প্রিয় সুখ-১২
_______________
লাল আভা বড় জলপাই গাছটার পাতার ভাজ থেকে ছিটকে এসে পড়ছে জমিনে। শুকনো পাতার মচমচে শব্দে শরীর একটু ভার ভার হয়ে আসছে। মাটিতে বিছানো অসংখ্য শুকনো রঙের পাতা মাড়িয়ে নীহারিকা এসে দাঁড়ায় তাযিনের সামনে। চোখের পাতা তখন এক সাথে লেপ্টে রয়েছে তার। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের রয়েছে ভিন্ন দূর্বলতা। শক্ত গম্ভীর মানুষটারও ভীতি রয়েছে। নীহারিকা ঠোঁটকে মিশিয়ে হাসল। সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু মুহূর্ত আবেশে তাকিয়ে রইল। হুংকার তুলে তাযিন তখন চেঁচিয়ে বলল,’ আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? ‘
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নীহারিকা ক্ষণকাল নীরব থেকে
পায়ের পেচানো সবুজ লতা নিজ হাতে সরিয়ে দিল। হাতের ভাঁজে লতা নিতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। লতার দিকে একবার চেয়ে দ্রুত ছুড়ে মারে তাযিনের দিকে। উৎকন্ঠা নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে, সাপ সাপ সাপ।’ তাযিন হাত পা ছুঁড়ে লাফিয়ে উঠে অনেক উপরে। তাকে খুব উত্তেজিত দেখাল। রিনঝিনে কন্ঠে হেসে উঠে নীহারিকা। মুখ চেপে মিহি কন্ঠে বলল,’ সেটা সাপ নয় লতা ছিল। এদিকে আসামি লতা বলে।’
চট করে চোখ খুলে মুখটা থমথমে করে তাযিন রগচটা গলায় বলল,’ আর এটা আপনি আমাকে এখন বলছেন? মজা নিচ্ছিলেন?’
মাথার উপরে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুছে নিয়ে নীহারিকা অবাক চক্ষু মেলে চেয়ে রইল। আজ কাল কার মানুষের উপকার করতে নেই। এরা প্রতিদানের বিপরীতে একটা মুখস্ত ঝারি থাবা মেরে মুখে বসিয়ে দেয়। জবাব দিল না নীহারিকা। তাযিন পা দিয়ে জোড়ে লাথি মারে লতার গায়ে। যদি মুখ খুলে কথা বলতে পারত, তাহলে এই লতা নির্ঘাত একটা গালি দিত। তাযিন রাগ দেখাল বিহুদা। নীহারিকা পাত্তাই দিল না। একটা সময় রাগ চেপে রেখে শান্ত কন্ঠে তাযিন বলল,’ আপনাকে ভাল ভেবেছিলাম। আপনি তা মোটেও নন।’
অন্যমনস্ক হয়ে নীহারিকা জবাবে বলল,’ ভাল ভাবতে বলেছে কে? আমি?’
একটু থেমে নীহারিকা হেসে বলল,’ আপনাকে আমি খুব সাহসী মনে করেছিলাম। আপনি তা মোটেও নন।’
তাযিন সরু দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। হঠাৎ করে সে হেসে উঠে। নীহারিকা স্তব্ধ। হাসার কি হল? ঠিক বুঝতে না পেরে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাযিন পাতলা কন্ঠে বলল,’ আমিও ভাবতে পারছিনা সামান্য লতায় আমি ভয় পেয়েছি।’
সে আর এক দফা হেসে চুপ হয়ে পড়ে। জঙ্গলে পাখিদের ডাক শুনা যাচ্ছে। কিচিরমিচির কন্ঠেস্বর। এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফঝাপ। উড়ে এসে বসা। আবার দল বেঁধে আনন্দে মেতে উঠা। বেশ উপভোগ করছে নীহারিকা। পথের আড়মোড়ে উঁচু নিচু মাটি জমে রয়েছে। কখনো নিচু। তো কখনো উঁচু। তাযিন উষ্ঠা খাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। আবার খুব সাবধানে নিজেকে সামলে সে হাঁটছে। তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই এই রাস্তা তার জন্য সম্পূর্ন নতুন। নিস্তেজ রাস্তাটাকে তার চুপটি থাকাটায় আরও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। নীহারিকা মিতু আপুর মত বকবক করে না। কিন্তু এই লোকের থেকেও একটু বেশি বলে। বিমুগ্ধ হলে এখন অনেক কথা বলত। বকবক করে তার মাথা ধরিয়ে দিত। ফিসফিস করে হুট করে কানের কাছে বলত,’ এই যে মিস ক্ষেপা মহিলা আপনি তো মহা স্লো হাঁটছেন। পা-টা চালান। এভাবে তো হাজার বছর লেগে যাবে।’
চিকন ঠোঁটে গাঢ় হাসির রেখা। নিজে নিজে কেউ হাসে? আগে কখনো দেখেনি তাযিন। সামনের দিকে মাঠ। বিশাল মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। পাশে গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। মাঠের এক পাশে প্রচুর পরিমাণে গাছের সমারহ রয়েছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় নীহারিকা। ভ্রু যুগল কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ে তাযিনও। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে নীহারিকার দিকে চোখ রাখে সে। মুখটা কাঁচুমাঁচু করে নিয়ে ভেজা গলায় নীহারিকা বলল,’ ইয়ে আসলে হয়েছে কি.’
