প্রিয় সুখ-৩
_________________
বাচ্চাটা কাঁদছে।অনেক সময় ধরে একটানা কেঁদেও সে থামছে না।কান্না যেন আনন্দ! প্রকৃত পক্ষে মানুষের স্বভাব আনন্দকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে চাওয়া।ছাড়তে চায় না কিছুতেই।সব সময় চায় আনন্দে আনন্দে সারাটা জীবন কাঁটিয়ে দিতে।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে কান্নাটা বেশিক্ষণ থাকে।ঠিক ততক্ষণ,যতক্ষণ নতুন আনন্দের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।গোল গোল বড় চোখ।সচ্ছ কাঁচের মত মনির চারপাশটা ঝকঝক করছে সাদা অংশ।জ্বলজ্বল করে মুক্ত কণার মতো উজ্জ্বল হয়ে ভাসছে পানি।ঠোঁট উল্টে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে সে।তার মা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝাতে ব্যস্ত।আচ্ছ মহিলাটির বিরক্ত লাগছে না?এত ধৈর্য্য নিয়ে তিনি কিভাবে চুপ করে আদর দিয়ে সামলাচ্ছে।নীহারিকা যদি এই জায়গায় হতো নিশ্চিত সে ছুড়ে ফেলে দিত জানালা দিয়ে।কান্নার শব্দে তার মাথা ব্যাথা করছে।মনে মনে সে খুব বিরক্ত ভাষায় বলল,অসভ্য বাচ্চা চুপ কর।তা না হলে সত্যি তোকে ফেলে দিবো।’কিন্তু সে জানে এই ভয়াবহ কাজ সে কখন করতে পারবে না।বিমু্গ্ধ সিট থেকে লাফঝাপ মেরে উঠে আড়মোড় ভেঙ্গে বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গেলো।মাথার পিছনে ঝাড়ি মেরে সরল বাক্যে বলল,’ কিরে তুই এমন হ্যাবলার মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছিস কেন?তুই কি ছাগল??’
বাচ্চাটা থেবলার মত মুখ করে তাকিয়ে রইলো।ভাষা যে সে বুঝে না তা নয়।বয়স কম করে হবে পাঁচ,ছয় বছর।কয়েক মুহূর্ত থেমে থেকে আবার কান্নায় মেতে উঠে সে।বিমুগ্ধ ছেলেটার চুল টানে।নাক টানে।গাল টেনে বলল,’ ছেলে হয়ে কান্না করছিস লজ্জা করেনা?বলদ একটা।’
ছেলেটা এবার একটু চুপ করে বলল,’ ছেলেরা বুঝি কাঁদে না??’
‘ একদম না।এসব নেকা নেকা কাঁদে মেয়েরা।তুই কি মেয়ে না কি?দেখে অর্ধ মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে।ছাগল একটা।’
‘আমি ছাগল না।মা দেখো না আমায় কি বলে?’ বলেই আবার কান্না করতে যাবে বিমুগ্ধের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে আর কাঁদলো না।চুপ চাপ বসে বসে পা দুলাতে লাগল।তাকে দেখে মনে হচ্ছে কান্নারা সব গলা,গালের ভিতরে দম ধরে আছে।মুখ ফুলিয়ে সে কান্না থামাচ্ছে।ছেলেরা কাঁদে না কাঁদলে ছাগল হয়ে যাবে ভেবে সে নিজেকে আটকে রেখেছে।
লোকজন ট্রেন থেকে নামছে।সবার আগ্রহ আকাশ সমপরিমাণ।কি হয়েছে??কিভাবে হয়েছে??জানার প্রবল আগ্রহ নিয়ে একে একে নিচে চলে যাচ্ছে তারা।নীহারিকা সিট থেকে উঠে দাঁড়ায়।মনে মনে ভাবে এসব কি সত্যি তার জন্য হয়েছে??হায় আল্লাহ!সিট থেকে বের হতে যাবে তার আগেই দরজা আকঁড়ে দাঁড়ায় বিমুগ্ধ।ঠোঁটে চিকন হাসি রেখে সে বলে উঠে,’ কোথায় যাওয়া হচ্ছে মিস ক্ষেপা মহিলা?’
