মন রাঙানোর পালা ২ পর্ব-০৭

0
36

#মন_রাঙানোর_পালা_2
#Part_7
#ইয়াসমিন_খন্দকার

সারজিস অভীক্ষাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিল। এই দৃশ্য দেখে জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে আসা কিছু মানুষজন তাদের দেখে ভুল ভাবে। তারা ভাবে দুজনে কোন অনৈতিক কাজ করতে এখানে এসেছিল। এজন্য তারা সবাই মিলে ঘিরে ধরে আছে তাদেরকে। সারজিসের ঘুম ভাঙতেই সে এত লোক দেখে অবাক হয় সাথে কিছুটা আশার আলোও খুঁজে পায়। তাদের সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এখানে আশেপাশে কি লোকালয় আছে? আমরা আসলে এই জঙ্গলে ঢুকে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের সাহায্য করুন প্লিজ।”

ঐ সমস্ত লোকদের মধ্যে একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলে ওঠে,”নষ্টামী করতে গিয়ে ধরা পড়ে এখন আমাদের সাথে চালাকি হচ্ছে? তোমাদের নাটকে আমরা ভুলছি না।”

এরইমধ্যে অভীক্ষারও ঘুম ভেঙে যায়। সে ঘুমঘুম চোখে চোখের সামনে এত মানুষকে দেখে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বসে। নিজেকে সারজিসের এত কাছে দেখে সে যথেষ্ট ঘাবড়ে যায়। দ্রুত দূরে সরে আসে।

সারজিস সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”দেখুন, আপনারা ভুল ভাবছেন। আমরা সত্যিই এখানে ফেঁসে গেছিলাম। আপনারা যেমন ভাবছেন তেমন কিছুই এখানে হয়নি। আর আমি একজন সেনাবাহিনীর সদস্য।”

“সে আপনি যাই হোন, আমাদের তাতে কিছু যায় আসেনা। এখান থেকে একটু দূরেই আমাদের গ্রাম। এই জঙ্গলটাও আমাদের সীমানার মাঝেই পড়ে। এর আগেও আমরা এখানে অনেককে নোংরামি করার সময় হাতেনাতে ধরেছি। তাদেরও ছিল নানান অজুহাত। কিন্তু এবার আমরা এসবে ভুলছি না। এই এদের সবাইকে ধরে নিয়ে চলো গ্রামে। তারপর সালিশ বসিয়ে এদের বিচার করা হবে।”

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অভীক্ষার ভীষণ ভয় হতে থাকে। সে সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”আপনারা প্লিজ এমন কিছু করবেন না। আমরা সত্যিই কোন অন্যায় করিনি।”

“এসব কথা সবাই বলে। এবার অন্তত আমরা এসব কথায় ভুলব না।”

একথা বলেই সবাই সারজিস ও অভীক্ষাকে একপ্রকার টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। অভীক্ষার ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারা দেখে সারজিস চোখের ইশারায় তাকে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অভীক্ষার উপর এখন এসবের কোন প্রভাব পড়ে না।

সারজিস ও অভীক্ষাকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে সালিশ বসানো হয়। সেখানে সারজিস ও অভীক্ষা সবাইকে সত্যটা বলে কনভিন্স করার অনেক চেষ্টা করে যে, তারা কোন নোংরামি করছিল না, পরিস্থিতির স্বীকার ছিল। কিন্তু কেউ তাদের কথা বিশ্বাস করে না। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি লোক বলে,”এসব অনাচার আমাদের গ্রামে আল্লাহর গজব নাজিল করতে পারে। তাই আমাদের এর একটা বিহিত করতেই হবে।”

এহেন কথায় গ্রামের সাধারণ মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। তারা সমস্বরে বলে,”আমাদের কোন উপায় বলুন যাতে আমরা গজব থেকে রক্ষা পাই।”

“এখন এর একটাই উপায়। এরা যা করেছে তাতে এদের বিয়ে দিয়ে দিলে এরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে। যাতে করে আমরা এই অপবিত্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাব।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই অভীক্ষা প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,’না, এমনটা হতে পারে না।’

সারজিসও বলে,”আপনারা এমন করবেন না। আমরা তো বারবার বলছি আমরা কোন অন্যায় করিনি, আপনারা তাই আমাদের উপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেন না।”

মুরুব্বি লোকটা বলে ওঠে,”আমাদের গ্রামকে গজব থেকে বাঁচাতে আমাদের এদের বিয়ে দিতেই হবে। যদি এরা রাজি নাহয় তো প্রয়োজনে জোর করে এদের বিয়ের ব্যবস্থা করো।”

এই কথাটা শোনার পরই কিছু পুরুষ জোরপূর্বক সারজিসকে আটকে ধরে। আর কয়েকজন নারী অভীক্ষাকে টেনে নিয়ে একটা ঘরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই অভীক্ষাকে একটা লাল শাড়ি পড়িয়ে বাইরে নিয়ে আসে। গ্রামের কাজিকে ডেকে পাঠানো হয়। কাজি এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করে। গ্রামের লোকেরা সারজিস ও অভীক্ষাকে এমন ভাবে ঘিরে রেখেছিল যে তাদের কিছু করারও ছিল না। কয়েকজন লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সারজিস ও অভীক্ষার সামনে৷ তাদের উদ্দ্যেশ্যে, এরা কোন গণ্ডগোল করার চেষ্টা করলেই এদের মারবে। সারজিস ও অভীক্ষা এমতাবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে চুপচাপ সব মেনে নেয়। কবুল বলার পালা আসলে দুজনেই নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও “কবুল” বলে দেয়। অভীক্ষা তো কবুল বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাজি সাহেব বলেন,”আজ থেকে আপনারা স্বামী-স্ত্রী। আল্লাহর কাছে আপনাদের সুখী দাম্পত্যের জন্য দোয়া করি।”

অভীক্ষাকে কাঁদতে দেখে কিছু মেয়ে বলে,”নোংরামি করার সময় মজা লাগে আর বিয়ে করতেই কি কান্না!”