ভ্রু আরও বাকিয়ে নিয়ে তাযিন প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ কি হয়েছে? ‘
‘ আমি ভাইয়াদের বাড়ির ঠিকানা জানি না। শুধু এটুকু যানি তারা মাঝি পাড়ায় থাকে। ‘
‘ আপনি সত্যি বাড়ির ঠিকানা জানেন না? ‘
‘ না জানি না। ‘
উপরের ঠোঁট উল্টে নেয় নীহারিকা। তাযিন তাকিয়ে থাকে। একটা দীর্ঘ গরম নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তাযিন যথেষ্ট শান্ত হয়ে বলল,’ আপনার থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। চলুন। ‘
‘ যাব মানে? বাড়ি চিনি না তো? ‘
‘ জিজ্ঞেস করে যাব। ‘
মুখে গাম্ভীর্য্যের লম্বা রেখা দেখে নীহারিকা বলল,’ আপনি সব সময় এমন ভাব নিয়ে থাকেন কেন? যেন প্রেসিডেন্ট। হুহ। ‘
‘ পৃথিবীরতে কি শুধু প্রেসিডেন্টের ভাব নিয়ে চলার লাইসেন্স রয়েছে? ‘
‘ ভাব নিয়ে চলার লাইসেন্সই হয় না। ‘
‘ তাহলে চুপ করে থাকুন। বেশি কথা বলেন আপনি। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে নীহারিকা কথা বন্ধ করে দিল। দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ বলে সে কম কথা বলে অথচ এই লোক বলে সে না কি অনেক কথা বলে। সিরিয়াসলি!
___________________
শান্তর মুখটা মলিন হয়ে রয়েছে। ফাবিহা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সিঁড়ির উপরে তাকে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পরে। উল্টো পায়ে হেঁটে এসে পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় জানতে চাইল,’ কি হয়েছে মিষ্টার অশান্ত? ‘
শান্ত খুবই অসন্তুষ্ট চোখে একবার তাকায়। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দুঃখি কন্ঠে বলল, ‘ বিমুগ্ধের মানে তাযিনের নানুকে চুরির কথা আপনি বলেছেন তাই না ?’
একটা ভাব নিয়ে ফাবিহা বলল, ‘ অবশ্যই । আমাদের বাগান থেকে চুরি করবেন আমরা চুপ করে থাকব? নেহি নেহি। ‘
আরও মলিন করে নেয় মুখটা শান্ত। তাকে খুবই দুঃখি দেখা যাচ্ছে। নানুকি খুব বকেছে? তিনি ডেয়ারিং মহিলা। বয়স হয়েছে তো কি হয়েছে এখনও খুব বকাঝকা করে। উল্টোপাল্টা কিছু করলেই রাগী রানী হয়ে শাসন করে। বেচারাকে মনে হয় খুব বকেছে! ফাবিহার খুব মায়া হয়। তার জন্যেই তো বকা খেয়েছে। সে দারুন গল্প বানিয়ে বলেছিল নানুকে। চুরির কথা চেপে গিয়ে বলেছিল রাতের আধারে গাছে উঠেছিল। যদি হাত পায়ের কিছু হয়ে যেত তাহলে তো তাদেরই দোষ হত। নানু তো শুনে খুবই ক্ষেপেছিল। ঝারি খেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে তার। নরম সুরে ফাবিহা বলল, ‘ খুব বকেছে আপনাকে?’
‘ তা আর বলতে। তাযিন্নাটাও যে কই গেল। সে হলে এত বকা খেতাম না। ‘
‘ কি কি বলেছে? ‘
‘ কি বলেনি সেটা বলুন। চোখ গুলো বড় বড় ডাইনির মত করে বলল, ‘ হুনো পোলা এই বাড়িতে এসব চোইলবো না।যদি এসব করার ইচ্ছা থাকে তাইলে বাহির হইয়া যাইয়ো।
আপনি বলুন মেহমানের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে। ‘
শান্ত খুব মন খারাপ করে বলল শেষ কথাটা। ফাবিহার মনে হল একটা বাচ্চা ছেলে কথাগুল বলছে। ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে সে বলল,’ স্যরি।’
শান্ত ভ্রু কুঁচকে তাকাল। চোখ গুলো তার অনেকটা গর্তে। কপাল উঁচা। নাকটা হালকা মোটা। ভ্রু কুঁচকালে চোখ আরও ছোট হয়ে আসে। ছোট করে ফাবিহা বলল,’ আমি দুঃখিত। ‘
এবার সোজা হয়ে বসল শান্ত। মেয়েটার চোখে মুখে অনুশোচনা দেখে সে নিশ্চিত এই মেয়েই বলেছে। কিন্তু প্রথম থেকে যে চাপা রাগ ছিল তা এখন কাজ করছে না। ভাল লাগছে। দুঃখিত, স্যরি এসব শব্দ কি খুব উঁচু মানের? শুনলেই মন ভাল হয়ে যায় টাইপের? হয় তো। শান্ত মনে মনে ঠিক করে যে ব্যাগ সে গুঁছিয়ে ছিল চলে যাওয়ার জন্য তা আবার খুলবে। ফাবিহা মুচকি হেসে বলল,’ আমার নানু একটু রাগী। মন থেকে কিন্তু খুব ভাল। ‘
তাচ্ছিল্যের সুরে শান্ত বলল,’ কেমন ভাল দেখা হয়ে গেছে।’
ফাবিহা পাশের জায়গাটায় হুট করেই বসে পড়ে। অবাক হয় শান্ত। অবাকের আরও এক ধাপ উপরে তুলে ফাবিহা পা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল,’ ভালই উনি। কিন্তু একটু রাগী। নীহু বলে রাগী মানুষের মন সবচেয়ে ভাল। মিতু আপু বলে রাগী মানুষ হয় সহজ সরল। বোকা ধাঁচের। আর আমি বলি রাগী মানুষের মন নরম। ‘
কৌতুহলী হয়ে শান্ত বলল,’ কিভাবে? ‘
‘ কারণ এরা এদের সব খারাপ লাগা রাগের মাঝেই ঢেলে দেয়। মনে কিছু জমিয়ে রাখে না। মন পরিষ্কার থাকে। ‘