এই মানুষটার সাথে নীহারিকা কথা বলবে না বলে ঠিক করেছে।আস্ত একটা বেয়াদপ ছেলে।কি বলে?কি করে?কি চায় কিছুই বুঝা যায় না।চরিত্রে তো ঘোর সমস্যা।দূরত্ব ভালো।কথা না বলে নীহারিকা দাঁড়িয়ে রয়।এদিক সেদিক তাকায়।হিজাবের একটা অংশ পিছনে উড়িয়ে দেয়।হাত দেয় জানালার গ্রিলে।যেন সে দেখছে না এই মানুষটাকে।বিমুগ্ধ অবাক হচ্ছে কি?ভেবে সে একবার পিছনে তাকাল।উল্টো সে নিজে অবাক হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।মানুষটার মাঝে কোন ভাবই প্রকাশিত হলো না।উল্টো সিটের মেয়েটির সাথে খুবই সুন্দর করে কথা বলছে সে।অথচ তার সাথেই যেন পাঙ্গা।এমন কেন মানুষটা?রাগে নীহারিকার হাত পা কাঁপছে যেন।ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে নেমে যেতে নেয়।বিমুগ্ধ তার দিকে না তাকিয়ে মেয়েটির উদ্দ্যেশে বলল,’ উনি হচ্ছেন মিস ক্ষেপা মহিলা।পালিয়ে এসেছে নিজের বিয়ে থেকে।আপনিও কি পালিয়েছেন??’
অবাক বিস্মৃত মুখ করে নীহারিকা তাকিয়ে রইলো বিমুগ্ধের দিকে।এভাবে তাকে অপমান করায় খুব খুব রাগ হচ্ছে তার।ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে চড় বসিয়ে গাল লাল করে দিতে।কিন্তু সে তেমন কিছুই করলো না।পাশ কাঁটিয়ে চলে যায়।নিচে নেমে নীহারিকার চোখ চড়কগাছ।ট্রেনের রাস্তার একটা অংশ ভাঙ্গা।মনে হচ্ছে কেঁটে কেউ নিয়ে গিয়েছে।অবাক জনতা গালাগাল করছে কর্তিপক্ষকে।এসব ঠিক করে রাখেনি কেন?কেন আগে বলেনি?এখন বাড়ি যাবে কিভাবে??আরো অনেক কথা।নীহারিকা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াল।অপরিচিত মানুষ গুলোর মাঝে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার।একা খুব একা লাগছে।এখন কি হবে?কিভাবে সে,কোথায় যাবে??ভয়ে আতঙ্কে তার খুবই বেদনা দায়ক অনুভুতি হচ্ছে।মনে পড়ছে বাড়ির কথা।মায়ের কথা।বাবার কথা।এই চরম উত্তেজনাময় মুহূর্তে এসে নীহারিকা বুঝতে পেরেছে সে ভুল করেছে।ভয়াবহ মহা ভুল।শরীর বেয়ে ভয় আলোড়ন ফেলছে।ভয় যখন নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারে সারা শরীর সে দখল করে ছাড়ে।নীহারিকার এই মুহূর্তে মন চাইছে ছুঁটে বাড়ি চলে যেতে।কতসময় হয়েছে??নীহারিকা দ্রুত ব্যাগ ঘেঁটে মোবাইল ফোন খুঁজতে শুরু করলো।প্রচন্ড ভাবে হতাশ হয়ে সে বুঝতে পারলো নিজের ফোন সে বাড়িতে রেখে এসেছে।এত বোকামি কিভাবে করতে পারলো সে?কান্না পাচ্ছে তার এখন।খুব কান্না।শরীর ভেঙ্গে আকাশ জুড়ে যেন অসহায়ত্ব তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।রাস্তায় যখন মানুষের হট্টগোল তখন সে উল্টো পথের দিকে তাকিয়ে আছে।নিজের বাড়ি,নিজের শহর তাকে খুব করে টানছে।এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহরটাও যদি তাকে উপহার দেওয়া হয় তাহলেও সে খুশি হবে না।যে কোন মূল্যে সে নিজের শহরে যেতে চায়।বাবা মায়ের কাছে যেতে চায়।বাবা মায়ের কাছে থাকার জন্য যদি তাকে মোটা,কালো,বাজে দেখতে একটা বুড়া লোককে বিয়ে করতে হয় তাহলে সে তাই করবে।বাবা মায়ের জন্য একটা বিয়ে করাই যায়।তবুও তার তাদেরকেই চাই।এত গুলো বছরের সব স্বাধীনতার ধারণা এক নিমিষে মাথা থেকে যেন কোথাও উধাও হয়ে গেছে।আশেপাশে,উপর নিচে কোথাও সে আর সেই স্বাধীন হওয়ার আনন্দ,খুশি,সুখ খুঁজে পাচ্ছে না।সুখ গুলো যেন নরম শিমুল তুলোর মত আকাশে,হাওয়ায় উড়ছে।যত ধরতে চাইছে সব ততো দূরে চলে যাচ্ছে।মাথা চেপে নীহারিকা রাস্তার পাশে উঁচু ঘাসে বসে পড়ে।
________________
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে।ঘড়িতে হয়তো ছ’টা বাজে।পশ্চিম আকাশে কমলা আভা।এত নিখুঁত সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছে সব শীতল।আকাশী আকাশটা যখন শিল্পী মশাই আকঁতে বসেছিলেন তখন অসাবধানতাবশত এক কৌটা কমলা রং হাত ফসকে উল্টে পড়েছে মুখ থুবড়ে।ছড়িয়ে ছিড়িয়ে সারা কাগজময় হয়ে গেছে।পশ্চিম দিকটা রঙ্গের খুব পছন্দ হয়েছে।বেছে বেছে সে পশ্চিমে রঙ্গীন হয়েছে।সোনার কাঠি দিয়ে দূরের সব সবুজ গাছে কেউ জাদু করেছে।সোনালী জাদু।সেই জাদুর ছোঁয়া পেয়ে স্বর্ণের রং ধারণ করেছে প্রকৃতি।মধুর মত রূপটা যেন সবাইকে মুগ্ধ করার জন্য জন্ম নিয়েছে।জন্মটা বৃথা গেল!দুঃখ।বিমুগ্ধ কথাটা ভাবতে ভাবতেই লাফিয়ে নিচে নামলো।শিশির কনার মত রূপালি আলো জমেছে সবুজ চেপ্টা পাতার বুক ঘেঁষে।বুকের উপরে প্রলেপ দিয়ে আঁছড়ে পড়ছে দূরের সূর্যের তীক্ষ্ন রশ্নি।ডান বাম দুই হাত আকাশের দিকে অবাধে বাড়িয়ে দিয়ে বিমুগ্ধ একটা জোড়ালো হাই তুললো।ট্রেনের রাস্তা ভাঙ্গা।কথাটা যেন তার কানের কাছে এসে গায়েব হয়ে গেছে।মাথায় প্রবেশ করতে পারেনি।তাই সে বেশি ভাবছে না।রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল।সামনে হেঁটে কৌতুহলি হয়ে জঙ্গল দেখছিল সে।হুট করে কারো গায়ের সাথে লেগে প্রায় পড়ে যেতে নেয় সে।উষ্ঠা খেয়ে পরার মত অবস্থা তার।নিজেকে সামলে সামনে তাকাতে তাকাতে হেসে উঠে বলল,’আন্ধারা রাস্তায় নামে কেন?যতসব পাগল।’
কালো কাপড়ে ঢাকা মাথাটা উপরে তুলতেই নীহারিকাকে আবিষ্কার করে বসে বিমুগ্ধ।হাসিতে ফেঁটে পড়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,’ এত পাগলী।পালিয়ে আসা পাগলী।’
কিছু বলে না নীহারিকা।গম্ভীর হয়ে বসে থাকে সে।বিমুগ্ধ পাশে বসতে বসতে বলল,’ কি হয়েছে আপনার?চুপ করে বসে আছেন কেন?জিনে ধরেছে??না কি ভূতে??’