এসব কথা অভীক্ষার বুকে তীরের মতো বিঁধে। এদিকে বিয়ের পালা মিটতেই সারজিস কিছু গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে সিলেটে ফেরার রাস্তা সম্পর্কে জেনে নেয়। অতঃপর অভীক্ষার কাছে এসে বলে,”চলুন,আমাদের এখন ফিরতে হবে।”

অভীক্ষা চিৎকার করে বলে ওঠে,”আপনার সাথে কোথাও যাব না আমি। এই বিয়েটা আমি মানি না। আপনি একদম আমার উপর স্বামীত্ব ফলাতে আসবেন না।”

সারজিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আমার এরকম কোন ইচ্ছা নেই। এই বিয়েতে আমার নিজেরও কোন মত ছিল না। আমি শুধু নিরাপদে এই সিলেটে পৌঁছানো পর্যন্ত আপনার সাথে আছি। তারপর আপনার পথ আলাদা আর আমার পথ আলাদা।”

শেষের কথাটা বলার সময় কেন জানি সারজিসের মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ রাজি না থাকলেও সে তো “কবুল” বলে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। তাছাড়া এই “অভীক্ষা” নামের মেয়েটার প্রতি তার মনে কোথাও একটা সফট কর্নারও তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে সারজিস অভীক্ষার সিদ্ধান্তকেই সম্মান দেবে। যদি অভীক্ষা এই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে না চায় তো সারজিসও এটা নিয়ে আর কথা বাড়াবে না।

অভীক্ষা সারজিসকে বলে,”সিলেটে ফেরার পর আপনি আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। যেহেতু আমরা দুজনের কেউই মন থেকে কবুল বলিনি তাই এই বিয়ে কবুল হয়নি৷ এর কোন ভিত্তি নেই।”

“ঠিক আছে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সিলেট শহরে পৌঁছেই অভীক্ষা সারজিসকে বলে,”আশা করি, এটাই আমাদের শেষ দেখা। জীবনে আর কখনো আমি আপনার মুখোমুখি হতে চাই না। আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে সমস্ত ঘটনাকে আমি দূর্ঘটনা ভেবে ভুলে যেতে চাই। যা-ইহোক, আপনি আমার অনেক সাহায্যও করেছেন। এসবের জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তবে আশা করি, আপনার চিন্তা-ভাবনাও আমার মতোই।”

সারজিস হালকা হেসে বলে,”আমিও এই বিয়েটা মন থেকে করিনি। তাই আপনি না চাইলে, এই সম্পর্কটা আমার কাছেও ভিত্তিহীন। ভালো থাকবেন। আপনি এগিয়ে যান আপনার পথে। সবটাকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন।”

অভীক্ষা রাস্তায় চলন্ত একটা বাস থামিয়ে সেখানে উঠে পড়ে। অতঃপর সেই বাসে করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সারজিস ব্যথিত চোখে অভীক্ষার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তার হৃদয়ে কেন জানি একটা সূক্ষ ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথার কারণ তার কাছে অজানা। ধীরে ধীরে বাসটা সারজিসের চোখের আড়াল হয়ে যায়। সারজিস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আমারও চেষ্টা করা উচিৎ, সবটাকে স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবার। এই বিয়ের কোন ভিত্তি নেই।”

অভীক্ষা হোটেলে ফিরে এসেই হতবাক হয়ে যায়। কারণ সে দেখতে পায় সুনীতি সেখানে এসে বসে আছে। তাকে ভীষণ চিন্তিত লাগছে। মুন্নিকে অনেক বকাবকিও করছে সে। অভীক্ষা এসেই বলে ওঠে,”মা, তুমি!”

সুনীতি অভীক্ষাকে দেখেই ছটফটিয়ে ছুটে আসে। অভীক্ষার গালে ঠা””স করে থা””প্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,”এই ছিল তোমার মনে? নিজেকে খুব চালাক ভেবেছ তাইনা? আমাকে এতটাই বোকা মনে করো তুমি? এজন্যই আমি তোমাকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিতে চাইনা। কাল থেকে তোমার কোন খোঁজ নেই, আমি তো শুনেই আজ সকাল সকাল ঢাকা থেকে সিলেটে ছুটে আসি। পুলিশ রিপোর্টও করেছি। জানো, কতোটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমি?”

অভীক্ষা মাথা নিচু করে। সুনীতি এবার অভীক্ষার দিকে ভালো ভাবে খেয়াল করে বলে,”আর তুমি এই লাল বেনারসি শাড়িটা কোথায় পেলে?”

“..”

“চুপ করে আছ কেন উত্তর দাও।”

“মা, আমি একটা ফ্যাশন শো এ ছিলাম আর সেখানেই এই শাড়িটা পড়তে হয়েছিল।”

“আমাকে বোকা ভেবেছ? একদিন থেকে তুমি ফ্যাশন শো এ ছিলে? কোথায় ছিলে সেখানকার নাম্বার দাও আমায়৷ আমিও সত্যটা যাচাই করে নেই।”

অভীক্ষা আর কিছু বলার মতো খুঁজে পায়না। কিন্তু তাকে তো সবটা ম্যানেজ করতে হবেই। এরমধ্যে সুনীতি বলে ওঠে,”অনেক হয়েছে। তুমি আর এক সেকেন্ডও সিলেটে থাকবে না। এক্ষুনি আমার সাথে ঢাকায় ফিরে চলো।”

বলেই টানতে টানতে অভীক্ষাকে নিয়ে যেতে থাকেন।

To be continue…….