‘ আপনি বলতে চাইছেন আপনার নানু খুব ভাল? ‘
‘ শতভাগ নিশ্চিত। শুধু রাগ বেশি। ‘
‘ হুম অনেক বেশি। আমাকে যখন পান চিবিয়ে চিবিয়ে বলছিল খুবই গায়ে লেগেছিল। ‘
ফাবিহা ঘুরে মুখ বরাবর তাকায়। শান্তও তাকায়।খুব উৎসাহি কন্ঠে ফাবিহা বলল,’ একটা মজার কাহিনী শুনাই। শুনবেন? ‘
শান্ত খুব মনযোগী হয়ে উঠে বলল,’ বলুন বলুন। ‘
‘ আমরা যখন তিন বোন পুকুরে গোসল করি তখন অনেক সময় পুকুরে থাকি। প্রায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ছোট থেকেই। অনেক ছোট বেলার ঘটনা এটা। নানু একদিন খুব রেগে ছিল। আমরা পুকুর থেকে উঠছিলাম না দেখে নানু মিতু আপুর ঘাড় ধরে তাকে পানিতে ডুবিয়ে ধরে। ‘
আঁৎকে উঠে শান্ত মৃদূ শব্দ করে বলল,’ হায় আল্লাহ এত ডেঞ্জারাস এই মহিলা। ‘
‘ খুব। তারপর নানু অনেক সময় পরে ছেড়ে দেয়। আর দ্রুত উঠে আসতে বলে। আমি আর নীহু অনেক দূরে ছিলাম। তিনি আমাদের ধরতে পারেনি। কিন্তু আপু তখন সাবান মাখবে বলে ঘাটে এসেছিল। বেচারী আপু সব সময় ফাঁসে। ‘
ফাবিহা খিলখিল শব্দ তুলে হাসতে শুরু করল। হাসির তালে সে দুলছে। পিছনে হেলে পড়ছে তো কখনো সোজা হয়ে বসছে। মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ও সে হাসছে। শান্তর চোখ জোড়া অশান্ত হয়ে উঠে। জ্বলজ্বল সূর্য কিরণের মত সে তাকিয়ে থাকে। ফাবিহার গালের দুপাশের ছোট ছোট চুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ছে। মাথায় বড় করে ওড়না দেওয়া।
‘ নানু চলে যেতেই আমি আর নীহু দ্রুত আপু কাছে এসে জিজ্ঞেস করি, আপু তোর শ্বাস চলছে তো? ‘ আপু তখন পাগলের মত হেসে কি বলেছিল জানেন? ‘
আনমনেই শান্ত আওড়াল,’ না বললে জানব কিভাবে? ‘
‘ আপু হেসে বলল, শুন আমি কিন্তু একটুও পানি খাইনি। আল্লাহ বাঁচাইছে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম আপুর নাক লাল চোখ লাল হয়ে ছিল। কাশিও হচ্ছিল।’
হাসার মত অতিরঞ্জিত কিছুই খুঁজে পেলনা শান্ত। অথচ মেয়েটা কি অট্টহাসিটাই না হাসছে। মেয়েরা কারণে অকারণে হাসে কথাটা সত্য। কিন্তু এই হাসি দেখার মাঝে যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করে তা এর আগে কখনো অনুভূতি দিয়ে অনুভব করেনি শান্ত। মনে মনে সে উচ্চারণ করে উঠে, মেয়েদের হাসি বুঝি এত সুন্দর হয়! ওহ এত হাসছে কেন ? মুখ দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি আর হাসবেন না। শুনে আমার কেমন ঠান্ডা লাগছে। হাসি শুনলে কি ঠান্ডা লাগে? শান্তু আশ্চর্য রকমের চমকে উঠে। পিছনে এসে পিঠে একটা চাপড় মারতেই তার হুশ ফিরে আসে। পিছনে তাকাতেই অর্পন বলল,’ কি দেখছিস একা একা। ‘
শান্ত চোখ দ্রুত সামনে নিয়ে দেখল ফাবিহা নেই। চোখের সামনেই তো বসে ছিল। এখনই গায়েব হয়ে গেল? এত কম সময়ে? কিভাবে?
____________________
মিতু আপু খুব বিপদে রয়েছে। কাজ করতে তার একদম ভাল লাগে না। সে সব সময় শুয়ে বসে জীবন শেষ করতে চায়। নিঃসন্দেহে অলসের মা বলা চলে তাকে। তার বেশির ভাগ কাজ করে দেয় ফাবিহা। কিন্তু আজ এই ফাবিহা এবং নীহারিকা গায়েব হয়ে গিয়েছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে মিতু আপু ফুলের ঝুঁড়ি নিয়ে একটা রুমে রাখে। এ নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে তাকে। আরও না কি করতে হবে। দিন কাল সব খারাপ হচ্ছে দিন দিন। বাহিরে আসতেই মিতু আপু ঠিক করলেন আর বড়দের আশেপাশে হাঁটবেন না। সুযোগ পেলেই কাজ ধরিয়ে দেয় হাতে। উঠানের যে দোলনা আছে সেখানে বসে পরে তিনি। দোল খেতে খেতে হঠাৎ পুরানো একটা কথা মনে পড়ে গেল তার,
দিনটি ছিল রবিবার। মিতু আপু তখন অষ্টমের ছাত্রী। স্কুলটায় যেতে হয় দীঘির পাড় ঘেঁষে। মিতু আপু সবুজ সেলোয়ার কামিজ পড়ে দুই বেনুনি দুই পাশে বেঁধে হাঁটতে শুরু করলেন। বাবা বিদেশে থাকেন। ফলে মা বেশির ভাগ সময় থাকে বাপের বাড়ি। তাদের ভর্তিও করিয়ে দেওয়া হয় নানুর বাড়িতে। লেখাপড়া তারা ছোট থেকে এখানেই করে। দাদুর বাড়ি হয়ে উঠে তাদের বেড়ানোর জায়গা। বাই সাইকেলের কিরিং কিরিং শব্দ তুলে কেউ পিছনে এসে থামতেই চমকে উঠে মিতু আপু। ভয় পেয়ে পিছনে তাকাতেই সে বুকে থু থু ছিড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটা খুব হাস্যকর ঠেকল শাহিন ভাইয়ের। তিনি নাকটা ছিঁটকে বললেন,’ মাতাল তুই এহনও ভয় পাস? বাচ্ছাগো মতন ?’