‘ আপনাকে বলেছিনা দূরে থাকতে?তবুও গায়ে পড়ে কথা বলছেন কেন?’ ভারী আশ্চর্য হওয়ার অভিনয় করে বিমুগ্ধ বলল,’ গায়ে পড়ে কথা বলছি মানে?নিজেকে কি বিশ্ব সুন্দরী মনে করেন?হতে পারে আমি লাফাঙ্গা।কিন্তু লাফাঙ্গা ছেলেদেরও মানসম্মান আছে।সব মেয়েদের গায়ে পড়ে না এরা।’
সব মেয়ে বলতে কি বুঝালো নীহারিকা বুঝলো না।তিশা দৌড়ে এসে বিমুগ্ধকে বলল,’দোস্ত আপাততো ও দিকে যেতে পারবে না ট্রেন।রাস্তা ঠিক করতে লোক আসছে।অনেক সময়ের ব্যাপার।হেঁটে যেতে হবে।দুই তিন ঘন্টার জায়গায় এখন পাঁচ ছয় ঘন্টা হাঁটতে হবে।হাঁটবি??না কি অপেক্ষা করবি?’
হঠাৎ খুব ভাবুক হয়ে ভাবতে শুরু করলো মানুষটা।নীহারিকা অবাক হয়ে লক্ষ করছে লোকটিকে অনেক ব্যক্তিত্ববান মানুষ মনে হচ্ছে।সাধারণের চেয়ে উর্ধ্বে কিছু আছে তার মাঝে।জানতে হলে খুব গভীর হয়ে ভাবতে হবে।খুবই গভীর হয়ে।সে তো ভাবতে চায় না।এক মুহূর্তের জন্যেও অসহ্য লোকটাকে নিয়ে ভাবতে চাচ্ছে না সে।মুখ ফিরিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।অপলক সে পাতা,গাছ গুণতে শুরু করে।আদো কি পাতা গুণা সহজ লভ্য?
‘ হাঁটা শুরু কর।উল্টো পথে।যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে যাবো।’
অর্পন অবাক হয়ে বলল,’ কেন??সামনের দিকে গেলে লাভ হবে।বাসায় পৌছতে সময় লাগলেও পৌছনো যাবে।কিন্তু পিছনে গিয়ে কি করবি??আর সামনে হাঁটলে গাড়ি পেয়ে যাবো।পাগলামু বন্ধ কর।’
‘ তোরা যেতে পারিস।আমি তো উল্টো হাঁটবো।’
বিমুগ্ধ উঠে দাঁড়ায়।সব মানুষজন সামনে হাঁটতে শুরু করেছে।শুধু একমাত্র এই ব্যক্তিটি উল্টো পথ ধরেছে।মুহিত কিছু একটা ভেবে বলল,’ তোরা সামনে যা।আমি তো বিমুগ্ধের দলে ভিড়লাম।নিশ্চুয়ই কিছু ভেবেই সে উল্টো পথ ধরেছে।’
একে একে মুনিরা,তিশা,শান্ত এক পর্যায়ে অর্পনও বিমুগ্ধের পিছনে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা শুরু করে।মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করেছে।নীহারিকা খুবই একা হয়ে পড়ছে।তার কান্না পাচ্ছে।একটা সময় নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে। সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।গলা কাঁপিয়ে শব্দ বেড়িয়ে আসতে চাইছে।চোখের পল্লব জোড়া ভিজে চুপচুপ হয়ে নিকাবের কাপড়ও ভিঁজিয়ে দিচ্ছে।কষ্টে বুক ভারী হয়ে চুর্ণবিচূর্ণ হতে শুরু করে।চারপাশে কালো ভূতুরে অন্ধকারে প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করেছে সে।কোথায় এসে ফেঁসে গিয়েছে ?হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে বসে সে ফুঁফাচ্ছে।কোন দিকে যাবে ??কোথায় যাবে?কিছু বুঝতে পারছে না।মাথা সম্পূর্ন খালি।হাতের ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে আর্তনাদ করে উঠে সে।দ্রুত নেওয়া সিদ্ধান্ত গুলো বেশিরভাগ সময় ভুল হয়।তার বাবা বলতেন।সত্যি বলতেন।একদম সত্যি।একা একটা মেয়ে নির্জন রাস্তায় বসে বসে ঝিম ধরে আছে।