মন রাঙানোর পালা ২ পর্ব-০৫

0
41

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_5
#ইয়াসমিন_খন্দকার

অভীক্ষা সিলেটে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। সুনীতি ভীষণ ছটফট করছে। তার মন একদমই সায় দিচ্ছে না অভীক্ষাকে সিলেটে পাঠাতে। বারংবার অজানা বিপদের আশংকায় বুক কেপে উঠছে। রাহেলা খাতুন সুনীতির এই অস্থিরতা লক্ষ্য করছেন। চিন্তা তো তারও হচ্ছে অভীক্ষার জন্য কিন্তু তাকে ঠেকানোর সাধ্যি রাহেলা খাতুনের নেই৷ তিনি খুব ভালো করেই জানেন অভীক্ষা কতটা জেদি। সে যে কোন কিছুর বিনিময়ে হলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকবেই।

অভীক্ষা গায়ে একটা হলুদ টপস আর জিন্স জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে। সাথে একটা ট্রলি ব্যাগ। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন রকম পোশাক এবং মেকআপ সামগ্রী। সুনীতি অভীক্ষাকে দেখামাত্রই বলে উঠল,”তোমার সিলেটে না গেলে হয়না! কোনভাবে যদি ম্যানেজ করতে তো..”

অভীক্ষা হতাশ স্বরে বলে,”এসব তুমি কি বলছ মা? আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। এই সময় অন্তত বাঁধা দিও না।”

সুনীতি কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রাহেলা খাতুন বলেন,”বৌমা, তুমি এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। ওকে যেতে দাও। এভাবে পিছু ডাকা অমঙ্গল জনক।”

সুনীতি আর কিছু বলে না। সেই মুহুর্তে মুন্নি চলে আসতেই তিনি মুন্নির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তোমার ম্যাডামের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর কিন্তু আমার চাই। এই কথাটা মনে রাখিও। তোমাকে কিন্তু আমি অনেক ভরসা করি। এই ভরসার মান রেখো।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি আপনার ভরসার মান রাখবোই।”

অভীক্ষা মুন্নির কথা শুনে মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,”তুমি অনেক বোকা মুন্নি। আমার সাথে চ্যালেঞ্জ নিয়ে লাভ হবে না। তোমায় ঘোল খাওয়ানো আমার দুই মিনিটের ব্যাপার।”

রাহেলা খাতুন তাড়া দিয়ে বলেন,”তোদের তো ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি রওনা দে।”

“আচ্ছা, সখী৷ থাকো, আমরা আসছি। মা, আসছি।”

” সাবধানে যেও। আর তোমার সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর আমি মুন্নির মাধ্যমে নেব। তাই কোন উলটাপালটা কিছু করার কথা ভাববে না।”

অভীক্ষা সামান্য মাথা নাড়ায়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সিলেটে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় অভীক্ষা। দীর্ঘক্ষণের ফ্লাইট জার্নির পর তারা সিলেটে পৌঁছালো। মুন্নি অভীক্ষার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”চলুন তাহলে আমাদের বুক করে রাখা হোটেলের দিকে রওনা দেই।”

“হুম, চলো।”

অতঃপর দুজনে একটা গাড়িতে করে সিলেটের গ্রান্ড হোটেলে পৌঁছে যায়। এই হোটেলের পাশেই একটা ফ্যাশন হাউজ রয়েছে যেখানে আগামীকাল অভীক্ষার শো আছে। অভীক্ষা হোটেলে পৌঁছেই নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর কাউকে একটা ফোন করে বলে,”যা বলেছিলাম, তা করেছ তো?”

“জ্বি, ম্যাম।”

“গুড। জলদি খাবার ডেলিভারির ব্যবস্থা করো। আমার হাতে বেশি টাইম নেই।”

বলেই নিজের স্মার্ট ওয়াচের দিকে তাকায় অভীক্ষা। বিকেল ৪ টা বাজে। একটু পর একজন ওয়েটার তার খাবার নিয়ে আসে। অভীক্ষা খাবারটা রিসিভ করেই বলে,”কাজ কমপ্লিট?”

“জ্বি, ম্যাডাম।”

অভীক্ষা একটা ক্যাশ ওয়েটারটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এই নাও তোমার পারিশ্রমিক।”

ওয়েটার একটা হাসি দিয়ে চলে যায়। অভীক্ষা নিজের খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে পাশের রুমে উঁকি দেয় যা মুন্নির জন্য বরাদ্দ। মুন্নির রুমের দরজাটা খোলাই ছিল। রুমে ঢুকতেই অভীক্ষা দেখতে পায় মুন্নি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এটা দেখে অভীক্ষা দুষ্টু হেসে বলে,”এখন কর মায়ের চামচামি।”

বলেই সে রুমের দরজা লক করে বেরিয়ে পড়ে। বর্তমানে তার পড়নে একটা কালো হুডি এবং জিন্স। মুখটা মাস্কে আবৃত করে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটি গাড়িতে উঠে পড়ে। ড্রাইভারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আমাকে সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ে চলো।”

গাড়ি রওনা দেয়। অভীক্ষা চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,”আমায় ক্ষমা করে দিও, মা। কিন্তু এছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। এই সময়ের মধ্যে আমায় সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকা খুঁজে দেখতে হবে। যদি বাবার সম্পর্কিত সামান্য কোন ক্লুও পাই সেটাই আমার জন্য অনেক।”