মিতু আপু ঠিক বুঝলেন মজা নিচ্ছে। রাগে কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি খুবই দ্রুত হাঁটা শুরু করলেন। শাহিন ভাইও কম না। সাইকেল দ্রুত চালিয়ে সমানে এসে বললেন,’ তুই না কি জাতির আপু? ‘
মিতু আপু সাথে সাথে রেগে বললেন,’ কে কইছে?’
‘ আমি মাত্র সুমিদের কাছ থেইক্কা শুইন্না আসলাম। বড় ছোট সবাই তোরে মিতু আপু ডাকে। কারণ কইবি? ‘
‘ না কমু না। যান ভাগেন। ‘
মিতু আপু আবার হাঁটা শুরু করল। শাহিন ভাই এবার একে বাড়ে সামনে পথ আঁকড়ে ধরে দু পা ফেলে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ রাইগ্গা যাইতাছস ক্যান? কথা কইলে কি জাত যাইব ? এক দিকেই তো যামু। কথা কইতে কইতে যাই চল।’
‘ না আমি আপনার লগে ধুক্কু সাথে যামু না। ‘
‘ ওই আরও একটা কাহিনী হুনলাম তুই না কি শুদ্ধ ভাষা শিখতাছস? সত্য নি? ‘
মিতু আপু এবার ভারী লজ্জা পেলেন। গাল হয়ে উঠল টকটকে লালাভ বর্ণের। শাহিন ভাই বার বার সাইকেলের বেল বাজাতে শুরু করলেন। আর মৃদূ হাসতে শুরু করলেন। মিতু আপু যে শুধু তার জন্য শুদ্ধ ভাষা শিখছে এটা কি ধরে ফেলেছে উনি? লজ্জা আরও জেকে বসে। শাহিন ভাই খুব সুন্দর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। যা এই গ্রামের বাকিরা হা হয়ে শুনে। সবার সাথে খুব সুন্দর করে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন তিনি। শুধু মিতু আপুর সাথে কথা বলেন খাঁটি গাঁইয়া ভাষায়। ব্যাপারটা অপমান জনক মনে হতেই মিতু আপু ঠিক করে ফেললেন নীহারিকার কাছ থেকে শুদ্ধ শিখে নিবেন। যেহেতু সে থাকেই শহরে। খুব সুন্দর ভাঁজে ভাঁজে শুদ্ধ বলে। শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। শাহিন ভাই ধরে না ফেললেই হয়। হাস্যউজ্জ্বল কন্ঠে শাহিন ভাই বলল,’ ওই কথা কস না ক্যান? কোন দুনিয়ায় তলাই গেলি। ‘
‘ আপনার সামনেই আছি। ‘
মুখটা বাঁকিয়ে বলল মিতু আপু।
‘ আরে বাচ তুই তো পুরাই শুদ্ধ শিক্ষা হালাইছস রে মাতাল। ‘
মনে মনে খুব অহংকার বোধ হলো মিতু আপুর। পাত্তা না দিয়ে তিনি চলে যেতে নেয়। শাহিন ভাই পথের সামনে হাত রেখে বলল,’ আইজগা না তোর জন্ম দিন? ‘
চমকে উঠে তাকায় মিতু আপু। বাড়ির সবাই তার জন্মদিন ভুলে গিয়েছে। এমন কি নীহুও। অথচ শাহিন ভাই জানল কিভাবে? চমকে যাওয়া কন্ঠে সে বলল,’ আপনি জানলেন কেমনে?’