বহু দূরে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে সব শূন্য।সত্যি কি শূন্য??না আসলে মানুষ কিছু আছে।নীহারিকা নিজেকে একা ভাবতে ভাবতে মনে করছে আশেপাশের সব ফাঁকা।পাশে চপ চপ শব্দ হচ্ছে।নীহারিকা অবাক হয়ে পাশে তাকাল।তার পাশে সেই ছেলেটি।হাতে নেশার বোতল।হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো নীহারিকা।এই ছেলেটির তো পায়ে সমস্যা??অথচ নেশা করছে।এই প্রথম তার মনে হচ্ছে বিমুগ্ধ সঠিক ব্যক্তি।সবাই ভুল করেছে শুধু সে বাদে।একটা টাকাও দেয়নি।ছেলেটির মাঝে স্পেশাল কিছু আছে।কি সেটা??কিভাবে পূর্বে সব বলে দিতে পারে?নিজের পুরো দুশো টাকা লস হওয়ায় নীহারিকা আফসোস করছে।ঝালমুড়ির ছেলেটাকে সে টাকা দিয়েছে আরো কম।অথচ সে ভালো ছিলো।পাশে তাকিয়ে নীহারিকা দুটি দুই রকমের পৃথিবী দেখতে পেল।সাথে নিজের ভুল ধারণাকে।ঝালমুড়ি বিক্রেতা বসে বসে টাকা গুনছে।নীহারিকা ব্যাগ থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে ছেলেটির থেকে ঝালমুড়ি কিনলো।বাড়তি টাকা শুধু শুধু নিতে চায়না তাই সে ঝালমুড়ি কিনেছে।বাচ্চা ছেলেটির পাশে বসে প্রশ্ন করে,’তুই বাড়ি যাবি কিভাবে??’ছেলেটা সুন্দর আনন্দিত একটি হাসি উপহার দিয়ে বলল,’হাইট্টা হাইট্টা যামু আপা।’
‘ আর কত দূর তোর বাড়ি??’
‘আছে দূর আছে আরো।’
‘ওহ।’ নীহারিকা মনে মনে বার বার বলছে আমাকেও তোর সাথে নিয়ে যা প্লিজ।নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার।ছেলেটি বলল,’ আপা বইসা আছেন ক্যান?যাইবেন না?বাড়ি?’
‘ স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়ে বাড়ি হারিয়ে ফেলেছি ভাই।’ উদাসীন গলায় বলল নীহারিকা।অবাক হয়ে ছেলেটি বলল,’ আপনার দলের পোলা পাইন কই আপা?’
‘ আমি তো একাই।’
‘ আরে ওই ভালা মত করে ভাইজানডা আপনার লগের না??’
‘ কোন ভালো মত ছেলে?’ নীহারিকা ভাবতে বসে কাউকেই পেলো না।তার পাশের ছেলেটি তো একটা বেয়াদপ!
‘ আমারে দুই হাজার টাকা দিছে ওই ভাইজান।আপনার সামনেই তো বইছে দেখছি।হাতে কি কতগুন পইরা ছিল।’
নীহারিকা অবাক হয়ে বসে বসে ভাবে লোকটি এত টাকা দিল?কই তারা তো কেউ দেখলো না?এত অদ্ভুত কেন মানুষটা?কৌতুহল বাড়ছে খুব তার।মানুষটার প্রতি সে অনেক আগ্রহীত হচ্ছে।কে এই বিমুগ্ধ?যার কাজে হঠাৎ করে সে মুগ্ধ হয়ে বসেছে?
ছেলেটি উঠে চলে যায়।রাত প্রায় হয়ে আসে।দূরে কোথাও আজান পড়ে।নীহারিকার গা কাঁপছে থরথর করে।ভয়ে শরীর মন সব জমে আছে।কিছুসময় পরে সে ভাবলো সে কি বোকা?এখানে বসে আছে কেন? হয় সামনে হাঁটবে নয় পিছনে।বসে থাকবে কেন?কিন্তু নীহারিকার শরীরে শক্তি পাচ্ছে না।বুকটা খুব কাঁপছে।কাঁপতে কাঁপতেই সে মরবে মনে হচ্ছে!
‘ বসে আছেন কেন?হাঁটুন।এত কষ্ট করে পালিয়েছেন।গন্তব্যে যান।এমন ভাবে বসে বসে ঝিমুচ্ছেন মনে তো হচ্ছে জিনে পেয়েছে।’
নীহারিকা আপন মনে উত্তর দিল,’আমি বাড়ি যাবো।’
কেউ একজন খুবই শীতল ঠান্ডা কন্ঠে বলল,’ তো বসে থাকলে কি জিনে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসবে?’
