলাদা হয়ত। কী জানি?
আজ’ও নিজেকে এলোমেলো লাগছে। কিছুতে মন বসছে না। মনটা অস্থির হয়ে আছে। কিছুতেই মনটাকে ঠিক করতে পারছে না। কারো সাথে একটু শেয়ার করলে মনটা হালকা হতো, কিন্তু দুঃখের বিষয় তার জীবনে এমন কেউ নেই। অনু ডায়েরীটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সেটা নিয়েই বসল। শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা খালি আছে মাত্র। এই ডায়েরীটায় সে নিজের অনুভূতিগুলো বদ্ধ করে রেখেছিল, আর কী করবে? কোনো প্রয়োজন আছে কি? অনু এককোণে বসে ডায়েরীর পৃষ্ঠা উল্টালো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সেই ঝাপসা দৃষ্টিতেই এলোমেলো অক্ষরে লিখতে থাকল…… কলম চলতেই থাকল অনবরত। অনুর থামতে ইচ্ছে করল না, জীবন থেকে ছাব্বিশটা বছর যেভাবে হারিয়ে গেছে সেভাবেই হারিয়ে যেতে চাইল নিজের মধ্যে!
.
.
.
চলবে…….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৩৮২