চমৎকার করে শাহিন ভাই হেসে উঠে বললেন,’ আরে এইডা কোন বড় ব্যাপার হইলো। তোর জন্মদিন বাইর করা এই শাহিনের বাম হাতের কাম। ‘
কথাটা শেষ করেই কলেজ ব্যাগ থেকে তিনি কি কি যেন বের করে মিতু আপুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। খুব তাড়া দিয়ে বললেন,’ নে এইডা আমার সামনে পড় তো। ‘
মিতু আপু নিতেই চাইলেন না। শাহিন ভাই জোর করে হাতে পড়িয়ে দিলেন কাঁচের রিমিঝিমি চুড়ি। তারপর মুঠো ভর্তি চুড়ি মিতু আপুর জামার সামনের লম্বা ওড়না টেনে তাতে রেখে দিয়ে বললেন,’ যা বাড়ি যা। আইজগা তোর ছুটি। ’
‘ আপনি ছুটি দিচ্ছেন কেন? সেটা তো স্কুলের স্যারেরা দেয়। ‘
‘ আমি মুজাম্মেল স্যারের লগে কথা কইয়াই তোরে ছুটি দিছি। স্যারের মাইয়ারে আমি পড়াই ভুল্লা গেলি? ‘
মহা আনন্দে মিতু আপু বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। শাহিন ভাইকে খুব অপছন্দ ছিল কিছু ঘন্টা আগেও। এখন অনেক ভাল লাগছে তার। অপছন্দের কারণ গ্রামের সব বড় ছোট ছেলেদের তিনি খুবই রাগ দেখিয়ে বলেদিলেন কেউ যদি তাকে মিতু বলে ডাকে বা মিতুয়া বলে ডাকে পা ভেঙ্গে দিবে সবার। ভয়ে সবাই মিতুকে আপু ডাকা শুরু করে। মেয়ে ছেলে ছোট বড় সবার কাছে মিতু থেকে মিতু আপু হয়ে উঠেন তিনি। জাতির মিতু আপু। কে শিখাল যখন জানতে পারে তখন থেকে শাহিন ভাই হচ্ছে জানের দুশমন। ঢুলে ঢুলে মিতু আপু হাঁটছিল। শাহিন ভাই বেনী ধরে টান মারতেই সে পিছিয়ে আসে। ঠোঁট উল্টে চেঁচিয়ে উঠেন মিতু আপু। শাহিন ভাই গদো গদো হেসে বললেন,’ শুন মিতুয়া বেশি বেশি সাজু গুজু করে ঘুরবি না। তাইলে জলদি জলদি তোর বিয়া হইয়া যাইব। ‘
মিতু আপু ভারী অবাক হয়ে পিছনে ফিরল। তীক্ষ্ন কন্ঠে জানতে চাইল,’ বিয়া হইলে হইব। তাই বলে সাজমু না?’
‘ না সাজবী না। এত সাজের কি আছে রে? সারা দিন দেখি রংঢং করে ঘুরিস। কাহিনী কি তোর মনে কি রং লাগছে? যে শুধু রং মাখবি মুখে? ‘
মিতু আপু শিশু বাচ্চার মত মুখ করে বলল,’ সাজলে আমারে খুব সুন্দর লাগে। সবাই কয়। তাই সাজি। ‘
শাহিন ভাই হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,’ তুই এমনই খুব সুন্দর রে মিতু। আমার ডর করে। ‘
‘ ডরের কি আছে? ‘ বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইল মিতু আপু। শাহিন ভাই সাইকেলে ভালো করে চেপে বলল,’আছে আছে। তোরে এহন কওয়া যাইবো না। তুই যা ভাগ। তা না হইলে দীঘিত চুবাইয়া সাজ উড়াইয়া দিমু।’
মিতু আপু মুখ বাঁকা করে বলল,’ আপনি তো শুদ্ধ ভাষা পারেন। আমার সাথে গাঁইয়া ভাষায় কথা বলেন কেন? ‘
সাইকেল ছুটিয়ে চলতে চলতে দূর থেকে তিনি উত্তর পাঠালেন,’ খুব কাছের মাইনষের লগে নিজের ভাষায় কথা কওনের আনন্দই আলাদা। তুই বুঝবি না। মাথা মোটা একটা। বাড়িত যা। তা না হইলে চোবড়ামু কইয়া দিলাম। ‘
শাহিন ভাই বিদায় হলেও তার কথাটা কেমন যেন গালের সাথেই লেগে গেল। বাসায় এসে মিতু আপু কড়া একটা চড় খেয়ে বসল। কারণ স্কুল মিস করা। অন্যদিকে সে যত বলছিল ছুটি দিয়েছে বিশ্বাসই করল না কেউ। রাতে যখন কেঁদে কেঁটে ঘুমাতে গেল তখন তার বালিশের নিচে নীহারিকার চিঠি পাওয়া গেল। তাতে গোটা গোটা সুন্দর অক্ষরে লেখা,’ মিতু আপু, তুই ভালো আছিস? শুন আজ তো তোর জন্মদিন আমি জানতাম। তাই আগে থেকে নানুর কাছে চিঠি রেখে গেলাম। কারণ আমি জানি পরের শীত ছাড়া দেখা হবে না। তোর জন্মদিনটা এমন বাজে দিনে কেন বলবি আপু? সত্যি অসহ্য একটি দিন। কারণ বৃষ্টি আমার পছন্দ না। তুই জন্মালি বৃষ্টির দিনে। আমার এত প্রিয় আপু কি না আমার সবচেয়ে অপ্রিয় বৃষ্টিতে এসে হাজির হলো? শুধু তুই একা না, বাবার জন্মদিনও বৃষ্টিতে। আপু তুই তো জানিস আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি বাবাকে। কাউকে বলিস না কিন্তু। ফাবিহাকেও না। ও শুনলে যদি মাকে বলে দেয়। আমার খুব লজ্জা করে। বাবাকে আমি ভয়ও পাই। কিন্তু তুই তো জানিস কত্ত ভালোবাসি। প্রিয়মটারও জন্মদিন বর্ষাকালে। ছিঃ। কি বিষন্ন দিন কাল। আমার বরাবরই বিরক্ত লাগে। আচ্ছা আপু জন্মদিন কি পরিবর্তন করা যায় না? তাহলে তোর, বাবার আর প্রিয়মের জন্মদিন আমি পরিবর্তন করে শীতে নিয়ে আসতাম। আমার জন্মদিনের আশেপাশেই রাখতাম তোকে। শুন আপু তোর জন্য যেই উপহার গুলো দিয়েছি ওগুলো ফাবিহাকে দেখাবিনা বলে দিলাম। ও সব নিয়ে যাবে। মাকেও বলে দিতে পারে। জমানো টাকার উপহার তো বেশি কিছু দিতে পারিনি। আচ্ছা শুন কি যেন লিখতে চেয়েছিলাম এখন ভুলে গিয়েছি । যখন মনে পড়বে আবার লিখব। আপু বৃষ্টিতে ভিজবি না একদম। আমার অপছন্দের জিনিস গুলো থেকে আমি চাই আমার প্রিয় মানুষ গুলো দূরে থাকুক। কিন্তু খুবই দুঃখের কথা হচ্ছে আমার জীবনের প্রিয় মানুষ গুলোই আসে অপছন্দের সময়টার আঙ্গুল ধরে। এখন খুব মন খারাপ করছে রে আপু। প্রতি বছর তিনটা দিন আমার খুব মন খারাপ থাকে। আজ তার মাঝে একদিন। আর লিখব না। যা তুই বের হতো চিঠি থেকে। আরে বের হতে বললাম না যা বের হ। তা না হলে উষ্ঠা দিয়ে বের করে দিব।’
ইতি তোর নীহুপরী..’