‘ একা কিভাবে যাবো?’
‘ একা পালিয়ে আসলেন কিভাবে?’
চমকে উঠে নীহারিকা পাশে তাকায়।বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সে তাকিয়ে আছে।অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসা কালো পরিবেশ কে ঠেলে সরিয়ে দুটি উজ্জ্বল চোখ দেখা যাচ্ছে।জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মত জ্বলে উঠেছে একটি হাসি।রসিকতায় ভরা চোখ তার।মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া মৃদূ কোঁকড়ানো চুল।মোটা দু জোড়া কালো কুচকুচে ভ্রু,পাতলা পোড়া ঠোঁট।বাঁশের কঞ্চির মত একটি লম্বা নাক মুখভর্তি খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি।লোকটি কে??চমকে উঠে একটু দুরে ছিটকে পড়ে সে।দ্রুত ফোনের লাইট জ্বলিয়ে তিশা এগিয়ে এসে বলল,’ আমরা ভয় পেয়েছ?’
হঠাৎ একটা অসম্ভব সাহস কাজ করছে নীহারিকার মাঝে।অচেনা অপরিচিত মানুষ গুলোকে হঠাৎ করে খুব কাছের আপন সত্ত্বা মনে হচ্ছে।পাশে লেপ্টে বসে বিমুগ্ধ নীহারিকার হাতের দিকে তাকালো।চোখ বড় করে উল্টে হাস্যকর ভাব নিয়ে বলল,’ এত ঝালমুড়ি আপনি একা খাবেন??আচ্ছা খাদক তো।বাপরে বাপ।’
এক টানে কেঁড়ে নিয়ে সে মুখে পুড়তে শুরু করে।চিবাতে চিবাতে সে বলল,’ কাঁদছিলেন কেন?’
‘ আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ হচ্ছে।’
‘ ঘর পালাতক মেয়েগুলো তো হয় খুবই জঘন্য।এদের আমার মন খারাপ করতে যাবে কেন?যতসব আদিক্ষেতা।তিশা আমার ব্যাগটা নিয়ে আয়।এই ক্ষেপা মহিলা এখানেই থাক।বেশি কিছু তো হবে না কালকে কাগজে ধর্ষণের একটা কেস দেখতে পাবো।অর্পন ভালো করে দেখিস।তুই তো বেশি পত্রিকা পড়িস।আর একদম লেজে লেজে আসবেন না।মসিবত আমার একদম পছন্দ না।চল সবাই।’
বিমুগ্ধ ঝালমুড়ির প্যাকেট নিয়েই উঠে গেল।সোজা হাঁটতে শুরু করেছে সে।ছেলেটা খুব গায়ে লাগার মত কথা বলে।যেন কাঁটা দিয়ে শরীরে কাঁটছে।কিন্তু একটা কথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠে নীহারিকা।তার মন বলছে এরা ওতোটাও খারাপ না।উঠে দৌড়ে পিছনে এসে দাঁড়ায়।দৌড়ানোর সময় পায়ের একটা অংশে প্রচন্ড আঘাত পায়।সেদিকে কোন পরোয়া না করে নীহারিকা পিছন পিছন হাঁটছে।বিমুগ্ধ হাঁটা থামি পিছনে ঘুরে তাকায়।লজ্জা,ভয়ে নীহারিকা মাথা নিচু করে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।ভ্রুজোড়া কুঁচকে নিলো বিমুগ্ধ।অন্ধকারেও তার চোখ দেখা যাচ্ছে।আশ্চর্য জনক চোখ!সন্দেহান চোখে তাকিয়ে সে বলল,’মিস ক্ষেপা মহিলা কি আমাদের সাথে যাওয়ার ফন্দি করছেন??’
ক্ষেপা মহিলা শুনতে শুনতে নীহারিকার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।চাপা রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে সে বলল,’ আমার একটা নাম আছে।সেই নামে ডাকুন।ক্ষেপা মহিলা এটা কেমন কথা?’