সিলেটের সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি এসে গাড়ি থেমে যায়। সামনে ঘন জঙ্গল। ড্রাইভার অভীক্ষাকে বলে,”সামনে আর যাওয়া সম্ভব নয় ম্যাম।”

অভীক্ষা গাড়ি থেকে নেমে বলে,”আপনি ফিরে যান। বাকি পথ আমি একাই যেতে পারব।”

“ঠিক আছে।”

অভীক্ষা সামনের ঘন জঙ্গলের দিকে তাকায়৷ সে জানে এটা বিপদজনক হতে পারে তবে নির্ভীক অভীক্ষা এসবে কেয়ার করে না। অভীক্ষা বুকে নিদারুণ সাহস নিয়ে বলে,”এতগুলো বছর বাদে যখন আমি সিলেটে আসার সুযোগ পেয়েছি তখন হয় ইসপার নাহয় ওসপার করেই যাব।”

এই প্রবল মনোবল নিয়ে অভীক্ষা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

এদিকে, সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও ওঁত পেতে ছিল স্মাগলারদের ধরার জন্য। অনেকক্ষণ যাবৎ স্নাগলারদের কোন হদিশ না পেয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছিল৷ একজন লেফট্যানান্ট তো মেজর সারজিসকে এসে বলে,”স্যার, আমার মনে হয়না এখানে কেউ আসবে বলে। আমাদের কাছে হয়তো কোন মিসইনফরমেশন এসেছিল।”

কিন্তু সারজিসের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এটা মানতে চায়না। সে বলে,”এমনটা হবার সম্ভাবনা কম। আমার মনে হয়, স্মাগলাররা আশেপাশেই আছে। আমাদের এত সহজে হার মেনে নেয়া উচিৎ হবে না৷ তাদের খোঁজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।”

সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকে। এমন সময় হঠাৎ করে পাতার মর্মর শব্দ পাওয়া যায়। সবাই সাবধানী হয়। ডান দিক থেকে শব্দটা আসছিল। তাই সবাই সেদিকেই বন্দুক তাক করে। সারজিস সেদিকে এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,”কে ওখানে সাড়া দাও, আদারওয়াইজ উই উইল শ্যুট।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে কালো হুডি আর জিন্স পরিহিত একজন আগন্তুক। যার চেহারা মাস্কের জন্য ঠাহর করা যাচ্ছে না। সারজিস আবারো জিজ্ঞেস করে,”কে তুমি?”

এমন সময় এক নমনীয় নারী কন্ঠ ভেসে আসে,”আমি অভীক্ষা। আমি এই জঙ্গলে কিছু জরুরি এসেছিলাম। কিন্তু আপনারা,,”

অভীক্ষার কথা শেষই হলো না কি তার আগেই গোলাগুলির শব্দে সবাই সাবধান হয়ে গেল। স্মাগলারদের দল অতর্কিতে হামলা চালিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ এত গোলাগুলির শব্দে অভীক্ষা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সেনাবাহিনীর সবাই যে যার মতো অবস্থান নিয়ে নেয়। সারজিস কিছুক্ষণ অভীক্ষার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অতঃপর একজন সেনাবাহিনীকে বলে তার দিকে গানপয়েন্ট করে রাখতে। কেননা, এই মেয়েটিও সন্দেহজনক। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। স্মাগলাররা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং তাদের কাছে অনেক দেশি-বিদেশি ভয়ানক অস্ত্র ছিল যা নিমেষেই সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেক বেশি প্রাণহানি ঘটায়। সারজিসের হাতেও একটা গুলি লাগে তবুও সে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। অভীক্ষা দূর থেকে এসব দেখে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছিল। এতদিন সে শুধু এসব সিনেমাতেই দেখত কিন্তু আজ বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতা হলো। অভীক্ষা বেশিক্ষণ আর এসব সহ্য করতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মাথা ঘুরে উঠল এবং সে ঐ স্থানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। এদিকে অসংখ্য সেনাবাহিনী নিজের জীবন হারালো তো অনেকে নিজের জীবন বাঁচাতে পিছু হটল। যে যার মতো পালিয়ে বাঁচল। সারজিসও বেশিক্ষণ লড়াই চালাতে পারল না কারণ তার বন্দুকের গুলি শেষের পথে। শেষ অব্দি সেও হার মানতে বাধ্য হলো। অভীক্ষার দিকে নজর যেতেই সংকোচ দূরে ঠেলে অজ্ঞান অজানা মেয়েটির দেহ তুলে নিয়ে দৌড় দিল সামনের দিকে। এখন তার কোন নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন। সেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজেই সে জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা দূরে চলে গেলো। কিন্তু এই জঙ্গলে কোন গোলকধাঁধার মতো কোথায় আটকে গেল সে। কোনভাবেই বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পেল না। এমতাবস্থায় ভীষণ অসহায় বোধ করল। নিজের জন্য না হলেও নিজের সাথে থাকা এই অচেনা অজানা মেয়ের জন্য তার দুঃচিন্তা হলো। সবকিছু ঠিক থাকবে তো?

To be continue…….