মিতু আপু প্রথমে খুব হাসলেন। মেয়েটা এত বাচ্চা বাচ্চা কথা বলত ছোট বেলায় কথা গুলোই গিলে খেতে ইচ্ছে করত। ইশ বাবু একটা। কিন্তু হঠাৎ তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এত কথা লিখল অথচ বললই না শুভ জন্মদিন আপু। পরক্ষণেই মনে পড়ে নীহু তো কখনো তাকে এটা বলেই না। জন্মের দিনটাকে সে খুব একটা শুভ মনে করে না। ছোট বেলায় খুব চঞ্চল আর বকবক স্বাভাবের মেয়েছিল নীহু। সময়ের সাথে সাথে কেমন চুপচাপ আর রাগী হয়ে উঠেছে। এখন খুব রেগে যায় কথায় কথায়। ক্ষেপা নীহু। সেবার উপহারে নীহু দিল পুতুল, অনেক গুলো সাজের জিনিস। আর দিল একজোড়া কানের দুল।যা মিতু আপুর কাছে এখনও আছে। খুব প্রিয় সেই দুল। মিতু আপুর সেদিন এত মন খারাপ ছিল যে সে নীহারিকার উপহারে হাত রাখে কয়েকদিন পরে। শাহিন ভাইয়ার উপরে রাগ করে কয়েকটা চুড়ি ভেঙ্গে ফেলেন। কারণ তিনি কেন বন্ধের লোভ দেখিয়ে চড় খাইয়েছেন। রাগ অভিমান ভাঙ্গে চুড়ির উপরে। মিতু আপুর সব রাগ চুড়ির উপরে। আহা চুড়ি!
‘ মিতু তুমি কি জানো নীহারিকা কোথায়? ‘
হঠাৎ কথা কানে যেতেই মিতু আপু হালকা কেঁপে উঠলেন। অতীত কত মধুর হয়। ভাবতেই তিনি আবার ডুবে যেতে চাইলেন অতীতে। কিন্তু জাওয়াদ দিল না। সে খুবই উত্তেজিত ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করে চলেছে। নীহারিকার জন্য কি এই ছেলে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে? যারা অতিমাত্রায় পাগলামি করে তাদের মিতু আপু সহ্য করতে পারে না। দু পা পিছনে নিয়ে উঁচুতে উঠে ছেড়ে দিলেন পা জোড়া।হাওয়ার উপরে উঠে পড়েন তিনি।দোলনার মুক্ত বাতাসে দোল খেতে খেতে বললেন,’ নীহারিকাকে দিয়ে আপনার কাজ কি? ‘
জাওয়াদ ফোন দেখিয়ে বলল,’ অনেক বার কল করছি ফোন বন্ধ আছে। কোথায় সে? সকাল থেকে দেখছি না। ‘
‘ আছে হয় তো কোথাও। নীহুর ফোন ব্যবহারের গুণটা খুবই কম। সে কোথায় থাকে ফোন কোথায় থাকে বলা যায় না। ‘
‘ সে আমার সাথে কথা বলেছে।’
‘ তাহলে মুরগীর ছাঁয়ের মত কুককুক করছেন কেন? জান আয়েশ করুন। ‘
জাওয়াদ মুখটা বিকৃত করে বলল,’ এভাবে কথা বলছ কেন? ‘
‘ কিভাবে বলছি? ‘ মিতু আপু দোলনা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে। ‘ তীর্যক চোখে চেয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। এত সুদর্শন পুরুষ বাংলাদেশে আছে? অথচ এ নীহুর পিছনে হাত পা ধূয়ে পড়ে আছে। বেচারা নিজের সৌন্দর্য্যেরও মূল্য রাখছে না। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সে নিজের মূল্য রাখতে জানে না। যে নিজের মূল্য রাখতে ব্যর্থ হয় তার বাকি জীবন ব্যর্থতার সাথেই ব্যতীত হয়। চুলের লম্বা বেনি গুলোর একটি বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুড়িয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে মিতু আপু বলল, ‘ আপনি কিন্তু অনেক সুন্দর ভাইয়া। নীহুর পিছনে না ঘুরে অন্য মেয়ে পটান। যেমন বিয়েতে অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আসবে। কাল থেকেই। এক রাত অপেক্ষা করুন। ‘
জাওয়াদ ঝনঝন করে রেগে গেল। তার নাকটা লাল হয়ে ভেসে উঠল। মিতু আপু বিস্মিত। রাগার মত কি কিছু বলেছেন তিনি? না মনে হচ্ছে না। জাওয়াদ চোখ রক্তলাল করে বলল, ‘ ফালতু কথা ছাড়া তোমার আর কাজ নেই? প্রশ্ন করেছি একটা বলছ অন্যসব কিন্তু উত্তর দিচ্ছ না। ‘
‘ উত্তর তো আমি নিজেই জানি না। শুধু সাবধান করছি। নীহু খুবই বিরক্ত হয়। যদি কেউ তার পিছনে ঘুরঘুর করে। ‘
‘ আমি তার পিছনে ঘুরছি না। ‘
‘ ঘুরেও লাভ নেই। ‘
মিতু আপু চুল ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পিছন থেকে তীব্র কন্ঠে জাওয়াত জানতে চায়, ‘ কেন লাভ নেই? ‘
‘ বাপের পছন্দের ছেলেগুলোকে মেয়েরা কম পছন্দ করে। ‘