‘ আপনার বুঝি নাম আছে??কি নাম?পালাতক আসামী?’
‘ সব সময় এভাবে কথা বলেন কেন আপনি?’
‘ কিভাবে কথা বলি আমি?’
‘ খোঁচা মেরে।সুন্দর করে কথা বলতে পারেন না?’
‘ আপনি কি প্রধানমন্ত্রী?না কি রাষ্ট্রপতি?এদের বাদে আমি কারো সাথে সুন্দর করে কথা বলতে পারি না।খুবই বেয়াদপ আর অসভ্য টাইপের ছেলে তো তাই।পিছন থেকে সরুন।আমরা আপনার মত মসিবত সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে পারবো না।’
‘ পারতে হবে না।আমি কি আপনার সাথে যাচ্ছি না কি?আপু আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি?নিজের খরচ আমি নিজেই দিবো।শুধু ঢাকার একটা গাড়িতে তুলে দিবেন প্লিজ?’ তিশার দিকে তাকিয়ে বলল নীহারিকা।তিশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই বিমুগ্ধ হাসতে শুরু করলো।বেশ মজা উড়িয়ে বলল,’ এতো তাড়াতাড়ি আপনার ঢাকা যাওয়া হবে না মিস ক্ষেপা মহিলা।’
‘ কেন??’
‘ আপনাকে কেন বলবো?আমি নিজের বুদ্ধি খরচ করে আপনার উপকার করবো কেন?’
‘ উপকারের কি আছে?’
‘বলে দেওয়া মানেই উপকার।এই তোরা কেউ এরে সঙ্গে নিবি না।পরে আরো বিপদে পড়তে হবে।যতসব ফাউল পাবলিক।’
বিমুগ্ধ হাঁটা শুরু করে।নীহারিকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর বসে পড়ে।চোখে হাত দিয়ে সে আবার অনুভব করে সে কাঁদছে।সচরাচর সে কাঁদে না।আজ শুধু তার কান্না পাচ্ছে।একটা লোক এত খারাপ কিভাবে হয়?দয়া মায়া কিছুই নেই।মনখারাপ করে সে কাঁদছে।মস্তিষ্ক শূন্য তার।কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে যেন।এই ট্রেনের কাউকে সে চিনে না।কি হবে ভেবেই মাথা ঘুরছে।
পিছন থেকে কেউ এসে বলল,’চলেন মিস ক্ষেপা মহিলা।’
মাথা তুলে তাকিয়ে নীহারিকা অন্ধকারে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লম্বা ছায়া দেখতে পায়।হাসির একটা রেখা ঠোঁটে ফুঁটে উঠে।এক লাফে উঠে সে বলল,’ আপনার এই ঋণ আমি কখনো ভুলবো না।একদিন আমিও আপনাকে সাহায্য করবো।দেখে নিয়েন।’
‘ তাই না কি?কিন্তু খুবই খুশির কথা আমি নিজের বিপদ হবে জেনে সেই কাজ কখনো করবো না।নিজের মোটা মাথাটা নিজের সাহায্যে কাজে লাগালে আমাদের ঘাড়ে চড়তে হবে না আশা করি।আহ আল্লাহ নারী নামক মসিবত কেন সব সময় আমার ঘাড়ে এসে পড়ে?কেন?’
খুবই আফসোস করে বিমুগ্ধ হাঁটতে শুরু করে।নীহারিকা পিছনে পিছনে গুঁটি গুঁটি পায়ে হাঁটতে থাকে।কয়েক সেকেন্ড পর পর মানুষটার চেহারা দেখার জন্য তার দিকে তাকাচ্ছে সে।কয়েক ঘন্টা আগের মনোভাব হঠাৎ উল্টে গেল।তার মনে হচ্ছে এই মানুষটার মত সুন্দর,ভালো,আশ্চর্য মানুষ সে তার ক্ষুদ্র জীবনে আর কখনো দেখেনি।বিমুগ্ধ হঠাৎ হাসতে শুরু করে।ভ্রু কুঁচকে নীহারিকা প্রশ্ন করে,’ হাসছেন কেন?’