মাথা পিছনে ফিরিয়ে কথাটা বলল মিতু আপু। বড় বড় পা ফেলে হেলে দুলে হেঁটে চলে গেল গোয়াল ঘরে। নানুর তিনটে গরু আছে। এদের মাঝে বর্ষাকে মিতু আপুর খুব পছন্দ আর নীহারিকার সবচেয়ে অপছন্দ। তার কারণ নাম কেন বর্ষা রেখেছে। কিন্তু এদানিং নীহারিকার কাজে কর্মে মিতু আপু দারুন অবাক হয়েছেন। বর্ষাকে হঠাৎ নীহারিকা খুব যত্ন করেছে। ঘাস খাইয়েছে। কাহিনী কি? বর্ষার প্রেমে পড়ল না কি? আবার প্রেম? মিতু আপু চোয়াল শক্ত করে উল্টো পথে ঘরের দিকে চলে এল। জাওয়াত তখন ফোনে ব্যস্ত। এত সুন্দর ছেলে ইশ তার উপরে ডাক্তার। নীহুকে বলতে হবে ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে। নিজের জন্য নয় নীহুর জন্যেই। ঠোঁট কামড়ে হাসলেন তিনি।
_____________________
অনেক খুঁজে তাযিন শাহিন ভাইয়ের বাড়ি খুঁজে বের করল। নীহারিকার পা ব্যথাময় হয়ে উঠেছে। মেজাজ হয়ে রয়েছে তিক্ত, বিরক্ত। শুধু মিতু আপুর জন্য। তা না হলে এত কষ্ট সে করতই না। শাহিন শাহিন করে খুঁজছিল। কিন্তু নীহারিকা কি জানত না কি মাঝি পাড়ার সবাই শাহিন ভাই বলে ডাকে? ও পাড়ায় জাতির মিতু আপু আর এই পাড়ায় জাতির ভাই শাহিন ভাই। ভাবা যায়! গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। এই মুহূর্তে পানির প্রয়োজন। একদীঘি পানি সে নিমিষে খেয়ে শেষ করতে পারবে বলে তার ধারণা। এক বাড়িতে এসেই নীহারিকা নির্লজ্জের মত পানি চেয়ে বসল। পানি খাওয়ার সময় লক্ষ করল তাযিন ড্যাবড্যাব করে তাকে দেখছে। কপালের উপরে ভাজ ফেলে সে তাকিয়ে আছে। নীহারিকা গ্লাস রেখে বলল,’ তাকিয়ে আছেন কেন? ‘
মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিল তাযিন। নীহারিকা ভ্রু নাচিয়ে আবার একুই প্রশ্ন করতেই সে হকচকিয়ে গেল। কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,’ এমন ভাবে পানি খাচ্ছিলেন মনে হচ্ছে কতবছর খাওয়া হয়নি। ‘
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ সত্যি মনে হচ্ছিল কত বছর খাইনি। আপনি খাবেন? ‘
‘ আপনার আধখাওয়া পানি আমি খাব? ‘ তাযিন বিভ্রান্ত হলো। কিন্তু নীহারিকার চোখে তা ধরা পড়ল না। সে পানি রেখে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে চলতে চলতে বলল,’ ওই তো শাহিন ভাইয়ের বাড়ি। ‘
‘ শাহিন ছেলেটা মাঝি? ‘
‘ আরে না।উনারা তো এই পাড়ার নামিদামি মানুষ। ঘরে ঢুকতে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। ‘
সত্যি সত্যি অনুমতির প্রয়োজন পড়ল। তাযিন যথেষ্ট স্বাভাবিক ভাবে বুঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীহারিকা পাশে থাকায় তাদের ডুকতে দেওয়া হলো না। তারা বাহিরে অপেক্ষা করবে ভেবেছিল কিন্তু শাহিন ভাইয়ের মা বেরিয়ে আসল। দামি অলংকারে তিনি প্রায় ডুবে আছেন। হঠাৎ বড় লোকের লক্ষণ। যতটা না আছে তার চেয়েও বেশি এরা দেখাতে পছন্দ করে। নীহারিকার দিকে ডাকু চোখে তাকিয়ে গলা ফাঁটিয়ে তিনি বললেন,’ ওই মাইয়া তুই ওই মিতুর খালাত বইন না? ‘
নীহারিকা ভয়ের চোটে পিছিয়ে গেল। ঝাঁঝাল গলায় তিনি আবার বলে উঠলেন, ‘ তোর এত বড় সাহস আমার বাড়িত আইছস? ‘
এবার তিনি প্রায় তেড়ে তেড়ে আসতে শুরু করেন। ভয়ে নীহারিকা তাযিনের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। খাঁমছে ধরে তাযিনের টি-শার্টের পিছনের অংশ। চোখ বুঝে নিয়ে দ্রুত বলে উঠে, ‘ দ্রুত চলুন প্লিজ এই মহিলা মানুষকে উড়াধুনা মারে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। প্লিজ চলুন।’
‘ কি কইলি মাইয়া খাড়া তুই? ‘ হন্তদন্ত হয়ে তিনি কিছু খুঁজতে শুরু করে। তাযিনের শরীর হাওয়ার বেগে শীতল হয়ে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে শরীরে নতুন করে কোন স্পর্শ বাসা বাঁধে। যে স্পর্শের নাম নীহারিকা! তাযিন বুকের পাশে হাত রাখে। তার বুক খুব শব্দ করছে। অস্থির হয়ে উঠছে। সব ঠিক করতে এসে সে গোলমেলে করে দিচ্ছি। দূরত্বে থাকতে চেয়ে আরো কাছে চলে আসছে। হচ্ছে টা কি? তাযিন চুল পিছনে টেনে ধরে। অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে যাচ্ছে শরীর। তার মন ভাঙ্গছে। সে অনুভব করছে। ভেঙ্গে গুড়োগুড়ো হয়ে নতুন মনের সৃষ্টি হচ্ছে। জীবনের দ্বিতীয় বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে। এই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসে। সে তো ইচ্ছে করেই নিয়ে এসেছে। ভুল গুলো সে ইচ্ছে করেই করছে। দোষ গুলোকে ভুল বলে চালিয়ে দিচ্ছে! ওহ বিমুগ্ধ তুমি কি করছ? নিজেকে শুধরে নেও। সামলে উঠে দাঁড়াও। ‘
শাহিন ভাইয়ের মা একটা বিশাল লাঠি নিয়ে হাজির। এই ডাকু মহিলার ক্ষপ্পড়ে পড়ে নীহারিকা ভয়ে কাঁপছে। শরীর মিশে যাচ্ছে প্রায় তাযিনের সাথে। চোখ বড় বড় হয়ে আসছে। ঘামতে শুরু করেছে। তাযিনকে ঠেলে সে। বার বার বলছে যেতে। তাযিন তখনো অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। তার কোন হেল দুল নেই। এত কি ভাবছে? বাড়িটা ভয়ংকর ভাবে এসে পড়ে কিন্তু নীহারিকার গায়ে পড়ার আগেই তাযিন হাত দিয়ে ধরে। শান্ত শীতল কন্ঠে বলে,’ আপনি আমার পিঠ ছাড়ুন।’
নীহারিকা লজ্জিত হয়ে দ্রুত পিঠ ছেড়ে দেয়। মনে মনে নিজেকে কিছু খারাপ বাক্য শুনিয়ে দেয়। শাহিন ভাই এসে হাজির। নীহারিকাকে দেখেই তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। যেন কখনো কল্পনাই করেননি নীহারিকা আসবে। খুশিতে আনন্দে তার চোখে পানি চলে আসে। আত্নহারা কন্ঠে তিনি বলে উঠে, ‘ নীহু যে। মিতুয়া পাঠিয়েছে তোকে? ‘
নীহারিকা হাপিয়ে উঠা গলায় বলল,’ ভাইয়া আগে আপনার মাকে বলুন লাঠি চার্জ বন্ধ করতে।’
শাহিন ভাই উপরে তাকিয়ে সত্যি হতভম্ব হয়ে রইলেন। মায়ের কাছ থেকে এটা আশা করেননি বোধ হয়। শাহিন ভাই বেশ চড়া রেগে বললেন,’ আম্মা ঘরে যান। তা না হইলে আমি এহনি বাড়ি ছাড়মু।’
এই কথায় যে কত তেজ থাকে নীহারিকা যানে। বাড়ি ছাড়ার নাম নিলেই সব শান্ত। মহিলা গজগজ করে রেগে যেতে যেতে বললেন,’ আমার পোলার মাথা খাওয়া দেখামু কইয়া দিলাম। বেয়াদ্দপ মাইয়া হগল।’
তাযিন আগে বলল,’ আমি তাযিন। মিতুয়ার বড় খালামনির ছেলে।’
শাহিন ভাইয়া সাবধানি চোখে চারপাশে তাকিয়ে বলল,’ কিছু মনে করবেন না আমরা দীঘির পাড়েই চলে যাই। এখানে থাকলে আবার কেউ না কেউ খারাপ ব্যবহার করবে। আমি দুঃখিত।’
রাজি হলো দু’জনেই।
দীঘির পাড়ে কালো ছায়া। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে গেছে। শেষ আলো লোপ পাচ্ছে। শাহিন ভাই প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন, ’ নীহু তুই এখানে কি করছিস? মা যদি মারত তোকে? আসতে গেলি কেন? ‘
নীহারিকা মৃদু হেসে ওড়না উড়িয়ে দিয়ে ঠিক করে পড়ে নিয়ে বলল,’ আরে মারা এত সহজ না কি? আমি তো বডিগার্ড নিয়ে এসেছি।’
সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে শাহিন ভাইয়া জানতে চাইল,’ কই বডিগার্ড? আমি তো দেখছি না। ‘
নীহারিকা তাযিনের দিকে মুখ করে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’ এই যে আমার বডিগার্ড।’
তাযিন চোখ বাঁকিয়ে তাকায়। স্থির তার চতুর চক্ষুজোড়া। শান্ত ম্লান বাতাস বইছে। লাল রক্তাক্ত আভা ছড়িয়ে দিয়ে দিনের প্রদীপ নিভছে। সেই নিভু নিভু প্রদীপের আলোতে মিষ্টি হাসির রেশ লেগে আছে নীহারিকার পাতলা ঠোঁটজোড়ায়। কাউকে বডিগার্ড বানিয়ে এত আনন্দ হয় আগে জানা ছিল না তার। তাযিন শীতল বরফের নেয় চক্ষুজোড়া দিয়ে চেয়েই রইল। হাসির তালে বাতাসে দুলছে শরীরের বস্ত্র। মিষ্টি হাসিটি তাকে বার বার পিছলে ফেলে দিচ্ছে। বরফ নেয় তাকে গলিয়ে দিচ্ছে। সৌন্দর্যের বাহার বাড়িয়ে দিয়েছে দীঘির। মেয়েটা কি সত্যি এত স্পেশাল? তার জন্য?
________________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..