‘ আমি মোটেও ভালো ছেলে নই।সুন্দর অবশ্য সত্য।নিজেকে আমি দারুন সুদর্শন পুরুষ মনে করি।তবে আমি খুবই অসভ্য স্বভাবের।’
কথাটা শেষ করার আগেই বিমুগ্ধ নীহারিকার মুখের উপরে হালকা ঝুঁকে পড়ে।ভয়ে মৃদূ দূরে সরে যেতে গিয়ে ধপ করে রাস্তার উপরেই পড়ে যায় নীহারিকা কোমড়ে খুবই ব্যথা পেয়েছে সে।বিমুগ্ধ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে যেন।মুহিতা আর তিশা টেনে তুলে নীহারিকাকে।চোখে পানি চলে এসেছে তার।আজকের দিনটাই তার কাঁদতে কাঁদতে শেষ হবে মনে হয়।লোকটা একটা অসভ্য।বেয়াদপ।জঘন্য।খুব বাজে।রাগে পা ঝাড়ি মেরে সে হাঁটতে শুরু করে।খুব গরম পড়ছে।এমন একটা ভাব করে বিমুগ্ধ নিজের শার্ট খুলে নীহারিকার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’মিস ক্ষেপা মহিলা এটা হাতে নিয়ে হাঁটুন।’
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে নীহারিকা বলল,আমি হাতে নিবো?’
‘ হুম।কেন আপনার হাত নেই?ল্যাংড়া লুলা?না কি পঙ্গু টঙ্গু? কোনটা?’
হা করে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো নীহারিকা।শান্ত অর্পন বিমুগ্ধকে পিছন থেকে বলল,’মেয়েটাকে এভাবে বিরক্ত করছিস কেন?ছেড়ে দে।’
‘ না কোন ছাড় নেই।নিলে চলুন আর না নিলে এখানে থাকুন।’
ডান হাত বাড়িয়ে শার্ট হাতের ভাজে নিয়ে নীহারিকা হতবাক হয়ে রইলো।একটা অপরিচিত মেয়ের হাতে কেউ নিজের শার্ট তুলে দিতে পারে??মানুষটা স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে।যেন কিছুই হয়নি।এই পৃথিবীতে কিছু হলেও তার যায় আসে না।সে সাধারণ পথিক।হাঁটাই তার এক মাত্র কাজ।নীহারিকা লক্ষ করেছে লোকটা কখনো বিরক্ত হয় না?রাগে না?চেতে না?ক্ষেপে না?শান্ত,হাসি খুশি,চঞ্চল,প্রাণবন্ত ভাবে থাকে।মুখ দেখেই বুঝা যায় সুখি মানুষ।হঠাৎ কি যেন হলো বিমুগ্ধ জুতো খুলে নীহারিকার হাতে দিয়ে দিলো।প্যান্ট ভাজ করে উপরে হাঁটু পর্যন্ত তুলে নিলো।গেঞ্জির হাতা আরো উপরে তুলে কাঁধে রেখে অনাবিল কন্ঠে সে বলল,’ গরম লাগছে খুব।আপনার লাগছে না??জুতো খুলে আমার হাতে দিতে পারেন।আমি কিছু মনে করবো না।’
খালি পায়ে পাথরের উপর দিয়ে সুন্দর করে হেঁটে চলেছে বিমুগ্ধ।ঠোঁট জুড়ে তার হাসি।নীহারিকা অবাক হয়ে পিছন পিছন হাঁটছে আর ভাবছে,এই ছেলের মাথায় ভয়াবহ সমস্যা আছে।
‘ আপনার ধারণা ভুল আমি পাগল নই।পাগল ঠিক করা আমার কাজ।’
মনের কথাও বুঝে যায়!দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীহারিকা হাঁটছে।আর কিছু ভাবতে পারছে না।যত ভাববে এই লোক ততো রহস্যে ঘেরা হয়ে সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।এত রহস্যে ভরা উদ্ভট মানুষটাকে সে সমাধাণ কিভাবে করবে?মানুষটা এবার নিজের হাতের ব্রেসলেট গুলো খুলে নীহারিকার হাতে পড়িয়ে দিয়েছে।চুল চুলকাতে চুলকাতে হাসতে শুরু করে বিমুগ্ধ।যেন সে যা করছে সব নিয়মের মাঝে পড়ে।
__________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..